8.3 C
New York
Friday, October 24, 2025

Buy now

spot_img
Home Blog Page 24

হারিয়ে যাওয়া কুতুবখানা

সংবাদ ছড়িয়ে পড়লো রায় থেকে সমরকন্দ। হায় হায় করে উঠলো সবাই। রেশম পথের ধারে সরাইখানাগুলোতে পরিব্রাজক দলের মুখরোচক আড্ডায় বারবার ঘুরে ফিরে আসলো কথাটা । প্রথমে কেউ কেউ অবিশ্বাস করলেও জানা গেলো সংবাদটা আসলেই সত্যি । আগুন লেগেছে বাগদাদের জামিয়া নিজামিয়ার কুতুবখানায় । অবশ্য খুব বেশি ক্ষয়ক্ষতির আগেই বেশিরভাগ বই সরিয়ে নেয়া সম্ভব হয়। সময়কাল ৫১০ হিজরী । ইবনে আসীর ৫১০ হিজরীর ঘটনাবলীতে এই অগ্নিকান্ডের কথা উল্লেখ করেছেন।

সব কুতুবখানার ভাগ্য এতটা সুপ্রসন্ন হয় নি । বসরার দারুল কুতুবের কথাই ধরা যাক। ৪৮৩ হিজরীতে আগুন লেগে পুড়ে গেলো এই কুতুবখানা । ৫৫৬ হিজরীতে নিশাপুরে আভ্যন্তরীন গোলযোগে পুড়ে গেলো ১২ টি কুতুবখানা । ৫৬৭ হিজরীতে আইয়ুবীরা মিসরে প্রবেশ করার পর ফাতেমীদের কুতুবখানার এক বিরাট অংশ আগুনে পোড়ানো হয়, নীলনদে ডুবানো হয়। ৫৪৮ হিজরীতে সুলতান মাহমুদ বিন সুবক্তগীন যখন রায় শহর অধিকার করেন তখন পোড়ানো হয় রাফেজীদের বইপত্র।

কায়রোর বিখ্যাত বাইতুল ইলমের অবস্থা আরো ভয়াবহ। ১০০৪ খ্রিস্টাব্দে এটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন হাকেম বি আমরিল্লাহ । মাত্র ৬৪ বছর পরে ১০৬৮ খ্রিস্টাব্দে কায়রোর উযির আবুল ফারাজ সেই কুতুবখানায় এলেন ২৫ টি উট নিয়ে । ২৫ উট ভর্তি বইপত্র নিয়ে এক লাখ দিনারে বিক্রি করে দেন। সেই টাকায় সেনাবাহিনীর বেতনভাতা পরিশোধ করেন। কয়েক মাস পর তুর্কীরা বিজয় লাভ করে কায়রো প্রবেশ করে। পুড়িয়ে ফেলে বাইতুল ইলমের বইপত্র। কেউ কেউ আবার ব্যস্ত ছিল বইয়ের বাধাই খুলে সুতা তৈরীতে ।
মধ্য এশিয়ার কুতুবখানাগুলো ধংস করে তাতারীরা। কী পরিমান কুতুবখানা ছিল মধ্য এশিয়ায় তা ইয়াকুত হামাভীর বিবরণ থেকে ধারণা করা যায় । হিজরী ষষ্ঠ শতাব্দীতে তিনি মার্ভ শহরে ভ্রমন করেন। সেখানে তখন ১২ টি কুতুবখানা ছিল। এগুলো ছিল সর্বসাধারনের জন্য উন্মুক্ত। একটি কুতুবখানায় তিনি ১২০০০ বই দেখেছেন।

গোবী থেকে ধেয়ে আসা তাতারী ঝড়ে বিপর্যস্ত হয় সোনালী গম্বুজের শহর সমরকন্দ । হারিয়ে যায় নিশাপুর , হেরাত ও বলখের কুতুবখানাগুলো। রায় এবং হামাদানের মধ্যবর্তী সাওয়াহ একটি ছোট শহর। এখানের কুতুবখানা ছিল খুবই প্রসিদ্ধ। ইয়াকুত হামাভী লিখেছেন তাতারীরা শহরে হামলা করে পাইকারী গনহত্যা চালায় এবং এই কুতুবখানা পুড়িয়ে ফেলে।

৬৫৬ হিজরীতে তাতারীদের হাতে বাগদাদের পতন হয় । ধংস হয় বাইতুল হিকমাহ । দজলার পানিতে ডুবানো হয় বই , কালো হয়ে যায় দজলার পানি । বাগদাদেও সেদিন পুড়ছে বই। তাতারীরা মাসউদ বেগের কুতুবখানা পুড়িয়েছে ৬১৭ হিজরীতে (১২২০ খ্রিস্টাব্দ), বোখারায়। পারস্যে খারেজম শাহের পাঠাগার ছিল সুপ্রসিদ্ধ।

চেংগিজ খানের তাতারী বাহিনী যখন পারস্যে প্রবেশ করলো তারা জনপদে নির্বিচারে হত্যাকান্ড চালায় । পুরো কুতুবখানা ধবংস করে দেয় । এটা ৬১৮ হিজরীর (১২২১ খ্রিস্টাব্দ) ঘটনা।তাতারীরা দামেশকের কুতুবখানায় আগুন ধরিয়ে দেয় ৭০০ হিজরীতে (১৩০০ খ্রিস্টাব্দ) ।

মাহমুদুদ্দৌলা ইবনে ফাতিক। একাদশ শতকের ফাতেমী যুবরাজ। বইয়ের প্রচন্ড নেশা ছিল। যুদ্ধের ময়দানেও বই নিয়ে যেতেন। যুদ্ধ থেকে ফিরে আবার বইয়ে ডুবে যেতেন। তার মৃত্যুর পর তার স্ত্রী একদিন স্বামীর পাঠাগার দেখতে এলেন । বইগুলো দেখেই তার রাগ উঠে যায়। দাসীদের আদেশ দিলেন সব বই হাউজে ফেলতে। তাই করা হলো। পরে একজন সামান্য কিছু বই উদ্ধার করেছিলেন।

কিতাব পোড়ানোর এই যজ্ঞে শামিল আছে ইউরোপিয়ান ক্রুসেডাররাও। ৫০৩ হিজরীতে তারা তরাবলিসের কুতুবখানা পুড়িয়ে ফেলে। ১১০৯ খ্রিস্টাব্দে ধংস করা হয় ত্রিপোলির কুতুবখানা । ক্রুসেডাররা যখন ধেয়ে আসে মুসলিম বিশ্বের দিকে তখন তারা ধবংস করে শহরের পর শহর। তাদের তান্ডবলীলায় পুড়েছে সাজানো জনপদ, পুড়েছে বই। তরাবলিস, কুদস, আসকালান ও অন্যান্য অঞ্চলে তারা যে পরিমান বই পুড়িয়েছে তার পরিমান ভাবলেও শিউরে উঠতে হয়।

ড মোস্তফা আস সিবাইয়ের মতে সেদিনের পৃথিবীতে ক্রুসেডারদের হাতে পুড়েছে ত্রিশ লক্ষ বই। স্পেন যখন আমাদের হাতছাড়া হলো, আমরা হারালাম আমাদের আন্দালুসকে, তখন গ্রানাডার ময়দানে একদিনেই পোড়ানো হয়েছে দশ লক্ষ বই। হালাবের বিখ্যাত খাজানাতুস সুফিয়াহ ধবংস হয় শিয়া সুন্নী দাংগায়। আশুরার দিনে সংঘটিত এই দাংগায় এই পাঠাগারের বেশিরভাগ বইই পুড়ে যায়। বার্বাররা যখন কর্ডোভা প্রবেশ করে তারা লুটপাট চালায় হাকেম মুস্তানসিরের পাঠাগারে। প্রচুর বইপত্র তারা বিক্রি করে দেয়। বাকিগুলো ধবংস করে।

কখনো আবার নিজেই পুড়িয়েছেন নিজের বই। উরওয়াহ ইবনে যুবাইর এমনই একজন। ৯১ হিজরী তথা ৭০৯ খ্রিস্টাব্দে ইন্তেকাল কারী এই তাবেয়ী নিজের সব বইপত্র পুড়িয়ে ফেলেন। কিতাব পোড়ানোর এই যজ্ঞে শরিক হয়েছেন আবু ওমর বিন আলা (মৃত্যু ১৫৪ হিজরী/৭৭০ খ্রিস্টাব্দ) । তার সম্পর্কে আবু উবাইদা জানাচ্ছেন, আবু ওমর অন্যদের চেয়ে আইয়ামে আরব ও কবিতায় অধিক জ্ঞান রাখতেন। তার বইয়ের সংগ্রহ ঘরের ছাদ ছুয়েছিল। এরপর তিনি যুহদের পথ অবলম্বন করেন এবং নিজের বইপত্র পুড়ে ফেলেন।

কখনো কখনো কিতাব পুড়েছে দুর্ঘটনায়। মিসরের কাজী আব্দুল্লাহ বিন লাহিমার গৃহে আগুন লেগে তার সব বইপত্র পুড়ে যায়। ৫১০ হিজরীতে আগুন ধরে জামিয়া নিজামিয়ার কুতুবখানায়। অবশ্য খুব বেশি ক্ষয়ক্ষতির আগেই আগুন নিয়ন্ত্রনে আনা সম্ভব হয়।
অনেকসময় বই নষ্ট করার পেছনে ছিল রমনীর হাত। একটু আগে বলা হয়েছে ফাতেমী যুবরাজ ইবনে ফাতিকের কথা। তার মতোই এমন ঘটনা ঘটে খলীল বিন আহমাদের জীবনে। তিনি একটি সুন্দরী দাসী ক্রয় করেছিলেন। দাসী তার উপর মনক্ষুন্ন ছিলো কারন খলিল সারাদিন কিতাবুল আইন পড়তেন। শীঘ্রই বইটি দাসীর চক্ষশূল হয়ে উঠে। একদিন সে বইটি পুড়িয়েই ফেলে। খলীল এ ঘটনায় অত্যন্ত মর্মাহত হন কারন তার কাছে বইটির আর কোনো কপি ছিল না।
বই পুড়েছে নানা কারনে । সময়টা তখন অস্থির। দফায় দফায় হচ্ছে ক্ষমতার পালাবদল। ক্ষমতার পালাবদল মানেই ইতিহাসেরও পালাবদল। নতুন ভাবে রচিত হচ্ছে ইতিহাস। কখনো কখনো শাসকরা পুরনো বইয়ে ঢুকিয়ে দিচ্ছে নিজেদের মনমত তথ্য। ক্ষমতার পালাবদলের সাথে উস্কে দেয়া হচ্ছে বংশীয় কিংবা আকিদাগত বিরোধ। সচেতন লেখকরা তাই চিন্তাশীল। মৃত্যুর পর লেখাগুলো অবিকৃত থাকবে তো ?? কারো কারো কাছে মনে হলো নিজের লেখা পুড়িয়ে ফেলা বেশ ভালো সমাধান। বিকৃতির পথ চিরতরে রুদ্ধ। এ পথেই হেটেছেন ইবনুল জাআবি (মৃত্যু ৩৫৫ হিজরী/৯৬৫ খ্রিস্টাব্দ)। নিজের হাতে পুড়িয়ে ফেলেছেন নিজের সব বইপত্র। ইমাম দারে কুতনি এ ঘটনার সময় তার পাশেই ছিলেন। তিনি প্রত্যক্ষদর্শী। সিরাফী (মৃত্যু ৩৮৫ হিজরী/৯৯৫ খ্রিস্টাব্দ) তার ছেলেকে অসিয়ত করেছেন তার বইগুলো পুড়িয়ে ফেলতে। আবু হাইয়ান তাওহিদি (মৃত্যু ৪০০ হিজরী) ধারনা করেছিলেন তার মৃত্যুর পর তার বইপত্রের মর্ম মানুষ বুঝবে না। তাই সমাধান খুজলেন বই পোড়ানোর পথেই।

৪৪৮ হিজরী তথা ১০৫৬ খ্রিস্টাব্দে বাগদাদে শিয়া সুন্নী দাংগায় পুড়ে যায় মুহাম্মদ আবু জাফর তুসির ব্যক্তিগত কুতুবখানা । শাসকের রোষানলেও পুড়েছে বই। ইবনে হাজম আন্দালুসির (মৃত্যু ৪৫৬ হিজরী /১০৬৩ খ্রিস্টাব্দ) বইপত্র পুড়িয়ে ফেলেছিলেন ইশবালিয়ার শাসনকর্তা মুতাজিদ বিন আব্বাদ। সুলতান মাহমুদ বিন সুবক্তগীন যখন রায় শহর দখল করলেন ৫৪৮ হিজরীতে তখন শহরের দারুল কুতুব পোড়ানো হলো। বেশিরভাগ ছিল ইলমে কালাম সম্পর্কে লিখিত বিদাতী ও রাফেজিদের বই। ৭৪৪ হিজরীতে (১৩৪৩ খ্রিস্টাব্দ) বাগদাদের মাদরাসা আসরুনিয়াতে ইবনুল আরাবির বইপত্র ছিড়ে ফেলা হয়, যার মধ্যে ছিল ফুসুসুল হিকাম বইটিও। ৭৭৩ হিজরীতে (১৩৭১ খ্রিস্টাব্দ) মোহাম্মদ বিন খতীবের বইপত্র পোড়ানো হয় আন্দালুসে।

দামেশকের জামে উমাভী। জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চার এক ঐতিহাসিক স্থান। দুবার আগুনে পুড়ে যায় জামে উমাভি। ধবংস হয় মূল্যবান অনেক বই। প্রথমবার আগুন লাগে ৪৬১ হিজরী/১০৬৮ খ্রিস্টাব্দে । পরেরবার ৭৪০ হিজরী/১৩৩৯ খ্রিস্টাব্দে। বাগদাদে সাবুর বিন আরদশীরের কুতুবখানা পুড়ে গেল ৪৫১ হিজরীতে (১০৫৯ খ্রিস্টাব্দ)। তার এই কুতুবখানায় ছিল অনেক দুষ্প্রাপ্য বই। ৪৮৩ হিজরীতে (১০৯০ খ্রিস্টাব্দ) পুড়ে গেল বসরার দারুল কুতুব। ইবনুল আসীর ও ইবনুল জাওযি দুজনেই বর্ননা দিয়েছেন এই অগ্নিকান্ডের। ৪৯৯ হিজরীতে (১১০৫ খ্রিস্টাব্দ) পুড়ে যায় কাজী আবুল ফারাজ বিন আবুল বাকার কুতুবখানা।


এটা পড়তে পারেন – সালাহুদ্দীন আইয়ুবী-সময়ের এক সাহসী বীর !


কাজী সাদিদুদ্দিন ইয়াহইয়া বিন সাঈদ। আব্বাসী সালতানাতের কাজী। তাকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা হয় ৫৫৫ হিজরীতে (১১৬০ খ্রিস্টাব্দ) ,মুস্তানজিদের আমলে। পুড়িয়ে ফেলা হয় তার বইপত্র। তার সংগ্রহে ছিল ইবনে সীনার কিতাবুশ শিফা, এবং ইখওয়ানুস সফার বইপত্র। একই বছর বিশাপুরে আভ্যন্তরীন গোলযোগের কারনে পোড়ানো হয় আকিল মসজিদের পাঠাগারে থাকা বইপত্র। ৫৬৭ হিজরীএত (১১৭১ খ্রিস্টাব্দ) আইয়ুবীরা মিসরে প্রবেশ করে পোড়ালো ফাতেমীদের বইপত্র। খলীফা আজিজ বিল্লাহ প্রতিষ্ঠিত কায়রোর বিখ্যাত খাজানাতুল কুতুবের বইপত্র পোড়ানো হলো, নীলনদে ডোবানো হলো। কিছু বইপত্র মরুভূমিতে ফেলে রাখা হলো। মুরাবিতিনরা আন্দালুস দখলের পর দর্শনের বইপত্র পোড়ানো হয়। এর মধ্যে ইমাম গাজালির বইপত্রও ছিল। পরে আবার ক্ষমতার পালাবদলে মুয়াহহিদিনরা যখন ক্ষমতায় এলো, তারা পোড়ালো মুরাবিতিনদের বই। পরে আবার মুয়াহহিদিনরা হারলে মুরাবিতীনরা তাদের বই পোড়ালো। মালেকি মাজহাবের বইপত্র নিয়ে যাওয়া হলো ফাস শহরে, পোড়ানো হলো জনসম্মুখে।৫৯৫ হিজরী (১১২১ খ্রিস্টাব্দে) আগুন লাগে ইস্ফাহানের জামে মসজিদে। পুড়ে যায় অনেক বইপত্র। ৫৯৯ হিজরীতে (১১২১ খ্রিস্টাব্দ) ক্রুসেডাররা ইস্তাম্বুল দখল করে। শুরু হয় গনহত্যা। পুড়িয়ে ফেলা হয় দুষ্প্রাপ্য বইয়ের বিশাল সংগ্রহ।

হিংসার কারনেও পোড়ানো হয়েছে বই। আবদুস সালাম জিলী এমনই এক প্রতিহিংসার শিকার। খলীফা মুস্তানসির পুড়িয়েছেন ইবনুল আবারের বইপত্র। সময়কাল ৬৫৮ হিজরী (১২৫৯ খ্রিস্টাব্দ) । ৩২২ হিজরীতে (৯৩৪ খ্রিস্টাব্দ) বাগদাদে পৌছান আবু বকর বিন মুকসিম। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উথে তিনি বিদআতি। পুড়িয়ে ফেলে হয় তার বইগুলো। ১২৯২ খ্রিস্টাব্দে মিসরের কেল্লা জাবালের খাজানাতুল কুতুবে আগুন ধরে। পুড়ে যায় হাদীস, তাফসীর, ইতিহাস , সাহিত্য বিষয়ক প্রচুর বই।

নাজাফের কুতুবখানায় আগুন লাগে ৮২৮ হিজরীতে (১৪২৪খ্রিস্টাব্দ)। পুড়ে যায় হজরত আলী র এর লেখা দুষ্প্রাপ্য একটি পান্ডুলিপি। দামেশকের মাদরাসা আদেলিয়্যাহ ও মাদরাসা কাজাইয়্যাহর কুতুবখানায় আগুন লাগে তৈমুর লঙ্গয়ের আক্রমনে । সময়কাল ৮০২ হিজরী (১৪০০ খ্রিস্টাব্দ)। ইসমাইল শাহ প্রথম পুড়িয়েছিল আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের বইপত্র। সময়কাল ৮৯০-৯৩০ হিজরী (১৪৮৫-১৫২৩ খ্রিস্টাব্দ)। স্থান পারস্য।
মুসলমানরা স্পেন শাসন করেছে প্রায় আটশো বছর। তারা স্পেনকে গড়ে তুলেছে সভ্যতা ও সংস্কৃতির কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে । সেখান থেকে আলো নিয়েই ইউরোপ হয়েছে সভ্য। এগিয়েছে জ্ঞান-বিজ্ঞানে। ৯০৫ হিজরীতে (১৪৯৯ খ্রিস্টাব্দ) গ্রানাডার পতনের মধ্য দিয়ে স্পেন মুসলমানদের হাতছাড়া হয়। তারপর শুরু হয় মুসলমানদের বই পোড়ানোর মহতসব। আন্দালুসের কুতুবখানাগুলোর করুন পরিনতির কথা ভেবে ইতিহাস আজো কেদে উঠে। গ্রানাডার ময়দানে বার্বাররা একদিনেই পুড়িয়েছিল দশ লক্ষ বই।
কিতাব যেভাবে পুড়েছে , সেভাবে ডুবেছেও। আইয়ুবীরা মিসরে পৌছে ফাতেমীদের কিতাব পুড়িয়েছে, নীলনদেও ডুবিয়েছে। তাতারীরা বাগদাদের কুতুবখানার বইপত্র দজলার পানিতে নিক্ষেপ করেছে ।

বই পানিতে নিক্ষেপ করার প্রথম যে সংবাদ পাওয়া যায় , তা তাজুল উম্মাহ খ্যাত দাউদ তাঈ বিন নাসির আল কুফির (মৃত্যু ১৬৫ হিজরী/৭৮১ খ্রিস্টাব্দ)। ইয়াকুত হামাভী লিখেছেন তার সম্পর্কে , দাউদ তাঈ নিজের বইগুলো ফুরাত নদীতে ডুবিয়ে দেন। আবু উমর হারুরী (মৃত্যু ২৫৫ হিজরী/৮৬৮ খ্রিস্টাব্দ) সফর করছিলেন পারস্যে, নৌপথে। নিহরাওয়ানে পৌছলে নদীতে প্লাবন আসে। ওজন কমানোর জন্য নদীতে অনেক মালপত্র ফেলে দেন। এর মধ্যে ছিল আবু উমর শায়বানীর (মৃত্যু ২০৮ হিজরী/৮২৩ খ্রিস্টাব্দ) ‘কিতাবুল জীম’। দুর্ঘটনায় পানিতে ডুবে যায় আহমাদ বিন মোহাম্মদ আল বাজ্জাজের (মৃত্যু ৪০৭ হিজরী/১০১৬ খ্রিস্টাব্দ) বইপত্র। আবুল আলা ছয়িদ বিন হাসান বিন ঈসা রিবয়ী মোসুলি (মৃত্যু ৪১৭ হিজরী/১০২৬ খ্রিস্টাব্দ) ।

মানসুর বিন আবু আমেরের সময় তিনি আন্দালুসে পৌছেন। মানসুর তাকে সম্মান করেন, অভ্ররথনা জানান। আবুল আলা একটি বইও লেখেন মানসুরের জন্য। একজন গোলামের হাতে বইটি দিয়ে তাকে বলেন বইটি মানসুরের কাছে পৌছাতে। গোলাম হাটছিল কর্ডোভার বিখ্যাত নহরের পাড় ধরে। হঠাত পা পিছলে সে বইসহ নহরে পড়ে যায়। গোলাম অক্ষত উঠতে পারলেও বইটি নষ্ট হয়ে যায়। আবুল হাসান আলী বিন আবদুল্লাহ (মৃত্যু ৪১৫ হিজরী/১০২৪ খ্রিস্টাব্দ) ছিলেন বিখ্যাত ভাষাবিদ। তিনি প্রচুর বই লিখেছেন। তার মৃত্যুর পর তার বইপত্র ইবনে দীনার ওয়াসেতির হাতে আসে। পরে বন্যার সময় বেশিরভাগ বই পানিতে নষ্ট হয়ে যায় । বাগদাদের বন্যায় নষ্ট হয় ইবনে দুহানের (মৃত্যু ৫৬৯ হিজরী/১১৭৩ খ্রিস্টাব্দ) লিখিত বই । বই পানিতে ডুবানোর সবচেয়ে বড় ঘটনাটি ঘটে তাতারীদের হাতে বাগদাদ পতনের পর। সময়কাল ৬৫৬ হিজরী তথা ১২৫৮ খ্রিস্টাব্দ। তাতারীরা নির্মমভাবে বাগদাদের পাঠাগারগুলো লুন্ঠন করে। বইপত্র নিক্ষেপ করে দজলা নদীতে। দজলা নদীর পানি কালো হয়ে যায় বইয়ের কালি উঠে। ১০৫৫ হিজরী তথা ১৬৪৫ সালে মক্কায় দেখা দেয় ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ংকর বন্যা। বন্যার পানি প্রবেশ করে মসজিদে হারামে। নষ্ট হয় অনেক বইপত্র ।শায়খ আব্দুল আজিজ নাজফী ভারত, ইরাক ও অন্যান্য অঞ্চল থেকে দুষ্প্রাপ্য বই সংগ্রহ করে একটি সমৃদ্ধ পাঠাগার গড়ে তুলেছিলেন। তার মৃত্যুর পর তার ওয়ারিসদের মধ্যে ঝগড়া শুরু হয়। কেউ তার বইপত্র বিক্রি করে দেয় । আবার কেউ তার বইপত্র ফেলে নজফের নদীতে। তিন নৌকা বোঝাই বই যাচ্ছিল ফাতিকান শহরে । প্রতিটি নৌকায় ছিল ইতিহাস, দর্শন ও অন্যান্য বিষয়ের বই। নদীতে ঝড় উঠেলে দুটি নৌকা ডুবে যায়। হারিয়ে যায় অনেক বই।

৭৫০ হিজরীতে (১৩৪৯ খ্রিস্টাব্দ) ডুবে যায় হজরত উসমান সংকলিত কোরআনের একটি কপি। এটি প্রথমে কর্ডোভার জামে মসজিদে ছিল। সুলতান আব্দুল মুমিন বিন আলীর শাসনামলে সেখান থেকে মারাকেশে আনা হয়। সুলতান আবুল হাসান মারিনী যখন আফ্রিকা জয় করেন তখন তিনি এই কপিটি নিজের অধিকারে নেন। বরকত হিসেবে যুদ্ধযাত্রা ও সফরে এটি নিজের সাথে রাখতেন। ৭৫০ হিজরীতে তিনি নৌপথে তিউনেসিয়া থেকে মরক্কোর দিকে যাচ্ছিলেন। মাঝপথে প্রচন্ড ঝড় শুরু হয়। নৌকা ডুবে যায়। সাথে ডুবে যায় হজরত উসমানের স্মৃতিবিজড়িত এই কপিটিও।

তথ্যসূত্র :
১। আল কিতাব ফিল হাদারাতিল ইসলামিয়্যা — ড. ইয়াহইয়া ওহিব জুবুরী
২। মিন রাওয়াউই হাদারাতিনা– ড. মোস্তফা আস সিবাঈ
৩। নাফহুত তীব মিন গুসনীল উন্দুলুসির রাতিব — আল্লামা মাক্কারি
৪। আল বায়ানুল মুগরিব ফি ইখতিসারি আখবারী মুলুকিল উন্দলুস ওয়াল মাগরিব — আহমাদ বিন মুহাম্মদ মারাকেশী
৫। হারকুল কুতুব ফিত তুরাসিল আরাবি– নাসের হাজিমী।

লেখক- ইমরান রাইহান

বিপদের আশংকা যখন

মানবকুলের উপর যে বিপদ বা বালা মসিবতের ঢল নেমে আসে, এটা তাদের স্বীয় কর্মফল । কালামে পাকে ইরশাদ হয়েছে –

ظَهَرَ ٱلْفَسَادُ فِى ٱلْبَرِّ وَٱلْبَحْرِ بِمَا كَسَبَتْ أَيْدِى ٱلنَّاسِ لِيُذِيقَهُم بَعْضَ ٱلَّذِى عَمِلُوا لَعَلَّهُمْ يَرْجِعُونَ

স্থলে ও জলে মানুষের কৃতকর্মের দরুন বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে। আল্লাহ তাদেরকে তাদের কর্মের শাস্তি আস্বাদন করাতে চান, যাতে তারা ফিরে আসে।(সূরা রুম-৪১)

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃযখন আমার উম্মাত ১০টা কাজ করবে, তখন তাদের উপর বিপদ নেমে আসবে।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করা হলোঃ হে রাসূল, কী কী? তিনি বললেনঃ

  • যখন রাস্ট্রীয় সম্পদকে ব্যক্তিগত সম্পত্তি মনে করা হবে
  • যখন আমানত হিসেবে রক্ষিত সম্পদকে লুটের মাল হিসাবে গ্রহণ করা হবে (অর্থাৎ আত্মসাৎ করা হবে)
  • যাকাতকে জরিমানার মতন মনে করা হবে
  • স্বামী যখন স্ত্রীর আনুগত্য করবে এবং মায়ের অবাধ্য হবে
  • বন্ধুর প্রতি সদাচারী ও পিতার সাথে দুর্ব্যবহারকারী হবে
  • মসজিদে হৈ চৈ হবে
  • জনগণের নেতা হবে সেই ব্যক্তি যে তাদের মধ্যেকার সবচেয়ে নিকৃষ্ট চরিত্রের অধিকারী
  • মানুষকে তার ক্ষতির আশংকায় সম্মান করা হবে
  • গায়িকা ও বাদ্যযন্ত্রের হিড়িক পড়ে যাবে
  • উম্মাতের পরবর্তীরা পূর্ববর্তীদেরকে অভিশাপ দেবে

তখন আগুনে বাতাস আসবে, মাটির ধস ও দেহের বিকৃতি ঘটবে।”

  • সহীহ তিরমিযী
  • হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত।
  • আততারগীব ওয়াত তারহীব- ৩য় খন্ড (১৫৪১)

এটা পড়তে পারেন –  ধন-সম্পদ, সুস্থতা ও আল্লাহ্‌র পরীক্ষা


বিপদে পড়ার দোয়া-

দোয়া ইউনুস

মহিলাদের ভ্রু প্লাক ও শরীরে উল্কি বা ট্যাটু আঁকা

বর্তমান সময়ের ফ্যাশন সচেতন বোনেরা অনেকেই ভ্রু প্লাক করে থাকেন এবং নানা রঙের নানা ধরনের পরচুলাও ব্যাবহার করে থাকেন। অথচ, আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম যারা ভ্রু প্লাক করে, তাদেরকে ‘লানত’ বা অভিশাপ করেছেন।

حَدَّثَنَا عُثْمَانُ، حَدَّثَنَا جَرِيرٌ، عَنْ مَنْصُورٍ، عَنْ إِبْرَاهِيمَ، عَنْ عَلْقَمَةَ، قَالَ عَبْدُ اللَّهِ: «لَعَنَ اللَّهُ الوَاشِمَاتِ وَالمُسْتَوْشِمَاتِ، وَالمُتَنَمِّصَاتِ، وَالمُتَفَلِّجَاتِ لِلْحُسْنِ، المُغَيِّرَاتِ خَلْقَ اللَّهِ تَعَالَى
অর্থ- হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, “আল্লাহ তা‘আলা অভিশম্পাত করেছেন সেসব নারীদের উপর যারা দেহাঙ্গে উল্কি উৎকীর্ণ করে এবং যারা করায়, তেমনি যারা ভ্রু চেঁছে সরু (প্লাক) করে, যারা সৌন্দর্য মানসে দাঁতের মাঝে ফাঁক সৃষ্টি করে, যারা মহান আল্লাহ পাক উনার সৃষ্টির মধ্যে পরিবর্তন আনে। (সহীহ বুখারীঃ ৭/১৬৪ হাদীস নং ৪৮৮৬, ৪৮৮৭, ৫৯৩১, ৫৯৪৩, ৫৯৪৮)

জনৈক মহিলা এ ব্যাপারে তার (ইবনে মাসউদের) কথার প্রতিবাদ করলে তিনি বলেন, “আমি কি তাকে অভিসম্পাত করব না, যাকে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম অভিসম্পাত করেছেন এবং তা আল্লাহর কিতাবে আছে?
আল্লাহ বলেছেন, “রাসুল যে বিধান তোমাদেরকে দিয়েছেন তা গ্রহণ করো, আর যা থেকে নিষেধ করেছেন, তা থেকে বিরত থাক।” (সুরা হাশরঃ ৭)

আপনি ভ্রু প্লাক কার জন্য করছেন? বাসায় যারা আছে তাদের জন্য? I don’t think so.
মানুষ সাধারণত নায়ক নায়িকা, গায়ক গায়িকা, এমন “সো কলড” সেলেব্রিটির দেখে প্রভাবিত হয়ে তাদের ফ্যাশান নকল করার চেষ্টা করে, যদিও ঐ সমস্ত নায়িকা বা গায়িকারা যে চরিত্রহীনা ও ব্যভিচারিণী, বর্তমান যুগের সকলেরই তা জানা আছে। এইভাবে মিডিয়ার পাল্লায় পড়ে আধুনিক যুগের দুর্বল ঈমান ও ইলমহীন নারীরা আসলে মডার্ণ যুগের প্রস্টিটিউটদেরকে ফলো করছে।

যা বলছিলাম, আপনি নিশ্চয়ই আপনার মা-বাবা বা ভাই-বোনদেরকে দেখানোর জন্য ভ্রু প্লাক করছেন না? তাহলে কার জন্য? বাইরের দুনিয়ার পর পুরুষদের জন্য? অথচ তাদের সামনে সাজ-গোজ করে যাওয়াতো দূরের কথা, আপনার জন্য নিকাব ছাড়া তাদের সামনে যাওয়াই নিষিদ্ধ। কথাগুলো বুঝানোর উদ্দেশ্যেই বলা, কেউ কষ্ট পেয়ে থাকলে তার জন্য দুঃখ প্রকাশ করছি।

আমাদের মা বোনেরা আমদের সম্মান, আল্লাহ আমাদের মা বোনদের হেফাজত করুন।

আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম আরো যাদের লানত বা অভিশাপ করেছেন তারা হলোঃ যারা দেহে উল্কি অংকন করে এবং অন্যকে  উল্কি এঁকে দেয়, সৌন্দর্যের জন্য দাঁতের মাঝে ফাঁক সৃষ্টি করে, যারা আল্লাহর সৃষ্টির মধ্যে পরিবর্তন আনে, যারা পরচুলা পড়ে ও অন্যকে পরচুলা পরতে বলে।


পরচুলা নিয়ে এ লেখাটি পড়তে পারেন নকল চুল ব্যবহারের হুকুম


আব্দুল্লাহ ইবনে উমার রাদিয়াল্লাহু আ’নহু হতে বর্ণিত। আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম যে মহিলা পরচুলা লাগিয়ে দেয় এবং যে পরচুলা লাগাতে বলে, আর যে মহিলা অঙ্গ প্রত্যঙ্গে উল্কি অংকন করে ও অন্যকে উল্কি অংকণ করতে বলে, তাদেরকে অভিশাপ করেছেন।” সহীহ বুখারীঃ ৫৯৩৭

ভ্রু প্লাক করা ও শরীরে ট্যাটু অংকন করা শুধু গুনাহ না, বরং কবীরা গুনাহ । 

ফুজাইল ডাকাত

ফুজাইল ডাকাত। সমরকন্দে জন্মেছেন। বেড়ে উঠেছেন আবয়ুর্দে। আবয়ুর্দের একজন মস্তবড় ডাকাত। ‘ফুজাইল ডাকাত’ বলে একনামে সবাই চিনত। সমরকন্দ ও আবয়ুর্দের রাস্তায় ডাকাতি করতেন। এ রাস্তা দিয়ে অতিক্রমকালে পথিকরা ‘ফুজাইল ডাকাত’র হাতে সবকিছু খোয়া যাওয়ার ভয়ে তটস্থ থাকত। ব্যবসায়ী কাফেলা আল্লাহর কাছে তাঁর খপ্পর থেকে বাঁচার জন্য ফরিয়াদ করত। রেহাই পাওয়ার জন্য অনেক কিছুই মান্নত করত।

যৌবনের মৌবনে এক রূপবতী কিশোরীর প্রেমে পড়েছিলেন ফুজাইল ডাকাত। কিশোরীর রূপের ঝলকে তিনি নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলেন। ‘ফুজাইল ডাকাত’র প্রেমের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়া কিশোরীর পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাই সে প্রেমের ডাকে সাড়া দেয়। তারা একে অপরের প্রেমে হাবুডুবু খেতে থাকেন। সুন্দরী কিশোরীর প্রেমে উন্মাদ টগবগে যৌবনের অধিকারী ডাকাত ফুজাইলের দিলে আল্লাহর ভয়ের ছিটেফোঁটাও ছিল না। ছিল না কোনো চিন্তা আখিরাত, কিয়ামত ও দোজখের। কিশোরীর প্রেম ছিল তাঁর নেশা। রাতের আঁধারে ডাকাতি ছিল তাঁর পেশা।

অনেকদিন হয়, কেউ কারও সাথে দেখাসাক্ষাৎ করতে পারছেন না। প্রেমিকার বদনখানি দেখার জন্য মনটা ছটফট করছিল ফুজাইল ডাকাতের। হৃদয়ের না বলা কথাগুলো বুকের ভেতর অস্থিরতা শুরু করে দিয়েছিল। ফুজাইল ডাকাত ছুটলেন প্রেমিকার বাড়ির উদ্দেশে। বাড়ির পাশে চলে এলেন। বাড়ির পাঁচিল টপকে ভেতরে প্রবেশ করতে গেলেন। ইত্যবসরে তাঁর কর্ণকুহরে এসে পৌঁছল সুমধুর কন্ঠে কারও কুরআন তিলাওয়াতের আওয়াজ। কে তার দিলখুশ আওয়াজে তিলাওয়াত করে চলছে সুরা হাদিদের ষোল নং আয়াতখানা-

“যারা মুমিন, তাদের জন্যে কি আল্লাহর স্মরণে এবং যে সত্য বাণী অবর্তীর্ণ হয়েছে, তার কারণে হৃদয় বিগলিত হওয়ার সময় আসেনি ?”

সম্বিত ফিরে পেলেন ফুজাইল ডাকাত। আল্লাহর এই বাণী তাঁর হৃদয়ের বদ্ধ দুয়ারে সজোরে আঘাত করতে সক্ষম হলো। এক আঘাতেই বদ্ধ দুয়ারের কপাট খুলে ফেলল ! মর্মে মর্মে মহাবাণীর এ মহাসুর তাঁর দিলে বাজতে লাগল সুমধুর। তিনি নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলেন না; পাপাচারিতার কালোজাল ছিন্ন করে মনের অজান্তেই বলে উঠলেন, ‘হ্যাঁ, অবশ্যই সময় এসেছে!’ পাঁচিলের উপর থেকেই ফিরে এলেন ফুজাইল ডাকাত। পাঁচিলঘেরা বাড়ির ভেতর প্রেয়সীর সাথে দেখা করার ইচ্ছা সেখানেই দাফন করলেন। আল্লাহর এই কালাম তাঁর বুকের ভেতর তোলপাড় সৃষ্টি করে ফেলেছে। গোনাহের আতিশয্যে তাঁর মৃত অন্তর জিন্দা হয়ে ওঠেছে। তাওবার জন্য তাঁর মনটা আঁতিউঁতি করতে শুরু করেছে।


এটা পড়তে পারেন  আযাদীর শিরোনাম : শহীদ টিপু সুলতান রহ.


ফেরার পথে রাত নেমে এল। গোনাহর পাহাড় মাথায় নিয়ে, অশ্রু টলোমল চোখে, দিকভ্রম ফুজাইল ডাকাত হেঁটে চলছেন। মাথা গুঁজার আশায় আশ্রয়স্থল খুঁজে ফিরছেন। অবশেষে একটি উজাড় করা স্থানে এসে ঠাঁই নিলেন। এসে দেখলেন তাঁর আগেই এই উজাড় করা স্থানে এসে আশ্রয় নিয়েছে একটি ব্যবসায়ী কাফেলা। তিনি শুনতে পেলেন কাফেলার ব্যবসায়ীরা তাদের কর্মপন্থা ঠিক করা নিয়ে মতানৈক্য করছে। কেউ বলছে এখানে অবস্থান না করে সফর অব্যাহত রাখতে। কেউ বাধা দিয়ে বলছে, এখন সফর করা মোটেই নিরাপদ নয়; এই রাস্তায় ফুজাইল নামের এক মস্তবড় ডাকাত আছে। তার খপ্পরে পড়লে উপায় নাই!

ব্যবসায়ীদের কথাগুলো শুনে ফুজাইল ডাকাতের দিল সংকীর্ণ হয়ে গেল। তিনি মনে মনে বললেন, ‘ইয়া আল্লাহ! এই লোকগুলো কী বলে! আমি কি এতটাই বিপজ্জনক?! এতটাই ত্রাসের কারণ?! ফুজাইল নামটা কি এ পথ অতিক্রমকারী ব্যবসায়ী কাফেলার আরাম হারাম হয়ে যাওয়ার উপকরণ?!’ তিনি এটাও ভাবলেন, ‘নিশ্চয় এদের কথা থেকে শিক্ষা নেয়ার জন্যে আল্লাহ আমাকে এখানে পাঠিয়েছেন। নইলে সম্পূর্ণ কাকতালীয়ভাবে এদের সাথে আমার এখানে জড়ো হওয়ার আর কোনো কারণ আছে?’

ফুজাইল ডাকাত মনে মনে বললেন, ‘যাহ! আর ডাকাতি করব না; বাকি জীবন বাইতুল্লাহর ছায়ায় আল্লাহর ইবাদতে কাটিয়ে দেব। কিশোরীর প্রেম বাদ দিয়ে আল্লাহর প্রেমে পাগল হয়ে যাব।’

সকাল হলেই ফুজাইল ডাকাত মক্কার উদ্দেশে রওয়ানা হলেন। ক্রমাগত কয়েকদিন সফর করে অবশেষে মক্কায় এসে পৌঁছলেন ফুজাইল ডাকাত। আল্লাহ-রাসুলের প্রেমে মত্ত হয়ে আল্লাহর ঘরের অবস্থানস্থল মক্কা আর রাসুলের ধূলি ধূসরিত মদিনায় জীবনযাপন করতে লাগলেন।

জানেন কে এই ফুজাইল ডাকাত? ইনি হলেন হিজরি দ্বিতীয় শতকের নামকরা মুহাদ্দিস ইমাম ফুজাইল ইবনে ইয়াজ (মৃত্য-১৮৭ হি.) রহ.। আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক, সুফইয়ান ইবনে উয়াইনা, আব্দুর রহমান বিন মাহদি, আবদুর রাজ্জাক ও ইমাম শাফিয়ি প্রমুখ বড় বড় মুহাদ্দিসদের উস্তাদ। ফুজাইল ডাকাত থেকে ইমাম ফুজাইল বিন ইয়াজ হয়ে গেলেন। যাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিলো কুরআনের একটুকরো বাণী।
——–
সূত্রঃسير أعلام النبلاء ৮/৪২২, ইমাম শামসুদ্দিন যাহাবি রহ.।
————-
লেখক আইনুল হক্ক কাসেমি

ঈমাণ ভঙ্গের কারণ সমূহ

আমরা অযু,নামায,রোযা ইত্যাদি ভাঙ্গার কারণ পড়ি । কিন্তু এগুলোর ভিত্তি যে ঈমানের উপর সেটা নিয়ে আমরা ভাবিনা । এমনতো নয় যে, হয়ত আমরা মনের অজান্তে এমন কাজ করে ফেলছি যা আমাদের ঈমানকে সন্দেহে ফেলে দেয় অথবা ঈমান নষ্ট বা ভেঙ্গে যায় । জেনে নেয় কিভাবে আমাদের ঈমান ভেঙ্গে যায় ।

ঈমাণ ভঙ্গের কারণ সমূহ

১.আল্লাহর ইবাদতে কাউকে শরীক করা বা অংশীদার স্থাপন করা।

দলীল:-(সূরা বনী ইসরাঈল-২২,৩৯/ মুমিনূন-১১৭/­শুয়ারা-২১৩/ মায়েদা-৩,৭২,৭৬/ আ’রাফ-১৮৮/রা’দ-১৬/ আন’আম-১৭-১৮/ যুমার-৩,৩৮,৬৫/ফুরক্বান-৩/ নামল-২৭/ফাতির-১৩-১৪/ আনকাবুত-১৭/আহকাফ-৫/ নিসা-১১৬)

২.আল্লাহ এবং বান্দার মাঝে কাউকে মাধ্যম তৈরী করে তাদেরকে ডাকা। এবং তাদের নিকট শাফায়াত কামনা করা।

দলীল:-(সূরা যুমার-৩৮,৪৪/ ইউনুস-১৮,৮৪/­মায়েদা-২৩)

৩.মুশরিকদেরকে কাফির মনে না করা অথবা তাদের কুফুরীর ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করা অথবা তাদের মতবাদ সমূহ সঠিক মনে করা। দলীল:-(সূরা তাওবা-৩,২৮/ বায়্যিনাহ-৬/ বাক্বারা-২২১)

৪.নবী করীম(সাঃ)এর দেখানো পথ ব্যতীত অন্য কোন পথকে পরিপূর্ণ মনে করা।অথবা ইসলামী হুকুমাত বা শরীয়াহ ব্যতীত অন্য কারো তৈরী বিধান (বর্তমান গণতন্ত্র)কে উত্তম মনে করা।

দলীল:-(সূরা তাওবা-৩১/আহযাব-৩৬)

৫.নবী করীম(সাঃ)এর আনিত বিধানের কোন একটিকে অপসন্দ করা।যদিও সে ঐ বিষয়ের উপর আমল করে।

দলীল:-(সূরা মুহাম্মদ-৮-৯/ তাওবা-৪৮)


এটা পড়তে পারেন জনসংখ্যা ও বিশ্বাস



৬.
মুহাম্মদ(সাঃ)এর আনিত ধর্ম (ইসলাম) এর কোন বিষয় অথবা ধর্মীয় ছওয়াব বা শাস্থির ব্যাপারে ঠাট্টা- বিদ্রূপ করা।

দলীল:-(সূরা তাওবা-৬৫-৬৬/ইউনুস-১১/ নিসা-১৪০/­মায়েদা-৫৭-৫৮/ বাক্বারা-১৪)

৭.যাদুর মাধ্যমে ভাল কিছু অর্জন বা মন্দ কিছু বর্জন করা।অথবা স্বামী-স্ত্রীর মাঝে সম্পর্ক স্থাপন বা ভাঙ্গন ধরাতে গোপন,প্রকাশ্য,মন্ত্র-তন্ত্র করা।অথবা কারো সাথে সম্পর্ক স্থাপন বা বন্ধুত্বে ফাঁটল ধরানো। দলীল:-(সূরা বাক্বারা-১০২

৮.মুসলমানদের বিরুদ্ধে মুশরিকদেরকে সাহায্য সহযোগিতা করা। দলীল:-
(সূরা মায়েদা-৫১/ মুমতাহিনা-১-২)

৯.মুহাম্মদ(সাঃ)এর আনিত শরীয়াহ ব্যতীত অন্য কোন পথে বা অন্য কোন ধর্মে জীবন পরিচালনা করলেও জান্নাত পাওয়া যাবে বা আল্লাহ সন্তষ্টি পাওয়া সম্ভব মনে করা। দলীল:-(সূরা আলে ইমরান-৮৩,৮৫/
নিসা-১১৫)

১০.আল্লাহর মনোনিত দ্বীন,ইসলাম থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া।ইসলাম অনুসারে আমল এবং শিক্ষা গ্রহণ করতে নারাজ হওয়া। দলীল:-(সূরা সাজদাহ-২২/ কাহফ-৫৭/ত্বা-হা-১২৪-১২৬/ মুমিনূন-৭১)

অতএব,ইসলামী আক্বীদা ও তাওহীদ গ্রহণের পর যদি কেউ উপরোল্লিখিত বিষয়গুলিতে নিপতিত হয়,তবে সে ঈমাণহারা হবে বা মুরতাদ হয়ে যাবে।

বিচার বিশ্লেষণ করে একেক সময় একেক মাযহাব মানতে সমস্যা কোথায় ?

ভিন্ন মাযহাব । আসসালামু আলাইকুম,আমার একটা বিষই জানার আছে, বিষয়টিই হল, ধরুন আমি নির্দিষ্ট একজন ইমামকে অনুসরন করি, যেমন ইমাম মালেকের সমস্ত নিয়ম কানুন এবং ফতোয়াগুলো অনুসরন করে চলি। কিন্তু ইমাম মালেকের কোনো এক ফতোয়া বিচার বিশ্লেষণ করে কুরআন এবং বিশুদ্ধ হাদিস অনুসারে দেখা গেল যে ইমাম শাফেই এর ফতোয়া থেকে কম বিশুদ্ধ। আবার ইমাম শাফেই এর কোনো এক ফতোয়া বিশুদ্ধ হাদিসের বিরুদ্ধে যাই অথবা ইমাম আবু হানিফা এর ফতোয়া থেকে কম বিশুদ্ধ, কুরআন এবং সুন্নাহর আলোকে। আবার দেখা যায় কোনো এক ইমামের বর্ণিত হাদিস দুর্বল আবার অন্য ইমামের বর্ণিত হাদিস বিশুদ্ধ। এক্ষেত্রে প্রত্যেক ইমামের মধ্যে কম বেশি ভুল ত্রুটি আছে। আল্লাহ মাফ করুন। আমরা কেও ভুলের উর্ধে নই। সেক্ষেত্রে আমি কি নির্দিষ্ট করে একজন ইমামকে অনুসরন করে চলব, যেখানে তার কুন ফতোয়া যদিও ভুল হয় এবং অন্য জনের ফতোয়া ঠিক হয়। নাকি সবাইকে অনুসরন করে চলব, সঠিকটা গ্রহনের ম্যাধ্যমে। আশা করি আমার বিষয়টা বুঝতে পেরেছেন। সাহিহ হাদিস ও কুরআন আলোকে জানিয়ে বাধিত করবেন।

উত্তর

وعليكم السلام ورحمة الله وبركاته

بسم الله الرحمن الرحيم

আপনার এ প্রশ্নটি মূলত ডাক্তার জাকির নায়েকের উর্বর মস্তিস্ক প্রসূত একটি তথ্য। তাই নয় কি? এখানে যে যুক্তি তুলে ধরা হল যে, চার ইমামের মত থেকে যার মতটিকে বিচার-বিশ্লেষণ করে অধিক দলীলযোগ্য বলে মনে হবে, তার মতকে গ্রহণ করা হবে, আর অন্য মতকে ছেড়ে দেয়া হবে।

এখন প্রশ্ন হল দু’টি। যথা-

১-বিচার বিশ্লেষণটা করবে কে?

২-কোন মূলনীতির আলোকে বিচার বিশ্লেষণ করা হবে?

বিচার বিশ্লেষণ কে করবে?

এটি একটি মৌলিক প্রশ্ন। কে বিচার বিশ্লেষণ করবে? যে ব্যক্তি কুরআন ও হাদীসকে অনুবাদ ছাড়া মূল কিতাব থেকে বুঝতে সক্ষম নয়। জানেনা আরবী শুদ্ধ করে পড়তেও। কোন হাদীসই সনদসহ মুখস্ত নেই। সনদের প্রতিটি রাবীর জীবনী মুখস্ত নয়। রাবীদের বিরুদ্ধে বা পক্ষে বলা মুহাদ্দিসীনদের বক্তব্য মুখস্ত নেই। মুহাদ্দিসীনগণ কোন কারণে রাবীকে দুর্বল বা সহীহ বলেছেন তা জানা নেই। আরবী ব্যকরণ শাস্ত্র সম্পর্কে নেই পর্যাপ্ত জ্ঞান। কুরআনের অলংকারশাস্ত্র সম্পর্কে নেই কোন জ্ঞান। পূর্ণ কুরআনের নাসেখ-মানসূখ, হাদীসের নাসেখ মানসূখ, সকল আয়াতের শানে নুজুল, হাদীসের শানে ওরূদ সম্পর্কে নেই কোন ইলম।

এরকম অজ্ঞ ব্যক্তি কি করে বুঝবে যে, কোন ইমামের বক্তব্যটি সঠিক আর কোন ইমামের বক্তব্যটি বেঠিক?

এমন অজ্ঞ ব্যক্তি যদি শুধু অনুবাদ পড়ে, কিংবা রাসূল সাঃ এর বলা খাইরুল কুরুন তথা শ্রেষ্ঠ যুগের পরের কোন উম্মতীর ব্যাখ্যার আলোকে নিজের মনমত যেটাকে ইচ্ছে গ্রহণ-বর্জন করার অধিকার থাকা কতটা ইসলাম মানা হবে? একবার ভেবে দেখবেন কি?

কোন মূলনীতির আলোকে বিচার-বিশ্লেষণ করা হবে?

মুহাদ্দিসীনদের বক্তব্যের আলোকে? যদি বলেন যে, হ্যাঁ, তাই। মুহাদ্দিসীনরা যে হাদীসকে সহীহ বলেছেন, আমরা কেবল সেই হাদীস অনুপাতেই আমল করবো। আর ফুক্বাহায়ে কেরামের বক্তব্যটি যদি মুহাদ্দিসীনের নির্ধারিত করা সহীহ হাদীসের খেলাফ হয়, তাহলে মুহাদ্দিসীনের কথা মানবো। ফক্বীহের কথা ছেড়ে দিব।

যদি এমনটিই করে থাকেন, তাহলে প্রশ্ন হল, আপনি মুহাদ্দিসীদের কথা মেনে একটি হাদীসকে আমলযোগ্য সাব্যস্ত করছেন, মুহাদ্দিস ফক্বীহের কথা মেনে তিনি যে হাদীসকে আমলযোগ্য বলে ঘোষণা করছেন সেটি মানছেন না কেন?

এ কেমন বিচার? যিনি শুধু মুহাদ্দিস, তার কথা মেনে হাদীস সহীহ দুর্বল নির্ণয় করছেন, কিন্তু যিনি মুহাদ্দিস হওয়ার সাথে সাথে ফক্বীহ তার কথা মেনে তার বলা হাদীসকে কেন সহীহ মানছেন না?

এ বৈষম্য কেন? মুহাদ্দিসতো আর তার হাদীস সহীহ হওয়ার দলীল কুরআন থেকে বা হাদীস থেকে দিচ্ছে না, শুধুমাত্র নিজের ইজতিহাদ দ্বারা হাদীস সহীহ-জঈফ বলছেন, ঠিক একই কাজ করেছেন মুহাদ্দিস ফুক্বাহায়ে কেরাম। তারাও হাদীস যাচাই-বাছাই করে তার নিকট আমলযোগ্য সহীহ হাদীসের উপর নিজের মাযহাবকে প্রতিষ্ঠা করেছেন। সেখানে আপনি শুধু মুহাদ্দিসের কথা মেনে তার সহীহ বলা হাদীসকেই সহীহ মানবেন, অথচ মুহাদ্দিস ফক্বীহের বলা হাদীসকে জঈফ বলবেন কোন যুক্তিতে?

মুহাদ্দিস ফক্বীহ তার বর্ণিত মাসায়েলের বিপক্ষ হাদীসকে দলীলযোগ্য নয়, বা জঈফ মনে করেছেন বলেই ছেড়ে দিয়েছেন। আর যে হাদীসকে সহীহ ও আমলযোগ্য মনে হয়েছে, সে হাদীসের উপর স্বীয় মাযহাব অন্তর্ভূুক্ত করেছেন। তাহলে আপনি একজন ইমামের মাযহাবের মাসআলাকে যা তিনি কুরআন বা হাদীসের আলোকে দাঁড় করিয়েছেন। তাকে আরেক মুহাদ্দিসের বক্তব্যের আলোকে বাদ দিবেন কি করে?

এর কি কোন যৌক্তিক কারণ আছে? যে যুক্তিতে আপনি মাযহাবকে বাদ দিতে চাচ্ছেন, সে যুক্তিতেতো মুহাদ্দিসের বলা সহীহ হাদীসও পরিত্যাজ্য হয়।

উদাহরণতঃ নামাযে আমীন জোরে আস্তে বলার ক্ষেত্রে মুহাদ্দিস ফক্বীহ ইমাম আবু হানীফা রহঃ ওয়াইল বিন হুজুর থেকে বর্ণিত আস্তে বলার বর্ণনাকে সহীহ ও আমলযোগ্য সাব্যস্ত করে এর উপর স্বীয় মাযহাব বানিয়েছেন। আর আমীন জোরে বলার বর্ণনাকে দুর্বল বা কোন কারণে আমলযোগ্য নয়, বলে পরিত্যাজ্য করেছেন।

অপরদিকে কতিপয় মুহাদ্দিস আমীন জোরে বলার বর্ণনাকে সহীহ সাব্যস্ত করেছেন। সেই সাথে আমীন আস্তে বলার বর্ণনাকে জঈফ সাব্যস্ত করেছেন।

এখন কথা হল, আপনি কার বক্তব্য নিবেন? আপনার প্রশ্ন অনুপাতে আপনার ধারণা হল, এক্ষেত্রে মুহাদ্দিস ফক্বীহের বলা সহীহ হাদীসকে ছেড়ে দিয়ে শুধু মুহাদ্দিসের বলা সহীহ হাদীসকে গ্রহণ করবেন? সে হিসেবে বলবেন যে, মুহাদ্দিস যেহেতু আমীন আস্তে বলার বর্ণনাকে জঈফ বলেছেন, আর জোরে বলার বর্ণনাকে সহীহ বলেছেন, তাই আমি মুহাদ্দিস ফক্বীহ ইমাম আবু হানীফার মাযহাব ছেড়ে দিয়ে আমীন জোরে বলার মাযহাব গ্রহণ করলাম।

এটা করবেন কেন? কিসের ভিত্তিতে করছেন? শুধু মুহাদ্দিস যে হাদীসকে সহীহ বললো, আপনার কাছে সেটি সহীহ। আর যে হাদীসকে মুহাদ্দিস ফক্বীহ সহীহ বললেন, সেটি সহীহ নয় কেন?

যিনি হাদীসের সনদ আর ইবারত সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ আপনি তার কথাই গ্রহণীয় সাব্যস্ত করছেন, অথচ যিনি হাদীসের সনদ ও ইবারতের সাথে সাথে হাদীসের অন্তর্নিহিত অর্থ ও আগে পরের সকল ঘটনাসহ জানেন উক্ত ব্যক্তির কথাকে ছেড়ে দেয়ার ধৃষ্টতা কেন দেখাবেন?

ইমাম আবু হানীফা রহঃ থেকে বর্ণিত সকল মাসআলার ভিত্তিই সহীহ হাদীস

ইমাম আবু হানীফা রহঃ স্বীয় মাযহাবের ভিত্তি রেখেছেন সহীহ হাদীসের উপর। কোন জঈফ হাদীসের উপর তার মাযহাবের ভিত্তি রাখেন নি। তাই হানাফী মাযহাবের সকল মাসআলা যা হাদীস দ্বারা প্রমাণিত তা সকলই সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমানিত। কোন জঈফ হাদীস দিয়ে হাদীসে বর্ণিত মাসআলা প্রমানিত করা হয়নি। এর সবচে’বড় দলীল হল, ইমাম আবু হানীফা রহঃ স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা দিয়েছেন যে,

“যখন হাদীস সহীহ হবে, সেটিই আমার মাযহাব”।

যিনি এ ঘোষণা দিচ্ছেন যে, সহীহ হাদীস তার মাযহাব, তিনি কি করে দুর্বল হাদীসের উপর নিজের মতাদর্শের ভিত্তি রাখবেন? সুতরাং একথা আমরা নির্ধিদ্ধায় বলতে পারি যে, ইমাম আবু হানীফা রহঃ বর্ণিত হাদীস দ্বারা প্রমাণিক সকল মাসআলাই সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত।

একটি প্রশ্ন ও জবাব

হানাফী মাযহাবের ভিত্তি সহীহ হাদীসের উপর হলে, বিভিন্ন মাসআলায় কেন হানাফী মাযহাবের হাদীসকে জঈফ বলে মুহাদ্দিসীনে কেরাম মন্তব্য করেছেন?

এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। কিন্তু উত্তরটি খুবই যৌক্তিক ও সহজ। আসলে ইতোপূর্বেই এর একটি জবাব অতিক্রান্ত হয়েছে। তথা- হাদীস সহীহ জঈফ হওয়ার প্রমাণ কুরআন ও হাদীস নয়। বরং ব্যক্তির মতামত। তথা বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিরা যে হাদীসকে সহীহ বলেছেন, আমরা সে হাদীসকে সহীহ বলি। যে হাদীসকে দুর্বল বলেন, আমরা সে হাদীসকে দুর্বল বলি। এ সহীহ বা জঈফ বলার উপর আমাদের কাছে কুরআন বা হাদীসের কোন দলীল নেই। পুরোটাই মুহাদ্দিসীনদের ইজতিহাদ তথা গবেষণা নির্ভর।

এ কারণেই এক হাদীসের ক্ষেত্রে একাধিক বক্তব্য এসেছে। এক হাদীসকে একদল মুহাদ্দিস সহীহ বলেছেন, অপরদল তাকে হাসান বলেছেন, কেউবা জঈফ বলেছেন।

যেহেতু হাদীস সহীহ বা জঈফ হওয়ার কোন দলীল কুরআন বা হাদীসে বর্ণিত নয়। এসবই গবেষকদের গবেষণার সৃষ্টি। যদি কুরআন বা হাদীসে কোন হাদীসকে সহীহ বা জঈফ বলা হতো, তাহলে আমরা কিছুতেই কারো গবেষণা মেনে হাদীসকে সহীহ বা জঈফ মানতাম না। বরং সরাসরি কুরআন ও হাদীসে বর্ণিত সহীহ এবং জঈফকেই মেনে নিতাম। কিন্তু যেহেতু কুরআন ও হাদীসে সহীহ বা জঈফের কথা উল্লেখ নেই, তাই আমাদের মূলনীতি হল, যিনি কুরআন ও হাদীসের শব্দের সাথ তার অন্তর্নিহিত অর্থ সম্পর্কে সম্মক অবগত, সেই সাথে যিনি আল্লাহর নবীর বলা শ্রেষ্ঠ যুগের মুহাদ্দিস ফক্বীহ তার কথার আলোকে হাদীসকে সহীহ ও জঈফ নির্ণিত করবো। তথা শ্রেষ্ঠ যুগের মুহাদ্দিস ফক্বীহ যে হাদীসকে গবেষণা করে সহীহ সাব্যস্ত করে আমলযোগ্য হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন, তার হাদীসকে সহীহ ধরে আমল করবো। আর তিনি যে হাদীসকে জঈফ বা কোন কারণ সংশ্লিষ্ট সাব্যস্ত করে বাদ দিয়েছেন, আমরা উক্ত হাদীসকে আমলহীন ধরে আমল করবো না।

শ্রেষ্ঠ যুগের পরের কোন মুহাদ্দিসের গবেষণা মেনে হাদীস সহীহ বা জঈফ বলার চেয়ে শ্রেষ্ঠ যুগের মুহাদ্দিস ফক্বীহের গবেষণা মেনে হাদীসকে সহীহ বা জঈফ বলা কি অধিক নিরাপদ নয়?

আরেকটি লক্ষ্যণীয় বিষয়

ইমাম আবু হানীফা রহঃ এর জন্ম ৮০ হিজরী। মৃত্যু-১৫০ হিজরী।

ইমাম মালিক রহঃ এর জন্ম-৯৩ হিজরী। মৃত্যু-১৭৯।

ইমাম শাফেয়ী রহঃ এর জন্ম-১৫০ হিজরী। মৃত্যু-২০৪ হিজরী।

ইমাম আহমাদ বিন বিন হাম্বল রহঃ এর জন্ম-১৬৪, মৃত্যু-২৪১ হিজরী।

ইমাম আবু ইউসুফ রহঃ এর জন্ম-১১৩ হিজরী এবং মৃত্যু-১৮২ হিজরী।

ইমাম মুহাম্মদ রহঃ এর জন্ম ১৩১ হিজরী এবং মৃত্যু-১৮৯ হিজরী।

বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ ইমাম মুহাম্মদ রহঃ নাবালেগ থেকে বালিগ হওয়ার সাথে সাথেই ইমাম আবু হানীফা রহঃ এর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন।

মুহাদ্দিসীনদের জন্ম ও মৃত্যু

মুহাম্মদ বিন ইসমাঈল বুখারী রহঃ এর জন্ম-১৯৪ হিজরী এবং মৃত্যু ২৫৬ হিজরী।

মুসলিম বিন হাজ্জাজ ইমাম মুসলিম রহঃ এর জন্ম ২০৪ হিজরী এবং মৃত্যু ২৬১ হিজরী।

মুহাম্মদ বিন ঈসা বিন সাওরা ইমাম তিরমিজী জন্ম-২১০ হিজরী এবং মৃত্যু ২৭৯ হিজরী।

মুহাম্মদ বিন ইয়াজিদ ইমাম ইবনে মাজাহ এর জন্ম-২০৯ হিজরী এবং মৃত্যু-২৭৩ হিজরী।

সুলাইমান বিন আসআস ইমাম আবু দাউদ রহঃ এর জন্ম- ২০২ হিজরী এবং মৃত্যু-২৭৫ হিজরী।

আবু আব্দুর রহমান আহমদ ইমাম নাসায়ী রহঃ এর জন্ম ২১৫ হিজরী এবং মৃত্যু ৩০৩ হিজরী।

এই হল সিহাহ সিত্তার জন্ম ও মৃত্যুর সন। লক্ষ্য করুন যে,

ইমাম আবু হানীফা রহঃ এর মৃত্যুর ৪৪ বছর পর জন্ম লাভ করেছে ইমাম বুখারী রহঃ।

ইমাম মুসলিম রহঃ এর জন্ম গ্রহণ করেছেন ৫৪ বছর পর।

ইমাম তিরমিজী রহঃ জন্ম গ্রহণ করেছেন ৬০ বছর পর।

ইমাম আবু দাউদ রহঃ জন্ম লাভ করেছেন ৫২ বছর পর।

ইমাম ইবনে মাজাহ রহঃ জন্ম গ্রহণ করেছেন ৫৯ বছর পর।

ইমাম নাসায়ী রহঃ জন্ম গ্রহণ করেছেন ৬৫ বছর পর।

ইলমে হাদীসের সাথে সম্পর্ক রাখেন এমন একজন সাধারণ শিক্ষার্থীও জানেন যে, হাদীস সহীহ বা জঈফ হয় মৌলিকভাবে সনদের দুর্বলতার কারণে। আরে অনেক কারণেও হয়, তবে মূল কারণ সনদের দুর্বলতা। অর্থাৎ সনদের মাঝে দুর্বল রাবী থাকার কারণে সহীহ হাদীসও জঈফ হয়ে যায়, এমনকি মুনকারও হয়ে যায়। আর সনদের মাঝে রাবীগণ শক্তিশালী থাকার কারণে হাদীস সহীহ হয়ে থাকে।

আমরা যদি ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করি যে, ইমাম আবু হানীফা রহঃ যখন হাদীসের আলোকে মাযহাব সংকলিত করেন, তখন যে হাদীস সনদের শক্তিশালীত্বের কারণে সহীহ ছিল, উক্ত হাদীসটি ৪০/৫০ বছর পরেও সহীহ থাকা শর্ত কি না? অবশ্যই নয়। কারণ, একটি হাদীস যখন ইমাম আবু হানীফা রহঃ দেখলেন, সে হাদীসটি তার কাছে সহীহ, কারণ তার মাঝে এবং সাহাবীর মাঝে একজন বা সর্বোচ্চ দুইজনের মাধ্যম বিদ্যমান। সেই একজন বা দুইজনও শ্রেষ্ঠ যুগের লোক। তাদের মাঝে হাদীস জঈফ হওয়ার কোন কারণ বিদ্যমান হওয়া প্রায় অসম্ভব। যেখানে ইমাম আবু হানীফা রহঃ নিজেই একজন জাঁদরেল মুহাদ্দিস এবং জারাহ তাদীলের ইমাম। সেখানে তিনি কোন সহীহ হাদীস ছাড়া গ্রহণ করতেই পারেন না। যেমনটি আমাদের গায়রে মুকাল্লিদরাও অকপটে স্বীকার করে প্রচার করে বেড়ায় যে, ইমাম আবু হানীফা রহঃ বলেছেন“যখন হাদীস সহীহ হবে, তখন সেটাই আমার মাযহাব”।

তাই তিনি হাদীসের ভিত্তিতে যেসব মাসআলা বলেছেন, তার সব ক’টিই ছিল সহীহ হাদীস। যেহেতু তার এবং রাসূল সাঃ এর মাঝে মাধ্যম ছিল দুই বা একজন। তাই সনদের মাঝে দুর্বলতা আসা ছিল খুবই দূরের কথা। কিন্তু উক্ত হাদীসটি, যেটাকে ইমাম আবু হানীফা রহঃ সনদ শক্তিশালী হওয়ার কারণে সহীহ হিসেবে মত দিয়ে তার মাঝে নিহিত মাসআলাকে সহীহ সাব্যস্ত করেছেন, ঠিক সেই হাদীসটিই ৪০/৫০ বছর পর সনদের দুর্বলতার কারণে পরবর্তীদের কাছে যেতে পারে।

কারণ ইমাম আবু হানীফা রহঃ এর কাছে যে হাদীস সহীহ হিসেবে এল সনদ শক্তিশালী হওয়ার দ্বারা উক্ত হাদীসটি যদি পরবর্তীতে কোন দুর্বল রাবী বর্ণনা করে, তাহলে উক্ত হাদীসটি উক্ত দুর্বল ব্যক্তির বর্ণনার কারণে যার কাছে বর্ণনা করল, তার কাছে উক্ত হয়ে যাচ্ছে দুর্বল তথা জঈফ। কিন্তু সে হাদীস কিন্তু ইমাম আবু হানীফা রহঃ এর জমানায় সহীহই ছিল। সেটি জঈফ হয়েছে পরবর্তীতে এসে। তাহলে সহীহ থাকা অবস্থায় উক্ত হাদীসের ভিত্তিতে যেহেতু ইমাম আবু হানীফা রহঃ স্বীয় মাযহাব দাঁড় করিয়ে ফেলেছেন, তাই ৪০/৫০ বছর পরের কোন মুহাক্কিকের কাছে জঈফ সুত্রে পৌঁছার কারণে জঈফ মনে হলেও আবু হানীফা রহঃ এর মাযহাব কিন্তু জঈফ হাদীস নির্ভর হয়ে যাচ্ছে না।

আরো সহজভাবে বুঝুন! ইমাম আবু হানীফা রহঃ তাবেয়ী হিসেবে চার জন সাহাবী থেকে সরাসরি হাদীস পেয়েছেন। যথা-

হযরত আব্দুল্লাহ বিন উনাইস রাঃ থেকে।

হযরত আব্দুল্লাহ বিন আবী আওফা রাঃ থেকে।

হযরত আব্দুল্লাহ বিন হারেস রাঃ থেকে।

হযরত মালেক বিন আনাস রাঃ থেকে।

এখন বলুন, এ চারজন থেকে পাওয়া হাদীস বা সুন্নতে নববীতে কোন জুউফ তথা দুর্বলতা পাওয়ার সুযোগ আছে?

তাহলে তাদের বক্তব্যের আলোকে তিনি যেসব মাসআলা তার ফিক্বহে হানাফীতে সংকলিত করেছেন, তা জঈফ হাদীস নির্ভর হয় কি করে?

তবে উক্ত হাদীসগুলোই পরবর্তীতে কোন দুর্বল হাদীস বর্ণনাকারী বলার কারণে দুর্বল হতেই পারে। বিশেষ করে যেখানে ৪০ থেকে ৬০/৭০ বছরের পর।

সুতরাং হানাফী মাযহাবের যেসকল মাসআলা হাদীস নির্ভর। কিন্তু সহীহ হাদীসের উপর নির্ভর করে মাসআলা সংকলিত হওয়ার পর পরবর্তী কোন হাদীস সংকলকের কাছে আসার পর পরবর্তী কোন রাবীর দুর্বলতার কারণে হাদীসটি জঈফ হয়ে গেলেও হানাফী মাযহাবকে দুর্বল হাদীস সম্বলিত বলে এড়িয়ে যাওয়াটা হবে অযৌক্তিক এবং বিবেকশূণ্য মতামত।

তবে কোন মুজতাহিদ এর বিরোধিতা করে ভিন্নমত পোষণ করতে পারেন তার ইজতিহাদী যোগ্যতার কারণে। যেমনটি ইমাম শাফেয়ী, ইমাম মালিক ও ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল রহঃ প্রমূখগণ করেছেন। কোন ইজতিহাদের যোগ্যতা নেই এমন কোন সাধারণ মুসলমানের কোন অধিকার নেই, মনমত একটি মতকে পরবর্তী মুহাদ্দিসের বক্তব্যের আলোকে একটি প্রাধান্য দিয়ে দেয়া। আর মুহাদ্দিস ফক্বীহ ইমামের মতকে ভুল বলে আখ্যায়িত করা। এরকম আচরণ চরম ধৃষ্টতা বৈ কিছু নয়।

মুজতাহিদ ভুল করলেও একটি সওয়াব

عَنْ عَمْرِو بْنِ الْعَاصِ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- « إِذَا حَكَمَ الْحَاكِمُ فَاجْتَهَدَ فَأَصَابَ فَلَهُ أَجْرَانِ وَإِذَا حَكَمَ فَاجْتَهَدَ فَأَخْطَأَ فَلَهُ أَجْرٌ

হযরত আমর বিন আস রাঃ থেকে বর্ণিত। রাসূল সাঃ ইরশাদ করেছেনঃ যখন কোন বিশেষজ্ঞ হুকুম বলতে গিয়ে ইজতিহাদ করে, আর তার ইজতিহাদ সঠিক হয়, তাহলে তার জন্য রয়েছে দু’টি সওয়াব। আর যদি ইজতিহাদে ভুল হয়, তাহলে তার জন্য রয়েছে একটি সওয়াব। {সহীহ বুখারী, হাদীস নং-৬৯১৯, সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-৪৫৮৪, সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং-৩৫৭৬}

মুজতাহিদের অনুসারী মুকাল্লিদের কোন চিন্তার কারণ নেই। অতিরিক্ত পন্ডিতিরও কোন দরকার নেই। কারণ রাসূল সাঃ ঘোষণা অনুযায়ী মুজতাহিদের যদি মাসআলা বলতে ভুলও হয়, তাহলেও তিনি একটি নেকি পাচ্ছেন। আর সঠিক হলে দুইটি নেকি পাবেন।

তাই মুজতাহিদের ইজতিহাদকৃত মাসআলায় চলার দ্বারা সওয়াব পাওয়া নিশ্চিত। চাই একটি হোক বা দুইটি। সওয়াবহীন কখনোই হবে না। তাই ভুলের উর্ধে কেউ নয় একথা সত্য। কিন্তু সবার ভুলেই সওয়াব হবে একথা কিন্তু নেই। কিন্তু মুজতাহিদের ভুলেও সওয়াবের নিশ্চয়তা রয়েছে। তাই মোটা ব্রেইনে চিন্তা করে নিজের ধারণার মতে মুজতাহিদের ভুল সিদ্ধান্ত ধরে নিজের মনগড়া মত মানা, যে ভুলের উপর জাহান্নামী হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে তার দিকে যাওয়াটা কতটুকু যৌক্তিক? সেই হিসেবে মুজতাহিদের সওয়াব নিশ্চিত মতামত মানাটা অধিক যৌক্তিক নয়?

তাই নিজের কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ করে কারো মতকে খেয়ালখুশি মত প্রাধান্য দেয়ার মানসিকতা ভ্রান্তিতা ছাড়া আর কিছু নয়।

যাকে ইচ্ছে তাকে মানা শরীয়তের অনুসরন নয় মন পূজা

যখন যে ইমামকে ইচ্ছে তাকে মানার প্রবণতা দ্বীনে শরীয়তের পাবন্দী হবে না, হবে কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ। মন যখন চাইবে ইমাম আবু হানীফার অনুসরণ করা, আবার মন যখন চাইবে ইমাম শাফেয়ী রহঃ এর মতকে অনুসরন করা, কিংবা অন্য কোন ইমামের অনুসরণ করা এটা দ্বীনে শরীয়তের আনগত্ব হবে? না মন আর খাহেশাতের আনুগত্ব হবে?

যখন মন চাইল ইমাম আবু হানীফা রহঃ এর মাযহাব অনুসরণ করে বলে দিলেন যে, মহিলাদের স্পর্শ করলে অজু ভাঙ্গবে না। আর ইমাম শাফেয়ী রহঃ এর বক্তব্য যে, মহিলা স্পর্শ করলে অজু ভেঙ্গে যায়, মতটিকে ছেড়ে দিলেন সুযোগের সদ্ব্যবহার করার জন্য।

আবার কিছুক্ষণ পর হাত কেটে গেল, এবার যখন দেখা গেল যে, ইমাম আবু হানীফা রহঃ এর মাযহাব অনুপাতে অজু ভেঙ্গে গেছে, আর ইমাম শাফেয়ী রহঃ এর মতে অজু ভাঙ্গেনি। তখন সাথে সাথেই মাযহাব পাল্টে বলতে শুরু করে দিলেন যে, না, না আমি হানাফী না, আমি শাফেয়ী। তাই আমার অজু ভাঙ্গেনি।

এভাবে প্রতিটি মাসআলায় স্বীয় খাহেশাত অনুযায়ী মত পাল্টাতেই থাকলে এর নাম দ্বীন মানা? না মনপূজা?

এ কারণেই শায়েখ ইবনে তাইমিয়া রহঃ বলেনঃ “লাগামহীনভাবে যে মাযহাব যখন মনে চায়, সেটাকে মানা সুষ্পষ্ট হারাম ও অবৈধ। {ফাতাওয়া ইবনে তাইমিয়া-২/২৪১}

সাত কিরাতের এ কিরাতে কুরআন পড়ার বিধান যেমন চার মাযহাবের এক মাযহাব তেমনি

কুরআন নাজিল হয়েছিল সাত কিরাতে। যার এক কিরাত অন্য কিরাতের সাথে মতভেদ ছিল। হযরত উসমান রাঃ এর আমলে সাত কিরাতের মাঝে এক কিরাতকে আবশ্যক করে দেয়া হয়েছে। বাকি ৬ কিরাতকে নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়েছে। যে কিরাতটি ছিল আসেম কুফী রহঃ এর কিরাত। মক্কা মদীনার কারীদের কিরাত রেখে হযরত উসমান রাঃ কুফার কারীর কিরাত হিসেবে কুরআন পড়ার সারা পৃথিবীর মুসলমানদের জন্য আবশ্যকীয় করে দিলেন।

এর একটাই কারণ ছিল, সেটি হল, বিশৃংখলা রোধ করা। আর মনের খাহেশাত পূজা বন্ধ করা। কারণ সাত কিরাত চালু থাকলে, কুরআন সম্পর্কে মানুষের অজ্ঞতা কারণে আন্দাজে একটি কিরাতের বিকৃত অর্থ করে মানুষ আমল করতে থাকতো। এক স্থানে এক আয়াত একভাবে তিলাওয়াত করতো, অন্য স্থানে গিয়ে মন চাইলে কিরাতে স্টাইল পাল্টে মানুষকে বিভ্রান্ত করতো। এরকম বিভ্রান্তির পথকে রুদ্ধ করার জন্য বাকি ৬ কিরাতকে হযরত উসমান রাঃ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে দেন।

ঠিক তেমনিভাবে চার মাযহাবের অবস্থা। যদি সবাইকে বলা হয় যে, তোমাদের গবেষণা অনুযায়ী যে মাযহাবের যে বক্তব্য ভাল লাগে সে বক্তব্যকে গ্রহণ করবে, তাহলে অধিকাংশ মানুষ যেখানে কুরআন হাদীস সম্পর্কে অজ্ঞ, সেসব মানুষ বাংলা আর অনুবাদ পড়ে যখন যে ইমামের বক্তব্যকে সহজ আর নিজের মনের মত পাবে, তা গ্রহণ করতো, আর যেটাকে ইচ্ছে ছেড়ে দিতো। আবার যখন মনে চায় আরেকজনের গ্রহণ করতো। এভাবে দ্বীনে শরীয়তকে একটি ছেলেখেলা বানিয়ে ফেলতো। তাই চতুর্থ শতাব্দির উলামায়ে কেরাম এ লাগামহীনতার পথকে রুদ্ধ করে দিলেন। উম্মতের ইজমা হয়ে গেছে যে, এ ৪র্থ শতাব্দির পর থেকে লাগামহীনভাবে যখন যে মাযহাব ইচ্ছে সে মাযহাব মানা যাবে না। সুনির্দিষ্টভাবে একটি মাযহাবকে মানতে হবে। {আলইনসাফ-৫২, ৫৭-৫৯, মাদারে হক-৩৪১, ইন্তিসারুল হক বজওয়াবে মিয়ারে হক-১৫৩, আলমুআফাকাত-৪/১৪৬, আলমাজমূহ শরহুল মুহাজ্জাব-১/৯১}

দলীলের ভিত্তিতে কারো মত প্রাধান্য দেয়ার যুক্তির জবাব ইতোপূর্বেই অতিক্রান্ত হয়েছে। অর্থাৎ ঠিক কার দলীল সঠিক, কোনটি সহীহ হাদীসের উপর নির্ভরশীল, আর কোনটি জঈফ হাদীসের উপর নির্ভরশীল। তা আল্লাহ ও রাসূল সাঃ থেকে বর্ণিত নয়। তাই উম্মতীর কথা শুনতে হয়। আর উম্মতীদের মাঝে সবচে’গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি তারাই হতে পারেন, যারা মুহাদ্দিস হওয়ার সাথে সাথে ফক্বীহ। যারা শুধু হাদীসের শব্দ জানেন, তারা কখনোই মুহাদ্দিস ফক্বহী মুজতাহিদের উপর প্রাধান্য পেতে পারে না।

তাই যে এলাকায় যে মাযহাব উসুল ও ফুরূ তথা মূলনীতি ও শাখাগত মাসায়েলসহ মুতাওয়াতিসূত্রে পৌঁছেছে সে সকল এলাকার মানুষের উপর উক্ত মাযহাব অনুযায়ী আমল করা উচিত। তাহলেই আর কোন সমস্যা থাকার কথা নয়। হাদীসের ইবারত শুদ্ধ করে না পড়তে পারলেই নিজেই মুজতাহিদ দাবি করে বসাটা পাগলের প্রলাপ ছাড়া আর কিছু হবে না।


মাযহাব নিয়ে এ লেখাটি পড়তে পারেন একটি সরল মূল্যায়ন: কুরআন-সুন্নাহ থাকতে মাযহাব কেন ?



অন্ধ তাক্বলীদ কাকে বলে?

আজ কালের অতি পন্ডিত গায়রে মুকাল্লিদ ভাইয়েরা বলে বেড়ান যে, মুজতাহিদদের অনুসরণে দ্বীনের অনুসরণ করা নাকি অন্ধ তাকলীদ।

আফসোস! এই বেচারারা অন্ধ তাকলীদের অর্থও জানেনা। অন্ধ তাকলীদ এটাকে বলে, যেখানে অন্ধ অন্ধের পিছনে চলে। তখন উভয়ে কোন গর্তে নিপতিত হয়। এটা অন্ধ তাকলীদ। আর যদি অন্ধ দৃষ্টিবান মানুষের পিছনে চলে, তো এই দৃষ্টিবান ব্যক্তি এই অন্ধকেও তার চোখের বরকতে সকল গর্ত থেকে বাঁচিয়ে নিয়ে যাবে। আর মানজিলে মাকসাদে পৌঁছিয়ে দিবে।

আইয়িম্মায়ে মুজতাহিদীন (নাউজুবিল্লাহ) অন্ধ নয়। তারা দৃষ্টিবান। তারা কুরআন সুন্নাহ ও সাহাবাদের ফাতওয়া ও জীবনাচার সম্পর্কে, সেই সাথে আরবী ভাষাসহ ইলমী সকল বিষয়ে প্রাজ্ঞ ও গভীর দৃষ্টির অধিকারী। তাদের ভুল হলেও একটি সওয়াব আর সঠিক হলে দুইটি সওয়াব হবে মর্মে হাদীসে স্পষ্ট ঘোষণা এসেছে।

তবে অন্ধ ব্যক্তি আছে। আছে অন্ধ মুকাল্লিদও। যারা নিজেরাও অন্ধ। তাদের পথিকৃত ও অন্ধ। অর্থাৎ তাদের ইজতিহাদের চোখ নাই। এই জন্যই নবীজী সাঃ বলেছেন যে, যে মুর্খকে দ্বীনের পথিকৃত বানায়, সেই মুর্খ নিজেও গোমড়া হয়, আর তার অনুসারীদেরও গোমড়া করে। এর নাম অন্ধ তাকলীদ।

আল্লাহ তায়ালা নিষ্পাপ নবী সাঃ  আর পূণ্যবান মুজতাহিদীনদের গবেষণা-সম্পাদনার উপর আমলে করার তৌফিক দান করুন। আর নব্য নব্য ফেতনা থেকে হিফাযত করুন।

আল্লাহ তাআলা আমাদের হককে বুঝার, এবং বাতিলকে বাতিল বুঝার তৌফিক দান করুন। সেই সাথে মুখরোচক স্লোগানের আড়ালে শয়তানের ঈমান বিধ্বংসী বক্তব্যের অনুসরণ থেকে পুরো মুসলিম জাতিকে হিফাযত করুন। আমীন। ছুম্মা আমীন।

والله اعلم بالصواب

বিটকয়েন — পরিচিতি ও শরঈ পর্যালোচনা

বিটকয়েন: ‘বিটকয়েন’ বর্তমানে আলোচিত একটি ক্রিপ্টোকারেন্সি (Cryptocurrency)। ‘ক্রিপ্টো’ মানে অদৃশ্য, গোপন, সিক্রেট। কারেন্সি মানে মুদ্রা। সহজে বললে এমন একটি মুদ্রা, যা  অদৃশ্য, সংকেত বা নাম্বারের মাধ্যমে প্রকাশ পায়, এর না আছে নিজস্ব বস্তুগত কোন আকার, না তা স্পর্শযোগ্য। তেমনিভাবে এর না আছে নিজস্ব কোন মূল্যমান বা ফায়দা (Intrinsic Value)।

আর ‘বিটকয়েন’-এ bit শব্দের অনেক অর্থ। যেমন, টুকরো, ছোট অংশ, অল্প, কিছুক্ষণ। এর আরেক অর্থ, কম্পিউটারে ব্যবহৃত সংক্ষিপ্ততম তথ্য। এখানে শেষোক্ত অর্থই উদ্দেশ্য। যেহেতু এটি কম্পিউটারের ক্ষুদ্র তথ্যকে ব্যবহার করে তৈরি হয়, তাই একে ‘বিটকয়েন’ বলা হয়।

ইন্টারনেটে ক্রিপ্টোকারেন্সি অনেক আছে। যেমন, Ripple, Ethereum ইত্যাদি। এসবের মধ্যে বর্তমানে ‘বিটকয়েন’ সর্বপ্রথম ও সবচেয়ে আলোচিত ক্রিপ্টোকারেন্সি। এসব ক্রিপ্টোকারেন্সির কিছু কমন বৈশিষ্ট্য রয়েছে, এবং কিছু নিজস্ব বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা কারেন্সির প্রস্তুতকারীগণ নির্ণয় করে থাকেন। আমাদের বক্ষ্যমাণ আলোচনা কেবল বিটকয়েন নিয়ে, যার সাথে অন্যগুলোর কিছু পার্থক্য আছে, এবং যা শরঈ বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে লক্ষ্য রাখা জরুরী।

বিশেষজ্ঞদের মতে, বিটকয়েন মূলত একটি ক্রিপ্টোকারেন্সি, যা ভার্চুয়াল মুদ্রা। এর শারীরিক(Physical) বৈশিষ্ট্য নেই। স্পর্শযোগ্য নয়। নিজস্ব কোন মূল্যও (Intrinsic Value) নেই।

এটি বিশেষ হার্ডওয়্যার দ্বারা নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় সংকেত আকারে তৈরি হয়। অন্য কথায়, এটি একটি ভার্চুয়াল টোকেন, যাকে এর প্রস্তুতকারীগণ বিনিময়ের মাধ্যম বা মুদ্রা হিসেবে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে তৈরি করেছেন। অন্য যে কোনো পন্যের ন্যায় বিটকয়েনেরও চাহিদা ও যোগানের ভিত্তিতে অন্যান্য ফেইথ (Faite) মুদ্রার সাথে এর মূল্যমান কম-বেশি হয়ে থাকে।

২০০৮ইং সনের নভেম্বরে এক অজ্ঞাত সংস্থা বা ব্যক্তি কর্তৃক একটি আর্টিকেল প্রকাশিত হয়।

যার ছদ্ম নাম ‘সাতোশী নাকামোতো (Satoshi Nakamoto)’। এই আর্টিকেলের ভিত্তিতে ২০০৯ইং সনের জানুয়ারীতে প্রথম বিটকয়েনের ঘোষণা দেয়া হয়। ধারণা করা হয় এই ছদ্মনাম বিশিষ্ট ব্যক্তি সর্বোচ্চ ২১ মিলিয়ন বিটকয়েনের মধ্যে মাত্র ৫% উৎপন্ন করেছে। এটি করা হয়েছে মাইনিং পদ্ধতি ব্যবহার করে।

cryptocurrency-ripple-bitcoin

যেভাবে বিটকয়েন তৈরি হয়

কাগুজে মুদ্রা তৈরি হয় টাকা ছাপানোর মেশিনে। সরকার একে অনুমোদন করে। নিয়ন্ত্রন করে। এভাবে এতে সৃষ্টি হয় ক্রয়-ক্ষমতা (Purchasing power)। কিন্তু বিটকয়েন তৈরি হয় সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে। এটি তৈরির প্রধান উৎস-‘ব্লক চেইন (Block chain) নামক এক উন্নত প্রযুক্তি। প্রযুক্তিটি আবিষ্কার হয়েছে ১৯৯১ইং সনে।

ব্লকচেইন (Block chain) একটি প্রযুক্তিগত ফ্রেমওয়ার্ক, যার ওপর বিটকয়েন তৈরি করা হয়েছে। ব্লক চেইন একটি চমৎকার প্রযুক্তি। সংক্ষেপে তার বিবরণ দেয়া হল।

ব্লক চেইন প্রযুক্তিঃ সাধারণত আমরা আরেক জনের কাছে টাকা পাঠাই তৃতীয় কোন মাধ্যমে। যেমন, ব্যাংক, পোস্ট অফিস ইত্যাদি। তদ্রুপ জমির মালিকানা হস্তান্তর করি ভূমি অধিদপ্তরের মধ্যস্থতায়। এসব তৃতীয় পক্ষ লেনদেনে মধ্যস্থতা করার পাশাপাশি অর্থ-সম্পদের নিরাপত্তাও প্রদান করে।

আমাদের লেনদেনের যাবতীয় তথ্য তাদের নিকট সংরক্ষিত থাকে। এই মাধ্যমগুলো ব্যবহারের অনেক সুবিধার মাঝে তিনটি অসুবিধাও আছে। যথা-এক. অতিরিক্ত ফি দিতে হয়। দুই. লেনদেন সম্পন্ন হতে অতিরিক্ত সময় ক্ষেপণ হয়। তিন.তৃতীয় পক্ষের নিকট সকল ডাটা চলে যায়। মূলত এই অসুবিধাগুলো দূর করতে আবিস্কৃত হয়েছে ইন্টারনেট ভিত্তিক এক বিশেষ ব্লক চেইন প্রযুক্তি। এর দুটি অংশ। যথা-

ক.Open Ledger বা উন্মুক্ত খাতা।

ইন্টারনেটে ব্লক চেইন প্রযু্িক্ত ব্যবহার করে যখন কেউ কারো নিকট অর্থ বা অন্য কোন তথ্য পাঠায়, তখন ব্লক চেইন নেটওয়ার্কে যারা লেজার মেইন্টেইন করে তাদের লেজারে সেই ডাটাগুলো ব্লক হয়ে  যুক্ত হয়। যেমন-A-b-C-d-e-F। ধরা যাক A ১০০ টাকা পাঠিয়েছে b এর নিকট। তদ্রুপ b কিছু পাঠিয়েছে C এর নিকট। এভাবে প্রত্যেকে তার পরের জনের নিকট কিছু অর্থ পাঠিয়েছে। এই পাঠানো তথ্যগুলো জমা হবে তাদের নিকট যারা লেজার মেইন্টেইন করে।

এখানে বড় হাতের ইংরেজী অক্ষর হল সেই লেজার মেইন্টেইনকারী। পরিভাষায় তাদেরকে Minersও বলা হয়। মনে রাখতে হবে, এখানে যে লেনদেনগুলো হল, এগুলো করার সাথে সাথে পূর্ণতায় পৌঁছে না। তথা সাথে সাথে বাস্তবেই অর্থ স্থানান্তর হয় না। বরং লেনদেনটি করা মাত্রই একটি ব্লক তৈরি হয়। উক্ত ব্লকে প্রতি দশ মিনিটের মধ্যে যেসব ট্রাঞ্জাকশন হয়, তা রেকর্ড হয়ে যায়।

খ. Distributed Ledger।

উক্ত ব্লক তৈরি হওয়ার পর সেটা ব্লক চেইন নেটওয়ার্কে ছড়িয়ে যায়, এবং পৃথিবীজুড়ে হাজারো কপি তৈরি হয়। তখন সেটা উপরোক্ত প্রত্যেক মাইনারের লেজারে ব্লক হিসেবে এসে যায়। কিন্তু এতেই উক্ত ট্রাঞ্জাকশন Validate হয়নি। অর্থাৎ বাস্তবেই অর্থ স্থানান্তর হয়নি। এখন তাকে Validate করার জন্য সকল মাইনার একযোগে ঐ ব্লক নিয়ে কাজ শুরু করে। তাকে সল্ভ করতে চেষ্টা করে। তাদের কেউ যখন সেটা সল্ভ করে ফেলে তখন ট্রাঞ্জাকশনটি Validate হয়। অর্থাৎ তখন বাস্তবেই যার কাছে টাকা পাঠানো হল সে সেটা পেয়ে যায়। এই সমাধিত ব্লকটি একটি ফাইনাল ব্লক।

এবার এই ব্লকটি প্রত্যেকে মাইনারের নিকট রেকর্ডকৃত পূর্বের সমাধিত ব্লকের সাথে জুড়ে যায়। অনেকটা চেইনের মত। একটির পেছনে আরেকটি জুড়ে। এজন্য একে ব্লক চেইন বলা হয়।

উল্লেখ্য, প্রতিটি সমাধিত ব্লকে তিনটি বিষয় থাকে। যথা-ডাটা, হ্যাশ ও পূর্বের ব্লকের হ্যাশ। হ্যাশ হল, বিশেষ অ্যালগরিদম বা বিশেষ ম্যাথ জাতীয় বিষয়। সেই ম্যাথ সলূশন করা হলে তাকে হ্যাশ বলে। এই হ্যাশটা পূর্বের সমাধিত ব্লকের সাথে মিলতে হবে। তবেই ফাইনাললি ব্লকটি সমাধিত হবে। সর্বপ্রথম যে মাইনর সমাধান করতে পারবে সে বিটকয়েন লাভ করবে।

এসব কাজের মধ্য দিয়েই তার জন্য অটো  বিটকয়েন ক্রিয়েট হয়ে যাবে। বর্তমানে প্রায় প্রতি দশ মিনিটে একটি ব্লক সল্ভ হয়ে যায়। এসব মাইনিং-এর জন্য বেশ পাওয়ারফুল কম্পিউটার ও বিশেষ মেশিনের প্রয়োজন হয়। অনেক বিদ্যুৎ খরচ হয়। মোটা অংকের টাকা এসব খাতে ইনভেষ্ট করতে হয়।

blockchain bitcoin

বিটকয়েন ও একটি উদাহরণ

আমাদের দেশে বিভিন্ন শপিং মলে এরূপ প্রচলন আছে যে, কোন পণ্য ক্রয় করা হলে একটি পয়েন্ট দেয়া হয়। এটি একটি সংখ্যা। ভার্চুয়াল টোকেন। এই পয়েন্ট যখন একটি নির্ধারিত পরিমাণে পৌঁছে, তখন তা দিয়ে ঐ দোকান থেকে কোন কিছু ক্রয় করা যায়। এর অর্থ এই ভার্চুয়াল পয়েন্টকে একটি বিনিময়ের মাধ্যমের মর্যাদা দেয়া হয়েছে। বিটকয়েন  কনসেপ্ট অনেকটাই এরূপ। একটি সংখ্যা। যা মাইনিং করার পর মাইনর পেয়ে থাকে। মাইনিং-এ উদ্বুদ্ধ করার জন্য এই  ভার্চুয়াল টোকেনকে বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে একটি বিশেষ মর্যাদা দেয়া হয়েছে। যার মূল্য ডিমান্ড অনুযায়ী বাড়ে-কমে।

ব্লক চেইনের বিস্তৃতিঃ ব্লক চেইট প্রযুক্তি মূলত সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য তৈরি হয়েছে। যেমনটি আমরা পূর্বে উল্লেখ করেছি। তাই এ প্রযুক্তি শুধু বিটকয়েন উৎপন্নে ব্যবহৃত হচ্ছে বিষয়টা এমন নয়। জমির দলিল সংরক্ষণের জন্যও এর ব্যবহার চিন্তা করা হচ্ছে। এমনটিক এর মাধ্যমে যাকাত সংগ্রহ ও আদায়ের চিন্তাও চলমান।

নিরাপত্তাঃ উক্ত প্রযুক্তিতে সকল ডাটা অগণিত মাইনিংকারীদের লেজারে সংরক্ষিত থাকে। ফলে সেটা হ্যাক করতে হলে একই সময় অগণিত কম্পিউটার হ্যাক করতে হবে, যা প্রায় অসম্ভব। এজন্য বলা হয়, এটি সেন্ট্রালাইজড মাধ্যম থেকেও নিরাপদ।

তবে হ্যাক হওয়াটা অবাস্তব নয়। ইতোমধ্যে কয়েকবার বিভিন্ন বিটকয়েন এক্সচেঞ্জ বা ওয়ালেট হ্যাক হয়েছে, ফলে হাজারো বিটকয়েন মজুদকারী ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। অপরদিকে পুরো পৃথিবীর মাইনারদের নিয়ন্ত্রণ করছে কয়েকটি বড় মাইনিং প্রতিষ্ঠান, যারা ৫০% এর বেশি

মাইনিং করে থাকে। অনেকে তাদেরকে বিটকয়েনের সেন্ট্রাল ব্যাংক বলে অভিহিত করে থাকে। বিশেষজ্ঞদের মতে, তারা একত্রিত হয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে চাইলে তা অসম্ভব নয়।

বলাবাহুল্য, বিটকয়েন একটি ভার্চুয়াল মুদ্রা, যা সংরক্ষিত থাকে ভার্চুয়াল ওয়ালেটে। কাজেই ওয়ালেটের নিরাপত্তা সংরক্ষণের উপরও ব্যক্তির সংগৃহীত বিটকয়েনের নিরাপত্তা নির্ভর করে।

বিটকয়েন মাইনিংঃ Mining শব্দের মূল অর্থ: মাটি খুঁড়ে মূল্যবান সম্পদ বের করা বা আবিষ্কার করা। এখানে বিশেষ এ্যলগরিদম সল্ভ করার মাধ্যমে মূল্যবান বিটকয়েন লাভ হয়। তাই একে মাটি খুঁড়ে মূল্যবান সম্পদ বের করার সাথে তুলনা করে ‘মাইনিং’ বলা হয়েছে। যারা এই কাজটি করেন, তাদেরকে বলা হয়-‘মাইনর’(Miner)।

বিটকয়েন মাইনিং এর প্রধান উদ্দেশ্য হল, দু’জন লেনদেনকারীর মালিকানা যথাযথভাবে ট্রান্সফার করাকে নিশ্চিত করা। এই নিশ্চিতকরণটা পূর্বোক্ত পন্থায় যে আগে করতে পারবে সেই  কিছু বিটকয়েন লাভ করবে।

এভাবে ২১ মিলিয়ন বিটকয়েন একক তৈরি করা যাবে। এভাবেই উক্ত প্রযুক্তির প্রোগ্রাম সেট করা আছে। এরপর আর নতুন করে বিটকয়েনের কোন একক তৈরি করা সম্ভব হবে না। (অর্থাৎ তখন আক্ষরিক অর্থেই মাইনিং বন্ধ হয়ে যাবে)। তবে উক্ত প্রযুক্তি ব্যবহার করে অর্থ লেনদেনের সত্যায়নের কাজ মাইনিংকারীরা করে যাবে আগের মতই। তখন বিটকয়েনের বহু ক্ষুদ্র একককে কাজে লাগানো হবে। বিশেষজ্ঞরা তাই বলছেন।

বিটকয়েন সংগ্রহঃ বিটকয়েন মূলত দুটি পন্থায় সংগ্রহ করা হয়। যথা-এক. মাইনিং করে। এর বিবরণ পূর্বে দেয়া হয়েছে। দুই.ক্রয় করে। যার কাছে বিটকয়েন আছে সেটা কাগুজে মুদ্রায় ক্রয় করা। বিটকয়েন সংগ্রহের জন্য দ্বিতীয়টিই এখন পর্যন্ত বহুল ব্যবহৃত মাধ্যম। একেই বলা হয় ‘বিটকয়েন

ইনভেষ্ট’। বলা বাহুল্য, বিটকয়েন সংগ্রহের দুটি মাধ্যমই বেশ প্রতারণাপূর্ণ। বহু মানুষের টাকা খোয়া গেছে।

বিটকয়েন সংরক্ষণঃ ইলেক্সট্রনিক বিশেষ পন্থা তথা E-Wallet এর মাধ্যমে বিটকয়েন সংরক্ষণ করা হয়। এর মাধ্যমে বিটকয়েন বেচা-কেনাও করা হয়।  কয়েকটি প্রসিদ্ধ ই-ওয়ালেট হল-Computer Wallets: এর মাধ্যমে বিটকয়েন প্রেরণ করা, গ্রহণ করা সবই সম্ভব। Phone Wallets: এটি অনেকাংশেই প্রথমটির মত। এর মাধ্যমে ঘঋঈ (NFC (Near field communication) টেকনোলজি ব্যবহার করে ক্রয়কৃত বিভিন্ন পণ্যের দামও শোধ করা যায়। Web wallets: বিটকয়েন ব্যবহারকারী এর মাধ্যমে নির্ধারিত সাইটে প্রথমে রেজিষ্ট্রেশন করতে হয়।
এটি অনেকটা ই-মেইল খোলার মত। এরপর নির্ধারিত একাউণ্ট খোলে তাতে বিটকয়েন সংরক্ষণ করা হয়। Hardware wallets: এটি ছোট একটি মেশিন জাতীয়। যার কাজই হল বিটকয়েন সংরক্ষণ করা। অন্য কোন কাজ নয়। এতে অন্য কোনও প্রোগ্রাম আপলোড করা যায় না। ইলেক্ট্রনিক চুরির ক্ষেত্রে এটি পূর্বের সকল পন্থার চেয়ে অনেক বেশি নিরাপত্তা দান করে।

বিটকয়েন ও অবৈধ কার্যকলাপ: বিটকয়েন সেন্ট্রালাইজড না হওয়ায় এর মাধ্যমে রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপ অনেক সহজ। ব্লকচেইন প্রযুক্তিটি প্রতিটি তথ্য অজ্ঞাতনামে সংরক্ষণ করে, ফলে বিটকয়েনের প্রেরক ও প্রাপক কে তা নির্দিষ্ট করা যায় না।
সুতরাং অর্থপাচার, (Money laundering), টেক্স/কর ফাঁকি দেয়া, ফটকাবাজী (Speculations), শুল্ক ফাঁকি দিয়ে আমদানি-রপ্তানি (Smuggling), অস্ত্রের ব্যবসা ইত্যাদি যাবতীয় রাষ্ট্রীয় আইন বহির্ভূত  ও শরীয়াহ্ পরিপন্থী কার্যকলাপ অনায়েসেই করা যায়।

ইসলামিক ইকনোমিক ফোরাম তাদের বিটকয়েন বিষয়ক গবেষণায় লিখেছে-অস্ট্রেলিয়ার জনৈক গবেষক তার গবেষণায় দেখিয়েছেন যে, এর মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় আইন বহির্ভূত কার্যকলাপ (অস্ত্রের ব্যবসা ইত্যাদি) এর হার ৫০%।

বিটকয়েন bitcoin

বিটকয়েনের শরঈ পর্যালোচনা

ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক মানের কয়েকটি ইসলামিক প্রতিষ্ঠান থেকে বিটকয়েন বিষয়ে শরঈ পর্যালোচনা পেশ করা হয়েছে। তন্মধ্যে অন্যতম হল, তুরস্কের ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রনালয়, মিশরের কেন্দ্রীয় ফতোয়া বিভাগ, ফিলিস্তিনের কেন্দ্রীয় ফতোয়া বিভাগ, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিদ্যাপিঠ দারুল উলূম দেওবন্দের ফতোয়া বিভাগ ও ইসলামিক ইকনোমিক ফোরাম নামক শারিয়াহ স্কলারদের একটি অনলাইন গ্রুপ।

শেষোক্ত ফোরাম এ বিষয়ে ফকীহদের নিয়ে মতবিনিময় মজলিস অনুষ্ঠিত করেছে। এরপর ফোরামের পক্ষ থেকে বিটকয়েন বিষয়ে যৌথ শরঈ পর্যালোচনা পেশ করা হয়েছে। ৩১ পৃ. ব্যাপী তাঁদের গবেষণামূলক যৌথ শরঈ পর্যালোচনাটি আরবী ভাষায় গত ১১/১/২০১৮ইং তারিখে ‘ইন্টারন্যাশনাল শরীয়াহ্ রিসার্চ একাডেমী ফর ইসলামিক ফিন্যান্স (ISRA)’ মালয়েশিয়ার অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে (https://www.isra.my/) ও অনলাইন ভিত্তিক  ‘ইসলামিক ইকনোমিকস এন্ড ফিন্যান্স পিডিয়া’-এর ওয়েব সাইটে (http://iefpedia.com/arab/?p=40129) প্রকাশ হয়েছে।

উক্ত গবেষণাটি ইসলামী অর্থনীতি জগতে এ বিষয়ে বিশদ প্রথম সম্মিলিত শরঈ আলোচনা । বক্ষ্যমাণ লেখার একটি প্রধান উৎস উক্ত গবেষণা।

উল্লেখ্য, ইতোমধ্যে বিভিন্ন ভাষায় গবেষণাটির অনুবাদের কাজ চলছে। আমাদের জানামতে এর মূল আরবীর উপর নির্ভর করে প্রথম অনুবাদটি সম্পন্ন হয়েছে বাংলা ভাষায় । অনুবাদটি করেছে বাংলাদেশের ইসলামিক ফাইন্যান্স একাডেমি এন্ড কনসালটেন্সি (আই. এফ. এ. সি.)।

বর্তমান পর্যন্ত বিটকয়েন বিষয়ে শরঈ যে মতামতগুলো প্রকাশিত হয়েছে, এগুলো মোট তিন ধরনের। যথা-

ক. বিটকয়েনের ব্যবহার বৈধ নয়, ঠিক নয়। (যথাক্রমে মিশরের কেন্দ্রীয় ফতোয়া বিভাগ, দেওবন্দের ফতোয়া ও তুরস্কের ধর্ম মন্ত্রনালয়) কেউ হারামও বলেছেন (ফিলিস্তিনের কেন্দ্রীয় ফতোয়া বিভাগ)
খ. বিটকয়েনের ব্যবহার শর্তসাপেক্ষে মৌলিকভাবে বৈধ। (ইসলামিক ইকনোমিক ফোরামের পূর্বোক্ত গবেষণায় অজ্ঞাতভাবে নাম ছাড়া এ মতামত উল্লেখ করা হয়েছে)
গ. এর থেকে বেঁচে থাকাই সতর্কতা। (এটি মালেকী মাযহাবের আন্তর্জাতিক কনফারেন্সের কতকের মত)

উপরোক্ত শরঈ পর্যালোচনায় বিটকয়েনের যে প্রসঙ্গগুলো গুরুত্বের সাথে আলোচনায় এসেছে, সংক্ষেপে তা হল-
১.বিটকয়েন প্রকাশকের অজ্ঞতা।
২.এর ভবিষ্যত বিষয়ে অজ্ঞতা।
৩.এর প্রাতিষ্ঠানিক কোন প্রকাশক নেই। যিম্মাদারও নেই।
৪.রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে তত্ত্বাবধান ও পর্যবেক্ষণ নেই।
৫.এতে ব্যাপকভাবে স্প্যাকুলেশন হয়। এর মূল্য স্থীর থাকে না।
৬.আইন বহির্ভূত কাজে অধিক ব্যবহার হওয়া।
৭.উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যের কারণে এটি শরীয়তের দৃষ্টিতে মূল্যমান বিশিষ্ট (মালে মুতাকাওয়্যিম) হবে কি না।

যারা একে নাজায়েয বলেন, তাদের মতে বিটকয়েনে উপরোক্ত ১-৬টি বৈশিষ্ট্য থাকায় সেটি শরীয়তের দৃষ্টিতে মূল্যমান বিশিষ্ট (মালে মুতাকাওয়্যিম)   কিছু নয়। তাই এটি জায়েয নয়। বর্তমান পর্যন্ত এ মতের প্রবক্তার সংখ্যাই অধিক।

আরো সংক্ষেপে বললে, তাঁদের আলোচনায় বিটকয়েন শরঈভাবে নিষিদ্ধ হওয়ার মৌলিক কারণ তিনটি। যথা-
১.গারার (Uncertainty), জাহালাহ (অজ্ঞতা) ও গ্যামব্লিং। মূলত বিটকয়েনের প্রকাশকের অজ্ঞতা, এর ভবিষ্যত বিষয়ে অজ্ঞতা, এটি সেন্ট্রালাইজড না হওয়া, তত্ত্বাবধান ও পর্যবেক্ষণ না হওয়া থেকেই এসব গারার ও জাহালাহ-এর সৃষ্টি।
২. নিষিদ্ধ কাজের মাধ্যম হওয়া।
৩.উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যসমূহের কারণে শরীয়তের দৃষ্টিতে এটি মূল্যমান বিশিষ্ট সম্পদ না হওয়া।

অপরদিকে যারা বিটকয়েনকে বৈধ বলতে চান, তাঁদের মূল যুক্তি হল-

১.প্রত্যেক জিনিষের মূল হল মুবাহ হওয়া।
২.বিটকয়েনের মাধ্যমে কেনা-বেচা হয়। এর মাধ্যমে অন্যান্য পণ্যের মালিকানা অর্জন হয়। সুতরাং এটি শরীয়তের দৃষ্টিতে মূল্যমান বিশিষ্ট (মালে মুতাকাওয়্যিম) হবে।
৩.এর মধ্যে সাধারণ কারেন্সি হওয়ার যে গুণ থাকা দরকার তা আছে। যদিও তা সরকারের পক্ষ থেকে প্রকাশিত নয়।

প্রথমোক্ত বক্তব্যের জবাবে তারা বলেন, এসব মৌলিক সমস্যা নয়। নিষিদ্ধ কাজ অন্যান্য কারেন্সির মাধ্যমেও হতে পারে। আর সরকারের তত্ত্বাবধান ও সেন্ট্রালাইজড-এর মূল লক্ষ্য হল, নিরাপত্তা দান। ব্লক চেইন প্রযুক্তি এক্ষত্রে সেই নিরাপত্তা নিশ্চিত করে।

আমাদের দৃষ্টিতে এখানে যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ, তা হল, বিটকয়েন শরঈ দৃষ্টিতে কারেন্সি কি না। অর্থনীতিবিদ ও ফকীহদের দৃষ্টিতে মুদ্রার চারটি বৈশিষ্ট্য ও অর্থনৈতিক কাজ (Economic  Activities) রয়েছে। যথা-

১। Medium of Exchange: এর সারকথা হল, যে জিনসটি মুদ্রা হবে তার প্রধান বৈশিষ্ট্য হবে-যেকোন কিছু ক্রয়-বিক্রয়ে বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে তা কাজ করবে।

২। Widely Acceptable: এর সারকথা হল, যে জিনিষটি মুদ্রা হবে সেটার জন্য জরুরী হল-তা ব্যাপকভাবে কোনও প্রকার দলীল-প্রমাণ ছাড়া গ্রহণযোগ্য হওয়া। এর বিপরীতে কাংখিত বস্তু দিতে প্রস্তুত হওয়া। এর জন্য একটি অন্যতম শর্ত হল, দেশীয় আইনে তা অস্বীকার না করা।

৩। Standard of Value/Measure of Value: এর সারকথা হল, কাপড়ে দীর্ঘতা মিটার বা গজে মাপা হয়। চাউল-গমের পরিমাণ ওযনের মাধ্যমে জানা যায়। তেমনি এসব বস্তুর ভেল্যু পরিমাপ করার মাধ্যম হল মুদ্রা। অর্থাৎ যে জিনিষটি মুদ্রা হবে  তার মধ্যে এই গুণ থাকতে হবে যে, এর মাধ্যমে বস্তুসমূহের ভ্যল্যু সহজেই নির্ণয় করা সম্ভব হবে।  যেমন, বলা হয় ঘড়িটির মূল্য দুইশত টাকা। বইটির মূল্য তিনশত টাকা।

৪। Store of Value: এর সারকথা হল, মানুষ সম্পদ সঞ্চয় করে। ভবিষ্যতে তা কাজে আসে। সম্পদ সঞ্চয়ের জন্য এমন কিছু দরকার, যার মূল্যমান সাধারণত হ্রাস হবে না। নষ্ট হবে না। এর দ্বারা নিজ সম্পদের ভ্যাল্যু সংরক্ষণ করা যাবে। এটি করার মাধ্যম হল-মুদ্রা। এক লক্ষ টাকা আপনার কাছে থাকার অর্থই হল, এ পরিমাণ সম্পদের ভ্যাল্যু আপনার কাছে আছে। অর্থাৎ যে জিনিষটি মুদ্রা হবে  তার মধ্যে এই গুণ থাকতে হবে যে, এর মাধ্যমে বস্তুসমূহের ভ্যাল্যু সহজেই সংরক্ষণ করা যায়।

সারকথা, এ আলোচনা থেকে স্পষ্ট যে, কোন কিছুকে মুদ্রা বলতে হলে আগে দেখতে হবে তার মধ্যে উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যগুলো আছে কি না। কোন একটা বৈশিষ্ট্য না থাকলে সেটা মুদ্রা হবে না।
আলোচিত বিটকয়েনে-অন্তত আমাদের দেশে-দ্বিতীয় গুণটি নেই। কারণ এটি ব্যাপকভাবে গৃহিত নয়। সরকারীভাবেও অনুমোদিত নয়।  সুতরাং একে আমাদের দেশে শরঈ ও অর্থনীতি কোন দৃষ্টিকোণ থেকেই কারেন্সি বা মুদ্রা বলা যায় না।

বিশেষত সরকারীভাবে এর লেনদেন আমাদের দেশে নিষিদ্ধ। শরীয়তের মাসয়ালা হল, বৈধ বিষয়ে রাষ্ট্রের আনুগত্য করা ওয়াজিব। এর জন্য রাষ্ট্র ইসলামী হওয়া জরুরী নয়।  এছাড়া দেশের প্রতিটি নাগরিকই বক্তব্য বা কর্মে একথার স্বীকারোক্তি দিয়েছে যে, সে বৈধ বিষয়ে সরকারের আইন  মানবে।

অতএব উপরোক্ত দুই কারণে, যতক্ষণ অবৈধ কাজে বাধ্য না করা হবে ততক্ষণ সরকারী আইন মানা জরুরী। (দেখুন, বুহুস,১:১৬৩/১৬৮,শরহু সিয়ারিল কাবীর, ১/১৬৮;তাকমিলাতু ফাতহিল মুলহিম ৩/৩২৩)

সুতরাং বিটকয়েনের লেনদেন থেকে বিরত থাকা উচিত। যদি কখনো তাতে পূর্বোক্ত দ্বিতীয় গুণটি পাওয়া যায়, তবে তখন সেটা কারেন্সির মর্যাদা পাবে। ডলার ও টাকার মত এটিও স্বতন্ত্র একটি মুদ্রা হিসেবে বিবেচিত হবে। এর সাথে ডলার/টাকার কমবেশি লেনদেন বৈধ হবে। যেমন, টাকার সাথে ডলারের লেনদেন কমবেশিতে বৈধ।

এছাড়া যে কাজগুলো বিটকয়েনে সবসময়ই নিষিদ্ধ ও নাজায়েয, তা হল-ফরেক্সের মত ফিউসার বা ফরওয়ার্ড সেল এতে করা যাবে না। বিটকয়েন হ্যাকিং করা জায়েয নয়। এটি চুরির নামান্তর। বাকিতে বিটকয়েন ক্রয় করা হলে, আদায়ের দিন যে মূল্য হবে সেটা পরিশোধ করবে।


লেখক

মুফতি আব্দুল্লাহ মাসুম

প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক,আই এফ একাডেমী এন্ড কনসালটেন্সি,

সহকারী মুফতি,ফতোয়া বিভাগ,জামিয়া শারইয়্যাহ মালিবাগ ঢাকা।

একটি সরল মূল্যায়ন: কুরআন-সুন্নাহ থাকতে মাযহাব কেন ?

আজ এই মুহূর্তে আপনি ইসলাম গ্রহণ করলেন কিংবা আপনি জন্মগতভাবেই মুসলিম, এ মুহূর্তে আপনি ইসলামের কোনো বিধান পালন করতে চান, তো আপনাকে আলেম-উলামা বা ইসলাম সম্পর্কে জানেন-এমন ব্যক্তির  শরণাপন্ন হতে হবে। আমাদের এই ভূখন্ডে প্রথম দিকে যারা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন তারা ঈমান শিখেছিলেন ইসলাম-প্রচারকদের কাছে। এরপর তাদের কাছেই নামায আদায় করতে শিখেছিলেন। আজ এবং অনাগত দিনেও পৃথিবীব্যাপী প্রতিটি নওমুসলিমই ঈমান, অযু-গোসল, হালাল-হারাম, সালাত-যাকাত, সিয়াম-হজ্ব ইত্যাদির প্রথম ধারণা লাভ করবেন তার ইসলাম গ্রহণের প্রথম মাধ্যম ব্যক্তিটির কাছ থেকে এবং বহু কিছু তিনি শিখে নিবেন মুসলিমসমাজের ধর্মীয় কার্যক্রম ও কালচার থেকে।

এ বিষয়টি আমরা খুব সহজেই বুঝতে পারব যদি কল্পনা করি সে সময়টির কথা, যখন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এত উন্নত হয়নি। শিক্ষা-দীক্ষার হার ছিল প্রায় শূন্যের কোঠায়। তথ্য ও  যোগাযোগ মাধ্যম বলতে তেমন কিছুই ছিল না। ছিল না এত বই-পুস্তক, পত্রিকা ও প্রকাশনা। তখন ভাবের আদান-প্রদান ও যোগাযোগের একটিই উপায় ছিল। তা হল মৌখিক জ্ঞান বিনিময়ের পাশাপাশি বাস্তব অনুশীলন। অর্থাৎ হাতে-কলমে শিক্ষা দেওয়া।

আজকের এই সময়টা নিয়েই ভাবুন। দেখবেন, বাংলাদেশের মুসলমানরা ইসলামী বিশ্বাস, চিন্তা-চেতনা, ইবাদত-বন্দেগী, সুন্নত-বিদআত, জায়েয-নাজায়েয, হালাল-হারাম প্রভৃতি যা কিছুই জানেন এর সিংহভাগই সমাজ, পরিবেশ, গৃহশিক্ষক, মসজিদের ইমাম, ওয়ায়েজ, মক্তবের উস্তাদ, মা-বাবা, দাদা-দাদী ইত্যাদি মানুষ থেকে শেখা। কেবল নিজের পড়াশোনা, প্রচারমাধ্যম বা অন্যান্য ব্যক্তিগত অনুসন্ধান থেকে ধর্মীয় জ্ঞান লাভ করেছেন এমন মানুষের সংখ্যা এ দেশে এখনও অনেক কম।

আমাদের সমাজের প্রকট বাস্তবতার আলোকেই বাঙ্গালী মুসলমানের প্রথম ইসলামী জ্ঞান অর্জনের এ ব্যবস্থাকে অবলম্বন করেই প্রবচন চালু হয়েছে-‘শুইন্যা মুসলমান।’ অর্থাৎ মূল উৎস ঘেঁটে, দেখে বা পড়ে নয়, শুনে শুনে যারা একটি বিশ্বাস ও সংস্কৃতিকে ধারণ করেছে এমন ব্যক্তির ক্ষেত্রেই এ প্রবচনটি প্রয়োগ করে থাকেন গ্রাম-বাংলার মানুষ।

কেবল বই-পুস্তক পড়ে একটা কাজ শেখা আর একজন শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে হাতে-কলমে শিক্ষালাভ করার মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাৎ আছে। কোনো খেলা, ব্যায়াম, সাইকেল বা গাড়ি চালনা কোনোটাই শুধু বই-পুস্তক পড়ে, মিডিয়ায় ছবি দেখে পূর্ণরূপে শিখে নেওয়া সহজ নয়। একজন উস্তাদের সাথে থেকে তার ইনস্ট্রাকশন মেনে বিষয়টি শিখলে এবং হাতে-কলমে অনুশীলন করলে পুঁথিগত জ্ঞান বা তাত্ত্বিক ব্যাকরণ ততটা না জানলেও কাঙ্খিত কার্যক্রমটুকু শিখে নেওয়া সম্ভব। পড়াশোনার বিষয়টি ব্যবহারিক পর্যায়ে থাকলেও কাজ বাধাগ্রস্ত হবে না। গভীর তত্ত্ব আলোচনা ও সামগ্রিক জ্ঞান অনুসন্ধান বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিবর্গের জন্য জরুরি হলেও বিশ্বাস, দর্শন ও জীবনব্যবস্থার সাধারণ অনুসারীর প্রাথমিক শিক্ষার জন্য ওই প্রশিক্ষক, গুরু, পীর, উস্তাদ, মুর্শিদ, আলেম, ইমাম বা প্রচারকের সান্নিধ্যই যথেষ্ট।

বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্ম ও আল্লাহর মনোনীত একমাত্র দ্বীন ইসলামের প্রচার  তত্ত্বের চেয়ে ব্যবহারিক পর্যায়েই বেশি অগ্রসর হয়েছে। কেননা, পৃথিবীর সকল অঞ্চলের সকল যোগ্যতার মানুষকে তাওহীদ, রিসালত ও আখেরাতের ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত জীবনব্যবস্থার দিকে দাওয়াত দিতে চাইলে কোনো কঠিন ও জটিল পন্থা অবলম্বন করা চলবে না। হযরত নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরাম রা.-এর সরল ও সনাতন পন্থায়ই তা করতে হবে।

হযরত নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরামকে জীবনের প্রতিটি বিষয় হাতে-কলমে শিক্ষা দিয়েছেন, কোনো বই-পুস্তক ধরিয়ে দিয়ে গবেষণা করে বুঝে নিতে বলেই দায়িত্ব শেষ করেননি। পৃথিবীর অপরাপর এলাকায় বসবাসরত সমকালীন মানুষ এবং পরবর্তী সকল যুগের অনাগত বিশ্বমানবমন্ডলীর কাছে নিজের দাওয়াত পৌঁছে দিতেও হযরত বই-পুস্তক, পত্র-পত্রিকা, পান্ডুলিপি ইত্যাদির আশ্রয় নেননি। তিনি তাঁর সাহাবীগণকে দায়িত্ব দিয়েছেন বিশ্বময় ছড়িয়ে পড় এবং আমার আদর্শের একটি বাণী হলেও পূর্ব-পশ্চিমে বসবাসরত প্রতিটি মানুষের কাছে পৌঁছে দাও।

হযরত নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেমন বলতেন, তোমরা আমাকে যেভাবে নামায পড়তে দেখ সেভাবে নামায পড়, সাহাবীরা যেমন নতুন কোনো মানুষকে অযু শেখানোর সময় তাদের সামনে বসে অযু করতেন এবং বলতেন, এই ছিল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অযু। ইসলামের প্রতিটি বিধানই প্রাথমিকভাবে এর ধারক-বাহকদের মাধ্যমে ব্যবহারিক তথা প্রায়োগিকভাবেই বিস্তৃত ও প্রচলিত হয়েছে। আর ইসলামের সৌন্দর্য ও শ্রেষ্ঠত্ব বা এর অন্তর্নিহিত শক্তিও এখানেই যে, এটি ধারণ বা পালন না করে বহন করা যায় না। আর একে ভালো না বেসে ধারণও করা যায় না। যারা একে ভালবাসেন ও নিজেরা ধারণ করেন, তারাই কেবল একে অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে পারেন। এর আনুষ্ঠানিক প্রচারের তুলনায় এর ধারক ও সেবকদের আন্তরিকতা ও কল্যাণকামিতার মাধ্যমেই ইসলাম অধিক, ব্যাপক, গভীর আর টেকসই পর্যায়ে     বিস্তৃত হয়েছে। দেড় হাজার বছরের ইতিহাসই এর সপক্ষে প্রমাণ হিসেবে যথেষ্ট।

এখন ইসলামের একজন অনুসারী হিসেবে আমি নিজেকে নিয়েই চিন্তা করি। ইসলামের একজন প্রচারক যখন আমার কাছে ইসলামের আদর্শ তুলে ধরবেন, সে সময়টা যদি হয় আরও ২, ৪, ৫, ৭ শ বছর আগের, তখন কি তার পক্ষে সম্ভব আমার হাতে এক কপি কুরআন বা সহীহ হাদীসের একটি পূর্ণাঙ্গ সংকলন তুলে দেওয়া? বাংলাভাষী হওয়ায় আমার পক্ষে কী আরবী ভাষায় তা পাঠ করাও সম্ভব? শুধু আরবী ভাষা বলেই কথা নয়, আমার পক্ষে কি তাত্ত্বিক এ দুটো উৎস-বিদ্যার বিষয়গত ভাব উদ্ধার করাও সম্ভব? এখানে আমার জ্ঞান-গরিমার পাশাপাশি আর্থ-সামাজিক অবস্থা, বোধ-বিবেকের পরিমাণও একটি প্রশ্ন। এরপর বহু সাধনা করে কুরআন-সুন্নাহর ভান্ডার হাতে পেয়ে গবেষণা করে এর সারনির্যাস হাসিল করে নিজে ঈমান, আমল ও আখলাক চর্চা শুরু করতে আমার কত মাস, বছর বা যুগ লাগবে সেটাও কি কম বড় প্রশ্ন ? এতটা পরিশ্রম করে যদি ইসলাম পালন আমি শুরু করি, তাহলেও তো ভালো। কিন্তু এ কাজটুকু ক’জন মানুষের পক্ষে সহজ বা সম্ভব? তদুপরি প্রশ্ন দেখা দেবে যে, কুরআন-সুন্নাহ গবেষণা করে ঈমান-আমল, নামায-রোযা, হজ্ব-যাকাত, বিয়ে-শাদি, ব্যবসা-বাণিজ্য, ঋণ-উৎপাদন, দান-খয়রাত, জীবন-মৃত্যু, জানাযা-উত্তরাধিকার ইত্যাদি শুরু করার আগ পর্যন্ত আমার মুসলমানিত্বের এ দীর্ঘ সময়ের নামায-বন্দেগী ও কাজকর্মের কী হবে?

আমার তো মনে হয়, কোনো ব্যক্তি বা জনগোষ্ঠীর ঈমান ও আমলের জন্য, ইসলামী জীবনবোধ ও সংস্কৃতি চর্চার জন্য প্রথম দিনই কুরআন ও সুন্নাহ গবেষণা শুরু করার পদ্বতি ইসলামের স্বাভাবিক রীতি নয়।

যদি এই না হবে তাহলে আমার সন্তানকে আমি ঈমান শেখাব কী করে? তাকে নামায, যিকর, সবর, শোকর, তাওয়াক্কুল ও আদব-আখলাক আমি কোন অধিকারে শিক্ষা দেব? যদি সে প্রশ্ন তোলে, আববু! তুমি আমাকে কুরআন ও সুন্নাহ শেখাও কেন? কুরআন-সুন্নাহ থেকে আমিই আমার জীবনবিধান খুঁজে নেব। তুমি এর মধ্যে এসো না। তুমি তোমার প্রায়োগিক আচরণ ও পর্যবেক্ষণ আমার ওপর চাপাতে চেষ্টা করো না। আমি তোমার বা তোমাদের মাযহাব মানি না। আমার দায়িত্ব তো কুরআন-সুন্নাহর ওপর আমল করা। অতএব কুরআন-সুন্নাহর ওপর দখল স্থাপন করার সময় আমাকে দাও। এরপরই আমি শরীয়তের ওপর আমল শুরু করব। পুত্রের এসব যুক্তির পর আমার বলার কি কিছু থাকবে?

পুত্রের এ বক্তব্য যে ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত সে ভিত্তিই আমাকে কথা বলার সুযোগ দেবে। কারণ মহান আল্লাহ তাঁর দ্বীনের প্রচার ও শিক্ষাকে যে সনাতন ও স্বাভাবিক পদ্ধতিতে প্রচলিত ও বিস্তৃত করেছেন, এর সম্পূর্ণ অনুরূপ হচ্ছে আমার এ উদ্যোগ।

আমার পুত্রকে ইসলামী জীবন-বিধান শিক্ষা দেওয়া আমার ওপর শরীয়তের নির্দেশ। আমি তাকে আল্লাহর পরিচয়, আল্লাহর শক্তি, প্রীতি, ভীতি ও ভালবাসা শেখাব। তাকে হযরত রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মহত্ত্ব, অবস্থান ও অপরিহার্যতা সম্পর্কে ধারণা দেব। তাকে নামায শেখাব। খাওয়া-পরা, ঘুম-বিশ্রাম, প্রস্রাব-পায়খানা, প্রবেশ-প্রস্থান, মসজিদে যাতায়াত, আযানের জবাব, হাঁটা-চলা, সালাম, মোসাফাহা ইত্যাদির ইসলামী নিয়ম শিক্ষা দেব। আমি নিজেও অযু-গোসল, রোযা-নামায, দাম্পত্য জীবন, পারিবারিক ও সামাজিক জীবন,হজ্ব-কুরবানী প্রভৃতি যথাযথ নিয়মে পালন করব। অথচ আমি কুরআন বা হাদীস পড়ার বা বুঝার মতো যোগ্যতা রাখি না।  জ্ঞানের এ দুই মহাসমুদ্র পাড়ি দিয়ে আমার দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয় বিধি-বিধান হস্তগত করে আমল করার মতো শিক্ষা, মেধা, মানসিক যোগ্যতা বা সামগ্রিক অবস্থা আমার নেই, এমতাবস্থায় আমার কী করণীয়?

আমার তো মনে হয়, এখানে আমার ও আমার পুত্রের একই ধরনের করণীয়, যা ইসলামের ১৫০ কোটি সমসাময়িক অনুসারীর প্রত্যেকেরই করণীয়। আর তা হল, কুরআন-সুন্নাহ ও ইজমা-কিয়াস থেকে গৃহীত ইসলামী বিধিবিধানের প্রায়োগিক রূপ ফিকহের অনুসরণ। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেমন বলেছেন, একজন ফকীহ  শয়তানের মোকাবেলায় এক হাজার আবেদেরও চেয়েও শক্তিশালী। এর কারণ সম্ভবত এটিও যে, এক হাজার সাধারণ মুসলিমকে ধর্মীয় বিষয়াদি নিয়ে সংশয় উদ্বেগ ও বিভ্রান্তিতে ফেলে দেওয়া শয়তানের জন্য যত না কঠিন একজনমাত্র শরীয়ত-বিশেষজ্ঞ ফকীহ আলেমকে বিভ্রান্ত করা এরচেয়ে বেশি কঠিন। কেননা, এই ব্যক্তির কাছে কুরআন ও সুন্নাহর শক্তিশালী সম্পদ রয়েছে। রয়েছে ইলমে দ্বীনের আরও   বিস্তারিত ভান্ডার।

কুরআন মজীদেও আল্লাহ তাআলা এ মর্মে বলেছেন, প্রত্যেক জনগোষ্ঠীর মধ্য হতে একদল মানুষ যেন দ্বীনী ইলমের উপর ব্যুৎপত্তি অর্জন করে কারণ জনগোষ্ঠীর বাকি অংশটিকে তাদের শরীয়তের উপর পরিচালনা করতে হবে। এখানেও আমরা ফকীহ বা শরীয়তের আলেমের বিধিগত অস্তিত্ব এবং তাঁর কুরআনী দায়িত্ব উপলব্ধি করতে পারি।

আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও মহামান্য সাহাবীগণের পৃথিবী থেকে চলে যাওয়ার পর ইসলাম যখন আরব-উপদ্বীপ ছেড়ে একদিকে সাহারা গোবি ছুঁয়ে দূর অতলান্তিক স্পর্শ করছিল, অপরদিকে আসমুদ্র সাইবেরিয়া আর মহাচীনের প্রাচীর পর্যন্ত পৌঁছে যাচ্ছিল তখনও কিন্তু পবিত্র কুরআন ব্যাপকভাবে হস্তলিখিত হয়ে এত বিপুল পরিমাণ অনুলিপি তৈরি হয়নি, যা প্রতিটি শিক্ষিত নও-মুসলিমের হাতে তুলে দেওয়া যায়। আর হাদীস শরীফ তো তখনও যাচাই বাছাইয়ের পর সংকলিত ও গ্রন্থবদ্ধ হয়েও শেষ হয়নি। তো ইসলামের এ অগ্রযাত্রা, ইসলামী শরীয়তের আলোয় প্লাবিত এ নতুন পৃথিবীর বুকে কাদের মাধ্যমে কুরআন-সুন্নাহর আলো প্রতিবিম্বিত হয়েছিল? এর ছোট এক টুকরো জবাবই ইসলামের ইতিহাসে সুরক্ষিত আছে, যা আমি এ লেখার শুরুতে নিবেদন করেছি। হাদীস শরীফে তো বলা হয়েছে, তোমাদের মাঝে দুটি বিষয় আমি রেখে গেলাম। যতদিন তোমরা এ দুটো আঁকড়ে রাখবে ততদিন পথচ্যুত হবে না। এক আল্লাহর কিতাব। দুই. আমার আদর্শ। এ মহা দিকনির্দেশনার আরও সুসংহত রূপ হচ্ছে হযরতের অপর বাণী, যেখানে মুসলিম জাতিকে সত্যপথের দিশা দিতে গিয়ে বলেছেন, ‘যে আদর্শের উপর আমি রয়েছি আর আমার সাহাবীগণ রয়েছেন।’ অন্যত্র বলেছেন, ‘তোমাদের জন্য অবধারিত করছি আমার এবং খোলাফায়ে রাশেদীনের আদর্শের অনুসরণ।’

এখানে আমরা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি যে, ইসলামী অগ্রযাত্রা ও ইসলামী জীবনসাধনার সঠিক দিকনির্দেশের জন্য কুরআন ও সুন্নাহকে মূল উৎস সাব্যস্ত করা হয়েছে। ইসলামী জীবনব্যবস্থার আদর্শ ও মাপকাঠিরূপে অভিহিত করা হয়েছে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সহচরবৃন্দের অনুসৃত পথ, যা প্রধানতই ব্যবহারিক ও সান্নিধ্যগত আদর্শ। বই-পুস্তক ও তত্ত্ব প্রধান নয়। যে জন্য সাহাবায়ে কেরামের মূল সময়কালের শেষ পর্যায়ে আমরা পবিত্র মদীনা মুনাওয়ারায় হযরত মালেক ইবনে আনাসকে রাহ. দেখতে পাই গোটা মুসলিমসমাজের লোকশিক্ষক ও দিকনির্দেশক হিসেবে। ইসলামের উপর আমল করার জন্য মদীনাবাসী তখন থেকেই কুরআন ও সুন্নাহ নিয়ে ব্যক্তিগতভাবে গবেষণা বা অনুসন্ধান শুরু না করে ফকীহ ও আলেম ইমাম মালেকের ফিকাহ বা মাযহাবের উপর, তার নির্বাচন ও পর্যবেক্ষণের উপর নিশ্চিন্তে নির্ভর করেছেন। এরও বহু আগে থেকে মক্কাবাসীরা নির্ভর করেছেন হযরত ইবনে আববাস রা.-এর উপর। এর কিছুদিন পর থেকে বৃহত্তর ইরাকবাসী ইমামে আজমের ফিকহের উপর। আর এটিই কুরআন ও সুন্নাহর বিধান। আল্লাহ তাআলা যেমন বলেছেন, তোমরা অনুসরণ কর আল্লাহর ও তাঁর রাসূলের। আর অনুসরণ কর তোমাদের উলুল আমর বা শরীয়তী অথরিটির। হাদীস শরীফে বলা হয়েছে, পিতার সন্তুষ্টিতেই রয়েছে আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি। তো আমার পুত্রকে দৈনন্দিন জীবনের যে শরীয়ত সম্পর্কিত শিক্ষা-দীক্ষা আমি দেব তা তৎক্ষণাৎ গ্রহণ করা ও তার উপর আমল করাও পুত্রের উপর শরীয়তেরই নির্দেশ। এখানে আমাদের মধ্যকার এ আদান-প্রদান কিছুতেই কুরআন-সুন্নাহ বিবর্জিত বা বিরোধী নয়।

মুসলিমজাতির হাতে তাদের শরীয়তের ব্যবহারিক রূপরেখা সমন্বিত ও সংকলিত আকারে তুলে দেওয়ার জন্য মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নির্দেশে যেসব সাহাবী, তাবেয়ী ও পরবর্তী যুগের ফকীহগণ কঠোর জ্ঞান-গবেষণা ও সাধনা করেছেন তাদের মর্যাদা বা গুরুত্ব নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা এখানে সম্ভব নয়, একখানা উদ্ধৃতি উল্লেখ করাই বিষয়টির মাহাত্ম্য উপলব্ধি করার জন্য যথেষ্ট মনে হয়। হযরত নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর একজন বিখ্যাত সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা. বলেন, রাতের কিছু সময় ইলম চর্চা করা রাতভর নফল ইবাদতের চেয়েও উত্তম।

কুরআন-সুন্নাহর ভেতর মানবজীবনের উদ্ভূত যে কোনো সমস্যার সমাধান পেয়ে গেলে এ থেকেই আমাদের তা গ্রহণ করতে হবে। অন্যথায় কুরআন-সুন্নাহর আলোকে সমাধানে পৌঁছার জন্য নিজের জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও বিবেচনার আশ্রয় নিতে হবে। এটি হযরত নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামেরই আদর্শ। হযরত মুআয ইবনে জাবাল রা.কে ইয়েমেনে পাঠানোর সময় তার মুখ থেকে এ কথা শুনতে পেয়ে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খুশি হয়ে আল্লাহর শোকর গোযারি করেছিলেন।

ইসলাম পৃথিবীর সর্বকালের সকল মানুষের জন্য চিরস্থায়ী জীবনব্যবস্থারূপে কুরআন, সুন্নাহ, ইজমা ও কিয়াস প্রভৃতির মূলনীতির ভিত্তিতে ফকীহ ও মুজতাহিদ সাহাবীগণের মাধ্যমে ব্যবহারিক বিধানরূপে, সমস্যার সমাধানরূপে, বিচারালয়ে ফয়সালারূপে জীবনের প্রতিটি অঙ্গনে অতুলনীয় ব্যবস্থারূপে তার ব্যাপক আকার পরিগ্রহ করতে থাকে। ব্যবহারিক জীবনে ইসলামের নানা বিধানে কিছু বৈচিত্র ইসলামের বিশালত্ব ব্যাপ্তি ও কালজয়ী গুণেরই বহিঃপ্রকাশ। অসংখ্য বিষয়ে সাহাবায়ে কেরামের পর্যবেক্ষণে ছিল অনেক মতবৈচিত্র! এ ইসলামের এক স্বীকৃত রীতি। প্রায়োগিক বিধানের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ তথা বিস্তারিত ফিকহ রচনার সময়ও মুজতাহিদ আলেমগণের পর্যবেক্ষণ, উপলব্ধি ও নির্বাচনে এ ধরনের বৈচিত্র ফুটে ওঠে। শরীয়তে চিন্তার এ বৈচিত্রকে উৎসাহিত করা হয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে মূল কথা হচ্ছে কুরআন মজীদ, সুন্নাহ, প্রথম যুগের প্রচলন, সাহাবীদের ঐকমত্য আর পূর্ববর্তী নজির অনুসরণ। এসব মূলনীতি বিশ্লেষণ করেই আপেক্ষিক বিষয়ের মধ্যে একটিকে প্রাধান্য দেওয়া হবে। আর এ ইজতিহাদী তত্ত্বের ভিত্তিতেই গড়ে ওঠেছে ইসলামের বহুমাযহাব সম্বলিত ব্যবহারিক ফিকহ।

কুরআন-সুন্নাহ ও এর প্রাসঙ্গিক সকল বিষয় যে সুযোগ্য ব্যক্তির নখদর্পণে, মুসলিম জাতির প্রয়োজনে তিনিই পারেন ইজতিহাদ করতে। কেননা, সাহাবায়ে কেরামের মতবৈচিত্রপূর্ণ কোনো বিষয় কিংবা    সাহাবীদের যুগের পরবর্তী কোনো নতুন সমস্যার সমাধান নির্বাচন ও পর্যবেক্ষণ ছাড়া কার্যকর করা সম্ভব ছিল না। ফলে অসংখ্য মত ও মাযহাবের বৈচিত্র ছিল খুবই স্বাভাবিক, যার মধ্যে অপেক্ষাকৃত প্রসিদ্ধ চারটি মাযহাবের সাথে মুসলিম জনসাধারণ সমধিক পরিচিত। এসব মাযহাবের কোনোটিই কুরআন-সুন্নাহ বহির্ভূত নয় এবং কোনোটিই এমন নয়, যার অনুসরণ করলে আমরা কুরআন-সুন্নাহর অনুসারী বলে গণ্য হব না। এমনকি একটি মাযহাবের ইমাম অপর মাযহাবের ইমামের এলাকায় বেড়াতে গিয়ে তার ফিকহ অনুসারেই আমল করেছেন এমন উদাহরণও ইমামদের জীবনে  দেখা যায়। যেন আমরা বুঝতে সক্ষম হই যে, মাযহাব কেবলই নির্বাচন ও পর্যবেক্ষণের বিষয়।


মাযহাব নিয়ে এ লেখাটি পড়তে পারেন – নবী একজন কিন্তু মাযহাব চারটি কেন ?


কুরআন-সুন্নাহ, ইজমা ও কিয়াসের সমন্বয়ে প্রাপ্ত সিদ্ধান্তের বহুমাত্রিকতা থেকে একটি অবস্থাকে প্রাধান্য দেওয়ার নাম তারজীহ। আর এ প্রাধান্যপ্রাপ্ত সমাধানগুলোই হচ্ছে মাযহাবের বৈচিত্রপূর্ণ অংশ। অতএব মাযহাব মানা আর কুরআন-সুন্নাহ মানার মধ্যে কোনোই ফারাক থাকার কথা নয়। তাছাড়া সাধারণ মুসলমানের পক্ষে কোনো আংশিক বা সামগ্রিক, প্রসিদ্ধ কিংবা অখ্যাত মাযহাব অনুসরণ ছাড়া শরীয়তের উপর আমল করাও প্রায় অসম্ভব।

কেননা, ইসলামের বিশালত্ব, চিরস্থায়িত্ব ও সর্বকালের সকল অঞ্চলের মানুষের উপযোগী ধর্ম ও জীবনব্যবস্থা হিসেবে এর ভেতরকার সবকিছুই পরম উদার ও বৈজ্ঞানিক। এতে অনেক সুযোগ, উদারতা ও বিস্তৃতি রয়েছে। জীবন ও জগতকে গতিশীল উপায়ে এগিয়ে নেওয়া ইসলামের প্রেরণা। সুতরাং এখানে প্রায় সব বিষয়েই অনেক এখতিয়ার, অনেক সহজতা। ইসলামের মূল ইবাদত নামাযের ভেতর যত বৈচিত্র ও সহজতা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জীবন থেকে হাদীসের মারফত আমরা পাই, এর সবগুলোর উপরই আমাদের আমল করার বৈধতা ও যুক্তি রয়েছে। এতে একজন বিজ্ঞ মুজতাহিদ যখন একটি নামায পদ্ধতি আমাদের জন্য কুরআন-সুন্নাহ, ইজমা, কিয়াস-এর আলোকে নির্বাচন করবেন, তখন সেটাই এক এলাকার, এক সংস্কৃতির মানুষকে ধারণ করতে হবে। এ পদ্ধতির চর্চাই পরস্পরগতভাবে প্রজন্মান্তরে চলতে থাকবে। শুধু নামায নয়, যাকাত, হজ্ব, কুরবানী, পাক-নাপাক, হালাল-হারাম, জায়েয-নাজায়েযের প্রতি ক্ষেত্রেই এভাবে মাযহাবের প্রয়োজনীয়তা মুসলিমজাতি উপলব্ধি করবে। সর্বোপরি সকল মাযহাবের ইমামদের অভিন্ন একটি কৈফিয়ত ইসলামে রয়েছে যে, আমার নির্বাচিত মাসআলার বিপরীতে যদি আরও শক্তিশালী প্রমাণ খুঁজে পাও তাহলে আমার মাসআলা ত্যাগ কর। বিশুদ্ধ হাদীস যদি আমার সিলেকশনকে চ্যালেঞ্জ করে তাহলে আমার কথাকে ছুঁড়ে ফেলে দাও। এখানে অবশ্য একজন মুজতাহিদের নির্বাচনকে যাচাই  করার জন্যও ন্যূনতম কিছু যোগ্যতার প্রয়োজন। সাধারণ একজন দর্শক, শ্রোতা বা পাঠকের পক্ষে এক্ষেত্রে নাক গলানো খুবই ঝুঁকিপূর্ণ ও অসঙ্গত।

যদি কোনো ব্যক্তি নিজেই শরীয়তের সকল শর্ত পূরণ করা একজন মুজতাহিদ হন তাহলে তিনি কোনো ইমামের মাযহাব অনুসরণ না করে নিজেই কুরআন-সুন্নাহর আলোকে জীবনযাপন করতে পারেন। তবে কুরআন-হাদীসের অনেক শাস্ত্রবিদ মনীষীও এ ধরনের ঝুঁকি নিতে চাননি। কেননা, বিষয়টি শরীয়তের এক বা দুই শাস্ত্রের মাঝে সীমাবদ্ধ নয়, কুরআন ও হাদীস সংক্রান্ত সকল মৌলিক শাস্ত্রে গভীর বুৎপত্তির অধিকারী হয়ে নিজেকে নতুন পথের পন্থী দাবি করা চাট্টিখানি কথা নয়।

অতএব নির্দ্ধিধায় আমরা স্বীকৃত মাযহাবগুলোর উপর আমল করতে পারি। কর্মসূচিগত ও সামাজিক শৃঙ্খলার জন্য যেকোনো একটি মাযহাবকে বেছে নেওয়া জরুরি। যেমন, একটি বহুতল ভবনে ওঠার জন্য যদি সিঁড়ি, এসকেলেটর, লিফট, ক্রেন, রশি প্রভৃতি উপায় থাকে তাহলে একই সঙ্গে একাধিক উপায় অবলম্বন করা শৃঙ্খলাবিরোধী কাজ বলে বিবেচিত। একটি পন্থাই বেছে নিতে হবে আমাকে। তাছাড়া ধর্মীয় কার্যক্রমের ক্ষেত্রে একটি পন্থা অনুসারে আমল করা এজন্যও কর্তব্য যে, ইবাদত বা আচরণে অস্থিরতা এর আবেদনকে বহুলাংশে ক্ষুণ্ণ করে থাকে।

অতএব স্বাভাবিকভাবেই আমরা এ সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে, মাযহাব অনুসরণ করলে প্রকৃতপক্ষে আমি কুরআন-সুন্নাহই অনুসরণ করলাম। আমি তখন আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত। আমি তখন আহলে কুরআন, আহলে হাদীস। আমিই তখন সালাফী বা পূর্ববর্তী মুরববীদের অনুসারী। কেননা, এসব পথের মূল প্রেরণা আর মাযহাব সংকলনের প্রেরণায় কোনোই বিরোধ নেই।

আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে দ্বীনের সঠিক বোধ ও উপলব্ধি দান করুন, আমীন।

======================

লেখক-মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভী

ইসলাম ও নারীবাদ বা ফেমিনিজম

Feminism বা নারীবাদ এর সংজ্ঞায়নে স্বয়ং ফেমিনিস্টরা নিজেরাই এত মত পথ বের করেছে যে তাদেরকে সংজ্ঞা জিজ্ঞেস করলে একেকজন একেকরকম উত্তর দেয়। বিশেষ করে ফেমিনিজমের পুরনো সংজ্ঞা যা মূলত ‘নারীদের সমঅধিকার’ কেন্দ্রিক – সেটাকে যুক্তিতর্ক দিয়ে এতই নাজেহাল করা হয়েছে যে স্বয়ং ফেমিনিস্টরাই ফেমিনিজমের সংজ্ঞা নতুনভাবে ঢেলে সাজাতে বাধ্য হয়েছে। যার ফলশ্রুতিতে এসেছে Neo-Feminism যা মূলত ফেমিনিস্টদের Gender Wage Gap আর Choice নিয়ে আবর্তন করে। আর যদিও বাঙ্গাল ফেমিনিস্টদের বেশিরভাগই এখনও এতদূর যায় নি, তবুও শেষে Neo-Femisnism সম্পর্কেও প্রয়োজনীয় আলোচনা থাকবে ইন-শা-আল্লাহ। কারণ ইন্টারনেট-স্মার্টফোনের যুগে ইতোমধ্যেই Neo-Femisnism এর বাতাসে কেউ কেউ অসুস্থ হয়েছে আর কিছুদিনের মধ্যেই যে তা পুরোদমে মহামারীতে রূপ নেবে তাও মোটামোটি নিশ্চিত।

‘সম’ সংশয়

প্রথমে আভিধানিক সংজ্ঞাতেই চোখ বুলানো যাক। Oxford ডিকশনারীর সংজ্ঞা অনুযায়ী Feminism হল, “The advocacy of women’s rights on the ground of the equality of the sexes.” আর Cambridge এর সংজ্ঞা হল “the belief that women should be allowed the same rights, power, and opportunities as men and be treated in the same way, or the set of activities intended to achieve this state:”
অর্থাৎ, ফেমিনিজম গড়েই উঠেছে নারীদের ‘সম’ অধিকার প্রতিষ্ঠাকে কেন্দ্র করে। লক্ষ্যণীয়, এখানে আগেই ধরে নেওয়া হয়েছে যে ‘সম’ মানেই হল ‘সঠিক’। আসলে কি তাই? নারী-পুরুষ সব জায়গায় সমান সমানভাবে থাকবে, সব জায়গায় সমান সমান অধিকার ভোগ করবে সেটাই কি ন্যায়? আদতে বাস-ট্রাক চালানো, গলা ফাটিয়ে হেল্পারি করাসহ ভারী ভারী যত কাজ রয়েছে – সেসব বিষয় সামনে নিয়ে এলে ফেমিনিস্টদের তোলা ‘সম’ অধিকারের আস্ফালন আর শোনা যায় না। কেবল অফিস-আদালতে এসির বাতাস খেতে খেতে ভাবমারা কর্পোরেট জব করার সময় সমধিকারের যত বুলি আওড়ানো হয়।
একটা উদাহরণ দেওয়া যাক, একটা কন্সট্রাকশন সাইটে কাজের জন্য দিন-মজুর নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। সেখানে লাইনে কিছু পুরুষ আর মহিলা দাঁড়ালো। লোক নিয়োগ শেষে দেখা গেল, পুরুষ বেশি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে আর মহিলা কম। মহিলাদের যেসব কাজ দেওয়া হয়েছে তাও অপেক্ষাকৃত কম কষ্টের, মজুরিও নির্ধারণ করা হয়েছে সে অনুযায়ী। এখন ফেমিনিস্টদের অবস্থা হল এমন – তারা দাবি করছে তারাও পুরুষদের সমান সংখ্যায় কাজ করবে, আর একই সময় পরিমাণ কাজ করার পরিবর্তে তাদেরকে একই পরিমাণ মজুরি দিতে হবে। এই হল তাদের সংজ্ঞার ‘সমঅধিকারের’ প্রায়োগিক রূপ। অথচ তারা নিজেরাও জানে একাজে তারা চাইলেও পুরুষদের সমান আউটপুট দিতে পারবে না।
বাস্তবতা হল এই যে, কিছু কাজ রয়েছে যা পুরুষদের জন্য, আবার কিছু কাজ রয়েছে যা মহিলাদের জন্য। স্বয়ং আল্লাহর নির্ধারণ করে দেওয়া এই বাস্তবতাকে যারা স্বাভাবিকভাবে নিতে পারে না, নিজেদের এই ফিতরাতবোধ যারা নষ্ট করে ফেলেছে তারাই সম অধিকারের অসাড় আস্ফালন করে থাকে। তাই নারীবাদীরা যতদ্রুত সত্য মেনে নিতে পারবে, ততই তাদের মঙ্গল। আর ‘সম’ মানেই সত্য নয়, সঠিক নয়। বরং যে যেখানে উপযুক্ত সেখানেই সে সঠিক, সত্য।

The Gender Wage Gap Myth

ফেমিনিস্টদের ব্যবহৃত এক কল্পনাপ্রসূত অসাড় যুক্তি হল Gender Wage Gap বা চাকরি বাকরিতে ‘বেতন বৈষম্য’ যা Neo-feminism এর মূল ভিত্তি। অর্থাৎ, ভারী সব কাজ বাদ দিয়ে ফেমিনিস্টরা যেসব জায়গায় নিজেদের ক্যারিয়ার গড়তে চায় সেখানে তারা নাকি তারা অধিকার(!) আর বেতন বৈষম্যের শিকার হয়। খতিয়ে দেখা যাক। (ইসলামের দৃষ্টিকোণ কিছুক্ষণ পরে আলোচিত হবে, প্রথমে সেক্যুলার দৃষ্টিকোণ থেকেই আলোচিত হল)
আমেরিকায় করা বিভিন্ন জরিপ অনুযায়ী তথাকথিত বেতন-বৈষম্যের পরিমাণ ২৩ পার্সেন্ট। অর্থাৎ, প্রতি একজন কর্মজীবী সাধারণ পুরুষ ১০০ ডলার আয় করলে প্রতি একজন কর্মজীবী সাধারণ নারী আয় করে ৭৭ ডলার। নিও-ফেমিনিস্টদেরকে প্রায় সবসময়ই এইধরনের মুখস্ত তথ্য ব্যবহার করতে দেখা যায়। অথচ একইসাথে এসব জরিপ আর রিসার্চে উল্লেখিত Wage Gap এর যেসমস্ত কারণগুলো উল্লেখ করা হয় সেগুলো আর বলতে শোনা যায় না। বাস্তবতা হল, পুরুষ আর নারীদের Wage Gap এর পিছনে কিছু ফ্যাক্টর কাজ করে যার প্রথমেই রয়েছে নারীদের Choice. এমনকি American Association of University Women, যা কিনা একটা ফেমিনিস্ট সংস্থা, এর দেওয়া রিপোর্টেও বলা হয়েছে বিদ্যমান এই Wage Gap বা বেতন বৈষম্যের প্রধান কারণগুলো হল পেশা, পদবি, শিক্ষাগত যোগ্যতা, কাজের ঘণ্টা ইত্যাদির ক্ষেত্রে পুরুষ আর নারীর ভিন্ন ভিন্ন পছন্দ। [১] সেখানে বলা হয়েছে, নারীরা নিজেরাই পড়ালেখা করার সময় এমনসব বিষয়াদি বেছে নেয় যার বাজারমূল্য কম আর তাছাড়া কর্মক্ষেত্রেও তাদের পদবি, দায়িত্ব, সংসারের জন্য ওভারটাইম না করা ইত্যাদি কারণে এমন বেতন-ফারাক সৃষ্টি হয়েছে যা অতি স্বাভাবিক।
আর এই বিভিন্ন ফ্যাক্টরগুলো বিবেচনা করলে Wage Gap এসে দাঁড়ায় মাত্র ৬.৬% এ. আর এরও কারণ শুধুমাত্র নারী-পুরুষের পছন্দ করে নেওয়ার বিভিন্নতা। একজন নারী তাঁর সংসার সামলানোর জন্য যেখানে তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরতে উদ্যত হন, সেখানে একজন পুরুষ সেই সংসারের জন্যই ওভারটাইম কাজ করতেও দ্বিধা করেন না। অর্থাৎ, Individual Career Choice এর বিভিন্নতার কারণেই এই Gap সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু এইকথাগুলো কিন্তু ফেমিনিস্টদের একদমই পছন্দ না। ২০০৯ সালে U.S. Department of Labor এর পাবলিশ করা ‘An Analysis of Reasons for the Disparity in Wages Between Men and Women’ রিপোর্টেও একই তথ্য পাওয়া গিয়েছিল যা কিনা ৫০ টিরও বেশি Peer Review Study থেকে নিয়ে তৈরি করা হয়েছিল। সেখানেও বলা হয়েছে বিদ্যমান Wage Gap এর ক্ষেত্রে পার্সোনাল চয়েস বিবেচনা করলে রীতিমত কোনো গ্যাপই আর বিবেচ্য থাকে না। সেগুলো নিয়ে আন্দোলন আর উচ্চবাচ্য করা তো হাস্যকর ব্যাপার। [২]
বাস্তবে দেখা যায়, দুইজন পুরুষ সমপোস্টে সমান সমান শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে কাজ করলেও একজনের আগে আগে পদোন্নতি হয়ে যায়। এটা অতি স্বাভাবিক একটা বিষয়। কর্মক্ষেত্রে পারফরমেন্স অনুযায়ী ইভালুয়েশন হয়। এখন নিজেদের Choice এর কারণে অল্প আউটপুট দিয়েও যদি কিছু অপদার্থ একই পরিমাণ বেতন দাবি করে তা তো বোকামি আর অন্যায় দাবি ছাড়া কিছু নয়। তাছাড়া –
এক. যদি একই পরিমাণ আউটপুট দিয়েও নারীদের বেতন কম হতো তাহলে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আর ইন্ডাস্ট্রিগুলো একই পোস্টে সব পুরুষ বদলে নারী বসায় না কেন? খরচ বাঁচানো ব্যবসাগুলোর একটা অন্যতম লক্ষ্য আর যেহেতু একইকাজে সব নারী নিয়োগ দিলে প্রতি ১০০ ডলারে ২৩ ডলার বেঁচে যায়, তাহলে কেন তারা সব নারী নিয়োগ দিয়ে খরচ কমিয়ে ফেলছে না? আদতে বাস্তবতা হল, বেশি অর্থ দিয়ে হলেও যোগ্যদেরকেই কাজ দেওয়া হয়। এখন অযোগ্য কেউ এসে যোগ্যদের সমান সমান সবকিছু পেতে চাইলেই তা ন্যায় হয়ে যায় না, বরং চরম অন্যায় হয়।
দুই. একটা প্রতিষ্ঠানের কোন পোস্টে কাকে নিয়োগ দেওয়া হবে, কত বেতন দেওয়া হবে সেগুলো অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের ব্যাপার। যাদেরকে যোগ্য মনে করা হয়, তাদেরকেই নিয়োগ দেওয়া হয় আর যত বেতনের যোগ্য মনে করা হয় তত বেতনেই নিয়োগ দেওয়া হয়। প্রতিযোগিতার এই যুগে অযোগ্যরা যোগ্যদের জায়গা দখল করে বেতন ভোগ করতে থাকলে সব ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান আর অর্থনীতির বিপর্যয় ঘটবে এতো ক্লাস ফাইভের বাচ্চারাও বোঝে।
একে তো ফেমিনিস্টদের ‘সম মানেই সঠিক’ এই রেথোরিকেই রয়েছে গলদ এর উপর সমস্ত রিপোর্টের তথ্যও যায় তাদের বিপরীত। একই রিপোর্টের একাংশ নিজেদের প্রয়োজনানুযায়ী ব্যবহার করে কারণগুলো লুকিয়ে লাফালাফি আর আন্দোলন করা অপরিণত মস্তিষ্কের পরিচয়ই বহন করে।

Choice leads to Consent Dilemma

নারী স্বাধীনতার ফসল Consent আর Rape এর ডিলেমার কথা জানেন? খুব সহজ ভাষায় সংক্ষেপে বলি। সেকেন্ড ওয়েভ ফেমিনিজম, পশ্চিমা সমাজে যার সূত্রপাত গত শতাব্দীর ষাট এর দশকে, ক্রমান্বয়ে তার মূল প্রতিপাদ্য হয়ে উঠে এমন – নারীরা যেভাবে খুশি সাজবে, যখন খুশি বিছানায় যাবে কেউ তাদের এসব একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপারে নাক গলাবে না, সহজকথায় Freedom of Choice বা নিজপছন্দের অবাধ স্বাধীনতা। রেইপ বা যৌন হয়রানির ডিলেমাটা এখানেই। একজন নারী কারও সাথে স্বেচ্ছায় বিছানায় গেল, কিন্তু পরবর্তীতে সে রেইপড হয়েছে দাবি করলে পুরুষ বেচারার নিজের পক্ষে তেমন প্রমাণই থাকে না। তাহলে বুঝা যাবে কী করে, নারী কি নিজের মতেই গিয়েছিল নাকি আসলেই ধর্ষিত হয়েছে?

নারী কাজ বাহির

সত্য নাকি ভিক্টিম সাজা?
হার্ভিরা প্রত্যেক সমাজের পরতে পরতে আছে। দু’এক জন সাহস করে নিজেদের হয়রানির কথা বলার পর হ্যাশট্যাগ me_too এর বন্যা বয়ে যায়। প্রশ্ন হল, এতদিন পর কেন হে ভগিনী! ওসব ঘটনায় তোমার যে কন্সেন্ট ছিল না তা এক হ্যাশট্যাগ স্ট্যাটাস বা টুইটেই তো প্রমাণ হয়ে যায় না। আসল কথা হল, ওরা নিজেরাই দেহ বিকিয়ে ক্যারিয়ার গড়তে চেয়েছিল। ক্যারিয়ারের স্বার্থেই ঘটনার পর পর নিজেরা চুপ থাকতো। ‘বাহিরে মেয়েদের নিজেদেরকে প্রমাণ করতেই হবে’ প্রথমে এই বুলিতে ঘোল খেয়ে প্রমাণ করতে গিয়ে এরপর মান-স্মমান সব খুইয়ে আসে। তুমি তো সেদিনই নিজেকে অপদস্থ করেছো যেদিন নেকড়েদের কাছে নিজেকে উজাড় করে প্রমাণ করতে গিয়েছিলে।

শিশুহত্যার লাইসেন্স ও নাস্তিক্যবাদী ইউটোপীয়া

নারী স্বাধীনতা থেকে অবাধ স্বাধীনতা…এরপর?
সেকেন্ড ওয়েভ ফেমিনিজম ভয়াল রূপ নেয় আরও কয়েক বছর পরে এসে। ‘নিজের শরীর, নিজের অধিকার’ এর প্রতিপাদ্যে চলে আসে ব্যাভিচার করে ইচ্ছেমতো অ্যাবরশন করার অধিকার চাওয়া! অর্থাৎ শিশুহত্যার লাইসেন্স! ইউরোপ আমেরিকায় এসব নিয়ে আন্দোলন লেগেই থাকে। এগুলোই হচ্ছে ফেমিনিস্টদের শেষদিকের কার্যকলাপ।
Freedom of Choice এর কন্সেপ্ট আরও একটু বিস্তৃত হয়ে সমকামিদের সমর্থনও ফেমিনিস্টরা আত্নস্থ করেছে। নিজেদের বাহিরে কাজ করাকে ধ্রুবক রেখে শিশুদের প্রয়োজনে ডে-কেয়ারে পাঠানো, অবাধ স্বাধীনতায় শিশু হত্যার লাইসেন্স জায়াজ করা, LGBT দের সমর্থন এভাবে করেই ফেমিনিস্টরা স্রষ্টার বিধিবিধান অস্বীকার করা নাস্তিক্যবাদী সমাজব্যাবস্থার দিকে এগিয়ে যায়।

ফেমিনিজম নদী অসারতা থেকে উৎপন্ন হয়ে নাস্তিক্যবাদের সাগরে গিয়ে মেশে।

ইসলামের দৃষ্টিতে ফেমিনিজম

পদে পদে অপদস্থ হওয়া ফেমিনিস্টরা দেখল, কিছু ধর্মভীরু নারী রয়েছে বিশেষ করে মুসলিমাহরা, তারা আপন ঘরে থেকে নিজেদের আব্রু রক্ষা করে স্বামী সন্তান নিয়ে সুখে জীবনযাপন করছে। অতএব তাদেরও ঘর থেকে বের করে আনতে হবে। নেকড়েরা মিটিমিটি হাসে। আর নারীবাদীরা নিজেদের পরবর্তী দুরাবস্থার কথা ঢেকে রেখে মুসলিমাদের পুরনো ঘোল দেয়া শুরু করে – ফার্স্ট ওয়েভ ফেমিনিজমের কথাবার্তা যেসব কথায় তারা প্রথমে ধোঁকা খেয়েছিল। আগে বের হয়ে তো আসুক! প্রথমে নিকাব থেকে, এরপর হিজাব থেকে, এরপর ঘর থেকে, এরপর… আর কেউ কেউ নিকাব-হিজাব সহই নিজেদের উজাড় করে দিয়ে প্রমাণ (!) করতে ব্যস্ত হয়। অন্যের কাছে প্রমাণ করতে গিয়ে যে তারা দাসত্বই করে যায়, তা আর টের পায় না।
অনেকে ফেমিনিজম বলতে নারীর অধিকার নিশ্চিত করা পর্যন্তই বোঝে। আর ইসলাম যেহেতু নারীকে সম্মানিত করেছে, তাই ‘ইসলাম একটা ফেমিনিস্ট ধর্ম’ বলে বলে প্রচার করতে থাকে। আদতে তারা ফেমিনিজমের মূলকথা বোঝে নি অথবা ইসলাম সম্পর্কে এখনও অজ্ঞ। ফেমিনিজমকে ভাল টাইপের কোনো আদর্শ বলে মনে করে। এই ধারণা পুরোপুরি ভুল ও মিথ্যা। আসল কথা হল, ইসলামে নারীর যে মর্যাদা দেওয়া হয়েছে এরপরেও যে অন্যকোনো আদর্শে খায়ের বা কল্যাণ খুঁজে সে প্রকাশ্যে বা গোপনে ধরে নেয় যে আল্লাহ রব্বুল আ’লামীন নারীদের যথেষ্ট সম্মান দেয় নি। নাউযুবিল্লাহ।

আনুগত্যঃ

আল্লাহ রব্বুল আ’লামীন বলেন তাঁর সৃষ্টি সম্পর্কে সম্যক অবগত আর তিনি তাঁর বান্দাদের জন্য নারীদের উপর কর্তৃত্ব আর কর্তব্য নির্ধারণ করেছেন আর বান্দীদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন যথাযথ পর্দা করতে ও প্রয়োজন ব্যতীত ঘরে থাকতে। তাদের ভরণপোষণ থেকে শুরু করে সমস্ত কিছুর দায়িত্ব পুরুষদের দেওয়া হয়েছে। এখন কেউ আল্লাহ রব্বুল আ’লামীনের দেওয়া নির্দেশ মেনে নিবে, অথবা অস্বীকার করবে। দু’টো একসাথে চলতে পারে না।
ٱلرِّجَالُ قَوَّٲمُونَ عَلَى ٱلنِّسَآءِ بِمَا فَضَّلَ ٱللَّهُ بَعۡضَهُمۡ عَلَىٰ بَعۡضٍ۬ وَبِمَآ أَنفَقُواْ مِنۡ أَمۡوَٲلِهِمۡ‌ۚ فَٱلصَّـٰلِحَـٰتُ قَـٰنِتَـٰتٌ حَـٰفِظَـٰتٌ۬ لِّلۡغَيۡبِ بِمَا حَفِظَ ٱللَّهُ‌ۚ وَٱلَّـٰتِى تَخَافُونَ نُشُوزَهُنَّ فَعِظُوهُنَّ وَٱهۡجُرُوهُنَّ فِى ٱلۡمَضَاجِعِ وَٱضۡرِبُوهُنَّ‌ۖ فَإِنۡ أَطَعۡنَڪُمۡ فَلَا تَبۡغُواْ عَلَيۡہِنَّ سَبِيلاً‌ۗ إِنَّ ٱللَّهَ كَانَ عَلِيًّ۬ا ڪَبِيرً۬ا (٣٤)
পুরুষেরা নারীদের উপর কর্তৃত্বশীল এ জন্য যে, আল্লাহ একের উপর অন্যের বৈশিষ্ট্য দান করেছেন এবং এ জন্য যে, তারা তাদের অর্থ ব্যয় করে। সে মতে নেককার স্ত্রীলোকগণ হয় অনুগতা এবং আল্লাহ যা হেফাযতযোগ্য করে দিয়েছেন লোক চক্ষুর অন্তরালেও তার হেফাযত করে। আর যাদের মধ্যে অবাধ্যতার আশঙ্কা কর তাদের সদুপদেশ দাও, তাদের শয্যা ত্যাগ কর এবং প্রহার কর। যদি তাতে তারা বাধ্য হয়ে যায়, তবে আর তাদের জন্য অন্য কোন পথ অনুসন্ধান করো না। নিশ্চয় আল্লাহ সবার উপর শ্রেষ্ঠ। [সূরা নিসা, ৩৪]
এই হল আল্লাহ রব্বুল আ’লামীনের আয়াত – তিনি একজনকে আরেকজনের উপর বৈশিষ্ট্যমন্ডিত করেছেন, আর একারণেই পুরুষদেরকে করেছেন কর্তৃত্বশীল। স্বামীর আনুগত্যের ব্যাপারে উদাসীনতার কারণেই বেশিরভাগ নারী জাহান্নামীদের অন্তর্ভূক্ত হবে বলে স্বয়ং রাসূলুল্লাহই ﷺ বলে গিয়েছেন।
রাসূল ﷺ বলেন, “আমাকে জাহান্নাম দেখানো হয়েছিল। আমি এর চেয়ে ভয়ঙ্কর আর কিছুই কখনো দেখিনি। আর আমি দেখলাম এখানকার বেশিরভাগই হচ্ছে নারী। সাহাবাগণ জিজ্ঞেস করল, “এমনটা কেন? ইয়া রাসূলুল্লাহ!”
তিনি ﷺ বললেন, “তাদের অকৃতজ্ঞতার কারণে।” প্রশ্ন করা হলো, “তারা কি আল্লাহর প্রতি অকৃতজ্ঞ?”
তিনি ﷺ উত্তর দিলেন, “তারা হচ্ছে তাদের স্বামীর প্রতি অকৃতজ্ঞ। তারা অকৃতজ্ঞ তাদের স্বামীর সদাচারণের প্রতি। তুমি সারাজীবন তাদের প্রতি মমতা দেখিয়ে যাবে, কিন্তু এর পর সে যদি কখনো তোমার মধ্যে (অপ্রত্যাশিত) কিছু দেখতে পায়, তবে বলবে, “আমি তোমার মধ্যে কখনোই ভালো কিছু দেখিনি।”
[সহিহ বুখারি, ১০৫২]
তাহলে কীভাবে একজন নারী একইসাথে আল্লাহর কিতাবে বিশ্বাস স্থাপনের কথা বলতে পারে, আবার শরীয়তসম্মত কারণ ছাড়া পিতা-স্বামীর অবাধ্য হতে পারে? প্রকৃতপক্ষে ‘ইসলামী ফেমিনিস্ট’ একটা Oxymoron ছাড়া কিছুই না, আর প্রকৃত মুসলিমাহরা ইসলাম ব্যাতীত অন্যকোনো আদর্শে খায়ের খোঁজেও না আলহামদুলিল্লাহ।

পথের দাবিঃ

وَلَا يَضۡرِبۡنَ بِأَرۡجُلِهِنَّ لِيُعۡلَمَ مَا يُخۡفِينَ مِن زِينَتِهِنَّ‌ۚ وَتُوبُوٓاْ إِلَى ٱللَّهِ جَمِيعًا أَيُّهَ ٱلۡمُؤۡمِنُونَ لَعَلَّكُمۡ تُفۡلِحُونَ (٣١)
তারা যেন তাদের গোপন সাজ-সজ্জা প্রকাশ করার জন্য জোরে পদচারণা না করে। মুমিনগণ, তোমরা সবাই আল্লাহর সামনে তওবা কর, যাতে তোমরা সফলকাম হও। [সূরা আন নূর, ৩১]
সূরা নূরের ৩১ নং আয়াতের বিস্তারিত আলোচনা নারীদের বিনা প্রয়োজনে বাহিরে না যাবার দিকটা স্পষ্ট করে। অথচ আজ আমাদের সমাজে হিজাব করা বোনেরাও সুঠাম ক্যারিয়ার গড়তে চায়। আসলে তাদের যে দ্বীন অন্তরে প্রবেশ করে নাই তাই সুস্পষ্ট হয়ে যায়।

নারীর অধিকার নিয়ে এ লেখাটি পড়তে পারেন ইসলামে নারীর সম্মান, মর্যাদা ও অধিকার


একবার রাসূলুল্লাহ ﷺ সাহাবাদের বললেন, “তোমরা পথে বসা হতে বিরত থাক।”
সাহাবিগণ আরজ করলেন, “ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমাদের প্রয়োজনীয় কথার জন্য পথে বসার যে বিকল্প নেই।” রদিআল্লাহু আনহুম।
রাসূলুল্লাহ ﷺ তখন বললেন, “যদি তোমাদের একান্তই বসতে হয়, তাহলে রাস্তার হক আদায় কর।”
তখন সাহাবিগণ জিজ্ঞেস করলেন, “ইয়া আল্লাহর রাসূল! রাস্তার হক কী?” তিনি ﷺ উত্তর দিলেন, “দৃষ্টি অবনত করা, কষ্ট দেওয়া থেকে বিরত থাকা, সালামের উত্তর প্রদান করা, সৎকাজের আদেশ দেওয়া আর মন্দ কাজে বাধা দেওয়া।”
[সহিহ বুখারি, ৬২২৯]
সুবহান-আল্লাহ! অপ্রয়োজনে বা অসার প্রয়োজনে সেই সাহাবাদের যুগেও পথে বসতে সাবধান করা হল… তাও পুরুষদের। আর নারীদের কণ্ঠও যেখানে সতরের অন্তর্ভূক্ত সেখানে তাদের অপ্রয়োজনে ক্যারিয়ারিস্ট হওয়ার তো কোনো প্রশ্নই আসে না। আর ক্যারিয়ারিস্ট হওয়া তো ‘দুনিয়াবি’ হওয়ার আরেক ভার্সন, যা পুরুষদের জন্যও অকল্যাণকর। রাসূলের ﷺ, সাহাবাদের (রদিয়াল্লাহু আনহুম), সালাফদের যুহদ নিয়ে তো কিতাবাদির অভাব নেই।
নারী-কাজ-বাহির
কোনো উপায় না বুঝে বাধ্য হয়ে থাকলে পর্দা করে নারীদের বাহিরে কাজ করার অনুমতি থাকলেও আমাদের উচিত এইসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আল্লাহ রব্বুল আলামীনকে যথার্থরূপে ভয় করা। এইধরনের সিদ্ধান্তগুলো দীর্ঘমেয়াদি হয়ে যায় আর সচরাচর পরবর্তীতে গুনাহের দরজা খুলে দেয়।
মনে রাখা প্রয়োজন, যা কিছু যাদের জন্য ফরজ করা হয় নি তা নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে গিয়ে ফিতনাহে পতিত হওয়া বা ফিতনাহ ছড়ানো আল্লাহর ক্রোধকে আমন্ত্রণ জানানো বৈ কিছু নয়।
.

স্বয়ং আল্লাহর ভারসাম্যকরণ

 [১] পুরুষের দায়িত্বের মূল্য
কোনোকিছুই মূল্য ছাড়া আসে না। আর পুরুষদেরকে যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, সেটাও চরম মূল্য ছাড়া আসে নাই। আর সেই মূল্য হল, আখিরাতে আল্লাহর কাছে জবাবদিহিতা। দায়িত্বের মধ্যে থাকা নারীদের প্রতি সুবিচার না করলে, সঠিক দ্বীনের শিক্ষা না দিলে, বেহায়াপনা করতে দিলে যে আখিরাতে দাইয়্যুস হয়ে বা গুনাহগার হয়ে চরম মূল্য দিতে হবে পুরুষকে সেসব কথা কিন্তু ফেমিনিস্টরা এড়িয়ে যায়। তারা শুধু দুনিয়াতে তাদের উপর কর্তৃত্ব দেওয়ার ব্যাপারগুলোই বলে যায়। অথচ আখিরাতের হিসাব ছাড়া সবকিছুই অপূর্ণ। এছাড়া স্বয়ং আল্লাহর দেওয়া বিধান নিয়ে প্রশ্ন করা তো শয়তানের চরম ধোঁকা।
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, “পূর্ণ মুমিন সেই যার চরিত্র সবচেয়ে সুন্দর। আর তোমাদের মধ্যে উত্তম সেই যে তার স্ত্রীর কাছে উত্তম।”
[সুনানে তিরমিযী ১১৬২; মিশকাত ৩২৬৪]
রাসূলুল্লাহ ﷺ আরও বলেন, “তোমরা নারীদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করো। নিশ্চয়ই, তোমরা তাদেরকে আল্লাহর থেকে ওয়াদাস্বরূপ নিয়েছ, আর তাদের সাথে সহবাস হালাল হয়েছে আল্লাহর কালাম দ্বারাই।”
[সহিহ মুসলিম, সুনানে বায়হাকি ৮৮৪৯]
এভাবেই করেই দ্বীন ইসলাম নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে এবং পুরুষদেরকে নিজেদের অধীনস্থ নারীদের সম্বন্ধে সতর্ক করে দিয়েছে। আরও অনেক আয়াত ও হাদিস উল্লেখ করা যাবে যেগুলো নারীদের ব্যাপারে পুরুষদের আল্লাহকে ভয় করার সবক দেয়। রাসূলুল্লাহ ﷺ নিজে ছিলেন তাঁর স্ত্রীদের নিকট সর্বোত্তম। পুরুষেরা এভাবেই আল্লাহর নিকট দায়বদ্ধ থাকে, আর আল্লাহভীরু পুরুষেরা তো নারীদের ব্যাপারে সীমালঙ্ঘন করতে পারে না। কিন্তু আজ তো নারী অধিকার হয়ে গিয়েছে ইচ্ছেমতো বেহায়াপনা করার অধিকার যেসবে গাফিলতি করলে পুরুষদেরও দাইয়্যুস হয়ে জাহান্নামে যেতে হবে। আল্লাহ আমাদের ভুলত্রুটি সংশোধনের ও নিজেদের দায়িত্ব যথাযথভাবে আদায়ের তাওফিক দিন।

[২] নারীর মর্যাদা ও দ্বীন সহজীকরণ

স্বামীর আনুগত্য, মাহরাম ছাড়া ভ্রমণের নিষেধ নফল রোযা রাখতে স্বামীর অনুমতির হাদিস – কারণ আল্লাহ পুরুষদের কামনা-বাসনা বেশি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন ইত্যাদি যারা অস্বীকার করতে চায় তারা আসলে আল্লাহর দেওয়া ফিতরাতকেই অস্বীকারের মাধ্যমে দ্বীন থেকেই নিজের অজান্তে বেরিয়ে পড়ে। অথচ একজন নেক নারী মা হলে সেই মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত, তাদের জন্য যে মাত্র কয়েকটি বিষয় ঠিক করলেই নিশ্চিত জান্নাতের সুসংবাদ দেওয়া হয়েছে, হাজ্জ করে আব্রু রক্ষা করে চলতে পারলে তা জিহাদের সমতুল্য করা হয়েছে সেসব কথা কিন্তু অব্যক্তই থেকে যায়। মোটকথা আখিরাতের পুরস্কারগুলোর কথা বাদ দিয়ে যখন কেবল দুনিয়ার সুযোগসুবিধা নিয়ে আলোচনা করা হয়, তখনই শয়তানের ওয়াসওয়াসার জন্য তাদের অন্তর উন্মুক্ত হয়ে যায়। আর ফলাফলস্বরূপ তারা ফেমিনিজমে ধাবিত হয়।
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, “যে নারী পাঁচ ওয়াক্ত সলাত আদায় করে, আপন লজ্জাস্থান হিফাজত করে এবং স্বামীর আনুগত্য করে, তাকে বলা হবে – যে দরজা দিয়ে ইচ্ছে তুমি জান্নাতে প্রবেশ কর।”
[ইবনে হিব্বান ৪১৬৩, সহিহ আল জামি’ ৬৬০]
عن عائشة أم المؤمنين رضي الله عنها استأذنت النبي صلى الله عليه وسلم في الجهاد، فقال : جهادكن الحج.
উম্মুল মুমিনীন আয়েশা (রদিআল্লাহু আনহা) বলেন, আমি (অন্য রেওয়ায়াতে আছে, আমরা) রাসূলুল্লাহর ﷺ কাছে জিহাদের অনুমতি চাইলাম। রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন, “তোমাদের জিহাদ হল হাজ্ব।”
[সহীহ বুখারী, ২৮৭৫]
আল্লাহু আকবার! এভাবেই আল্লাহ রব্বুল আলামীন মুসলিমাহদের জন্য জান্নাতে যাওয়া সহজ করে দিলেন। কিন্তু কিছু অভাগা কেবল পার্থিব বিষয়াদি গণনা করতে গিয়ে দুনিয়া ও আখিরাত উভয়ই হারিয়ে বসে। কতই না বোকামিপূর্ণ তাদের চিন্তাগুলো!

পরিশেষ

আল্লাহ রব্বুল আলামীন আমাদেরকে ইসলাম দিয়ে সম্মানিত করেছেন, আর ইসলাম ছাড়া অন্য যেকোনো আদর্শে যেই কল্যাণ খুঁজতে যাবে সে অপদস্থ হবেই। দুঃখজনক হল, স্বয়ং আল্লাহ রব্বুল আলামীন তাঁর বান্দীদের সম্মানিত করলেও এই উম্মতের কিছু অভাগা ফেমিনিজমে খায়ের খুঁজে অপদস্থ হওয়ার পথই বেছে নিয়েছে। আল্লাহ রব্বুল আ’লামীন ভাল কাজে প্রতিযোগিতা করে এগিয়ে যেতে বলেছিলেন, আর সেখানে ইসলামের বেশ ধরেও অন্তরে ইসলামবিদ্বেষ পোষণ করে বা অন্তত কিছু আয়াত ও হাদিসের বিরোধিতা করে কিছু মানুষ নাস্তিক্যবাদী ফেমিনিজম আলিঙ্গন করেছে। আর নিজেদের জন্য খরিদ করেছে লাঞ্ছনা ও আগুন।
আজ তাই শতকোটি পুরুষদেরকেও লজ্জা দেওয়া নুসাইরা বিনতি কা’বদের (রদিআল্লাহু আ’নহা) দেখা যায় না। আজ দেখা যায় না, সালাহউদদীন আল-আইয়ূবিদের জন্ম দেওয়া মায়েদের। আল্লাহ আমাদের সহীহ বুঝ দান করুন এবং ইসলামভিন্ন অন্যসব আদর্শের ধোঁকা থেকে ভাই ও বোনদের হিফাজত করুন।
.
টিকাঃ

আল-কুরআন ও নাস্তিকতা

(أَفَلَا يَتَدَبَّرُونَ ٱلۡقُرۡءَانَ أَمۡ عَلَىٰ قُلُوبٍ أَقۡفَالُهَآ (٢٤
তারা কি কোরআন সম্পর্কে গভীর চিন্তা করে না? না তাদের অন্তর তালাবদ্ধ? [সূরা মুহাম্মাদ, ২৪]
আল-কুরআনে আল্লাহ রব্বুল আলামীন সকল ধরনের মানুষের বর্ণনা দিয়েছেন। কিন্তু অনেক বান্দা মনে করেন যে নাস্তিকদের নিয়ে কুরআনে কিছু বলা নেই। আদতে এমন ধারণা সহিহ নয়। নাস্তিকতা হল কুফর, নাস্তিকেরা হল কাফির। আর আল্লাহ রব্বুল আলামীন কুরআনে কাফিরদের স্বরূপ তুলে ধরে বহু আয়াত নাযিল করেছেন। একারণে অবিশ্বাসী নাস্তিকদের অনেক বৈশিষ্ট্যই কুরআনে বর্ণিত কাফিরদের বৈশিষ্ট্যগুলোর সাথে হুবহু মিলে যায়। ওদের জন্য আলাদা করে আয়াত নাযিল আল্লাহ কোনোই প্রয়োজন মনে করেন নাই।
আজকের লিখাটি এমন কিছু বান্দাদের নিয়ে যারা ঈমানদার হয়েও নিজেদের ঈমানকে, নিজেদের আখিরাতকে আগুনের ওপর দোদুল্যমান করে রেখেছে। কারণ কাফির নাস্তিকদের ব্যাপারেও আল্লাহ রব্বুল আ’লামীন যেসব আয়াত নাযিল করেছেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ­ যেসব দিকনির্দেশনা দিয়ে গেছেন তাও মুমিন বা বিশ্বাসীদের জন্যই। কিন্তু আজ ঈমানদার হয়েও নিজেদের ঈমানকে দোদুল্যমান করে রাখা অভাগাদের সংখ্যা অগণিত। অনেক মুসলিমরাও, এমনকি পাঁচ ওয়াক্ত সলাত আদায়কারী, হালাল-হারাম দেখে শুনে চলা ঈমানদাররাও প্রবৃত্তির এক রোগে আক্রান্ত হয়েছে। তাই তাদের জন্য কিছু নাসীহার সাথে সাথে কুরআনের সেই আয়াতগুলো উল্লেখ করব, যা আজকের যুগের কাফির নাস্তিকদের সাথে মিলে যায় এবং একইসাথে সাবধান করে দেয় মুমিনদের।
মুমিনরা আল্লাহকে বিশ্বাস করে এবং তাঁর দেওয়া বিধিনিষেধ মেনে চলে। স্বাভাবিকভাবেই তার দিন কাটতে থাকে। এর মধ্যে হঠাৎ কেউ নিজেকে নাস্তিক দাবি করলে কৌতুহলী সেই মুমিন ঘাঁটিয়ে দেখতে চায়। কিন্তু তখন তার শয়তানের ধোঁকার কথা খেয়াল থাকে না। খেয়াল থাকে না যে, বারসিসার কাহিনীর প্রথম ও মূল শিক্ষাটা আসলে নারীর ফিতান নিয়ে ছিল না, ছিল শয়তানের ধীরে পদক্ষেপে অত্যন্ত কৌশলে পদস্খলন করানোর ব্যাপারটা উপলব্ধি করা। তাই সে যে শয়তানের ফাঁদের দিকে প্রথম পদক্ষেপ দিয়ে ফেলেছে তা সে বোঝে না।
অল্প কয়েকজন ওইসব নাস্তিকদের তোলা প্রশ্নের কিছু জবাব খুঁজে পেয়ে সন্তুষ্ট হয়। হয়তো কিছুক্ষণের জন্য তার ঈমান কিছুটা বাড়ে। এরপর ধীরে ধীরে সে তাতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। একটা সময় চলে আসে যখন নাস্তিকদের কথাবার্তা আর প্রশ্নের দেওয়া জবাবে সে আসক্ত হয়ে পড়ে। মনের অজান্তে অবস্থা এমন হয়ে যায় যে, নাস্তিকদের কথাবার্তার বিজ্ঞানভিত্তিক আর যুক্তিভিত্তিক উত্তরই তার ঈমান বাড়ার একমাত্র অবলম্বন হয়ে যায়। অনেকে তো তা আবার সজ্ঞানে দাবিও করে।

লেখকের এ লেখাটি পড়তে পারেন  প্রবৃত্তি


কিন্তু তারা আসলে বোঝে না তারা রাসূলের শিক্ষার, সাহাবাদের আর সলফে সলেহীনদের হাঁটা পথের উল্টো পথেই হাঁটছে। ঈমান আনার পর যখন দায়িত্ব ছিল আমল বাড়িয়ে ঈমানকে তরতাজা করা, সেখানে নাফসের তাড়নায় এই মানুষগুলো নিজেদের ঈমানকে বরবাদ হওয়ার দিকে ঠেলে রাখে, নিজেকে জাহান্নামের উপর দোদুল্যমান করে রাখে। হয়তো ফেসবুকের কোনো গ্রুপে বা কোনো নাস্তিকের লিখা ফলো করে তারা প্রতিনিয়িত মানব শয়তান হয়ে উঠা নাস্তিকদের সংস্পর্শে থাকে…।
এরপর একদিন এমন কোনো এক প্রশ্ন বা বিষয়াদি যখন চলে আসে, যার উত্তর সে আর খুঁজে পায় না, তখন তার বিশ্বাসে একটু ফাটল ধরে। প্রথমে খুবই সূক্ষ হয় এই ফাটল, এর প্রভাব খুব বেশি হয় না, কিন্তু এরপর আরও কয়েকদিন পর হয়তো আরেকটা প্রশ্ন বা বিষয়… এভাবে শেষমেশ কতজন ঈমানহারাই হয়ে যায়!
ঈমানকে হারিয়ে যখন সে আল্লাহর দাসত্ব ছেড়ে দিয়ে নাফসের দাসত্ব শুরু করে, তখন শয়তান তার সেইসব কাজগুলোকে মোহনীয় করে তোলে… এভাবে সে দিন দিন আরও দূরে সরে যেতে থাকে। অথচ একেবারে শুরুতেই ওইসব নাস্তিকদের সংস্পর্শে না থাকলে হয়তো কোনোদিনই তার মনে এমন প্রশ্নের উদ্ভবই হতো না।
أَفَلَا يَتَدَبَّرُونَ ٱلۡقُرۡءَانَ أَمۡ عَلَىٰ قُلُوبٍ أَقۡفَالُهَآ (٢٤) إِنَّ ٱلَّذِينَ ٱرۡتَدُّواْ عَلَىٰٓ أَدۡبَـٰرِهِم مِّنۢ بَعۡدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُمُ ٱلۡهُدَى‌ۙ ٱلشَّيۡطَـٰنُ سَوَّلَ لَهُمۡ وَأَمۡلَىٰ لَهُمۡ (٢٥)
“তারা কি কোরআন সম্পর্কে গভীর চিন্তা করে না? না তাদের অন্তর তালাবদ্ধ? নিশ্চয়ই যারা সরলপথ ব্যক্ত হওয়ার পর তা থেকে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করে, শয়তান তাদের জন্যে তাদের কাজকে সুন্দর করে দেখায় এবং তাদেরকে মিথ্যা আশা দেয়।” [সূরা মুহাম্মাদ, ২৪-২৫]
তাই মুমিনদের জন্য নাসীহা –
প্রথমত, আমরা আল্লাহ সুবহানাহুর ওপর দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস স্থাপন করেছি তাঁকে না দেখেই। কোনও প্রমাণ ছাড়াই। আল্লাহ রব্বুল আ’লামীন কুরআনের শুরুতেই সূরা বাকারাহের ২য় ও ৩য় আয়াতে বলেছেন তাঁর কিতাব তাদেরই পথপ্রদর্শক ‘যারা অদেখা বিষয়ে বিশ্বাস স্থাপন করে’, এর তাৎপর্য হল এই যে, কিছু মানুষ কখনোই বিশ্বাস করবে না। এমনকি তাদেরকে চাঁদ দ্বিখণ্ডিত করে দেখালেও তারা বলবে যে সেটা যাদু ছিল… হেন ছিল, তেন ছিল – কিন্তু বিশ্বাস স্থাপন করবে না। শেষমেশ বিশ্বাস ওই ‘না দেখা বিষয়েই’ গিয়ে পড়বে।
ذَٲلِكَ ٱلۡڪِتَـٰبُ لَا رَيۡبَ‌ۛ فِيهِ‌ۛ هُدً۬ى لِّلۡمُتَّقِينَ (٢) ٱلَّذِينَ يُؤۡمِنُونَ بِٱلۡغَيۡبِ وَيُقِيمُونَ ٱلصَّلَوٰةَ وَمِمَّا رَزَقۡنَـٰهُمۡ يُنفِقُونَ (٣)
এ সেই কিতাব যাতে কোনই সন্দেহ নেই। পথ প্রদর্শনকারী পরহেযগারদের জন্য,যারা অদেখা বিষয়ের উপর বিশ্বাস স্থাপন করে এবং নামায প্রতিষ্ঠা করে। [সূরা বাকারাহ, ২-৩]
তাই আল-কুরআন আল্লাহ রব্বুল আ’লামীন পুরো মানবজাতির জন্য নাযিল করলেও তা সাধারণভাবে গায়েবে বিশ্বাস স্থাপনকারীদের পথ প্রদর্শন করে থাকে। এমনটাই তো স্বাভাবিক যে, যারা বিশ্বাস স্থাপন করে না বা করতেও চায় না তারা কুরআন থেকে দিকনির্দেশনা নিবে না। তবে সত্যিকারের সত্যান্বেষী আর ইখলাসপূর্ণ মানুষদের অনেককে আল্লাহ রব্বুল আ’লামীন সরাসরি কুরআন দিয়েও হিদায়াত করেন, সেগুলো ব্যতিক্রম আর আশ্চর্যজনক ঘটনা বলে বিবেচিত হলেও আলাহ রব্বুল আলামীন তা কুরআনে উল্লেখ করেছেন। আল্লাহর কালামের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হল তা মানুষ যেদিকে ধাবিত হতে চায়, তা সেদিকেই ঘুরিয়ে দেয়। তাই একই কুরআন পড়ে কেউ হিদায়াতের দিকে ধাবিত হয়, তো কেউ ধাবিত হয় গোমরাহির দিকে।
ڪَثِيرً۬ا وَيَهۡدِى بِهِۦ كَثِيرً۬ا‌ۚ وَمَا يُضِلُّ بِهِۦۤ إِلَّا ٱلۡفَـٰسِقِينَ (٢٦)
এ দ্বারা আল্লাহ তা’আলা অনেককে বিপথগামী করেন, আবার অনেককে সঠিক পথও প্রদর্শন করেন। তিনি অনুরূপ উপমা দ্বারা অসৎ ব্যক্তিবর্গ ভিন্ন কাকেও বিপথগামী করেন না। [সূরা বাকারাহ, ২৬]
দ্বিতীয়ত, আমাদেরকে সমস্ত প্রশ্নের উত্তর জানানো হয় নাই। কারণ আমাদের সেগুলোর প্রয়োজন নাই। ‘আল্লাহ কেন মহাবিশ্ব সৃষ্টি করলেন, কীই বা হতো কিছু না সৃষ্টি করলে? এমনই একটি প্রশ্নের উত্তর আল্লাহ ফেরেশতাদেরই বলেছিলেন ‘আমি যা জানি, তোমরা তা জান না’। সুতরাং আমরা জানি না তো কী হয়েছে, আল্লাহ সুবহানাহু হলেন ‘আল-আলীম’ অর্থাৎ সর্বজ্ঞ, The All Knowing, তাঁর জ্ঞানের উপর কোনো জ্ঞান বা প্রশ্ন নেই। আর নাস্তিকদের প্রশ্ন তো কিছুই না।
তৃতীয়ত, সেদিন নাস্তিকদের সাথে অবিচারও করা হবে না। এ অবস্থায় মারা গেলে সেদিন তারা কী বলে কান্নাকাটি করবে? তারা বলবে যে তারা নিজেরাই নিজেদের সাথে জুলুম করেছে। আর আল্লাহর কাছে পুনরায় সুযোগ চাইবে; কিন্তু কেউ সেদিন একথা বলবে না যে ‘আমার প্রশ্নগুলোর উত্তর পাই নি’ বা ‘আমার উপর জুলুম করা হয়েছে’।
না না, আসলে তাও না। আল্লাহ হচ্ছেন আমাদের রব! তিনি তো বাধ্য নন তাঁরই এক নগন্য সৃষ্টির প্রশ্নের উত্তর দিতে! আল্লাহকে অবিশ্বাস করে কোনো বড় কিছু হয়ে যায় নি কেউ যে আল্লাহ তাকে উত্তর দিতে বাধ্য। বরং আমরা তাঁর বান্দা! আমরাই না আল্লাহর কাছে বাধ্য! আল্লাহু আকবার! তাই নাস্তিকদেরকে কোনো প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই জাহান্নামে ফেলে দেওয়াও হতে পারে। আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ ন্যায়বিচারক। স্বয়ং আল্লাহ নিজেই এমন ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন, যা নাস্তিকদের সাথে মিলে যায় বলে শুরুতেই উল্লেখ করেছিলাম –
وَلَوۡ تَرَىٰٓ إِذۡ وُقِفُواْ عَلَى ٱلنَّارِ فَقَالُواْ يَـٰلَيۡتَنَا نُرَدُّ وَلَا نُكَذِّبَ بِـَٔايَـٰتِ رَبِّنَا وَنَكُونَ مِنَ ٱلۡمُؤۡمِنِينَ (٢٧)
“আর আপনি যদি দেখেন, যখন তাদেরকে দোযখের উপর দাঁড় করানো হবে! তারা বলবেঃ কতই না ভাল হত, যদি আমরা পুনঃ প্রেরিত হতাম; তা হলে আমরা স্বীয় পালনকর্তার নিদর্শনসমূহে মিথ্যারোপ করতাম না এবং আমরা বিশ্বাসীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যেতাম।” [সূরা আনআম, ২৭]
بَلۡ بَدَا لَهُم مَّا كَانُواْ يُخۡفُونَ مِن قَبۡلُ‌ۖ وَلَوۡ رُدُّواْ لَعَادُواْ لِمَا نُہُواْ عَنۡهُ وَإِنَّہُمۡ لَكَـٰذِبُونَ (٢٨)
“এবং তারা ইতি পূর্বে যা গোপন করত, তা তাদের সামনে প্রকাশ হয়ে পড়েছে। যদি তারা পুনঃ প্রেরিত হয়, তবুও তাই করবে, যা তাদেরকে নিষেধ করা হয়েছিল। নিশ্চয় তারা মিথ্যাবাদী।” [সূরা আনআম, ২৮]
وَقَالُوٓاْ إِنۡ هِىَ إِلَّا حَيَاتُنَا ٱلدُّنۡيَا وَمَا نَحۡنُ بِمَبۡعُوثِينَ (٢٩)
“তারা বলেঃ আমাদের এ পার্থিব জীবনই জীবন। আমাদেরকে পুনরায় জীবিত হতে হবে না।” [সূরা আনআম, ২৯]
وَلَوۡ تَرَىٰٓ إِذۡ وُقِفُواْ عَلَىٰ رَبِّہِمۡ‌ۚ قَالَ أَلَيۡسَ هَـٰذَا بِٱلۡحَقِّ‌ۚ قَالُواْ بَلَىٰ وَرَبِّنَا‌ۚ قَالَ فَذُوقُواْ ٱلۡعَذَابَ بِمَا كُنتُمۡ تَكۡفُرُونَ (٣٠)
“আর যদি আপনি দেখেন; যখন তাদেরকে প্রতিপালকের সামনে দাঁড় করানো হবে। তিনি বলবেনঃ এটা কি বাস্তব সত্য নয়? তারা বলবেঃ হ্যাঁ, আমাদের প্রতিপালকের কসম! তিনি বলবেনঃ অতএব, স্বীয় কুফরের কারণে শাস্তি আস্বাদন কর।” [সূরা আনআম, ৩০]
قَدۡ خَسِرَ ٱلَّذِينَ كَذَّبُواْ بِلِقَآءِ ٱللَّهِ‌ۖ حَتَّىٰٓ إِذَا جَآءَتۡہُمُ ٱلسَّاعَةُ بَغۡتَةً۬ قَالُواْ يَـٰحَسۡرَتَنَا عَلَىٰ مَا فَرَّطۡنَا فِيہَا وَهُمۡ يَحۡمِلُونَ أَوۡزَارَهُمۡ عَلَىٰ ظُهُورِهِمۡ‌ۚ أَلَا سَآءَ مَا يَزِرُونَ (٣١)
“নিশ্চয়ই তারা ক্ষতিগ্রস্ত, যারা আল্লাহর সাক্ষাৎকে মিথ্যা মনে করেছে। এমনকি, যখন কিয়ামত তাদের কাছে অকস্মাৎ এসে যাবে, তারা বলবেঃ হায় আফসোস, এর ব্যাপারে আমরা কতই না ক্রটি করেছি। তার স্বীয় বোঝা স্বীয় পৃষ্ঠে বহন করবে। শুনে রাখ, তারা যে বোঝা বহন করবে, তা নিকৃষ্টতর বোঝা।” [সূরা আনআম, ৩১]
আল্লাহর আয়াত আল্লাহর ওয়াদাস্বরূপ। আর নিশ্চয়ই আল্লাহর ওয়াদা সত্য।
চতুর্থত, আমরা জানি যে আল্লাহ রব্বুল আ’লামীন তাঁর জান্নাতি বান্দাদের সাথে সরাসরি দেখা করবেন ও কথা বলবেন। আর এটাই হল জান্নাতিদের সবচেয়ে বড় পাওয়া – তাঁদের রবের সাথে সাক্ষাত, যিনি আমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন, যাঁকে বান্দারা না দেখেই, কোনো অকাট্য প্রমাণ ব্যতিরেকেই, প্রশ্নগুলোর উত্তর না পেয়েই বিশ্বাস করেছিল। অথবা হয়ত সে সৃষ্টির মধ্যেই যথেষ্ট প্রমাণ মেনে নিয়েছিল বা প্রশ্নগুলোর জানা উত্তরেই সন্তুষ্ট ছিল – কারণ সে মূলত বিশ্বাস করতে চেয়েছিল।
যদি সত্যিই এমন কোনো প্রশ্ন থাকে যেগুলোর উত্তর তুমি সত্যিই জানতে চাও তাহলে তুমি জান্নাতে গিয়ে আল্লাহ সুবহানাহুতা’লাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করলেই পার! সুতরাং তোমারও ওই একটাই পথঃ সিরতল মুস্তাকিম! এর জন্য নিজের ঈমানকে নিয়েই টানাহেঁচড়া তো চূড়ান্ত বোকাদের কাজ।
পঞ্চমত, হিদায়াত কেবল আল্লাহরই হাতে আর নাস্তিকদের উত্তর দেওয়া সবার কাজ না। রাসূলুল্লাহকে ﷺ তাকদির নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি উত্তরে এগুলো নিয়ে কথা বলতে নিষেধ করেছিলেন। আর বলেছিলেন পূর্ববর্তীরা এগুলো নিয়ে মেতে থাকতো বলেই ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। কথাগুলো রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছিলেন সাহাবাদের! আর সেখানে তুমি আমি কত বড় পণ্ডিত হয়েছি যে আমরা এসব নিয়ে অযথা মেতে থাকি। যুগে যুগে নাস্তিক নামক কাফিরদের উত্তর দিতে গিয়েই যত্তসব বিভ্রান্ত আকিদাহের সূত্রপাত হয়েছিল।
এছাড়া ওদের বোঝাতে গিয়ে অনেক যুগে যুগে অনেকেও সজ্ঞানে-অজ্ঞানে আকিদাহের আবশ্যক আল-ওয়ালা ওয়াল বারা’ নষ্ট করে ফেলেছে, কুরআনের আয়াতের বিজ্ঞানভিত্তিক তাউয়িল করে ফেলেছে। আবার অনেকেই পরিবর্তনশীল বিজ্ঞানকেই আল্লাহর দ্বীনের সত্যতা যাচাইয়ের মানদন্ড বানিয়ে বিজ্ঞানকে আল্লাহর দ্বীনের উপরে স্থান দিয়ে ফেলেছে। দ্বীন ইসলামের আহ্বান করতে গিয়ে দ্বীন ইসলামেরই বিকৃতি কখনোই কাম্য নয়। ভাল নিয়্যাত রেখেও ক্ষণে ক্ষণে নাস্তিকদের সংস্পর্শে থাকলে একটি দু’টি প্রশ্ন থেকে সংশয়, আর সেই সংশয়ের উত্তর দিতে গিয়ে এমন আকিদাহ বিচ্যুত হওয়া মুহুর্তের ব্যাপার মাত্র। তাই যাদের ঈমান আনা সংক্রান্ত কোনো প্রশ্ন নেই, এমন প্রশ্ন যা তাকে সত্যিই অস্থির করে দিচ্ছে – এমন অবস্থা না হলে কেবল প্রবৃত্তির তাড়নায় নাস্তিকতা নিয়ে পড়ে থাকা চরম নিন্দনীয়।
গোঁড়া নাস্তিকদেরকে প্রয়োজনের অধিক প্রাধান্য দিলে, ওদের সমস্ত কথার উত্তর দিতে গেলে আকিদাহ বিচ্যুতির সাক্ষ্য ইতিহাসই দেয়। ওদের বেশিরভাগ তো বিশ্বাস করবে না বলেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। অতএব, লেখক এবং চিন্তাশীলদের জন্যও কাফিরদের পিছনে প্রয়োজনের অধিক সময় ব্যয় করা কখনোই কাম্য নয়, এমনকি ওদের বিমুখতা আমাদের জন্য কষ্টকর হলেও।
وَإِن كَانَ كَبُرَ عَلَيۡكَ إِعۡرَاضُہُمۡ فَإِنِ ٱسۡتَطَعۡتَ أَن تَبۡتَغِىَ نَفَقً۬ا فِى ٱلۡأَرۡضِ أَوۡ سُلَّمً۬ا فِى ٱلسَّمَآءِ فَتَأۡتِيَہُم بِـَٔايَةٍ۬‌ۚ وَلَوۡ شَآءَ ٱللَّهُ لَجَمَعَهُمۡ عَلَى ٱلۡهُدَىٰ‌ۚ فَلَا تَكُونَنَّ مِنَ ٱلۡجَـٰهِلِينَ (٣٥)
“আর যদি তাদের বিমুখতা আপনার পক্ষে কষ্টকর হয়, তবে আপনি যদি ভূতলে কোন সুড়ঙ্গ অথবা আকাশে কোন সিড়ি অনুসন্ধান করতে সমর্থ হন, অতঃপর তাদের কাছে কোন একটি মু’জিযা আনতে পারেন, তবে নিয়ে আসুন। আল্লাহ ইচ্ছা করলে সবাইকে সরল পথে সমবেত করতে পারতেন। অতএব, আপনি নির্বোধদের অন্তর্ভুক্ত হবেন না।” [সূরা আনআম, ৩৫]
আল্লাহু আকবার! এমন কথা আল্লাহ রব্বুল আ’লামীন বলছেন তাঁর রাসূলকে ﷺ­!
ওহে আব্দুল্লাহ! ওহে আমাতুল্লাহ! তুমি আকিদাহ বিচ্যুত হলে বা ঈমানহারাই হয়ে গেলে তোমার সেই দ্বীনহীনতায় মহান রব্বুল আ’লামীনের কিছুই আসে যায় না। কিন্তু তোমার অনন্তকালের যে চরম ক্ষতি হয়ে যাবে তা কিন্তু রক্তকান্না কেঁদেও ফল হবে না। তাই তুমি নিজের ঈমান-আকিদাহের হিফাজত করো। তুমি আগুন নিয়ে খেলো না।
========================
লেখক তানভীর আহমেদ