ফুজাইল ডাকাত

535
ইসলামি গল্প

ফুজাইল ডাকাত। সমরকন্দে জন্মেছেন। বেড়ে উঠেছেন আবয়ুর্দে। আবয়ুর্দের একজন মস্তবড় ডাকাত। ‘ফুজাইল ডাকাত’ বলে একনামে সবাই চিনত। সমরকন্দ ও আবয়ুর্দের রাস্তায় ডাকাতি করতেন। এ রাস্তা দিয়ে অতিক্রমকালে পথিকরা ‘ফুজাইল ডাকাত’র হাতে সবকিছু খোয়া যাওয়ার ভয়ে তটস্থ থাকত। ব্যবসায়ী কাফেলা আল্লাহর কাছে তাঁর খপ্পর থেকে বাঁচার জন্য ফরিয়াদ করত। রেহাই পাওয়ার জন্য অনেক কিছুই মান্নত করত।

যৌবনের মৌবনে এক রূপবতী কিশোরীর প্রেমে পড়েছিলেন ফুজাইল ডাকাত। কিশোরীর রূপের ঝলকে তিনি নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলেন। ‘ফুজাইল ডাকাত’র প্রেমের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়া কিশোরীর পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাই সে প্রেমের ডাকে সাড়া দেয়। তারা একে অপরের প্রেমে হাবুডুবু খেতে থাকেন। সুন্দরী কিশোরীর প্রেমে উন্মাদ টগবগে যৌবনের অধিকারী ডাকাত ফুজাইলের দিলে আল্লাহর ভয়ের ছিটেফোঁটাও ছিল না। ছিল না কোনো চিন্তা আখিরাত, কিয়ামত ও দোজখের। কিশোরীর প্রেম ছিল তাঁর নেশা। রাতের আঁধারে ডাকাতি ছিল তাঁর পেশা।

অনেকদিন হয়, কেউ কারও সাথে দেখাসাক্ষাৎ করতে পারছেন না। প্রেমিকার বদনখানি দেখার জন্য মনটা ছটফট করছিল ফুজাইল ডাকাতের। হৃদয়ের না বলা কথাগুলো বুকের ভেতর অস্থিরতা শুরু করে দিয়েছিল। ফুজাইল ডাকাত ছুটলেন প্রেমিকার বাড়ির উদ্দেশে। বাড়ির পাশে চলে এলেন। বাড়ির পাঁচিল টপকে ভেতরে প্রবেশ করতে গেলেন। ইত্যবসরে তাঁর কর্ণকুহরে এসে পৌঁছল সুমধুর কন্ঠে কারও কুরআন তিলাওয়াতের আওয়াজ। কে তার দিলখুশ আওয়াজে তিলাওয়াত করে চলছে সুরা হাদিদের ষোল নং আয়াতখানা-

“যারা মুমিন, তাদের জন্যে কি আল্লাহর স্মরণে এবং যে সত্য বাণী অবর্তীর্ণ হয়েছে, তার কারণে হৃদয় বিগলিত হওয়ার সময় আসেনি ?”

সম্বিত ফিরে পেলেন ফুজাইল ডাকাত। আল্লাহর এই বাণী তাঁর হৃদয়ের বদ্ধ দুয়ারে সজোরে আঘাত করতে সক্ষম হলো। এক আঘাতেই বদ্ধ দুয়ারের কপাট খুলে ফেলল ! মর্মে মর্মে মহাবাণীর এ মহাসুর তাঁর দিলে বাজতে লাগল সুমধুর। তিনি নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলেন না; পাপাচারিতার কালোজাল ছিন্ন করে মনের অজান্তেই বলে উঠলেন, ‘হ্যাঁ, অবশ্যই সময় এসেছে!’ পাঁচিলের উপর থেকেই ফিরে এলেন ফুজাইল ডাকাত। পাঁচিলঘেরা বাড়ির ভেতর প্রেয়সীর সাথে দেখা করার ইচ্ছা সেখানেই দাফন করলেন। আল্লাহর এই কালাম তাঁর বুকের ভেতর তোলপাড় সৃষ্টি করে ফেলেছে। গোনাহের আতিশয্যে তাঁর মৃত অন্তর জিন্দা হয়ে ওঠেছে। তাওবার জন্য তাঁর মনটা আঁতিউঁতি করতে শুরু করেছে।


এটা পড়তে পারেন  আযাদীর শিরোনাম : শহীদ টিপু সুলতান রহ.


ফেরার পথে রাত নেমে এল। গোনাহর পাহাড় মাথায় নিয়ে, অশ্রু টলোমল চোখে, দিকভ্রম ফুজাইল ডাকাত হেঁটে চলছেন। মাথা গুঁজার আশায় আশ্রয়স্থল খুঁজে ফিরছেন। অবশেষে একটি উজাড় করা স্থানে এসে ঠাঁই নিলেন। এসে দেখলেন তাঁর আগেই এই উজাড় করা স্থানে এসে আশ্রয় নিয়েছে একটি ব্যবসায়ী কাফেলা। তিনি শুনতে পেলেন কাফেলার ব্যবসায়ীরা তাদের কর্মপন্থা ঠিক করা নিয়ে মতানৈক্য করছে। কেউ বলছে এখানে অবস্থান না করে সফর অব্যাহত রাখতে। কেউ বাধা দিয়ে বলছে, এখন সফর করা মোটেই নিরাপদ নয়; এই রাস্তায় ফুজাইল নামের এক মস্তবড় ডাকাত আছে। তার খপ্পরে পড়লে উপায় নাই!

ব্যবসায়ীদের কথাগুলো শুনে ফুজাইল ডাকাতের দিল সংকীর্ণ হয়ে গেল। তিনি মনে মনে বললেন, ‘ইয়া আল্লাহ! এই লোকগুলো কী বলে! আমি কি এতটাই বিপজ্জনক?! এতটাই ত্রাসের কারণ?! ফুজাইল নামটা কি এ পথ অতিক্রমকারী ব্যবসায়ী কাফেলার আরাম হারাম হয়ে যাওয়ার উপকরণ?!’ তিনি এটাও ভাবলেন, ‘নিশ্চয় এদের কথা থেকে শিক্ষা নেয়ার জন্যে আল্লাহ আমাকে এখানে পাঠিয়েছেন। নইলে সম্পূর্ণ কাকতালীয়ভাবে এদের সাথে আমার এখানে জড়ো হওয়ার আর কোনো কারণ আছে?’

ফুজাইল ডাকাত মনে মনে বললেন, ‘যাহ! আর ডাকাতি করব না; বাকি জীবন বাইতুল্লাহর ছায়ায় আল্লাহর ইবাদতে কাটিয়ে দেব। কিশোরীর প্রেম বাদ দিয়ে আল্লাহর প্রেমে পাগল হয়ে যাব।’

সকাল হলেই ফুজাইল ডাকাত মক্কার উদ্দেশে রওয়ানা হলেন। ক্রমাগত কয়েকদিন সফর করে অবশেষে মক্কায় এসে পৌঁছলেন ফুজাইল ডাকাত। আল্লাহ-রাসুলের প্রেমে মত্ত হয়ে আল্লাহর ঘরের অবস্থানস্থল মক্কা আর রাসুলের ধূলি ধূসরিত মদিনায় জীবনযাপন করতে লাগলেন।

জানেন কে এই ফুজাইল ডাকাত? ইনি হলেন হিজরি দ্বিতীয় শতকের নামকরা মুহাদ্দিস ইমাম ফুজাইল ইবনে ইয়াজ (মৃত্য-১৮৭ হি.) রহ.। আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক, সুফইয়ান ইবনে উয়াইনা, আব্দুর রহমান বিন মাহদি, আবদুর রাজ্জাক ও ইমাম শাফিয়ি প্রমুখ বড় বড় মুহাদ্দিসদের উস্তাদ। ফুজাইল ডাকাত থেকে ইমাম ফুজাইল বিন ইয়াজ হয়ে গেলেন। যাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিলো কুরআনের একটুকরো বাণী।
——–
সূত্রঃسير أعلام النبلاء ৮/৪২২, ইমাম শামসুদ্দিন যাহাবি রহ.।
————-
লেখক আইনুল হক্ক কাসেমি

Facebook Comments