8.3 C
New York
Friday, October 24, 2025

Buy now

spot_img
Home Blog Page 25

ধন-সম্পদ, সুস্থতা ও আল্লাহ্‌র পরীক্ষা

আবূ হুরাইরাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছেন যে, ‘‘বনী ইসরাঈলের মধ্যে তিন ব্যক্তি ছিল। একজন ধবল-কুষ্ঠ রোগাক্রান্ত, দ্বিতীয়জন টেকো এবং তৃতীয়জন অন্ধ ছিল। আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে পরীক্ষা করার ইচ্ছা করলেন। ফলে তিনি তাদের কাছে একজন ফিরিশতা  পাঠালেন। ফিরিশতা (প্রথমে) ধবল-কুষ্ঠ রোগীর কাছে এসে বললেন,

‘তোমার নিকট প্রিয়মত বস্তু কী?’ সে বলল, ‘সুন্দর রং ও সুন্দর ত্বক। আর আমার নিকট থেকে এই রোগ দূরীভূত হোক – যার জন্য মানুষ আমাকে ঘৃণা করছে।’ অতঃপর তিনি তার দেহে হাত ফিরালেন, যার ফলে (আল্লাহর আদেশে) তার ঘৃণিত রোগ দূর হয়ে গেল এবং তাকে সুন্দর রং দেওয়া হল।

অতঃপর তিনি বললেন, ‘তোমার নিকট প্রিয়তম ধন কী?’ সে বলল, ‘উট অথবা গাভী।’ (এটি বর্ণনাকারীর সন্দেহ।) সুতরাং তাকে দশ মাসের গাভিন একটি উটনী দেওয়া হল। তারপর তিনি বললেন, ‘আল্লাহ তোমাকে এতে বরকত (প্রাচুর্য) দান করুন।’

অতঃপর তিনি টেকোর কাছে এসে বললেন, ‘তোমার নিকট প্রিয়তম জিনিস কী?’ সে বলল, ‘সুন্দর কেশ এবং এই রোগ দূরীভূত হওয়া – যার জন্য মানুষ আমাকে ঘৃণা করছে।’ অতঃপর তিনি তার মাথায় হাত ফিরালেন, যার ফলে তার (সেই রোগ) দূর হয়ে গেল এবং তাকে সুন্দর কেশ দান করা হল। (অতঃপর) তিনি বললেন, ‘তোমার নিকট সবচেয়ে পছন্দনীয় ধন কোনটা?’ সে বলল, ‘গাভী।’ সুতরাং তাকে একটি গাভিন গাই দেওয়া হল এবং তিনি বললেন, ‘আল্লাহ এতে তোমার জন্য বরকত দান করুন।’

অতঃপর তিনি অন্ধের কাছে এলেন এবং বললেন, ‘তোমার নিকটে প্রিয়তম বস্তু কী?’ সে বলল, ‘এই যে, আল্লাহ তা‘আলা যেন আমার দৃষ্টি ফিরিয়ে দেন যার দ্বারা আমি লোকেদেরকে দেখতে পাই।’ সুতরাং তিনি তার চোখে হাত ফিরালেন। ফলে আল্লাহ তাকে তার দৃষ্টি ফিরিয়ে দিলেন। ফিরিশতা বললেন, ‘তুমি কোন্ ধন সবচেয়ে পছন্দ কর?’ সে বলল, ‘ছাগল।’ সুতরাং তাকে একটি গাভিন ছাগল দেওয়া হল।

অতঃপর ঐ দুজনের (কুষ্ঠরোগী ও টেকোর) পশু (উটনী ও গাভীর) পাল বৃদ্ধি পেতে লাগল এবং এই অন্ধের ছাগলটিও বাচ্চা প্রসব করল। ফলে এর এক উপত্যকা ভরতি উট, এর এক উপত্যকা ভরতি গরু এবং এর এক উপত্যকা ভরতি ছাগল হয়ে গেল।


এ গল্পটি পড়ুন সৃষ্টিকর্তার অনুগ্রহ ! শিক্ষণীয় গল্প


পুনরায় ফিরিশতা (পরীক্ষার উদ্দেশ্যে তাঁর পূর্বের চেহারা ও আকৃতিতে) কুষ্ঠরোগীর কাছে এলেন এবং বললেন, ‘আমি মিসকীন মানুষ, সফরে আমার সকল পাথেয় শেষ হয়ে গেছে। ফলে দেশে পৌঁছনোর জন্য আল্লাহ অতঃপর তোমার সাহায্য ছাড়া আজ আমার কোন উপায় নেই। সেজন্য আমি ঐ সত্তার নামে তোমার কাছে একটি উট চাচ্ছি, যিনি তোমাকে সুন্দর রং ও সুন্দর ত্বক দান করেছেন; যার দ্বারা আমি আমার এই সফরের গন্তব্যস্থলে পৌঁছে যাই।’ সে উত্তর দিল যে, ‘(আমার দায়িত্বে আগে থেকেই) বহু অধিকার ও দাবি রয়েছে।’

(এ কথা শুনে) ফিরিশতা বললেন, ‘তোমাকে আমার চেনা মনে হচ্ছে। তুমি কি কুষ্ঠরোগী ছিলে না, লোকেরা তোমাকে ঘৃণা করত? তুমি কি দরিদ্র ছিলে না, আল্লাহ তা‘আলা তোমাকে ধন প্রদান করেছেন?’ সে বলল, ‘এ ধন তো আমি পিতা ও পিতামহ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছি।’ ফিরিশতা বললেন, ‘যদি তুমি মিথ্যাবাদী হও, তাহলে আল্লাহ তোমাকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে দিন!’

অতঃপর তিনি তার পূর্বেকার আকার ও আকৃতিতে টেকোর কাছে এলেন এবং তাকেও সে কথা বললেন, যে কথা কুষ্ঠরোগীকে বলেছিলেন। আর টেকোও সেই জবাব দিল, যে জবাব কুষ্ঠরোগী দিয়েছিল। সে জন্য ফিরিশতা তাকেও বললেন যে, ‘যদি তুমি মিথ্যাবাদী হও, তাহলে আল্লাহ তোমাকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে দিন!’

পুনরায় তিনি তাঁর পূর্বেকার আকার ও আকৃতিতে অন্ধের নিকট এসে বললেন যে, আমি একজন মিসকীন ও মুসাফির মানুষ, সফরের যাবতীয় পাথেয় শেষ হয়ে গেছে। ফলে সবদেশে পৌঁছার জন্য আল্লাহ অতঃপর তোমার সাহায্য ছাড়া আজ আমার আর কোন উপায় নেই। সুতরাং আমি তোমার নিকট সেই সত্তার নামে একটি ছাগল চাচ্ছি, যিনি তোমার দৃষ্টি ফিরিয়ে দিয়েছেন; যার দ্বারা আমি আমার এই সফরের গন্তব্যস্থলে পৌঁছে যাই।’ সে বলল, ‘নিঃসন্দেহে আমি অন্ধ ছিলাম। অতঃপর আল্লাহ আমাকে দৃষ্টি ফিরিয়ে দিলেন। (আর এই ছাগলও তাঁরই দান।) অতএব তুমি ছাগলের পাল থেকে যা ইচ্ছা নাও ও যা ইচ্ছা ছেড়ে দাও। আল্লাহর কসম! আজ তুমি আল্লাহ আয্‌যা ওয়াজাল্লার জন্য যা নেবে, সে ব্যাপারে আমি তোমাকে কোন কষ্ট বা বাধা দেব না।’ এ কথা শুনে ফিরিশতা বললেন, ‘তুমি তোমার মাল তোমার কাছে রাখ। নিঃসন্দেহে তোমাদেরকে পরীক্ষা করা হল (যাতে তুমি কৃতকার্য হলে)। ফলে আল্লাহ তা‘আলা তোমার প্রতি সন্তুষ্ট এবং তোমার সঙ্গীদ্বয়ের প্রতি অসন্তুষ্ট হলেন।’’

==============

রেফারেন্স – রিয়াযুস স্বা-লিহীন, হাদিস নম্বরঃ ৬৬, অধ্যায়ঃ ১/ বিবিধ,

ইসলাম ও নারী – কতিপয় জ্ঞানান্ধের আস্ফালন ও বাস্তব অবস্থা ।

জীবিকার দায় থেকে অব্যাহতি

মূল আলোচনায় ফিরে আসি। জীবনের সবচে’ কঠিন কাজ জীবিকার জন্য ঘাম ঝরানো এবং উপার্জনের জন্য দৌড়ঝাঁপ করা। ইসলাম নারীসমাজের প্রতি অনেক বড় একটি ইহসান এই করেছে যে, তার নিজের এবং পরিবারের অন্যসবার জীবিকা থেকে এবং যাবতীয় অর্থনৈতিক দায়-দায়িত্ব থেকে তাকে সম্পূর্ণরূপে অব্যাহতি দান করেছে এবং তা পুরুষের কাঁধে অর্পণ করেছে। এটা কন্যা হিসাবে, স্ত্রী হিসাবে এবং সন্তানের মা হিসাবে বাবার কাছে, স্বামীর কাছে এবং সন্তানের পিতার কাছে নারীর অধিকার ও প্রাপ্য।

মানবসমাজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য, সভ্যতার অগ্রযাত্রাকে অব্যাহত রাখার জন্য এবং সবচে’ বড় কথা, আল্লাহর পক্ষ হতে অর্পিত খেলাফতের দায়িত্ব বহন করার জন্য সবচে’ গুরুত্বপূর্ণ, সবচে’ কঠিন ও কষ্টকর যে দায়িত্ব তা হলো সন্তান ধারণ ও সন্তান প্রসব। কে পালন করবে এ মহা-দায়িত্ব? আমাদের আল্লাহ এজন্য পুরুষের পরিবর্তে নারীকে নির্বাচন করেছেন এবং নারীর দেহসত্তা ও মানসসত্তাকে সেভাবেই তৈরী করেছেন।

তারপর সবচে’ গুরুত্বপূর্ণ ও জটিল দায়িত্ব হচ্ছে সন্তানের শারীরিক ও মানসিক প্রতিপালন, তার শিক্ষা, দীক্ষা, নৈতিক ও চারিত্রিক উৎকর্ষ সাধন। দুনিয়ার মানুষ গর্ব করে বলে, আজকের শিশু আগামী দিনের আদর্শ নাগরিক। আমরা বলি, আজকের শিশু হলো আগামী দিনের আদর্শ মা, আদর্শ বাবা এবং আলিমে দ্বীন, দাঈ ইলাল্লাহ ও মুজাহিদ ফী সাবীলিল্লাহ। তো কে পালন করবে শিশুকে গড়ে তোলার এ মহাদায়িত্ব? এখানেও নারীর ভূমিকাই বড়। এজন্যই ইসলাম নারীকে জীবিকার দৌড়ঝাঁপ থেকে এবং সর্বপ্রকার অর্থনৈতিক দায়-দায়িত্ব থেকে সযত্নে দূরে সরিয়ে রেখেছে, যেন সে তার উপর অর্পিত দায়িত্ব স্বস্তির সঙ্গে, নিরাপত্তার সঙ্গে এবং মর্যাদার সঙ্গে পালন করে যেতে পারে। পুরুষের কর্তব্য নারীর এই ত্যাগ ও কোরবানিকে কৃতজ্ঞচিত্তে মূল্যায়ন করা এবং জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত নারীর অর্থনৈতিক দায়-দায়িত্ব কৃতার্থতার সঙ্গে পালন করে যাওয়া।

কৃতজ্ঞতা ও কৃতার্থতার সঙ্গে কেন? উত্তরে বলা যায়, মাতৃত্ব দিয়ে নারীকে আল্লাহ গৌরবান্বিত করেছেন, আর পিতৃত্ব দিয়ে পুরুষকে আল্লাহ মুক্তি দান করেছেন। মাতৃত্বের গৌরব অর্জন করার জন্য পৃথিবীর প্রতিটি নারীকে প্রতিবার জীবন-মৃত্যুর ঝুঁকি নিতে হয় এবং দীর্ঘ নয়মাস ব্যথার সাগর পাড়ি দিতে হয়। পক্ষান্তরে পুরুষকে শুধু উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও ব্যয়ভার বহন করতে হয়।

আল্লাহ তো নারী ও পুরুষ উভয়ের স্রষ্টা। তিনি জানেন, মাতৃত্ব কীভাবে অর্জিত হয়, আর পিতৃত্ব লাভ হয় কার কষ্টের সুফলরূপে। আল্লাহ বলেছেন-

ووصينا الانسان بوالديه احسانا حمتله امه كرها ووضعته كرها

 (আর মানুষকে আমি উপদেশ দিয়েছি তার মা-বাবার সঙ্গে সদাচার করার। তার মা তাকে বহন করেছে কষ্ট করে এবং প্রসব করেছে কষ্ট করে।)

আল্লাহ তাআলা পিতামাতা উভয়ের প্রতি সদাচারের আদেশ করার পর বিশেষভাবে মার কষ্টের কথা বলেছেন। এভাবে আল্লাহ নারীর মাতৃত্বকে মহিমান্বিত করেছেন এবং সম্ভবত এ বিষয়েও তাম্বীহ করেছেন যে, পুরুষের পিতৃত্বের পিছনেও নারীর গর্ভযন্ত্রণা ও প্রসববেদনার অবদান।

তো পুরুষ তার এমন জীবনসঙ্গিনীর জন্য একটু ছাদের ছায়া, একটুকরো রুটির অন্ন এবং একখন্ড বস্ত্রের আবরণ যোগাড় করবে না? করতে হবে এবং কৃতজ্ঞতার সঙ্গেই করতে হবে। পুরুষের এটা শুধু নৈতিক দায়িত্ব নয়, আইনগত দায়িত্ব। ইসলামী খিলাফত কায়েম হলে রাষ্ট্রশক্তি পুরুষের এই দায়িত্বপালনের বিষয়টি নিশ্চিত করবে, করতে বাধ্য। এ জন্য নারীকে কেন তার মূল দায়িত্ব ছেড়ে ঘর থেকে বের হতে হবে? কেন তাকে দুনিয়ার ঝামেলায় জড়াতে হবে?

অন্তত মুসলিম বিশ্বে যত সরকার আছে, পাশ্চাত্য ও জাতিসঙ্ঘের হাতে ‘নৃত্যপুতুল’না হয়ে তারা সত্যি যদি নারীর অধিকার নিশ্চিত করতে চায় তাহলে আইন করে এ বিষয়টি নিশ্চিত করুক।

সম্পদসঞ্চয়ের অধিকার

ইসলাম নারীসমাজের উপর দ্বিতীয় যে ইহসান করেছে তা এই যে, তাকে তার নিজস্ব পরিমন্ডলে সম্পদ উপার্জনের এবং সঞ্চয়ের অধিকার দান করেছে। মীরাছ ও মোহররূপে যে সম্পদ সে লাভ করবে, নিজের শ্রম দ্বারা যে সম্পদ সে উপার্জন করবে সেগুলোর উপর তার পূর্ণ অধিকার ইসলাম নিশ্চিত করেছে। নারী যতই সম্পদশালী হোক, তার ভরণপোষণের দায়িত্ব পুরুষের, নারীর নিজের নয়। হাঁ, সচ্ছল নারী যদি স্বামীকে হাদিয়া দেয়, ছাদাকা দেয়, দিতে পারে এবং সে জন্য সে দ্বিগুণ আজর পাবে। যেমন হাদীছ শরীফে এরকম মযমূন এসেছে-হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মসঊদ রাদিয়াল্লাহু আনহুর স্ত্রী হযরত যায়নাব রাদিয়াল্লাহু আনহা তার স্বামী ও কয়েকজন ইয়াতিমের জন্য খরচ করতেন। একবার নবী সাল্লাল্লাহু  আলাইহি ওয়াসাল্লাম নারীদেরকে সদাকা করতে উৎসাহিত করলেন। তখন যায়নাব রা. স্বামীকে বললেন, তুমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে গিয়ে জিজ্ঞাসা কর যে, তোমার জন্য ও আমার তত্ত্বাবধানে থাকা ইয়াতীম শিশুদের জন্য যে খরচ করে থাকি তা ঐ সদাকার মধ্যে গণ্য হবে কি না। তিনি বললেন, আমার লজ্জা করে, তুমিই গিয়ে জিজ্ঞাসা কর।

হযরত যায়নাব দরবারে নববীর দুয়ারে হাযির হলেন। দেখা গেলো, আরো কতিপয় নারী একই উদ্দেশ্যে সেখানে একত্র হয়েছে। এর পর তারা সকলে হযরত বিলাল রাদিয়াল্লাহু আনহুর মাধ্যমে বিষয়টি নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খিদমতে উত্থাপন করলেন, আর নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলে পাঠালেন যে, তারা দ্বিগুণ ছাওয়াব পাবে, সাদাকা করার এবং আত্মীয়তা রক্ষা করার। (সহীহ বুখারী, হাদীস : ১৪৬৬)

পাশ্চাত্যে নারীসমাজের দুর্দশা

আধুনিক যুগে নারী-স্বাধীনতার আন্দোলন মূলত শুরু হয়েছে পাশ্চাত্যে, ধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহেরও শুরু হয়েছিলো পাশ্চাত্যসমাজে। নারী-স্বাধীনতা ও ধর্মের প্রতি বিদ্রোহ, এদু’টোর পিছনে অভিন্ন কারণ কাজ করেছে। প্রথমেই আসে ধর্ম ও সভ্যতার দ্বন্দ্বের বিষয়টি। ইসলামের সোনালী যুগে মুসলিমসমাজে যখন জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা শুরু হয় তখন বিজ্ঞানের সঙ্গে ইসলামের কোন দ্বন্দ্ব দেখা দেয়নি। বরং ইসলাম জ্ঞান-বিজ্ঞানের পরিচর্যায় এগিয়ে এসেছে। কারণ ইসলাম হলো বিজ্ঞানময় ধর্ম। তাই ইসলাম তার অনুসারীকে আলকোরআনের মাধ্যমে শুরু থেকেই আহবান জানিয়েছে যেন আল্লাহর পরিচয় লাভের জন্য সে সৃষ্টিজগত সম্পর্কে চিন্তা করে। ইসলামী জাহানে যখন বিজ্ঞানের স্বর্ণযুগ, পাশ্চাত্য তখন অজ্ঞতার অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিলো। অনেক পরে মুসলিমজাহানের অনুসরণে পাশ্চাত্যে বিজ্ঞানের চর্চা ব্যাপকভাবে শুরু হয়। তবে উভয় সভ্যতার মধ্যে একটি বুনিয়াদি পার্থক্য ছিলো। ইসলামে    জ্ঞানসাধনা ও বিজ্ঞানচর্চার উদ্দেশ্য ছিলো সৃষ্টিজগত সম্পর্কে চিন্তার মাধ্যমে আল্লাহ ও স্রষ্টার পরিচয় লাভ করা, যা অতি বড় ইবাদত;  পক্ষান্তরে পাশ্চাত্য সভ্যতায় বিজ্ঞানচর্চার মূলে ছিলো প্রকৃতির গোপনশক্তিকে আয়ত্ত করে সম্পদ আহরণ করা।

মানবজাতির দুর্ভাগ্য এই যে, ইউরোপে গীর্জার ধর্মনেতারা বিজ্ঞানচর্চার বিরুদ্ধে চরম হিংস্রতার সঙ্গে রুখে দাড়িয়েছিলেন। সে ইতিহাস বড় মর্মন্তুদ, যার বিবরণ তুলে ধরার এখানে অবকাশ নেই। গীর্জার অসহায় ধর্মনেতাদের অবশ্য এছাড়া উপায়ও ছিলো না। কারণ বিজ্ঞান খৃষ্টধর্মের বিশ্বাসের বুনিয়াদ ধরেই নাড়া দিয়েছিলো। ফলে শুরু হয়ে যায় বিজ্ঞান ও খৃষ্টধর্মের সঙ্ঘাত। তাতে স্বাভাবিকভাবেই খৃষ্টধর্মের পরাজয় ঘটে।

যদি বিজ্ঞানের পথে অগ্রসর পাশ্চাত্যের খৃষ্টজগত ইসলাম ধর্মের আশ্রয় গ্রহণ করতে পারতো তাহলে মানবসভ্যতার ইতিহাস আজ অন্যরকম হতো, কিন্তু তা হয়নি। বিজ্ঞান পাশ্চাত্যকে নিয়ে গেছে নাস্তিক্যবাদ ও চরম ভোগবাদের দিকে।

একই ভাবে ইসলাম যেখানে আবির্ভাবলগ্নেই চরম লাঞ্ছনা ও দুর্গতির শিকার নারীজাতিকে তার প্রাপ্য মর্যাদার আসনে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে সেখানে পাশ্চাত্যে এই কিছুদিন আগেও নারী তার মৌলিক মানবিক অধিকার থেকেই ছিলো বঞ্চিত, যার সংক্ষিপ্ত চিত্র পিছনে আমরা তুলে ধরেছি। পাশ্চাত্যে ধর্ম, সমাজ ও সভ্যতা সবকিছু ছিলো নারী-নির্যাতনের হাতিয়ার। কিন্তু  প্রকৃতির অমোঘ নিয়মেই প্রতিটি ক্রিয়ার সমান একটি প্রতিক্রিয়া থাকে। সেই অনিবার্য প্রতিক্রিয়ারূপে সেখানে নারী-স্বাধীনতার আন্দোলন শুরু হয় এবং শুরু হয় অবধারিত সংঘর্ষ। একদিকে ধর্ম, সমাজ ও সভ্যতা যেমন নারী-অধিকার আন্দোলনে সোচ্চার স্বাধীনচেতা নারীদের উপর চরম হিংস্রতায় ঝাঁপিয়ে পড়ে, অন্যদিকে নারীসমাজও সকল নিয়ম-কানুন ও বিধি-বন্ধন ছিন্ন-ভিন্ন করে ঘর থেকে বের হয়ে আসে। ইউরোপে নারীসমাজ যে অমানবিক নিপীড়ন-নির্যাতনের শিকার ছিলো তাতে তাদের বিক্ষোভ ও বিদ্রোহ ছিলো স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক। কিন্তু তাদেরকে আলোর সিঁড়ি এবং মুক্তির রাজপথ দেখিয়ে দেয়ার কেউ ছিলো না। একথা বলারও কেউ ছিলো না যে, ‘যে অধিকার ও স্বাধীনতার জন্য ধর্ম, সভ্যতা ও সমাজের বিরুদ্ধে তোমাদের বিদ্রোহ, তা ইসলাম ও মুসলিম-সভ্যতা শুরু থেকেই তোমাদেরকে সম্মান ও মর্যাদার সঙ্গে দিয়ে রেখেছে।’

এসব কথা তাদের বলার কেউ ছিলো না, বরং লালসাগ্রস্ত সুচতুর একদল পুরুষ তাদের সামনে তুলে ধরে সমঅধিকার ও অবাধ স্বাধীনতার অলীক স্বপ্ন। কারণ তাদের আসল উদ্দেশ্য ছিলো গৃহের নিরাপদ বেষ্টনীর বাইরে এনে নারীকে ভোগের পাত্রী ও লালসার শিকার করা। স্বাভাবিক কারণেই পুরুষের সে হীন উদ্দেশ্য চরিতার্থ হয়েছে।

তো পাশ্চাত্যের নারী-আন্দোলনের ফল কী দাঁড়িয়েছে? নারী তার প্রাকৃতিক ও সামাজিক দায়-দায়িত্ব থেকে কোনভাবেই অব্যাহতি পায়নি এবং পাওয়া সম্ভবও নয়। তদুপরি নিজের ভরণপোষণের দায় এবং পরিবারের অর্থনৈতিক দায়িত্বও চেপেছে তার উপর। জীবন ও জীবিকার কঠিন রণাঙ্গনে নারীকেও নামতে হয়েছে পুরুষের প্রতিদ্বন্দ্বীরূপে। ‘একঠোঙ্গা’ মিষ্টি যত সহজলভ্য, পুরুষের কাছে নারী হয়ে উঠলো তার চেয়েও সহজলভ্য। অথচ শত লাঞ্ছনার পরও নারী ছিলো পুরুষের কাছে দুর্লভ সম্পদ।

স্বাধীনতার নামে কিছু সুযোগ, কিছু সুবিধা পাশ্চাত্য-নারীর সামনে ছুঁড়ে দেয়া হয়েছে, যা আগে সে কোনভাবেই ভোগ করতে পারেনি, কিন্তু বিনিময়ে তার কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হয়েছে তার নারিত্ব, সতিত্ব, মাতৃত্ব, সম্মান, গৌরব ও মর্যাদা। ঘরে হয়ত তাকে একজন পুরুষের সেবা ও মনোরঞ্জন করতে হতো, এখন বাইরে তাকে হতে হয় বহুপুরুষের লালসার শিকার।

শায়খুল ইসলাম হযরত মাওলানা তকী উছমানী, আল্লাহ তাঁকে দীর্ঘজীবী করুন, বড় সুন্দর লিখেছেন, ‘আশ্চর্য তামাশার বিষয় এই যে, নারী যখন ঘরে বসে স্বামী-সন্তানের সেবা করে, খাবার রান্না করে, ঘরদোর সাজায় তখন সেটা হয় পশ্চাদপদতা ও মৌলবাদিতা, পক্ষান্তরে এই নারী যখন বিমানবালা হয়ে চারশ পুরুষের জন্য ট্রে সাজিয়ে খাবার সরবরাহ করে, আর তাদের লালসা-দৃষ্টির শিকার হয় তখন সেটা হয় সম্মান ও মর্যাদা!’ (ইছলাহী মাওয়াইয, পৃ. ১৫৪)

এখানে আমি মুসলিম নারী-সমাজের পক্ষ হতে যথাযোগ্য বিনয়ের সঙ্গে নিবেদন করতে চাই যে, প্রত্যেক জাহিলিয়্যাতের মতো পশ্চিমা জাহিলিয়্যাত ও নারীর প্রতি পশ্চিমা প্রতারণামূলক শোষণ থেকে নিষ্কৃতির একমাত্র উপায় নিঃসন্দেহে ইসলামেই আছে। তবে তা যদি শুধু বইয়ের পাতায় কিংবা মৌখিক আলোচনায় সীমাবদ্ধ থাকে তাহলে এই শিক্ষার কোনো ফায়েদা চোখে পড়বে না। এর জন্য অপরিহার্য হল, খায়রুল কুরূনের পরিবারগুলোর মতো আমাদের সকল পরিবার নারীর জন্য ঐ ইসলামী শিক্ষার বাস্তব নমুনা হওয়া। আমাদের প্রত্যেক আলিম ও মুবাল্লিগের ঘর যেন অন্যদের জন্য উত্তম আদর্শ হয়। আর এর জন্য প্রয়োজন দাওয়াত ও ইলমে দ্বীনের ব্যাপক চর্চা এবং মুবাল্লিগ ও মুআল্লিমদের পরিবারে এর যথাযথ বাস্তবায়ন। এই দায়িত্ব পালনের এখন আর কোনো বিকল্প নেই।

আমি আমার সমাজের পক্ষ হতে আবারও বলবো, আল্লাহর নামে, ইসলামের নামে আমাদের কোন শেকায়াত নেই। আল্লাহর কাছে, ইসলামের কাছে আমরা চিরকৃতজ্ঞ। আমাদের পেয়ারা নবী আমাদের অনেক দিয়েছেন, আমাদের পায়ের নীচে সন্তানের জান্নাত দিয়েছেন; ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। কিন্তু আজকের মুসলিম সমাজ! আল্লাহর ওয়াস্তে ঘরে আমাদের প্রাপ্য মর্যাদাটুকু নিশ্চিত করুন। আমাদের ত্যাগ ও আত্মত্যাগের মূল্যায়ন করুন। বুঝতে চেষ্টা করুন, নারীও মানুষ; তারও ইচ্ছা আছে, আকাঙ্ক্ষা আছে, চাহিদা ও প্রয়োজন আছে। বিশ্বাস করুন, আমাদের ঘরগুলোতে যদি ইসলামী শিক্ষা অনুযায়ী নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তারা  তাদের প্রাপ্য অধিকারসমূহ পেতে থাকেন তখন পৃথিবীর সকল নারী এই সত্যকে নিজের চোখে প্রত্যক্ষ করবে এবং পশ্চিমা সভ্যতার আপাত সৌন্দর্য ও নারীবাদীদের কপট শ্লোগান তাদের প্রতারিত করতে পারবে না। তারা ইসলামের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে নিজেই নিজের মান-মর্যাদা ও ইযযত-আব্রুর হেফাযত করবে।

পাশ্চাত্যে নারী-স্বাধীনতার বিষফল

আমাদের দেশে নারী-স্বাধীনতার যে সয়লাব শুরু হয়েছে এবং স্বার্থবাদী পুরুষদের সুচতুর প্রচারণা ও প্ররোচনায় আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত নারীসমাজের একটা অংশ তাতে যথেষ্ট বিভ্রান্তও হয়েছে, আমার মনে হয়, এর পিছনে দু’টি কারণ রয়েছে। প্রথমত কোরআন-সুন্নায় মুসলিম নারীর যে আদর্শ চিত্র তুলে ধরা হয়েছে এবং ইসলাম নারীকে যে অধিকার ও মর্যাদা দিয়েছে, সোনালী যুগের মুসলিমসমাজে যার বাস্তব নমুনা বিদ্যমান ছিলো, এখনকার মুসলিম সমাজে তা বিদ্যমান নেই। সুতরাং আগেও বলেছি, আবারও বলছি, আমাদের প্রথম কাজ হবে, অন্তত নিজেদের সমাজে ইসলামের সোনালী অতীতের সেই নমুনা আবার ফিরিয়ে আনা, যা দেখে বৃহত্তর মুসলিম নারীসমাজ প্রতারণাকারীদের প্রতারণা বুঝতে পারবে, ইসলামের দেয়া নারী-অধিকারের প্রতি উদ্বুদ্ধ হবে।

দ্বিতীয়ত পাশ্চাত্যের চোখ ধাঁধানো নারী-স্বাধীনতার মোহজালে তারা আটকা পড়ছে; অথচ এর ভিতরের কদর্যতা তাদের সামনে সঠিকভাবে তুলে ধরা হয়নি। এখানে আমি সে বিষয়ে কিছু আলোচনা করতে চাই।

একথা সত্য, পাশ্চাত্যের নারী আজ কিছু স্বাধীনতা ভোগ করছে। বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে তারা যোগ্যতা ও প্রতিভার প্রমাণও দিচ্ছে। তাদের জীবনে আর্থিক সচ্ছলতা ও  প্রাচুর্যও এসেছে। কিন্তু একটা কথা আমরা ভুলে যাই, পাশ্চাত্যে প্রতিটি নারী হিলারি ক্লিন্টন নয়। (অবশ্য শেষ পর্যন্ত তাকেও ক্লিন্টনের নাম, যশঃ ও অপযশঃ সবই বয়ে বেড়াতে হয়।)

শায়খুল ইসলাম হযরত মাওলানা তকী উছমানী বড় শিক্ষণীয় কথা লিখেছেন, ‘নারীরা এখন এ ধোকায় আছে যে, বাইরে বের হয়ে আমার মর্যাদা বেড়েছে। আসলে এ ধোকা দিয়েই তাকে বাইরে বের করে আনা হয়েছিলো। কিন্তু এখন সবকিছু বুঝেও আবার ঘরে ফিরে আসার ক্ষেত্রে সে দ্বিধা-দ্বন্দের শিকার।

তাকে এই ধোকা দেয়া হয়েছিলো যে, তোমরা বাইরে বের হও এবং পুরুষ যত মর্যাদা ও প্রতিষ্ঠা অর্জন করছে তোমরাও তা অর্জন কর। তোমরাও রাষ্ট্রপ্রধান হও। তোমরাও বড় বড় কাজ করো যেমন পুরুষ করছে। কিন্তু পরিসংখ্যান দেখুন, বাইরে বের হয়ে আসা কোটি কোটি নারীর মধ্যে ক’জন রাষ্ট্রপ্রধান, মন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রী হতে পেরেছে। হাতের আঙুলে তাদের গোনা যাবে, আর কোটি কোটি নারীকে রাস্তায় এনে বে-আব্রু করা হয়েছে। (ইছলাহী মাওয়াইয, পৃ. ১৫৩)

পাশ্চাত্যে কর্মজীবী নারীদের শতকরা ক’জন সরকারী-বেসরকারী উচ্চ পদে চাকুরী করে? এবং সেজন্য তাদেরকে কী পরিমাণ মূল্য দিতে হয়? পনেরো দিনও হয়নি, আই, এম, এফ (আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল)-এর ব্যবস্থাপনা প্রধান হোটেল পরিচারিকার উপর যৌননির্যাতনের অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছেন। এর আগে তিনি তার সহকর্মী একনারী অর্থনীতিবিদের উপরও যৌন হামলা চালিয়েছিলেন তবে ক্ষমা চেয়ে পার পেয়েছিলেন। এখন তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন নারীর পক্ষ হতে অসংখ্য অভিযোগ আসতে শুরু করেছে। বলাবাহুল্য, এরা সবাই উচ্চসমাজের নারী। পক্ষান্তরে সিংহভাগ নারীকেই করতে হয় সামান্য বেতনের নিমণস্তরের অসম্মানজনক কাজ, আর তাদের মন ও দেহ ক্ষতবিক্ষত হতে থাকে প্রতিদিন। ‘তাদের কাঁদবারও সুযোগ নেই’ একথা বলেছেন আমেরিকার সি, এন, এন, এর একটি সামাজিক অনুষ্ঠানের উপস্থাপিকা। তিনি নিমণস্তরের কর্মজীবী নারীদের সাক্ষাৎকার প্রচার করেছিলেন।

ড. মুস্তফা সিবাঈ বলেন, ‘পাশ্চাত্য-নারীর স্বাধীন ও জৌলুসপূর্ণ জীবনের যে চিত্র আমাদের দেখানো হয়, বাস্তবে তা খুব কম নারীর ভাগ্যেই জোটে। কোটি কোটি সাধারণ নারীর জীবন সেখানে দাসীর চেয়েও জঘন্য। এমনকি বাইরের  জৌলুসি জীবনের ভিতরেও আছে এমন আগুন-যন্ত্রণা যা অতীতে কোন জাতির নারী কোন সভ্যতার অধীনে ভোগ করেনি।

 আমাদের দেশেও একই চিত্র আপনি দেখতে পাবেন। হাতে গোনা কিছু নারী কর্পোরেট চাকুরি করছে এবং ভোগবিলাসের জীবন যাপন করছে। অন্যরা হয় সাধারণ কর্মক্ষেত্রগুলোতে নিগৃহীত হয়, আর না হয় পথে মাথায় ইটের বোঝা বয়। এর নাম যদি হয় অধিকার ও স্বাধীনতা, তাহলে দূর থেকে তাকে ‘প্রণাম’!

পারিবারিক ব্যবস্থায় ধ্বস

পৃথিবীর সকল প্রাচীন ও আধুনিক সভ্যতা এবং সকল ধর্ম ও সমাজ-ব্যবস্থা এ বিষয়ে একমত যে, মানবসমাজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য  যে কোন মূল্যে পারিবারিক ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখা অপরিহার্য। সেই সঙ্গে প্রাচীন ও আধুনিক সকল সমাজবিজ্ঞানী এটাও স্বীকার করেন যে, নারীই হলো পরিবারের কেন্দ্রবিন্দু। পরিবারব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ার অর্থই হলো সমাজব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়া, আর সমাজব্যবস্থা যখন ভেঙ্গে পড়ে তখন সভ্যতার ধ্বংস অনিবার্য হয়ে পড়ে। প্রাচীন সভ্যতার ক্ষেত্রেও এটা হয়েছে, আধুনিক সভ্যতার ক্ষেত্রেও তা হতে বাধ্য।

নারীর বাইরে আসা এবং কর্মজীবী হওয়ার কারণে ইউরোপ আমেরিকায় আজ পারিবারিক ব্যবস্থা চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। একে তো পাশ্চাত্যের পুরুষ বিবাহবিমুখ হয়ে পড়েছে। তদুপরি কোন দাম্পত্য সম্পর্ক স্থায়ী হচ্ছে না। একজন সমাজবিজ্ঞানী দুঃখ করে বলেছেন, ‘এমন স্বামী বা স্ত্রী এখন আপনি কমই দেখতে পাবেন, যে বলবে, এটা তার তৃতীয় বা চতুর্থ বিবাহ নয়। খুব কম সন্তানই এখন আপন মা, কিংবা আপন বাবাকে কাছে পায়। কুমারি মাতার সংখ্যা দিন দিন শুধু বেড়েই চলেছে না, বরং আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে চলেছে।’

এর প্রধান কারণ হলো, স্ত্রী অর্থ উপার্জন করে সংসারে অর্থের যোগান দিচ্ছে, কিন্তু স্বামীকে পর্যাপ্ত সময় দিতে পারছে না। ফলে পুরুষ ঘরের বাইরের জীবনের প্রতি অতিমাত্রায় আকৃষ্ট হয়ে পড়েছে। এর প্রতিক্রিয়া হিসাবে নারীও শেষ পর্যন্ত একই পথে পা বাড়ায়। ফলে পারস্পরিক অবিশ্বাস এমন চরম আকার ধারণ করে যে, বিচ্ছিন্ন হওয়া ছাড়া কোন উপায় থাকে না। এ ক্ষেত্রে তাদের অল্পবয়স্ক ছেলে-মেয়েরা হয় সবচে’ ক্ষতিগ্রস্ত। তারা ব্যাপকহারে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে এবং বিভিন্ন সহিংস অপরাধে জড়িয়ে পড়ে, যার প্রধান কারণ পারিবারিক তত্ত্বাবধানের অনুপস্থিতি। পরিস্থিতির ভয়াবহতা দেখে খোদ পাশ্চাত্যের         চিন্তাশীল ব্যক্তিগণ আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। তারা সমাজ ও সভ্যতার পতন ঘনিয়ে আসছে বলেও হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করতে শুরু করেছেন। তারা প্রায় সবাই একমত যে, নারীর বহির্মুখী কর্মজীবনই পারিবারিক ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ার একমাত্র কারণ। পাশ্চাত্যের  পূজনীয় দার্শনিক রাসেলও এ কথা বলেছেন।

প্রখ্যাত তাত্ত্বিক অর্থনীতিবিদ জন সিমন বলেন, ‘নারী হয়ত কিছু অর্থ উপার্জন করছে, কিন্তু এর ফলে পরিবার ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।’

আগস্ট কাউন্ট তার ‘রাজনৈতিক ব্যবস্থা’ গ্রন্থে বলেন, ‘সঠিক অর্থে মানব-উন্নয়ন করতে হলে নারী-জীবন যথাসম্ভব পরিবারকেন্দ্রিক ও ঘরোয়া হতে হবে এবং বাইরের কাজ থেকে তাকে মুক্ত রাখতে হবে, যাতে সে তার প্রধান দায়িত্ব পালন করতে পারে।’

তিনি আরো বলেন, ‘এজন্য স্ত্রীর খাদ্যের ব্যবস্থা করা স্বামীর জন্য বাধ্যতামূলক।’

সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্বশেষ প্রেসিডেন্ট গর্ভাচোভ তার সুবিখ্যাত ‘প্রেস্ট্রয়কা’গ্রন্থে বলেছেন, ‘মেয়েদের আমরা বাইরের কর্মক্ষেত্রে নিয়ে এসেছি। তাতে উৎপাদন হয়ত কিছু বেড়েছে, কিন্তু এত বড় বিপর্যয় নেমে এসেছে যা রোধ করার কোন উপায় নেই। আমাদের পারিবারিক ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে গেছে। এখন চিন্তা করে উপায় বের করতে হবে, কীভাবে নারীকে ঘরে আনা যায়।’

ইসলামের পারিবারিক ব্যবস্থা

সবকিছু হারিয়ে পাশ্চাত্য সভ্যতার চিন্তানায়কগণ পরিবার সম্পর্কে আজ যা ভাবছেন, ইসলাম চৌদ্দশ বছর আগেই তা বলে দিয়েছে এবং এরই উপর গড়ে উঠেছে ইসলামের পারিবারিক ব্যবস্থা। কোরআন বলেছে-হে নারীসমাজ, তোমরা তোমাদের ঘরে স্থির থাকো।

ইসলামী বিশ্বে এত অন্যায়-অনাচার, এত অবক্ষয়-অধপতন এবং ‘দুশমনানে ইসলামের’ এত ষড়যন্ত্র-চক্রান্তের পরো এখন পর্যন্ত  যে পারিবারিক ব্যবস্থা কিছু না কিছু টিকে আছে তার মূল কারণ কিন্তু এটাই যে, মুসলিম উম্মাহর সিংহভাগ নারী এখনো ঘরে আছে এবং পরিবার ও সন্তান-সন্তুতির দেখভাল করছে, যদিও অধিকাংশেরই সে শিক্ষা নেই।

পৃথিবীতে কোন প্রতিষ্ঠান একজন পরিচালক ও ব্যবস্থাপক ছাড়া টিকে থাকতে পারে না, একই ভাবে টিকে থাকতে পারে না দু’জন পরিচালকের উপস্থিতিতে। সুতরাং পৃথিবীর সবচে’ গুরুত্বপূর্ণ ও সবচে’ মর্যাদাপূর্ণ প্রতিষ্ঠান পরিবার যেন সুষ্ঠুরূপে পরিচালিত হয় এবং উদ্দেশ্য অর্জনে সফল হয়, পরিবারের জন্য পরিচালক দরকার এবং একজন পরিচালক দরকার। তো ইসলাম তাকেই পরিবার-পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছে যার কাঁধে পরিবারের জন্য অর্থনৈতিক দায়িত্ব অর্পণ করেছে। এটাই একমাত্র যুক্তিপূর্ণ ব্যবস্থা। এর বাইরে যা কিছু করা হবে তা শুধু বিপর্যয়ই ডেকে আনবে।

পাশ্চাত্য কী চায়?

 পাশ্চাত্যসভ্যতার কর্ণধারগণ আজ পরিষ্কার বুঝতে পারছেন যে, তাদের সমাজ ও সভ্যতার অবক্ষয়ের মূল কারণ কী এবং তা থেকে উত্তরণের উপায় কী? কিন্তু অনেক বিলম্ব হয়ে গেছে এবং পরিবার-ব্যবস্থা ভেঙ্গে গিয়ে সমাজ ও সভ্যতার দেহে পচন ধরা শুরু হয়ে গেছে। এখন আর ফিরে আসার কোন উপায় নেই। এ বিষয়ে মিসরের প্রখ্যাত ইসলামি চিন্তাবিদ, ড. মুস্তফা সিবা‘ঈ নিজের বড় শিক্ষণীয় অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন।  তিনি বলেন, ‘১৯৫৬ সালে লন্ডনে জনৈক ইংরেজ অধ্যাপকের সঙ্গে আমার কথা হয়। তিনি আমার কাছে পাশ্চাত্য সভ্যতা সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি জানতে চাইলেন। আমি বললাম, আমরা এর ভালোটুকু গ্রহণ এবং মন্দটুকু বর্জন করি।

তিনি বললেন, এটা সম্ভব নয়। কারণ সভ্যতার সত্তা অবিভাজ্য। যেমন, ইউরোপে শিল্পবিপ্লব পরিবার ভেঙ্গেছে, কারণ কাজের জন্য নারীকে বাইরে আসতে হয়েছে, যা অনিবার্য ছিলো, অথচ সেটাই পরিবার ভাঙ্গার কারণ ছিলো। (এখন কোনটা নেবেন, কোনটা বাদ দেবেন?)


নারী অধিকার বিষয়ে এ লেখাটি পড়তে পারেন  ইসলামে নারীর সম্মান, মর্যাদা ও অধিকার


আমি বললাম, আমার মতে শিল্প বিপ্লব আপনাদের পরিবার ভাঙ্গার কারণ ছিলো না, কারণ ছিলো নারীর গৃহত্যাগ, আর তা অনিবার্য ছিলো না; বরং আপনারাই নারীকে বের করেছেন, প্রথমত  নিজেদের প্রবৃত্তির তাড়নায়, দ্বিতীয়ত অর্থনৈতিক স্বার্থপরতার কারণে। আপনারা চাননি কন্যা হিসাবে, স্ত্রী হিসাবে এবং মা হিসাবে নারীর আর্থিক দায়িত্বভার বহন করতে। ফলে তারা বাড়ির বাইরে যেতে বাধ্য হয়েছে।

তিনি জানতে চাইলেন, এরূপ সমস্যায় আপনারা কী করবেন?

আমি বললাম, ইসলামে নারীর জীবিকা হয় পিতার উপর, না হয় স্বামীর উপর, (কিংবা সন্তানের উপর।) কোন অবস্থাতেই তার নিজের উপর নয়।

তিনি অবাক হয়ে বললেন, পাশ্চাত্য এতটা স্বার্থত্যাগে অক্ষম।

আরেকটি ঘটনা মনে পড়ে। পানির জাহাযে বেলজিয়াম যাওয়ার পথে এক ইতালীয় তরুণীর সঙ্গে কথা হয়। অক্সফোর্ডে অধ্যয়নরতা এই তরুণী আমার কাছে ইসলামে নারীর অধিকার সম্পর্কে জানতে চায়। আমি যখন বললাম, ইসলাম নারীকে উপার্জনের কষ্ট থেকে অব্যাহতি দিয়েছে, সে গৃহকর্ত্রীরূপে তার দায়িত্ব পালন করতে পারে, তখন সে অকপটে বললো, মুসলিম নারীর প্রতি সত্যি আমার ঈর্ষা হয়। কত ভালো হতো আপনাদের দেশে যদি আমার জন্ম হতো! আমি বললাম, তুমি কি পারো তোমার সমাজের নারীকে গৃহমুখী হওয়ার এবং পুরুষকে তার দায়িত্ব পালন করার আবেদন জানাতে?

এবারও সে অকপটে বললো, সময় পার হয়ে গেছে। নারী এখন বাইরের জীবনের স্বাধীনতায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। এখন ঘরোয়া জীবন তার জন্য কঠিন হবে, যদিও আমি বিশ্বাস করি, এতেই তার শান্তি নিহিত।’

মোটকথা পাশ্চাত্যের  চিন্তানায়কগণ জানেন যে এটা এখন অসম্ভব, অন্যদিকে মুসলিম সভ্যতায় পারিবারিক ব্যবস্থা এখনো সম্পূর্ণ অটুট। সুতরাং দুই সভ্যতার সঙ্ঘাতে ইসলামী সভ্যতার বিজয় এবং পাশ্চাত্য সভ্যতার পরাজয় অবশ্যম্ভাবী, যদি না মুসলিম পারিবারিক ব্যবস্থাকেও গুঁড়িয়ে দেয়া যায়। এজন্যই পাশ্চত্যের চিন্তানায়কগণ তথাকথিত নারী-স্বাধীনতার নামে তাদের সমাজদেহের পচনব্যাধি আমাদের সমাজেও ছড়িয়ে দিতে উঠে পড়ে লেগেছে।

=============

লেখক আমাতুল্লাহ তাসনীম সাফফানা

ইসলামে নারীর সম্মান, মর্যাদা ও অধিকার

বর্তমান সময়ে নারী অধিকার গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। এ বিষয়টি নিয়ে পাশ্চাত্য খুবই শোরগোল করছে। যার সূত্র ধরে ইসলাম বিরোধী অপশক্তিগুলোও ইসলামের উপর কালিমা লেপনের অপচেষ্টায় আদাজল খেয়ে মাঠে নেমেছে, পশ্চিমাদের এজেন্ট, কুফরী শক্তির দালালরা ইসলাম ও মুসলিমদের তাহযীব-তামাদ্দুনকে সমূলে ধ্বংস করে মুসলিম উম্মাহকে চিরতরে পঙ্গু করার জন্য যেই ভয়ংকর মিশন নিয়ে মাঠে নেমেছে তার নাম হচ্ছে -নারী অধিকার, নারী স্বাধীনতা।

বর্তমান পাশ্চাত্য এবং ইসলাম বিদ্বেষী অপশক্তি আজ অত্যন্ত কৌশলে মুসলিম উম্মাহর নারীদেরকে টার্গেট করেছে। তারা মুসলিম পারিবারিক ব্যবস্থা বিলুপ্ত করে দেয়ার নীলনকশা বাস্তবায়নের জন্য নারীদেরকে রাস্তায় নামিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে। অধিকার কিংবা আর্থিক স্বনির্ভরতার টোপ ফেলে তারা সহজ-সরল মুসলিম রমণীদেরকে হিজাব ও পর্দার সবচেয়ে নিরাপদ স্থান তাদের ঘর থেকে তাদেরকে মাঠে ময়দানে টেনে আনার অপচেষ্টা করছে।

বাস্তবতার মাথা খেয়ে স্বার্থান্ধ একদল অপরদিকে বলে চলেছে যে, ইসলাম নারীকে শেকল পরিয়ে চার দেয়ালের মাঝে বন্দী করে রেখেছে। ইসলাম নারীকে তার প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে। তাদের উপর চাপিয়ে দিয়েছে জুলুমের বোঝা (নাউযুবিল্লাহ।)

নারী সম্পর্কিত এধরণের হাজারো অভিযোগ আজ চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে ইসলামের উপর। বাঁধ ভাঙ্গা স্রোতের মতো বিষোদ্গারের ঢল নামানো হচ্ছে। অথচ বাস্তবতা হলো এর সম্পূর্ণ বিপরীত। আমি বলবো, কেবলমাত্র ইসলামই এমন এক দীন বা জীবন ব্যবস্থা, যা নারী জাতিকে তাদের ন্যায্য অধিকার দিয়েছে। তাদেরকে সমাসীন করেছে সম্মান ও মর্যাদার সর্বোচ্চ আসনে। আর হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ই একমাত্র ব্যক্তিত্ব যিনি নারীদের সকল অধিকার আদায় করে দেয়ার ব্যবস্থা করেছেন। যদি আমরা ইসলাম পূর্ব আইয়্যামে জাহেলিয়াত, অন্যান্য ধর্ম ও ইসলাম পরবর্তী সময়ের নারীদের অবস্থা ও অবস্থানের দিকে তাকাই তাহলে বিষয়টি দিবালোকের মতো সুস্পষ্ট হয়ে যাবে। কিছু নমুনা—

অন্যান্য ধর্মে নারীর সম্মান,মর্যাদা ও অধিকার ।

ইসলাম আসার পূর্বে সেই আইয়ামে জাহেলিয়াতে নারীদেরকে সামাজিক মর্যাদা দেয়া তো দূরের কথা তাদের বেঁচে থাকার অধিকার পর্যন্ত ছিলো না। কন্যা সন্তান জন্ম গ্রহণের কথা শ্রবণ করার সাথে সাথেই সকলের মুখ কালো হয়ে যেতো। তাকে জীবন্ত মাটিতে পুঁতে ফেলার জন্য সকলে আয়োজনে ব্যতি ব্যস্ত হয়ে উঠতো এবং এই কন্যা সন্তানকে মাটিতে জীবন্ত প্রোথিত করাকেই নিজেদের জন্য সম্মান, মর্যাদা ও পুন্যের কাজ বলে মনে করতো। জাহেলী যুগের সেই সময়কার ভয়বহ এই অবস্থার কথা তুলে ধরে পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে,

وَإِذَا بُشِّرَ أَحَدُهُمْ بِالْأُنْثَى ظَلَّ وَجْهُهُ مُسْوَدًّا وَهُوَ كَظِيمٌ. يَتَوَارَى مِنَ الْقَوْمِ مِنْ سُوءِ مَا بُشِّرَ بِهِ أَيُمْسِكُهُ عَلَى هُونٍ أَمْ يَدُسُّهُ فِي التُّرَابِ أَلَا سَاءَ مَا يَحْكُمُونَ

“আর যখন তাদের কাউকে কন্যা সন্তানের সুসংবাদ দেয়া হয়; তখন তার চেহারা কালো হয়ে যায়। আর সে থাকে দুঃখ ভারাক্রান্ত। তাকে যে সংবাদ দেয়া হয়েছে, সে দুঃখে সে কওমের থেকে আত্মগোপন করে। আপমান সত্ত্বেও কি একে রেখে দেবে, না মাটিতে পুঁতে ফেলবে? জেনে রেখ, তারা যা ফয়সালা করে, তা কতই না মন্দ!” (সুরা নাহল: আয়াত ৫৮, ৫৯)

ইসলাম পূর্ব আরব সমাজে নারীদের অবস্থা এমনই ছিলো। এমনকি ইসলাম ব্যতীত অন্য সকল ধর্মে আজ পর্যন্ত নারী জাতির অধিকারের কোনো স্বীকৃতি দেয়া হয়নি।

হিন্দুধর্মে নারী জাতিকে মৃত্যু, নরক, সর্প, বীষ ও আগুন থেকেও মারাত্মক বলা হয়েছে। স্বামী ছাড়া নারী জাতির আলাদা কোনো অস্তিত্বকে স্বীকার করা হয় নি। যার কারণে স্বামী মারা গেলে স্ত্রীকেও তার স্বামীর সাথে সহমরণে যেতে বাধ্য করার কথা বলা হয়েছে। কিছু নমুনা দেওয়া হল—

  1. নারীরা কোনো নিয়মানুবর্তিতা মেনে চলে না। তাদের বুদ্ধিমত্তা নাই বললেই চলে। [ঋগ্বেদ ৮:৩৩:১৭]
  2. হিন্দু ধর্ম বলে: একজন স্বামী যতই খারাপ হোক না কেন, তথাপি একজনকর্তব্যনিষ্ঠ স্ত্রী সেই স্বামীকে দেবতা হিসেবে ক্রমাগত পূজা করবে। [মনুসংহিতা ৫:১৫৪]
  3. নারীদের মৃত্যুর পর তাদের মৃতদেহ সৎকারের সময় পবিত্র ধর্মগ্রন্থ থেকে কিছু পাঠ করা যাবে না। [মনুসংহিতা ২:৬৬]

হিন্দু ধর্মে নারী,আরও জানুন মনুসংহিতা ৯:১৪,ঋগ্বেদ ৮:৩৩:১৯ ,মনুসংহিতা ২:২১৫


খৃষ্টান ধর্মে নারী
জাতিকে চরম লাঞ্চনার বস্তু বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। তাই তো খৃষ্টান পাদ্রী মি: সেন্ট টার্টুলিয়ামের মতে, নারী হচ্ছে বন্য জন্তুর চেয়েও অধিক বিপদজনক। অন্য আরেক পাদ্রী সেন্ট ক্রিয়ান নারীকে বীষধর সাপের সাথে তুলনা করে তার থেকে দূরে সরে থাকতে বলেছেন। সপ্তদশ শতকে খৃষ্টধর্মের রাজধানী রোমে বিত্তবানদের একটি কাউন্সিল সমবেত সকল শীর্ষ ব্যক্তি এই মর্মে সর্বসম্মতিক্রমে একমত হয়েছিল যে, নারীর কোন আত্মা নেই। দেখুন –

  1. পুরুষের কর্তা হচ্ছে যীশু, আর নারীর কর্তা হচ্ছে পুরুষ।
    But I would have you know, that the head of every man is Christ; and the head of the woman is the man; and the head of Christ is God. (1 Corinthians 11:3)
  2. স্ত্রীরা তাদের স্বামীদের প্রতি আত্মসমর্পণ করবে, যেমন গডের প্রতি তারা আত্মসমর্পণ করে। তার মানে স্ত্রীর কাছে স্বামী হচ্ছে গডের সমতুল্য !
    Wives, submit yourselves unto your own husbands, as unto the Lord. (Ephesians 5:22)
  3. পুরুষকে নারীর জন্য সৃষ্টি করা হয়নি, কিন্তু নারীকে পুরুষের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে।
    For the man is not of the woman: but the woman of the man. Neither was the man created for the woman; but the woman for the man. (1 Corinthians 11:8-9)

ইহুদী ধর্মে নারীকে পুরুষের জন্য প্রতারক বলা হয়েছে। তাদের মতে একজন সতী নারীর চেয়ে একজন পাপিষ্ট পুরুষ বহু গুণে শ্রেষ্ঠ।

বৌদ্ধধর্মে নারী কন্যা সন্তান জন্ম লাভ করাকে অলক্ষণীয় বলে মনে করা হয়। নারীর কোনো অধিকার আছে বলে স্বীকৃতি দেয় না।

এভাবে ইসলাম ছাড়া অন্য সকল ধর্মেই নারী জাতিকে পাপিষ্ট, অলুক্ষুণে, অপয়া ও ক্ষতিকর বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তাদেরকে কোনো অধিকার দেয়া তো দূরের কথা, তাদেরকে মানুষ বলেই স্বীকার করা হয়নি। তারা নারীদেরকে কেবলমাত্র ভোগের পণ্য হিসেবেই গণনা করতো। -এমনিভাবে সর্বত্রই যখন নারী জাতির এমন লাঞ্চনা-গঞ্জনা আর অসম্মান ঠিক সেই বিভীষিকাময় মুহূর্তে ইসলাম এসে তৎকালীন সেই বর্বর যুগের অমানুষিক জুলুম থেকে নারীকে মুক্ত করেছে। ইসলামই একমাত্র দীন -যা নারী জাতিকে ফিরিয়ে দিয়েছে তাদের যথাযথ অধিকার। দেখুন –

ইসলামে নারী অধিকার ।

বেঁচে থাকার অধিকারঃ-

ইসলাম এসে ধাপে ধাপে নারী জাতিকে তাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নিরাপত্তা, সম্মান ও মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছে। যেই সমাজে নারী জন্মই পাপ বলে গণ্য হতো সেখানে ইসলাম সর্বপ্রথমই নারীজন্মের অধিকার নিশ্চিত করেছে। নারী সন্তানকে হত্যাকারীদের জন্য কঠোর হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করেছে। ঘোষণা করেছে,
وَإِذَا الْمَوْءُودَةُ سُئِلَتْ. بِأَيِّ ذَنْبٍ قُتِلَتْ

“আর স্মরণ করো সেই দিনের কথা! যখন জীবন্ত কবরস্থ কন্যাকে জিজ্ঞাসা করা হবে। কী অপরাধে তাকে হত্যা করা হয়েছে?” (সুরা তাকউইর, আয়াত ৮-৯)

কন্যা সন্তানের অধিকার ও মর্যাদা রক্ষায় ইসলাম:-

সন্তান ছেলে হবে না মেয়ে হবে এটি নির্ধারণ করেন স্বয়ং মহান আল্লাহ। তিনি যাকে চান তাকেই নির্দিষ্ট লিঙ্গের সন্তান দান করেন। কাউকে আবার নি:সন্তান করে রাখেন। সুতরাং নি:সন্তানদের তুলনায় কন্যা সন্তানের অভিভাবকগণ যে কতো অকল্পনীয় মর্যাদার অধিকারী এবং কন্যা সন্তানও যে সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান হতে পারে সে সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে,

لِلَّهِ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ يَخْلُقُ مَا يَشَاءُ يَهَبُ لِمَنْ يَشَاءُ إِنَاثًا وَيَهَبُ لِمَنْ يَشَاءُ الذُّكُورَ. أَوْ يُزَوِّجُهُمْ ذُكْرَانًا وَإِنَاثًا وَيَجْعَلُ مَنْ يَشَاءُ عَقِيمًا إِنَّهُ عَلِيمٌ قَدِيرٌ

“আসমানসমূহ ও যমীনের রাজত্ব আল্লাহরই। তিনি যা চান সৃষ্টি করেন। তিনি যাকে ইচ্ছা কন্যা সন্তান দান করেন এবং যাকে ইচ্ছা পুত্র সন্তান দান করেন। অথবা তাদেরকে পুত্র ও কন্যা উভয়ই দান করেন এবং যাকে ইচ্ছা বন্ধ্যা করেন। তিনি তো সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান।” (সুরা শু’রা: আয়াত ৪৯, ৫০)

কুরআনের পাশাপাশি হাদীসের মাঝেও মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কন্যা সন্তানদেরকে খুবই সম্মান ও মর্যাদার উপলক্ষ্য হিসেবে ঘোষণা করেছেন। ইরশাদ হয়েছে,

“ইবনে আব্বাস রা. হতে বর্ণিত; তিনি বলেন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন; যে ব্যক্তির একটি মেয়ে আছে আর সে তাকে তুচ্ছ মনে করে নাই, অপমানিত করে নাই এবং ছেলেদের উপর প্রাদান্য দেয় নাই। আল্লাহ তায়ালা তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন।” (সুনানে আবু দাউদ)

আরো ইরশাদ হয়েছে, “আনাস ইবনে মালেক রা. হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন; যে ব্যক্তি দুটি কন্যা সন্তান সাবালক হওয়া পর্যন্ত লালন-পালন করল সে কেয়ামতের দিবসে আমার সাথে থাকবে।” (সহীহ মুসলিম)

অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে,

عن عقبة بن عامر يقول : سمعت رسول الله صلى الله عليه وسلم يقول ” من كان له ثلاث بنات ، فصبر عليهن وأطعمهن وسقاهن وكساهن من جدته ، كن له حجابا من النار يوم القيامة ” (سنن ابن ماجة)

“উকবা ইবনে আমের হতে বর্ণিত: তিনি বলেন, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে বলতে শুনেছি যে, তিনি বলেন; যে ব্যক্তির তিনটি কন্যা সন্তান আছে অত:পর সে তাদের নিয়ে ধৈর্য্য ধারন করে এবং তাদেরকে ভরণ-পোষণ দিয়ে খাওয়ায় পান করায় তার নিজ সম্পদ থেকে, ক্বিয়ামতের দিবসে ঐ কন্যা সন্তানগুলো তার জন্য জাহান্নাম থেকে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াবে।” (সুনানে ইবনে মাজা)

আরো ইরশাদ হয়েছে,

عن أبى سعيد الخدرى ، قال : قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : (من عال ثلاث بنات فأدبهن وزوجهن وأحسن إليهن فله الجنة) (سنن أبي داود)

“আবু সাঈদ খুদরী হতে বর্ণিত: তিনি বলেল, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন; যে ব্যক্তির তিনটি কন্যা সন্তান আছে, সে তাদেরকে আদব শিক্ষা দিয়েছে এবং বিবাহ দিয়েছে এবং তাদের সাথে সদাচরন করেছে, তার জন্য রয়েছে জান্নাত।” (সুনানে আবু দাউদ)

অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে,
أكمل المؤمنين إيمانا أحسنهم خلقا. وخياركم خيار لنسائه وبناته

“পরিপূর্ণ মু’মিন হলো সেই ব্যক্তি, যার আখলাক-চরিত্র উত্তম। আর তোমাদের মধ্যে সেই সর্বোত্তম, যে তার স্ত্রী-কন্যাদের কাছে উত্তম।””
সম্মান ও মর্যাদায় নারী-পুরুষকে সমান ঘোষণা করেছে ইসলাম:

মানব সমাজে নারী জন্মের অধিকার প্রতিষ্ঠা, কন্যা সন্তানের অধিকার ও মর্যাদা নিশ্চিত করার পর ইসলাম সম্মান ও মর্যাদার ক্ষেত্রেও নারী- পুরুষকে সমান ঘোষণা করেছে। জন্মগতভাবে নারী-পুরুষ আল্লাহর কাছে সমান বলে, নারীকে সম্মান ও মর্যাদার দিক থেকে পুরুষের সমকক্ষ ঘোষণা করে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। ঘোষণা করেছে,

يَا أَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوا رَبَّكُمُ الَّذِي خَلَقَكُمْ مِنْ نَفْسٍ وَاحِدَةٍ وَخَلَقَ مِنْهَا زَوْجَهَا وَبَثَّ مِنْهُمَا رِجَالًا كَثِيرًا وَنِسَاءً وَاتَّقُوا اللَّهَ الَّذِي تَسَاءَلُونَ بِهِ وَالْأَرْحَامَ إِنَّ اللَّهَ كَانَ عَلَيْكُمْ رَقِيبًا

“হে মানুষ, তোমরা তোমাদের রবকে ভয় কর, যিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এক উৎস থেকে। আর তা থেকে তোমাদের স্ত্রীদেরকেও সৃষ্টি করেছেন। এরপর তা থেকে ছড়িয়ে দিয়েছেন বহু পুরুষ ও নারী। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, যার মাধ্যমে তোমরা একে অপরের কাছে চাও। আর ভয় কর রক্ত-সম্পর্কিত আত্মীয়ের ব্যাপারে। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের উপর পর্যবেক্ষক।” (সূরা নিসা, আয়াত ০১)

অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে,

يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّا خَلَقْنَاكُمْ مِنْ ذَكَرٍ وَأُنْثَى وَجَعَلْنَاكُمْ شُعُوبًا وَقَبَائِلَ لِتَعَارَفُوا إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ

হে মানুষ, আমি তোমাদেরকে এক নারী ও এক পুরুষ থেকে সৃষ্টি করেছি আর তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি। যাতে তোমরা পরস্পর পরিচিত হতে পার। তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সেই অধিক মর্যাদাসম্পন্ন যে তোমাদের মধ্যে অধিক তাকওয়া সম্পন্ন। (সুরা আল-হুজরাত: ১৩)

আল্লাহর কাছে শ্রেষ্ঠ ও সফল হওয়ার মানদন্ড নির্ধারণ করা হয়েছে তাকওয়া তথা আল্লাহভীতিকে। তাই একজন নারী একজন পুরুষ হতেও শ্রেষ্ঠ হতে পারে। উপরের আয়াতে এ বিষয়টির দিকে ইঙ্গিত করে পুরুষদেরকে সতর্ক করা হয়েছে।

স্ত্রী হিসেবে নারীর সম্মান-মর্যাদা:-

নারী-পুরুষ বালেগ হওয়ার পর উভয়েই উভয়ের মাধ্যমে পূর্ণতা লাভ করে। কিন্তু এটি যেনো তেনোভাবে না করে এজন্য ইসলাম বিবাহের মতো সুন্দর একটি বিধান দিয়েছে। আর এই বিবাহের মাধ্যমে আসলে মূলত: ইসলাম নারীদেরকেই লাভবান করেছে। দিয়েছে সম্মান ও মর্যাদার এক শীর্ষ চূড়া। বিবাহ সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে,

هُوَ الَّذِي خَلَقَكُمْ مِنْ نَفْسٍ وَاحِدَةٍ وَجَعَلَ مِنْهَا زَوْجَهَا لِيَسْكُنَ إِلَيْهَا

“তিনিই সে সত্তা যিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এক ব্যক্তি থেকে এবং তার থেকে বানিয়েছেন তার সঙ্গিনীকে, যাতে সে তার নিকট প্রশান্তি লাভ করে।” (সূরা আরাফ, আয়াত ১৮৯)

বিবাহের মাধ্যমে মানুষ তাদের প্রাকৃতিক চাহিদা বৈধ পন্থায় পূর্ণ করে। পারিবারিক জীবনে প্রশান্তি লাভ করে। ইরশাদ হয়েছে:

وَمِنْ آيَاتِهِ أَنْ خَلَقَ لَكُمْ مِنْ أَنْفُسِكُمْ أَزْوَاجًا لِتَسْكُنُوا إِلَيْهَا وَجَعَلَ بَيْنَكُمْ مَوَدَّةً وَرَحْمَةً إِنَّ فِي ذَلِكَ لَآيَاتٍ لِقَوْمٍ يَتَفَكَّرُونَ

আর তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের থেকেই স্ত্রীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে প্রশান্তি পাও। আর তিনি তোমাদের মধ্যে ভালবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয় এর মধ্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে সে কওমের জন্য, যারা চিন্তা করে। (সুরা রূম: আয়াত ২১)

আরো ইরশাদ হয়েছে,

وَلَقَدْ أَرْسَلْنَا رُسُلًا مِنْ قَبْلِكَ وَجَعَلْنَا لَهُمْ أَزْوَاجًا وَذُرِّيَّةً

“আর অবশ্যই তোমার পূর্বে আমি রাসূলদের প্রেরণ করেছি এবং তাদেরকে দিয়েছি স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি। (সুরা রা’দ: আয়াত ৩৮)

অন্যত্র আরো ইরশাদ হয়েছে:
هُنَّ لِبَاسٌ لَّكُمْ وَأَنتُمْ لِبَاسٌ لَّهُنَّ

“তোমাদের স্ত্রীরা তোমাদের জন্যে পরিধেয় আর তোমরা তাদের জন্যে পরিধেয়।” (সূরা বাকারা : আয়াত ১৮৭)

বিবাহের মাধ্যমে দুটি পরিবারের মধ্যে আত্মিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। নারী পুরুষের ইজ্জত-সম্ভ্রম হিফাজত হয়। পারিবারিক শান্তি ও সুন্দর জীবন লাভ করা যায়। এছাড়াও বিবাহের মাধ্যমে সামাজিক পর্যায়ে অনেক সুফল পাওয়া যায়। এজন্যেই মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্ত্রীর ভরু-পোষণ দিতে সক্ষম সকল যুবককে বিবাহের নির্দেশ দিয়েছেন। ইরশাদ হচ্ছে:
عن عبد الله بن مسعود قال لنا رسول الله صلى الله عليه و سلم ( يا معشر الشباب من استطاع الباءة فليتزوج فإنه أغض للبصر وأحصن للفرج ومن لم يستطع فعليه بالصوم فإنه له وجاء

“হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, হে যুব সম্প্রদায়! তোমাদের মধ্যে যারা স্ত্রীদের ভরু-পোষণের সক্ষমতা রাখে তারা যেন বিয়ে করে ফেলে। কেনন এটা চোখের প্রশান্তি দানকারী ও লজ্জাস্থানের হিফাজতকারী। আর যারা স্ত্রীদের ভরু-পোষণের সামর্থ্য রাখে না, তারা যেন রোজা রাখে, কেননা এটা তাদের উত্তেজনাকে হ্রাস করবে।” (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৪৭৭৮)

যুবকদেরকে বিবাহের ব্যাপারে উৎসাহিত করার জন্য বিবাহের ফজীলত সম্পর্কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘোষণা করেন,

إذا تزوج العبد فقد استكمل نصف الدين فليتق الله في النصف الباقي

“হযরত আনাস রা. থেকেব বর্ণিত, যখন কোন ব্যক্তি বিবাহ করে, তখন সে যেন তার অর্ধেক ঈমানকে পূর্ণ করে ফেললো। এখন বাকি অর্ধেকের ব্যাপারে সে যেন আল্লাহকে ভয় করে।” (মিশকাত শরীফ: হাদীস নং ৩০৯৭)

স্ত্রীদের গুরুত্ব সম্পর্কে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন:

المرأة الصالحة من السعادة

“উত্তম স্ত্রী সৌভাগ্যর পরিচায়ক।” (মুসলিম শরীফ)

বৈরাগী জীবনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে,

تَزَوَّجُوا فَإِنِّى مُكَاثِرٌ بِكُمُ الأُمَمَ وَلاَ تَكُونُوا كَرَهْبَانِيَّةِ النَّصَارَى

“আবু উমামা রা. হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: তোমরা বিবাহ কর, কেননা আমি তোমাদের নিয়ে উম্মতের আধিক্যের উপর গর্ববোধ করব। এবং তোমরা খৃষ্টান বৈরাগ্যদের মত হয়ো না।” (সুনানে কুবরা লিল বায়হাকী)

পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ পুরুষদেরকে নেককার স্ত্রী ও নেক সন্তান কামনা করা শিখিয়েছেন এভাবে,

وَالَّذِينَ يَقُولُونَ رَبَّنَا هَبْ لَنَا مِنْ أَزْوَاجِنَا وَذُرِّيَّاتِنَا قُرَّةَ أَعْيُنٍ

“আর যারা বলে, ‘হে আমাদের রব, আপনি আমাদেরকে এমন স্ত্রী ও সন্তানাদি দান করুন যারা আমাদের চক্ষু শীতল করবে।” (সুরা ফুরক্বান, আয়াত ৭৪)

অধিক খরচের গ্যারাকলে পরে পুরুষরা যেনো বিবাহ বিমুখ না হয়, সেজন্য ইসলাম বিবাহের ক্ষেত্রে বাহুল্য খরচ বর্জনের কথা বলেছে। বাহুল্য খরচ বর্জিত বিবাহকেই সবচেয়ে বেশী বরকতপূর্ণ ও উত্তম বিবাহ বলে ঘোষণা করা হয়েছে হাদীসের মাঝে। ইরশাদ হয়েছে,

إن أعظم النكاح بركة أيسره مؤنة

হযরত আয়শা রা. থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “নিশ্চয়ই সবচেয়ে বেশি বরকত ও কল্যাণময় বিবাহ হচ্ছে সেটি, যেখানে খরচ কম হয় (অহেতুক খরচ হয় না)।” (বায়হাকী, ঈমান অধ্যায়)

বিবাহের মাধ্যমে নারী-পুরুষ উভয়েই নিজেদের প্রয়োজন পূর্ণ করলেও ইসলাম নারীদের জন্য বোনাস পাওয়ার ব্যবস্থা রেখেছে। পুরুষের উপর বিবাহের সময় স্ত্রীদের জন্য মহর দেয়া ফরজ করেছে। ঘোষণা করেছে,

انْكِحُوهُنَّ بِإِذْنِ أَهْلِهِنَّ وَآتُوهُنَّ أُجُورَهُنَّ بِالْمَعْرُوفِ

“সুতরাং তোমরা তাদেরকে তাদের অভিভাবকদের অনুমতিক্রমে বিবাহ কর এবং ন্যায়সঙ্গতভাবে তাদেরকে তাদের মোহর দিয়ে দাও।” (সূরা নিসা: আয়াত ২৫)

অন্যত্র আরো ইরশাদ হয়েছে,

وَآتُوا النِّسَاءَ صَدُقَاتِهِنَّ نِحْلَةً

“আর তোমরা নারীদেরকে সন্তুষ্টচিত্তে তাদের মোহর দিয়ে দাও।” (সূরা নিসা: আয়াত ৪)

বিবাহের পর স্ত্রীদের সাথে সর্বদা সদাচারণ বজায় রাখার নির্দেশ দিয়ে ইসলাম ঘোষণা করেছে,

وَعَاشِرُوهُنَّ بِالْمَعْرُوفِ

“আর তোমরা তাদের সাথে সদাচারণ করো।” (সূরা নিসা: আয়াত ১৯)

নিজে ভালো খাবে, উত্তম পোষাক পড়বে আর স্ত্রীদেরকে নিম্ন মানের জীবন ধারণে বাধ্য করার জাহেলি মানসিকতাকে সমূলে বিনাশ করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে,

أَسْكِنُوهُنَّ مِنْ حَيْثُ سَكَنْتُمْ مِنْ وُجْدِكُمْ

“তোমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী যেখানে তোমরা বসবাস কর সেখানে তাদেরকেও বাস করতে দাও।” (সূরা তালাক, আয়াত ৬)

নারীর নিজের ভরণ-পোষণের পাশাপাশি সন্তানের দায়িত্বও স্বামীর কাঁধে তুলে দেয়া হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে,

لِيُنْفِقْ ذُو سَعَةٍ مِنْ سَعَتِهِ وَمَنْ قُدِرَ عَلَيْهِ رِزْقُهُ فَلْيُنْفِقْ مِمَّا آتَاهُ اللَّهُ

“বিত্তশালীরা যেনো সামর্থানুযায়ী স্ত্রী-সন্তানের উপর ব্যয় করে। সীমিত উপার্জনকারীরা আল্লাহর দেয়া অর্থানুপাতে ব্যয় করবে।” (সূরা তালাক, আয়াত ৭)

পুরুষদের উপর নারীদের অধিকারের স্বীকৃতি দিয়ে ঘোষণা করেছে,

وَلَهُنَّ مِثْلُ الَّذِى عَلَيْهِنَّ بِالْمَعْرُوفِ وَلِلرِّجَالِ عَلَيْهِنَّ دَرَجَةٌ وَاللَّهُ عَزِيزٌ حَكُيمٌ

“নারীদের উপর যেমন তোমাদের কিছু অধিকার রয়েছে ঠিক তেমনি তোমাদের উপরও তাদের কিছু অধিকার রয়েছে। স্ত্রীর উপর পুরুষের মর্যাদা। আর নিশ্চয়ই আল্লাহ পরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময়।” (সূরা বাকারা : আয়াত ২২৮)

নারীদেরকে দূর্বল ও অসহায় পেয়ে যাতে করে কেউ তাঁদের উপর জুলুম ও অত্যাচার না করে সেজন্যে ইসলাম ঘোষণা করেছে,

وَلاَ تُمْسِكُوهُنَّ ضِرَارًا لِّتَعْتَدُواْ وَمَن يَفْعَلْ ذَٰلِكَ فَقَدْ ظَلَمَ نَفْسَهُ

“আর তোমরা স্ত্রীদেরকে কষ্ট দেয়ার জন্যে আটকে রেখো না। আর যারা এ ধরণের জঘন্যতম অন্যায় করবে তারা নিজেদের উপরই জুলুম করবে।” (সূরা বাকারা : আয়াত ২৩১)

বার্ধক্যেও নারীর সম্মান-মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেছে ইসলাম:

বার্ধক্যে নারীদের দায়িত্ব সন্তানদের উপর অর্পন করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে,

وَوَصَّيْنَا الإِنْسَـٰنَ بِوَالِدَيْهِ حُسْناً

“আর আমি মানুষদেরকে তাদের পিতা-মাতার সাথে সদাচারণের নির্দেশ দিয়েছি।” (সূরা আনকাবুত : আয়াত ৮)

অন্যত্র আরো ইরশাদ হয়েছে,

وَاخْفِضْ لَهُمَا جَنَاحَ الذُّلِّ مِنَ الرَّحْمَةِ وَقُلْ رَبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّيَانِي صَغِيرًا

“আর তুমি তাদের (তোমার পিতা-মাতার) সামনে দীনতার পক্ষপুটকে বিছিয়ে দাও। আর বলো যে, হে আমার রব! আপনি তাদের উপর রহম করুন, যেমন তারা আমার উপর বাল্যকালে রহম করেছেন। ” (সূরা বনী ইসরাঈল : আয়াত ২৪)

অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে,

وَإِن جَـٰهَدَاكَ عَلَىٰ أَن تُشْرِكَ بِى مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ فَلاَ تُطِعْهُمَا وَصَـٰحِبْهُمَا فِى الدُّنْيَا مَعْرُوفاً

“আর তাঁরা যদি তোমাকে আমার সাথে শিরক করার এমন বিষয়ের বাধ্য করে তোমাদের কাছে যার জ্ঞান নেই, তবে (সেক্ষেত্রে) তুমি তাঁদের অনুসরণ করো না। তবে তাঁদের সাথে দুনিয়াতে সৎব্যবহার এবং সদাচারণ বজায় রাখো।” (সূরা লুকমান, আয়াত ১৫)

অনেক ক্ষেত্রেই পুরুষের উপর নারীকে অগ্রাধিকার দিয়েছে ইসলাম
পিতা-মাতার সম্মান ও মর্যাদা বর্ণনার ক্ষেত্রেও ইসলাম নারীদেরকে অগ্রাধিকার ও অধিক সম্মান দিয়েছে। পিতার থেকে মাতার সম্মান ও মর্যাদা বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। নিম্নোক্ত হাদীস থেকে যা পরিস্কারভাবে ফুটে উঠেছে।
عن أبي هريرة رضي الله عنه قال : جاء رجل إلى رسول الله صلى الله عليه وسلم فقال : يا رسول الله من أحق الناس بحسن صحابتي ؟ قال : أمك ,, قال : ثم من ؟ قال : أمك, قال : ثم من ؟ قال : أمك, قال : ثم من ؟ قال : أبوك . (متفق عليه)

“রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে একবার জিজ্ঞাসা করা হলো যে ইয়া রাসূলাল্লাহ! পিতা-মাতার মধ্যে আমার কাছে সবচেয়ে বেশি সম্মান ও মর্যাদার হকদার কে? প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন বললেন, তোমার মা। সাহাবী জিজ্ঞেস করলেন, তারপর কে? প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন বললেন, তোমার মা। সাহাবী জিজ্ঞেস করলেন, তারপর কে? প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন বললেন, তোমার মা। এরপর সাহাবী চতুর্থ বার যখন জিজ্ঞেস করলেন যে, তারপর কে? তখন প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন বললেন, তোমার বাবা।” (বুখারী ও মুসলিম)

এই হাদীসের দ্বারা এটা পরিস্কার হয়ে গেলো যে, নারী জাতিকে ইসলাম মাতৃত্বের উচ্চাসনে বসিয়েছে। তাদেরকে সম্মান ও মর্যাদার সর্বোচ্চ আসনে সমাসীন করেছে।

এছাড়াও অনেক হাদীস আছে যেখানে শুধু মাতার কথাই বলা হয়েছে। যেমন এক হাদীসে রাসূল সা. বলেন,

عن معاوية بن جاهمة أنه جاء النبي صلى الله عليه وسلم فقال : يا رسول الله أردت أن أغزو، وجئت أستشيرك ؟ فقال: “هل لك من أم”؟ قال نعم: قال: “فالزمها فإن الجنة تحت رجليها” رواه النسائي

হযরত মুয়াবিয়া বিনতে জাহিমা নবীজীর সা. এর কাছে এসে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি যুদ্ধে যেতে চাচ্ছি। আপনার কাছে পরামর্শের জন্য এসেছি। তিনি বললেন, তোমার মা আছে কি? সে বলল, হ্যাঁ। তিনি বললেন, তাহলে তাঁকে সঙ্গ দাও। কেননা জান্নাত তাঁর দুই পায়ের নিচে।” (সুনানে নাসাঈ )

সমাজে কেউ যেনো নারী জাতির অবমাননা করতে না পারে সেটিও ইসলাম নিশ্চিত করেছে। অন্যায়ভাবে কেউ কোনো নারীকে অপবাদ দিলে তার জন্য শাস্তির বিধান দিয়েছে। ইরশাদ হয়েছে,
وَالَّذِينَ يَرْمُونَ الْمُحْصَنَاتِ ثُمَّ لَمْ يَأْتُوا بِأَرْبَعَةِ شُهَدَاءَ فَاجْلِدُوهُمْ ثَمَانِينَ جَلْدَةً وَلَا تَقْبَلُوا لَهُمْ شَهَادَةً أَبَدًا وَأُولَئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ

“আর যারা সচ্চরিত্র নারীর প্রতি অপবাদ আরোপ করে, তারপর তারা চারজন সাক্ষী নিয়ে আসে না, তবে তাদেরকে আশিটি বেত্রাঘাত কর এবং তোমরা কখনই তাদের সাক্ষ্য গ্রহণ করো না। আর এরাই হলো ফাসিক।” (সুরা আন-নূর: আয়াত ৪)

আমল ও সওয়াবের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষকে সমান করেছে ইসলাম:-

এভাবে নারীদেরকে দুনিয়ার জীবনে নিশ্চিত, নিরাপদ করার পর পরকালীন জীবনেও তাদের জন্য কল্যাণ ও মঙ্গলের কথা ঘোষণা করেছে। এক্ষেত্রে পুরুষ-নারী বলে কাউকে আলাদা করা হয় নি। ইরশাদ হয়েছে,

مَنْ عَمِلَ صَالِحًا مِنْ ذَكَرٍ أَوْ أُنْثَى وَهُوَ مُؤْمِنٌ فَلَنُحْيِيَنَّهُ حَيَاةً طَيِّبَةً وَلَنَجْزِيَنَّهُمْ أَجْرَهُمْ بِأَحْسَنِ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ

“যে মুমিন অবস্থায় নেক আমল করবে, পুরুষ হোক বা নারী, আমি তাকে পবিত্র জীবন দান করব এবং তারা যা করত তার তুলনায় অবশ্যই আমি তাদেরকে উত্তম প্রতিদান দেব।” (সুরা আন-নাহল: আয়াত ৯৭)

আরো ইরশাদ হয়েছে,
مَنْ عَمِلَ صَالِحًا مِنْ ذَكَرٍ أَوْ أُنْثَى وَهُوَ مُؤْمِنٌ فَلَنُحْيِيَنَّهُ حَيَاةً طَيِّبَةً وَلَنَجْزِيَنَّهُمْ أَجْرَهُمْ بِأَحْسَنِ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ. وَمَنْ يَعْمَلْ مِنَ الصَّالِحَاتِ مِنْ ذَكَرٍ أَوْ أُنْثَى وَهُوَ مُؤْمِنٌ فَأُولَئِكَ يَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ وَلَا يُظْلَمُونَ نَقِيرًا

“আর পুরুষ কিংবা নারীর মধ্য থেকে যে নেককাজ করবে এমতাবস্থায় যে, সে মুমিন, তাহলে তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং তাদের প্রতি খেজুরবীচির আবরণ পরিমাণ যুল্ম ও করা হবে না।” (সুরা নিসা: আয়াত ১২৪)

অন্যত্র আরো ইরশাদ হয়েছে,
أَنِّي لَا أُضِيعُ عَمَلَ عَامِلٍ مِنْكُمْ مِنْ ذَكَرٍ أَوْ أُنْثَى بَعْضُكُمْ مِنْ بَعْضٍ

‘নিশ্চয় আমি তোমাদের কোন পুরুষ অথবা মহিলা আমলকারীর আমল নষ্ট করব না। তোমাদের একে অপরের অংশ। (সুরা আল-ইমরান: আয়াত ১৯৫)

সুরা আল আহযাব এর ৩৫নং আয়াতে আল্লাহ তা’য়ালা বলেন:
أَنِّي لَا أُضِيعُ عَمَلَ عَامِلٍ مِنْكُمْ مِنْ ذَكَرٍ أَوْ أُنْثَى بَعْضُكُمْ مِنْ بَعْضٍ. إِنَّ الْمُسْلِمِينَ وَالْمُسْلِمَاتِ وَالْمُؤْمِنِينَ وَالْمُؤْمِنَاتِ وَالْقَانِتِينَ وَالْقَانِتَاتِ وَالصَّادِقِينَ وَالصَّادِقَاتِ وَالصَّابِرِينَ وَالصَّابِرَاتِ وَالْخَاشِعِينَ وَالْخَاشِعَاتِ وَالْمُتَصَدِّقِينَ وَالْمُتَصَدِّقَاتِ وَالصَّائِمِينَ وَالصَّائِمَاتِ وَالْحَافِظِينَ فُرُوجَهُمْ وَالْحَافِظَاتِ وَالذَّاكِرِينَ اللَّهَ كَثِيرًا وَالذَّاكِرَاتِ أَعَدَّ اللَّهُ لَهُمْ مَغْفِرَةً وَأَجْرًا عَظِيمًا

“নিশ্চয় মুসলিম পুরুষ ও নারী, মুমিন পুরুষ ও নারী, অনুগত পুরুষ ও নারী, সত্যবাদী পুরুষ ও নারী, ধৈর্যশীল পুরুষ ও নারী, বিনয়াবনত পুরুষ ও নারী, দানশীল পুরুষ ও নারী, সিয়ামপালনকারী পুরুষ ও নারী, নিজদের লজ্জাস্থানের হিফাযতকারী পুরুষ ও নারী, আল্লাহকে অধিক স্মরণকারী পুরুষ ও নারী, তাদের জন্য আল্লাহ মাগফিরাত ও মহান প্রতিদান প্রস্তুত রেখেছেন।” (সুরা আহযাব: আয়াত ৩৫)


এটা পড়তে পারেন ইসলাম ও নারী


নারী জীবনের প্রত্যেক পর্যায় সম্পর্কে উপরে বর্ণিত সুন্দর ও সুনিপুন ব্যবস্থাপনা দিয়ে ইসলাম নারী জাতির পুরো জীবনটিকেই একেবারে সহজ, সুন্দর, নিরাপদ ও নির্ভাবনার করে দিয়েছে। কন্যা সন্তানের জন্য বিবাহের আগ পর্যন্ত যাবতীয় ব্যবস্থাপনা ইসলাম তার পিতার উপর ন্যস্ত করেছে। বিবাহের মাধ্যমে তার দায়িত্ব অর্পন করেছে স্বামীর উপর। এরপর মাতা হিসেবে তার দায়িত্ব দিয়েছে সন্তানের উপর।

এমন সুন্দর ব্যবস্থা কারো ক্ষেত্রে কোনো পর্যায়ে বিঘ্নিত হলে সেজন্য আগে থেকেই রিজার্ভ ফান্ডেরও ব্যবস্থা রেখেছে পিতা-মাতার কাছ থেকে ওয়ারিশ হিসেবে প্রাপ্ত সম্পদ, স্বামীর কাছ থেকে প্রাপ্য মোহরানা এবং নিজের উপার্জিত যাবতীয় সম্পদ স্বাধীনভাবে ব্যবহারের অধিকার দিয়েছে। স্বামীদের উপর নিজ স্ত্রীদের জন্য মহরানা প্রদান বাধ্যতামূলক করে ঘোষণা করেছে,
وَآتُوا النِّسَاءَ صَدُقَاتِهِنَّ نِحْلَةً

“আর তোমরা নারীদেরকে সন্তুষ্টচিত্তে তাদের মোহর দিয়ে দাও।” (সূরা নিসা: আয়াত ৪)

ইসলাম নারীর আর্থিক স্বাবলম্বীতা নিশ্চিত করার জন্য বিশেষ প্রয়োজনে শরীয়তের সীমা ঠিক রেখে নারীকে কর্মস্থলে যাওয়ারও অনুমতি দিয়েছে। ইসলাম নারীর নিজের প্রয়োজন পূরণের দায়িত্ব পিতা, স্বামী, সন্তানের উপর ন্যস্ত করলেও; নারীর নিজের আয়, নিজের সম্পত্তি কোনো ব্যবসায় বিনিয়োগ করে সেখান থেকে অর্জিত মুনাফা ইত্যাদির উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ও স্বাধীনতা দিয়েছে নারীর হাতে। এক্ষেত্রে জোর করে অন্য কারো জন্য সম্পদ গ্রাস করাকেও হারাম করেছে।

ইসলামী সমাজব্যবস্থায় নারীর সম্মান ও মর্যাদাঃ-

প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য – তথা সমগ্র বিশ্বব্যাপী নারী নির্যাতন একটি সমস্যা। কিন্তু এ সম্পর্কিত সমস্ত আলোচনায় এমনভাবে এ ব্যাপারটিকে উপস্থাপন করা হয় যেন এটি শুধুমাত্র মুসলিম বিশ্বেরই একটি সমস্যা আর এর কারণ হিসেবে সব সময় দায়ী করা হয় ইসলামকে। ইসলামে নারীর অধিকার ও মর্যাদা সম্পর্কে অনেক ভ্রান্ত ধারণা সমাজে প্রচলিত আছে। যেমন:

– ইসলাম পুরুষকে দিয়েছে নারী নির্যাতন করার অধিকার।
– নারীর নেই শিক্ষা গ্রহণ, রাজনীতি কিংবা অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণের অধিকার।
– নারীর নেই কোন বিষয়ে নিজস্ব মত প্রকাশের অধিকার।
– নারীর নেই স্বামী নির্বাচন বা তালাকের অধিকার।
– হিজাব বা পর্দাপ্রার মূল উদ্দেশ্য নারীদের অবরুদ্ধ করা।
– হিল্লা বিয়ে, গ্রামগঞ্জের মোলাদের অন্যায় ফতোয়া, অনার কিলিং ইত্যাদি ইসলাম অনুমোদিত বিষয়।

কিন্তু বিস্ময়কর হলেও সত্য, উপরোক্ত কোন প্রচারণার সাথেই নেই ইসলামের দূরতম সম্পর্ক। এখন থেকে চৌদ্দ’শত বছর আগে ইসলাম নিষিদ্ধ করেছে সকল প্রকার নারী নির্যাতন। উপযুক্ত সম্মানের সাথে নিশ্চিত করেছে নারীর সুষ্পষ্ট সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকার। কিন্তু, আজ সমস্ত বিশ্বব্যাপী ইসলামী রাষ্ট্রের অনুপস্থিতিতে নারী বঞ্চিত হয়েছে তার আল্লাহ্‌ প্রদত্ত সকল অধিকার থেকে।

ইসলাম নারীদের ভূমিকাকে যথার্থ সম্মান দিয়েছে। একটু বিশ্লেষন ও গবেষনা করলেই আমরা দেখবো মা, স্ত্রী ও কন্যা হিসেবে অথবা একজন পেশাজীবি ও অন্যান্য ক্ষেত্রে ভূমিকা পালনকারী হিসেবে কীভাবে ইসলাম নারীদের মর্যদাকে সুউচ্চ করেছে।

১. সম্মান ও মর্যাদার মাপকাঠি: পুঁজিবাদী সমাজে মূলতঃ নারীর সম্মান ও মর্যাদার মাপকাঠি হচ্ছে নারীর দৈহিক সৌন্দর্য ও আর্থিক প্রতিষ্ঠা। আর ইসলামী সমাজে নারীর সম্মান ও মর্যাদার মাপকাঠি হচ্ছে তার আলাহ্‌ভীরুতা বা তাকওয়া। রাসূল (সাঃ) বলেছেন, “এই পৃথিবী এবং এর মধ্যস্থিত সমস্ত কিছুই মূল্যবান। কিন্তু সবচাইতে মূল্যবান হচ্ছে একজন সৎকর্মশীল নারী।” (মুসলিম)

২. মাতৃত্বের সম্মান: পুঁজিবাদী সমাজ নারীর মাতৃত্বকে দেয়নি কোন সম্মান ও মর্যাদা। আর ইসলাম নারীকে মা হিসাবে করেছে সবচাইতে বেশী সম্মানিত। রাসূল (সাঃ) বলেছেন, “মায়ের পায়ের নীচে সন্তানের জান্নাত।”

৩. গৃহকর্মের মর্যাদা: পুঁজিবাদী সমাজ নারীর গৃহকর্মের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজকে করেছে তুচ্ছতাচ্ছিল্য। আর ইসলাম নারীর গৃহের অভ্যন্তরের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব, সন্তান জন্মদান ও লালনপালন করাকে দিয়েছে জিহাদের মর্যাদা। মূলত এটিই একজন নারীর মৌলিক ও প্রধান কাজ। রাসূল (সাঃ) বলেছেন, “ঘরে তোমরা (নারীরা) তোমাদের সন্তানদের যত্ন নাও আর এটাই তোমাদের জন্য জিহাদ।” (মুসনাদে আহমাদ)

৪. স্ত্রী হিসাবে সম্মান: স্ত্রী হিসাবেও নারীকে ইসলাম দিয়েছে পরিপূর্ণ সম্মান ও মর্যাদা। রাসূল (সাঃ) বলেছেন, “তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি উত্তম যে তার স্ত্রীর কাছে উত্তম। আর নিশ্চয়ই আমি আমার স্ত্রীর কাছে সর্বাপেক্ষা বেশী উত্তম।” (তিরমিযী)

৫. কন্যাসন্তানের সম্মান: পুঁজিবাদ নিয়ন্ত্রিত আধুনিক এই পৃথিবীতে এখনও কন্যাসন্তান অনাকাঙ্খিত। অথচ ইসলাম উত্তম রূপে কন্যা সন্তান লালন-পালন করাকেও ইবাদত হিসাবে গণ্য করেছে। রাসূল (সাঃ) বলেছেন, “যে ব্যক্তির কোন কন্যা সন্তান থাকে এবং তাকে সে উত্তম শিক্ষা দেয়, তার জন্য জান্নাত অবধারিত হয়ে যায়।”

৬. সর্বস্তরে নারীর সম্মান: ইসলাম সমাজের সকল স্তরের মানুষকে নারীর সাথে সম্মানজনক আচরণ করার জন্য উৎসাহিত করেছে। রাসূল (সাঃ) বলেছেন, “শুধুমাত্র সম্মানিত লোকেরাই নারীদের প্রতি সম্মানজনক আচরণ করে। আর যারা অসম্মানিত, নারীদের প্রতি তাদের আচরণও হয় অসম্মানজনক।” (তিরমিযী)

এই হলো ইসলামে নারীর মর্যাদা আর এটা বর্তমান বিশ্বের প্রচলিত মূল্যবোধের মতো নয় যেখানে নারীদের দেখা হয় কেবলমাত্র যৌনতার প্রতীকরূপে এবং ভোগের উপাদান হিসেবে। এর ফলশ্রুতিতে প্রতিনিয়ত নারীরা নির্যাতিত হচ্ছে।

ইসলাম ও নারী

ইসলাম ও নারী ।  আল্লাহ তা‘আলা যখন ফিরেশতাদের সামনে ঘোষণা করলেন-

إني جاعل في الأرض خليفة

পৃথিবীতে আমি খলীফাহ বানাতে চাই। (সূরা বাকারা (২) : ৩০)

তখন প্রকৃতপক্ষে   সেটা শুধু একজন পুরুষ (বা হযরত আদম আ.)কে সৃষ্টি করার ঘোষণা ছিলো না, বরং নর ও নারী সম্মিলিতরূপে যে ‘মানব’ সেই মানব সৃষ্টির ঘোষণা ছিলো। অর্থাৎ সেটা হযরত আদম ও হযরত হাওয়া উভয়ের সৃষ্টির ঘোষণা ছিলো। কারণ পৃথিবীতে মানবজাতির বিস্তার ও খেলাফত শুধু পুরুষ দ্বারা সম্ভব ছিলো না। আদমের খেলাফতে হযরত হাওয়ার ভূমিকা ছিলো অনিবার্য ও অপরিহার্য। জান্নাতে আমাদের বাবা হযরত আদম (আ.)কে যখন সৃষ্টি করা হলো, তখন নিজের মধ্যে তিনি একটি শূন্যতা, একটি অভাব এবং অশান্তি  অনুভব করছিলেন। তিনি যখন ঘুমুলেন তখন তাঁর বামপার্শ্বের অস্থির ঊর্ধ্ব-অংশ থেকে প্রথম নারী হযরত হাওয়াকে সৃষ্টি করা হলো। কেন? আদম যেন তাঁর সঙ্গ দ্বারা সুখ-শান্তি এবং স্বস্তি ও প্রশান্তি লাভ করেন। বস্ত্তত পৃথিবীর প্রথম নারী ছিলেন প্রথম পুরুষের জন্য স্রষ্টার পক্ষ হতে জান্নাতের চেয়েও মূল্যবান উপহার। কারণ জান্নাত তার অফুরন্ত নায-নেয়ামত সত্ত্বেও আদমের অন্তরের শূন্যতা, নিঃসঙ্গতা, অভাব ও অশান্তি দূর করতে পারেনি। একা একা জান্নাত ভোগ করে আদমের অন্তরে শান্তি আসেনি। হযরত হাওয়াকে জীবনসঙ্গিনীরূপে পাওয়ার পরই আদমের কাছে জান্নাত জান্নাত মনে হয়েছিলো। জান্নাতের বাগানে দু’জনের এই যে শান্তির সম্পর্ক, এটা শুধু ঐ দু’জনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। উভয়ের সন্তানসন্তুতির ক্ষেত্রেও সমান সত্য। তাই আল্লাহ ইরশাদ করেছেন-

هو الذي خلقكم من نفس واحدة و جعل منها زوجها ليسكن إليها

তিনি ঐ সত্তা যিনি তোমাদের সৃষ্টি করেছেন একটি ‘নফস’ থেকে এবং বানিয়েছেন তার থেকে তার জোড়া যেন সে তার কাছে স্বস্তি লাভ করে। (সূরা আরাফ : ১৮৯)

সুতরাং বোঝা গেলো, পৃথিবীর প্রতিটি স্ত্রী তার স্বামীর জন্য আল্লাহর পক্ষ হতে একটি পবিত্র উপহার। এজন্যই আল্লাহর নামকে মাধ্যম করে এবং মোহর আদায় করে একটি জান্নাতি উপহাররূপেই নারীকে গ্রহণ করতে হয়। আর এজন্যই বিদায় হজ্বের ঐতিহাসিক মুহূর্তে আল্লাহর পেয়ারা হাবীব ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

و إنكم إنما أخذتموهن بأمانة الله واستحللتم فروجهن بكلمات الله

আর তোমরা তাদের গ্রহণ করেছো আল্লাহর আমানতরূপে, আর তোমরা তাদের ‘লজ্জাস্থান’কে হালাল করেছো আল্লাহর কালিমাকে মাধ্যম করে।’ (সহীহ বুখারী ১/৩৯৭)

তো উপরের আলোচনার সারসংক্ষেপ হলো-

(ক) ফিরেশতাদের সভায় আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হতে খেলাফতের যে ঘোষণা, প্রকৃতপক্ষে তা ছিলো নর ও নারীর সম্মিলিত যে ‘মানবরূপ’ সেই মানবসৃষ্টির ঘোষণা। (তাতে হযরত আদম আ.-এর ভূমিকা অবশ্যই প্রধান, তবে হযরত হওয়া আ.-এর ভূমিকাও ছিলো অনিবার্য ও অপরিহার্য।)

(খ) নারী হচ্ছে নরের জন্য আল্লাহর পক্ষ হতে একটি পবিত্র উপহার। যার উদ্দেশ্য হচ্ছে সুখ শান্তি ও স্বস্তি লাভ করা।

(গ) পুরুষের উপর আল্লাহর পক্ষ হতে অর্পিত দায়িত্ব ও কর্তব্য হচ্ছে নারীকে তার প্রাপ্য অধিকার ও মর্যাদা দান করা এবং নারীর জীবনে সুখ-শান্তি নিশ্চিত করা। কারণ কোন নারী যদি তার পরিবারে লাঞ্ছিত ও অসম্মানিত হয়; তার জীবনে যদি অশান্তি থাকে তাহলে সে পুরুষের জন্য সুখ-শান্তি ও স্বস্তির মাধ্যম কিছুতেই হতে পারবে না।

হযরত আদম আ. যত দিন জান্নাতে ছিলেন, তারপর যতদিন দুনিয়াতে জীবনযাপন করেছেন মা হাওয়াকে তিনি তাঁর জীবনসঙ্গিনীরূপে প্রাপ্য অধিকার ও মর্যাদা পরিপূর্ণরূপে দান করেছেন এবং সর্বদিক থেকে তাঁর সুখ-শান্তি নিশ্চিত করেছেন। ফলে তিনি নিজেও মা হাওয়ার সঙ্গে থেকে সুখ-শান্তি লাভ করেছেন।

হযরত আদম (আ.)-এর ইনতিকালের পর মানবজাতি যত দিন তাদের পিতার তরীকার উপর ছিলো এবং নারীকে তার প্রাপ্য অধিকার ও মর্যাদা দান করেছিলো তত দিন তারা সুখে শান্তিতেই জীবন যাপন করেছে। নারীর কাছে সে সুকূন ও স্বস্তি পেয়েছে।

কিন্তু একটা সময় এলো যখন মানুষ আল্লাহর বিধান ও শরীআত ভুলে গেলো এবং শয়তানের প্ররোচনায় হিদায়াত ও সত্যপথ হতে ভ্রষ্ট হলো তখন অন্যান্য অনাচারের সঙ্গে নারীজাতির উপরও নেমে এলো বিভিন্ন অনাচার-অবিচার। বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন সভ্যতায় নারীজাতিকে কী কী দুর্গতি ও লাঞ্ছনা ভোগ করতে হয়েছে এখানে আমরা সংক্ষেপে তা তুলে ধরছি।

বিভিন্ন ধর্ম ও সভ্যতায় নারী

গ্রীক ও রোমান সমাজে নারীকে মনে করা হতো সকল অনিষ্টের মূল এবং সবচে’ নিকৃষ্ট প্রাণী। পরিবারে মা, বোন, স্ত্রী ও কন্যা কোন নারীর মর্যাদাই দাসীর চেয়ে বেশী ছিলো না। নারী ছিলো বাজারে বেচা-কেনার পণ্য। পরিবার-প্রধান যে কোন নারীকে বাজারে বিক্রি করতে পারতো।

কারণ আইনগতভাবেই নারী ছিলো পরিবারের অস্থাবর সম্পত্তি।

কোন পর্যায়েই নারীর উত্তরাধিকার স্বীকৃত ছিলো না। পুরুষের অনুমতি ছাড়া নারী তার সম্পত্তি ভোগ করতে পারতো না এবং হস্তান্তরও করতে পারতো না।

বিবাহের ক্ষেত্রে নারীর নিজস্ব কোন ইচ্ছা বা অধিকার ছিলো না। পরিবারের প্রধান পুরুষ যে স্বামী নির্বাচন করতো তাকেই গ্রহণ করতে নারী বাধ্য ছিলো।

প্রত্যেক ক্রিয়ার একটি প্রতিক্রিয়া থাকে, এটাই প্রকৃতির অমোঘ বিধান। সে হিসাবে গ্রীক ও রোমান উভয় সভ্যতারই শেষ দিকে বিপরীত প্রতিক্রিয়া দেখা দিলো। নারীসমাজ বাঁধভাঙ্গা জোয়ারের মত উশৃঙ্খল হয়ে উঠলো এবং সমাজের সর্বত্র নগ্নতা ও যৌননৈরাজ্য ছড়িয়ে পড়লো, যার অনিবার্য ফলরূপে গ্রীক ও রোমান সভ্যতা বিলুপ্ত হয়ে গেলো।

তুরস্কের সুপ্রসিদ্ধ নারী বুদ্ধিজীবী খালিদা এদিব খানম গ্রীক ও রোমান সভ্যতায় নারীর লাঞ্ছনা সম্পর্কে ‘তুরস্কে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের দ্বন্দ্ব’ নামক গ্রন্থে অত্যন্ত বিশদ আলোচনা করেছেন।

ইহুদিজাতি ও খৃস্টধর্মে

নারীকে অভিশপ্ত মনে করা হয়, কারণ তাদের ধারণায় আদমকে ভ্রষ্ট করার জন্য শয়তান হাওয়াকেই অস্ত্ররূপে ব্যবহার করেছিলো। উভয়জাতির বিশ্বাস ছিলো যে, স্ত্রীলোক  স্বর্গরাজ্যে প্রবেশ করতে পারবে না, কারণ তার মধ্যে মানবাত্মা নেই। এই বিশ্বাসের ভিত্তিতেই  ৫৮৬ খৃস্টাব্দে ফ্রান্সে এক ধর্মসম্মেলনে সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছিলো যে, স্ত্রীলোককে মানুষ বলা তো যায়, তবে তাকে শুধু পুরুষের সেবার জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে।

খৃস্টধর্মের প্রভাবে নারীর প্রতি পাশ্চাত্যজগতের আচরণ ছিলো চরম অবমাননামূলক, যা মধ্যযুগ পর্যন্ত অব্যাহত ছিলো। এমনকি ১৮০৫ সাল পর্যন্ত বৃটিশ আইনে স্বামীর অধিকার ছিলো স্ত্রীকে বিক্রি করার। অন্যদিকে ফরাসী বিপ্লবের পরও নারীর অধিকার ও মর্যাদা রক্ষা করার কথা সেখানকার চিন্তানায়কদের মাথায় আসেনি। ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত ফরাসী নাগরিক আইনে অভিভাবকের অনুমতি ছাড়া নারীর অধিকার ছিলো না কোন বিষয়ে কোন পক্ষের সঙ্গে চুক্তিতে আবদ্ধ হওয়ার।

হিন্দুসমাজে নারীর অবস্থা ছিলো সবচে’ করুণ। এ প্রসঙ্গে শুধু সতীদাহ-এর কথা উল্লেখ করাই যথেষ্ট, যা এই মাত্র সেদিন সংস্কারবাদী নেতা রাজা রামমোহন রায় ব্যাপক আন্দোলনের মাধ্যমে বাতিল করিয়েছেন।

আরব জাহিলিয়াতের সমাজেও আছে নারীর প্রতি নিষ্ঠুরতা ও নির্মমতার মর্মন্তুদ ইতিহাস। শুধু  এইটুকু উল্লেখ করাই যথেষ্ট যে, কন্যাসন্তানের জন্মকে তখন মনে করা হতো চরম কলঙ্কের বিষয়। জাহেলি সমাজের এই চিত্রটি দেখুন আলকোরআনে-

وإذا بشر إحدهم بالأنثى ظل وجهه مسودا و هو كظيم، يتوارى من القوم من سوء ما بشر به,  أيمسكه على هون أم يدسه في التراب, ألا ساء ما يحكمون

 (আর যখন তাদের কাউকে কন্যাসন্তান জন্মের সংবাদ দেয়া হতো তখন দুশ্চিন্তায় তার মুখ কালো হয়ে যেতো, আর বিষাদে আচ্ছন্ন হয়ে থাকতো। ঐ জঘন্য খবরের কারণে মানুষের কাছ থেকে সে মুখ লুকিয়ে ফিরতো। (আর দিশেহারা হয়ে ভাবতো যে কী করবে সে?) লাঞ্ছনা সহ্য করে তাকে রেখে দেবে, না মাটিতে পুতে ফেলবে। কত মন্দ ছিলো তাদের এ মনোভাব! (সূরা নাহল : ৫৮)

সেখানে নারীর জন্মগ্রহণই ছিলো অপরাধ, আর বেঁচে থাকা ছিলো আরো বড় অপরাধ। তাই অধিকাংশ সময় জন্মদাতা পিতা কন্যাসন্তানকে মায়ের বুক থেকে ছিনিয়ে নিতো এবং নিজের হাতে জ্যান্ত দাফন করে ফেলতো। অসহায় মায়ের বাধা দেয়ার কোন অধিকার ছিলো না। তাই কন্যাসন্তান জন্ম দেয়ার আশঙ্কায় মা ভুলে যেতো তার প্রসববেদনা। অস্থির পেরেশান হয়ে শুধু ভাবতো পিতার নিষ্ঠুরতা থেকে কীভাবে সে বাঁচাবে তার সন্তানকে? কোথায় কীভাবে লুকাবে সে তার কলিজার টুকরোকে?  কোরআনে অত্যন্ত আবেদনপূর্ণ ভাষায় এই নিষ্ঠুর প্রথার নিন্দা করে বলা হয়েছে-

وإذا الموؤودة سئلت0 بأي ذنب قتلت0

আর যখন জ্যান্ত দাফনকৃত কন্যাকে জিজ্ঞাসা করা হবে যে, কোন অপরাধে তাকে হত্যা করা হয়েছিলো (তখন কী জবাব দেবে তোমরা?) (সূরা আত-তাকভীর : ৮ ও ৯)

তো এই ছিলো ইসলামের পূর্বে বিশ্বের বিভিন্ন ধর্ম, সমাজ  ও সভ্যতায় নারীদের অবস্থা ও মর্যাদাগত অবস্থান। এককথায় যদি বলি তাহলে বলতে হয়, মানুষ হিসাবে নারীর কোন মর্যাদাই ছিলো না। চরম লাঞ্ছনা ও যিল্লতি ছাড়া তার ভাগ্যে আর কিছুই ছিলো না।

ইসলামে নারীর মর্যাদা

প্রথম কথা এই যে, মৌলিক মানবিক অধিকারের ক্ষেত্রে এবং দ্বীন ও ধর্মের যাবতীয় কর্মের ক্ষেত্রে ইসলাম নারীকে পুরুষের সমমর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছে।

বিকৃত ইহুদিধর্ম ও খৃস্টধর্ম যেখানে আদমের বিচ্যুতির জন্য হাওয়াকে অপরাধী সাব্যস্ত করেছে ইসলাম সেখানে আদম ও হাওয়া দুজনকে ভুল ও ক্ষমা প্রার্থনা উভয়ক্ষেত্রে অভিন্ন সাব্যস্ত করেছে। ইরাশাদ হয়েছে-

فأزلهما الشيطن عنها

শয়তান উভয়কে তা থেকে বিচ্যুত করেছে। (সূরা বাকারা : ৩৬)

ভুল শোধরানো সম্পর্কে বলা হয়েছে-

قالا ربنا ظلمنا أنفسنا

তারা উভয়ে বললো, হে আমাদের প্রতিপালক, আমরা নিজেদের উপর জুলুম করেছি। (সূরা আরাফ : ২৩)

তবে যেহেতু পরিচালক হিসাবে আদমের দায়িত্ব ছিলো বেশী সেহেতু এককভাবে তার সম্পর্কে বলা হয়েছে-

فنسى ولم نجد له عزما

সে ভুলে গিয়েছিল। আমি তাকে সংকল্পে দৃঢ় পাইনি। (সূরা ত্বহা : ১১৫)

নারী ও পুরুষের মৌলিকভাবে সমান অধিকার ও মর্যাদার স্বীকৃতি দিয়ে কোরআনে বলা হয়েছে-

هن لباس لكم و أنتم لباس لهن

এবং নারীদের তেমনি ন্যায়সঙ্গত অধিকার আছে, যেমন আছে তাদের উপর পুরুষদের। তবে তাদের উপর পুরুষদের এক পর্যায়ের প্রাধান্য রয়েছে। আল্লাহ পরাক্রান্ত ও প্রজ্ঞাময়। (সূরা বাকারা : ২২৮)

এই এক পর্যায়ের প্রাধান্য হল, অভিভাবক ও তত্ত্বাবধানের মর্যাদা, যা সূরা নিসার ৩৪ নং আয়াতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। আর এটি স্বামী-স্ত্রীর জীবন চলার পথে একটি অপরিহার্য বিষয়।

হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে-

إنما النساء شقائق الرجال

অর্থাৎ নারীরা হলো পুরুষের সমতুল্য। (সুনানে আবু দাউদ ১/৩১)

আরো ইরশাদ হয়েছে-

من كانت له أنثى فلم يئدها و لم يهنها و لم يؤثر ولده الذكور عليها أدخلها الله الجنة

যে ব্যক্তি কন্যসন্তানকে জ্যান্ত দাফন করবে না এবং তার অমর্যাদা করবে না এবং পুত্রসন্তানকে তার উপর অগ্রাধিকার দেবে না আল্লাহ তাকে জান্নাতে দাখেল করবেন। (সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ৫১০৩)

দ্বীন ও ধর্মের যাবতীয় কর্মে নারী ও পুরুষের সমমর্যাদা সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে-

و من عمل صلحا من ذكر أو أنثى و هو مؤمن فأؤلئك يدخلون الجنة يرزقون فيها بغير حساب

আর যে কোন পুরুষ বা নারী নেক আমল করবে, আর সে মুমিন হবে, তাহলে তারা জান্নাতে দাখেল হবে এবং সেখানে তাদেরকে বেলা হিসাব রিযিক দান করা হবে। (সূরা মুমিন : ৪০)

আরো ইরশাদ হয়েছে-

فاستجاب لهم ربهم أني لا أضيع عمل عمل منكم من ذكر أو أنثى, بعضكم من بعض

অনন্তর তাদের প্রতিপালক তাদের দু‘আ কবুল করলেন (আর বললেন) যে, আমি তোমাদের কোন আমলকারীর আমল নষ্ট করবো না, সে পুরুষ হোক, বা নারী। তোমরা তো পরস্পরের অংশবিশেষ। (সূরা আলইমরান : ১৯৫)

নারীর সঙ্গে পুরুষের যতগুলো সম্পর্ক হতে পারে প্রতিটি সম্পর্ককে ইসলাম অনন্য মর্যাদা ও মহিমায় অধিষ্ঠিত করেছে। এক্ষেত্রে নারীকে শুধু সমমর্যাদা নয়, বরং অগ্রমর্যাদা দান করেছে।

প্রথম সম্পর্ক হলো মা হিসাবে। তো ইসলাম ও তার নবীর কাছে মায়ের যে মর্যাদা তা পৃথিবীর কোন ধর্ম ও সভ্যতা এমনকি আধুনিক সভ্যতাও কল্পনা করতে পারেনি। কোরআনে ইরশাদ হয়েছে-

ووصينا الانسان بوالديه احسانا حملته امه كرها ووضعته كرها

‘আর আমি মানুষকে তার পিতা-মাতার প্রতি সদাচারের আদেশ করেছি। (কারণ) তার মা তাকে কষ্টের সঙ্গে গর্ভে ধারণ করেছে এবং কষ্টের সঙ্গে প্রসব করেছে।’ (সূরা আহকাফ : ১৫)

এখানে পিতা-মাতা উভয়ের সঙ্গে সদাচার কেন করতে হবে তার কারণ উল্লেখ করতে গিয়ে পিতার কোন অবদানের কথা বলা হয়নি, শুধু মায়ের ত্যাগ ও কষ্টের কথা বলা হয়েছে। অথচ পিতারও বিরাট অবদান রয়েছে সন্তানের জীবনে। এটা এদিকেই ইঙ্গিত করে যে, মাতার ত্যাগ ও কষ্টের তুলনায় পিতার ত্যাগ ও কষ্ট খুবই সামান্য।

হাদীছ শরীফে এসেছে, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এসে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার সদাচারের বেশী হকদার কে? তিনি বললেন, তোমার মা। ছাহাবী বললেন, এর পর কে? তিনি বললেন, তোমার মা। ছাহাবী বললেন, এর পর কে? তিনি বললেন, তোমার মা। ছাহাবী বললেন, এর পর কে? তখন নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এর পর তোমার বাবা। (সহীহ বুখারী, হাদীস : ৫৯৭১)

আফসোস, যে ধর্মের নবী তাঁর উম্মতকে মাতৃজাতি সম্পর্কে এমন উপদেশ দান করেছেন সে ধর্মকে আজ নারী অধিকারের বিরোধীরূপে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হচ্ছে।    পক্ষান্তরে যেসকল ধর্ম ও সভ্যতার হাতে এবং যে আধুনিক পাশ্চাত্য সভ্যতার হাতে নারীজাতি বিভিন্নভাবে লাঞ্ছিত ও নিগৃহীত হয়েছে তারা পেয়ে যাচ্ছে বেকসুর খালাস, বরং উলটো সেজে বসেছে নারীদরদী!

ফিরে আসি হাদীছের আলোচনায়। শুধু এই হাদীছই নয়, বরং অন্য এক হাদীছে বর্ণিত আছে, এক ছাহাবী আরয করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি জিহাদে গমন করতে চাই। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার কি মা আছেন? ছাহাবী বললেন, আছেন। তখন তিনি বললেন, যাও তার কাছে বসে থাকো, কেননা জান্নাত তার পায়েরই কাছে। (মুসনাদে আহমদ ৩/৪২৯; মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা ১৩/৮০)

অন্য বর্ণনায় আছে, ‘জান্নাত হলো মায়েদের কদমের নীচে।’ (মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস : ৭৩৩০)

দ্বিতীয় সম্পর্ক হলো স্ত্রী হিসাবে। তো এ সম্পর্কে দেখুন, কোরআন  শরীফে আল্লাহ তা‘আলার আদেশ-

و عاشروهن بالمعروف, فإن كرهتموهن فعسى أن تكرهوا شيأ و يجعل الله فيه خيرا كثيرا

আর তোমরা স্ত্রীলোকদের সঙ্গে বসবাস করো সদাচারের সাথে। আর যদি (কোন কারণে) তোমরা তাদেরকে অপছন্দ করো তাহলে হতে পারে যে, তোমরা এমন কোন কিছুকে অপছন্দ করলে, আর আল্লাহ তাতে প্রচুর কল্যাণ রেখে দিলেন। (সূরা নিসা : ১৯)

এ বিষয়টি হাদীছ শরীফে নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এভাবে বলেছেন, ‘কোন মুমিন পুরুষ কোন মুমিন নারীকে যেন সম্পূর্ণ অপছন্দ না করে। কারণ তার একটি স্বভাব অপছন্দ হলে, আরেকটি স্বভাব অবশ্যই পছন্দনীয় হবে। (সহীহ মুসলিম, হাদীস : ১৪৬৯; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস : ১৯৭৯)

এখানে নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নারী-পুরুষের দাম্পত্যজীবনের এমন একটি মূলনীতি বর্ণনা করেছেন যার উপর আমল করলে এখনই আমাদের সংসার ‘জান্নাত-নযীর’ হয়ে যেতে পারে।

দু’জন নারী-পুরুষ যখন একত্রে ঘর-সংসার করবে তখন একজনের সবকিছু অপরজনের ভালো লাগবে এটা হতেই পারে না। কিছু আচরণ ভালো লাগবে, কিছু মন্দ লাগবে, এটাই স্বাভাবিক। এক্ষেত্রে পুরুষের করণীয় হলো, স্ত্রীর ভালো গুণগুলোর দিকে লক্ষ্য করে আল্লাহর শোকর আদায় করা যে, আলহামদু লিল্লাহ আমার স্ত্রীর মধ্যে এই এই ভালো গুণ তো আছে!

আল্লাহর শোকর আদায় করবে, আবার আন্তরিকভাবে স্ত্রীর প্রশংসা করবে। তখন হয়ত আল্লাহ তার মন্দ স্বভাবগুলো দূর করে দেবেন।

সুতরাং পুরুষের কর্তব্য হলো স্ত্রীর ত্রুটিগুলোর প্রতি ক্ষমাসুন্দর হওয়া, আর ভালো গুণগুলোর কদর করা। কারণ পূর্ণতা তো কোন মানুষেরই নেই। না নারীর, না পুরুষের।

নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

و عاشروهن بالمعروف, فإن كرهتموهن فعسى أن تكرهوا شيأ و يجعل الله فيه خيرا كثيرا

তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম সে-ই যে তার স্ত্রীদের জন্য তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম, আর আমি তোমাদের মধ্যে আমার স্ত্রীদের জন্য সর্বোত্তম। (সুনানে ইবনে মাজাহ, পৃ. ১৪২; জামে তিরমিযী, হাদীস : ১১৬২)

উম্মাহাতুল মুমিনীনের প্রতি নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আচরণ কেমন ছিলো তার বিশদ বিবরণ সীরাতের কিতাবে রয়েছে। মুসলিম উম্মাহর প্রত্যেক স্বামীর কর্তব্য তা পড়া এবং নিজেদের জীবনে তা আমলে আনা, যাতে প্রতিটি সংসার হতে পারে শান্তির জান্নাত। হযরত আয়েশা (রা.) বলেন, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সারা জীবনে কোন নারীকে প্রহার করেননি, বরং যখনই ঘরে প্রবেশ করতেন (তাঁর মনের অবস্থা যেমনই হোক) পবিত্র মুখমন্ডল হাসিতে উদ্ভাসিত থাকতো। তিনি নিজের কাজ নিজে করা পছন্দ করতেন, এমনকি ছেঁড়া জুতা নিজের হাতে সেলাই করতেন। (শামাইলে তিরমিযী; আলমাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়্যাহ; সুবুলুল হুদা ওয়ার রাশাদ)

বর্ণিত আছে, তিনি যখন রাতে তাহাজ্জুদের জন্য উঠতেন, ঘরের দরজা খুব আস্তে খুলতেন যাতে ঘরের লোকদের ঘুমে ব্যাঘাত না ঘটে। আরো বর্ণিত আছে যে, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মুছল্লায় দাঁড়িয়ে তাহাজ্জুদের নামায পড়তেন তখন ঘুমের অবস্থায় মা আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহার পা মুছল্লার উপর চলে আসতো। নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সিজদায় যাওয়ার সময় কোমলভাবে মা আয়েশা (রা.)-এর পা সরিয়ে তবে সিজদায় যেতেন। (সহীহ বুখারী, হাদীস : ৩৮২; সহীহ মুসলিম, হাদীস : ৫১২)

এজন্য কখনো বিরক্তি বা অসন্তুষ্টি প্রকাশ করতেন না। সুবহানাল্লাহ!

একটি হাদীছে নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

استوصوا بالنساء خيرا

আমি তোমাদেরকে স্ত্রীলোকদের সম্পর্কে উত্তম আচরণের উপদেশ দিচ্ছি; তোমরা আমার উপদেশ গ্রহণ করো। (জামে তিরমিযী, হাদীস : ১১৬৩)

কন্যা ও ভগ্নি হিসাবে নারীর অধিকার ও মর্যাদা সম্পর্কে নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীছ শুনুন, যার খোলাছা হলো, কারো ঘরে যদি তিনজন বা দুজন কন্যা বা ভগ্নি থাকে, আর সে তাদের উত্তম শিক্ষাদীক্ষা দান করে, তারপর তাদেরকে উত্তম পাত্রে বিবাহ দেয় তাহলে তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব হয়ে যায়। (বুখারী ও মুসলিম) কোন কোন বর্ণনায় আছে, তার উপর জাহান্নাম হারাম হয়ে যাবে। কোন বর্ণনায় আছে, তাহলে সে আর আমি জান্নাতে এরূপ পাশাপাশি থাকবো। তারপর তিনি দুই আঙ্গুল পাশাপাশি রেখে ইশারা করলেন।

এক হাদীছে আছে-

لا تكرهوا البنات, فإنهن المؤنسات الغاليات

তোমরা মেয়েদের অপছন্দ করো না। কারণ তারা অন্তরঙ্গতা পোষণকারী মূল্যবান সম্পদ। (মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ১৭৩০৬)

যে কোন পরিবারে আপনি পিতা-মাতার প্রতি কন্যাসন্তানের অনুভব-অনুভূতি এবং সেই তুলনায় পুত্রসন্তানের অনুভব-অনুভূতি পর্যবেক্ষণ করে দেখুন, অবশ্যই আপনার বুঝে আসবে যে, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কেন কন্যসন্তানদের সম্পর্কে একথা বলেছেন!

নারীদের প্রতি নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুভূতি

নারীসমাজের প্রতি নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুভূতি কেমন ছিলো এবং তাদের কষ্ট ও সুবিধা-অসুবিধার প্রতি তিনি কত সজাগ ছিলেন এবং তাদের বিচক্ষণতা ও বুদ্ধিমত্তার প্রতি তাঁর কিরূপ আস্থা ছিলো তা নীচের বর্ণনাগুলো থেকে পরিষ্কাররূপে বোঝা যাবে। তিনি ইরশাদ করেছেন-

حبب إلي من دنياكم الطيب و النساء و جعلت قرة عيني في الصلوة

তোমাদের দুনিয়াতে সুগন্ধি ও নারীকে আমার কাছে প্রিয় করা হয়েছে, আর আমার চোখের শীতলতা রাখা হয়েছে ছালাতের মধ্যে। (মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ১২২৩৩)

এই হাদীছটি অত্যন্ত অর্থপূর্ণ। কারণ সুগন্ধি ও নারীর একত্র উল্লেখ দ্বারা বোঝা যায় যে, স্বভাব ও ফিতরত এবং সৃষ্টিগত দিক থেকে নারী সুগন্ধির মতই সিণগ্ধ ও পবিত্র। সুগন্ধি যেমন হৃদয়ে মস্তিষ্কে কোমল ও সিণগ্ধ অনুভূতি সৃষ্টি করে, নারীর সংস্পর্শও তেমনি কোমলতা, সিণগ্ধতা ও পবিত্রতার অনুভূতি সৃষ্টি করে।

দ্বিতীয়ত এখানে পছন্দ করার কথা বলা হয়নি, বরং পছন্দ করানোর কথা বলা হয়েছে, অর্থাৎ নবীর অন্তরে নারীর এই প্রিয়তা ও পছন্দনীয়তা নিছক মানবিক কোন আকর্ষণ নয়, বরং এটি সম্পূর্ণ ঐশী বিষয়। আল্লাহ তা‘আলার গায়বি ইশারা দ্বারা সম্পন্ন হয়েছে। অর্থাৎ এটি যত না জৈবিক তার চেয়ে অনেক বেশী আত্মিক ও আধ্যাত্মিক। বলাবাহুল্য, এতে স্ত্রীজাতির আধ্যাত্মিক মর্যাদাও প্রকাশ পায়। অথচ ইসলামের পূর্বে  নারীকে অপবিত্র সত্তা বলে সাব্যস্ত করেছে।

স্ত্রীজাতির সুবিধা-অসুবিধার প্রতি তিনি কতটা সজাগ ছিলেন তা নীচের এই ঘটনা থেকে বোঝা যায়। ঘটনার খোলাছা এই যে, একবার নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে নববীতে নামায পড়াচ্ছিলেন। এমন সময় পিছন থেকে কোন শিশুর কান্নার আওয়ায পেলেন, আর সঙ্গে সঙ্গে তিনি নামায সংক্ষিপ্ত করে সালাম ফেরালেন, আর বললেন, আমি নামায সংক্ষিপ্ত করেছি, যাতে ঐ মা তার সন্তানের কারণে পেরেশান না হয়। (সহীহ বুখারী, সালাত অধ্যায়)

একসফরে নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দেখলেন, আনজাশা নামে এক ছাহাবী উট দ্রুত হাঁকিয়ে নিচ্ছেন। ঐ উটের আরোহী ছিলো নারী। তখন তিনি ছাহাবীকে ধীরগতিতে ও কোমলভাবে উটচালনা করার আদেশ দিয়ে বললেন-

رويدك يا أنجشة, رفقا بالقوارير

ধীরে হে আনজাশা! কাচের পাত্রগুলোর প্রতি কোমল হও। (বুখারী ও মুসলিম)

নারীকে কাচের পাত্রের সঙ্গে উপমা প্রদান করা কত যে প্রজ্ঞাপূর্ণ তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। এই একটি উপমা দ্বারাই উম্মতকে তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, নারীর স্বভাব ও প্রকৃতি কত কোমল এবং তাদের প্রতি আচরণের ক্ষেত্রে পুরুষকে কত সতর্ক, সাবধানী ও কোমল হতে হবে।

(এটা অবশ্য আলাদা বিষয় যে, মুসলিম নারীদের প্রতি মুসলিম পুরুষদের বর্তমান আচরণ কিরূপ? বর্তমানে কতজন মুসলমান এমন আছেন, যারা  নবীর এই মহামূল্যবান উপদেশের প্রতি  যত্নবান? ঘরে ও সফরে নারিদের সুখ-সুবিধার প্রতি তারা কী পরিমাণ খেয়াল রাখে? কী পরিমাণ কোমল আচরণ করে? আর কাল কেয়ামতের দিন তাদের নবীর কাছে তারা কী জবাব দেবে?)

ইলমের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমান অধিকার

ইসলামের পূর্বে অন্যান্য ধর্ম ও সভ্যতা যেখানে নারীর শিক্ষার কোন অধিকারই স্বীকার করেনি। এমনকি আধুনিক পাশ্চাত্য সভ্যতায়ও এই সেদিন পর্যন্ত যেখানে নারীশিক্ষাকে ঘৃণার চোখে দেখা হতো সেখানে ইসলাম সেই প্রথম দিন থেকে নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য শিক্ষার সমান অধিকার ঘোষণা করেছে।

কারণ এটা তো বলাই বাহুল্য যে, দ্বীন ও শরীয়াতের উপর আমল করা পুরুষের জন্য যেমন ফরয তেমনি নারীর জন্যও ফরয। আর শরীয়তের ইলম অর্জন না করে শরীয়তের উপর আমল করা সম্ভব নয়। আর কোরআনের

 رب زدنى علما

হে আল্লাহ আমার জ্ঞান বৃদ্ধি করো। (সূরা ত্বহা : ১১৪)

এই প্রার্থনা তো পুরুষ ও নারী উভয়েই আল্লাহর কাছে করে থাকে। আর এটা শুধু জ্ঞান অর্জনের দু‘আ নয়, বরং অধিক থেকে অধিক জ্ঞান অর্জনের দু‘আ।

طلب العلم فريضة على كل مسلم ইলম অর্জন করা প্রত্যেক মুসলমানের উপর ফরয। (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস : ২২৪; তবরানী-আওসাত, হাদীস : ৯) এ হাদীছ ওলামায়ে উম্মতের সর্বসম্মতিক্রমে মুসলিম পুরুষ ও মুসলিম নারী উভয়ের ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রযোজ্য। তাছাড়া তলবে ইলমের যত ফযীলত বর্ণিত হয়েছে তা নারী-পুরুষ উভয়ের জন্যই।

فعلمها و أحسن تعليمها, و أدبها فأحسن تأديبها

তাকে ইলম শিক্ষা দিলো এবং উত্তম শিক্ষা দিলো, আর তাকে আদব ও শিষ্টাচার শিক্ষা দিলো এবং উত্তম শিক্ষা দিলো। (সহীহ বুখারী)

এই হাদীছে স্বয়ং পুরুষকে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে যেন তার তাদের অধীন নারীদের উত্তম শিক্ষা-দীক্ষার ব্যবস্থা করে, আর এর বিনময়রূপে জান্নাতের ঘোষণা এসেছে।

বর্ণিত আছে যে, জনৈকা স্ত্রীলোক নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খিদমতে হাযির হয়ে আরয করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! পুরুষেরা তো আপনার উপদেশ এককভাবে নিয়ে গেলো। সুতরাং আমাদের জন্য আপনার একটি দিন নির্ধারণ করে দিন যখন

শুধু আমরা আপনার কাছে আসবো। আপনি আমাদের ঐ ইলম থেকে শিক্ষা দান করবেন যা আল্লাহ আপনাকে শিক্ষা দান করেছেন।

নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ আবেদন গ্রহণ করে বললেন, তোমরা অমুক অমুক দিন একত্র হও। (সহীহ বুখারী, ইলম অধ্যায়)

এ হাদীছ সন্দেহাতীতরূপে প্রমাণ করে যে, ইলম অর্জনের জন্য নবীর কাছে যেমন নারীদের আলাদা সময় পাওয়ার হক ছিলো তেমনি কিয়ামত পর্যন্ত ওয়ারিছীনে নবীর কাছেও সেটা পাওয়া তাদের হক।

নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মাহতুল মিমিনীনের লেখা শেখার ব্যবস্থা করেছিলেন বলেও সীরাতের কিতাবে প্রমাণ রয়েছে। উম্মুল মুমিনীন হযরত হাফছা (রা.), হযরত আয়েশা (রা.) এবং অন্যান্য স্ত্রীছাহাবী লিখতে জানতেন।

হযরত আয়েশা (রা.) ইলম ও ফিকহের ক্ষেত্রে এবং সমকালীন শিক্ষা-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে কত উচ্চ মর্যাদার অধিকারী ছিলেন তা বোঝা যায় নিমেণাক্ত বর্ণনা থেকে।

হযরত ওরওয়া বিন যোবায়র তাঁর খালা সম্পর্কে বলেন, ফারায়েযের ইলম, হালাল-হারামের মাসায়েল এবং কোরআনের ইলমের ক্ষেত্রে হযরত আয়েশা (রা.)-এর চেয়ে বড় আলিম আমি দেখিনি। প্রসিদ্ধ তাবেঈ হযরত মসরূক বলেন, আল্লাহর কসম, বড় বড় ছাহাবাকে আমি তাঁর কাছে মীরাছের মাসআলা জিজ্ঞাসা করতে শুনেছি।

হযরত ওরওয়া আরো বলেন,

সাহিত্য, কবিতা, চিকিৎসা এবং আরবজাতির ইতিহাস সম্পর্কে তাঁর চেয়ে বড় জ্ঞানী আমি দেখিনি।

হাদীছ বর্ণনার ক্ষেত্রেও তার মর্যাদা ছিলো অনেক পুরুষ

সাহাবীরও উপরে।

জ্ঞানচর্চা ও তলবে ইলমের ক্ষেত্রে আরো বহু স্ত্রীছাহাবীর নাম এখানে উল্লেখ করা যায়।

যেসকল স্ত্রীছাহাবী কবিখ্যাতি অর্জন করেছিলেন তাদের মধ্যে রয়েছেন আরওয়া বিনতে আব্দুল মুত্তালিব, হযরত খানসা, সু‘দা বিনতে কোরায়য (হযরত উছমান রা.-এর খালা), নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দুধবোন শায়মা, আতেকা বিনতে যায়দ ও অন্যান্য। বর্ণিত আছে যে,

হযরত খানসা (রা.)-এর

কবিতা নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে শ্রবণ করতেন, আর হাতে ইশারা করে বলতেন, হে খানসা, আরো কিছু শোনাও। (ইলইসাবা, ইবনে হাজার ৪/২৪৮৬-২৪৮৭)

নারীসমাজের ইলমচর্চার এ ধারা পরবর্তী যুগেও অব্যাহত ছিলো। কারীমাহ আলমারওয়াযিয়্যাহ ছিলেন অনেক উচ্চস্তরের মুহাদ্দিছাহ। বহু মুহাদ্দিছ পর্দার আড়াল থেকে তাঁর কাছ থেকে হাদীছ গ্রহণ করেছেন। ইবনে আসাকির বলেন, ইমাম বুখারী যেসকল নারী মুহাদ্দিছ থেকে হাদীছ গ্রহণ করেছেন, অর্থাৎ তাঁর নারীশায়খ-এর সংখ্যা ছিলো আশির উপরে। ইমাম যাহাবী রহ, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি তথ্য দিয়েছেন। তাঁর মতে যেখানে বহু পুরুষ বর্ণনাকারী মিথ্যাচারী বলে অভিযুক্ত হয়েছে এবং বিভিন্ন দোষ-দুর্বলতার কারণে পরিত্যক্ত বলে সাব্যস্ত হয়েছেন সেখানে কোন নারীবর্ণনাকারী অভিযুক্ত বা পরিত্যক্ত সব্যস্ত হননি।

হানাফী ফিকহ-এর সুপসিদ্ধ কিতাব ‘বাদায়েউস সানায়ে’-এর রচয়িতা আল্লামা কাসানী রহ, এর স্ত্রী হলেন ফাতেমা। তিনি এত উচ্চস্তরের ফকীহা ছিলেন যে, তিনি, তাঁর পিতা আল্লামা সমরকন্দী ও স্বামী আল্লামা কাসানী, এই তিনজনের সম্মিলিত স্বাক্ষরে ফতোয়া জারি করা হতো।

এমনকি হিন্দুস্তানের ইতিহাসেও এর নমুনা রয়েছে। ভুপালের প্রসিদ্ধ আলিম মুফতি মাওলানা আব্দুল কাইঊম (রহ.)-এর স্ত্রী ছিলেন শাহ ওয়ালিউল্লহ দেহলবী (রহ.)-এর খান্দানের  নারী। তিনি এত বড় আলিমা ছিলেন যে, কোন কঠিন মাসআলার সম্মুখীন হলে মুফতী আব্দুল কাইঊম (রহ.) বলতেন অপেক্ষা করো, আমার স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করে বলছি।

সালাফ ও খালাফের এই ধারাকে পুনর্জীবিত করা এখন সময়ের দাবি।

ওলামায়ে কেরামের নিকট নিবেদন, তারা যেন নারীদের শিক্ষা ও তারবিয়তের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দেন এবং উপযুক্ত ও আদর্শ পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন।

বাকী অংশ – ইসলাম ও নারী
================

লেখক আমাতুল্লাহ তাসনীম সাফফানা

সৃষ্টিকর্তার অনুগ্রহ ! শিক্ষণীয় গল্প

একবার এক প্লেন দুর্ঘটনায় শুধু একজন বাদে সবাই মারা যায়, প্লেনটা ক্র্যাশ করে একটা নির্জনদ্বীপে।

জনমানবসংকীর্ণ দ্বীপের চারিদিকে শুধু জল আর জল ।
কিন্তু তাকে উদ্ধার করার মতো কোন জাহাজও আশেপাশে চোখে পড়ছেনা।
দিন যায়, মাস যায়- লোকটি আশায় থাকে কোনও জাহাজ হয়তো তাকে দেখতে পেয়ে উদ্ধার করে নিয়ে যাবে,কিন্তু আশায় আশায় শুধু দিন কেটে যায় তবু কিছু আসেনা।

এদিকে একাকি দ্বীপে থাকার জন্য লোকটি ইতিমধ্যে একটা ছোট্ট কুঁড়েঘর বানায় আর সে ঘরের মধ্যে থেকেই সারাদিন শুধু সাগরের দিকে তাকিয়ে থাকে আর ভাবতে থাকে এই বুঝি কেও উদ্ধার করতে এলো।

অবশেষে লোকটি শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “সৃষ্টিকর্তা-তুমি ও কি আমায় দেখো না?”
একদিনের ঘটনা, আজও লোকটি আগের মতোই
সাগরের দিকে তাকিয়ে রয়েছে । কিন্তু বেলা যতো গড়াতে লাগলো লোকটির ততোই ক্ষুধা পেতে লাগলো। যা ফলমূল ছিল সবশেষ হয়ে গেছে!

অগত্যা,লোকটি খাবার জোগাড় করতে কুটির ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে এবং বেশ কিছুক্ষণ পর যখন আবার খাবার নিয়ে কুটিরে ফিরে আসে, দেখতে পায় তার উনুনের জ্বালানো আগুন থেকে আগুন ছড়িয়ে পড়ে তার ছোট্ট কুটিরে আগুন ধরে গেছে এবং আগুন প্রায় সম্পূর্ণ কুটিরটাকেই পুড়িয়ে ভস্ম করে ফেলেছে!
লোকটি আর সহ্য করতে পারেনা।


এটা পড়ুন – এ যুগের ইব্রাহিম আদহাম


সে প্রচণ্ড রাগে-ক্ষোভে আর দুঃখে চিৎকার করে বলে,
“হে সৃষ্টিকর্তা !
তুমি আমার থেকে আমার পরিবারকে দূরে সরিয়ে এই নির্জনে এনে ফেলেছো, এখন আমার সামান্য কুটিরটাকেও
তুমি জ্বালিয়ে দিলে; এমনকাজ তুমি কিভাবে করতে পারলে?”

কথাগুলো বলে লোকটি কান্নায় ভেঙে পড়ে, এমন সময় দ্বীপের ধারে একটা ছোট জাহাজ এসে ভেড়ে আর তার থেকে কিছু লোক বেরিয়ে এসে হারানো লোকটির কাছে এসে সাহায্য চায় কিনা জানতে চায়।

লোকটি তখন কান্না থামিয়ে জানতে চায়,তারা তাকে কিভাবে দেখেছে ?

জবাবে তখন জাহাজের লোকগুলো বলে,
“আমরা দূর থেকে এইদ্বীপে আগুন আর ধুঁয়া দেখে বুঝে নিই কেও হয়তো সাহায্য চাইছে তাই এখানে এসেছি”।

কথা গুলো শুনে লোকটি সৃষ্টিকর্তার অনুগ্রহ পেয়ে বিস্মিত হয়ে যায়। সে বুঝতে পারে, “সত্যিই আজকে তার ঘরে আগুন না লাগলে এইদ্বীপ থেকে হয়তো কোনোদিনও
সে ছাড়া পেতোনা!!”

– সৃষ্টিকর্তা মানুষের ভালোর জন্যই সবকিছু করেন কিন্তু মানুষ আমরাই ভুল করে সৃষ্টিকর্তার অনুগ্রহকে অস্বীকার করি; দেখতে চাই না আসলে তিনি আমাদের জন্য কি রেখেছেন!! ফলে অসন্তুষ্ট হয়ে গালমন্দ করতে থাকি নিজেদের ভাগ্যকে!!

সুতরাং সৃষ্টিকর্তার অনুগ্রহের অপেক্ষায় থাকুন, নিশ্চিত আপনার সামনে এমন কোনও কিছু অপেক্ষা করছে যা আপনার জীবনটাকেই বদলে দেবে!!

তথ্যসুত্র: ইন্টারনেট!

সফলতার চার ধাপ – সূরা আল-আসর এর আলোকে

এই জীবনে আমরা সবাই কিছু না কিছু পাওয়া বা সফলতার পিছনে ছুটি।  সেই কিছু কে পাওয়ার জন্য জীবনে চারটি মাত্র বিষয়ে মনোযোগী হতে হয়। এই চারটি বিষয় আয়ত্ত করতে পারলে যে কোন মানুষই সাধারণ থেকে অসাধারণ হয়ে উঠতে পারবে – ইহকালে এবং পরকালেও। সূরা ‘আসরের দ্বিতীয় আর তৃতীয় আয়াতে আল্লাহ ﷻ এই চারটি বিষয় আমাদের বলে দিয়েছেন। আসুন সেই চারটি ব্যাপার দেখা নেয়া যাক:

১) বিশ্বাস রাখো:  “ঈমান” শব্দের অর্থ হলো বিশ্বাস। মৃত্যু পরবর্তী জীবনে সফলতা চাইলে এক আল্লাহ ﷻ, তাঁর রাসূল ﷺ এবং রাসূল ﷺ এর উপর যা অবতীর্ণ হয়েছে তাতে বিশ্বাস রাখতে হবে। আর এই জীবনে সাফল্য অর্জন করতে হলে আমাদের বিশ্বাস রাখতে হবে – “আমি পারবই ইনশা’ আল্লাহ”। হাল ছেড়ে দিলে চলবে না।

ওয়াল ‘আসর ইন্নাল ইনসা-না লাফিই খুসর। ইল্লাল্লাযিনা আ-মানু … (সূরা ‘আসর ১-২)

অর্থ: সময়ের শপথ, নিশ্চয়ই মানুষ চরম ক্ষতির মধ্যে নিমজ্জিত। তারা ছাড়া, যারা ঈমান এনেছে …

২)  যা করা দরকার তা করে যাও: অনেক সময় আমাদের এমন হয় যে – নামাজ পড়তে ইচ্ছা করে না, যিকর করতে মন চায় না, কোরআন মজিদ পড়ারও আগ্রহ পাওয়া যায় না – তবু যেহেতু আল্লাহ ﷻ  ও তাঁর রাসূল ﷺ  এই রিচুয়ালগুলো আমাদের করতে বলেছেন – তাই এগুলো করে যেতে হবে। একইভাবে, দুনিয়াতে সাফল্য পাওয়ার জন্যও কিছু রুটিন ওয়ার্ক আছে, সেগুলি আমাদের করে যেতে হবে। যেদিন ভালো লাগবে সেদিনও একজন ছাত্রকে পড়তে বসতে হবে, যেদিন ভালো লাগবে না সেদিনও তাকে পড়তে বসতে হবে; একজন চাকুরিজীবির যেদিন কাজে মন বসবে সেদিন অফিসের কাজ করতে হবে, আবার কাজে মনোযোগ না বসলেও জোর করে অফিসের কাজ করে যেতে হবে। যা করা উচিত তা করতে থাকতে হবে, আজ বা আগামীকাল এর ফল চোখে না দেখা গেলেও, পরশু এর ফল ঠিকই পাওয়া যাবে।

ওয়া ‘আমিলুস স্বয়ালিহ্বা-তি  … (সূরা ‘আসর ৩)

অর্থ: যারা ভালো কাজ করে

৩)  নতুন কিছু শেখো: আল্লাহ ﷻ কোরআন মাজিদের সূরা ফাতির এর ২৮ নং আয়াতে বলেছেন “আল্লাহর ﷻ বান্দাদের মধ্যে  শুধু তারাই তাঁকে ভয় করে যাদের জ্ঞান আছে”। ইসলাম সম্পর্কে আপনি যত জানবেন ততই রুটিন ইবাদতগুলো আপনার কাছে অর্থবহ হয়ে উঠবে। নামাজ-রোজাকে আপনার কাছে রবোটিক কোন ব্যাপার বলে মনে হবে না, বরং তখন আপনি এই ইবাদতগুলোর মধ্যে ঈমানের মিষ্টি স্বাদ আস্বাদন করতে পারবেন।

পার্থিব জীবনেও সেই ব্যক্তি তত সফল, যে অন্য মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে সবচেয়ে বেশী অবদান রাখতে পারে।  আর অন্যের উপকারে আসতে চাইলে, আগে নিজের উন্নয়ন করতে হবে।  ভালো কথা অন্যকে বলতে হলে আগে নিজেকে ভালো কথা শিখতে হবে।

ওয়াতা ওয়া- সাওবিল হাক্কি … (সূরা ‘আসর ৩)

অর্থ: একে অপরকে সঠিক উপদেশ দেয়

৪) মানুষের উপকারে আসো: নবী হওয়ারও আগে রাসূলুল্লাহ ﷺ ছিলেন মক্কার সবচেয়ে বিশ্বস্ত আর পরোপকারী মানুষ। রাসূলুল্লাহ ﷺ তাঁর সমস্ত জীবন ব্যয় করেছেন অন্য মানুষদের ভাগ্য উন্নয়নে। আমরাও যত অল্প টাকাই পারি না কেন তা দিয়ে মানুষকে সাহায্য করব, যত অল্প শ্রমই হোক না কেন তা দিয়ে মানুষের উপকার করব, যত অল্পই শিখি না কেন, তা অন্যদের সাথে শেয়ার করব। পরিবার, বন্ধু, প্রতিবেশীদের সহ সমস্ত মানুষকে উপকারের চেষ্টা করব। কারো কাছ থেকে প্রতিদান চাইবো না, প্রতিদান চাইবো শুধুই আল্লাহর কাছে।

মানুষকে উপকার করার এই পথ মধুর না, বন্ধুর। অনেক সমালোচনা-গালমন্দ শুনব, অনেক অকৃতজ্ঞ মানুষের দেখা পাবো, অনেক সময় আর্থিক বা সামাজিক সংকটে পর্যন্ত পড়ে যেতে পারি – তবু ধৈর্য্য ধরব। যত অল্পই হোক না কেন, নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী কন্ট্রিবিউট করব। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন – খেজুরের অর্ধেকটা দান করে হলেও নিজেকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও (বুখারী)।

ওয়াতা ওয়া- সাওবিস সবর। (সূরা ‘আসর ৩)

অর্থ: একে অপরকে ধৈর্য্যের উপদেশ দেয়।  

দ্বিতীয়-তৃতীয় আয়াতে বর্ণিত এই চারটি কাজ যদি আমরা না করি তাহলে আমরা মারাত্মক ক্ষতির মধ্যে ডুবে যাবো।  এই ক্ষতির ভয়াবহতা যে কতটা চরম তা বুঝাতে আল্লাহ ﷻ এই কাজগুলোর উপর চারভাবে গুরুত্ব আরোপ করেছেন।

এক: প্রথম আয়াতে আল্লাহ ﷻ সময়ের কসম নিয়েছেন। আল্লাহ ﷻ কোন কিছু কসম নেয়ার অর্থ হচ্ছে তার পরের কথাটি খুব গুরুত্বপূর্ন।

দুই: আল্লাহ ﷻ “ইন্না” দিয়ে বাক্য শুরু করে গুরুত্ব আরোপ করেছেন। “ইন্না” শব্দের অর্থ হলো “নিশ্চয়ই”।

তিন: আল্লাহ ﷻ “ইন্নাল ইনসানা ফি খুসর” (নিশ্চয়ই মানুষ ক্ষতির মধ্যে আছে), না বলে “ফি” এর আগে “লা” যুক্ত করেছেন। এই “লা” এর অর্থ হলো “অবশ্যই”। সুতরাং আল্লাহ ﷻ যখন বললেন “ইন্নাল ইনসানা লাফি খুসর”, এর অর্থ দাঁড়ায় “নিশ্চয়ই অবশ্যই মানুষ ক্ষতির মধ্যে আছে”।

চার: আল্লাহ ﷻ তৃতীয় বাক্য শুরু করলেন “ইল্লা” (“শুধু তারা বাদে” বা Except) দিয়ে। ইল্লা দিয়ে কোন বাক্য শুরু করা হলে সেটা পূর্ববর্তী বাক্যের গুরুত্ব বাড়িয়ে দেয়। যেমন – কোন ক্লাসের ১০০ জন ছাত্রের মধ্যে যদি ৯৫ জন ফেইল করে তাহলে টিচার বলবেন – “এই ক্লাসের ছাত্ররা ফেল করেছে, শুধু কয়েকজন বাদে”, অর্থাৎ ফেল করাটাই যেন স্বাভাবিক ঘটনা, পাশ করাটা হলো ব্যতিক্রম। একইভাবে, আল্লাহও ﷻ বলতে চাইছেন যে, অধিকাংশ মানুষই ক্ষতির মধ্যে রয়েছে, শুধু গুটিকয় আছে যারা সঠিক পথে আছে।

আমাদের অফিসের কোন বিশ্বস্ত কলিগ যদি এক বা দুইবার নয়, চার চারবার ফোন করে বলে – “বন্ধু, মহাখালীর রাস্তায় এক্সিডেণ্ট হয়েছে, বিরাট জ্যাম, ভুলেও ঐ পথে যেও না, ঘুরে যাও” – তাহলে আমরা বাসায় ফিরতে নিশ্চিত মহাখালীর রাস্তা নিব না। আর, আমাদের পালনকর্তা প্রভু যখন আমাদের একই আয়াতে চারবার সতর্ক করে কোন কিছু করতে আদেশ করেন তখন আমরা কত অনায়াসে সেই আদেশ অমান্য করে দিনাতিপাত করতে থাকি!

ইমাম শাফেঈ’ বলেছেন – লোকে যদি শুধু এই সূরা (সূরা ‘আসর) নিয়ে চিন্তা করত, সেটাই তাদের জন্য যথেষ্ট হত।

রেফারেন্স:

  1. Khutbah- The Role of a Muslim in a Non-Muslim Society (Based on Sura ‘Asr) ~ Dr. Yasir Qadhi
  2. Meaning of Surat Al-‘Asr – Understand Quran Academy

সফলতার সুত্র পড়তে পারেন দুইটি স্বর্ণালী সূত্র

এক মূহুর্তের রাগ, সারা জীবনের কান্না।

এক মূহুর্তের রাগ, সারা জীবনের কান্না। আল্লাহ্ ﷻ বলেছেন – “তোমরা রাগকে গিলে ফেলো” (সূরা আলে ইমরান:১৩৪)। রাগ যদি নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যায় তাহলে রাগের মাথায় আমরা এমন কিছু করে বসতে পারি, বা বলে বসতে পারি যার জন্য আজীবন অনুশোচনা করতে হবে। রাগ-নিয়ন্ত্রণ তাই অতীব গুরুত্বপূর্ন একটি যোগ্যতা।

এই লেখায় আমি রাগ-সংক্রান্ত ৪টি হাদিস শেয়ার করব, এই চারটি হাদিস থেকে দেখব কেউ যখন রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সাথে রাগিয়ে দেয়ার মতো আচরণ করতেন, তখন তিনি ﷺ কিভাবে তা নিয়ন্ত্রণ করতেন।

১) আনাস(রা) ছিলেন ৭-৮ বছরের ছোট্ট একটা ছেলে। আনাস(রা) এর মা, আনাস(রা)কে রাসূলুল্লাহ ﷺ এর কাছে গিফট করেছিলেন তাঁর সেবা করার জন্য। রাসূলুল্লাহ ﷺ এর বিভিন্ন ছোট-খাটো কাজ করে দিতেন আনাস(রা); যতটা না কাজ করতেন তারচেয়ে বেশী দুষ্টামীই করতেন! একদিন রাসূলুল্লাহ ﷺ আনাসকে (রা) একটা কাজে বাইরে পাঠালেন। যাওয়ার পথে রাস্তার মধ্যে আনাস(রা) কিছু ছেলেকে দেখলেন তারা খেলা করছে। তাদেরকে দেখে কাজের কথা ভুলে ছোট্ট আনাসও (রা) খেলায় মজে গেলেন। খেলার ঘোরে কতক্ষণ কেটে গেছে আনাসেরও আর খেয়াল নাই, এমনি এক সময় আনাস(রা) হঠাৎ অনুভব করলেন বিশাল সাইজের কোন এক খেলোয়াড় তাকে পেছন থেকে ঘাড় চেপে ধরেছে! আনাস(রা) মাথা ঘুরিয়ে দেখেন – একি! এ যে স্বয়ং রাসূলুল্লাহ ﷺ এক মুখ হাসি নিয়ে উপস্থিত!

রাসূলুল্লাহ ﷺ আনাস(রা)কে জরুরী কোন কাজেই কিন্তু পাঠিয়েছিলেন। অনেক সময় পার হওয়ার পরেও আনাস(রা) যখন ফিরলেন না, তখন রাসূলুল্লাহ ﷺ এর জন্য রেগে যাওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু তিনি আনাস(রা) এর উপর তো রাগলেনই না, বরং প্র্যাক্টিকাল জোক করলেন!

আমাদের সাথে যখন রেগে যাওয়ার মতো কিছু ঘটে, তখন লক্ষ্য করলে আমরা দেখব ঘটনাটার একটা হিউমেরাস দিকও আছে। আমাদের উচিত হবে ঘটনার রাগের অংশটি উপেক্ষা করে হিউমেরাস অংশটির দিকে মনযোগ দেয়া।

টিপস#১: রাগকে হিউমার (হাস্যরসবোধ) দিয়ে পরিবর্তন করুন।

২) রাসূলুল্লাহ ﷺ এর স্ত্রীদের মধ্যে আয়েশা(রা) খুব ভালো রান্না করতে পারতেন না। রান্নার জন্য প্রসিদ্ধ ছিলেন সাফিয়াহ(রা) ও উম্মে সালামাহ(রা)। একবার রাসূলুল্লাহ ﷺ যখন অন্য সাহাবাদের নিয়ে আয়েশার(রা) ঘরে বসে আলাপ করছিলেন, তখন উম্মে সালামাহ(রা) তাঁর রান্না করা খাবার নিয়ে ঘরে প্রবেশ করলেন। এতে আয়েশা (রা) ভীষণ জেলাস ফিল করলেন! ব্যাপারটা অনেকটা এরকম যে – আমার রান্না কি এতই খারাপ যে অন্য ঘর থেকে খাবার আনতে হবে? আয়েশা(রা) রেগে গিয়ে এক বাড়িতে খাবারের প্লেটটাই ভেঙ্গে ফেললেন!


এটা পড়ে দেখতে পারেন-জনসংখ্যা ও বিশ্বাস


ভেবে দেখুন, অতিথির সামনে আপনার স্ত্রী যদি এমন আচরণ করে বসে তো আপনি কি করবেন? একটু হলেও হয়তো “উফ” বলে উঠবেন। অন্তত এটুকু হয়তো বলে উঠবেন – “একি! এটা কি করলে তুমি?” রাসূলুল্লাহ ﷺ সেরকম কিছু বললেন না। ভেঙে যাওয়া প্লেট এর টুকরোগুলো কুড়াতে কুড়াতে বাকী সাহাবাদেরকে বললেন – “তোমরা তোমাদের খাবার খেয়ে নাও”। তারপর তিনি ﷺ বাকী সাহাবাদের সামনে আয়েশা(রা) কে প্রোটেক্ট করার সুরে বললেন “তোমাদের মা জেলাস ফিল করেছেন।” রাসূলুল্লাহ ﷺ এমনভাবে কথাটা বললেন যে – এটাতো কোন ব্যাপারই না, সব মানুষই তো কম-বেশী জেলাস ফিল করে। শুধু তাই না – তিনি সাহাবাদের মনে করিয়ে দিতে চাইলেন আয়েশা(রা) এর মর্যাদা, তাই তিনি আয়েশা(রা) কে নাম ধরে না ডেকে “তোমাদের মা” বলে সম্বোধন করেছেন ।

টিপস#২: কেউ রেগে গেলে তার প্রতি পাল্টা রাগ না করে তাকে প্রোটেক্ট করুন।

৩) একবার রাসূলুল্লাহ ﷺ দেখলেন এক মহিলা কবরের সামনে বেজায় কান্নাকাটি করছে। রাসূলুল্লাহ ﷺ তাকে বললেন – “আল্লাহকে ﷻ ভয় করো এবং ধৈর্য্য ধরো।” মহিলা রাসূলুল্লাহ ﷺ কে চিনতে না পেরে রেগে-মেগে বলে উঠলো – “যান এখান থেকে! আমার মত বিপদ তো আর আপনার হয়নি!” জবাবে রাসূলুল্লাহ ﷺ রেগে গেলেন না, তাকে আরেকবার বুঝানোর চেষ্টাও করলেন না, বললেন না – “আমি হলাম আল্লাহ্র ﷻ রাসূল, আর আমার মুখে মুখে কথা!”, অথবা বললেন না- “আমি বললাম ভালো কথা আর তুমি কি না আমার সাথে এমন ব্যবহার করলে!” না, তিনি এরকম কিছুই করলেন না। তিনি চুপচাপ কিছু না বলে সেই স্থান থেকে চলে গেলেন।

টিপস#৩: রেগে থাকা মানুষকে বুঝাতে যাবেন না, সে বুঝবে না। তাকে শান্ত হওয়ার জন্য সময় দিন।

৪) রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন: “যে ব্যক্তি তর্ক করা ছেড়ে দিবে, সে যদি ভুলের পক্ষেও হয় তবুও সে জান্নাতের প্রান্তে বাড়ী পাবে। আর যে ব্যক্তি সঠিক হওয়ার পরেও তর্ক ছেড়ে দিবে, সে জান্নাতের মাঝখানে বাড়ী পাবে। আর যে ব্যক্তি নিজের চরিত্রের উন্নয়ন করবে সে জান্নাতের সর্বোচ্চ স্থানে বাড়ী পাবে।”

ভেবে দেখুন – কি লাভ আরেকজনের সাথে তর্কাতর্কি করে, রাগারাগি করে, নিজের মেজাজ খারাপ করে, যুক্তির উপর যুক্তি তৈরী করে শুধুই এটা প্রমাণ করা যে “আমি সঠিক, তুমি ভুল”? এর মাধ্যমে না পাওয়ার যায় নিজের মনে শান্তি, না করা যায় অন্যের মন জয়। তারচেয়ে চুপ করে থেকে অন্যের ভুল উপেক্ষা করে নিজের জন্য জান্নাতে একটা বাড়ী নির্মান করা কি বুদ্ধিমানের কাজ না?

 

টিপস#৪: রাগ করার মত কারণ থাকা সত্ত্বেও তা ছেড়ে দিন, আর আল্লাহর ﷻ কাছে প্রতিদানের আশা রাখুন।

পাদটীকা:
১) ইসলামে ব্যক্তিগত কারণে রাগ করার অনুমতি নেই। তবে যেসব কারণে আল্লাহ্ ﷻ ও তাঁর রাসূল ﷺ রাগ করেছেন (যেমন – কাউকে শিরক করতে দেখলে) সে সব কারণে রাগ করা বৈধ। তবে, এই রাগের বহিঃপ্রকাশও নিয়ন্ত্রিত হতে হবে।
২) লেখাটি পড়ে মনে করবেন না আমি রাগ-নিয়ন্ত্রনে মাষ্টার, বরং উল্টোটা সত্য। লেখাটি আমি লিখেছি সবচেয়ে বেশী নিজেকে মনে করিয়ে দেয়ার জন্য। এটা যদি অন্য কারো উপকারে আসে তো আলহামদুলিল্লাহ!

রেফারেন্স:

হাদিস১: মুসলিম ২৩১০ ,হাদিস২: সুনান আন-নাসাঈ ৩৯৭৩,হাদিস৩: বুখারী ১২২৩, হাদিস৪: তিরমিযী


লেখক- আদনান ফয়সাল

কাজা নামাজের নাড়ি-নক্ষত্র

কাজা নামাজ । শরীয়তে ঈমানের পরেই নামাযের স্থান এবং তা ইসলামের অন্যতম স্তম্ভ। প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক, সুস্থ, সবল বিবেকবান মুসলমান নর-নারীর ওপর প্রত্যহ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া ফরজ। ইচ্ছাকৃত নামাজ ছেড়ে দেয়া কবিরা গুনাহ। পরে তার কাজা আদায় করা ওয়াজিব।

নামাজের গুরুত্বঃ নামাজ ফরজ হওয়া প্রসঙ্গে আল্লাহপাক বলেন,

‘হে নবী! আমার বান্দাদের মধ্যে যারা মুমিন তাদের বলুন, নামাজ কায়েম করতে’। (সূরা ইবরাহিম, আয়াত-৩১)।

অন্যত্র আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন, ‘তোমরা লোকদের সঙ্গে উত্তমভাবে কথা বলবে এবং নামাজ আদায় করবে। (সূরা বাকারাহ, আয়াত-৮৩)।

অন্য হাদিসে এসেছে- রাসুল সাঃ আবু দারদা রাঃ কে বলেন-“তুমি ফরজ নামায ইচ্ছাকৃতভাবে পরিত্যাগ করবেনা। কেননা, যে ব্যাক্তি ইচ্ছাকৃত তা পরিত্যাগ করে তাঁর উপর থেকে আল্লাহর দায়িত্ব উঠে যায়।সুনানে ইবনে মাযাহ হাদিস-৩০১

উল্লেখিত আয়াত ও হাদিস থেকে শরীয়তে নামাযের মান ও অবস্থান সুস্পষ্ট বোঝা যায় এবং নামায ছেড়ে দেওয়ার পরিণতি যে কত ভয়াবহ তাও সুস্পষ্ট ।

কাজা নামাযের পরিচয় ।

নামায যথাসময়ে আদায় করা আবশ্যক। তবে যদি কোন বৈধ কারনে আদায় করা না যায় পরে তা আদায় করার নাম কাযা। রাসুল সাঃ ইবাদাতে কাযার দর্শনটি অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী করে বুঝিয়েছেন- ইবনে আব্বাস রাঃ থেকে বর্ণিত-তিনি বলেন,”জুহাইনা গোত্রের একজন মহিলা নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)- এর নিকট এসে বললেন, আমার আম্মা হাজ্জের মানৎ করেছিলেন তবে তিনি হজ্জ আদায় না করেই ইন্তিকাল করেছেন। আমি কি তাঁর পক্ষ হতে হজ্জ আদায় করতে পারি? আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ তার পক্ষ হতে তুমি হজ্জ আদায় কর। তুমি এই ব্যাপারে কি মনে কর যদি তোমার আম্মার উপর ঋণ থাকত তা হলে কি তুমি তা আদায় করতে না? সুতরাং আল্লাহর হক আদায় করে দাও। কেননা আল্লাহ্‌র হকই বেশী আদায়যোগ্য।”(সহীহ বুখারী,১৮৫২)

নামায হল আল্লাহর হক বা ঋণ । তা পরিশোধ করা আবশ্যক। সেটা সময়মত আদায় করতে না পারলেও পরে কাজা পড়তে হবে।

কোন নামাযের কাযা করবঃ- পাঁচ ওয়াক্তের ফরজ নামাজ ছুটে গেলে কাযা করা ফরজ। এশার নামাজের সময় বিতিরসহ যে কোনো ওয়াজিব নামাজের কাযা করা ওয়াজিব।

নফল নামাজ শুরু করার পর ওয়াজিব হয়ে যায়। কোন কারণে নফল নামাজ নষ্ট হলে অথবা শুরু করার পর কোন কারণে যদি ছেড়ে দিতে হয়, তাহলে তার কাযা করাও ওয়াজিব। যেই ওয়াক্তের সুন্নত নামাজ সেই ওয়াক্ত শেষ হয়ে গেলে তা আর কাযা করতে হয় না। তবে যদি ফজরের ফরজ ও সুন্নত নামাজ একসাথে ছুটে যায় তাহলে সেই দিন সূর্য মধ্য আকাশ থেকে পশ্চিম দিক ঢলে যাবার পূর্বে ফজর নামাজ কাযা আদায় করলে তার সাথে সুন্নতও পড়তে হবে। সূর্য ঢলে গেলে বা শুধু ফজরের সুন্নত ছুটে গেলে পরবর্তিতে তা আর আদায় করতে হবে না।
কারো যদি যোহর বা জুম’আর পূর্বের চার রাকাত সুন্নত ছুটে যায় তাহলে ফরজের পর ওয়াক্ত থাকতে থাকতেই তা আদায় করে নিতে হবে। ওয়াক্ত শেষ হলে তা আর আদায় করা লাগবেনা। তবে এসকল ক্ষেত্রে সুন্নতে মু’আক্কাদা ছেড়ে দেয়ার কারণে গোনাহগার হতে হবে।

উল্লেখ্য জুমা নামাজের কাযা নেই। জুমা পড়তে না পারলে চার রাকাত জোহার কাযা পড়তে হবে।

কাযা নামাজের সময় : কাজা নামাজ পড়ার নির্দিষ্ট সময় নেই। যখনই স্মরণ হবে এবং সময়-সুযোগ হবে পড়ে নিতে হবে। তবে নামাযের নিষিদ্ধ সময়গুলোতে পড়া যাবেনা।

সফর বা ভ্রমণের সময়ের কাযা : সফরে যে নামাজ কাযা হবে তা মুকিম হয়ে পড়তে গেলে কসর পড়বে। কসর মানে চার রাকাত বিশিষ্ট নামাজ দুই রাকাত পড়বে। তেমনি মুকিম অবস্থায় কাযা হলে সফরে তা পুরা পড়তে হবে। মূল বিষয় হল,নামায যে অবস্থায় কাযা হয়েছে সেই অবস্থার নামায কাযা আদায় করবে।

কাযা নামাযের নিয়ত। যদি এক বা দুই ওয়াক্ত নামায কাযা হয় তবে নির্দিষ্ট সেই ওয়াক্তের উল্লেখপূর্বক নিয়ত এভাবে করবে- আমি অমুক ওয়াক্তের নামাযের কাযা আদায় করছি। অতটুকু যথেষ্ট। যাদের জিম্মায় অনেক কাজা নামাজ রয়েছে। আর কাজা নামাজ আদায় করার সময় এ নিয়ত করতে হবে, আমি অমুক দিনের জোহরের নামাজ কাজা আদায় করছি।
যদি দিন-তারিখ মনে না থাকে, এমতাবস্থায় এভাবে নিয়ত করবে আমি আমার জীবনের সর্বপ্রথম জোহর যে ওয়া নামাজের কাজা আদায় করছি। এভাবে প্রত্যেক কাজা নামাজ আদায় করার ক্ষেত্রে নিয়ত করবে। এভাবে ততদিন পর্যন্ত কাজা নামাজ আদায় করতে থাকবে, যতক্ষণ না ব্যক্তির মন এ সাক্ষ্য দেবে, তার জিম্মায় কোনও নামাজ কাজা নেই ।

উল্লেখ্য বিভিন্ন পর্ব তথা শবে কদর,শবে বারাত,শবে মেরাজ ইত্যাদিতে আমরা নফল কম করে আমার জিম্মায় যে কাজা নামাজ আছে টা আদায় করা উচিত । কেননা নফলের জন্য আল্লাহ্‌ পাকড়াও করবেন না বরং ফরজের জন্য করবেন ।

আল্লাহ আমাদের পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ যথাসময়ে পড়ার তাওফিক দান করুক । আমীন।

রেফারেন্সঃ-

১) ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/১৭১
২) আল মামসূত লিস সারখসী ১/১৬১
৩) তাবয়ীনুল হাকায়েক ১/১৮৩
৪) আপকে মাসায়েল ৩/৬০৩
৫) ফাতাওয়া শামী ৩/৭১

৬)জামিয়াতুল আস’আদ আল ইসলামিয়া ওয়েবসাইট

এটা পড়তে পারেন মৃতের একাধিক জানাজা কি জায়েজ ?

 

 

ধর্মের কি দরকার? মানবতাবাদীতাই কি শ্রেষ্ঠ ধর্ম না?

প্রশ্ন ১: আচ্ছা ধর্মের দরকার কি আমি এটাই বুঝি না। সেই প্রাচীন যুগ তো এখন আর নাই। এখন আমরা সভ্য, বুদ্ধিমান প্রানী। মানবতাবাদীতাই কি শ্রেষ্ঠ ধর্ম না?

উত্তর: মানবতাবাদীতে কেন শ্রেষ্ঠ ধর্ম না তার অনেকগুলো কারণ আছে, নিচের তার কয়েকটি উল্লেখ করছি।

এক – মানবতাবাদীতার সমস্যা হলো যে মানবতাবাদীতার কোন স্ট্যান্ডার্ড নাই। যেমন, আমরা সবাই জানি যে আমাদের উচিত বাবা-মার সাথে ভালো ব্যবহার করা। কিন্তু, কতটুকু ভালো ব্যবহারকে ভালো ব্যবহার বলবো? কে এটার স্ট্যান্ডার্ড ঠিক করে দিবে? অথচ, ইসলাম বলে, বাবা-মার সাথে এমনভাবে ভালো ব্যবহার করো যে তাদের প্রতি কখনো উহ্‌ শব্দ পর্যন্ত করবে না। এমনিভাবে, মানুষের জীবনের প্রতিটা কাজের স্ট্যান্ডার্ড ধর্ম (বিশেষ করে ইসলাম) নির্ধারিত করে দেয়, ফলে পথহারা মানুষ পথ খুঁজে পায়।

দুই – মানুষ এমন একটা প্রাণী যার ব্রেইন ওয়াশ করা খুব সহজ, আর একবার ব্রেন ওয়াশ হয়ে গেলে সে মানুষ হত্যার মত ঘোরতর খারাপ কাজকেও সে খুব স্বাভাবিক ব্যাপার বলে মেনে নিতে পারে (যেটা আসলে অমানবিক!)। যেমন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলার জার্মানদের এমনভাবে ব্রেইন ওয়াশ করেছিল যে তারা অনায়াসে গণহত্যা সমর্থন করেছিলো। আবার, প্রিয়নবী মুহাম্মদ(সা) এর আগমনের আগে আরবের রীতি ছিল মেয়েদের জ্যান্ত কবর দেয়া, এটাকে তারা খুব স্বাভাবিক মনে করত! কারণ, তাদের ব্রেইন এভাবেই ওয়াশ হয়ে গিয়েছিল। এক সময় আমেরিকায় সমকামীদের ঘৃণার চোখ্যে দেখা হতো, অথচ এখন দেখা হয় সম্মানের চোখে! আজকের সমাজে ভাই-বোন বিছানায় শোয়াকে (Incest) ঘৃণার চোখে দেখা হয়, কিন্তু সেইদিন খুব বেশী দূরে নাই যেইদিন এই নোংরা কাজটাকেও মানবতার চোখে ‘হালাল’ হবে!

সত্যি কথা হলো, স্ট্যান্ডার্ড ঠিক না করে দিলে মানুষ আর মানুষ থাকে না, ক্রমশ:ই পশু হয়ে যায় । আর ভালো-মন্দের এই স্ট্যান্ডার্ড মানুষ দিতে পারবে না, কারণ সে সব সময়ই সুবিধাবাদী, সব সময়ই কিছু না কিছু দ্বারা ব্রেইন ওয়াশড।  এই স্ট্যান্ডার্ড আসতে হবে উপরের লেভেল থেকে। এই প্রসঙ্গে এমন একজনের উক্তি দিচ্ছি যাকে কোন ‘মানবতাবাদী’ উপেক্ষা করতে পারবে না!

We cannot solve our problems with the same thinking we used when we created them. – Albert Einstein

একটু চিন্তা করলে বুঝবেন উপরের কথাটায় একটা অসীম পুনরাবৃত্তির চক্র রয়েছে। আপনাকে যে কোন সমস্যার সমাধান করতে হলে যে লেভেলে তা তৈরী করা হয়েছিলো তার উপরের লেভেলে যেয়ে চিন্তা করতে হবে, কিন্তু ঐ লেভেলে চিন্তা করতে যেয়ে আপনি আবার কিছু সমস্যা তৈরী করবেন, যার সমাধান করতে হলে যেতে হবে আরো উপরে, তারপর আরো, তারপর আরো … শেষমেশ আপনি আসলে সমস্যার সমাধানই করতে পারবেন না। সুতরাং, মানবজীবনের সমস্যার সমাধান আসতে পারে শুধুমাত্র সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর কাছ থেকে।

তোমরা কি বেশী জানো, না আল্লাহ্‌? তার চেয়ে বড় জুলুমকারী কে যে আল্লাহর কাছ থেকে পাওয়া প্রমাণ গোপন করে? – (সূরা বাকারাহ্‌ ২:১৪০)

তিন – মানুষকে সোজা রাখার সবচেয়ে উত্তম উপায় হলো Carrot and Stick পদ্ধতি। ধর্মকে বাদ দিলে স্রষ্টার কাছে জবাবদিহিতা বাদ দেয়া হয়, বাকী থাকে শুধু মানুষের কাছে জবাবদিহিতা। কাজেই, যার স্রষ্টাভীতি (ইসলামী পরিভাষায় তাকওয়া) নাই সে যখন মানুষের চোখকে ফাঁকি দিয়ে তার লোভ-লালসা পূরণের কোন উপায় পেয়ে যায়, তখন সেই কাজটা খারাপ হলেও খুব সহজেই সেই পাপগুলো সে করে ফেলে বা ভালো কাজ করা থেকে বিরত থাকে।

উদাহরণ দিচ্ছি। ধরুন আপনার এক প্রতিবেশী আপনার কাছে একদিন সাহায্য চাইলো, আপনি তাকে সাহায্য করলেন, কিন্তু বিনিময়ে সে আপনাকে ধন্যবাদ জানালো না, আপনি কিন্তু মন:ক্ষুণ্ন হবেন। দ্বিতীয় একদিন সে সাহায্য চাইলো, আপনি সেদিনো তাকে সাহায্য করলেন, এবারো সে আপনাকে ধন্যবাদ জানালো না, আপনি কিন্তু আসলেই মন:ক্ষুন্ন হবেন এবার, এবং খুব সম্ভবত: তৃতীয়দিন সে যখন সাহায্য চাইবে আপনি তাকে সাহায্য করবেন না। কারণ, মানুষ জন্মগতভাবে প্রতিদান প্রিয় (এর জন্যই বছর শেষে বেতন না বাড়লে আপনার মন খারাপ হয়ে যায়!), সে একদিন ফ্রি ফ্রি কাজ করে দিবে, ২ দিন করে দিবে, কিন্তু তৃতীয় দিন আর করবে না। অথচ, আপনি যদি একজন প্রকৃত ধার্মিক হয়ে থাকেন, আপনি কিন্তু তা-ও ঐ মানুষটির উপকার করে যাবেন, ধন্যবাদে তোয়াক্কা করবেন না কারণ, যে আল্লাহয় বিশ্বাস করে, সে পরকালে বিশ্বাস করে। একজন প্রকৃত ধার্মিক মানুষ এই দুনিয়ায় মানুষের কাছ থেকে প্রতিদান পাবার আশায় কাজ করে না, সে কাজ করে করে আল্লাহর কাছে প্রতিদান পাবার আশায়। একজন মু’মিন গীবত করবে না, অশ্লীল কথা বলবে না – যদিও সে  জানে এই কাজের জন্য তাকে পুলিশ ধরবে না, যদিও জানে কেউ তাকে দেখছে না, কিন্তু সে জানে আল্লাহর কাছে তাকে একদিন জবাবদিহি করতেই হবে, আর তাই সে সর্বাবস্থায় সকল খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকতে চেষ্টা করবে। কাজেই ধর্মীয় জীবন ব্যবস্থা অবশ্যই ধর্মহীন জীবন ব্যবস্থা থেকে শ্রেষ্ঠ।


এ লেখাটি পড়তে পারেন  মহাবিশ্ব কী নিজে নিজেই সৃষ্টি-নাকি এর একজন স্রষ্টা আছে


গবেষনায় দেখা গেছে যে ধার্মিক মানুষেরা ধর্মহীনদের চেয়ে দান বেশী করে এবং ভলান্টিয়ার কাজেও বেশী অংশগ্রহণ করে। বিশ্বখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী আর্থুর সি ব্রুকস স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত তার গবেষনাপত্র Religious Faith and Charitable Giving এ তথ্য-উপাত্তসহ এই ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। কোন্‌ কোন্‌ ফ্যাক্টর মানুষের civic behavior (যেমন – দানশীলতা এবং ভলান্টিয়ার কাজ) কে প্রভাবিত করে তা জানার জন্য ২০০০ সালে আমেরিকার কিছু রিসার্চার ৫০টি কমিউনিটির থেকে ৩০ হাজার অবজারভেশন সংগ্রহ করে। তাদের গবেষনায় প্রাপ্ত ফল দেখে তারা বিস্মিত হয়ে যায় – নাস্তিকেরা মুখে যত বড় বড় কথাই বলুক না কেন, ভালো কাজের হিসাব নিলে দেখা যায় যে ধার্মিকেরা ভালো কাজে অংশগ্রহণে সেক্যুলারদের থেকে বহুগুণে এগিয়ে আছে। আমি আর্থুর সি ক্লার্কের লেখা থেকে উদ্ধৃত করছি:

  • The differences in charity between secular and religious people are dramatic. Religious people are 25 percentage points more likely than secularists to donate money (91 percent to 66 percent) and 23 points more likely to volunteer time (67 percent to 44 percent).    
  • The data show that if two people — one religious and the other secular — are identical in every other way, the secular person is 23 percentage points less likely to give than the religious person and 26 points less likely to volunteer.

চার- মানবতাবাদীরা প্রায়শ:ই হয়ে দাঁড়ায় সুবিধাবাদী। একজন মানবতাবাদী যে শাস্তি সবার জন্য অমানবিক মনে করে, সেই একই শাস্তি তার চরম শত্রুর জন্য সঠিক বলে মনে করতে পারে। উদাহরণ দিচ্ছি। বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সময় মানবতাবাদীরা কিন্তু এইসব অপরাধীদের ফাঁসীর জন্য গলা ফাটিয়ে ফেলেছেন। কিন্তু, এরাই আবার অন্য আলোচনায় বলবেন মানুষের ফাঁসী দেয়া ঘোরতর অপরাধ, যেহেতু আমরা প্রাণ দিতে পারি না, কাজেই প্রাণ নেয়ার অধিকারো আমাদের নেই। [আপনি আবার ভেবে বসবেন না আমি ৭১ এর খুনীদের মৃত্যুদন্ড বিরোধী! আমি শুধু ৭১ কেন, সকল প্রকার খুনীরই মৃত্যুদন্ডের পক্ষে, কারণ আল্লাহর আইন সকল অপরাধীর জন্য সমান]।

পাঁচ – শেষ কথা হলো ধর্মকে বাদ দিলে আপনি সৃষ্টিকর্তাকে বাদ দিচ্ছেন। অথচ সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব যুক্তি প্রমাণিত দিয়ে (আমার এই লেখাটি পড়ুন), সৃষ্টিকর্তার উপাসনা করা মানুষের মানসিক কাঠামোর অবিচ্ছেদ্য অংশ। আল্লাহ্‌ মানুষকে উপাসনা করার need দিয়ে তৈরী করেছেন, আর তাই বিপদে পড়লে বা আটকে গেলে ঘোর নাস্তিকও স্রষ্টাকে ডাকে (এই ভিডিওতে উদাহরণ দেখুন)। কাজেই, স্রষ্টাকে উপাসনা না করে মানুষ কখনোই মানসিক প্রশান্তি পাবে না।  

 

প্রশ্ন ২। ধর্ম ছাড়া পৃথিবীটা কত সুন্দর হতো! এই ধর্মের কারণে মানুষে মানুষে কত বিভেদ, হানাহানি, যুদ্ধ! ধর্মের ব্যাপারটা বাদ দিলে হয় না?

উত্তর: আপনি উপরের বক্তব্যে বিশ্বাসী হলে বুঝে নিতে হবে হয় আপনি জ্ঞান রাখেন না, নতুবা আপনার ব্রেইন শয়তান ভালো মতই ওয়াশ করে রেখেছে। পৃথিবীতে হানাহানি আর যুদ্ধ বরং তখনই হয় যখন মানুষ ধর্ম মানে না। পৃথিবীর বেশীরভাগ যুদ্ধেরই কারণ হলো অর্থ আর ক্ষমতা – ধর্ম না।

বিংশ শতাব্দী ছিল  ধর্ম-নিরপেক্ষতা এবং ধর্মহীনতার উত্থান এর শতক। আসুন দেখি এই শতকের মানবতার কিছু অর্জন! (তথ্যসূত্র: How Do You Kill 11 Million People – Andy Andrews)

 

  • প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুর্কীর নবগঠিত সেক্যুলার সরকার তাদের দেশের জ্ঞানী-গুনী, ধর্মীয় নেতা, নারী, গর্ভবতী মা, আর শিশুসহ ২ মিলিয়ন মানুষ
  • ১৯৩৩ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত হিটলার পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে ১১ মিলিয়ন মানুষ।
  • দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আরো মারা যায় ৫ মিলিয়ন জার্মান বেসামরিক ও সামরিক মানুষ, ২.৮ মিলিয়ন ইউরোপীয়ান
  • কম্বোডিয়ার সরকার ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত মেরেছে তার দেশের তিন মিলিয়ন মানুষ – যে দেশের মোট জনসংখ্যা ছিলো ৮ মিলিয়ন
  • ১৯১৭ থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের ‘মানবতাবাদী’ কমিউনিষ্ট সরকার হত্যা করেছে তাদের দেশের ৫৫ মিলিয়ন (জ্বী ঠিক পড়ছেন, সাড়ে পাঁচ কোটি) পুরুষ, নারী এবং শিশুদের!! (গত শতাব্দীর বৃহত্তম গণহত্যা!)
  • ৩রা নভেম্বর ২০০২ থেকে শুরু করে পরের ১০ বছরে মার্কিন দ্রোন হামলায় মারা গেছে ৪৭০০ মানুষ যাদের মধ্যে আছে স্কুলগামী শিশু, বিয়েতে যোগ দিতে যাওয়া বরযাত্রীসহ অসংখ্য নিরপরাধ মানুষ (সূত্র: Josh Begle’s DroneStream)

আপনার কাছে আমার প্রশ্ন: এই হত্যাকান্ডের কোন্‌টি ধার্মিকেরা করেছে? আর স্পেসিফিকভাবে বললে, কোন্‌টা মুসলমানেরা করেছে? বরং, যে জাতি যত ধর্মবিরোধী ছিল, সেই জাতি ছিল ততো নিষ্ঠুর।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণ ছিল ইউরোপীয় শক্তিগুলোর মতপার্থক্য, শত্রুতা, জোটবদ্ধতা, সামরিকবাদ, সাম্রাজ্যবাদ ও জাতীয়বাদ। ধর্ম এখানে সম্পূর্ন অনুপস্থিত!

The main causes of World War I, which began in central Europe in late July 1914, included many factors, such as the conflicts and hostilitybetween the great European powers of the four decades leading up to the war. Militarism, alliances, imperialism, and nationalism played major roles in the conflict as well. – Wikipedia

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণ ছিলো হিটলারের ক্ষমতার লোভ , অর্থের লোভ। আর মানুষকে motivate  করার জন্য হিটলার ব্যবহার করেছিলেন মিথ্যা কথা আর ঘৃণাকে। কাজেই, এই যুদ্ধের জন্যও ধর্মকে দোষ দেয়ার কোন কারণ নেই!

The main cause of World War II was the desire and ability of Adolf Hitler, in control of Nazi Germany, to dominate Europe and gain controlespecially of the agrarian resources to the east of Germany.– Wikipedia

৭১ সালে পাকিস্তান আর্মির গণহত্যা, মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমা আগ্রাসন, এমনকি সিরিয়ায় বাশার আল আসাদের হত্যাযজ্ঞ – এই প্রত্যেকটি নৃশংসতার পিছনের কারণ হলো অর্থ আর ক্ষমতার লোভ । সুতরাং, সত্য হলো পৃথিবীর হত্যা, হানা-হানির মূলে আছে স্রষ্টার কাছে জবাবদিহি করতে হবে এই সত্য উপেক্ষা করে মানুষের কাছের জবাবদিহিতা কৌশলে এড়িয়ে যেয়ে অন্ধভাবে ক্ষমতা আর অর্থের পিছনে ছুটা!

আমেরিকার বিখ্যাত আইন বিশেষজ্ঞ Stephen Carter বলেন যে বিংশ শতাব্দী হলো মানব সভ্যতার ইতিহাসের সবচেয়ে রক্তাক্ত শতক। আর এই বিশাল হত্যাযজ্ঞের পিছনে কারণ ধর্ম না, ছিলো ক্ষমতালোভী চিন্তা-ভাবনা! বিশ্বনন্দিত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী Zbigniew Brzezinski তার Out of Control: Global Turmoil on the Eve of the Twenty-First Century (1993) লেখায় এই হত্যাকান্ডের যে কারণ উল্লেখ করেছেন তা উদ্ধৃত করে Shaikh Hamza Tzortzis  বলেন:

Lives had been deliberately extinguished, by politically motivated carnage via state backed entities. The war dead alone for politically motivated reasons is eighty seven and a half million people. State terrorism is the real terrorism.

 

সুতরাং, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সন্ত্রাস হলো ক্ষমতালিপ্সু রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস! গত শতাব্দীতে ৮ কোটি ৭৫ লক্ষ মানুষ মারা গেছে সেক্যুলার চিন্তা-ভাবনার রাস্ট্রগুলোর সন্ত্রাসের কারনে আর এই রাষ্ট্রগুলোই কিনা দোষ দেয় ধর্মকে! ধর্ম মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করে না, ধর্ম মানুষকে একত্রিত করে, কমন লক্ষ্য দেয়ার মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ করে, অন্য মতের প্রতি সহিষ্ণু হতে শেখায়। অন্যদিকে মানুষকে বিভক্ত করে মুনাফালোভী ধর্মবিদ্বেষী চিন্তা-ভাবনা। প্রকৃত ধর্মীয় শিক্ষা থেকে মানুষ যত বেশী দূরে সরে যাবে, ততই সে দূরে সরে যাবে মনুষ্যত্ব থেকে।

… যে ব্যক্তি নরহত্যা বা পৃথিবীতে ফ্যাসাদ সৃষ্টিকারী কাজের শাস্তি প্রদানের উদ্দেশ্য ছাড়া কাউকে হত্যা করল, সে যেন পৃথিবীর সকল মানুষকেই হত্যা করল। আর যে কেউ কারো প্রাণ রক্ষা করল, সে যেন পৃথিবীর সকল মানুষের প্রানরক্ষা করল।  – সূরা মায়িদাহ্‌ ৫:৩২

ইসলামের ইতিহাস যদি ঘাটেন তো দেখবেন মুসলিমরা কখনোই জোর করে তাদের ধর্ম অন্য মানুষের উপর চাপিয়ে দেয়নি। ইসলামী রাষ্ট্রে অন্য ধর্মাবলম্বীদের নির্বিঘ্নে ধর্ম-চর্চার অধিকারের ইতিহাস নিয়ে মুসলিমরাই শুধু নয়, অমুসলিমেরাও শত শত গবেষণামূলক লেখা লিখেছেন (পড়ুন Alexander Knysh এর লেখা Islam in Historical Perspective)।  ইসলামের সহমর্মিতার আমি শুধু কয়েকটি উদাহরণ দিচ্ছি:

  • মদীনায় রাসূলুল্লাহ(সা) নিশ্চিত করেছিলেন যাতে  ইহুদীরা নির্বিঘ্নে তাদের ধর্ম পালন করতে পারে।
  • উমার(রা) জেরুজালেম এর চাবি হিরাক্লিয়াস এর কাছ থেকে বুঝে নেয়ার পর পাদ্রীর অনুরোধের পরেও গীর্জায় যোহরের নামাজ পড়েননি শুধুমাত্র এই কারণে যে ভবিষ্যতের মুসলিমরা এই গীর্জাকে হয়তো আমিরুল মু’মিনীন এর মসজিদ বলে দাবী করবে।
  • খালিদ বিন ওয়ালিদ(রা) এর নেতৃত্বে ৬৩৪ খ্রীষ্টাব্দে সিরিয়ার দামাস্কাস বিজয় করার পর মুসলিমরা সেন্ট জন দি ব্যাপ্টিস্ট গির্জাতে শুক্রবারে জুমুআর নামাজ পড়ত, একই সপ্তাহের রবিবারে খ্রীষ্টানেরা সেই একই গির্জায় তাদের সাপ্তাহিক উপাসনা করত। মুসলিমরা দামাস্কাসে এসে খ্রিস্টানদের গির্জা ভেঙ্গে দেই নাই। বরং মুসলিমদের ব্যবহার আর চারিত্রিক গুনাবলিতে আকৃষ্ট হয়ে দলে দলে মানুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে।
  • ক্রুসেডারেরা ১০৯৯ সালের ১৫ জুলাই জেরুজালেম দখল করে মুসলমানদের রক্তে পুরো শহরকে হাঁটু পর্যন্ত রক্তে ডুবিয়ে দেয়, কিন্তু এর প্রায় ১শ বছর পর ১১৮৭ সালে সালাহ-আদ-দীন আইউবী (রহিমাহুল্লাহ) যখন জেরুজালেম পুনরূদ্ধার করেন তখন তিনি কোনও প্রতিশোধ তো নেনই নি বরং খ্রীষ্টানসহ সকল বিধর্মীদের ক্ষমা করে দেন, তাদেরকে তাদের মতো করে ধর্ম পালন করতে দেন, এমনকি তাদের কে তাদের সকল সম্পদ নিয়ে অন্য দেশে (ইউরোপে) চলে যাওয়ারও স্বাধীনতা দেন।

[বিস্তারিত জানতে দেখুন: PBS Documentary – Islam: Empire of Faith.]

সকল ধর্মের মানুষের প্রতি ইসলাম সহনশীলতার কথা বলে, সহমর্মিতার আর ন্যায়বিচারের কথা বলে। কারণ এটা মানুষের তৈরী ধর্ম না, এটা এসেছে আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার কাছ থেকে, যিনি সবচেয়ে বেশী ন্যায়বিচারক। একজন মু’মীনের কাছে একজন মুসলমান যতটুকু নিরাপদ, একজন অমুসলিমও ততটুকুই নিরাপদ – যেরকম রাসূলুল্লাহ(সা) শিখিয়ে দিয়ে গেছেন।

রাসূলুল্লাহ(সা) বলেন: সাবধান! যে ব্যক্তি কোনও মুয়াহিদের (মুয়াহিদ: মুসলিম রাষ্ট্রে ন্যায়সঙ্গতভাবে বসবাসরত অমুসলিম) উপর অত্যাচার করবে অথবা তার কোন অধিকার ছিনিয়ে নিবে অথবা তাকে অসহনীয় যন্ত্রণা দিবে অথবা তার অনুমতি ছাড়া তার কোনও কিছু নিবে, সে জেনে রাখুক যে বিচার দিবসে আমি তার (অত্যাচারী ব্যক্তির) বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবো।  – (সুনান আবু দাউদ)

 

=============

লেখক- আদনান ফয়সাল

আহা, এ কবর যদি আমার হত !

সাহাবী সিরিজ-১

ক্কা ও মদিনার মাঝামাঝি স্থানে মুযায়না গোত্রের লোকজন বসবাস করত। মুযায়না গোত্রেরই যুবক আবদুল উয্যা ইবন নুহাম আল মুযায়নি। তার পিতা ইতিমধ্যে মৃত্যুবরণ করেছে। যুবকের বয়স ছিল তখন ষোলবছর। তখন পর্যন্ত তার চাচাই তাকে লালন-পালন করে আসছিল।

চাচা অত্যন্ত ধনাঢ্য ব্যক্তি ছিল। সে তার এ এতিম ভাতিজার সব চাহিদা পূরণ করত। উত্তম খাবার, উত্তম পোশাক, ভালো থাকার ব্যবস্থা ইত্যাদি সবকিছু। আবদুল উয্যা যা কিছু চাইত চাচা এনে দিত। তার জন্য বিশেষভাবে অন্যান্য এলাকা থেকে উন্নতমানের পোশাক অর্ডার দিয়ে আনা হত। কারণ স্থানীয়ভাবে তৈরি পোশাক আবদুল উয্যার পসন্দ ছিল না। এভাবে বন্ধুমহলে তার একটা স্বতন্ত্র অবস্থান তৈরি হয়ে গিয়ে ছিল। আলাদাভাবে দেখা হত তাকে।

আবদুল উয্যার বস্তির লোকেরা ছিল মূর্তিপূজক। তাদের সবার আলাদা আলাদা মূর্তি ছিল। সেগুলোকে সামনে রেখে তারা তাদের প্রয়োজন প্রার্থনা করত। এটা ছিল ঠিক তখনকার কথা যখন মুসলমানরা মক্কা থেকে হিজরত করে মদিনা চলে যাচ্ছিল। যেহেতু আবদুল উয্যার বস্তি তখন শহরের মধ্যে ছিল, তাই যাতায়াতকারী কাফেলাসমূহ সেই বস্তিতে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেয়ার উদ্দেশ্যে অবস্থান করত।

কোনো কোনো কাফেলা তো এখানে রাত্রি যাপনও করত। কাফেলাগুলোর জন্য সবচেয়ে সুবিধার বিষয় ছিল এই, এখানে সহজে পানি পাওয়া যেত। অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী ক্রয়ের ক্ষেত্রেও তেমন কোনো সমস্যা হত না। একদা আবদুল উয্যার ভাগ্য খুলে যায়।

কিছু মুসলমান মক্কা থেকে হিজরত করে মদিনা যাচ্ছিলেন। তারা তার বস্তিতে অবস্থান করেন। আবদুল উয্যাকে ইসলামের দাওয়াত দেন তারা। আবদুল উয্যা ছিল খুবই সরলমনা যুবক। সে সাথে সাথে ইসলাম কবুল করে নিল। সাহাবিরা তাকে ইসলামের জরুরি শিক্ষা সম্পর্কে অবহিত করেন। পবিত্র কুরআনের কিছু আয়াত শিখিয়ে দেন। আয়াতগুলো সে তাৎক্ষণিক মুখস্ত করে নেয়। তারপর ওই সাহাবিরা মদিনার দিকে রওয়ানা দেন।

পবিত্র কুরআন খুব পসন্দ হয় আবদুল উয্যার। সে আল্লাহর কালাম মুখস্ত করা আরম্ভ করে। যে মুসলমানের সাথেই দেখা হত, সে তার কাছ থেকে কুরআন করিম শিখত এবং নিজের সুললিত কন্ঠে তা তিলাওয়াত করত। অত্যন্ত বুদ্ধিমান যুবক ছিল সে। উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষায় সে তার ইসলামগ্রহণের বিষয়টা গোপন রাখে। কাউকে কিছুই বলেনি।

আবদুল উয্যা কাফেলার প্রতীক্ষায় থাকত। কখন আসবে কোনো কাফেলা?! আর সে তাদের কাছ থেকে কুরআন শিখবে। আগত সাহাবিদের সে অনুরোধ করত, যেন তারা তার বস্তিতে আরো কিছুদিন অবস্থান করে। যাতে আরো কিছু বেশি কুরআন শিখতে পারে।

মক্কার কুরাইশ সর্বত্র তাদের গুপ্তচর ছড়িয়ে দিয়েছিল। কোথাও যদি কোনো মুসলমান পাওয়া যায় তাহলে তাকে ধরে যেন ফিরিয়ে নিয়ে আসে। আবদুল উয্যার চাচাও ইসলামের ঘোর বিরোধী ছিল।
সম্মানিত পাঠক! এভাবে প্রায় তিন বছর কেটে যায়। হিজরতের চতুর্থ বছর শুরু হয়ে গিয়েছিল।

একবার কাফেলার এক মুসলমান আবদুল উয্যাকে বলে দিল,
-তুমি এখানে কি করছ? হিজরত করছ না কেন?
আবদুল উয্যা বলল,
-তোমার কথা তো ঠিক। কিন্তু আমি আমার প্রিয় চাচাকে কিভাবে ছেড়ে যাই? তখনই আমি হিজরত করব যখন আমি আমার চাচার হাত ধরে তাকে রাসূলুল্লাহ সা.এর দরবারে পেশ করতে পারব।

আবদুল উয্যা ইবাদত করার জন্যে মরুভূমিতে চলে যেত। যখন সে নিশ্চিত হত, এখন কেউ আর তাকে দেখছে না, তখনই সে নামায আদায় করত। চাচার সাথে সাক্ষাত হলে অত্যন্ত ভালোবাসা ও কৌশলের সাথে বলত,
-চাচাজান! ইয়সরিবে মুহাম্মদ নামের এক লোক সম্পর্কে আমি শুনেছি, সে নাকি এমন এমন কথা বলে।
সে চাচাকে কুরআন করিমের আয়াতগুলো শোনাত। এদিকে তার চাচার মধ্যে এর কোনো প্রতিক্রিয়াই দেখা যেত না। জবাবে সে কিছুই বলত না। এই টানাপোড়েনে সময় দ্রুত অতিবাহিত হচ্ছিল।

একদা তার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে যায়। সে অত্যন্ত ভালোবাসা দিয়ে বলল চাচাকে, –
-প্রিয়চাচা! দীর্ঘ সময় পর্যন্ত আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করেছি। আমার ধারণা ছিল, আপনি ইসলাম কবুল করে নিবেন। কিন্তু আপনি ইসলাম কবুল করেননি। এখন আপনাকে এ কথা বলার সময় এসে গেছে যে, আমি আক্বিদায়ে তাওহিদ কবুল করেছি। আর (أشهد أن لا إله إلا الله وأشهد أن محمدا رسول الله) স্বীকার করে নিচ্ছি। অতএব রাসূলল্লাহ সা.এর বিরহ আমি আর সহ্য করতে পারছি না। তাই আমি হিজরত করে মদিনা চলে যাচ্ছি। আমি আন্তরিকভাবে আশা করি, আপনিও আমার সঙ্গে যাবেন।

প্রথম প্রথম তো চাচার বিশ্বাসই হয়নি। যখন ভাতিজার ইসলাম সম্পর্কে নিশ্চিত হয়, খুব রাগান্বিত হল। বলল,
-“আমি তোমার লালন-পালন করেছি। তোমাকে আদর-যত্ন করেছি। পৃথিবীর সবধরনের নেয়ামত ও সুযোগ-সুবিধা তোমার জন্য ব্যবস্থা করেছি। আমি তোমাকে নির্দেশ করছি, এক্ষণি তুমি ইসলামের পথ ছেড়ে ফিরে এসো।”
-“আমি তো কখনো ইসলাম ত্যাগ করার কল্পনাও করতে পারি না।” আবদুল উয্যা উত্তর দিল।

-তাহলে তো প্রতিটি নিয়ামত, প্রতিটি জিনিস যেসবের তুমি মালিক হয়েছ, সব ছাড়তে হবে তোমাকে। আমি তোমার আরামের সকল বস্তু ও সুযোগ-সুবিধা ফিরিয়ে নেব। শোন! প্রতিটি জিনিস এমনকি তোমার শরীরের কাপড়-চোপড় পর্যন্ত খুলে নেয়া হবে। 

আবদুল উয্যা বলল,
– চাচাজান! আপনার যা ইচ্ছা। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সা.এর মোকাবেলায় কোনো কিছুকেই গুরুত্ব ও প্রাধান্য দিতে পারব না। আমি রাসূলুল্লাহ সা.এর বিনিময়ে প্রতিটি নেয়ামতকে প্রত্যাখ্যান করছি। আপনার ইচ্ছা হলে আমার কাছ থেকে প্রতিটি বস্তুই ফিরিয়ে নিন।
রাগে-ক্ষোভে অগ্নিশর্মা হয়ে গেল চাচা। আবদুল উয্যার কাপড়-চোপড় ধরে ছিড়ে ফেলল। টুকরো টুকরো করে একদিকে ছুটে মারল।

আবদুল উয্যা প্রায় বিবস্ত্র হয়ে যায়। মাটিতে পড়ে থাকা দুই টুকরো ছালা দেখতে পেল সে। দ্রুত একটি টুকরো নিয়ে সে তার লজ্জাস্থান ঢেকে নিল। আরেক টুকরো তার কাঁধের উপর রাখল।

প্রিয় পাঠক! আজকালের মুসলমান তো রুখসত তথা ইসলামপ্রদত্ত সুযোগের জন্য পাগলপারা। দৃঢ়তা ও সাহসিকতার কাহিনী পড়তে হলে তো সাহাবায়ে কেরাম রা.এর জীবনী অধ্যয়ন করতে হবে, কিভাবে তারা ইসলামের জন্য কুরবানি দিয়েছেন, বিসর্জন দিয়েছেন। 

এক বর্ণনায় রয়েছে, আবদুল উয্যা ওই অবস্থায় নিজের মায়ের নিকট যান। তার কাছে সহযোগিতা চাইলে সে ছালার একটি টুকরা ছেলের দিকে নিক্ষেপ করে। ঐ টুকরো দিয়ে আবদুল উয্যা তার লজ্জাস্থান ও কাঁধ ঢেকে নেন। মাও পরিস্কারভাবে জবাব দিয়ে দিল,
-আমি এর চাইতে বেশি কিছু তোমার জন্য করতে পারব না।

আবদুল উয্যা তখন মদিনাতুর রাসূলের দিকে রওয়ানা দেন। যেখানে মানবজগতের সবচেয়ে বেশি স্নেহ ও ভালোবাসা দেয়ার শ্রেষ্ঠ মানুষটি অবস্থান করছিলেন। যার উন্নত চরিত্রের দ্বিতীয় কোনো নজির নেই দুনিয়ার ইতিহাসে। আবদুল উয্যা আজ পর্যন্ত আল্লাহ রাসূল সা.কে দেখেনি। পায়ে হেঁটেই তিনি মদিনা পৌঁছলেন। তাঁর মত অসহায় মুহাজিরদের জন্য একমাত্র আশ্রয়স্থল ছিল মসজিদ নববি। এই আবদুল উয্যাই পরবর্তীতে আবদুল্লাহ যুল বাজাদাইন নামে পরিচিতি লাভ করেন ইতিহাসে।

আবদুল্লাহ যুল বাজাদাইন যখন মদিনা পৌঁছেন তখন রাত। তাই মসজিদে নববিতেই শুয়ে পড়েন তিনি। রাত পেরিয়ে ভোর হয়। আল্লাহর রাসূল সা. এসে ফজরের নামায পড়ালেন। নামায শেষে সাহাবায়ে কেরামের দিকে যখন তাকান, তাদের মাঝে এক অপরিচিত মুখের উপর তাঁর দৃষ্টি পড়ে। মসজিদে নববিতে আসহাবে ছুফ্ফার ছাউনিতে যুবককে দেখতে পেলেন তিনি। বয়স আনুমানিক ২১ বছর।

রাসূলল্লাহ সা. প্রশ্ন করলেন,
(من أنت؟)
-“তুমি কে?”
উত্তর দিলেন,
(أنا عبد العزى)
-“আমি আবদুল উয্যা।”
জিজ্ঞাসা করলেন,
-“পরিধানে ছালা কেন?”
আবদুল উয্যা রাসূলুল্লাহ সা.কে তার পুরো কাহিনী বর্ণনা করে বললেন,
-আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সা.কে নির্বাচন করেছি এবং দুনিয়ার সকল নেয়ামতকে ঘৃণাভরে পরিত্যাগ করে এসেছি।

আল্লাহর রাসূল সা. তাঁর সেই নতুন সাথীকে সাহস দিলেন। বললেন,
-“আজ থেকে তোমার নাম আবদুল উয্যা নয়; বরং আবদুল্লাহ যুল বাজাদাইন।” যুল বাজাদাইন শব্দের অর্থ হচ্ছে দুই টুকরো ছালা বিশিষ্ট। রাসূলুল্লাহ সা.এর পবিত্র মুখ থেকে বের হওয়া এ নামই তার পরিচয় হয়ে গেল। আবদুল্লাহ তাতে খুব খুশি হলেন।

আবদুল্লাহ যুল বাজাদাইন তখন থেকে মসজিদে নববিতে অবস্থান করতে থাকেন। খুব উচ্চস্বরে পুরো জোশের সাথে তিনি কুরআন করিম তেলাওয়াত করতেন। তিনি কুরআন করিম শিখতেন এবং তা খুব পড়তেন। এভাবে পবিত্র কুরআনের অনেকাংশ তার পড়া হয়ে যায়। কুরআন করিম অত্যন্ত ভালোবাসতেন তিনি।

আল্লাহর রাসূল সা. তাকে বলেছিলেন,
(فالتزم بابي)
-“আমার দরজার কাছে কাছে থেকো।”
আর বাস্তবেই আবদুল্লাহ যুল বাজাদাইন রাসূলুল্লাহ সা.এর দারওয়ানে পরিণত হয়ে যান। সর্বদা তিনি তাঁর খেদমতের জন্য উপস্থিত থাকতেন।
আবদুল্লাহ খুবই উচ্চস্বরে যিকির-আযকার করতেন। একবার হযরত উমর রা. বললেন,
(أمراء هو؟)
– “সে কি লোকদেখানোর জন্য এমন উচ্চস্বরে পড়ে নাকি?”
রাসূলুল্লাহ সা. উত্তর দিলেন,
(دعه عنك فإنه أحد الأواهين)
– “নাহ, বরং সেতো আল্লাহর দরবারে আহাজারিকারীদের একজন।”

আবদুল্লাহ যুল বাজাদাইন মসজিদেই পড়ে থাকতেন। উচ্চস্বরে কুরআন করিম তেলাওয়াত করতেন। একদা হযরত উমর রা. রাসূলুল্লাহ সা.কে আরজ করেন,
(ألا تسمع إلى هذا الأعرابي يرفع صوته بالقرآن)
-এই বেদুইনকে দেখুন তো, কত উঁচু আওয়াজে সে কুরআন মজিদ তেলাওয়াত করছে। তার কারণে অন্য মানুষের কুরআন তেলাওয়াত করতে সমস্যা হয়। আল্লাহর রাসূল সা. বললেন,
(دعه يا عمر فإنه خرج مهاجرا إلى الله ورسوله)
-“উমর! তাকে ছেড়ে দাও (কিছু বলো না)। সেতো আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি হিজরত করতে গিয়ে সবকিছু ত্যাগ করেই ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে।”

সম্মানিত পাঠক! একটু চিন্তা করুন। আবদুল্লাহ যুল বাজাদাইন হচ্ছেন একজন সাধারণ মানুষ। মদিনায় তার কোনো পরিবার-পরিজন নেই, কোনো গোত্র নেই। ধন-সম্পদের মালিকও নয়। তারপরও আল্লাহর রাসূল সা. তাকে তাঁর নিকটস্থ সাথীদের অন্তর্ভূক্ত করেছেন। একেই বলে উন্নত চরিত্র। তার সবচেয়ে বড় গুণ হচ্ছে, তিনি আল্লাহর রাসূল সা.কে আর আল্লাহর রাসূল তাকে ভালোবাসেন।

সময় অতিবাহিত হতে বেশি দিন লাগেনি। কয়েক বছর কেটে যায়। নবম হিজরিতে আল্লাহর রাসূল সা. গাযওয়ায়ে তাবূকের উদ্দেশ্যে রাওয়ানা হন। বিরাট সৈন্যবাহিনী ছিল। ইসলামের অন্যান্য মুজাহিদদের সঙ্গে আবদুল্লাহ যুল বাজাদাইনও শামিল হন।

শাহাদাতের জযবায় আপ্লুত আপ্লূত হয়ে তিনি রাসূলুল্লাহ সা.এর দরবারে উপস্থিত হলেন। অনুরোধ করলেন তাঁকে,
-হে আল্লাহর রাসূল! আমার জন্য দুআ করুন যাতে আল্লাহ তা‘আলা আমাকে যুদ্ধে শাহাদাতের নেয়ামতে ভূষিত করেন।
আল্লাহর রাসুল সা. তার জন্য দুআ করলেন,
(اللهم إني أحرم دمه على الكفار)
-“হে আল্লাহ! কাফিরদের জন্য আমি তার রক্ত হারাম করছি।”
তিনি আরজ করলেন,
-হে আল্লাহর রাসূল! আমার উদ্দেশ্য তো এটা ছিল না। আমি তো শাহাদাত প্রত্যাশী।
রাসূলুল্লাহ সা. ইরশাদ করলেন,
-“যুল বাজাদাইন! তুমি আল্লাহর রাস্তায় জিহাদের লক্ষ্যে বের হয়েছ। তোমার যদি জ্বর হয় এবং জ্বরের কারণে তোমার মৃত্যু হয়, তাহলেও তুমি শহীদ।”

আল্লাহর রাসূল সা. তাবূক পৌঁছে গেলেন। পাঠকমহল! আপনারা ভালো করেই জানেন, এ যুদ্ধে রোমানদের বিরুদ্ধে কোনে সংঘর্ষ হয়নি। তাবূকে অবস্থানকালেই আবদুল্লাহ যুল বাজাদাইন একদিন জ্বরে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। শরীরের অবস্থা খুব খারাপ হতে থাকে। একসময় আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সা.এর জন্য ঘর-বাড়ি এবং আরাম-আয়েশে ভরা জীবন পরিত্যাগকারী এ আবদুল্লাহ ইনতিকাল করেন।

দয়ালু নবীকে অবহিত করা হয়। আল্লাহর রাসূল সা. আবু বকর ও উমর রা.কে সঙ্গে নিয়ে তার দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করতে লাগলেন। তখন ছিল শীতের রাত। এদিকে রাসূলুল্লাহ সা.এর আরেক সাহাবি হযরত আবদুল্লাহ ইবন মাসঊদ রা.ও সেই যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। যিনি দেহের দিক দিয়ে দুর্বল ও কৃশকায় তবে ঈমানের দিক দিয়ে সবল ছিলেন। মধ্য রাতে তার ঘুম ভেঙ্গে যায়।

খাটো আকৃতির আবদুল্লাহ ইবন মাসঊদ রা. আল্লাহর রাসূল সা.কে যারপারনাই ভালোবাসতেন। প্রথম দিকের মুসলমান ছিলেন। তিনি যখন রাসূলুল্লাহ সা.এর বিছানার দিকে তাকান। দেখলেন, বিছানা খালি পড়ে আছে। তারপর আবুবকর ও উমর রা.এর বিছানা দেখলেন, তাও খালি। খুব অবাক হলেন। মনে মনে চিন্তা হল, কোথাও কোনো বিপদ আসে নি তো? দাঁড়িয়ে চারিদিকে চোখ বুলালেন।

মধ্য রাতের সময়। চতুর্দিকে গভীর অন্ধকার। ফের একদিকে আবছা আলো নজরে পড়ে। আবদুল্লাহ ইবন মাসঊদ রা. সেই আলোর দিকে চললেন। যেতে যেতে মুসলমানদের তাবুর এক কোণায় বিস্ময়ভরা এক দৃশ্য অবলোকন করলেন তিনি। দেখলেন, বেলাল ইবন হারেস একটি ছোট বাতি ধরে দাঁড়িয়ে আছে, যার আলোতে একটি কবর খনন করা হয়েছে। আবু বকর ও উমর রা. এর হাতে কার যেন লাশ। আল্লাহর রাসূল সা. নেমেছেন কবরে ।

তার মনে হল, এটা আবদুল্লাহ যুল বাজাদাইনের লাশ। আল্লাহর রাসূল সা. ইরশাদ করছেন,
(أدليا إلى أخاكما)
– “তোমাদের ভাইকে কাছে আনো।”
আবু বকর ও উমর রা. যুল বাজাদাইনের লাশ আল্লাহর রাসূল সা.এর হাতে তুলে দিচ্ছেন। আর আল্লাহর রাসূল সা. বলছেন,
(رفقا بأخيكم)
“তোমাদের ভাইকে আস্তে করে তোল।”
(رفقا بأخيكم)
“আদর করে, নরমভাবে এবং মহব্বতের সাথে ধরো।” কারণ, (إنه كان يحب الله ورسوله) “সে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সা.কে ভালোবাসত।”

আল্লাহর রাসূল সা. তাঁর প্রিয় সাথীকে নিজ পবিত্র হাতে উঠালেন এবং অত্যন্ত মহব্বত ও ভালোবাসার সাথে তাকে কবরে রাখলেন। অত:পর রাসূলুল্লাহ সা.এর চারিত্রিক মাহাত্ম্য দেখুন। তিনি নিজ হাত আসমানের দিকে তুলে আল্লাহর কাছে দুআ করলেন,
(اللهم إني أمسيت عنه راضيا)
-“হে আল্লাহ! আমি তোমাকে সাক্ষী রেখে বলছি, আমি আজ সন্ধ্যা পর্যন্ত যুল বাজাদাইনের প্রতি সন্তুষ্ট ছিলাম।” (فارض عنه) “হে আল্লাহ! তুমিও তার উপর রাজি ও সন্তুষ্ট হয়ে যাও।”

এক বর্ণনায় এসেছে, আল্লাহর রাসূল সা. তাঁর নিজ হাতে তাকে দাফন করেছেন এবং বললেন, (اللهم ارحمه إنه كان قارئا للقرآن محبا لرسول الله…)
-“হে আল্লাহ! তার উপর রহমত করো। সে কুরআন করিমের তেলাওয়াতকারী ছিল। আল্লাহর রাসূলকে মহব্বত করত।”

আবদুল্লাহ ইবন মাসঊদ রা. স্বচক্ষে দেখা ঘটনা আমাদের বর্ণনা করছেন। সেই সাধারণ সাহাবির সম্মান ও মর্যাদা দেখেছেন। তাকে যে আল্লাহর রাসূল সা. কী পরিমাণ ভালোবাসতেন তাও লক্ষ করেছেন। এসব দেখার পর তিনি নির্দ্বিধায় বলেন,
(يا ليتني كنت صاحب اللحد)
-“আহ, এ কবরে যদি আমি হতাম!” .. .. এ কবরটা যদি আমার হত !”

=====================

লেখক- ড. সাদিক হুসাইন