8.5 C
New York
Friday, October 24, 2025

Buy now

spot_img
Home Blog Page 15

মুসলিমদের মাঝে পৌত্তলিক রীতিনীতির অনুপ্রবেশ ! সতর্কতা জরুরী!

অধ্যাপক মুরতাহিন বিল্লাহ জাসির: অবস্থা দেখে মনে হয়, এ দেশের বৃহত্তর জনগণের মুসলিম-পরিচিতি বিলুপ্ত করার ও তাদেরকে মুশরিক (পৌত্তলিক) বানানোর কাজ দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে। কাজটি হচ্ছে একটি অতি সূক্ষ্ম, সুচিন্তিত ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার আওতায়। পরিকল্পনাটি বহুমাত্রিক, যাতে রয়েছে শিক্ষাকেন্দ্রিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক নানা দিক। এ নিবন্ধটি এমন কিছু বিষয় নিয়ে লেখা, যেগুলো শিরকি (পৌত্তলিক) ধ্যান-ধারণার বাহন হিসেবেই কাজ করছে। এসব কাজের দ্বারা বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মধ্যে, বিশেষত তরুণসমাজের মধ্যে যে মগজ ধোলাই হচ্ছে, তাতে ধীরে ধীরে আমাদের ঈমানী শক্তি লোপ পাচ্ছে এবং পৌত্তলিকতার দিকে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি বলে মনে করার কারণ আছে। ( শিরক )

মঙ্গলপ্রদীপ

কোনো অনুষ্ঠানের শুরুতে মঙ্গলপ্রদীপ জ্বালানো একটি হিন্দু ধর্মীয় রীতি। মঙ্গলপ্রদীপ জ্বালানোর উদ্দেশ্য অনুষ্ঠানটি যাতে সুচারুরূপে সম্পন্ন হয় তার জন্য অগ্নি-দেবতার আশির্বাদ কামনা করা। বাংলাদেশের বৃহত্তর সমাজে মঙ্গলপ্রদীপ জ্বালানোর এ হিন্দু-প্রথাটি চালু করেছে থিয়েটার। সর্বপ্রথম বাংলা ১৪০০ সালকে বরণ করা হয় মঙ্গলপ্রদীপ জ্বালিয়ে। মঙ্গলপ্রদীপ প্রথমে থিয়েটার শুরু করলেও তা অনেকটা ব্যাপকভাবে চালু হয়ে গিয়েছে। ১৯৯৫ সালের ২৭ শে নভেম্বর কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরী মিলনায়তনে বাংলা মঞ্চ-নাটকের দু’শ বছর পূর্তি এবং বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরীর ৭০তম জন্মবার্ষিকীকে ঢাকঢোল বাজিয়ে স্বাগত জানানো হয়। এ সময় শিবের নৃত্যভঙ্গিমায় তৈরি প্রতিকৃতি গাঁদা ফুল দিয়ে সাজানো ছিল। তিনটি মেয়ে মঙ্গলপ্রদীপ নিয়ে নৃত্যের তালে তালে এগিয়ে আসে (ইনকিলাব, ২৯-০৩-০৪ ঈ.)

ধীরে ধীরে মঙ্গলপ্রদীপ জ্বালানোর এ রীতিটি আরো ব্যাপকতা লাভ করে। বর্তমানে মুসলিমপ্রধান এ দেশের কোনো কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠানে মঙ্গলপ্রদীপ জ্বালিয়ে অনুষ্ঠান শুরু করা হয়। কাজটি এমনভাবে করা হয় যেন তা আমাদের জাতীয় সংস্কৃতির অংশ। শিরক

প্রশ্ন হচ্ছে, একটি হিন্দু রেওয়াজকে এভাবে চালু করার যৌক্তিকতা কোথায়? এ দেশের বৃহত্তর জনগণ কি অগ্নিদেবতার ভক্ত? আমাদের দেশে চিরাচরিত নিয়ম হচ্ছে অনুষ্ঠান শুরু করার সময় পবিত্র কুরআন থেকে তিলাওয়াত করা। এ নিয়ম বাদ দিয়ে মঙ্গলপ্রদীপ চালু করা আর হিন্দুত্ব বরণ করে নেওয়ার মধ্যে পার্থক্য কোথায়? এসব বিজাতীয় আচার-অনুষ্ঠান কেবল বর্জন নয়, প্রতিহত করা আজ আমাদের ঈমানি দায়িত্ব।

বর্ষবরণ ও বৈশাখী মেলা

১৯৬৭ সালের আগে বৈশাখী মেলা নামের কোনো সামাজিক অনুষ্ঠান এ দেশে ছিল না। সর্বপ্রথম এ মেলা আরম্ভ হয় ১৯৬৭ সালে, ছায়ানটের উদ্যোগে। প্রথম অনুষ্ঠানটি হয় ঢাকাস্থ রমনার বটমূলে (শান্তা মরিয়া, নববর্ষ, জনকণ্ঠ ১২-০৪-২০০০)। শুরুতে ‘বৈশাখ বরণ’ অনুষ্ঠান অনেকটা ক্ষুদ্র আকারে হলেও ক্রমে তা একটি বড় উৎসবে পরিণত হয়েছে এবং বছর বছর এর সাথে যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন অনুষঙ্গ।

বর্ষবরণ উৎসব পালনকালে যা করা হয় তা-ও বিজাতীয় আচার-অনুষ্ঠান থেকে নেয়া হয়েছে। বর্ষ বা বৈশাখ হচ্ছে সময়ের নাম। ‘এসো হে বৈশাখ’ বলে ‘কালবৈশাখী’ হিসেবে পরিচিত মাসটিকে যেভাবে বরণ করা হয় তাতে মনে হয় তার একটি জীবন্ত সত্তা আছে। এটা প্রকৃতি পূজার সমান বা সেদিকে নিয়ে যায় কি না ভেবে দেখা দরকার। বর্ষবরণ ও বৈশাখী মেলায় নাচ-গান, নানা ধরনের বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার, বিভিন্ন জীবজন্তুর মুখোশ পরা, নারীপুরুষের অবাধ মেলামেশা, রাখিবন্ধন প্রভৃতি যেসব কাজ হয়, তা কি হিন্দুদের পূজা-উৎসবের অনুকরণ নয়? ভেবে দেখার দরকার আছে।

মঙ্গল শোভাযাত্রা

বর্ষবরণের একটি অনুষ্ঠান হিসেবে ইদানিং শুরু হয়েছে মঙ্গল শোভাযাত্রা। এটা বর্ষবরণের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অনুষ্ঠান। মঙ্গল শোভাযাত্রা প্রথম শুরু হয়েছে ১৯৮৯ সালে, চারুকলার শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে। মঙ্গল শোভাযাত্রায় থাকে বিশাল আকারের রাজা-রানীর পুতুল ও পেঁচাসহ নানা ধরনের পশু-পাখির মূর্তি। এসব মূর্তিকে সাথে নিয়ে বাদ্যের তালে তালে এগিয়ে যায় শোভাযাত্রা। শোভাযাত্রায় যারা অংশগ্রহণ করে তাদের অনেকেই পরে নানা ধরনের মুখোশ। ( শিরক )

মঙ্গল শোভাযাত্রায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ছাড়াও নানা পেশার ও বয়সের লোক যোগ দিয়ে থাকেন। পয়লা বৈশাখে কেবল ঢাকায় নয়, মফস্বলের কোনো কোনো শহরেও এ শোভাযাত্রা চালু হয়েছে এবং ক্রমে তা চারদিকে বিস্তার লাভ করছে। বলা হয়, সারা বছর সবাই যাতে নিরাপদ থাকে সেটাই হচ্ছে এ শোভাযাত্রার উদ্দেশ্য, কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, নিরাপত্তা দেবার মালিক কে? যদি এ শোভাযাত্রার মাধ্যমে নিরাপত্তা চাওয়া হয় তবে কার কাছে এ কামনা বা প্রার্থনা? মুসলমানের তো আল্লাহ ছাড়া আর কারো কাছে প্রার্থনা করার অবকাশ নেই। আর যারা ধর্মে বিশ্বাস করে না বা বস্ত্তবাদী, নাস্তিক, তাদের তো এমন কেউ নেই যার কাছে তারা প্রার্থনা করতে পারে।

মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়ে যারা বেশি মাতামাতি করেন তারা অসাম্প্রদায়িক হিসেবেই নিজেদের পরিচয় দেন। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, এ শোভাযাত্রার মূল অনুষঙ্গ ঢোলের বাদ্য- যা দেবী দূর্গাকে আহবান করাসহ অন্যান্য মূর্তিপূজার মূল বাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়- তা একটি বিশেষ সম্প্রদায় হিন্দুদের পূজার উপাদান।

এখানে প্রশ্ন হচ্ছে (১) মহান আল্লাহ তা’আলা ছাড়া কারো কাছে কল্যাণ প্রার্থনা করা (২) হিন্দুদের দেবদেবীর পূজার অনুকরণে বাদ্য বাজানো (৩) নানা ধরণের মূর্তি ও মুখোশ বহন করা (৪) দলে দলে যুবক-যুবতী মিলে পথে-ঘাটে নৃত্য করা, এসব কি এ দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠির সংস্কৃতি? কিংবা এ-ই কি অর্থ অসাম্প্রদায়িকতার? এ অপসংস্কৃতি প্রতিরোধ করা কি আমাদের ঈমানী দায়িত্ব নয়?

বসন্ত উৎসব

গত কয়েক বছর থেকে আমাদের দেশে বসন্ত-উৎসব নামে একটি অনুষ্ঠানের সূচনা হয়েছে। বসন্ত ঋতুর শুরুতে পৌষ মাসে ‘পৌষমেলা’ নামে উৎসবটি সর্বপ্রথম শুরু হয় ১৯৯৮ সালে (জনকণ্ঠ, ২০-১২-৯৮)।

রমনা বটমূলে পালিত এ উৎসবে যা করা হয় তার অনেক কিছুই মিলে যায় মূর্তি ও প্রকৃতি-পূজারীদের আচার-অনুষ্ঠানের সাথে। মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে যে, এটাও বিজাতীয় উৎসবের অনুকরণ বৈ কিছু নয়। বসন্ত উৎসবটি সম্পর্কে অমলচন্দ্র চক্রবর্তী বলেন ‘‘ফাল্গুনের পূর্ণিমা তিথিতে শ্রী শ্রী রাধা কৃষ্ণের পূজো করে তাঁদের পায়ে আবির, কুমকুম ও পুষ্প দিয়ে রাধাকৃষ্ণ আরাধনা করা হয়। এভাবেই আনন্দ উৎসব আর কীর্তনের মধ্য দিয়ে বসন্ত বরণ ও দোলযাত্রা উৎসব পালিত হয়’’ (দৈনিক সিলেটের ডাক, ১০ এপ্রিল ২০১০)।

চৈত্রসংক্রান্তি

বহু কাল থেকেই হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুষ্ঠান হিসেবে চৈত্রসংক্রান্তি উৎসবটি চালু আছে। এ হিন্দু উৎসব সম্পর্কে আমাদের বলার কিছুই ছিল না যদি না একে বাঙালী উৎসবের লেবাস পরিয়ে সার্বজনীন রূপ দেওয়ার চেষ্টা করা হত। ইসলামবৈরীদের নিয়ন্ত্রিত মিডিয়ার বদৌলতে ইতিমধ্যে উৎসবটি ব্যাপক বিস্তার লাভ করেছে।

বাংলা সালের শেষ দিনকে বলা হয় চৈত্রসংক্রান্তি। এ দিনটি হিন্দু সম্প্রদায়ের একটি উৎসবের দিন। হিন্দুদের বিশ্বাস, এ দিনে স্নান, দান, ব্রত, উপাসনা প্রভৃতি ক্রিয়াকর্ম পুণ্যজনক (বাংলাপিডিয়া)। এ কারণে প্রাচীনকাল থেকেই হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে রেওয়াজ আছে, চৈত্রমাসের শেষ দিনটিকে এসব কাজের ভেতর দিয়ে উদযাপন করার।

চৈত্রসংক্রান্তি উপলক্ষে আয়োজিত একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে চৈত্রমেলা। এ মেলার প্রধান আকর্ষণ নানা ধরনের পণ্য কেনাবেচা ও পুতুলনাচ, নাগরদোলা, ম্যাজিক, যাত্রা ও সার্কাসসহ নানা বিনোদনমূলক আয়োজন। তবে ইতিহাসের কোথাও এমন কোনো রেকর্ড নেই যে, চৈত্রসংক্রান্তির মেলাকে মুসলমানগণ বাঙালী মুসলিম-সমাজের উৎসব হিসেবে বিবেচনা করেছেন। বাঙালী উৎসবের লেবেল লাগিয়ে চৈত্রসংক্রান্তি উৎসব উদযাপনের সময় যা করা হয় তার মধ্যে রয়েছে, ঢোল, বেহালা, সেতার প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার, ব্যান্ডপার্টি, নৃত্যানুষ্ঠান. নাট্যানুষ্ঠান, গানের আসর, প্রকৃতিপূজা, যুবক-যুবতীর অবাধ মেলামেশাসহ নানা ধরনের বেহায়াপনা। এ দিনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে জনসমাগম, বিশেষত তরুণ সমাজের ভীড়ের কারণ, প্রায় সব অনুষ্ঠানেই রয়েছে যুবক-যুবতীর অবাধ মেলামেশাসহ আমোদষ্ফূর্তির নানা আয়োজন।

এ দেশের আবেগপ্রবণ লোকদের দিয়ে অনেক কিছুই করানো সহজ, কিন্তু ভিন্ন সম্প্রদায়কে খুশি করার জন্য কিছু মতলববাজ লোক কি ইচ্ছেমত যা-তা করে যেতে থাকবে? আমাদের জাতীয় সংস্কৃতির কি কোনো অভিভাবক নেই? এ ব্যাপারে দেশের অলেমসমাজ, ঈমানদার বুদ্ধিজীবী ও সাধারণ মুসলিমদের কোনো দায়িত্ব নেই?

শিখাচিরন্তন/শিখা অনির্বাণ

দেশ স্বাধীন হওয়ার কয়েক বছর পর ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় একটি আগুনের শিখা জ্বালাবার ব্যবস্থা করা হয়েছে, এর নাম দেওয়া হয়েছে ‘শিখা অনির্বাণ’। পরে আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় সরকারের সময় সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে আরেকটি শিখা জ্বালাবার ব্যবস্থা করা হয়েছে; এর নাম দেওয়া হয়েছে (শিখাচিরন্তন)। শিখা অনির্বাণকে মাধ্যম বানিয়ে বিশেষ বিশেষ দিন সামরিক বাহিনীর মরহুম সদস্যদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়। আর শিখা চিরন্তনকে মাধ্যম বানিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয় মরহুম শেখ মুজিবুর রহমানকে তার ৭ই মার্চের ভাষণের জন্য।

শিখা অনির্বাণ বা শিখাচিরন্তনকে কেউ পূজা করে না তবে শ্রদ্ধা জানাবার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ায় এগুলো সম্মানিত বস্ত্ততে পরিণত হয়েছে। পৌত্তলিক হিন্দুরাও মূলত মূর্তির পূজা করে না, করে দেবতার পূজা। দেবতাকে ভক্তি জানাবার মাধ্যম হিসেবেই তারা মূর্তি ব্যবহার করে। কিন্তু তবুও তারা মূর্তিপূজারী।

অগ্নি হচ্ছে হিন্দু ও মাজুসিদের (অগ্নি উপাসকদের) দেবতা। কাজেই প্রশ্ন হচ্ছে, অগ্নি-শিখার মাধ্যমে কাউকে শ্রদ্ধা জানানো ইসলামসম্মত কি না। এখানে সহীহ বুখারির একটি ঘটনা উল্লেখ করছি। তখনও নামাযের আযান প্রবর্তিত হয়নি। নামাযের ঘোষণা কীভাবে দেওয়া যায়, সে সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এবং সাহাবিদের মধ্যে আলোচনা হচ্ছিল। তখন একটি প্রস্তাবে বলা হয়, নামাযের সময় নির্দেশ করার জন্য উঁচু জায়গায় আগুন জ্বালানো যেতে পারে। এ প্রস্তাবটি ছিল কেবল নামাযের সময় ঘোষণার জন্য, আগুনের শিখাকে সম্মান দেখানোর জন্য নয়। কিন্তু অগ্নি মাজুসিদের ধর্মীয় নিদর্শন হওয়ার কারণে একবাক্যে সবাই প্রস্তাবটি নাকচ করে দেন। এ ঘটনাটি থেকে এ কথা উপলব্ধি করতে বেগ পেতে হয় না যে, কোনো কিছুর প্রতীক বা নিদর্শন হিসেবে অগ্নিকে অভিবাদন করা, একে পুষ্পমাল্য দেওয়া, এর সামনে দাঁড়িয়ে শপথ করা, নীরবতা পালন করা বা অন্য কোনো পন্থায় এর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা বা একে নিয়ে আনন্দ-উৎসব পালন করা ইসলামসম্মত নয়।

অন্য ধর্মের পূজনীয় বস্ত্ত হওয়ায় শিখা চিরন্তন বা অন্য কোনো নামে অগ্নিকে শ্রদ্ধা জানাবার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা ইসলামের তাওহীদের চেতনা ও বৈশিষ্ট্যের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এ জাতীয় প্রয়াস জাতিকে পৌত্তলিকতার দিকেও ঠেলে দিবে।

শহীদ মিনারকেন্দ্রিক আচার-অনুষ্ঠান

একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপনে যারা অংশগ্রহণ করেন তাদের প্রায় নববই শতাংশ মুসলমান। কিন্তু এ দিবস উদযাপন উপলক্ষে যা করা হয় তা মুসলমানদের আকিদা-বিশ্বাসের সাথে কতটুকু সঙ্গতিপূর্ণ, তা ভেবে দেখার প্রয়োজন আছে। শহীদ মিনারকেন্দ্রিক অনুষ্ঠানের অনেক কিছুরই মিল আছে হিন্দুদের পূজা-পার্বণের সাথে। কয়েকটি উদাহরণ দিচ্ছি :

১. হিন্দু দেবদেবীর প্রতিমাকে যে উঁচু স্থানে স্থাপন করা হয় সে স্থানকে বলা হয় বেদী, শহীদ মিনারের পদমূলকেও বলা হয় বেদী। বেদী শব্দটির অর্থ ‘হিন্দুদের যজ্ঞ বা পূজার জন্য প্রস্ত্তত উচ্চভূমি।’ (সংক্ষিপ্ত বাংলা অভিধান, বাংলা একাডেমী)  শিরক

২. প্রতিমা বা মূর্তির বেদীমূলকে পবিত্র মনে করা হয়, তাই সেখানে যেতে হয় নগ্নপদে। শহীদ মিনারের মূলকেও পবিত্র মনে করার কারণেই সেখানে নগ্নপদে যেতে হয়।

৩. লক্ষ্মীপূজার সময় আলপনা আঁকা হয়। শহীদ মিনারের পদমূলে যাবার পথেও আলপনা আঁকা হয়। আলপনা অর্থ ‘মেঝে, দেয়াল, সিঁড়ি প্রভৃতিতে অঙ্কিত হিন্দুদের মঙ্গলসূচক চিত্রবিশেষ’। (সংক্ষিপ্ত বাংলা অভিধান, বাংলা একাডেমী)

৪. হিন্দু দেবদেবীর পূজার সময় কয়েকটি বিষয় অপরিহার্য। এগুলো হল : লগ্ন, অর্ঘ্য বা নৈবেদ্য, স্তব বা স্ত্ততি, পুরোহিত, দেবতা ও অর্চনা। এসবের সাথেও একুশে ফেব্রুয়ারির আচার-আচরণের সাদৃশ্য আছে। যেমন, অনুষ্ঠান জিরো আওয়ারে শুরু করা (লগ্ন), অনুষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্বে থাকেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি (পুরোহিত), নির্দিষ্টভাবে আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো … ’ গান গেয়ে কাজ করা (স্তব/স্ত্ততি), শহীদ মিনার (জড়পদার্থ)-কে নীরবে শ্রদ্ধা জানানো (অর্চনা)।

৫. দূর্গাপূজার সময় দেখা যায়, দূর্গার মূর্তির পাশে রয়েছে আরো চারটি (দূর্গার পুত্র গণেষ ও কার্তিক এবং কন্যা সরস্বতী ও লক্ষ্মীর) মূর্তি। এভাবে সব মিলে মূর্তির সংখ্যা হয়েছে পাঁচ। শহীদ মিনারেও মিনারগুলোর সংখ্যা পাঁচ। মিনারের সংখ্যা পাঁচ হওয়ার কারণ কী? ভাষা শহীদদের সংখ্যা কি পাঁচ ছিল? আবার মধ্যবর্তী মিনারটির আকার অন্যদের তুলনায় বড় কেন? এ প্রশ্নগুলোর জবাব পাওয়া দরকার।

মুসলিম-সমাজে রীতি আছে, মৃত বা শহীদ মুসলমানের মাগফেরাতের জন্য দুআর অনুষ্ঠান করা। কিন্তু ভাষা শহীদদের জন্য তাও করা হয় না; যা করা হয় তার সাথে ইসলামের রীতির মিল নেই। হিন্দুরা প্রতিমা-পূজার পক্ষে এ যুক্তি পেশ করেন যে, দেবতা পূজারীদের নাগালের ভেতর নেই, তাই তার প্রতিমার মাধ্যমে তাঁকে পূজা দেওয়া হয়। শহীদ মিনারের বেলায়ও এ বিশ্বাস করা হয় যে, শহীদ মিনারকে সম্মান দেখানো ভাষা শহীদদেরকে শ্রদ্ধা করার সমতুল্য।

শহীদ মিনারকেন্দ্রিক আচার-অনুষ্ঠানকে গভীরভাবে পর্যালোচনা করে দেখার দরকার আছে। ভাষা শহীদরা সবাই ছিলেন মুসলমান। কাজেই তাদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে আমরা এমন কিছু করতে পারি না যা ইসলামী চেতনার সাথে সাংঘর্ষিক। তাছাড়া কোনো মুসলমানই তাওহীদ-বিরোধী কোনো কাজ করতে পারে না।


এটা পড়ুন – ইসলামের দৃষ্টিতে মূর্তি ও ভাস্কর্যের বিধান


আলপনা আঁকা

ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে, আলপনা শব্দটির অর্থ, সিঁড়ি প্রভৃতিতে অঙ্কিত হিন্দুদের মঙ্গলসূচক চিত্রবিশেষ। আজকাল শিক্ষিত ও ধনী মুসলমান পরিবারের প্রায় বাড়িতে বিয়ে-শাদি উপলক্ষে আলপনা আঁকা হয়। আর শহীদ দিবস উদযাপন উপলক্ষে শহীদ মিনার ও আশপাশ এলাকার পথেঘাটে ব্যাপক আকারে যে আলপনা আঁকা হয়, তা আমাদের সবার জানা কথা।

আলপনা আঁকা হিন্দুদের একটি ধর্মীয় বিষয়। নিজেদের অজান্তে অনেকে হিন্দু দেবীর উপাসনার অনুষঙ্গ এ কাজটি করে যাচ্ছেন। বিষয়টি সম্পর্কে সঠিক ধারণা থাকা দরকার।

‘‘হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্যতম একটি ধর্মীয় উৎসব লক্ষ্মীপূজা। শারদীয় দূর্গার বিজয়া দশমীর পরের পূর্ণিমা তিথিতে লক্ষ্মীপূজা করা হয়। দেবী দূর্গার কন্যা এবং ধন ও ঐশ্বর্যের দেবী লক্ষ্মীর পূজা হয় মূলত ঘরে ঘরে। হিন্দু নারীরা উপবাস থেকে দেবীর প্রতি অর্ঘ্য নিবেদন করেন। সরা এবং প্রতিমা দিয়ে পূজা সম্পন্ন করার পাশাপাশি বাড়ির আঙিনা ও ঘরের মেঝেতে লক্ষ্মীর পায়ের ছাপ ও ধানের ছড়ার আলপনা আঁকাও এই পূজার অন্যতম অনুষঙ্গ। পারিবারিক ধন-সম্পদ অর্জন করার মানসে লক্ষ্মীর পূজা করা হয়। লক্ষ্মীর সঙ্গে থাকে তাঁর লক্ষ্মীপেঁচা। তাই লক্ষ্মীপূজা উপলক্ষে ঘরে ঘরে প্রদীপ জ্বালানো হয়।’’ (প্রথম আলো, ১৬-১০-২০০৮)

ভাষ্কর্য

দেশ স্বাধীন হওয়ার সাথে সাথে এখানে সেখানে নির্মাণ করা হচ্ছে ভাষ্কর্য নামক মানুষের মূর্তি। কোনো সাধারণ লোকের নয়, বরং যারা সম্মানীয়, বরণীয় ব্যক্তি কেবল তাদেরই ভাষ্কর্য বা প্রতিকৃতি নির্মাণ করা হয়। কাজটির মূলে যে অনুভূতি রয়েছে, তা হল শ্রদ্ধাবোধ। এক সাথে একাধিক ব্যক্তির ভাষ্কর্য (অপরাজেয় বাংলা) নির্মাণের মূলেও রয়েছে শ্রদ্ধামিশ্রিত এক বিশেষ অনুভূতি। কাজেই, হিন্দু দেবদেবীর মূর্তি এবং ভাষ্কর্য নির্মাণের উদ্দেশ্য মূলত এক। আর তা হচ্ছে শ্রদ্ধা জানানো। এ কারণেই ভাষ্কর্য নির্মাণ এবং এটাকে ফুলের তোড়া দিয়ে বা অন্য কোনোভাবে শ্রদ্ধা জানানো আর মূর্তিপূজার মাঝে সাদৃশ্য রয়েছে। এ কারণে এ ব্যাপারে সচেতনতার প্রয়োজন।

প্রসঙ্গক্রমে একটি প্রশ্ন করা স্বাভাবিক। যে ঢাকা শহর হাজার বছর থেকে ‘মসজিদের নগরী’ নামে পরিচিত ছিল, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর হঠাৎ করে সেখানে শত শত ভাষ্কর্য বা মূর্তি নির্মাণ করার কারণ কী? এগুলো কারা করছে, কারা এগুলো নির্মাণের অর্থ যোগাচ্ছে আর কারা এ কাজের প্রেরণা দিচ্ছে, জানার দরকার আছে।

কপালে টিপ দেওয়া

প্রাচীন কালে হিন্দুধর্মে বিবাহের আটটি পদ্ধতির একটি ছিল নারী অপহরণ। হিন্দু দেবতা কৃষ্ণও কয়েকজন নারীকে অপহরণের মাধ্যমে বিয়ে করেছিলেন। প্রাচীনকাল থেকে বিবাহিত হিন্দু নারীদের সিঁথিতে সিঁদুর দেওয়ার উদ্দেশ্য ছিল এটা বোঝানো যে, তার বিবাহ হয়ে গিয়েছে। সিঁথিতে সিঁদুর থাকলে কোনো নারীর অপহৃত হওয়ার ভয় থাকত না। হিন্দু এ সংস্কৃতির অনুকরণে আজকাল মুসলমান নারীরা কপালে টিপ দিতে শুরু করেছে। মনে করা হয়, এটা সৌন্দর্যের প্রতীক। কিন্তু আসলে এটা হচ্ছে পৌত্তলিক সংস্কৃতিকে বরণ করে নেওয়া। কপাল হচ্ছে দেহের শ্রেষ্ঠ অংশ, যা দিয়ে আল্লাহ তাআলাকে সিজদা করা হয়। আফসোসের বিষয়, অনেক মুসলিম নারীর দেহের এ অংশটিকে পৌত্তলিক সংস্কৃতি দখল করে নিয়েছে।

আবার না টিপ দেওয়ার এটাও কারণ–

হযরত ইবরাহীম আঃ কে যখন আগুনে পুড়িয়ে মারার জন্য নমরুদ ৮ মাইলপরিমান জায়গা আগুন জ্বালালো , তখন একটা নতুন সমস্যা দেখা দিল। আগুনের উত্তাপ এতই বেশি ছিল যে তার কাছে পৌছানো যাচ্ছিল না। তাই একটা চরক বানানো হল যার মাধ্যমে ইবরাহীম (আঃ) কে ছুড়ে আগুনে নিক্ষেপ করা যায়। কিন্তু রহমতের ফেরেশতা রা চরকের একপাশে ভর করে থাকায় চরক ঘুরানো যাচ্ছিল না।

তখন শয়তান নমরুদকে কুবুদ্ধি দিল কিছু নগ্ন মেয়ে(পতিতা) এনে চরকের সামনে বসিয়ে দিতে, কারন এ অবস্থায় ফেরেশতারা থাকতে পারবে না। তাই করা হল এবং ফেরেশতারা চলে গেল, ইবরাহীম (আঃ) কে আগুনে নিক্ষেপ করতে তারা সক্ষম হলেন। পরবর্তিতে ঐ মেয়েগুলোকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দান করা হল এবং তাদের মাথায় তীলক পরানো হল।

যেটা এখন আমাদের কাছে টিপ নামে পরিচিত। অতএব যারা বলে— মহিলাদের সৌন্দর্য সব জায়গায় এবং এই দোহাই দিয়ে টিপ কে নিজেদের জন্য বৈধ মনে করেন, তারা যুগযুগ ধরে নিজেদের কোন পরিচয় বহন করছেন তা একবার ভেবে দেখবেন ? পতিতার পরিচয় বোঝানোর জন্য যে টিপ ব্যবহার করা হত, তা আজ আমাদের উপমহাদেশে ফ্যাশন! ওহে! মুসলিম নারীরা, এই সত্য কথাটা জানার পর ও কি আপনি আপনাদের কপালে টিপ পড়বেন?

সূত্রঃ

* তাফসীরে মা-রেফুল কুরআন, হযরত ইবরাহিম (আঃ) মূলগ্রন্থ।

* তাবারী, তারীখ, ১খ, ১২৩-১২৪; ছালাবী

* আদি গ্রন্থ, কাসাসুল আম্বিয়া, পৃষ্ঠাঃ ৮১, আদি ইসলামী ইতিহাস

রাখিবন্ধন

হিন্দু সম্প্রদায় শ্রাবণ মাসের পূর্ণিমায় প্রিয়জনের মণিবন্ধে একটি গেরুয়া সুতো বেঁধে দেয়। এ সুতোকে বলা হয় মঙ্গল-সূত্র। সূতো-বাধার কাজকেই বলা হয় রাখিবন্ধন। এটা একটা হিন্দু-সংস্কৃতি। কিন্তু নিজেদের হীনম্মন্যতার কারণে একশ্রেণীর লোক আমাদের দেশে রাখিবন্ধনের প্রচলন করেছে। আজকাল অনেক মুসলিম তরুণকে অতি উৎসাহের সাথে এ কাজটি করতে দেখা যায়। ( শিরক )

হিন্দু দেবদেবীর নামে নামকরণ

হিন্দু ধর্মশাস্ত্রের বিভিন্ন নাম এমনকি দেবদেবীর নামেও আজকাল বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নাম রাখা হয়। উদাহরণস্বরূপ, মুসলমানদের বহু ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের নামের অংশ হিসেবে ‘শতরূপা’ (সরস্বতীর নাম) শব্দটি দেখা যায়। শব্দটির আসল অর্থ বা ঐতিহাসিক তাৎপর্য সম্পর্কে কিছু জানা না থাকায় হয়ত কেউ কেউ নিজেদের ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের জন্য এ নাম মনোনীত করেছেন। কয়েকটি উদাহরণ দিচ্ছি : শতরূপা টেক্সটাইলস, রাজলক্ষ্মী রেস্টুরেন্ট, ইন্দ্রপুরী হোটেল। শুধু প্রতিষ্ঠানের নাম নয়, আজকাল অনেকেই অতি বাঙালিত্ব দেখাতে গিয়ে ছেলেমেয়েদের এমন সব নাম রাখেন যেগুলো কেবল হিন্দুরাই রাখতে পারে। কেউ কেউ আবার আসল মুসলমানি নাম বাদ দিয়ে নিজের জন্য হিন্দু নাম রাখেন। এ প্রসঙ্গে কবি সমুদ্রগুপ্তকে উল্লেখ করা যায়। তিনি যে মুসলিম ছিলেন তা অনেকেই জানতেন না। ২০০৮ সালে তাঁর মৃত্যুর পরই জানা গেল তাঁর আসল নাম ছিল আবদুল মান্নান বাদশা। এ তথ্য জানা না থাকার কারণে তাঁর গুণগ্রাহী অনেকেই তাঁর মৃত্যুসংবাদ শুনে ‘ইন্না লিল্লাহ’ পড়েননি।

পবিত্র কুরআনের সাথে অন্যান্য ধর্মশাস্ত্র পাঠ

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রথমবারের মতো বেতারে পবিত্র কুরআন তিলাওয়াতের সাথে গীতা, বাইবেল ও ত্রিপিটক থেকে পাঠ করার নিয়ম চালু হয়েছিল। এ কাজের যৌক্তিকতা হিসেবে বলা হতো, বাংলাদেশ যে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র, তা দেখানোই এর উদ্দেশ্য। পরে রাষ্ট্রীয় নানা অনুষ্ঠানেও পবিত্র কুরআনের সাথে এসব ধর্মগ্রন্থ থেকে পাঠ করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের সভায়ও এ নিয়ম চালু করা হয়েছে।

যারা এ কাজ করেন তাদের জানা থাকা দরকার যে, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ হচ্ছে একটি কুফরী মতবাদ। তাছাড়া এ কাজের মাধ্যমে পবিত্র কুরআনকে অন্যান্য ধর্মগ্রন্থের সমপর্যায়ভুক্ত করা হয়। এ ধরনের কাজের ফলে আমাদের সরলমনা তরুণদের মনে এ ধারণা জন্মাতে পারে যে পবিত্র কুরআন অন্যান্য ধর্মশাস্ত্রের মতোই একটি গ্রন্থ। এভাবে তাদের মন থেকে কুরআনের প্রতি বিশেষ মর্যাদাবোধ দূর হয়ে যেতে পারে। এটা বোঝা দরকার যে, ধর্মীয় ব্যাপারে অন্যান্য ধর্মের সাথে ইসলামকে সমপর্যায়ভুক্ত করা করা হলে ঈমান থাকার কথা নয়। ( শিরক )

মসজিদ ও মন্দিরে ‘সমতা’ বিধানের চেষ্টা

সরকারি পর্যায়ে আজকাল এমন সব কাজ করা হয় যা দেখে মনে করার কারণ আছে যে, মসজিদ ও মন্দিরের মধ্যকার পার্থক্য সম্বন্ধে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঠিক ধারণা নেই। তারা মনে করেন, মসজিদের জন্য কিছু করতে হলে মন্দিরের জন্যও তা করতে হবে। আসলে ধর্মনিরপেক্ষতার নামে এটা বাড়াবাড়ি ছাড়া কিছুই নয়। মসজিদকেন্দ্রিক কোনো প্রকল্প হাতে নিলে মন্দিরের ব্যাপারেও যে তা করতে হবে, তা মোটেই ঠিক নয়।

মসজিদ ও মন্দির এক নয়; দু’ টোর মধ্যে পার্থক্য অনেক। মুসলমান পুরুষদের প্রতিদিন পাঁচবার ফরয নামায আদায় করার জন্য মসজিদে যেতে হয়। মন্দিরের ব্যাপারটি কিন্তু ভিন্ন। কোনো কোনো মন্দিরে বছরে মাত্র একবার পূজা হয়। আবার এমন বহু মন্দির আছে যেখানে বছরে একবারও কেউ যায় না।

ইসলামের মৌলিক শিক্ষা লাভ করা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য ফরয। হিন্দু ধর্মে কিন্তু এ ধরনের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। জাতিভেদভিত্তিক হিন্দুধর্মের অনুসারীরা একসাথে বসার কোনো সুযোগ নেই। তাদের অনেকেরই মন্দিরে প্রবেশের অধিকার নেই। এসব কারণে, মুসলমান শিশুদের জন্য মসজিদভিত্তিক শিক্ষাকার্যক্রম গ্রহণ করলেই যে মন্দিরের বেলায়ও তা করতে হবে এমন কোনো কথা নয়। কিন্তু এখন এমনটাই করা হচ্ছে।

ভারতের কোনো মন্দিরেই মন্দিরভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রম নেই। কারণ জাতিভেদভিত্তিক হিন্দুধর্মের সাথে এটা সঙ্গতিপূর্ণ নয়। হিন্দু সম্প্রদায়ের বৃহত্তর অংশই হচ্ছে কথিত নিম্নবর্ণের লোক। নিচ জাতের লোক (?) হওয়ার কারণে তারা মন্দিরের ধারে কাছেও যেতে পারে না। কাজেই, মসজিদের সাথে ‘সমতা’ বিধানের চেষ্টা খোদ হিন্দুদের ধর্ম-বিশ্বাসের সাথে সাংঘর্ষিক।

প্রতিকৃতি ও মাজারকেন্দ্রিক অনুষ্ঠান

আমাদের দেশে পীর-আউলিয়াদের মাজারে বাতি জ্বালানো প্রভৃতি কাজকে হক্কানি আলিমগণ বিদআত বলে থাকেন। কেবল যিয়ারত ছাড়া মৃত ব্যক্তির কবরে গিয়ে আর কিছু করার বিধান ইসলামে নেই। মরহুম শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মরহুম এ.কে ফজলুল হক ও মরহুম খাজা নাজিমুদ্দীন ঢাকা শহরেই শায়িত আছেন। তাঁদের অনেক ভক্তও দেশে আছেন। কিন্তু বছরে একবারও তাঁদের মাজারে গিয়ে ফুল দিতে কাউকে দেখা যায় না। কিন্তু মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান ও মরহুম জিয়াউর রহমানের মাজার একটি ব্যতিক্রম। শুধু তাদের জন্ম ও মৃত্যু দিবসে নয়, বছরের আরো বহু দিন দলীয়ভাবে বা ব্যক্তিগত আনুগত্য প্রকাশের জন্য এঁদের মাজারে গিয়ে ফুলের তোড়া দেওয়া হয় এবং আরো অনেক কাজ করা হয়।

প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের অতি সম্মানিত জাতীয় নেতাদের জন্য এমন কিছু কেন করা হয় না, যার দ্বারা তাঁদের পরকালীন কল্যাণ হতে পারে। আর যা করা হয়, তা কি শরীয়তসম্মত? একজন মৃত ব্যক্তির জন্য তো কেবল এমন কাজ করা উচিত যা ইসলামী অনুশাসনের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। ইতিহাসে দেখা যায়, মৃত ব্যক্তির প্রতি ভক্তি দেখাতে গিয়ে অতি বাড়াবাড়ির পথ ধরেই পৃথিবীতে মূর্তিপূজা শুরু হয়েছে।

মৃত ব্যক্তির কফিনে ফুল দেওয়া

আজকাল প্রায়ই কোনো বিশিষ্ট লোক মারা গেলে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে তার কফিনে ফুলের তোড়া দেওয়া হয়। এটা একটা অর্থহীন কাজ। এ ধরনের কোনো প্রথা কিছুদিন আগেও এদেশে ছিল না। এটা বর্জনীয়। কারণ ১. এটা একটা বিজাতীয় কালচার। ২. এতে মৃত ব্যক্তির কোনো কল্যাণ হয় না এবং ৩. মৃত ব্যক্তিকে যথাসম্ভব শীঘ্র দাফন করার যে নির্দেশ ইসলামে রয়েছে এতে তা লঙ্ঘিত হয়। ( শিরক )

মৃত ব্যক্তির সম্মানে নীরবতা পালন

আজকাল দেখা যায়, কোনো মৃত ব্যক্তির প্রতি সম্মান দেখাবার জন্য কিছু সময় নীরবতা পালন করা হয়। এটা অমুসলমানদের রীতি। মৃত ব্যক্তির কল্যাণে কিছু করার বিধান তাদের ধর্মে না থাকার কারণেই তারা এ কাজ করে থাকে। একজন মৃত ব্যক্তির জন্য কী করতে হবে তার সুস্পষ্ট বিধান ইসলাম দিয়েছে। কাজেই এ ব্যাপারে বিধর্মীদের অনুকরণ করা হীনম্মন্যতারই শামিল।

উপসংহার

ইসলাম এমন একটি দ্বীন, যাতে রয়েছে পরিপূর্ণ জীবনবিধান। মানুষের জীবনে যা কিছুর প্রয়োজন, তা সবই ইসলামে আছে, এতে কোনো অপূর্ণতা নেই। অন্য ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় বা নিদর্শনমূলক আচার-আচরণ অনুসরণ করার সুযোগ ইসলামে নেই। বিধর্মীদের অনুসরণ একজন মুসলমানকে বিপথে নিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা অনেক। এজন্য এ থেকে আমাদের সাবধান করে দেওয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআন ও হাদীস শরীফ থেকে দুটো উদ্ধৃতি দিচ্ছি। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, (তরজমা) কারো নিকট সৎপথ প্রকাশ হওয়ার পর সে যদি রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ করে এবং মুমিনদের পথ ব্যতীত অন্য পথ অনুসরণ করে, তবে যে দিকে সে ফিরে যায় সেদিকেই তাকে ফিরিয়ে দেব এবং জাহান্নামে তাকে দগ্ধ করব। আর তা কতই না মন্দ নিবাস। (সূরা নিসা ৪ : ১১৫)

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হাদীসেও এ ব্যাপারে সাবধানবাণী এসেছে। তিনি বলেছেন, যে কেউ কোনো কওমের সাদৃশ্য গ্রহণ করে, সে তাদের অন্তর্ভুক্ত হয়। (সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ৪০৩৩)

সবুজ পোষাকের বীরাঙ্গনা ও ভিখারি শাহজাদা

মূল: খাজা হাসান নিজামী অনুবাদ: ইমরান রাইহান
(খাজা হাসান নিজামির জন্ম দিল্লীতে, ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে। জন্মের পর তার নাম রাখা হয় আলী হাসান নিজামি। তবে পরে তিনি খাজা হাসান নিজামি নামেই প্রসিদ্ধি অর্জন করেন। তিনি ছিলেন একাধারে সুফী দার্শনিক, কবি, ঐতিহাসিক, সম্পাদক ও সাহিত্যিক। তার শিক্ষকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন, মাওলানা ইসমাইল কান্ধলভী, মুফতি এলাহি বখশ কান্ধলভী, মুফতি রশিদ আহমদ গাংগুহি। খাজা হাসান নিজামির বাল্যকাল কেটেছে ভাগ্যবিড়ম্বিত মুঘল শাহজাদাদের সাথে। তিনি আগ্রহী হয়ে উঠেন ১৮৫৭ সালের ইতিহাস জানতে। ভাগ্যবিড়ম্বিত মুঘলদের নিয়ে রচিত তার সবচেয়ে বিখ্যাত গ্রন্থ বেগমাত কে আসু প্রকাশিত হলে হৈ চৈ পড়ে যায়। ১৯৪৪ সালে লেখকের জীবদ্দশাতেই বইটির ত্রয়োদশ সংস্করণ প্রকাশিত হয়। তার উল্লেখযোগ্য অন্যান্য গ্রন্থ ফাতেমি দাওয়াতে ইসলাম, ইংরেজো কি পিতা , বাহাদুর শাহ কা মুকাদ্দামা, দিহলি কি জাঁ কুনি, দিহলি কি সাজা। ৩১ জুলাই ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি দিল্লীতে ইন্তেকাল করেন।)

সবুজ পোষাকের বীরাঙ্গনা

(১)

দিল্লীর যেসকল বৃদ্ধ ১৮৫৭ তে যুবক ছিলেন তারা এক সবুজ পোষাক পরিহিতা রমনীর গল্প করেন। বিদ্রোহের সময়টায় ইংরেজ বাহিনী টিলার উপর ক্যাম্প করেছিল। কাশ্মিরী দরজার দিক থেকে তারা শহরের বাজারে গুলি চালাতো। সেসময় সবুজ পোষাক পরিহিতা এক বৃদ্ধা মহিলা শহরের বাজারে গিয়ে উচ্চস্বরে বলতেন, চলো, আল্লাহ তোমাদের জান্নাতে ডেকেছেন।

তার কথা শুনে অনেকেই তার সাথে একত্রিত হতো। মহিলা সবাইকে নিয়ে কাশ্মিরী দরজার দিকে যেতো এবং ইংরেজদের উপর হামলা চালাতো। সকাল থেকে সন্ধ্যা যুদ্ধ চলতো।

যারা স্বচক্ষে এই লড়াই দেখেছে তারা বলে, এই নারী ছিল অসম সাহসী ও নির্ভিক। মৃত্যুর ভয় তার ছিলই না। গুলিবৃষ্টির মধ্যেও সে সাহসি সিপাহিদের মতো সামনে এগিয়ে যেত। কখনো পায়ে হেটে, কখনো ঘোড়ায় চড়ে। তার হাতে থাকতো একটি বন্দুক, তলোয়ার ও একটি পতাকা। বন্দুক চালানোয় তার বেশ দক্ষতা ছিল। তার সাথে চলেছে এমন একজনের ভাষ্যমতে তলোয়ার চালানোতেও সে দক্ষ ছিল।

অনেকবার সে সেনাদের সাথে তলোয়ার নিয়ে সামনাসামনি লড়েছে। এই নারীর বীরত্ব ও সাহসিকতা দেখে শহরবাসী উদ্দিপ্ত হতো এবং তারাও এগিয়ে এসে লড়াই করতো। তবে যেহেতু কারোই যুদ্ধের অভিজ্ঞতা ছিল না তাই প্রায়ই তাদের পালাতে হতো। তারা পালাতে চাইলে এই নারী তাদের বাধা দিতো কিন্তু শেষে তাকেও সরতে হতো। কেউ জানতো না এই মহিলা কোথেকে আসে আর কোথায় যায়।

এভাবে একদিন এমন হল যে সে উত্তেজনার চোটে আক্রমন চালাতে চালাতে ইংরেজদের ঘাটি পর্যন্ত পৌছে গেল। এক পর্যায়ে আঘাত পেয়ে সে ঘোড়া থেকে পরে যায়। সেনারা তাকে গ্রেফতার করে। তারপর তার কোনো হদিশ মেলেনি। কেউ জানে না তার কী হয়েছে।

সম্প্রতি দিল্লী সরকার কিছু ইংরেজি পত্র প্রকাশ করেছে যা দিল্লী অবরোধের সময় ইংরেজ অফিসাররা লিখেছিল। এর মধ্যে একটি চিঠি আছে যার লেখক লেফট্যান্যাট উইলিয়াম হাডসন। দিল্লী ক্যাম্প থেকে ২৯ জুলাই ১৮৫৭ তারিখে লিখিত এই চিঠি পাঠানো হয়েছিল আম্বালার ডেপুটি কমিশনার মিস্টার যে গিলসন ফরসাইথের কাছে। সেই চিঠিতে এই বৃদ্ধা সম্পর্কে কিছু তথ্য আছে।চিঠির ভাষ্য নিম্মরুপ-

‘প্রিয় ফরসাইথ। আপনার কাছে একজন মুসলমান বৃদ্ধাকে পাঠাচ্ছি। অদ্ভুত এই নারী। সবুজ জামা গায়ে দিয়ে লোকদের উত্তেজিত করতো এবং নিজেই তাদের নেতৃত্ব দিয়ে আমাদের উপর আক্রমন করতো। যেসব সেনারা তার সাথে লড়াই করেছে তাদের ভাষ্যমতে সে খুবই সাহসী, অস্ত্র চালনায় পারদর্শী এবং সে একাই ৫ পুরুষের সমান শক্তি রাখে। যেদিন তাকে গ্রেফতার করা হয় সেদিন সে ঘোড়ায় চড়ে বিদ্রোহীদের নিয়ে ফৌজি কায়দায় লড়ছিল। তার বন্দুক দিয়ে সে আমাদের অনেককে গুলি করে। অনেকে হতাহত হয়। পরে তার সাথিরা পালিয়ে যায় এবং সে আহত অবস্থায় গ্রেফতার হয়। জেনারেলের সামনে তাকে আনা হলে তিনি সাধারণ নারী ভেবে তাকে মুক্তি দেয়ার আদেশ দেন। আমি জেনারেলকে বুঝিয়ে বলি একে মুক্তি দিলে সে আমাদের জন্য নতুন সমস্যার সৃষ্টি করবে। সে শহরে ফিরে গেলে অন্ধ বিশ্বাসে আচ্ছন্ন লোকেরা একে কোনো অলৌকিক ঘটনা মনে করবে। ফলে ফ্রান্সের সেই মহিলার মতো জটিলতা দেখা দিবে। (১) জেনারেল সাহেব আমার কথা মেনে নিলেন এবং তাকে বন্দী করার আদেশ দিলেন। মহিলাকে আপনার কাছে পাঠানো হচ্ছে। আপনি একে বন্দী করবেন এবং পাহারায় রাখবেন। — ইতি হাডসন

(২) দিল্লীর লোকমুখে প্রচলিত গল্পগুলোতে এই মহিলার উল্লেখ আছে। হাডসনের চিঠি থেকেও এই ঘটনার সত্যতা মেলে। কিন্তু এ থেকে মহিলার বিস্তারিত পরিচয় জানা জায় না। আমি বহুদিন ধরে চেষ্টা করেছি এই মহিলার প্রকৃত পরিচয় জানতে। কিন্তু কেউই তার সম্পর্কে বিস্তারিত জানে না। যারা তাকে দেখেছে, তারাও শুধু তাকে লোক সমাগম করতে ও ইংরেজদের সাথে লড়তেই দেখতো। সে কে? কোথায় থাকে , কোথায় যায় এসব তথ্য তাদেরও অজানা। পরে একজনের কাছে আমি একটা গল্প শুনি। তার গল্পের সাথে সবুজ পোষাকের বীরংগনার মিল পাওয়া যায়।

আমাকে এই ঘটনা শুনিয়েছেন রিয়াসত টুংকের এক লোক। তার পিতা ছিলেন হাজি লাল মুহাম্মদ চিশতি নিজামির মুরিদ। হাজি লাল মুহাম্মদ ছিলেন হযরত ফখরুদ্দিন চিশতি নিজামি দেহলভির খলিফা। তার কবর নিজামুদ্দিন আউলিয়ার মাজারের পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত।
টুংকের সেই লোক আমাকে বলেছেন,

‘আমার পিতা আজমীর শরিফে হাজি লাল মুহাম্মদের কাছে বায়াত হন। তখন পাশে এক মাযজুব ধরনের মহিলাও বসা ছিল। মহিলা বারবার হাজি সাহেবকে বলছিল, আমার জন্য দোয়া করবেন আমি যেন শহীদ হতে পারি। তার কথাবার্তা ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু চলাফেরায় তাকে খানিকটা উদভ্রান্ত মনে হতো। হাজি সাহেব কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলেন, যাও নফসের সাথে লড়াই কর। এটাও জিহাদ। মহিলা বললো, নফস কি আমাকে শহীদ করতে পারবে? বা আমি নফসকে হত্যা করতে পারবো? এই কথা শুনে হাজি লাল মুহাম্মদ মুচকি হাসেন। একটু পর তিনি বলেন, মেহেদির পাতা সবুজ কিন্তু ভেতরে লাল। যাও সবুজ ধারণ করে লাল হও।

উপস্থিত কেউই হাজি সাহেবের এই কথা বুঝেনি। কিন্তু মহিলা খুব খুশি হয়। বারবার হাজি সাহেবের শুকরিয়া আদায় করে চলে যায়। তার চেহারা দেখে মনে হচ্ছিল সে যা চাইতে এসেছে তা পেয়ে গেছে। কয়েক মাস পর আমার বাবা এই মহিলাকে দরগাহে খাজা কুতুব সাহেবে দেখেন। মহিলা সেখানে হযরত ফখর সাহেবের মাজারের পাশে বসে মুরাকাবা করছিল। তার মুরাকাবা শেষ হলে পিতা জিজ্ঞাসা করেন, ‘তোমাকে আজমির শরিফে দেখেছি মনে হচ্ছে। মহিলা জবাব দেয়, হ্যা। আমিই সেই মহিলা। তোমার পীর বোন’। এরপর পিতা তাকে তার পরিচয় জিজ্ঞাসা করলে মহিলা নিজের পরিচয় দেয়।

(৩) আমার দাদা ছিলেন আহমদ শাহ আবদালীর সেনাবাহিনীর সর্দার। পানিপথে মারাঠাদের সাথে আবদালীর যে লড়াই হয় দাদা তাতে উপস্থিত ছিলেন। সেই লড়াইয়েই তিনি শহীদ হন। আমার বাবাও আবদালীর বাহিনীতে ছিলেন। তবে সেসময় তার বয়স কম ছিল। যুদ্ধের পর তিনি তার মায়ের সাথে কিছুদিন লাহোর থাকেন। পরে ভাওয়ালপুর গিয়ে একটি চাকুরি নেন। সেখানেই বিবাহ করেন। সেখানে আমার দুই ভাই হয় কিন্তু তারা অল্পবয়সেই মারা যায়। এরপর আমার জন্ম হয়। আমার বাল্যকাল কাটে ভাওয়ালপুরেই। এরপর বাবামার সাথে জয়পুর চলে আসি। বাবা এখানে নতুন একটি চাকরি নেন। বাবা এখানেই মারা যান। রাজার এক মুসলমান কর্মচারীর সাথে আমার বিবাহ হয়। কিছুদিন পর আমার স্বামী খুব অসুস্থ হয়ে যায়। চিকিতসক তার বাচার আশা ছেড়ে দেন। একরাতে আমি তার পাশে বসে কাদছিলাম।

দোয়া করছিলাম, হে আল্লাহ আমার স্বামীকে সুস্থ করে দেন। একটু পর আমার ঘুম আসে। ঘুমের ভেতর স্বপ্নে দেখি চারপাশে আগুন লেগে গেছে। লোকজন আগুন নিভাতে পানি ঢালছে কিন্তু সেই পানিও আগুন হয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে একপাশ থেকে এক সৌম্যদর্শন বৃদ্ধকে এগিয়ে আসতে দেখা যায়। তিনি আমাকে বলেন, তুমি শহীদ হয়ে যাও। আমি বলি কীভাবে শহীদ হবো। তিনি আমার গায়ে একটি সবুজ চাদর পরিয়ে দেন। আমি চাদর পরতেই চারপাশ থেকে শব্দ আসে সে শহীদ, সে শহীদ। আমার ঘুম ভেংগে যায়। এর কিছুক্ষণ পরেই আমার স্বামী ইন্তেকাল করেন। স্বামীর মৃত্যুতে আমি খুব কষ্ট পাই। এরপর আমি আজমির শরিফ যাই এবং হাজি লাল মুহাম্মদ সাহেবের কাছে বায়াত হই। এখন আমি একা থাকি। বাবা মা আগেই মারা গেছেন। আমার বিশ্বাস স্বপ্নে যাকে দেখেছি তিনি খাজা আজমেরি। তিনি আমাকে দেখা দিয়েছেন। তিনি আমাকে শহিদ হতে বলেছেন। এখন আমি দিল্লীতে বেড়াতে এসেছি। বেশিরভাগ সময় দাদা পীরের ( হযরত ফখর সাহেব) মাজারের পাশেই কাটাই। পরশু দিন দাদাপীরকে স্বপ্নে দেখেছি। তিনিও আমাকে বলেছেন তুমি সবুজ পোষাকের শহীদ। টুংকের সেই লোক বলেন, মহিলার কথা শুনে বাবা চলে আসেন। এর কিছুদিন পর বিদ্রোহ শুরু হয়। এই ঘটনা থেকে মনে হয় বিদ্রোহের সময় এই মহিলাই লোক জড় করে ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়তেন।

(৪) এই গল্প শুনে আমি ভাবতে থাকি। টুংকের লোক যার কথা বলেছে সেই কী দিল্লীর এই লড়াকু নারী? সেই মহিলার কথা অনুযায়ী তার দাদা যদিও আবদালির সেনাবাহিনীতে ছিলেন কিন্তু তার পিতা সারাজীবন অন্যের চাকুরি করে জীবন কাটিয়েছেন। মহিলাও জীবনে কোথাও বন্দুক চালনা কিংবা তলোয়ারবাজী শিখেছে এমন বর্ননা নেই। এমন একজন মহিলার পক্ষে লোক জড় করে সামরিক কায়দায় ইংরেজদের মোকাবেলা করা অনেকটাই অসম্ভব। অবশ্য এও হতে পারে সেই মহিলা বিদ্রোহের শুরুতে বিদ্রোহীদের সাথে যোগ দেয় এবং যুদ্ধের প্রশিক্ষন নেয়।

এই মহিলা যেই হোক না কেনো, তার অসামান্য কীর্তি অবশ্যই বলতে হবে। ১৮৫৭ সালের ইতিহাস লিখতে গিয়ে তার কথা উল্লেখ না করলে এক আকর্ষনীয় অধ্যায় আমাদের চোখের আড়ালেই থেকে যাবে। আমার বিশ্বাস যদি এই মহিলাকে প্রশিক্ষণ দিয়ে অন্য কোনো কাজে লাগানো যেত তাহলে তার নামও চাঁদ সুলতানা (২), নুরজাহান (৩) ও রাজিয়া সুলতানার (৪) পাশে থাকতো।

হাডসনের চিঠির সাথে আমিও একমত। যদি এই মহিলাকে জেনারেল মুক্তি দিতেন তাহলে বিদ্রোহের আগুন আরো জ্বলে উঠতো। দলে দলে লোক এই মহিলার সাথে যোগ দিতো। এই মহিলা সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু এখনো জানতে পারিনি। যদি কোনো ইংরেজী নথি বা দেশিয় লেখায় এই মহিলা সম্পর্কে বিস্তারিত কোনো তথ্য মিলে তবে আমাকে জানানোর অনুরোধ রইলো। আমি এ নিয়ে বিস্তারিত লিখবো।
আমি ব্রিটিশ অফিসারের মহত্বের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি তিনি এই মহিলাকে হত্যা করেননি যদিও এই মহিলা অনেক ইংরেজ অফিসারকে হত্যা করেছে। তিনি রাজকীয় ভদ্রতা ও মনুষত্বের পরিচয় দিয়েছেন। (৫)
টীকা:
১। ফ্রান্সে বিদ্রোহের সময় জোয়ান অব আর্ক নামে এক নারী এমন সাহসিকতার সাথে লড়াই করতো। হাজার হাজার মানুষ তার পক্ষে লড়তো। সবাই ভাবতো সে অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী। পরে শত্রুরা তাকে পুড়িয়ে মারে। এই ঘটনার দিকে ইংগিত—খাজা নিজামি
২। খ্রিষ্টিয় ১৫৯৬ সনের ১ মার্চ দক্ষিণ ভারতের নিজাম-শাহী রাজবংশের পরিচালিত রাষ্ট্র আহমাদনগরে হামলা চালায় মুঘল সম্রাট আকবরের সেনারা। কিন্তু এই হামলা বীরত্বের সঙ্গে প্রতিহত করেন রাজকন্যা চাঁদ সুলতানা। বিজাপুর রাষ্ট্রের সুলতান আলী আদেল শাহের বিধবা স্ত্রী চাঁদ সুলতানা (চাঁদ বিবি) এ সময় আহমদনগরের নাবালক সুলতান বাহাদুর নিজাম শাহের অভিভাবক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন। এই সুলতান ছিলেন তারই ভাই বা বোনের নাতি। চাঁদ সুলতানা ছিলেন আহমদনগরের সাবেক বাদশাহ হুসাইন নিজাম শাহ (প্রথম)-এর কন্যা। চাঁদ সুলতানা বিজাপুর রাষ্ট্রেরও একই ধরনের অভিভাবক ছিলেন।- অনুবাদক
৩। নুরজাহান বা জগতের আলো(জন্মঃ ৩১ মে, ১৫৭৭– মৃত্যুঃ ১৭ ডিসেম্বর, ১৬৪৫) হচ্ছেন সম্রাট জাহাঙ্গীর এর স্ত্রী। নুরজাহান সম্রাটের দেয়া নাম। তার আসল নাম ছিল মেহেরুন্নিসা।– অনুবাদক
৪। রাজিয়া সুলতানা ( ১২০৫ ,১২৪০) সুলতান ইলতুতমিশের কন্যা ও ভারতবর্ষের প্রথম মহিলা শাসক। তিনি একাধারে একজন ভাল প্রসাশক ও সেনাপতি ছিলেন; তাছাড়া যুদ্ধক্ষেত্রে একজন দক্ষ সৈন্য হিসেবে তার পরিচিতি ছিল। সুলতান ইলতুতমিশের সব থেকে যোগ্য পুত্র সুলতানের জীবদ্দশায় মৃত্যু বরণ করলে সুলতান তার কন্যা রাজিয়া সুলতানাকে দিল্লীর শাসক হিসেবে মনোনিত করে যান। যখনই ইলতুতমিশের রাজধানী ছাড়তে হত, তিনি তখন তার কন্যা রাজিয়া সুলতানাকে শাসনভার বুঝিয়ে যেতেন। ইলতুতুমিশের পর তিনি ভারতের শাসক হন। —অনুবাদক।
৫। এই একটি ঘটনা দ্বারা ইংরেজদের মহত্ত্ব ও দয়া সম্পর্কে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া ভুল হবে। বিদ্রোহের পর দিল্লী ও অন্যান্য শহরে তারা যে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে তার বিবরন পেতে মৌলভী যাকাউল্লাহ রচিত ‘তারীখে হিন্দুস্তান’ এর দশম খন্ড এবং খাজা হাসান নিজামির ‘দিহলী কি জা কুনি’ দেখা যেতে পারে। — অনুবাদক

ভিখারি শাহজাদা

এই হলো দিল্লী। একে বলা হয় হিন্দুস্তানের দিল।একসময় এই শহর আবাদ ছিল, লাল কেল্লায় জ্বলছিল মুঘল প্রদীপ, মাথা উচু করে দাঁড়িয়ে ছিল ইসলামী ঐতিহ্য। শেষেরদিকে এই শহরের বাসিন্দারা বদলে গেল, তাদের আমলের খাতা শূন্য হয়ে গেল। পরিবর্তনটা এসেছিল শাসকদের হাত ধরে। প্রথমে তাদের আমল খারাপ হলো, তারপর শহরবাসী তাদের অনুসরণ করলো। পরিনতিতে শাসক ও শাসিত উভয়েই বরবাদ হলো, তাদের উপর নেমে এলো মুসিবতের দমকা হাওয়া। ইতিহাসের পাতায় উদাহরণ অনেক আছে, তবে এখানে আমি শুধু একটি ঘটনাই বলবো।
# বিদ্রোহের এক বছর আগের ঘটনা। দিল্লীর বাইরে জংগলে কয়েকজন শাহজাদা শিকারে ব্যস্ত ছিল। সময়টা ছিল মধ্যদুপুর, গাছের ডালে ডালে চড়ুই পাখি ও ঘুঘুর দল বসে জিরিয়ে নিচ্ছিল। খেলার ছলে শাহজাদারা ঘুঘু ও চড়ুইগুলোকে নিশানা বানিয়ে গুলতি ছুড়তে লাগলো। এসময় ঝোপের আড়াল থেকে এক শুভ্রকেশ দরবেশ বের হয়ে এলেন।

‘কেন অবলা প্রানীগুলোকে কষ্ট দিচ্ছেন প্রিয় শাহজাদা। তাদেরও আমাদের মতো অনুভূতি আছে। তারাও ব্যাথা পায়, কষ্ট অনুভব করে কিন্তু তা প্রকাশের ভাষা তাদের নাই। আপনারা বাদশাহর সন্তান। বাদশাহ তো নিজের রাজত্বের প্রতিটি প্রানীর প্রতি দয়াবান হবে’ বললেন দরবেশ।

একথা শুনে বড় শাহজাদা, যার বয়স তখন আঠারো বছর, লজ্জিত হয়ে হাত থেকে গুলতি রেখে দিলেন। তবে ছোট শাহজাদা মির্জা নাসিরুল মুলক বিগড়ে বসলেন, ‘আমরা তো শিকার করতে এসেছি। শিকার করা দোষের কিছু নয়’। দরবেশ বললেন, ‘জনাব, শিকার করা অপরাধ নয়। অযথা প্রানীগুলোকে কষ্ট দেয়া অপরাধ’। দরবেশের কথা শুনে মির্জা নাসিরুল মুলক রাগে ফেটে পড়লো। তাতক্ষনিক গুলতি হাতে নিয়ে দরবেশের হাটুতে ঢিল ছুড়লো। তীব্র ব্যাথায় দরবেশ আর্তনাদ করে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। দরবেশকে মাটিতে পড়তে দেখে দুই শাহজাদা কেল্লার দিকে রওনা হয়ে গেল। দরবেশ হেচড়ে হেচড়ে পুরাতন কবরস্থানের দিকে আগান। তার মুখে উচ্চারিত হচ্ছিল, ‘যে সিংহাসনের উত্তরাধিকারীরা এতটা নির্দয় ও জালেম, তা আর কী করে টিকে থাকবে। শাহজাদা, তুমি আজ আমার পা ভেংগেছো, একদিন সময় আসবে খোদা তোমার পাও ভেংগে দিবেন। তুমিও সেদিন আমার মতো হেচড়ে চলবে’।

# তোপ গর্জাচ্ছে। একের পর এক গোলা শূন্যে উঠে আবার নিচে নেমে আসছে। সাথে নিয়ে আসছে ধবংস ও তান্ডব। চারদিকে শুধু লাশের সারি নজরে আসছে। দিল্লীকে মনে হচ্ছে জনমানবহীন। মনে হচ্ছে মৃতের শহর। লাল কেল্লার দরজা খুলে কয়েকজন শাহজাদাকে বের হতে দেখা গেল। শাহজাদারা ঘোড় সওয়ার। তারা পালাচ্ছে পাহাড়গঞ্জের দিকে। একটু পরেই বিশ পচিশজন গোরা সেপাই তাদের ধাওয়া করলো। সেপাইরা শাহজাদাদের লক্ষ্য করে গুলি চালায়। গুলিবিদ্ধ শাহজাদারা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। নিজেদের রক্তের মাঝে নিজেরা কাতরাতে থাকে। সেপাইরা কাছে এগিয়ে আসে। দেখা যায়, দুই শাহজাদা মারা গেছে। একজন জীবিত আছে এবং তার গায়ে গুলি লাগেনি।। শুধু ঘোড়া থেকে পড়ে যাওয়ায় হালকা আঘাত পেয়েছে। সেপাইরা জীবিত শাহজাদাকে গ্রেফতার করে ক্যাম্পে নিয়ে যায়। ক্যাম্প ছিল পাহাড়ের উপর। বড় অফিসার শাহজাদাকে দেখে চিনতে পারেন। ইনি বাদশাহর নাতী নাসিরুল মুলক। সেপাইদের নির্দেশ দেয়া হয়, তাকে কয়েদ করতে।

# বিদ্রোহী সিপাহীরা পরাজিত হয়ে পালাতে থাকে এবং ইংরেজ বাহিনী উল্লাস করতে করতে শহরে প্রবেশ করে। বাহাদুর শাহ জাফর গ্রেফতার হলেন হুমায়ুনের সমাধি থেকে। তৈমুরী রাজত্বের শেষ প্রদীপ এভাবেই নিভে যায়। শহরের বাইরে জংগলে আশ্রয় নেয় সম্ভ্রান্ত শহরবাসী। যে নারীদের চেহারা বাইরের কেউ দেখেনি কখনো, তারাও আজ বে আব্রু।

Shahjahanabad old delhi
Shahjahanabad old delhi

দিল্লীতে চলছে খুনের উতসব। সন্তানের সামনে পিতাকে জবাই করা হচ্ছে। কন্যাকে হত্যা করা হচ্ছে মায়ের সামনে। এই বিশৃংখল সময়টাতে শাহজাদা নাসিরুল মুলককে হাত পা বেধে ফেলে রাখা হয়েছে পাহাড়ি ক্যাম্পে। এক পাঠান সিপাহী এসে বললো, বড় সাহেব আপনাকে ছেড়ে দিতে রাজি হয়েছেন। আপনি চলে যান। আবার কোনো বিপদে পড়ার আগে এই এলাকা ছেড়ে যান।

শাহজাদার হাত পায়ের বাধন খুলে দেয়া হলো। শাহজাদা পাঠান সিপাহীর শুকরিয়া আদায় করে জঙ্গলের দিকে রওনা হলো। শাহজাদা হাটছে , কিন্তু কোথায় যাচ্ছে সে সম্পর্কে স্পষ্ট ধারনা নেই তার। শাহজাদা প্রায় এক মাইল হাটলো। মৃত্যুভয় ও ক্ষুধায় শরীর ক্লান্ত। হাটায় অনভ্যস্ত পা দুটো আর চলতে চাইছে না। গলা শুকিয়ে গেছে। কন্ঠনালীতে কাটার মতো বিধছে কিছু একটা। ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত শাহজাদা এক গাছের ছায়ায় বসে পড়লো। কষ্টের দু ফোটা অশ্রু গালে বেয়ে পড়লো। ‘খোদা, এ কোন মুসিবতে আমাদের ফেললে? আমরা এখন কোথায় যাবো? কোথায় আমাদের ঠিকানা?’এ একথা বলতে বলতে শাহজাদা আসমানের দিকে মাথা তুলে তাকালো। শাহজাদার চোখ পড়লো গাছের ডালে। সেখানে ঘুঘু বাসা বুনেছে। আয়েশ করে ডিমের উপর বসে তা দিচ্ছে। ঘুঘুর স্বাধিনতা ও নিশ্চিন্ত জীবনযাপন দেখে শাহজাদার মুখ থেকে বের হলো, ঘুঘু, তুমি আমার চেয়ে হাজারগুন সুখে আছো। তুমি তো নিশ্চিন্তে নিজের বাসায় বসে আছো। আর আমার জন্য আসমান জমিনের কোথাও এক ইঞ্চি জায়গা নেই’।

একটু দূরে একটা বসতি দেখা যাচ্ছে। সেদিকে যাওয়ার জন্য শাহজাদা উঠে দাড়ালো। পা দুটো চলতে চাইছে না। কোনোমতে টেনে টেনে বসতিতে পৌছলো। বসতির বাইরে, বড় একটা গাছের নিচে অনেক লোক জমা হয়েছে। গাছের নিচে চত্বরের মতো একটা জায়গায় এক কিশোরী বসে আছে। বাতাসে কিশোরীর চুল উড়ছে, তার দুকান রক্তে রঞ্জিত। গ্রাম্য লোকেরা পাশে দাঁড়িয়ে তামাশা করছে। একইসময়ে মেয়েটির সাথে মির্জার চোখাচুখি হলো। দুজনেই চিতকার করে উঠলো। মেয়েটি আর কেউ নয়, মির্জার ছোট বোন। ভাই বোন পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে। দিল্লীর পতন আসন্ন বুঝতে পেরে মির্জার মা ও বোন রথ নিয়ে কেল্লা ছেড়ে কুতুব সাহেবের দিকে রওনা হন।


এটা পড়ুন – শয়তান


মির্জার ধারনাও ছিলো না , তার মা ও বোন কোনো বিপদে পড়েছে। “বোন তোমার এ অবস্থা কেন’ মির্জা জিজ্ঞাসা করলো। ‘ভাইজান, আমাদের লুটপাট করেছে। চাকরদের মেরে ফেলেছে। আম্মাকে অন্য গ্রামে নিয়ে গেছে। আমাকে এই গ্রামে আনা হয়েছে। আমার চুল ধরে টেনেছে। একের পর এক থাপ্পড় বসিয়েছে গালে’ বলতে বলতে শাহজাদী কেদে ফেললো। কান্নার দমকে তার কথা আটকে গেল। শাহজাদা বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে তাকে সান্ত্বনা দিলো। গ্রামবাসীদের সামনে হাত জোর করে শাহজাদিকে ছেড়ে দেয়ার অনুরোধ জানালো। ‘আরে ভাগ এখান থেকে। নইলে এমন মার খাবি যে কল্লা উড়ে যাবে। ওকে আমরা পাশের গ্রাম থেকে কিনে এনেছি। দাম দে, নিয়ে যা’ মাতবর গোছের একজন বললো। ‘চৌধুরী সাহেব, একটু রহম করুন। দাম দিবো কীভাবে? আমি নিজেই তো এখন ভিক্ষুক। একটু দয়া করো। গতকাল তোমরা আমাদের প্রজা ছিলে। আমরা বাদশাহ ছিলাম। আজ সময়ের চাকা উলটে গেছে। যদি আবার আমাদের দিন ফিরে আসে, তাহলে তোমাদের অনেক ধন সম্পদ পুরস্কার দিবো’ শাহজাদার কথা শুনে গ্রামবাসী হেসে দিল। ‘তোর আর বাদশাহ হতে হবে না। তোকে ইংরেজদের হাতে তুলে দিবো। আর এই মেয়ে আমাদের গ্রামে থাকবে। আমাদের ঘর বাড়ি ঝাড়ু দিবে। ক্ষেতে কাজ করবে’ বললো একজন। কথাবার্তা চলার ফাকেই কজন ইংরেজ সেনা এসে গ্রামবাসীকে ঘিরে ফেললো। সামান্য কথা কাটাকাটির পর চারজন গ্রামবাসী ও শাহজাদা শাহজাদিকে ইংরেজরা গ্রেফতার করে।

# চাদনি চকে ফাসির মঞ্চ প্রস্তুত করা হয়েছে। সামনে নিয়ে আসা হচ্ছে সন্দেহভাজনদের। যার ব্যাপারে ইংরেজ অফিসার ফাসির রায় দিচ্ছে তাকেই তাতক্ষনিক ফাসিতে ঝুলিয়ে দেয়া হচ্ছে। প্রতিদিন শত শত লোককে ফাসি দেয়া হচ্ছে। কাউকে গুলি করে হত্যা করা হচ্ছে। দিল্লীতে শুধুই খুনের উতসব। শাহজাদা মির্জা নাসির ও তার বোনকে বড় অফিসারের সামনে আনা হলো। কিছুক্ষন কথাবার্তা বলে অফিসার তাদের ছেড়ে দিলো। মুক্তি পেয়ে দুই ভাইবোন এক সওদাগরের বাড়িতে চাকরি নিলো। শাহজাদি সওদাগরের বাচ্চাদের দেখভাল করতো আর শাহজাদা ঘরের বাজার সদাই করতো। কিছুদিন পর শাহজাদি অসুস্থ হয়ে মারা যায়। শাহজাদা আরো কিছুদিন এদিক সেদিক ঘুরে চাকরের কাজ করে। পরে ইংরেজ সরকার তার জন্য মাসিক ৫ রুপি ভাতা নির্ধারণ করে দেয়। সাথে ছোট একটা চাকরির সুবাধে মির্জার দিনগুলো কেটে যাচ্ছিল।

# এক বছর আগের কথা। দিল্লীর বাজার, চিতলি কবর, কামরা বাংগিশ ও অন্যান্য এলাকায় এক বৃদ্ধ ভিখারীকে দেখা যেত। তার পা ছিল পক্ষাগাতগ্রস্ত। সে হাতে ভর দিয়ে হেচড়ে হেচড়ে চলাফেরা করতো। তার গলায় ঝুলানো থাকতো ভিখারীর ঝুলি। সে দু কদম এগিয়ে থামতো, আশপাশের পথিকদের দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকাতো। তার চোখে ফুটে উঠতো বোবা আকুতি। তার চেহারায় ছিল তৈমুরী বংশের ছাপ। দিল্লীর অনেকেই তাকে চিনতো। তাকে জিজ্ঞেস করলেও তার পরিচয় জানা যেত।

তার নাম মির্জা নাসিরুল মুলক, শেষ মুঘল বাদশাহ বাহাদুর শাহ জাফরের নাতী। পেনশনের সব অর্থ ঋনের কারনে শেষ করে ফেলে এখন ভিক্ষার ঝুলিই হয়েছে তার সম্বল। আমি যখনই তাকে দেখতাম, তখনই তার জীবন থেকে শিক্ষা নিতাম। আমার মনে পড়তো তার জীবনের শুরুর দিকের ঘটনাবলী, যার কিছুটা আমি তার মুখে এবং কিছুটা অন্য শাহজাদাদের মুখে শুনেছি। শাহজাদাকে দিল্লীর বাজারে হাতে ভর করে চলতে দেখলে আমার মনে পড়তে সেই দরবেশের কথা, যাকে শাহজাদা গুলতি মেরেছিল এবং তিনি বদদোয়া করে বলেছিলেন, ‘একদিন খোদা তোমার পা’ও ভেংগে দিবেন’। আমার মনে হতো সেই দরবেশের বদদোয়া বাস্তবায়িত হয়েছে। শাহজাদাকে দেখলেই আমি খোদার ভয়ে কাপতে থাকতাম। কিছুদিন আগে এই শাহজাদা ইন্তেকাল করেছে।

এই সত্য ঘটনা থেকে আমাদের ধনী ভাইদের শিক্ষা নেয়ার আছে। অহংকারীর করুন পরিনতি তাদের সামনেই আছে, এরপরেও কি তারা অহংকার ত্যাগ করবে না ?

আমি পীর মাশায়েখদের সন্তানদেরকেও সতর্ক করতে চাই, যারা হাতের তালুতে বাবার মুরিদদের চুমু পেয়ে অভ্যস্ত এবং এটাই তাদের ঠেলে দেয় ধবংসের দিকে। তাদের মনে জমা হয় অহমিকা, দুনিয়ার কাউকে তারা আর মানুষই মনে করে না। নিজের পূর্বসুরিদের কীর্তির উপর ভরসা করে নিজে যোগ্যতা অর্জন না করে অযোগ্য থাকা, একদিন মানুষকে লাঞ্চিত ও অপদস্থ করে। সকল পীরজাদার উচিত তারা সেই যোগ্যতা অর্জন করবে যার কারনে তার পিতাকে পীর বলা হয়। মুরিদদের হাদিয়া তোহফার উপর ভরসা করে থাকা চুড়ান্ত পর্যায়ের আত্মমর্যাদাহীনতা। আমি অনেক পীরজাদাকে দেখেছি, তারা বাল্যকালেই শাহী জীবনে অভ্যস্ত হয়ে যায় এবং বাবার মুরিদদের নিজের দাস ভাবে। তাদের মনে রাখা উচিত, যেভাবে সময়ের পরিবর্তনে বাদশাহরা ক্ষমতা হারায় এবং তাদের উত্তরাধিকারীরা হয় লাঞ্চিত, সেভাবেই পীরজাদাদের অহংকার ও বদদ্বীনি তাদের পতন ঘটাতে পারে যে কোন সময়। এজন্য সবার উচিত , কঠিন সময় আসার আগেই নিজের নিয়ত ও আমলের পরিবর্তন ঘটানো।
আমি এই কথাগুলোই বলছি এবং বলবো, যতদিন যবান ও কলম সচল থাকে।

খিলাফত ও ভারতীয় উপমহাদেশ

আবু ইসমাইল আল-বেইরভীঃ খিলাফত রাষ্ট্র ধ্বংসের পর আরও একটি বার্ষিকী অতিক্রম করছে মুসলিম উম্মাহ। এই মুহুর্তে অতিব জরুরী হয়ে দাঁড়িয়েছে ইতিহাস ফিরে দেখা এবং এই পতন ও ধ্বংসের প্রতি মুসলিমদের প্রতিক্রিয়া কী ছিল তা খতিয়ে দেখা। ধারণা করা হয়, খিলাফত ধ্বংসের প্রতি মুসলিমদের ও তৎকালীন আলেম-ওলামাদের কোন প্রতিক্রিয়াই ছিল না এবং তারা এর গুরুত্ব বুঝতে পারেন নি। কিন্তু এটি সত্য না; ইতিহাস সাক্ষী হিসেবে যথেষ্ট যে, মুসলিমদের প্রতিক্রিয়া কী ছিল, কিভাবে তাঁরা এটি রক্ষার চেষ্টা করেছিলেন এবং আল্লাহর ছায়াকে দুনিয়া থেকে নির্মূল হতে দেখে কীরূপ কষ্ট সহ্য করেছিলেন। এই ভারত উপমহাদেশের মুসলিম ও তাদের গড়ে তোলা খিলাফত আন্দোলন তার জ্বাজ্জল্যমান উদাহরণ।

মুসলিমদের প্রতিক্রিয়া জানার পূর্বে আমাদের জেনে নেয়া দরকার কিভাবে ইসলামী শাসনব্যবস্থা এই ভারতীয় উপমহাদেশে পৌঁছেছিল। যেখানে ইসলামি উম্মাহর প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠীর বসবাস। সংখ্যায় যার পরিমাণ প্রায় অর্ধ বিলিয়ন, অর্থাৎ ভারতে ২৫০ মিলিয়ন মুসলিম, পাকিস্তানে ১৬০ মিলিয়ন মুসলিম এবং বাংলাদেশে ১২০ মিলিয়ন মুসলিম। বস্তুত উর্দূ হচ্ছে যথা সম্ভব এই উম্মাহর সবচেয়ে বহুল উচ্চারিত ভাষা। এমনকি আরবী অপেক্ষাও বেশি।

ভারতে খিলাফতের ইতিহাস:

৭১১ খ্রিষ্টাব্দ; মুসলিম বণিকেরা সীলন (Ceylon) থেকে ভারত মহাসাগর পাড়ি দিয়ে নোঙর ফেলেছিলেন সিন্ধু উপকূলে। কিন্তু তাদের জাহাজ লুট করা হয় এবং মুসলিমদের আটক করে জেলবন্দী করা হয়। এই খবরটি তৎকালীন খিলাফত রাষ্ট্রের রাজধানীতে খলীফা আল ওয়ালিদ বিন আব্দুল মালিকের কানে পৌঁছল। তিনি তৎকালীন বাগদাদের ওয়ালী (গভর্নর) হাজ্জাজ বিন ইউসুফকে চিঠি পাঠালেন যেন সে তৎক্ষণাত সিন্ধুর শাসক প্রধানের কাছ থেকে ক্ষমা আদায়ের ব্যবস্থা করে ও মুসলিমদের মুক্ত করে। একদল সেনাবাহিনী পাঠানো হলো যার নেতৃত্বে ছিলেন এই উম্মাহর দীপ্তিমান সন্তানদের মধ্যে একজন। এই যুবকের নামটি সকল মুসলিম বিশেষ করে ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিমদের অন্তরে এক উচ্চ স্থান দখল করে আছে। এই যুবকের কাঁধেই দায়িত্ব পড়েছিল খিলাফাহ্ রাষ্ট্রের সেনাবাহিনীকে একটি অপরিচিত ভুমিতে নেতৃত্ব দিয়ে নিয়ে যাওয়ার। তাঁর নাম মুহাম্মদদ বিন কাসিম আল-ছাকাফী। বিলাদ-আল-হিনদ মুক্তকারী।যখন খিলাফত রাষ্টের সেনাবাহিনী দিবাল পৌঁছাল (বর্তমান করাচির কাছাকাছি), মুহাম্মদ বিন কাসিম তাঁর দাবীসমূহ রাজা দাহিরের কাছে তুলে ধরলেন। রাজা দাবীসমূহ প্রত্যাহার করেছিলো এবং ফলাফলসরূপ মুসলিমদের সাথে যুদ্ধে পরাজিত হয়েছিল ও তার রাজ্য দখলে নেয়া হয়েছিল।

এই সফলতার পরপরই মুহাম্মদ বিন কাসিম আরও অভিযান পরিচালনা করেছিলেন যেহেতু মুসলিম বাহিনীর দায়িত্ব হচ্ছে আল্লাহ আজ্জা ওয়া জালের বাণীকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে তুলে ধরা। এই আকীদার জোরেই মুসলিম সেনাবাহিনী অভিযান পরিচালনা করতে করতে মূলতান পর্যন্ত পৌছে গিয়েছিলেন। তিন বছরের মধ্যে অর্থাৎ ৭১৪ খ্রিষ্টাব্দতে সমগ্র সিন্ধু অঞ্চল এবং পাঞ্জাবের নিম্নাঞ্চল খিলাফত রাষ্ট্রের হুকুমের অধীনে চলে এসেছিল।

ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তর পশ্চিমাঞ্চল বিজিত হওয়ার পর তাঁর সেনাবাহীনী মূর্তিপূজারীদেরকে অন্ধকার থেকে ইসলামের আলোর পথে নিয়ে এসেছিলেন। তাঁর প্রশাসনে মুসলিম ও অমুসলিম বিভেদ ছিল না। তিনি বিজিত ভুমিসমূহের অমুসলিম কর্মকর্তাদের তাদের আগের জায়গায় বহাল রেখেছিলেন।

মুহাম্মদ বিন কাসিম খিলাফতের অধীনস্ত প্রশাসনকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, “মানুষের ব্যপারে সততা ও রাষ্ট্র সৎভাবে পরিচালনা কর। কর নির্ধারন করো মানুষের পরিশোধ করার সামর্থ্য অনুযায়ী।

খলীফা হিশাম বিন আব্দুল মালিকের সময় অর্থাৎ ৭২৪ থেকে ৭৪৩ খ্রিষ্ট্রাব্দের মধ্যে কাশ্মীর ও কাঙ্গারা খিলাফত রাষ্ট্রের অধীনে চলে আসে। এবং ৭৫৪ থেক ৭৫৫ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে আব্বাসীয় খলীফা আবু জাফর আল মানছুর কান্দাহার মুক্ত করেন এবং তাঁরই প্রচেষ্টায় সংগঠিত ভাবে সমগ্র ভারত উপমহাদেশে খিলাফত রাষ্ট্রের সীমান্ত বৃদ্ধি পেতে থাকে। ৭৮৬-৮০৯ খ্রিষ্ট্রাব্দের মধ্যে, হারুন আর রশীদের খিলাফত আমলে মুসলিম আর্মি সিন্ধু সীমান্ত বৃদ্ধি করে গুজরাট (অর্থাৎ বর্তমান ভারতে) পর্যন্ত নিয়ে যায়। এই সময়ে এসেই মুসলিম সেনাবাহীনী স্থানীয় ভাবে বসবাস শুরু করেছিল এবং নতুন শহরের গোড়াপত্তন হয়েছিল। এই সময়ে পর থেকেই ব্যাপক সংখ্যক ভারতীয়রা তাদের কুফর সামাজিক বর্ণবাদী সংস্কৃতির ভিত্তিহীনতা থেকে উঠে এসে বিশ্ব ভাতৃত্বের ছায়ায় আশ্রয় নিয়েছিল। তারা সন্ধান পেয়েছিল ইসলামের আলোর, আল্লাহর ইবাদাতের এবং পরিত্যাগ করেছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন কুফর, অজ্ঞতা ও মিথ্যা মুর্তিপূজা। ইসলাম শাসন করেছিল যা বর্তমানে ইন্ডিয়া, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ নামে পরিচিত এক হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে।

ওরিয়েন্টালিস্টরা (প্রাচ্যবাদী) যে ভাবে ভারতের ইতিহাসে তুলে ধরে তার বিপরীতে আমাদের বুঝতে হবে যে ভারত খিলাফতের উইলায়া’হ ছিল। কিছু খলীফার অবহেলার কারণে কিছুকাল এটি অপর্যবেক্ষিত অবস্থায় ছিল এবং একে স্বাধীনভাবে ছেড়ে দেয়া হয়েছিল। তথাপী, শাসকবর্গ এখানে আহকাম শরী’আহ বাস্তবায়িত অবস্থায় রেখেছিলেন এবং ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার পূর্ব পর্যন্ত এটি দার-উল-ইসলামের অংশ ছিল।

মুসলিম ইতিহাসবিদ, ইবনে কাসীর আল-দামিস্কি (মৃত্যু- ৭৭৪ হিজরী) তাঁর বিখ্যাত কর্ম ‘আল-বিদায়াহ-ওয়ান-নিহায়াহ’ তে ইন্ডিয়াকে দার-উল-ইসলামের অংশ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি এর বিজয়ের ব্যাপারে কিছু হাদীসও উল্লেখ করেছেন। আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত: “হে আমার সত্য বন্ধু, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, “এই উম্মতের সেনাবাহিনী সিন্ধু ও আল-হিন্দ পর্যন্ত পৌঁছাবে। আমি যদি এতে অংশগ্রহণের সুযোগ পাই এবং শহীদ হই তবে তা একটি (মঙ্গলজনক) বিষয়, আর আমি যদি ফিরে আসি তবে আমি হব মুক্ত আবু হুরায়রা। মহিমান্বিত রব আমাকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিবেন”। (আহমাদ)

ভারতবর্ষ খিলাফতের অধিভূক্ত প্রদেশ ছিল সমগ্র দিল্লী সুলতানীয়াত (১২০৫-১৫২৬ খ্রিষ্টাব্দ) এবং মুঘল আমলে (১৫২৬ – ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দ) শুধুমাত্র আকবরের শাসনামল ব্যতীত যেহেতু সে ইসলাম থেকে মুরতাদ হয়ে গিয়েছিল এবং দ্বীন-ই-ইলাহী নামে নতুন ধর্মের প্রবর্তন করেছিল।

বার শতাব্দীর শেষ চতুর্থাংশে মুহাম্মদ ঘূড়ি (Mohammad of Ghor) ইন্দো-গঙ্গা অববাহিকা (Indo-Gangetic Plain) আক্রমণ করেন। এরই ধারাবাহিকতায় বিজিত হয় গজনী, মূলতান, সিন্ধু, লাহোড় এবং দিল্লী। তাঁর একজন সেনাপ্রধান কুতুব উদ্দীন আইবেগ দিল্লীর সুলতান হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। তের শতাব্দীদে শামসুদ্দিন ইলতুতমিস (১২১১-১২৩৬), একজন অভিজ্ঞ তুর্কী দাস যোদ্ধা দিল্লীর ক্ষমতায় আসলে পরবর্তী সুলতানদের সাম্রাজ্য বৃদ্ধির পথ সুগম হয়। পরবর্তী ১০০ বছরে দিল্লী সুলতানীয়াত প্রসারিত হয়ে পূর্ব বাংলা এবং দক্ষিণ ডেক্কান (Deccan) পর্যন্ত পৌঁছে যায়। পাঁচ রাজবংশ দ্বারা দিল্লী সুলতানীয়াত শাসিত হয়েছিল) মামলূক বংশ (১২০৬-৯০) খলজী বংশ (১২৯০-১৩২০), তুঘলক বংশ (১৩২০-১৪১৩), সৈয়দ বংশ (১৪১৪-৫১) এবং লোদী বংশ (১৪৫১-১৫২৬)।

মধ্য এশিয়ার বংশোদ্ভূত বাবর ১৫২৬ সালে দিল্লী দখলে নেন এবং সর্বপ্রথম মুঘল শাসক হিসেবে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। তাঁর মৃত্যুর পর ১৫৩০ সালে তার পূত্র হুমায়ুন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয় (১৫৩০-৫৬)। ভোপাল কেন্দ্রীয় লাইব্রেরীতে সংরক্ষিত একটি ডকুমেন্ট থেকে জানা যায়, বাবর তার পূত্রকে নিম্নলিখিত অছিয়ত নামা দিয়ে গিয়েছিল। যা থেকে বুঝা যায় তার মধ্যে কিছু ভূল থাকলেও ইসলাম প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে যত্নবান ছিলেন :-

“পূত্র! নিম্নোক্ত বিষয়গুলোর প্রতি নজর দিও: কোন ধর্মের প্রতি ঘৃণা পোষণ করিও না। তুমি অব্যশই ন্যায় বাস্তবায়ন করবে তথাপী মানুষের ধর্মীয় অনুভূতি ও আচার সমূহ মাথায় রেখে। কিছু সময় গরু জবাই করা থেকে বিরত থাকো। যাতে স্থানীয়দের অন্তরে স্থান করে নিতে পারো। এটি তোমাকে জনগনের আরো নিকটবর্তী করবে।

কোন ধর্মীয় বিশ্বাসের স্থান ধ্বংস করো না এবং সকলের ক্ষেত্রে পরিপূর্ণ ন্যায় প্রতিষ্ঠা করো যাতে দেশে শান্তি সুনিশ্চিত হয়। ইসলামের দাওয়াত ভালোভাবেই পৌছে দেয়া সম্ভব দয়া ও ভালাবাসার তলোয়ার দিয়ে, জুলুম ও অত্যাচারের তলোয়ার বদলে। শিয়া সুন্নীর মধ্যকার বিভেদ সমূহ এড়িয়ে চলো। তোমার জনগণের বিবিধ বৈশিষ্ট্যসমূহ পর্যবেক্ষণ কর ঠিক যেভাবে ঋতু সমূহের বিবিধ বৈশিষ্ট্য রয়েছে।”

আমাদের ইতিহাস নেয়ার ক্ষেত্রে যত্নবান হতে হবে কেননা ভারতবর্ষ ও ইসলামের বেশির ভাগ ইতিহাস লেখা হয়েছে ওরিয়েন্টালিষ্টদের (প্রাচ্যবাদী) দ্বারা। আমরা অবশ্যই স্বীকার করি যে, ভারতবর্ষের কিছু মুসলিম শাসক ইসলামী হুকুমের অপপ্রয়োগ করেছিলেন এবং কতিপয় অন্যায় সম্পাদন করেছিলেন। তা সত্ত্বেও ভারতীয় উপমহাদেশ দার-উল-ইসলামের অন্তর্ভূক্ত ছিল যেহেতু ইসলামি ব্যবস্থা বাস্তবায়িত অবস্থায় ছিল। প্রধান শহরগুলোর আদালতের নথীসমূহ যা এখনো বিদ্যামান তাতে দেখা যায় যে ইসলামী শরীয়া ব্যতীত অন্য কোন, আইনের উৎসই গ্রহণযোগ্য ছিল না।

অপপ্রয়োগ খিলাফত, ওয়ালী (গভর্নর) কিংবা আমীল (মেয়র)-এর (শর’ঈ বৈধতা) বাতিলের দলীল হতে পারে না। অসংখ্য হাদীস রয়েছে যেখানে যদি অত্যাচারীও হয় তারপরও আমীরের আনুগত্য ফরয করা হয়েছে যতক্ষণ পযন্ত সে শরীয়া বাস্তবায়ন করে এবং কোন কুফর বাওয়াহ (সুস্পষ্ট কুফরী) সম্পাদন না করে।

আনাস বিন মলিক থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন। “শুন এবং মান্য কর, এমনকি যদিও তোমরা শাসিত হও একজন আবীসীনিয়ান দাস কর্তৃক যার মাথা কিসমিসের ন্যায়” অন্য এক বর্ণনায় রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, “যতক্ষণ পর্যন্ত সে তোমাদের আল্লাহর কিতাব দিয়ে পরিচালনা করে।”

মুসলিম বর্ণনা করেছেন আউফ বিন মালিক থেকে বর্ণিত আমি রাসূলুল্লাহ (সা) কে বলতে শুনেছি, “তোমাদের মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট নেতা হল সেই ব্যক্তি যাকে তোমরা ভালোবাসো এবং সে তোমাদের ভালোবাসে। তোমরা তার জন্য দোয়া কর এবং সে তোমাদের জন্য দোয়া করে। আর তোমাদের মধ্যে সর্বনিকৃষ্ট নেতা হল সেই ব্যক্তি যাকে তোমরা ঘৃনা কর এবং সে তোমাদের ঘৃণা করে। তোমর তাকে অভিসম্পাত কর এবং সে তোমাদের অভিসম্পাত করে।” আমরা জিজ্ঞেস করলাম। “হে রাসূলাল্লাহ, আমরা কি তার বিরূদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করব না? ? তিনি (সঃ) বললেন। “না! যতক্ষণ পর্যন্ত তারা সালাত কায়েম করে। যদি তোমাদের মধ্যে কেউ একজন ওয়ালী দ্বারা শাসিত হও এবং তাকে গুনাহে নিমজ্জিত দেখতে পাও, তবে সে যেন আল্লাহর বিরূদ্ধে কৃত গুণাহকে ঘৃণা করে। কিন্তু আনুগত্য হতে যেন হাত সরিয়ে না নেয়।”আহমাদ ও আবু দাউদ হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, “হে আবু যর, তুমি কি করবে যদি কোন ওয়ালী গণীমত ভোগদখল করে ও তোমাকে তা থেকে বঞ্চিত করে?” তিনি বললেন, “সে সত্তার কছম যিনি আপনাকে সত্য সহকারে প্রেরণ করেছেন, আমি তরবারী তুলে নিব এবং ততক্ষণ যুদ্ধ করব যতক্ষণ পর্যন্ত না আপনার সাথে মিলিত হই।” এটা শুনে রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, “আমি তোমাকে এমন কিছু বলব যা এর থেকে উত্তম। ধৈর্য্যশীল হও এবং সহ্য কর যতক্ষণ পর্যন্ত আমার সাথে মিলিত হও।”

ভারত যে বৈশ্বিক খিলাফতের অংশ ছিল তা অমুসলিম লেখকরাও বর্ণনা করেছেন। যেমন হিন্দু লেখক শশী এস শর্মা তার বই ‘Caliphs and Sultans – Religious ideology and political praxis’ এ বিষয়টি বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন:

“দিল্লী সুলতানীয়াত (১২০৫-১৫২৬) তার সর্বশেষ অস্তিত্ব পর্যন্ত বিশ্ব মুসলিম সাম্রাজ্যের বৈধ অংশ ছিল যার কার্যক্রম আব্বাসীয় খলিফাদের বৈধ অধিরাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। সুলতানগন নিজেদেরকে খলীফার ডেপুটি মনে করতেন এবং তাদের নির্বাহী ও আইনী কর্তৃত্ব (খলীফার দেয়া) প্রতিনিধিত্বের মাধ্যমেই বৈধতা পেত। যেহেতু সকল সম্প্রদায়ের (উম্মাহর) সামগ্রিক কর্তৃত্বের বৈধতা খলীফার ছিল। তাই প্রত্যেক রাজা ও ক্ষমতাবান ব্যক্তি ইসলামের ইমামের জন্য ও তার প্রতিনিধি হিসেবে শাসনক্ষমতা পালন করার দাবী করত। “[Shashi S. Sharma, Caliphs and Sultans – Religious ideology and political praxis, pg. 247]

মুহাম্মদ শাহ বাহমান (১৪৬৩-৮২), উসমানীয় সুলতান মুহাম্মদ ২য়কে একমাত্র যোগ্য খলীফা বলে সম্বোধন করত। বিজাপুর রাজ্য তুর্কী (উসমানী) প্রতীককে রাজ্যের প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করেছিল। গুজরাটের নেতৃস্থানীয় উচ্চ বংশীয় মালিক আয়ায সুলতান সেলিম ১মকে পৃথিবীর খলীফা বলে সম্বোধণ করেছেন। মূঘল সম্রাটেরা যে তুর্কীর সুলতানের প্রতি অতি উচ্চ ধারণা পোষণ করতেন যার প্রমান পাওয়া যায় দিল্লী ও ইস্তাম্বুলের মধ্যে আদান প্রদানকৃত কিছু চিঠিপত্রে। সুলতান সুলাইমানকে লেখা একটি পত্রে, হুমায়ুন (ভারতের সম্রাট) তাঁকে সর্বোৎকৃষ্ট গুণাবলী সমৃদ্ধ খলীফা বলে সম্বোধন করেছেন এবং তার খিলাফতের শাশ্বত চিরস্থায়িত্বের জন্য দোয়া করেছিলেন। তিনি সুলতানকে ইঙ্গিত করে একটি কোরআনের আয়াত ও উল্লেখ করেছিলেন “তিনি (আল্লাহ) আপনাকে পৃথিবীতে প্রতিনিধিত্ব দান করেছেন। সুলতান ইব্রাহীম শাহজাহানকে একটি চিঠি লিখেছিলেন যেখানে তিনি নিজেকে বিশ্বের সম্রাটদের নিরাপত্তা ও আশ্রয়স্থল রূপে উল্লেখ করেছেন যিনি খিলাফতের আসনে আসীন হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করেছেন। আহমাদ আকা, একজন তুর্কী প্রতিনিধি সুলতানের পক্ষ থেকে ১৬৯০ সালে একটি সরকারী পত্র নিয়ে আওরঙ্গজেবের মহলে এসেছিল যা কুরআনের আয়াত দ্বারা পরিপূর্ণ ছিল এবং সুলতান নিজেকে ইসলামের খলীফা বলে উল্লেখ করেছিলেন। ১৭২৩ সালে মুহাম্মদ শাহ (১৭১৯-১৭৪৮) মুঘল সাম্রাজ্যের পক্ষ থেকে ইস্তাম্বুলের তুর্কী সম্রাটের সাথে চিঠি আদান-প্রদান বজায় রাখেন। তাঁর চিঠিতে মুহাম্মদ শাহ সুলতানকে মহান সম্রাটদের আশ্রয়দাতা ‘মর্যাদাবান সম্রাটের নিরাপত্তাদানকারী’, ‘সম্মানীত খিলাফতের রূপকার’ এবং ‘শরীয়তের আদর্শ প্রচারকারী’ বলে সম্বোধন করেছিলেন,” [Shashi S. Sharma, Caliphs and Sultans – Religious ideology and political praxis, pg. 248-249]

কিছু প্রাচীন নিদর্শন খিলাফত ও ভারতের মধ্যে সংযোগের চিত্রও তুলে ধরে। উদাহরণস্বরূপ সুলতান শামসুদ্দীন আলতামাশ (১২১১-৩৬) যিনি ভারতের ওয়ালী ছিলেন, তাঁর সময়কার রৌপ্য মূদ্রার একপাশে খলীফা আল মুসতানসীরের নাম এবং অন্য পাশে খিলাফতের সাহায্যকারী হিসেবে নিজের নাম খোদাই করেছিলেন।

এমনকি ১২৫৮ খৃষ্টাব্দে বাগদাদ ধ্বংস হওয়ার পর যখন খলীফা আল-মুসতা’সীমের মৃত্যু হয়, তারপরও ভারতের মূদ্রায় তাঁর নাম ব্যবহার অব্যাহত ছিল।

ভারত ইসলামী শাসনামলে মহান আলেমদের জন্ম দিয়েছে যেমন শেখ আহমাদ সিরহিন্দী (দীল্লীতে মৃত্যু বরণ, ১৬২৪ খ্রিঃ) যিনি মুজাদ্দিদে আলফে সানী নামেও পরিচিত। তিনি ফিকহ শাস্ত্রের সুপ্রসিদ্ধ আলেম ছিলেন। তিনি উসমানী শাসকদের নিজের মতামত পেশ করে ৫৩৬ টি চিঠি লিখেছিলেন যে গুলোকে একত্রে ‘সংগৃহীত পত্র’ বা ‘মাকতুবাত’ বলা হয়।

শাহ ওয়ালী উল্লাহ দেহলভী (১৭০৩-১৭৬২ খৃঃ) ভারতের সবচেয়ে সম্মাণিত আলেমদের মধ্যে একজন এবং তিনি দক্ষিণ এশিয়া ও এর বাইরের প্রায় সকল দল ও মাযহাবের কাছে সমান ভাবে গ্রহণীয় ও সম্মানিত। তিনি তার উর্বর লেখনী ক্ষমতার দ্বারা অসংখ্য ইসলামি বিষয়ে বিস্তৃতভাবে লিখেছেন। তাঁর কাজের মধ্যে রয়েছে কুরআনের আয়াত থেকে উর্দু অনুবাদকর্ম যা অন্যতম পুরোনো ও মাধূর্য্যময় একটি অনুবাদকর্ম। এছাড়া তিনি কোরআন অনুবাদ করেছেন সংস্কৃত ভাষায়, যদিও সমসাময়িক মুসলিম আলেমরা কুরআন কে তার প্রকৃত ভাষায় রাখার পক্ষে ছিলেন তবে পরবর্তীতে ভারতের ইসলামি আলেমরা তাঁর এই কর্মকে গ্রহণ করে নিয়েছেন এবং সমালোচনার পরিবর্তে স্বাগত জানিয়েছেন। এছাড়াও তারঁ বিখ্যাত কর্মের মধ্যে রয়েছে হুজ্জাত-আল-বালিগাহ এবং আল-তাফহীমাত আল-ইলাহীয়া’। শাহ ওয়ালী উল্লাহ ‘ইজালাত আল খীফা’ তে খিলাফত সম্বদ্ধে বলেছেন-“খিলাফত হচ্ছে একটি ঐক্যবদ্ধ জাতির নেতৃত্ব যার উত্থান হয়েছে দ্বীন বাস্তবায়নের জন্য তথাপী ইলমের শাখা সমূহ পুণর্জাগরণ, ইসলামি আচার-অনুষ্ঠান প্রতিষ্ঠা, জিহাদ পরিচালনা, সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণ, যোদ্ধাদের পুরস্কৃতকরণ বিচার ব্যবস্থা তৈরী ও আইন প্রয়োগ অপরাধ দমন এই সবগুলো কাজ বাস্তবায়ন এর দ্বারা করতে হবে যেন তা রাসূলুল্লাহ (সা) এর প্রতিনিধিত্ব করে”।

ইসলামের উলাইয়া আম্মা (আম বা সাধারণ প্রতিনিধিত্ব) গ্রহণযোগ্য:

ভারতীয় উপমহাদেশকে খলীফাদের পক্ষ থেকে উলাইয়া আম্মা (সাধারণ প্রতিনিধিত্ব) দেয়া হয়েছিল যা শরী’আর হুকুম অনুযায়ী একটি গ্রহণযোগ্য প্রতিনিধিত্ব। এটা সত্য যে খলীফাগণ উলাইয়াত বা প্রদেশগুলোর ব্যাপারে অনুসন্ধান, সরাসরি প্রতিনিধি নিয়োগ ও অপসারনের ব্যাপারে উদাসীন হয়ে পড়েছিলেন। এটি একটি রীতিতে পরিণত হয়েছিল যে সরাসরি নিয়োগের পরিবর্তে যেই প্রাদেশিক ক্ষমতা গ্রহণ করতো তাকেই মেনে নেয়া হত। তা সত্ত্বেও যেহেতু তাদেরকে গ্রহণ করা হত তাই তাদের কর্তৃত্ব খলীফা কর্তৃক সমর্থিত ছিল।

নিম্নে দুই ধরণের উইলায়াতের পক্ষে ইসলামি দলীল তুলে ধরা হল, যা নেয়া হয়েছে শেখ তাকী উদ্দীন আন নাবহানী ও শেখ আব্দুল কাদীম যাল্লুম কর্তৃক লিখিত বই The Ruling System in Islam (ইসলামী শাসন ব্যবস্থা) এর ইংরেজি অনুবাদ থেকে,

“ওয়ালী (গভর্নর) হচ্ছেন খলীফার প্রতিনিধি। তিনি সেই সকল কার্যই সম্পাদন করেন যে সকল কাজের জন্য খলীফা তাকে নিজের পক্ষে কর্তৃত্ব দান করেন। শরী’য়ায় উইলায়ার কোন নির্দিষ্ট সীমা নেই। সুতরাং খলীফার পক্ষ থেকে কোনো হুকুমের ব্যাপারে যিনিই নিয়োগ প্রাপ্ত হবেন তিনিই হবেন ওয়ালী। পাশাপাশি সে সকল শর্তের ভিত্তিতে খলীফা তাকে নিয়োগ দিবেন। তবে কোন একটি দেশের উইলায়াহ ভৌগলিক ভাবে নির্দিষ্ট। কেননা রাসূলুল্লাহ (সা) ওয়ালী নিয়োগের ক্ষেত্রে আয়তন নির্ধারন করে দিয়েছেন অর্থাৎ যেখানে তিনি (সা) আমীরকে ইমারত (শাসনকর্তৃত্ব) সহকারে নিয়োগ দিয়েছেন।

দুই ধরনের উইলাইয়া রয়েছে: সাধারণ ও বিশেষ। সাধারণ উইলায়াতে সকল ধরনের হুকুমি ব্যাপার সমূহ নিযুক্ত থাকবে। উক্ত উইলায়ার কাউকে নিয়োগের অর্থ দাঁড়ায় খলীফা উক্ত ওয়ালীকে নির্দিষ্ট দেশ বা প্রদেশের প্রতিনিধিত্ব স্বরূপ ইমারাহ প্রদান করেছেন। যিনি উইলায়ার জনগণের সকল স্বাভাবিক কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণের জন্য, নিয়োগ প্রাপ্ত। সুতরাং তিনি সাধারণভাবে পর্যবেক্ষণের দায়িত্বপ্রাপ্ত। অন্যদিকে বিশেষ ইমারা হচ্ছে যেখানে আমীর নির্দিষ্ট দেশ বা প্রদেশে সীমাবদ্ধ বিষয়ের উপর নিয়োগপ্রাপ্ত যেমন- সৈন্য পরিচালনা, নাগরিকদের শাসনকার্য পরিচালনা, ভুমি প্রতিরক্ষা আর নারী ও শিশুদের নিরাপত্তা দান। কিন্তু বিচার বিভাগ পরিচালনা, খারাজ ও সদকা আদায়ের ব্যাপারে তার কর্তৃত্ব থাকবে না। রাসূলুল্লাহ্ (সা) সাধারণ দায়িত্ব (উইলায়া আম্মা) সহকারে ওয়ালী নিয়োগ দিয়েছেন। যেমন তিনি (সা) যখন আমরু বিন হাযমকে ইয়েমেনে নিয়োগ দিয়েছিলেন। তেমনি ভাবে রাসূলুল্লাহ (সা) বিশেষ দায়িত্ব (উইলায়া খাসসা) সহকারে ওয়ালী নিয়োগ দিয়েছেন। যেমন তিনি (সা) আলী বিন আবি তালিবকে ইয়েমেনের বিচার বিভাগের দায়িত্বে নিয়োগ দিয়েছিলেন। খলীফাগণ রাসূলুল্লাহ (সঃ) এর পদাঙ্ক অনুসরণ করেছেন। উমার ইবনুল খাত্তাব মুয়াবিয়া বিন আবি সুফিয়ানকে আল-শামের সাধারণ ওয়ালী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলন। অন্যদিকে আলী বিন আবি তালিব আব্দুল্লাহ বিন আব্বাসকে বসরায় শাসনকার্য পরিচালনার জন্য বিশেষ ক্ষমতা (উইলায়া খাসসা) সহকারে নিয়োগ দিয়েছিলেন, বায়তুল মালের দায়িত্ব ব্যতিত, যেখানে নিয়োগ দিয়েছিলেন যিয়াদকে।

শুরুর দিকে দুই ধরনের উইলায়াহ প্রচলিত ছিল: উইলায়াহ সালাহ্ এবং উইলায়াহ খারাজ। তাই ইতিহাসে উইলায়ার আমীরের ক্ষেত্রে দুই ধরণের ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায়: প্রথমটি হচ্ছে সালাতের উপর ইমারাহ্ আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে সালাহ ও খারাজের উপর ইমারাহ। অন্য কথায় আমীর নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন সালাত ও খারাজ উভয়ের উপর অথবা শুধুমাত্র সালাতের উপর। এখানে উইলায়াহ বা ইমারাহ এর ক্ষেত্রে সালাহ শব্দটি শুধুমাত্র নামাযে নেতৃত্ব দেয়া বুঝাচ্ছে না কারণ হচ্ছে সালাহ শব্দটি শাসনকার্যের ক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হয় যেখানে বায়তুল মালের খাজনা বা কর অন্তর্ভূক্ত নয়। তাই ওয়ালী যদি সালাহ এবং খারাজ উভয়ের উপর নিয়োগপ্রাপ্ত হন, তবে ঐ উইলায়াহ হবে সাধারণ (উইলায়াহ আম্মা)। আর তার উইলায়াহ যদি সীমাবদ্ধ হয়, শুধুমাত্র সালাহ অথবা শুধুমাত্র খারাজের জন্য, তবে ঐটি বিশেষ উইলায়াহ (উইলায়াহ খাসসা) উভয় ক্ষেত্রেই এটি সম্পূর্ণরূপে খলীফার এখতিয়ারভূক্ত, যেহেতু তাঁরই অধিকার রয়েছে উইলায়াহকে সীমাবদ্ধ করার যা হতে পারে খারাজের ক্ষেত্রে, বিচার বিভাগের ক্ষেত্রে, অথবা খারাজ, বিচার বিভাগ ও সেনাবাহিনী ছাড়াও অন্য যে কোনো ক্ষেত্রে। তিনি প্রদেশ উইলায়াহ পরিচালনায় যা ভাল মনে করবেন তাই করবেন। কারণ শরী’য়াহ ওয়ালীর কার্যক্রম নির্দিষ্ট করে দেয় নি এবং তিনি শাসনব্যবস্থার সকল কার্য পরিচালনায়ও বাধ্য নন। তবে এটি অবশ্যই নির্ধারিত যে ওয়ালী বা আমীর শাসনকার্যের কর্তৃত্বের ব্যাপারে দায়িত্বপ্রাপ্ত এবং তিনি খলীফার প্রতিনিধি এবং তিনি অবশ্যই একটি নির্দিষ্ট জায়গায় আমীর হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন। এই সকল বিষয় উঠে এসেছে রাসূলুল্লাহ (সা) এর কর্মকান্ডের মধ্যে। তবে শরী’আহ খলীফার জন্য ওয়ালী নিয়োগের সুযোগ করে দিয়েছে, হোক সে সাধারণ উইলায়াহ (উইলায়াহ আম্মা) বা বিশেষ উইলায়া (উইলায়া খাসসা) যা তাঁর (খলীফার) নিজস্ব এখতিয়ারভূক্ত এবং এর সবই রাসূলুল্লাহ (সা) এর কার্যকলাপ দ্বারা প্রমাণিত।

সীরাত ইবনে হিশাম থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (সঃ) ফারওয়া বিন মুসাইককে মুরাদ, যুবাইর ও মিজহাজ গোত্রের উপর নিয়োগ দিয়েছিলেন। আর তাঁর সাথে খালিদ বিন সাইদ বিন আল আসকে সদাকার ওয়ালী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন।

এছাড়াও রাসূলুল্লাহ (সা) যিয়াদ বিন লবীদ আল-আনসারীকে হাদারামাউতে সদাকাহর ওয়ালী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন। তিনি (সা) আলী বিন আবী তালিবকে নাযরানে পাঠিয়েছিলেন সদাকাহ ও যিজিয়া আদায়ের জন্য। এছাড়াও তিনি (সা) তাকে (আলী) (রা) ইয়েমেনে কাজী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন, যেভাবে আল- হাকিম থেকে বর্ণিত হয়েছে।

কিতাবুল ইসতিয়াব থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (সা) মুয়ায বিন জাবালকে আল-জানাদে নিয়োগ দিয়েছিলেন মানুষকে কুরআন ও ইসলামি আইন শিক্ষা দেয়ার জন্য এবং তাদের মাঝে বিচারকার্য পরিচালনার জন্য। তিনি (সা) তাকে ইয়েমেনের আমিলদের নিকট থেকে সদাকাহ আদায়ের জন্যও নিয়োগ দিয়েছিলেন। সীরাত ইবন হিশাম থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (সা) উহুদ যুদ্ধে যাওয়ার পূর্বে ইবনে উম্মে মাকতুমকে আল-মদীনায় সালাতের দায়িত্বে নিয়োগ দিয়েছিলেন। [The Ruling System in Islam, Sheikh Taqi-ud-deen-an-Nabhani & Sheikh Abdnl Qadeem Zalloom, Al-Khilafah Publications]

ভারতে বৃটিশ আগ্রাসন ও মুসলমানদের প্রতিক্রিয়া:

ঔপনিবেশিকদের ক্রমাগত কুটচাল ও মুসলিম উম্মাহর বহুলাংশে বুদ্ধিবৃত্তিক অধঃপতনের দরুণ, কুফফাররা ভারতীয় উপমহাদেশে প্রভাব বিস্তারের সুপ্ত ইচ্ছার প্রতিফলনের সুযোগ খুঁজে পায়। ১৬০০ খ্রিঃ বৃটিশরা ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী প্রতিষ্ঠা করে। এটা ছিল বেদনাদায়ক যুগের সূচনা যখন বৃটিশ ও অন্যান্য ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকরা উম্মাহর ভূমি ও সম্পদ লুন্ঠন করা শুরু করে। তারা মুসলিম ও অমুসলিমদের মাঝেও ঘৃণার আগুন জ্বালিয়ে দেয়।

বৃটিশরা ভারতীয় উপমহাদেশের আক্রমণ করে ১৮১৯ সালে, যখন তারা মুসলিমদের শক্তিশালী প্রতিরোধের মুখে পড়ে। এই যুদ্ধ উপমহাদেশে ইসলামি কর্তৃত্ব ও আক্রমণকারী বৃটেনের মধ্যে কিছু কুফর শক্তি যথা হিন্দু, বৌদ্ধ ও অন্যান্য কুফর শক্তির সাহায্যে পাল্টাপাল্টি সফলতার মাধ্যমে অব্যাহত থাকে। বৃটেন মুসলিমদের সাথে ২৭ বছরের দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৮৪৬ সালে স্থায়ী নিয়ন্ত্রণ নেয়।

এই সময় ভারতবর্ষের বিভিন্ন অংশে যেহেতু মুঘল উইলায়াহ দূর্বল হয়ে পড়েছিল, তাই এর অন্যান্য অংশের শাসকবর্গ ইস্তাম্বুলে খলীফার কাছ থেকে সাহায্য ও (শাসনকতৃত্বের) বৈধতা চেয়েছিল। উদাহরণস্বরূপ কান্নুরের রাণী ১৭৭৯ সালে সুলতান আব্দুল হামিদকে উদ্দেশ্য করে একটি কুটনীতিক পত্র লিখেছিলেন, যেখানে তিনি, খলীফার কাছে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে নিরাপত্তার আরজি করেছিলেন। মাইসুরের টিপু সুলতান (বৈধতা) অন্বেষণের পর খলীফার কাছ থেকে একটি স্বীকৃতি পত্র পেয়েছিলেন যেখানে তাকে মাইসুরের শাসক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।

বৃটিশ ঔপনিবেশিকরা ভারত থেকে ইসলামি শাসন সরিয়ে দেয়ার পরও মুসলিমরা ইস্তাম্বুলের খলীফার প্রতি অনুগত ছিল। অনেকে জিহাদ পরিচালনা অব্যাহত রেখেছিল যেমন বিখ্যাত সায়্যিদ আহমাদ শহীদ। অন্যান্যরা বিশেষ করে ইয়াগিস্তানের (আফগানিস্তানের পূর্বে পশতুন উপজাতীয় অঞ্চল, সংযুক্ত হেয়াট, কান্দাহার, কাবুল, গাজনী ও কাবুল যা বৃটিশ শাসনামলে ভারতবর্ষের অন্তর্ভুক্ত ছিল) আলেমগণ ঔপনিবেশিকদের বিরূদ্ধে জিহাদ পরিচালনা ও সংগঠিত করেছিলেন।

গ্রীক-তুর্কী যুদ্ধের ফলাফল যখন উসমানী খিলাফতের পক্ষে এসেছিল, তখন ভারতের মুসলিমেরা মওলানা আব্দুল বারীর নেতৃত্বে লাখনৌতে একটি সৌজন্য বৈঠক করে সুলতানকে অভিনন্দন জানিয়েছিল। ঠিক তেমনিভাবে খিলাফত যখন বলকান এবং ত্রিপোলী যুদ্ধে দূর্বল হয়ে পড়েছিল, তখন মুসলিমেরা পশ্চিমা শক্তির খিলাফতকে দূর্বল করে দেয়ার ষড়যন্ত্রের বিরূদ্ধে গর্জে উঠেছিল।

মওলানা মুহাম্মদ আলী জওহর, যিনি খিলাফতের পক্ষের একজন অবিসংবাদিত কর্মী এবং বৃটিশ বিরোধী অবস্থানের জন্য সুপরিচিত, তিনি বৃটেনের লিংকন কলেজ থেকে মাত্র স্নাতক শেষ করে ফিরেছিলেন। ১৯১৪ সালে লন্ডন টাইমসে প্রকাশিত একটি অনুচ্ছেদের প্রতিউত্তরে তিনি ছত্রিশ ঘন্টা বৈঠকের সম্পাদকীয় ‘The Choice of Turks’ লিখেছিলেন। ১৯১২ তে বলকান যুদ্ধ শুরু হলে তিনি অর্থ যোগানের সনির্বন্ধ আবেদন করেছিলেন এবং তুর্কীর ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য একটি মেডিকেল মিশন প্রেরণ করেছিলেন।

ভারতের সুপ্রসিদ্ধ ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়, দারুল-উলুম-দেওবন্দের প্রধান, শাইখ-উল-হিন্দ মওলানা মাহমুদ হাসান, বলকান ও ত্রিপোলী যুদ্ধে খিলাফতের সাহায্যার্থে অর্থ-সংগ্রহের জন্য বিরামহীনভাবে কাজ করেছিলেন। মওলানা হোসাইন আহম্মদ মাদানী তাঁর সম্পর্কে লিখেছেন, “বলকান ও ক্রিপোলীর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ মওলানা মাহমুদ হাসানের মনে ও হৃদয়ে দুঃখের ছাপ ফেলেছিল। এটিই তাঁকে তার পূর্বসূরী মওলানা কাসিম নানুতভির (যিনি দারুল-উলুম-দেওবন্দের সহকারী প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন এবং সোভিয়েত-তুর্কী যুদ্ধে খিলাফতের পক্ষে সহযোগীতা করেছিলেন) দেখিয়ে দেওয়া পথে পরিচালিত করে। মওলানা মাহমুদ হাসান ইসলামের স্বার্থে আত্মনিয়োগ করেছিলেন এবং উসমানী সাম্রাজ্যের পক্ষে সম্ভাব্য সকল সাহায্য বৃদ্ধি করেছিলেন। তিনি দারুল-উলুম-দেওবন্দ বন্ধ রাখার ফতোয়া দিয়েছিলেন, উসমানী সাম্রাজ্যের জন্য অর্থ সংগ্রহ করেছিলেন, তুর্কীতে ছাত্র প্রতিনিধি পাঠিয়েছিলেন, নিজেই একটি প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। এরপরও তিনি উসমানী সাম্রাজ্যকে তাঁর পক্ষ থেকে দেয়া সাহায্যে সন্তুষ্ট ছিলেন না। এর মূল কারণ ছিল বলকান যুদ্ধের ফলাফল যা তাঁর মত মুসলিম স্বপ্নদর্শীদের বিচলিত করে দিয়েছিল। তাঁরা জানতেন যে ইউরোপের শ্বেতাঙ্গরা ইসলামের মশাল থেকে বিচ্ছুরিত আলো নিভিয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্র করছে। তার উপর মিঃ স্কুইবদের মত বৃটিশ শাসকদের বিশ্বাসঘাতকতা, মুসলিমদের উপর রাশিয়ার পরিচালিত নৃশংসতা এবং তুর্কীর বিভাজন এই বিশ্বাসকে আরো পাকাপোক্ত করেছিল যে, বহুদিনের প্রতিপালিত গ্ল্যাডস্টোনের স্বপ্ন বাস্তবায়নের সময় শ্বেতাঙ্গদের চলে এসেছে।” [Naqsh-E- Hayat, Vol.2, pg.140]

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়, কুফর শক্তির ধ্বংস কামনা করে, (তুরস্কের) সুলতান ও তাঁর আর্মির সফলতার জন্য আল্লাহর নিকট সাহায্য প্রার্থনা করে ভারতের মসজিদগুলোর খুতবা উষ্ণ দোয়ায় প্রতিধ্বনিত হতো। যখন মওলানা শওকত আলী, যিনি এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন, যখন তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল কেন তিনি তুরস্কের সুলতানের নামে খুতবা পড়েছিলেন, তিনি উত্তরে বলেছিলেন, “তোমরা আমাকে দোষ দিতে পারো না যদি ইসলামের খলীফা একই সাথে তুর্কীর সুলতানও হয়।” [The Khilafat Movement, Gail Minault, Oxford University Press, 1982, p.55]

খিলাফত রাষ্ট্র ভারতের মুসলিমদের এই প্রচেষ্টাকে স্বীকৃতি দিয়েছিল এবং তাদের একে (খিলাফতকে) সাহায্য করতে ও বৃটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে আহ্বান করেছিল।

খিলাফত রাষ্ট্রের রাজধানী ইস্তাম্বুল থেকে আরবী সংবাদপত্র ‘আল-জাওয়াইত’ প্রকাশিত হত। এই ‘আল-জাওয়াইত’ এর পরিচালক ভারতের দারুল-উলুম-দেওবন্দের ছাত্রদের জন্য একটি ‘শুভেচ্ছা কপি’ পাঠিয়েছিলেন যা ইস্তাম্বুল থেকে প্রায় আট হাজার মাইল দূরে [Saweaneh Qasmi, Vol.2, p.329]

শাইখুল হিন্দ মওলানা মাহমুদুল হাসান যার কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, খিলাফতের প্রত্যক্ষ সমর্থক ছিলেন এবং তা রক্ষার জন্য জোর প্রচেষ্ঠা চালিয়েছিলেন। তিনি হিযাজে ভ্রমন করে মক্কায় নিযুক্ত খিলাফতের ওয়ালী (গভর্নর) ও খলীফার সহকারীদের সাথে সাক্ষাত করেছিলেন। উক্ত ওয়ালী বৃটিশদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে ভারতের মুসলিমদের আন্দোলনের সহযোগীতার স্বার্থে শায়খের হাতে কিছু নথিপত্র দিয়েছিলেন। ভারতের মুসলিমদের উদ্দেশ্যে ওয়ালীর এক আবেদন এই নথিপত্রের মধ্যে অন্যতম ছিল। উক্ত আবেদনে মক্কার ওয়ালী শাইখুল হিন্দকে ঔপনিবেশিক বৃটিশদের বিরূদ্ধে আন্দোলনের জন্য সাধুবাদ জানিয়েছিলেন এবং ভারতের মুসলিমদেরও একে পূর্ণ সমর্থনের দেবার জন্য উৎসাহ দিয়েছিলেন। এছাড়াও তিনি ভারতীয় মুসলিমদের আন্দোলনে খিলাফত কর্তৃক সকল ধরনের পার্থিব সহযোগীতার আশ্বাস দিয়েছিলেন। মক্কার গর্ভনরের লিখিত এই নথিপত্র ইতিহাসে ‘গালিব নামা’ নামে খ্যাত। এছাড়াও শায়খ ১৩৩৪ হিজরীতে হজ্জ্ব পালনের পর আনোয়ার পাশা ও জামাল পাশার সাথেও সাক্ষাত করেন, যারা খিলাফত রাষ্ট্রের কর্মকর্তা ছিলেন। আনোয়ার পাশাও বৃটিশদের বিরুদ্ধে ভারতের মুসলিমদের অবিরত আন্দোলনের প্রশংসা করে একটি আবেদন পত্র লিখেন। এই পত্রের লেখাগুলো গালিব নামার সাথে মিল ছিল, যেমন বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে উসমানী খিলাফতের পক্ষ থেকে ভারতের মুসলিমদের পার্থিব সহযোগীতার নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছিল। এছাড়াও উক্ত পত্রে উসমানী খিলাফতের সকল নাগরিক ও কর্মচারীদের শাইখুল হিন্দের প্রতি পুর্ণ আস্থা রাখতে ও পার্থিব সহায়তা প্রদানের উৎসাহ দেয়া হয়েছিল। এ পত্রসমূহ বৃটিশ গোয়েন্দা সংস্থার শত বাধার মূখে গোপনে ভারতে পাচার করা হয়েছিল এবং পরবর্তীতে সমগ্র ইয়াগিস্তান জুড়ে বিলি করা হয়েছিল। [The prisoners of Malta (Asiran-e-Mallta), Maulana Syed Muhammad Mian. jamiat ulama –I-Hind]

ভারতের মুসলিমরা শরীফ হোসাইনের বিশ্বাসঘাতকতা ও বৃটিশদের সহযোগিতায় (খিলাফতের বিরুদ্ধে) তার বিদ্রোহের ব্যাপারে সচেতন ছিল। তারা বৃটিশ কর্তৃক হিযাজ অঞ্চলের খাদ্য রসদ সরবরাহ বন্ধের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিল।

কর্নেল টি. ই. লরেন্স কর্তৃক ছড়ানো প্রপাগান্ডা, তার চটকদার ও আবেগপ্রবণ আরবী বক্তৃতা এবং শরীফ হোসেন ও হেনরী মেকমোহান কর্তৃক সম্পাদিত গোপন চুক্তি সত্ত্বেও, হিযাজ অঞ্চলের সাধারণ নাগরিক তুর্কীদের বিপরীতে সংগঠিত বিদ্রোহের বিরূদ্ধে ছিল না। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য বৃটিশ সরকার খুবই অমানবিক ও একটি নিষ্ঠুর ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নিয়েছিল। শাইখুল ইসলাম মওলানা হুসাইন আহমাদ মাদানী বিষয়টি এভাবে বর্ণনা করেছেন: “হিযাজে খাদ্য সরবরাহ বন্ধ কর দেয়া হযেছিল। জাহাজযোগে হিযাজে শেষ খাদ্য চালানটি পৌঁছেছিল ১৩৩৪ হিজরীর সফর মাসে। যেহেতু খাদ্য সরবরাহ বন্ধ ছিল, মূল্য বৃদ্ধি পেল এবং মানুষ অনাহারে মরতে লাগল ভারতের মুসলিমদের আন্দোলনের দরূণ, ১৩৩৪ হিজরীর জমাদিউল-সানী মাসে ফায়রোজী আগানবোট কয়েক হাজার বস্তা চাউল নিয়ে কলকাতা ছেড়ে যায়। কিন্তু তাও জোরপূর্বক এডেন বন্দরে খালাস করা হয়। এটি শুধুমাত্র তখনই জেদ্দায় পৌঁছানোর অনুমতি দেয়া হয়, যখন হিযাজ থেকে উসমানী সাম্রাজের প্রভাব সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হয়েছিল।” [The Prisoners of Malta (Asiran-e-Malta), Maulana Syed Muhammad Mian, Jamiatul-I-Hind, English Edition, P.45]

পূর্বে উল্লিখিত হয়েছে, দারুল উলুম দেওবন্দের প্রধান, শাইখুল হিন্দ, মওলানা মাহমুদ হাসান তাঁর সত্যের প্রতি অবিচলতা ও উসমানী খিলাফতের সমর্থন বর্জন না করার দরূন বৃটিশ কর্তৃক মাল্টায় বন্দী ছিলেন। বৃটিশরা চেয়েছিল তাঁর দ্বারা উসমানী খিলাফত বর্জন করতে এবং শরীফ হোসেনকে সমর্থন করে একটি ফতোয়া জারি করতে। শাইখুল হিন্দ ১৩৩৫ হিজরীর ২৩ সফর হিযাজে (মক্কায়) বিশ্বাসঘাতক শরীফ হোসেন কর্তৃক গ্রেফতার হন। তিনি এবং অন্যান্য অনেক আলেমকে ১৩৩৫ হিজরীর ২৯ রবিউল সানী (২১ ফেব্রুয়ারী, ১৯১৭) একটি জাহাজে করে কায়রো হয়ে মাল্টায় প্রেরন করা হয়। অন্যান্য ভারতীয় উলামাদের মধ্যে ছিলেন মওলানা হুসাইন আহমদ মাদানী, মওলানা আজিজ গুল, মওলানা হাকিম নূসরাত হুসেন ও মওলানা ওয়াহিদ আহমেদ যাদের প্রত্যেককেই বৃটিশরা কারাগারে চাপ সৃষ্টি করেছিল। মওলানা মাহমুদ হাসান ৩ বছর ৪মাস জেলবন্দী ছিলেন। তিনি ১৯২০ সালের ৪ঠা জুলাই মুক্ত হয়ে বোম্বে ফিরে আসেন। এই সময়টি মালটা থেকে ফিরে আসার পাশাপাশি ছিল খিলাফত আন্দোলনের সূচনালগ্ন। [The Prisoners of Malta (Asiran-e-Malta), Maulana Syed Muhammad Mian, Jamiat ulama-I-Hind]

১৩২১ হিজরীতে নিজারাতুল মারিফ (কুরআন শিক্ষা একাডেমী) প্রতিষ্ঠিত হয়। মুজাহিদ মওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধির নেতৃত্বে যার উদ্দেশ্য ছিল মুসলিম চিন্তাবিদ তৈরী করে ইসলাম বিরোধী প্রচারণার বিরূদ্ধে রুখে দাঁড়ানো এবং ইসলামি চিন্তা ছড়িয়ে দেয়া। বৃটিশরা এই হুমকির প্রভাব বুঝতে পেরেছিল। যা বৃটিশ সরকারের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা বিভাগ (CID) কর্তৃক প্রকাশিত রিপোর্টে দেখা যায়। যার শিরোনাম ছিল (The Petition of British Queen Vs Maulana Obaidullah Sindhi), সেখানে বলা হয়েছে-

“মওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধী দারুল উলুম দেওবন্দকে তাঁর মুজাহিদদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারছিলেন না। এই লক্ষ্যে তিনি দিল্লীতে একটি মাদরাসা (নিজারুতুল মা’আরিফ) প্রতিষ্ঠা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ………… যা এটির নাম থেকে স্পষ্ট, মাদ্রাসাটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল কুরআনের ব্যাখ্যা ও সঠিক দৃষ্টিকোণ থেকে তা শিক্ষা দেয়ার জন্য। এটি আরবী ভাষাও শিক্ষা দিত।” (The Petition of British Queen Vs Maulana Obaidullah sindhi, Section 17)

“নিজারাতুল মারিফ এর এই শিক্ষাদানের পাশাপাশি, যা ছিল বেআইনী, এটি ষড়যন্ত্রকারীদের গোপন সাক্ষাতস্থান হিসেবেও ব্যবহৃত হত।” [The Petition of the British Queen vs Maulana Obaidullah Sindhi, Section 20]

বৃটিশরা এই বিষযটির প্রতি ইঙ্গিত করছিল যে নিজারাতুল মারিফ মুসলিম বিদ্রোহীদের সাক্ষাত স্থান ও কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল, যারা ভারতে বৃটিশ সরকারের শাসন উৎখাত করতে চেয়েছিল। এদের মধ্যে ছিল হাকীম আজমল খান, ড. মুখতার আহমদ আনসারী, মওলানা শওকত আলী, মওলানা মুহাম্মাদ আলী জওহর, মওলানা জাফর আলী খান ও মওলানা আবুল কালাম আজাদ।

মুসলিম আলেমগণ, চিন্তাবিদ ও মাঠকর্মীগণ বিদেশি পণ্য বয়কট ও বৃটিশ সরকারের সাথে অসহযোগিতার আহ্বান জানিয়েছিল। এই ইস্যুগুলোকে সমর্থন করে জনগণকে জড়ো করার লক্ষ্যে বৈঠকাদির আয়োজন করা হতো। এই বৈঠকগুলো পরিচালিত হতো ‘মু‘তামার আল-আনসার’ (The Workers Conference) নামক ব্যানারে এবং বিভিন্ন পত্রিকায় তা প্রকাশিত হত যেমন মওলানা আবুল কালাম আজাদ পরিচালিত আল-হিলাল ও মওলানা মোহাম্মদ আলী জওহর পরিচালিত ‘দ্যা কমরেড’ পত্রিকায়। মাওলানা আবুল কালাম আজাদ ও মওলানা মুহাম্মদ আলী জওহর উভয়কেই সংবাদপত্রে বৃটিশ বিরোধী প্রবন্ধ ছাপার দরুণ কারারূদ্ধ করে রাখা হয়েছিল। শেষের জন ১৯১১ থেকে ১৯১৫ খৃঃ পর্যন্ত চার বছর জেল খেটেছিলেন।

ভারতের মুসলিম চিন্তাবিদগণ (Intelligentsia) খিলাফত রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য ছিল প্রশ্নাতীত। মওলানা আবুল কালাম আজাদ ১৯১২ সালের ৬ই নভেম্বর তাঁর আল-হিলাল পত্রিকায় তাঁদের দর্শন সমূহের সারসংক্ষেপ তুলে ধরে লিখেছিলেন যে, উসমানী সুলতানই মুসলিমদের নিরাপত্তার সর্বশেষ তরবারী ধারণ করেন। এতদূর পর্যন্ত লিখেছিলেন যে, “খিলাফত মূলত শরীআহকে ধর্মীয় সমগ্রতা প্রদানকারী (শক্তি)” এটি “ওহীর মাধ্যমে জরুরী হয়ে পড়েছে যে, এটি আল্লাহর প্রতিষ্ঠান এবং এর কর্তৃত্বের প্রতি আনূগত্য ফরয বা ইতিবাচক নির্দেশনা।”

খিলাফত আন্দোলন:১৯১৯ সালের সেপ্টেম্বরে, মওলানা মুহাম্মদ আলী ও তাঁর ভাই শওকত আলী, মওলানা আবুল কালাম আজাদ, ড. মুখতার আহমেদ আনসারী ও হাসরাত মোহানী সহ খিলাফত আন্দোলন (১৯১৯-১৯২৪) নামে একটি নতুন সংগঠনের যাত্রা শুরু করেন। খিলাফত রক্ষায় সাধ্যানুযায়ী যেকোনো সুযোগের সদ্ব্যবহার করা তাদের সংকল্পবদ্ধ লক্ষ্য ছিল। তাঁরা ভারতে উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন শহরে খিলাফত কনফারেন্সের আয়োজন করেছিলেন। এটি লক্ষণীয় যে, খিলাফত আন্দোলনের উলামা ও কর্মীগণ বিভিন্ন মাযহাব ও প্রেক্ষাপট থেকে উঠে এসেছিলেন, উদাহরণস্বরূপ মওলানা আবুল কালাম আজাদ গায়ের তাকলীদি (যারা মাযহাবের তাকলীদ হারাম মনে করেন) হিসেবে পরিচিত এবং মওলানা মাহমুদুল হাসান ছিলেন দেওবন্দী যারা হানাফী মাযহাবের অনুসারী, তা সত্ত্বেও তাঁরা খিলাফত সুরক্ষার লক্ষ্যে একতাবদ্ধ ছিলেন।১৯১৯ সালে বোম্বে খিলাফত কমিটি দুটি গুরুত্বপূর্ণ সাংগঠনিক লক্ষ্যে একমত হয়; “প্রথমতঃ তুর্কী সুলতানের প্রতি খলীফা হিসেবে পার্থিব ক্ষমতা ধরে রাখার জোরালো দাবি জানানো, এবং দ্বিতীয়ত, ইসলামের পবিত্র ভুমিসমূহে তাঁর অব্যাহত কর্তৃত্ব সুনিশ্চিত করা।”

১৯২০ সালে বেঙ্গল প্রাদেশিক খিলাফত কনফারেন্সের কলকাতা সভায় সভাপতির বক্তব্যে মওলানা আবুল কালাম আজাদ খিলাফতের গুরুত্ব আলোচনা করে ঘোষণা দেন, “এই প্রতিষ্ঠানের (খিলাফতের) লক্ষ্য হচ্ছে মুসলিম জাতিকে সঠিক পথে সংগঠিত করা ও নেতৃত্ব দেয়া, ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা, শান্তি ফিরিয়ে আনা এবং আল্লাহর বাণীকে পৃথিবীতে ছড়িয়ে দেয়া। এই সকল বিষয়ের জন্য খলীফার পার্থিব কর্তৃত্ব টিকিয়ে রাখা অত্যাবশ্যক।” মওলানা আযাদের এই ব্যাপারে কোন কোন সন্দেহ ছিল না যে, “একজন ইমাম ব্যতীত তাদের জীবন অনৈসলামিক হয়ে পড়বে এবং মৃত্যুর পরে তারা ক্ষতিগ্রস্থ হবে।”

মওলানা আযাদ ১৯২০ সালে মাসআলা-এ-খিলাফত (খিলাফতের মাসাআলা সমূহ) নামে একটি বই প্রকাশ করেন যেখানে তিনি বলেন, “খিলাফত ছাড়া ইসলামের অস্তিত্ব সম্ভব না তাই ভারতের মুসলিমদের উচিত তাদের সমস্ত প্রচেষ্টা ও ক্ষমতা দিয়ে এর জন্য কাজ করা।”

একই বইয়ের ১৭৬ নম্বর পৃষ্ঠায় মওলানা আজাদ বলেন; “দুই ধরণের আহকাম শরীআহ রয়েছে। প্রথমটি হচ্ছে ব্যক্তি সম্পর্কিত যেমন আদেশ ও নিষেধ, ফরজ (বাধ্যতামূলক) ও ওয়াজিবসমূহ যা নিজেদের পরিপূর্ণতার জন্য। দ্বিতীয়টি ব্যক্তির সাথে সম্পর্কিত নয় বরং উম্মাহর সাথে, জাতির সাথে সম্পর্কিত, সামষ্টিক বাধ্যবাধকতা এবং রাষ্ট্রের রাজনীতি যেমন ভুমি জয় করা, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নীতিমালা।”

Peter Hardy’ র মতে, মওলানা আজাদ বিশ্বাস করতেন যে, “যে মুসলিম ধর্ম ও রাজনীতিকে মুসলিমদের থেকে আলাদা করবে সে নিঃশব্দে কর্মসম্পাদনকারী মুরতাদ।”

ভারত থেকে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব হারানো ও খলীফার সমসাময়িক ক্ষমতার প্রতি যৌথ বাহিনীর হুমকি, মুসলিম জাতির নেতাদের এতটাই চিন্তাগ্রস্ত করে তুলেছিল যে, তাদের অনেকেই ভারত থেকে হিজরতের (Migration) পক্ষে ফতোয়া দেয়ার তাগিদ অনুভব করেন।

মওলানা আবুল কালাম আজাদ একটি ফতোয়া জারি করেছিলেন যা ১৯২০ সালের ৩০ জুলাই অমৃতসরের দৈনিক আহল-এ-হাদীস এ প্রকাশিত হয়েছিল। উক্ত ফতোয়ায় তিনি বৃটিশদের বিরুদ্ধে অসহযোগের বিকল্প হিসেবে ভারত থেকে হিজরতের জোর দাবি জানিয়েছিলেন ।

মওলানা আব্দুল বারী তাঁর ফতোয়ায় বলেছিলেন, “প্রত্যেক মুসলিম যারা এখানে বসবাস করছেন তাদের অসহযোগে সংযুক্ত হওয়া উচিত। আর তা যদি সম্ভব না হয় তবে হিজরত করা উচিত।” মওলানা শওকত আলী কেন্দ্রীয় খিলাফত কমিটির পক্ষে একটি ফতোয়া জারি করেন, যেখানে প্রত্যেক নিষ্ঠাবান মুসলিমকে ভারতে অবস্থান করার এবং অসহযোগের জন্য কাজ করার আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়। শুধুমাত্র এটি সম্ভব না হলেই তারা হিজরতের ব্যাপারটি আমলে নিতে পারেন। এই ফতোয়ার চমৎকার প্রভাব তৈরি হয়েছিল এবং হাজার হাজার মুসলিম ভারতের দার-উল-হারব ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, যেহেতু তুর্কী খলিফার পদ যা তাদের ধর্মীয় অধিকার হিসেবে চিহ্নিত ছিল, তা খর্ব হয়েছিল।”

খিলাফতের প্রশ্নটি শুধু একটি রাজনৈতিক প্রশ্নই ছিল না বরং এই ব্যাপারটি ছিল মুক্তি অথবা ধ্বংসের” প্রশ্ন। তুর্কী যদি শাসনাঞ্চল হারায়, ইসলাম মতাদর্শ হিসেবে হুমকির মুখে পড়বে।

মওলানা শওকত আলী এই অনুভূতির পক্ষেই ১৯২৩ সালের ২৭ ডিসেম্বর সমগ্র ভারত খিলাফত কনফারেন্সের দশম অধিবেশনে তার সভাপতি বক্তব্যে বলেছিলেন, “যতক্ষণ পর্যন্ত জাজিরাত-উল-আরব এর এক ইঞ্চি ভূমিও অমুসলিমদের প্রভাবে রয়েছে, একজন মুসলিমের অন্তরে শান্তি থাকতে পারে না। [The Indian Muslims, Shan Muhammad, Meenakshi Prakashani, 1981, Vol. VII; p.209]

মোহাম্মদ আসাফ আলী কর্তৃক ১৯২১ সালের ২রা নভেম্বর ‘কমরেড’ পত্রিকার সম্পাদককে লিখিত একটি চিঠিতে খিলাফতের ইসলামি বাধ্যবাধকতার বিষয়টি চিহ্নিত করা হয়,” তুরস্কের সম্মান ইসলামের সম্মানের সাথে সমার্থক, উসমানী সাম্রাজ্যের অস্ত্বিত্ব মুসলিম জাতির পার্থিব উন্নতির জন্য আবশ্যক …. উসমানী সাম্রাজ্য বিলুপ্তির সাথে সাথে সভ্যতা হিসেবে ইসলামের শক্তি হারিয়ে যাবে… তুরস্কের পতন ঘটলে ইসলাম দাঁড়াতে পারবে না। তাই তুরস্কই হচ্ছে ইসলামের মেরূদন্ড।” মওলানা মুহাম্মদ আলী এই দৃষ্টিভঙ্গিকে সমর্থন দিয়েছিলেন যিনি গুরুত্বারোপ করেছিলেন যে তা সাধারণ মুসলিমদের মতকে প্রতিফলিত করে।

১৯১৯ সালের ২৬ জানুয়ারী লক্ষনৌতে ফিরাঙ্গী মহলের পৃষ্ঠপোষকতায় আঞ্জুমান মুইদ-উল-ইসলামের সভায় সমাধানস্বরূপ বলা হয়: “ফিরাঙ্গী মহলের আলেমদের এই সভায় সুলতান মুহাম্মদ ষষ্ঠ-এর প্রতি একনিষ্ট ও সচেতন আনুগত্যের পাশাপাশি জোরালোভাবে এ ঘোষণা দিচ্ছে যে সঠিক ইসলামি বিশ্বাস অনুযায়ী, বর্তমান তুর্কী সুলতানই হচ্ছে আইনসম্মত খলীফা এবং (আলেমগণ) এও ঘোষণা দিচ্ছে যে, ইসলাম কখনই খিলাফতের প্রশ্নে অমুসলিমদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে না।

প্রকৃতপক্ষে, সৈয়দ সুলাইমান নদভীর মতো সেসময়কার অনেক আলেমই খিলাফত থাকার বাধ্যবাধকতার ব্যাপারে জোর দিয়েছেন। মওলানা নদভী বলেন: “…….অন্যান্য বিশিষ্ট কর্তৃপক্ষের মধ্যে আল্লামা নাসাফী, ইমাম রাজি, কাজী উযুদ, এই ব্যাপারে তাদের বইগুলোতে বিশদ আলোচনা করেছেন এবং উক্ত ব্যাপারে সর্বশেষ কর্তৃপক্ষ ধরে নেয়া উচিত। রাসূলুল্লাহ (সা) হতে একটি নির্ভরযোগ্য সূত্রে সহীহ মুসলিমে সুষ্পষ্ঠভাবে ঘোষণা দেয়া হয়েছে যে, কোন মুসলমান যদি তার সময়ের ইমামকে স্বীকার করা ব্যতীত মৃত্যুবরণ করে তাবে সে কাফেরের মতো অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে।” [The Muslim outlook march 1920]

মওলানা মুহাম্মদ আলী ১৯২০ সালে প্যারিসে একটি বক্তৃতায় বলেন, “খিলাফত হচ্ছে সমগ্র বিশ্বের মুসলিম জাতির জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। মুসলিম বিশ্বের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী তুরস্কের সুলতানকে ঈমানদারদের নেতা ও তাদের নবীর খলীফাদের উত্তরসূরী হিসেবে মেনে দিয়েছে। এই বিশ্বাসের গুরুত্বপূর্ণ এক অংশ এই যে খলীফার, যিনি বিশ্বাসীদের নেতা, অবশ্যই পর্যাপ্ত পরিমাণ সীমানা, পর্যাপ্ত পরিমাণ সামরিক ও নৌ সম্পদ এবং পর্যাপ্ত পরিমাণ অর্থনৈতিক সম্পদ থাকতে হবে।”

সৈয়দ হুসেইন যিনি প্যারিস-এর সভায় মুহাম্মদ আলীর সাথে একই মঞ্চে উপবিষ্ট ছিলেন বলেছেন, “যদি পৃথিবীতে ইসলাম টিকে থাকতে হয়, তবে এটি অত্যাবশ্যক যে ইসলামের অবশ্যই একটি খিলাফত থাকবে। যেটি চৌদ্দশ বছর পূর্বে যখন থেকে ইসলামের ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে তখন থেকেই তা ইসলামের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অংশ হয়ে আছে।”

মওলানা মুহাম্মদ আলী জওহর আরও বলেন, “তুর্কী সুলতান ছিলেন খলীফা বা নবীর উত্তরসূরী এবং আমির উল-মুমিনীন বা বিশ্বাসীদের নেতা, এবং খিলাফত আমাদের সেইরূপ গুরূত্বপূর্ণ ব্যাপার ঠিক যেমনি কুরআন কিংবা নবীর সুন্নাহ। “[My life a Fragnent, Mohammed Ali Johar, pg.41]

বস্তুতঃ আলেমগণ খিলাফত আন্দোলনে নেতৃত্বস্থানীয় ভুমিকা নিয়েছিলেন। নিম্নোক্ত কিছু গুরুত্বপূর্ন দফা যা ১৯২০ সালের ৫ ও ৬ ই এপ্রিল ভারতের উলেমাদের জন্য অনুষ্ঠিত কনফারেন্সের ঘোষণা থেকে নেয়া হয়েছে, যেখানে অনেক উলেমাই অংশগ্রহণ করেছিলেন:

ঘোষিত দফা ১: আলেমদের অবশ্যই খিলাফত বিষয়ে জনমত প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

দফা ২ : কপটাচারি (মুনাফিক) আলেম এবং এই বিষয়ের বিরুদ্ধবাদী আলেমদের বয়কট করতে হবে।

দফা ৭ : উলেমাদের অবশ্যই তাদের অনুসরণকারীদের নিকট থেকে প্রতিজ্ঞা নিতে হবে যে, তারা খিলাফতের বিষয়ে বলতে ও লিখতে গিয়ে তাদের মন-প্রাণ উৎসর্গ করবেন।

দফা ৯ : মুসলিমদের অবশ্যই সাংবিধানিক নির্বাচন থেকে দূরে থাকতে হবে।

১৯২০ সালের ১৯ ও ২০ নভেম্বর দিল্লীতে অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত সম্মেলনে জামিয়াত আল উলেমা হিন্দ কর্তৃক ঘোষিত নিম্নোক্ত কয়েকটি দফা থেকে খিলাফতের ব্যপারে তাদের সমর্থনকেও তুলে ধরে:

– ইংরেজরা ইসলাম এবং মুসলিমদের সবচেয়ে বড় শত্রু এবং তাদের বিরুদ্ধচারন করা ফরয।

– উম্মাহর নিরাপত্তা দেয়া এবং খিলাফতের নিরাপত্তা দেয়া একটি পবিত্র ইসলামি জরুরত। যদি এই দেশের ভাইয়েরা এই ব্যাপারে সাহায্য ও সহযোগীতা করেন, তাদেরকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

শাইখুল হিন্দ মওলানা মাহমুদ হাসান, দারুল উলুম দেওবন্দের প্রধান, যার কথা এর আগে উল্লেখ করা হয়েছিল, তিনি ১৩৩৮ হিজরীর ২০ রমযান জেল থেকে মুক্তি পেয়ে বোম্বে ফিরে আসেন। ফিরে আসার পর তিনি একনিষ্টভাবে খিলাফত আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। তাঁর উত্তরসূরী মওলানা হুসাইন আহমাদ মাদানী লিখেছেন, “জেল ও নির্বাসনের কষ্ট সহ্য করে যখন হযরত শাইখুল হিন্দ রহমতুল্লাহ আলাইহি ভারতে ফিরে আসলেন, আমরা তাঁর বৃটিশদের প্রতি ঘৃণা ও উপনিবেশিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রতি স্পৃহার কোনো কমতি দেখতে পেলাম না। দেশে জারি করা মার্শাল আইন, দেশের অভ্যন্তরে রওলাট অ্যাক্ট কার্যকরণ ও জালিয়ানওয়ালাবাগ গণহত্যা, উসমানী খিলাফতের বিভাজন এবং ভারতের বাইরে তুর্কীদের সাথে অমানবিক ব্যবহার তাঁকে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত করেছিল। তিনি বোম্বেতে পা রাখা মাত্রই মওলানা শওকত আলী এবং খিলাফত কমিটির অন্যান্য সদস্যদের সাথে সাক্ষাত করেন। ফিরাঙ্গী মহল, লক্ষনৌ-এর মওলানা আব্দুল বারী এবং আহমেদাবাদ থেকে মহাত্মা গান্ধী শাইখুল হিন্দ মওলানা মাহমুদ হাসানকে বোম্বেতে গ্রহণ করতে এসেছিলেন। তাঁদের সাথে এবং খিলাফত কমিটির অন্যান্য নেতৃবৃন্দের সাথে প্রকাশ্যে ও নির্জনে আলোচনার পর, শাইখুল হিন্দও ভারত মুক্তির দাবীতে অহিংস আন্দোলন শুরু করার পক্ষে মত দিয়েছিলে।” [Naqsh-e-Hayt, Vol.2,p.247]

শায়খের একটি ফতোয়ার বইতে খিলাফত রাষ্ট্রের উপনিবেশিকদের প্রতি সহযোগীতার বিষয়টি উঠে আসে। যদিও তা ১৯২০ সালে ইস্যু করা হয়েছিল তাঁর উল্লেখিত অনেক দফাই আজ অবধি প্রয়োগযোগ্য। তিনি বলেন:

“ইসলামের শত্রুরা ইসলামের বিরূদ্ধে আঘাত হানতে এবং ইসলামের সম্মান ও মর্যাদা ক্ষুন্ন করতে কোনো কিছু করাই অবশিষ্ট রাখেনি। ইরাক, ফিলিস্তিন ও সিরিয়া যা রাসূলুল্লাহ (সা) এর সাহাবা এবং তাঁদের অনুসারীদের দ্বারা বিজিত হয়েছিল, আজ আবার ইসলামের শত্রুদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে । খিলাফতের মার্যাদা ছিঁড়ে টুকরো করে ফেলা হয়েছে। খলীফাতুল-মুসলিমীন (মুসলিমদের খলীফা), যিনি এই গ্রহে সকল মানুষকে একতাবদ্ধ রাখবেন, যিনি এই পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধিত্বস্বরূপ ইসলামের বিশ্বজনীন আইন বাস্তবায়ন করবেন, যিনি মুসলিমদের অধিকার ও স্বার্থের নিরাপত্তা দিবেন। যিনি এই বিশ্বে আল্লাহর বাণীর মহিমা অক্ষুন্ন রাখবেন এবং বাস্তবায়ন সুনিশ্চিত করবেন, আজ শত্রুদের দ্বারা পরিবেষ্টিত এবং তাঁকে আজ অপ্রয়োজনীয় করে তোলা হয়েছে…………ইসলামের পতাকা আজ নিচুতে উড়ছে। হযরত আবু উবাইদা (রা) সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাস (রা), খালিদ বিন ওয়ালীদ (রা) এবং আবু আইয়ুব আনসারী (রা)-এর আত্মারা আজ অস্থির। কেন তা হল? এর কারণ মুসলমানরা তাদের সম্ভ্রম, মর্যাদা ও আত্মসম্মান হারিয়ে ফেলেছে। সাহসিকতাও ধর্মীয় শক্তিমত্তা ছিল যাদের দূর্গ ও উত্তরাধিকার তারা তা আজ হারাতে বসেছে তাদের অজ্ঞতা এবং অতিমাত্রায় অবহেলার দরুণ।

বিষয়টি শুধু এই নয় যে এক মুসলিম কষ্টের সময় আরেক মুসলিম ভাইকে সাহায্য করছে না। বরং দুঃখজনকভাবে, সুনাম কুড়ানো ও কাফিরদের সাথে বন্ধুত্বের অর্জনের আকাঙ্ক্ষা এক ভাইকে আরেক ভাইয়ের মাথা কাটতে ঠেলে দিয়েছে। মুসলিম মুসলিমের রক্ত পান করছে। মুসলিমগণ তাদের নিজেদের ভাইদের রক্তে হাত রঞ্জিত করছে।

হে ইসলামের সন্তানেরা! এবং হে মহান এ জাতির প্রেমিকেরা। তোমরা আমার চেয়ে ভালো জানো, যেই গর্জন ও আগুন ইসলামি বিশ্বের তাঁবুগুলোকে জ্বালিয়ে দিয়েছে এবং ইসলামি খিলাফতের দূর্গে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে তা নির্গত হয়েছে আরব ও ভারতীয়দের তাজা রক্ত থেকে। যে সম্পদের ক্ষমতাবলে খ্রিষ্টানরা মুসলিম জাতিকে আয়ত্তে আনতে সমর্থ হয়েছে তার একটি বৃহৎ অংশ তোমাদের কঠোর পরিশ্রমের ফসল।

তাই কোনো নির্বোধ ও মাথামোটা মুসলিম কি থাকতে পারে যে বুঝে না খৃষ্টানদের সহযোগীতার ফলাফল কী ? এবং এটাও কি বুঝে না যে, একজন ডুবন্ত মানুষ যদি একটি খঁড়কুটোকে আঁকরে ধরে এবং সহযোগীতার পথ খুঁজতে থাকে তবে কি তা তাকে ডুবে যাওয়া থেকে বাঁচাতে পারবে? “ [From the Fatwa of Maulana Mahmood Hossan on 16th Safar 1339 Hijri, Corresponding to October 29th 1920 Gregonina year, The Prisoners of Malta (Asira’n-E-Malta), Maulana Syed Muhammad Mian, Jamiat ulama-I-Hind. English edition p.78-79]

যেভাবে আজকের উলেমাদের মধ্যে কেউ কেউ রাজনীতি ও ইসলামকে আলাদা বলতে চান তাদের মত নয়, বরং তৎকালীন উলেমারা বুঝতে পেরেছিলেন যে এই দুটি বিষয় ওতপ্রোতভাবে জড়িত। খিলাফত ধ্বংসের মাত্র কিছুকাল পূর্বে ১৯২৩ সালের ২৪ শে ডিসেম্বর গয়া’তে জামিয়াত-উল-উলামা-হিন্দের ৪র্থ অধিভেশন অনুষ্ঠিত হয়। এই অধিবেশনে ইসলামের জ্ঞানী আলেম ও শিক্ষকেরা ভারতের সকল অংশ থেকে একত্রিত হয়ে মুসলিম উম্মাহর রাজনৈতিক ভবিষ্যতের প্রশ্নে বিস্তারিত আলোচনা করেছিলে। সামগ্রিক সকল তর্ক-বিতর্কের পর এই অধিবেশন সর্বসম্মত মতামত দিয়েছিল যে, রাজনীতি ও ধর্ম ইসলামের অবিচ্ছেদ্য উপাদান।

খিলাফত আন্দোলন এমনকি হিন্দুদের উপরও যেরূপ প্রভাব বিস্তার করেছিল তা দেখে বর্তমান ইন্ডিয়ার জনক, মোহনদাস করমাচাঁদ গান্ধী এতে অংশ নিয়েছিলেন এবং কেন্দ্রীয় খিলাফত কমিটির সদস্য হয়েছিলেন।

তবে ১৯২৪ সালের ৩রা মার্চ মুস্তফা কামাল আতাতুর্কের হাতে খিলাফত ধ্বংসের পর এই আন্দোলনের পতন হয়। অনেকেই তখন খিলাফতের পুনঃস্থাপন অসম্ভব মনে করে এবং বৃটিশ ঔপনিবেশিকদের থেকে ভারতকে মুক্ত করাকেই কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করতে শুরু করেন।

খিলাফত ধ্বংসের একদিন পরে মওলানা মোহাম্মদ আলী জওহর বলেছিলেন, যা ১৯২৪ সালের ৪ঠা মার্চ টাইমস পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। “এটা নির্ধারণ করা কঠিন হবে যে খিলাফতের পতন ভারতের মুসলমানদের অন্তরে ঠিক কী পরিমাণ প্রভাব ফেলবে। আমি শুধু নিশ্চিতভাবে এতুটুকুই বলতে পারি যে এটি ইসলাম ও সভ্যতা উভয়ের জন্যই ধ্বংস প্রমাণিত হবে। এই সম্মানিত প্রতিষ্ঠান যা ছিল সমগ্র মুসলিম বিশ্বে ইসলামের ঐক্যের প্রতীক, এর দমন ইসলামের (শক্তির) ভেঙে পড়ার কারন হবে………..।

তিনি কত সত্যই না বলেছিলেন। এটি ধ্বংসের পর মুসলিম বিশ্ব ঠিক তা-ই প্রত্যক্ষ করেছে, যা তিনি বলেছিলেন। আজ এটি ধ্বংসের প্রায় আশি বছরেরও বেশি সময় পরে এসে, খিলাফত আবার গণমাধ্যমগুলোর গুঞ্জনধ্বণিতে পরিণত হয়েছে যেহেতু পশ্চিমা রাজনীতিবিদ, চিন্তাবিদ ও নেতারা এর ফিরে আসার ভয়ে ভীত এবং মুসলিম উম্মাহ এর পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য ব্যাকুলভাবে আকাংক্ষিত। ২০০৬ সালের ১১ই অক্টোবর বুধবার হোয়াইট হাউসের সামনে একটি সংবাদ সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের (তৎকালীন) প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ বলেছিল, “চরমপন্থীরা মুক্তমনা লোকদের ভীতি প্রর্দশনের চেষ্টা করছে যাতে উদারপন্থী সরকারগুলোকে উৎখাত কার যায় এবং যাতে খিলাফতের বিস্তৃতি ঘটানো যায়। এর চেয়ে বেশি ঝুকির বাস্তবতা আর হতে পারে না। যা আমি আগেই বলেছি, আমরা যে পৃথিবীতে বসবাস করি, তাতে চরমপন্থী উপাদান রয়েছে যারা লক্ষ্য অর্জনের জন্য ধর্মকে ব্যবহার করে। এবং তারা চায় যাতে আমরা (তাদের পথ হতে) সরে পড়ি। তারা সরকার উৎখাত করতে চায়। তারা একটি আদর্শিক খিলাফতকে বিস্তৃত করতে চায় যার বিশ্বাসের মধ্যে স্বাধীনতার কোন ধারণার অন্তর্ভুক্তি নেই।”

পশ্চিমাদের বুঝা উচিত যেহেতু খিলাফত ইসলামের অবিচ্ছেদ্য অংশ, তাই ঘৃণা করার পরিবর্তে তাদের একে প্রণিধান করা উচিত যাতে তারা এর সাথে (প্রয়োজনীয় চুক্তিতে) আবদ্ধ হতে পারে যখন এটি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে।

ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিমরা খিলাফতের প্রয়োজনীয়তা ভুলে যায় নি। এই উপমহাদশের অনেক দল, আলেম ও চিন্তাবিদরা এটিকে ফিরিয়ে আনার আহ্বান জানাচ্ছেন। এ বিষয়টি হিযবুত তাহরীর থেকে শুরু করে পাকিস্তানে ড. ইসরার আহমেদ-এর তানজীম-ই-ইসলামি, বাংলাদেশের খিলাফত আন্দোলন ও খিলাফত মজলিস সহ বর্তমানে নিষিদ্ধ Students Islamic Movement of India (SIMI) সহ আরো অনেক আন্দোলনের এর আহ্বান থেকে পরিষ্কার।

খিলাফত আবার ফিরে আসবে এবং এর শাসন আবার ভারত উপমহাদেশকে মুক্ত করবে যা নিম্নোক্ত হাদীসসমূহ পাশাপাশি আরও হাদীস দ্বারা প্রতিষ্ঠিত।

আবু হুরায়রা থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, “তোমাদের মধ্যে একটি দল ভারতবর্ষ জয় করবে। আল্লাহ তাদের জন্য (ভারতবর্ষকে) মুক্ত করে দিবেন, এমনকি তারা এর শাসকদের শিকল পরিহিত অবস্থায় নিয়ে আসবে। আল্লাহ তাদের গূনাহসমূহ মাফ করে দিবেন- যখন তারা ফিরে আসবে (ভারতবর্ষ থেকে) তারা সিরিয়াতে ইবনে মরিয়মকে খুঁজে পাবে” [Naim b. Hammad in Al-Fitan]

ছাওবান থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, “আমার উম্মতের দুটি দলকে আল্লাহ জাহান্নাম থেকে নিরাপত্তা দিয়েছেন – একটি দল যারা ভারতবর্ষ জয় করবে এবং অন্য দলটি যারা ঈসা ইবন মরিয়মের সাথে থাকবে।” [Ahmad and An-Nasai]

আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) আমাদেরকে আজকের খিলাফত আন্দোলনে শরীক হওয়ার তৌফিক দিন, যে ভাবে আমাদের পূর্বসূরীরা অংশগ্রহণ করেছিলেন।

আবু ইসমাইল আল-বেইরভী
রমযান ১৪২৭; অক্টোবর, ২০০৬

অনুবাদ : সোহান ইয়াসির ইকবাল।

কুরআনের মতে পৃথিবী কি সমতল না গোলাকার ?

সাজিদ সিরিজ … খুবই সিরিয়াস একটি ব্যাপার নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। ঠিক আলোচনা নয়, আদতে হাসাহাসি হচ্ছে।
যারা হাসাহাসি করছে তাদের সবাই খুবই স্মার্ট। শুধু স্মার্ট নয়, ওভার স্মার্ট বলা যায়।

এরা কথায় কথায় বলে, আমরা বিজ্ঞান ছাড়া কিছুই বুঝি না। এরা উঠতে-বসতে, হাঁটতে-চলতে সবকিছুতেই বিজ্ঞানের প্রমাণ খুঁজে।

কেউ যখন তাদের বলে বিজ্ঞানের এইটা এইরকম নয়, ওইরকম, তখন তারা তেঁড়েমেড়ে এসে বলবে,- ‘বাপু, তুমি কি বিজ্ঞানী? বিজ্ঞান নিয়া পড়াশুনা আছে? ক’ ক্লাশ বিজ্ঞান পড়েছো যে বিজ্ঞান নিয়ে কথা বলতে আসছো? যাও, আগে পড়ো, পরে লেকচার দিবা।’

আবার এই তারাই অনলাইনে কিছু ছাই-পাশ পড়া মুক্তোমনা তথা নাস্তিকদের লেখা পড়ে সেটাকে এতো পরিমাণ বিশ্বাস করে যে, নিজের বাবা-মাকেও এরা অতো বিশ্বাস করে না।
এইসব নাস্তিকগুলোর অধিকাংশই এমন, যারা আরবিতে কোরআন পড়তেই জানে না।কিছু ইংরেজি অনুবাদ এবং বাংলা অনুবাদের খিস্তি উড়িয়ে বলে,- ‘কোরআনের এইটা ভুল, অইটা ভুল।কোরআনের এইটা অবৈজ্ঞানিক, অইটা অবৈজ্ঞানিক।’

লেখা পড়ে মনে হবে, এরা একেকজন বড় বড় মুফতি ছিলো একসময়। কোরআনের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এতোসব ভুলভাল দেখে তারা আজকে নাস্তিক হয়ে গেছে।
এরা আরবিতে কোরআন পড়া তো দূরে, অধিকাংশই ২৯ টি আরবি হরফ ঠিকঠাক মতো বলতেও পারবে না।

এই মূহুর্তে হাসাহাসি হচ্ছে কোরআনের পৃথিবীর আকার নিয়ে।
হাসাহাসি করছে বিপুল, সৌরভ আর নিপুণ দা।

বিপুলকে আগে জুমার নামাজে দেখতাম।এখন সে নাকি ধর্মকর্ম করছে না। বিপ্লব নিয়ে আছে। কমিউনিজম বিপ্লব। বিশ্ববিদ্যালয়ে আসলে ছেলেদের মধ্যে এমনিতেই রক্ত গরম রক্ত গরম টাইপ একটা ভাব থাকে। এই ভাবের সাথে যখন দু চারখানা মার্ক্স আর লেলিনের কিতাব যুক্ত হয়, তাহলে তো কথাই নেই। স্বপ্নের মধ্যেও তখন হেলাল হাফিজের পঙক্তি ‘এখন যৌবন যার, মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’ জপতে থাকে।

বিপুলেরও একই অবস্থা। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে কি না কি পড়েছে, এখন ইশ্বরকে অলীক কল্পনা মনে করা শুরু করেছে। অবশ্য, এর পেছনে মোক্ষম ভূমিকা পালন করেছে নিপুণ দা। ইনি কট্টর বাম।আমাকেও কয়েকবার আরজ আলি মাতুব্বরের বই-টই পড়তে দিয়েছিলো। আমি পড়ে হাসিমুখে ফেরত দিয়েছিলাম।আমার কাছ থেকে বই নেওয়ার সময় জিজ্ঞেস করলেন,- ‘কি? কি বুঝলে ভাইয়া?’

আমি ফিক করে হেসে বললাম,- ‘বুঝলাম যে, লোকটার মেণ্ট্যাল ট্রিটমেন্ট দরকার ছিলো। কিন্তু দুঃখের বিষয়, তিনি বিনা চিকিৎসায় গত হয়েছেন।’
আমার মুখ থেকে এইরকম কথা শুনে নিপুণ দা খুব চমকে গেলেন।এখন বুঝতে পারছি ইনিই বিপুল আর সৌরবের ব্রেইন ওয়াশ করেছেন।

এরা এখন যা পড়ে হাসাহাসি করছে, তা একজন ব্লগারের লেখা। ব্লগারটা হিন্দু পরিবারের।হিন্দু পরিবারের হলেও উনি নিজের ধর্মত্যাগ করে একসময় নাস্তিকতা চর্চা শুরু করেন। পেশায় একজন ইঞ্জিনিয়ার।
এই ব্লগার লিখেছেন, ‘মুহাম্মদের আল্লা কি জানতো না যে পৃথিবী গোলাকার, সমতল নয়? তাহলে মুহাম্মদের আল্লা পৃথিবীকে সমতল বললো কেনো? আসলে , কোরান কোন ইশ্বরের বাণী-টানী না। এটা স্রেফ মুহাম্মদের নিজের বানানো।

১৫০০ বছর আগে মানুষ বিশ্বাস করতো যে পৃথিবী হইলো সমতল। মুহাম্মদ তখন যা বিশ্বাস করতো, তাই লিখে দিছে আর বলে দিছে এইটা আসছে আল্লার কাছ থেইকা। হা হা হা। বোকা মুমিনগুলা এইটারে আল্লার বাণী মনে কইরা বাকুম বাকুম করতাছে।’ (নাউজুবিল্লাহ)
প্রমান হিসেবে উল্লেখ করলো এই আয়াতগুলো- ‘তিনি (আল্লাহ) তোমাদের জন্য ভূমিকে করেছেন বিছানা স্বরূপ।’- সূরা নূহ ১৯
[“And Allah has made the earth for you as a carpet (spread out)] ”

”তিনিই তোমাদের জন্য জমিনকে করেছেন বিছানা স্বরূপ। আর তাতে তোমাদের জন্য করেছেন চলার পথ।”- সূরা ত্বাহা ৫৩
[ “He Who has made for you the earth like a carpet spread out; has enabled you to go about therein by roads (and channels)….” ]

‘অতঃপর, তিনি তার জমিনকে বিস্তৃর্ণ করেছেন।’
– আন-নাজিরাত ৩০


এটা পড়ুন – অ্যান আপীল টু কমন সেন্স


আমি আর সাজিদ পাশাপাশি বসে আছি।আমার তো গা জ্বলে যাচ্ছে এদের বিদ্রুপ-ঠাট্টা দেখে।সাজিদ একদম শান্তভাবে বসে বসে এসব শুনছে। কি করে যে পারছে কে জানে।
নিপুণ দা বললো,- ‘কি সাজিদ মিয়া, তোমার কি কিছু বলার আছে এই ব্যাপারে?’
সাজিদ হাসলো।সচরাচর যেমন হাসে।এরপর বললো,- ‘দাদা, তোমরা বলে যাও।আমি নাহয় আজ শুনেই যাই।’
– ‘না না, তোমাকেও বলতে হবে। বলতে হবে তুমি কি বিশ্বাস করো, পৃথিবীটা কার্পেটের মতো সমতল? নাকি বিশ্বাস করো পৃথিবীটা গোলাকার?’- নিপুণ দা বললো।
সাজিদ বললো,- ‘আমি বিশ্বাস করি পৃথিবীটা গোলাকার।’

– ‘হা হা হা। তাহলে তো কোরানের সাথে বীপরিত হয়ে গেলো। কোরান বলছে পৃথিবীরে কার্পেটের মতো সমতল করে বিছানো হয়েছে। ইউ বিলিভ ইট?’

সাজিদ কিছু বললো না। একটু ঝেঁড়ে কেশে নিলো। এরপর বললো,- ‘দাদা, অনেকক্ষণ ধরেই খেয়াল করছি তোমরা বলছো ‘সমতল সমতল।’ আচ্ছা, কোরানের ঠিক কোন জায়গায় বলা হয়েছে পৃথিবীটা সমতল?’
নিপুণ দা বললো,- ‘আরে, কোরান বলেছে পৃথিবীকে বিছানার মতো বিছানো হয়েছে।এর মানে কি এই নয় যে, পৃথিবীটাকে সমতল বলা হয়েছে?’
সাজিদ বললো,- ‘দাদা, প্রথমেই বলে রাখি, অনুবাদ দিয়ে কোরআনকে জাষ্টিফাই করাটা ভুল। দেখো, সমতল শব্দের আরবি প্রতিশব্দ হলো ‘সাবি’ ‘আল মুস্তাবি’ এসব। কোরআন যদি সত্যিই পৃথিবীকে সমতল বলতো, তাহলে কোরআন নিশ্চই এই শব্দগুলো ব্যবহার করতো।কিন্তু কোরআন এখানে এসব শব্দ ব্যবহার করে নি।

কোরআন এখানে ব্যবহার করেছে ‘ফারাশ’ ‘বাস্বাত’ ‘দাহাহা’ এই জাতীয় শব্দ যার কোনটার অর্থই ‘সমতল’ নয়। এগুলোর অর্থ ‘কার্পেট’ বা ‘বিছানার মতো করে বিছানো’, Spread Out’. এগুলো দিয়ে কোনভাবেই বুঝায় না যে পৃথিবী সমতল।’
নিপুণ দা অনেকটাই বিদ্রুপ করে বললো,- ‘তাহলে কি বুঝায় এগুলো দিয়ে স্যার সাজিদ?’
সাজিদ বললো,- ‘Let me finish….
আমরা কোরআনের সেই আয়াতে চলে যাই, যেটা নিয়ে তোমাদের আপত্তি। যেটাতে নাকি বলা হচ্ছে পৃথিবী সমতল। আয়াতটি হলো- ‘তিনিই তোমাদের জন্য জমিনকে করেছেন বিছানা স্বরূপ। আর তাতে তোমাদের জন্য করেছেন চলার পথ।’

দেখো দাদা, আল্লাহ বলছেন, তিনি আমাদের জন্য জমিনকে করেছেন বিছানা স্বরূপ, কার্পেটের মতো করে। আচ্ছা দাদা, বিছানা বলতে আমরা কি বুঝি? আমরা বুঝি, বিছানা এমন একটি জিনিস, যা নরম, আরামদায়ক। যাতে বিশ্রাম নেওয়া যায়।যদি এটাকে রূপক হিসেবে ধরি, তাহলে এটা এমন কিছু যাতে স্বচ্ছন্দে বেঁচে থাকা যায়, চলাফেরা করা যায়।আজকের বিজ্ঞানও আমাদের সেটা বলছে।

বিজ্ঞান আমাদের বলছে, আমাদের পৃথিবীর ভূ-ত্বক মোট ৭টি স্তরে বিভক্ত। এই স্তরগুলোর মধ্যে সবচে উপরের স্তরের নাম হলো Crust। এই স্তরের পুরুত্ব ভূ-পৃষ্ট থেকে মাত্র ৩০ কিলোমিটার গভীর পর্যন্ত। এটিই সেই স্তর, যে স্তরে আমরা বসবাস করি, চলাফেরা করি।এরপরে আছে Mentle।

এই স্তরের পুরুত্ব ২৯০০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। এই স্তরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা হলো ৯০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এই তাপমাত্রায় মানুষ তো দূরের কথা, একটি ক্ষুদ্র জীবও মূহুর্তে ভস্ম হয়ে যাবে। চিন্তা করো তো, পৃথিবীর যে স্তরে আমরা বাস করছি, হাঁটছি, চলছি, ঘুরছি-ফিরছি, তার থেকে মাত্র ৩০ কিলোমিটার গভীরে এই ভয়াল স্তর অবস্থিত।

এটা তো মাত্র দ্বিতীয় স্তরের কথা। এরপরের স্তরের নাম হলো Outer Core।উইকিপিডিয়া মতে, এর পুরুত্ব হলো ২৮৯০ কিলোমিটার এবং এই স্তরের তাপমাত্রা হলো ৩৭০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। চিন্তা করো, পৃথিবীর আভ্যন্তরীণ এইসব স্তরে ঠিক কি ঘটে?
এরপরের স্তরের নাম হলো Inner Core। এটা তো আরো ভয়াবহ। এভাবে যতো নিচে নামা হয়, স্তরগুলো ততোই ভয়ানক। আমরা যে আগ্নেয়গিরির লাভা দেখি, এটা এইসব স্তরের ছোট্ট একটা বিস্ফারণ মাত্র।কিন্তু আমরা যে স্তরে থাকি, সেই Crust স্তরের তাপমাত্রা অন্য ৬ স্তরের তাপমাত্রার তুলনায় মাত্র ১%, যা আমাদের বসবাসের উপযোগী।

এখন, এই দিকটার দিকে ইঙ্গিত করে আল্লাহ যদি বলেন, ‘আমি তোমাদের জন্য ভূমিকে করেছি বিছানা স্বরূপ’ তাতে কি বোঝায় যে আল্লাহ এটা দ্বারা পৃথিবীর শেইপ বুঝিয়েছেন? একদম না। এটা দিয়ে যে আল্লাহ ভূ-ত্বকের অই স্তরের কথাই মিন করেছেন যা আমাদের বসবাসের উপযোগি, তা আয়াতের পরের অংশ থেকেই বোঝা যায়।আয়াতের পরের অংশেই আছে ‘আর, তাতে তোমাদের জন্য করেছেন চলার পথ।’
এটা তো একদম ক্লিয়ার যে এটা পৃথিবীর আকার নয়, ভূমির ব্যাপারে বলা হয়েছে। এবং, ভূমির সেই অংশের ব্যাপারে, যে অংশে আমরা, মানুষেরা বসবাস করছি।যেটা আমাদের বসবাসের জন্য উপযোগী। তাহলে এটা দিয়ে পৃথিবীকে সমতল বানিয়ে দেওয়া যায় কি করে? স্রেফ মনগড়া ব্যাখ্যা।’
নিপুণ দা চুপ করে আছে। বিপুল বলে উঠলো,- ‘আচ্ছা সাজিদ ভাই, আপনার কথা মানলাম যে এখানে পৃথিবীর আকার নয়, ভূমির স্তরের কথা বলা হয়েছে আর সেটাকে বিছানার সাথে উপমা দেওয়া হয়েছে।কিন্তু আপনি কি কোরানের এমন একটি আয়াত দেখাতে পারবেন যে যেখানে বলা হচ্ছে পৃথিবী গোল? সমতল নয়?’
বিপুলের কথা শুনে সাজিদ হেসে উঠলো। বললো,- ‘বিপুল, তার আগে তুমি বলো তো, কোরআন কি মানুষকে পৃথিবীর শেইপ কি রকম, পদার্থবিদ্যায় কি কি খাটে, রসায়নে কোন যৌগের সাথে কোন যৌগের বিক্রিয়া ঘটে এসব শেখানোর জন্য নাজিল হয়েছে?’
– ‘না।’- বিপুল বললো।
– ‘তাহলে তুমি কি করে এক্সপেক্ট করো যে কোরআন পৃথিবীর আকার,আয়তন নিয়ে বলবে?’
এবার বিপুলও চুপ। কিন্তু সাজিদ আর চুপ হলো না। সে বলে যেতে লাগলো,- ‘ঠিক আছে বিপুল। তুমি যখন আশা করেছো, তখন আমি প্রমান করে দেখাতে পারি যে কোরআন পৃথিবীর আকার নিয়ে বলেছে, এবং, সেটা গোলাকার।’
এবার আমি, নিপুণ দা, বিপুল আর সৌরভ চোখ বড় বড় করে সাজিদের দিকে তাকালাম। বলে কি ব্যাটা!! কোরআন পৃথিবীকে গোলাকার যদি বলেই থাকে, তাহলে এতক্ষণ এতো কাহিনী বলার কি কোন দরকার ছিলো?
নিপুণ দা হো হো করে হেসে উঠলো। বললো,- ‘এবার কি নতুন তত্ব শোনানো হবে নাকি? হা হা হা।’
নিপুণ দা’র সাথে সাথে বিপুল আর সৌরভও হেসে উঠলো।তাদের সাথে সাজিদও হাসছে।আমার তখন সাজিদের উপর খুব রাগ হচ্ছে।

সাজিদ বললো,- ‘নিপুণ দা, একটু মনোযোগ দিয়ে শুনবে প্লিজ। কোরআন সরাসরি পৃথিবীকে গোলাকার বলে নি।বলার দরকারও ছিলো না।কারন, কোরআন জিওগ্রাফির কোন বই নয় যে এখানে পৃথিবীর আকার,আকৃতি নিয়ে বলাই লাগবে। তবে, কোরআন কিছু ইঙ্গিত দিয়েছে। জ্ঞানীদের উচিত তা বুঝে নেওয়া।’

নিপুণ দা বললো,- ‘তাই বুঝি? তা বুঝাই দেন দেখি মহাজ্ঞানী সাজিদ ভাই। হা হা হা।’
সাজিদ বললো,-
প্রথমত,
সূরা আয যুমারের ৫ নং আয়াত। বলা হচ্ছে- “তিনি রাত দ্বারা দিনকে আচ্ছাদিত করেন এবং রাতকে আচ্ছাদিত করেন দিন দ্বারা।”
এই আয়াতে রাত দিন দ্বারা এবং দিন রাত দ্বারা আচ্ছাদিত হওয়া বুঝাতে যে আরবি শব্দ ব্যবহার হয়েছে তা হলো “يُكَوِّرُ”। এই শব্দটির একদম সঠিক অর্থ হলো প্যাঁচানো / জড়ানো।

ক্লাসিকাল আরবি ডিকশনারিতে এর অর্থের ব্যাখ্যাতে বলা হয়েছে এটি ঠিক এমন- কোন পাগড়ির মধ্যে একটি কাপড় অন্য একটি কাপড়ের মধ্যে যেভাবে প্যাঁচিয়ে ঢুকানো হয়।একটি অন্যটির মধ্যে প্যাঁচিয়ে ঢুকে যাচ্ছে।জীবনে কখনো পাগড়ি দেখলে বা পাগড়ী বেঁধে থাকলে ব্যাপারটা ভালো বুঝার কথা।

আল্লাহ বলেছেন তিনি রাত দ্বারা দিনকে, এবং দিন দ্বারা রাতকে ঠিক সেভাবেই আচ্ছাদিত করেন।

এখন রাতকে দিন দ্বারা এবং দিনকে রাত দ্বারা এভাবে আচ্ছাদিত করা তখনই সম্ভব, যখন পৃথিবীর আকার গোল হবে।
আমরা দেখি কিভাবে দিন-রাত্রি হয়। প্রথমে ভোর, এরপর আস্তে আস্তে দুপুর, এরপর বিকেল, এরপর গোধূলি, এরপর সন্ধ্যা, এরপর একসময় দিন রাতের অন্ধকারে মিলিয়ে যায় যেভাবে আস্তে আস্তে পাগড়ীর একটা অংশ অন্য অংশের মধ্যে ঢুকে পড়ে।

যদি পৃথিবী সমতল হতো, একটা লম্বা কাঠ বা তক্তার মতো,তাহলে কি এভাবে দিনরাত্রি হতো? না। তখন এই দিন, আবার চোখের পলকে রাত নেমে পড়তো।

তাহলে সূরা যুমারের এই আয়াত থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, আল্লাহ রাতকে দিনে এবং দিনকে রাতে আচ্ছাদিত করার যে প্রক্রিয়া বলেছেন সেটা তখনই সম্ভব, যখন পৃথিবী গোলাকার হবে। তাহলে কোরআন ইন্ডিরেক্টলি ইঙ্গিত করছে যে পৃথিবী গোলাকার।

দ্বিতীয়ত,
সূরা আর রহমানের ১৭ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ বলছেন,- ‘তিনিই দুই অস্তাচল আর দুই উদয়াচলের মালিক।’
এখানে অস্তাচল আর উদয়াচল বলতে সূর্যের উদয়-অস্তের কথা বলা হচ্ছে।
আমরা জানি, পৃথিবীতে একদিনে দুইবার সূর্যোদয় আর দুইবার সূর্যাস্ত ঘটে থাকে। আমরা বাংলাদেশে যখন সূর্যকে পূর্বদিকে উদিত হতে দেখি, তখন আমেরিকানরা দেখে যে সেখানে সূর্যটা পশ্চিমে ডুবে যাচ্ছে। তাহলে আমাদের এখানে যখন সকাল, তাদের কাছে তা সন্ধ্যা। আবার, আমরা যখন সূর্যকে পশ্চিমে ডুবে যেতে দেখি, তারা তখন সূর্যকে পূর্ব দিক থেকে উদিত হতে দেখে।
তার মানে পৃথিবীতে মোট দু’বার সকাল, দু’বার সন্ধ্যা পরিলক্ষিত হয়। এখন,দুবার সূর্যাস্ত আর আর দুবার সূর্যোদয় তখনই সম্ভব যখন পৃথিবীর আকার গোল হবে। পৃথিবীর আকার যদি সমতল বা চ্যাপ্টা কাঠ বা তক্তার মতো হতো, তাহলে পৃথিবীতে একবারই সূর্যাস্ত – সূর্যোদয় ঘটতো। তক্তা সদৃশ পৃথিবীর একপাশে সূর্য উঠে অন্যপাশে ডুবে যেতো। কিন্তু সেরকম হয়না, কারন পৃথিবী গোলাকার।

এইজন্য পৃথিবীতে আমরা দুইবার সূর্যাস্ত আর সূর্যোদয় দেখতে পাই।
আল্লাহও কোরআনে একই কথা বলছেন। তিনি বলছেন,- ‘তিনিই মালিক দুই অস্তাচল আর উদয়াচলের।’ তাহলে তিনি নিশ্চই জানেন পৃথিবী গোলাকার।তাই তিনি দুই সুর্যাস্ত আর দুই সুর্যোদয়ের কথা বলেছেন। তিনি যদি পৃথিবীকে ফ্ল্যাট তথা সমতলই বলবেন, তাহলে অবশ্যই তিনি এক অস্তাচল আর এক উদয়াচল এর কথাই বলতেন। কিন্তু তিনি তা বলেন নি।তার মানে, কোরআন ইঙ্গিত করছে যে, পৃথিবী গোলাকার।’

এতোটুকু বলে সাজিদ থামলো। বিপুল চুপ করে আছে। নিপুণ দা’ও চুপ। তাদের হয়তো আর কিছু বলার নেই এই মূহুর্তে। সৌরভ বললো,- ‘সবই বুঝলাম, কিন্তু পৃথিবীর ভূমিকে বিছানা বলার কি দরকার? এত জটিল করে।’
সাজিদ হাসলো। বললো,- ‘সৌরভ, আমি যখন সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি, তখন নিপুণ দা আমাকে একটি লাভ লেটার দিয়েছিলেন বিপাশা দি কে দেবার জন্য। কি নিপুণ দা, দাও নি?’
নিপুণ দা লজ্জা লজ্জা ভাব নিয়ে বললো,- ‘হ্যাঁ, কিন্তু এখানে বলছো কেনো এসব?’
– ‘জানো নিপুণ দা, আমি সেই চিঠিটা বিপাশা দি কে দেবার আগে খুলে একবার পড়ে নিয়েছিলাম। হা হা হা হা। কি রোমাণ্টিক প্রেমপত্র ছিলো সেটা। হা হা হা।’
নিপুণ দা হাসছে, লজ্জাও পাচ্ছে। আমরাও হাসছি। সাজিদ বললো,- ‘জানো সৌরভ, সেই চিঠির শুরুতেই বিপাশা দি’র রূপের বর্ণনা দিতে গিয়ে নিপুণ দা লিখেছে- ‘তোমার অই চাঁদমুখ খানা না দেখলে আমার দিনটাই পানসে লাগে।’
আমরা সবাই হো হো হো করে হাসছি। সাজিদ আবার বললো,- ‘আচ্ছা সৌরভ, নিপুণ দা যে বিপাশা দি’র মুখকে চাঁদমুখ বলেছে, এখানে নিপুণ দা কি বুঝিয়েছে যে বিপাশা দি’র মুখ দেখতে চাঁদের আকৃতির মতো? আই মিন গোলাকার?’
সৌরভ বললো,- ‘না, উনি বিপাশা দি’র রূপ বুঝিয়েছেন এটা দিয়ে।’
– ‘এক্সাক্টলি। নিপুণ দা সেদিন ‘চাঁদমুখ’ দিয়ে আসলে বিপাশা দি’র রূপ বুঝিয়েছে, বিপাশা দি’র মুখের আকৃতি না। এটাকে বলে উপমা। ঠিক সেরকম আল্লাহও পৃথিবীর ভূমিকে বিছানার উপমা দিয়ে বুঝিয়েছেন তিনি আমাদের জন্য কতো উপযোগী করেই না এটা তৈরি করেছেন। এটা দিয়ে তিনি পৃথিবীর আকৃতি বা আমার বা তোমার বেডরুমের বিছানা বুঝান নি, বুঝেছো?’

সৌরভ একদম চুপ মেরে গেলো। সে নিশ্চই বুঝেছে। বিপুলও চুপচাপ। সাজিদ নিপুণ দা’র কাছে গিয়ে বললো, – ‘স্যরি দা ভাই, অই চিঠিটা তোমার পারমিশান ছাড়াই পড়েছিলাম বলে। কি করবো বলো? তোমাদের মতো সিনিয়ারদের থেকেই তো এক্সপেরিন্স নিতে হবে,তাই না? হা হা হা।’

নিপুণ দা সাজিদকে ধরতে যাচ্ছিলো আর সে অমনি দিলো এক দৌঁড়…………….

[তর্কের খাতিরে যদি ধরেই নেওয়া হয় যে, আল্লাহ সত্যি সত্যিই পৃথিবীকে কার্পেটের মতো করে তৈরি করেছেন, তাহলেও কোন ভুল হবে না। কারন, কার্পেট যে শুধু সমতল জিনিসে করা হয় তা নয়। গোলাকার জিনিসেও কার্পেট করা যায়। উদাহরণস্বরূপ, একটি ফুটবলের কথা চিন্তা করুন। ফুটবল একটি গোলাকার জিনিস। এর উপরিভাগ কি রকম? কার্পেটের মতো করে আচ্ছাদিত। সো, আল্লাহ যদি বলেন তিনি ভূমিকে কার্পেটের মতো করে বিছিয়েছেন, তাহলে ধরা যায় যে, ফুটবলের মতো গোলাকার ভূমিকে তিনি কার্পেটের মতো বিছিয়েছেন।]

তাছাড়া, সূরা আল ইনশিক্বাকের ৩ নাম্বার আয়াতে আছে- ‘যেদিন পৃথিবীকে সমতল করা হবে…..।’

এখানে বলা হচ্ছে কিয়ামত দিবসের কথা। সেদিন পৃথিবীকে আল্লাহ সমতল করবেন। তাহলে , তিনি যদি এখনই পৃথিবীকে সমতল করে তৈরি করতেন, আবার কিয়ামত দিবসে এটাকে সমতল করার কথা আসে কিভাবে?

ইসলাম বনাম ফেমিনিজম : ইকুইটি না ইকুয়্যালিটি ?

মাহমুদ নাঈম:নারী অধিকার সংক্রান্ত আলোচনায় ইসলামের অবস্থান খুব ভালনারেবল হিসেবে দেখা হয় পশ্চিমা ফিলোসফিতে। যদিও ইসলাম একজন নারীকে মানুষ হিসেবে যথার্থ মূল্যায়নসহ সর্বোচ্চ অধিকার এবং মর্যাদা দিয়েছে। তবে এই অভিযোগটা সম্পূর্ণ মিথ্যা হলেও বাহ্যিকভাবে অস্বীকার করার তেমন সুযোগ নেই। এর পেছনের কারণ অবশ্য মুসলিমদের প্র্যাকটিসের উপরেই বর্তায়, যেখানে এখন পর্যন্ত নারীদের ক্ষমতায়ন (অধিকার এবং মর্যাদার দৃষ্টিতে) কোথায়ও তেমন দেখা যায়না। ইসলাম নারীর স্বাধীনতা, মর্যাদা ও অধিকার যা দিয়েছে তা অধিকাংশ মুসলিম সোসাইটি, পরিবার কিংবা ব্যক্তিগত পরিমন্ডলে মানা হয়না।

এখানে নারীর ক্ষমতায়ন শব্দটা ব্যাখার দাবি রাখে, ইসলামের যার সুনির্দিষ্ট সীমারেখা আছে। রাসুল এবং সাহাবীদের যুগে জ্ঞানচর্চা, দা’ওয়াহ, অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা, সিদ্ধান্ত গ্রহণ থেকে শুরু করে যুদ্ধের ময়দানে পর্যন্ত মহিলা সাহাবীদের অনন্য ভূমিকা ছিলো। এমনকি খিলাফতের সময় কখনো কখনো মজলিশে শুরা, ফতোয়া বোর্ডে মহিলা স্কলারদের দেখা গিয়েছিলো। কিন্তু পরবর্তী যুগে এসে তেমন একটা দেখা যায়নি, এমনকি জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রেও নাহ। ক্রুসেডের সময়কালে জ্ঞানচর্চা ও ইসলামে তাঁদের প্রত্যক্ষ অবদানের ধারা থমকে যেতে শুরু করে। কেউ কেউ ব্যাখ্যা দিয়েছেন এভাবে যে, ক্রুসেডের সময় মহিলাদের দ্বারা ছড়িয়ে পড়া ফিতনার কারনেই তৎকালীন স্কলাররা মহিলাদের প্রতি অনমনীয় মনোভাব পোষণ করেছিলেন, যা তাদেরকে আড়ালে চলে যেতে বাধ্য করে।

তবে আসলেই কি পরবর্তী যুগে মুসলিম মহিলাগণ পর্দার আড়ালে ছিলেন নাকি তাঁদের কথা আমরা জানিনা! এই প্রশ্নটা ওঠছে, সম্প্রতি প্রকাশিত আকরাম নদভীর ‘Al-Muhaddithat: The Women Scholars in Islam’ বইটার কারণে। ৪০ খন্ডের এ বইটাতে উনি ৮০০০ মহিলা মুসলিম স্কলারদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন, যাদের কথা আমরা কোনদিনই জানতাম নাহ। এমনকি লেখক নিজেও এ বিষয়ে কাজ শুরু করার পূর্বে ৩০-৪০ জন মহিলা স্কলার খুঁজে পাবার কথা চিন্তা করেছিলেন। এত বৃহৎ সংখ্যক নারীদের কথা আমরা জানিনা, তাঁদের কোন বই বা ফতোয়া আমরা দেখিনা এর কারণ হিসেবে এটা বলা খুব অযৌক্তিক হবেনা যে, ইসলাম নয় বরং মুসলিম পুরুষরা আসলেই নারীদের উপর ডমিনেটিং ছিলো সবসময়। এর ফলেই তারা পর্দার আড়ালেই থেকে গেছে সবসময়।

সাধারণ মানুষ একটা দল বা ধর্মের মূলনীতি পড়ার বদলে সেই দল তার অনুসারীদের প্র্যাকটিস দেখেই ধর্ম বা দলটাকে বিচার করে। সুতরাং ইসলামের বহিরাগত লোকদের জন্য নারীদের ব্যাপারে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি সংক্রান্ত এই ধারনা পোষণ করার দায়টা মুসলিমদেরই অনেকাংশে, যদিও অধিকাংশ মুসলিমেরই এতে কোন মাথাব্যাথা নেই- বরং তারা সেটা উপভোগই করে। আর বাকি দায়টা পলিটিসাইজেশন অব নলেজকে দেয়া যেতে পারে।

নারী ও পুরুষের অধিকারের ভিত্তিটা কি, সাম্যতা (Equality) নাকি ন্যায্যতা (Equity), সেটা নিয়েই সাধারন মুসলিমদের ভেতর স্পষ্ট ধারণা নেই। যেখানে অধিকাংশ মুসলিম স্কলারগণও সাধারণত এই বিষয়ের সুক্ষ্ম পার্থক্য এবং ইসলামের বিধানটা ক্লিয়ার করতে মনোযোগী নন। যার ফলে অধিকাংশ মুসলিমই ফেমিনিজম-এর ‘সাম্যতা’কেই ইসলামের বিধান হিসেবে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন। আর এই সাম্যতার কথা বলতে গেলেই কিছু প্রশ্ন ওঠে আসে যা ইসলামের প্র্যাকটিসের সাথেই সাংঘর্ষিক। ফলে নন-মুসলিমরা ইসলামের নারী-পুরুষের সমতার বিষয়টিকে সহজেই খারিজ করে দেয়।

নারী-পুরুষের সমতার সাথে সাংঘর্ষিক এবং একই সাথে সবচেয়ে মূখ্য যে অভিযোগটা ইসলামের প্রতি সেটা হচ্ছে, পলিগ্যামি। এই ব্যাপারটা শুধুমাত্র অমুসলিমদের-ই মাথাব্যাথা না, বরং সেমি-ওয়েস্টার্ন কালচারে বড় হওয়া অনেক মুসলিমকেও এটা কনফিউজড করে দেয়। তাদের সবচেয়ে বড় পয়েন্ট হচ্ছে, ইসলাম পলিগ্যামির বিধান রাখলেও পলিয়্যান্ড্রি (মহিলাদের বহুগামীতা)-র বিধান নেই কেন?

আসলে শিল্পবিপ্লবের পরে ক্যাপিটালিজমের বিপরীতে ‘সাম্যবাদ’ টার্মটা ছিলো আধুনিকতাবাদের হাত ধরে গড়ে ওঠা  টার্মগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ফ্রড এবং আনএপ্লিকেবল। চিন্তাশক্তিসম্পন্ন একটা মানব সোসাইটিতে এটা আসলে কাজ করতে পারেনা। শুনতে যতই মধুর শোনাক, এপ্লাই করার পর এটার তিক্ত রুপটা বেড়িয়ে এসেছে সবসময়। এই সাম্যবাদ তাই কোথাও টিকে থাকেনি। একজন পরিশ্রমী, জ্ঞানী মানুষ এবং একজন অলস, মুর্খ মানুষ কোনদিনই সমান হতে পারেনা। উভয়েরই মানবিক কিছু কমন অধিকার থাকতে পারে, তবে প্রত্যেকেই একই লাইফ ডিজার্ভ করেনা। সুতরাং ইসলামও কখনো সাম্যবাদের কথা বলেনি, বরং ন্যায্যতার কথা বলেছে।

   শুধুমাত্র নারী-পুরুষের অধিকারের বেলায়-ই নয়, বরং ইসলাম প্রায় বিধানের ক্ষেত্রেই Equality এর পরিবর্তে Equity এর কথা বলেছে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে কম্যুনিজমের সাম্যবাদের মধুর প্রস্তাবনার বিপরীতে ইসলাম অনেক উন্নত যৌক্তিক অর্থনৈতিক ন্যায্যতার কথা বলেছে। প্রত্যেকেই তার মেধা, পরিশ্রম অনুযায়ী সম্পদের মালিক হতে পারে। কিন্তু আবার এই অর্থনৈতিক উঁচু-নিচু ভেদাভেদ দূর করার জন্য মানবিক সাম্যের মাধ্যমে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ধনীদের জন্য গরিবদের প্রতি যাকাতের বিধান রেখেছে। চাকরের প্রতি মালিকের দায়িত্ব নির্ধারণ করে দিয়েছে।

Equality আর Equity এর মধ্যে পার্থ্যক্যটা আসলে Worth/Value তে নয়, পার্থ্যক্যটা হলো এপ্লিকেশনে।ইকুয়্যালিটি-তে ভ্যালু থেকে শুরু করে এপ্লিকেশন, পরিমাপ সবই এক। তবে ইক্যুইটি-তে ভ্যালুটা এক, তবে প্রয়োজন অনুযায়ী এপ্লিকেশন এবং পরিমাপে ভিন্নতা হয়। একজন নারী এবং পুরুষ বায়োলজিক্যালি ভিন্ন, তাঁদের প্রয়োজনও অবস্থা ভেদে ভিন্ন হয়। ইসলাম সেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই সমতা নয়, ন্যায্যতা বিধান করেছে নারী পুরুষের মাঝে। কাউকে ক্ষমতা বেশি দিয়েছে, বিপরীতে কাউকে মর্যাদা বেশি দিয়েছে।

ব্যাপারটা অনেকটা এইরকম- এক কৃষকের মুরগির ফার্ম আছে, আরেকজনের ধানের ক্ষেত আছে। এক কেজি চালের দাম ৪০ টাকা, একহালি ডিমের দামও ৪০ টাকা। এখন সরকার ফার্মের মালিককে এককেজি চাল দিলো, আর ধানের জমিওয়ালাকে এক হালি ডিম দিলো। যার ফলে ফার্মের মালিকও ভাত-ডিম দিয়ে খেলো, ধানের জমিওয়ালাও ভাত-ডিম দিয়ে খেলো- দুজনেরই পেট ভরলো। কিন্তু দুজনকে দেয়া জিনিস কিন্তু এক ছিলো না, তবে জিনিসের মূল্য সমান ছিলো, এপ্লিকেশন ও পরিমাপ ভিন্ন ছিলো।

এবার চিন্তা করি, ফার্মের মালিক একজন মহিলা আর ধানের জমিওয়ালা একজন পুরুষ। এবার ফার্মের মালিক ফেমিনিজমের আইডিয়া গ্রহণ করে প্রতিবাদ শুরু করলো, ধানওয়ালা পুরুষ বলে তাকে ৪ টা ডিম দেয়া হবে আর আমি নারী বলে মাত্র ১ কেজি ধান দেয়া হবে, সেটা মানবো না। তাকে যা দেয়া হবে আমাকেও তা দিতে হবে। তাহলে দেখা যাবে পরদিন কারো মুখেই ভাত-ডিম দুইটা একসাথে জুটবে না।

ইসলামের নারীর অধিকারের সাথে ফেমিনিজমের এইখানেই তফাৎ। সো-কল্ড ফেমিনিজম সব ক্ষেত্রেই নারীর সমান অধিকার চায়, কড়ায়-গন্ডায়। অথচ ইসলাম নারী ও পুরুষের মাঝে ন্যয্যতা বিধান করে নারীকে অন্য যেকোন মতবাদের চেয়ে বেশি মর্যাদা ও অধিকার দিয়েছে। ইসলামে নারীকে শিক্ষার অধিকার, মতামত প্রধানের অধিকার থেকে শুরু করে সব ধরনের অধিকার দেয়া হয়েছে।

হ্যাঁ, ইসলামে পুরুষকে নারীদের উপর ক্ষমতাবান হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়েছে। পুরুষদের তুলনায় নারীদের দুর্বলতার এই ব্যাপারটা বায়োলজিক্যালিও প্রামাণিত। তবে একই সাথে অনেক হাদীসে নারীকে পুরুষের উপর মর্যাদাবান হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়েছে- বাবার উপর মাকে গুরত্ব দেয়া হয়েছে, পুত্র সন্তানের উপর কন্যাসন্তানকে। ইসলামে মেয়েরা বাবার সম্পত্তি কম পায়, কিন্তু সে স্বামী-ছেলের সম্পত্তি থেকেও ভাগ পায়। আবার সংসারের সমস্ত দায়ভার পুরুষের উপর। তবে পাপ-পূণ্য বা বিচারের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের বিধান বা অধিকার আবার এক।

ইসলামে আসলে ‘নারী অধিকার’ বলে আলাদা কোন টার্ম নেই। মানবিক অধিকার বা মর্যাদাগত দিক থেকে ইসলাম নারী-পুরুষকে আলাদা করেনি কখনো, শুধুমাত্র প্রয়োজন ও বাস্তবতার উপর ভিত্তি করে কিছু নির্দিষ্ট বিষয়ে আলাদা আলাদা নিয়ম বেঁধে দিয়েছে। বরং ইসলাম মানবিক অধিকারের বিধান প্রতিষ্ঠা করেছে, যেখানে প্রত্যেকটা ইন্ডিভিজুয়্যাল পারসন এর স্বতন্ত্র মর্যাদা এবং অধিকার আছে। আর সেই মর্যাদা এবং অধিকার কোন শ্রেণী বৈষম্যের ভিত্তিতে নয়, বরং মানুষ বা মুসলিম হিসেবে তার কর্মের ভিত্তিতে ইক্যুইটি অনুযায়ী বন্টিত হয়েছে।

তাহলে ফেমিনিজমের সাথে ইসলামের দ্বন্দটা কোথায়? দ্বন্দ্বটা কি, ইসলাম একতরফা অযৌক্তিক সমতায় বিশ্বাস করেনা, তার বদলে ন্যায্যতায় বিশ্বাস করে! কিন্তু সেই ইক্যুইটি অনুসারেও ইসলামে নারীর মর্যাদা অন্য সব প্রচলিত মতবাদ থেকে বেশি। তাহলে? খুব সম্ভবত দ্বন্দ্বটা এসে দাঁড়িয়েছে পলিগ্যামি আর হিজাবে।হ্যাঁ, ইসলাম পুরুষের জন্য পলিগ্যামিকে বৈধতা দিয়েছে, একজন পুরুষ অনধিক চারটি নারীকে বিয়ে করতে পারবে। সেই সাথে ইসলাম শর্তও আরোপ করেছে, স্ত্রীদের ভরণ পোষণের ক্ষমতা থাকতে হবে এবং তাদের মধ্যে ন্যায়বিচার করতে হবে। সেটা সম্ভব না হলে সেই অনুমতি বাতিল করেছে।অনভ্যস্ত একটা সমাজের কাছে এই পলিগ্যামির বিষয়টা হঠাৎ বর্বোরচিত মনে হতে পারে। কিন্তু এই পলিগ্যামির বিধান কি পরিস্থিতিতে এসেছিলো, সে পরিস্থিতি বিবেচনা করলে বরং পলিগ্যামি অনেক ক্ষেত্রেই নারীদের জন্য অনুগ্রহ স্বরুপ।

আরবের তৎকালীন সমাজে প্রচুর এতিম মেয়েরা ছিলো, যাদের কার্যত অভিভাবক ছিলোনা। সেই সকল এতিম মেয়েদের নিরাপত্তা-ই নিশ্চিত করেছিলো সুরা নিসার ৩ নং আয়াত, যাতে অনধিক চারজন স্ত্রী গ্রহণের অনুমতি দেয়া হয়েছিলো। তাছাড়া তখনকার সময়ে যুদ্ধে পুরুষরা নিহত হওয়ার ফলে বিধবা নারীর সংখ্যা প্রচুর বেড়ে যেতো, আর সেই বিধবাদের চরম অসহায় অবস্থার মধ্য দিয়ে যেতে হতো। তাদের এই অসহায় অবস্থা থেকে মুক্তির একমাত্র চিরস্থায়ী পথ ছিলো অন্যকারো সাথে বিবাহে আবদ্ধ হওয়া। তাছাড়া তৎকালীন সমাজে কিছু দাসী নারীদের দাসত্ব থেকে মুক্ত জীবন মিলেছিলো এই পলিগ্যামির ফলেই।


এটা পড়ুন – নারী অধিকার আন্দোলন : ভুল পথে যার পথচলা।


রাসুলের খাদিজা পরবর্তী ১০ জন স্ত্রীদের মধ্যে ৩ জন ছিলেন বিধবা অসহায়, ১ জন দাসী এবং ১ জন ছিলেন যিনি তাঁর স্ত্রী হবার প্রবল ইচ্ছে পোষণ করেছিলেন। যাদেরকে রাসুল বিয়ে করে সামাজিক অধিকার এবং উম্মুল মু’মিনীনে হওয়ার মতো মর্যাদা অর্জনের সুযোগ দিয়েছিলেন। অথচ তাঁর ৫০ বছর বয়স পর্যন্ত একমাত্র খাদিজাই ছিলেন স্ত্রী। সাহাবীদের মধ্যেও অনেকেই বিধবা মহিলাদের গ্রহণ করেছেন ২য়-৩য় স্ত্রী হিসেবে, যেসব মহিলাদের জন্য কাউকে বিয়ে পারাটা ছিলো পুনরায় সুস্থ একটা সামাজিক জীবন ফিরে পাবার মতো।

অথচ এই পলিগ্যামির ইতিহাস খুব প্রাচীন। পুর্বের প্রায় প্রত্যেকটা ধর্মে, প্রত্যেকটা অঞ্চলেই পলিগ্যামির প্র্যাকটিস ছিলো। ক্রিশ্চিয়ান চার্চ পলিগ্যামিকে নিষিদ্ধ করেছে গ্রিকো-রোমান কালচারের অনুকরণে। যে কালচারে বিয়ের মাধ্যমে পলিগ্যামি নিষিদ্ধ ছিলো, কিন্তু প্রত্যেক পুরুষই একজন স্ত্রীর সাথে অসংখ্য মিসট্রেস বা দাসী রাখতে পারতো। পলিগ্যামির ইতিহাসে ইসলামের সাথে অন্যদের পার্থ্যক্য হলো, ইসলামে পলিগ্যামিকে অনধিক চারে নিয়ন্ত্রিত করা হয়েছে, যেখানে অন্য মতবাদগুলোতে পলিগ্যামি ছিলো অনিয়ন্ত্রিত।

 

পশ্চিমা/ফেমিনিস্টদের ভাবনায় আসলে পলিগ্যামি নয় বরং বিয়ে টার্মটাই আপত্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনকি প্রোটোফেমিনিস্টদের অনেকেরও বিয়েতে আপত্তি ছিলো। এঙ্গেলস তো বিয়েকে সংজ্ঞায়িত করেছিলেন, ‘Dreary mutation of slavery’। সে পথ পেরিয়ে আজকাল তাদের দাবিটা পৌঁছে গেছে সেক্সুয়াল ফ্রিডমে। অথচ পশ্চিমা সমাজে সিরিয়াল পলিগ্যামির অবাধ চর্চা হয়, যেখানে বিয়ে-ডিভোর্স-বিয়ে সমীকরন চলতেই থাকে- যদিও তারা এটাকে সিরিয়াল পলিগ্যামি হিসেবে স্বীকার করে না। তাছাড়া বিয়ে ছাড়া বহুগামীতা, অন্যের স্ত্রীগামীতা বহুল চর্চিত বিষয়। এটাকে তারা যৌন স্বাধীনতা স্বাধীনতার কাতারে ফেলেন। আর ইসলাম সিরিয়াল পলিগ্যামিকে নিরুৎসাহিত করেছে এবং বিয়ে ছাড়া বহুগামীতাকে নিষিদ্ধ করেছে।

ইসলামে বহুবিবাহের ব্যাপারটা একটা অপশন, যাতে বাধ্যবাধকতা নেই। যদিও কিছু স্কলার এটাকে সুন্নাত হিসেবে মত দিয়েছেন, তবে অনেকের মতেই এটা একটা প্রয়োজন সাপেক্ষে অনুমোদিত ব্যাপার। যা অনেক ক্ষেত্রেই নারীর জন্য মর্যাদা বয়ে নিয়ে এসেছে।

 

আসলে ফেমিনিজম মুভমেন্ট বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে আলোচিত আন্দোলন হলেও, এর শেকড়টা খুব পুরনো। খুব সম্ভবত ফেমিনিজমের প্রথম সুর ভেসে আসে, প্লেটোর বিপাবলিক থেকে। তারপরের প্রোটোফেমিনিস্টদের লিস্টটাও কম লম্বা নয়। তবে ফেমিনিজম টার্মটা যখন অজ্ঞাত ছিলো তখনকার প্রোটোফেমিনিস্টদের ভাবনায় নারীদের সামাজিক, পারিবারিক আর সম্পদের অধিকারগুলোই মুখ্য ছিলো। তবে ধীরে ধীরে বিংশ শতাব্দীর শেষদিকে এসে ফেমিনিজমের প্রধান মটো হয়ে দাঁড়িয়েছে, যৌন স্বাধীনতা। যার বিশেষায়িত রুপ হোমোসেক্সুয়ালিটি বা এলজিবিটি মুভমেন্ট।

 

আয়রনি হলো, ম্যাটেরিয়ালিস্টিক এই সোসাইটিতে নারীকে যেখানে পণ্য হিসেবে বিবেচনা করা করা হয়, সেখান থেকেই আবার ফেমিনিজমের সুর ভেসে আসে। কই, ফেমিনিজম কি যুদ্ধে নিহত ব্যক্তির স্ত্রীদের ভবিষ্যত নিয়ে কখনো কিছু বলেছিলো? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সেই সব অসহায় নারীদের জায়গা হয়েছিলো বাস্তার মোড়ে, গজিয়েছিলো একেরপর এক ব্রোথেল। কারণ, আধুনিক সভ্য পশ্চিমা সমাজে দ্বিতীয় বিবাহ হারাম, কিন্তু ব্রোথেলে কোন মেয়ে গ্রহণ করা নয়। কারণ তাদের কাছে দিনশেষে মেয়ে একটা উপভোগের বস্তু। নারীদের দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করাটা অমর্যাদাকর, কিন্তু বেশ্যা হিসেবে নয়।

 

নারী অধিকার
চিন্তা করুন

ফেমিনিজম সম অধিকারের কথা বলে, চাকরি-বাকরি থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রেই মহিলা পুরুষদের সবকিছুই সমান সমান হিসেবে বিবেচনা করার দাবি জানায়। সেক্ষেত্রে যেখানে একজন নবাগত সন্তানের পিতা সন্তান জন্মের পূর্বে যেখানে প্যাটার্নাল লিভ নেয়না, সেখানে একজন মায়ের ম্যাটার্নাল লিভের ব্যাপারটা তো অযৌক্তিক হওয়ার কথা। এটা স্পেশ্যাল কেস? হুহ! না, এটাই হলো নারী এবং পুরুষের বিশিষ্ট্যতা। তাদের জীবনের কিছু প্রয়োজন, কিছু আচার-অনুষ্ঠান একে অপর থেক ভিন্ন। তাই ইসলাম সম অধিকারের কথা বলেনা, বরং পরিস্থিতি অনুযায়ী ন্যায্যতার কথা বলে। ইসলাম ব্যক্তি হিসবে ইন্ডিভিজুয়াল রাইটস এর কথা বলে, ইক্যুইটির কথা বলে।

 

এখন কথা হলো, ফেমিনিজম কি সামগ্রিক ভাবে নারীদের কথা বলে? নাকি একটা নির্দিষ্ট সোসাইটি কিংবা নির্দিষ্ট মানসিকতার নারীদেরই প্রতিনিধিত্ব করে? যারা একটা স্ট্যাবল সোসাইটির ন্যাচারাল রুলসগুলো ভেঙে দিতেই আগ্রহী। যে মেয়েটা হিজাব করতে ভালোবাসে, তখন তো হিজাব করাটা ইসলামের বিধান ছাড়িয়ে তার নারী অধিকারের ভেতর পড়ে। তাহলে হিজাব ব্যান কি নারী অধিকারের লঙ্ঘন নয়? ফেমিনিজম কি এই ব্যানের বিরুদ্ধে কিছু বলেছে কখনো? আসলে ফেমিনিজম নারীর ইচ্ছের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেনা, বরং একটা নির্দিষ্ট (পুরুষতান্ত্রিক) গোষ্ঠির ইচ্ছায় বিশ্বাস করে, যাদের ম্যানিপুলেশনের অংশ তারা।

 

ইন্টারেস্টিং ফ্যাক্ট হলো, ফেমিনিজমের বুলি কপচানো পশ্চিমা ফিলোসফি নারীকে কেবল একটা পণ্য হিসেবেই দেখে। আর ইসলাম নারীকে একজন পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবেই দেখে। আর সেখানেই ইসলামের সাথে পশ্চিমা ফিলোসফির ফেমিনিজমের দ্বন্দ্ব। এই ফেমিনিজম একজন নারীর হিজাব পরাটাকে নারী অধিকার লঙ্ঘন হিসেবে দেখে, আর টেলিভিশনের পর্দায় কিংবা ক্লাবের বলরুমে নারীকে পণ্যের মতো উপস্থাপন করাকে নারী স্বাধীনতার সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করে। কিন্তু এই সংজ্ঞায়ন করে কারা, কাদের জন্য? হা হা হা! দিনশেষে সেই ফেমিনিষ্টরা যে পুরুষদের সামনে নিজেদের বিকিয়ে দিতে দিতে পুরুষদের শেখানো রাস্তা ধরেই ফেমিনিজমের বুলি কপচাতে কপচাতে ঝিমিয়ে যায়। এভাবেই যে পুরুষদের জন্যই বেঁচে থাকে ফেমিনিজম- মাথাখোলা ফেমিনিস্টের ভাবনায় তা ধরেনা।

 


মাহমুদ নাঈম
ছাত্র,জার্নালিজম
এগে ইউনিভার্সিটি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ইজমির, তুরস্ক।

বাইবেলের ভবিষ্যদ্বাণী মুহাম্মদ সাঃ সম্পর্কে যা তাঁর নবুওতের অনন্য দলীল ।

বাইবেলে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের আবির্ভাবের ভবিষ্যদ্বাণী ইসলামের সত্যতারই একটা প্রমাণ। এ ছাড়া সেটা বাইবেলে বিশ্বাসী মানুষদের চোখের সামনেও মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওতের একটা প্রমাণ।

Deutaronomy (দ্বিতীয় বিবরণ) এর ১৮ তে বলা হয়েছে, মুসা আ. বলেন: আল্লাহ তা‘আলা আমাকে বললেন: “তাদের জন্য তাদের ভাইদের মধ্য থেকে তোমার মত একজন নবীকে প্রেরণ করা হবে। আমি তার মুখে আমার কথা দিয়ে দেব। তিনি আমার নির্দেশিত বাণী দিয়ে কথাবার্তা বলবেন। আর যারা তার মুখস্থিত আমার কথা না শুনবে তাদেরকে আমি জিজ্ঞাসাবাদ করব।” (দ্বিতীয় বিবরণ, ১৮ : ১৮-১৯)

উক্ত উক্তির সারাংশ হলো— আবির্ভূত ব্যক্তির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে:

১. তিনি হবেন মুসা আ. এর মত।
২. তিনি ইসরাইলীদের ভাইদের তথা ইসমাইলিয় বংশ থেকে আসবেন।
৩. আল্লাহ তা‘আলা নিজ বাণীকে তার মুখে দিয়ে দিবেন। তিনি তার নির্দেশিত বিষয়সমূহ মানুষকে জানিয়ে দিবেন।

এবার আসুন! আমরা এই বৈশিষ্ট্যগুলোকে একটু গভীরভাবে বিশ্লেষণ ও চিন্তা করি।

১. মুসা আ. এর মত নবী:

মুসা আ. ও মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের মধ্যকার যেমন মিল রয়েছে অন্যান্য নবীদের মধ্যে সে রকম মিল অন্য দু‘জন নবীর মধ্যে খুঁজে পাওয়া খুবই কষ্টকর। তারা উভয়েই পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান নিয়ে এসেছেন। তারা প্রত্যেকেই শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করে আশ্চর্যজনকভাবে বিজয়ী হয়েছেন। তাদের প্রত্যেকেই ছিলেন নবী ও রাষ্ট্রপ্রধান। এবং তারা প্রত্যেকেই নিজের মাতৃভূমি থেকে তাদের বিরুদ্ধে হত্যার ষড়যন্ত্রের কারণে হিজরত (যাত্রা) করেছেন।

ঈসা আ. ও মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের মধ্যে উপরের মত মিল নেই এবং অন্যান্য ক্ষেত্রেও মিল নেই যেমন— স্বাভাবিক জন্ম, পারিবারিক জীবন এবং মুসা আ. ও মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের মত স্বাভাবিক মৃত্যু; যেহেতু ঈসা আ. ইন্তেকালই করেন নি।

মুসা আ. ও মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রত্যেকের উম্মতেরা তাদেরকে যেমন আল্লাহ তা‘আলার নবী মনে করেন; ঈসা আ. এর অনুসারীরা তাকে তেমন নবী মনে করে না বরং আল্লাহ তা‘আলার পুত্র মনে করে। এ ছাড়া মুসলিমরা ঈসা আ. কেও আল্লাহ তা‘আলার নবী বলে বিশ্বাস করে।

উপরের আলোচনা থেকে এ কথা বলা যায় যে, বাইবেলের ভবিষ্যদ্বাণী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে মিলে যায়; ঈসা আ. এর সাথে নয়। কারণ, মুসা আ. এর সাথে ঈসা আ. এর তুলনায় মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাদৃশ্যই বেশি।

অপরদিকে, “গসপেল অব জন” থেকে জানা যায় যে, ইহুদিরা তিনটি স্বতন্ত্র ভবিষ্যদ্বাণীর অপেক্ষা করছিল। সেগুলো হল-

১. ঈসা আ. এর আবির্ভাব

২. ইলিয়ার (Elija) আবির্ভাব।

৩. মহানবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের আবির্ভাব।

জন দ্য ব্যাপ্টিস্ট (ইয়াহিয়া আ.) -কে জিজ্ঞাসা করা তিনটি প্রশ্ন থেকেই এটা স্পষ্ট হয় যে, তারা তিনটি ভবিষ্যদ্বাণীর অপেক্ষা করছিল: “এই হলো জনের সাক্ষ্য, যখন জেরুজালেমের ইহুদিরা পাদ্রীদেরকে পাঠাল এই প্রশ্ন করতে যে, ‘কে আপনি? তিনি নিজের পরিচয় দিলেন, অস্বীকার করেন নি। তিনি তাদেরকে বললেন: আমি খ্রিষ্ট নই। তারা জিজ্ঞাসা করল: তাহলে আপনি কি ইলিয়‘? উত্তরে বললেন: না। তারা বলল: আপনি কি সেই নবী? তিনি বললেন: না” (জন ১: ১৯-২১)

যদি আমরা বাইবেলের পাতার পার্শ্ব-টীকার দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাই যে, সেখানে (জন ১:২১) উল্লেখিত “Prophet” শব্দটি  Deutaronomy (দ্বিতীয় বাণী) এর 18 : ১৫ এবং ১৮ : ১৮ তে উল্লেখিত ভবিষ্যদ্বাণীর সাথে সম্পৃক্ত। উক্ত আলোচনার পর এখন আমরা বলতে পারি যে, Deutaronomy (দ্বিতীয় বাণী) এর 18 : ১৮ তে উল্লেখিত নবী বলে ঈসা আ. কে বুঝানো হয় নি।

২. ইসরাইলীদের ভ্রাতৃবর্গ থেকে:

ইব্রাহীম আ. এর ছিল দুই সন্তান; ইসমাইল ও ইসহাক আ. (Genesis বা আদিপুস্তক ২১)। ইসমাইল আ. হলেন আরবদের পূর্বপুরুষ। আর ইসহাক আ. ইহুদি জাতির পূর্বপুরুষ। আর যে নবীর ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে তিনি ইহুদীদের মধ্য থেকে আসবেন না। বরং তিনি আসবেন তাদের ভ্রাতৃবর্গদের মধ্য থেকে, তথা ইসমাইল আ. এর বংশ থেকে। মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামও ইসমাইল আ. এর বংশ থেকে এসেছেন। সুতরাং, তিনিই বাইবেলে উল্লিখিত আকাঙ্ক্ষিত নবী।

বাইবেলের ইশাঈয়া ৪২ : ১-১৩ তে আলোচনা করা হয়েছে একজন আল্লাহর বান্দা “যাকে নির্বাচন করা হয়েছে” এবং “রাসূল (দূত)” সম্পর্কে। বলা হয়েছে যে, তিনি শরীয়ত তথা জীবনবিধান নিয়ে আসবেন। “তিনি তা পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা না করা পর্যন্ত ক্ষান্ত বা পিছপা হবেন না। দ্বীপের অধিবাসীরা তার আনিত জীবনবিধানের জন্য অপেক্ষায় থাকবেন।” (ইশাঈয়া ৪২ : ৪) ১১ নং উক্তিতে রাসূল বা দূতকে “কেদারের” বংশ থেকে আবির্ভাব হবে বলে বলা হয়েছে। Genesis (আদিপুস্তক) ২৫:১৩ অনুসারে কেদার হলেন— ইসমাইল আ. এর দ্বিতীয় পুত্র ও মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের পূর্বপুরুষ।

৩. আল্লাহ এই নবীর মুখে তার বাণী রাখবেন:

আল্লাহ তা‘আলা তার বাণী কুরআন মাজীদকে বাস্তবিকই তার মুখে দিয়ে দিয়েছেন। তিনি জিবরাইল আ. কে পাঠিয়েছেন মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তার বাণী শিক্ষা দেবার জন্য। আর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সাহাবীদের দিয়ে জিবরাইল আ. এর কাছ থেকে যেমন শুনতেন তেমনি লিখিয়ে নিতেন। সুতরাং, কুরআনের বাণী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথা নয়। তার নিজের চিন্তা-প্রসূত নয়। বরং, তা জিবরাইল আ. এর মাধ্যমে তার মুখে রাখা হয়েছে। আর মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবদ্দশাতেই এবং তার নিজের পরিচালনাতেই সাহাবীরা কুরআনকে লিপিবদ্ধ ও কণ্ঠস্থ করেছেন।


এটা পড়ুন – মানবাধিকার ও হযরত মুহাম্মদ সা. : আবদুল খালেক


লক্ষ করুন, Deutaronomy (দ্বিতীয় বর্ণনা) -এ বলা হয়েছে, “আর যারা তার মুখস্থিত আমার কথা না শুনবে আমি তাদেরকে আমি জিজ্ঞাসাবাদ করব।” (দ্বিতীয় বর্ণনা ১৮:১৯) এর অর্থ হচ্ছে যে, যে ব্যক্তি বাইবেলে বিশ্বাস করবে, তাকে অবশ্যই এই নবীর কথা বিশ্বাস করতে হবে। আর এ নবী হচ্ছেন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম।

(বাইবেলে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্বন্ধে আরও জানতে www.islam-guide.com/mib ব্রাউজ করতে পারেন) বাইবেলের-ভবিষ্যদ্বাণী

হিন্দুদের ভগবান যখন ইসলাম প্রচারক – একটি ঈমানদীপ্ত কাহিনী

“অজ্ঞানতার দুনিয়ায় আমি ‘ভগবান’ হিসেবে পূজিত ছিলাম, আলোকিত বিশ্বে আমি নিজকে মানুষ হিসেবে খুঁজে পেয়েছি।” ডঃ স্বরূপজী
ডঃ স্বরূপজী ইসলামে মুক্তির স্বাদ পেলেন গত ১০ই মে (১৯৮৬) ভারতের সাম্প্রতিক কালের এক মহাত্মা ধর্মগুরু যিনি সেদিন পর্যন্ত সেদেশের সর্বত্র ‘ভগবান’ নামে পরিচিত ও পূজিত ছিলেন সেই ডঃ শিবশক্তি স্বরূপজী মহারাজ উদাসেন নিজ স্ত্রী ও কন্যাসহ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তাহার নতুন নাম রাখা হয় ইসলামুল হক, পত্নীর নাম খোদেজা হক আর কন্যা নাম রাখা হয় আয়েশা হক। গুজরাটের প্রভাবশালী সাপ্তাহিক ‘শাহীন’ এর তরফ হতে সম্প্রতি ডঃ ইসলামুল হকের এক সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয়। ১ মার্চ ৮৭ তারিখে সাপ্তাহিক ‘শাহীন] এর প্রকাশিত উক্ত সাক্ষাৎকারটি ইত্তেফাকের পাঠক-পাঠিকা বর্গের নিকট প্রেরণ করেছেন মোহাম্মদ মাহফুজুর রহমান, পোষ্ট বক্স নং-২৫, জেদ্দা-২১৪১, সৌদি আরব হতে।

প্রশ্নঃ ইসলাম গ্রহণের পর আপনি কি অনুভব করছেন?
উত্তরঃ আল্লাহর হাজার শোকর যে, তিনি আমাকে ঈমানের অমূল্য সম্পদ প্রদান করেছেন। আমি নিজকে পৃথিবীর এক ভাগ্যবান ও বিজয়ী পুরুষ বলে মনে করি। অজ্ঞানতার দুনিয়ায় আমি ‘ভগবান’ হিসেবে পূজিত ছিলাম, আলোকিত বিশ্বে আমি নিজকে মানুষ হিসেবে খুঁজে পেয়েছি। হিন্দুদের ভগবান

প্রশ্নঃ আপনাকে ধন্যবাদ। এখন আপনি মেহেরবানী করে আপনার আগের নাম ও পরিচয় সম্বন্ধে কিছু বলুন?
উত্তরঃ আমার নাম মহানত, ডঃ শিবশক্তি স্বরূপজী মহারাজ উদাসেন, ধর্মচারিয়া, আদ্যশক্তিপীঠ। উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত আমার পেশা মহানতগিরি। বৃন্দাবনে ‘অনাখন্ড আশ্রম’ নামে আমার বড় আশ্রম ছিল। দ্বিতীয় আশ্রম ছিল বোম্বাইয়ের মুলুনডে। আর তৃতীয় দেবালেইনে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের এই আশ্রমটির নির্মাণ কাজ প্রায় ৫০ একর জমির উপর চলছিল। ‘খারাপ পথে’ চলা মানুষের সুপথে আনার উদ্দেশ্যে শিক্ষাদান’ পথ প্রদর্শন ও শিষ্য তৈরী করা ছিল আমার প্রাত্যহিক কাজ।

প্রশ্নঃ আপনার পাণ্ডিত্যের খ্যাতি সর্বত্র। আপনি আপনার নিজের সম্পর্কে, নিজের শিক্ষা জীবন ও ধর্মজীবন সম্পর্কে কিছু বলুন।
উত্তরঃ আশ্রমেই আমার শিক্ষার সূচনা হয়। পরে এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ওরিয়েন্টালিজমে এম.এ। গুরুকুল কাংডি থেকে ‘আচারিয়া’ (আচার্য) পদবী লাভ। ব্রিটেনের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিশ্বের দশটি প্রধানতম ধর্মের উপর ডক্টর অব ডিভাইনিটি এবং সেই সাথে ওরিয়েন্টালিজমে আরেক পি.এইচ.ডি। পোপ পল-৬ এর আহবানে ইতালী যাই। সেখানে সাতটি বিভিন্ন বিষয়ে ভাষণ দান করি। আমাকে এক মহাসম্মান ভাটিকানের নাগরিত্ব দান করা হয়। এবং খ্রীষ্ট ধর্ম গ্রহণের জন্য বিশেষ অনুরোধ জানান হয়। আমি তদের অনুরোধ উপেক্ষা করে ভারতে এসে বিধিমত মুকুট ধারণ করে আশ্রমের গদিতে বসে পড়ি। আমার জন্ম ১৯৩৬ সালের ২ ফেব্রুয়ারী। জন্মস্থান মথুরা, বৃন্দাবন। আমি প্রায় ১২টি ভাষা জানি, এর মধ্যে ইংরেজী, সংস্কৃত, গ্রীক, হিন্দি, পালি, গোরমুখী, মারাঠী, গুজরাতি, উর্দু ও আরবী আমার ভাল লাগে।

… আগেই বলেছি, আমি দুনিয়ার দশটি প্রধানতম ধর্মের উপর তুলনামূলক পড়াশুনা ও গবেষণা করেছি। সে জন্য সত্য স্বীকারে আমার কোন সংকোচ ছিল না। আমার সমকালীনদের মধ্যে হিন্দু জগতের বড় বড় জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিত্ব ও পন্ডিত রয়েছেন। যেমন জগৎগুরু শংকরাচার্য, রামগোপাল শারওয়ালে, পুরীর শংকরাচার্য, মহামন্ডেলশ্বর স্বামী অখন্ডানন্দজী, গুরু গোলওয়ালকার বাবা সাহেব দেশমুখ, বালঠাকুরে, অটলবিহারী বাজপায়ী, নানা সাহেব, দেশমুখ, বিনোবা ভাবে এবং অন্যান্য। একবার তিনি তার “পরমধাম” আশ্রমে আমাকে বক্তৃতাদানের বিশেষ আমন্ত্রণ জানান।

সেখানে উপস্থিত লোকজনের সামনে দাদা ধর্মাধীকারী আমাকে জিজ্ঞাসা করে বসেনঃ “আপনি পৃথিবীর বিভিন্ন ধর্ম সম্বন্ধে পড়াশুনা করেছেন, মানুষের জন্য কোন ধর্ম শ্রেষ্ঠ বলে মনে হয়? আমি জবাবে বলেছিলাম,‘ইসলাম’ আমার জওয়াবে দাদা খুশী হন নাই। তিনি বলেন, উঠেন, “ইসলাম নানা বাধা-বন্ধন আরোপ করে।” আমি জবাব দিলাম, “যে বন্ধন বাঁধে, সেই বন্ধনই মুক্তি দিতে পারে। আর যে প্রথম থেকে স্বাধীন, তার সারা জীবনের জন্য বন্ধন সৃষ্টি প্রবণতা থেকে যাবে। এ ধরনীতে মানুষকে এক সাথে বেঁধে রাখার জন্য বন্ধনকারী ধর্মের প্রয়োজন রয়েছে, যা তাদের পৃথিবীতে ভাল করে বেঁধে রাখবে এবং পরলোকে মুক্ত করে দেবে। আর এ রকম ধর্ম আমার মতে একমাত্র ইসলামেই রয়েছে। ইসলাম ছাড়া এরকম ধর্ম আমি আর দেখি না।” ( হিন্দুদের ভগবান )

প্রশ্নঃ নিজের ইসলাম গ্রহণের কারণ সম্পর্কে কিছু বর্ণনা করুন।
উত্তরঃ ১৯৮৪’র জানুয়ারীর কথা। এক রাত্রে আমি স্বপ্ন দেখলাম। একদল লোক আমাকে ধাওয়া করছে। আমি দৌড়চ্ছি তারাও দৌড়চ্ছে। আমি দাঁড়াই, তারাও দাঁড়ায়। হঠাৎ আমি ধাক্কা খেলাম এবং মাটিতে পড়ে গেলাম। দু’টি অজানা হাত আমাকে ধরে দাঁড় করালো। দাঁড়িয়ে এক নূরানী চেহারার দিকে অবাক হয়ে থাকিয়ে রইলাম। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক ভদ্রলোক আমাকে বললেন, ইনি হযরত মোহাম্মদ (সাঃ)। আমার শরীর কাঁপতে শুরু করল। নবীজী বললেন, ‘‘কলমা পড়।” আমি কলমা পড়লাম। তিনি আমার ডান হাত নিজের পবিত্র হাতের মধ্যে রেখে যা যা পড়াতে লাগলেন, আমি তা পড়তে লাগলাম। এমনি করে পড়া শেষ হলো। তার পর তিনি আমাকে আলিঙ্গন করলেনঃ আর বললেন, “এ দেশকে কলমা পড়াও।” আমি কতক্ষণ ধরে এ স্বপ্ন দেখেছিলাম, তা আমার মনে নেই। যখন চোখ খুললাম, দেখলাম রাত তিনটা বাজে। একই রাতে, একই সময়ে আমার স্ত্রীও এ ধরনের স্বপ্ন দেখেছিলেন। … আমরা স্বামী-স্ত্রী দুজনেই নিজেদের প্রথম শতাব্দীর মুসলমান বলে ভাবতে লাগলাম। আমি বিধিসম্মতভাবে মুসলমান হবার উপায় খুঁজতে লাগলাম, এখানে সেখানে ঘুরি, আর মুসলমানদের সাথে সম্পর্ক বাড়াই। চুপিসারে নামায পড়ি। এবাদত বন্দেগী করি। পরিশেষে ভাগ্যক্রমে আলেমদের শহর ভূপাল পৌঁছই। ১৯৮৬-এর ১০ই মে, রমজান মাসের চাঁদ দেখার সাথে সাথে আমি আমার স্ত্রী আর আমার যুবতী কন্যা প্রকাশ্যভাবে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করি। আলহামদুলিল্লাহ ( হিন্দুদের ভগবান )

প্রশ্নঃ আপনি বহু ধর্ম অধ্যয়ন করেছেন। ইসলামের পূর্ববর্তী ধর্মগ্রন্থে আল্লাহ, কুরআন, মোহাম্মদ (সাঃ) অথবা ইসলাম সম্পর্কে কোন বর্ণনা দেখতে পেয়েছেন?
উত্তরঃ বৌদ্ধ ও জৈন মতবাদ ছাড়া বাকী সব ধর্ম গ্রন্থে আল্লাহ, মোহাম্মদ (সাঃ) অথবা আহমদ নাম পাওয়া যায়। বেদে খুবই স্পষ্টভাবে পাওয়া যায়।


এটা পড়ুন – এক আমেরিকান নওমুসলিম নারীর ঈমানদীপ্ত কাহিনী !


প্রশ্নঃ আপনি লাখ লাখ টাকার সম্পদের মোহ ছেড়ে দিয়ে ইসলাম কবুল করেছেন। বর্তমানে আপনি কিভাবে জীবন নির্বাহ করছেন? ( হিন্দুদের ভগবান )
উত্তরঃ আমি সমগ্র বিশ্বের রাজত্বও ইসলামের এই মহান উপহারের বদলে ত্যাগ করতে দ্বিধা বা কুণ্ঠাবোধ করতাম না। ইসলাম গ্রহণের মাধ্যমে যে তৃপ্তি আমি পেয়েছি সাতরাজ্যের ধন সম্পদ লাভ করেও তা পাওয়া সম্ভব নয়। আমি আয়ুর্বেদিক পদ্ধতিতে চিকিৎসা করি। আল্লাহ তায়ালার কৃপায় প্যারা মাইক্রো পন্থায় দুরারোগ্য ব্যাধির উপশম ঘটাই। এতেই আমার, আমার পরিবারের ডাল রুটির ব্যবস্থা হয়ে যায়।

প্রশ্নঃ সারওয়ারে কায়েনাত হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) সম্পর্কে আপনার ধারণা কি?
উত্তরঃ আমি আল্লাহ তায়ালাকে চিনতাম না। আল্লাহর কসম, তিনি আমাকে রাব্বে জুলজালালকে চিনিয়ে দিয়েছেন…..।

হিন্দুদের ভগবানপ্রশ্নঃ ইসলামের সিপাহী হিসেবে আপনি দুনিয়ার মুসলমানদের উদ্দেশ্যে কি বাণী রাখতে চান। …. আপনার মতে মুসলমানদের কেমন হওয়া উচিত?
উত্তরঃ এ ব্যাপারে নবীজি যা বলেছেন তার চেয়ে ভাল কিছু আর কে বলতে পারে? তিনি মুসলামনদেরকে এমন সোনার টুকরার সাথে তুলনা করেছেন কোন অবস্থায়ই যার ঔজ্জ্বল্য কমে না। আরেক জায়গায় তিনি মুসলমানদের তুলনা করেছেন মধুমক্কীকার সাথে, যা ফুলের উপর গিয়ে বসে, নোংরা জায়গায় বসে না। ফুল থেকে রস চুষে মধু বানায়, বিষ তৈরী করে না। আর তা সে নিজের জন্য নয়, অপরের জন্য তৈরী করে। সে ডালে বসে, সে ডালের কোন ক্ষতি করে না। অন্যত্র তিনি বলেছেন, মুসলমান সেই, যার হাত ও কথা থেকে অন্য মুসলমান নিরাপদ থাকে।

প্রশ্নঃ আপনার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কিছু বলুন।
উত্তরঃ স্বার্থপরতার জাল হঠাতে হবে। মুসলিম মুজাহিদদের নতুন শপথ নিয়ে মঠে নামতে হবে। সাহস, নিঃস্বার্থ ঈমান, আর মন-প্রাণ ঢেলে কাজে নামতে হবে। আমার নিজের তরফ থেকে আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টায় আছি। সমগ্র মুসলিম সমাজকে এক দেহ আর এক প্রাণে পরিণত করতে হবে।

নারী অধিকার আন্দোলন : ভুল পথে যার পথচলা।

‘অধিকার’ পাওয়ার অধিকার সকলেই সংরক্ষণ করে। চাই সে পুরুষ হোক বা নারী। কিন্তু বিশ্বব্যাপী সর্বত্র শুধু নারী অধিকারের কথা শোনা যায়। পুরুষের অধিকার নিয়ে কোথাও কোন মিছিল-মিটিং বা সেমিনার-সিম্পোজিয়ামের আয়োজন করা হয়েছে এমনটা শোনা যায় নি। এটা নিয়ে অবশ্য পুরুষদের মনে তেমন কষ্ট নেই। তাদের নিষ্ক্রিয় ভাব-ভঙ্গিই এর প্রমাণ। এর কারণ হয়ত পুরুষদের তুলনায় নারীদের বেশি অধিকার বঞ্চিত হতে হয়। তাই তারা প্রতিবাদ করবে ও নিজ অধিকার ফিরে পাওয়ার জোর চেষ্টা চালাবে এটাই স্বাভাবিক।

অনেক ক্ষেত্রে পুরুষ সমাজের কিছু লোককেও দেখা যায় যারা নারীর অধিকার নিয়ে কথা বলেন। পুরুষ শাসিত সমাজে তাদের বঞ্চনা ও নিগৃহীত হওয়ার নিষ্কৃতি চেয়ে রাজপথে বড় বড় ব্যানার-ফেস্টুন নিয়ে র্যায়লি করেন। পত্রিকার পাতায় মাঝে মাঝে এ বিষয়ে কলাম লিখেন। নারীদরদি হিসেবে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন সংগঠন থেকে বাহবা পান। এদের মধ্যে বড় একটা অংশ কম্যুনিস্ট, যাদের বেশির ভাগ বক্তব্য আর লেখনি নারী অধিকার বিষয়ে হয়ে থাকে। কিছু কিছু নাস্তিকও এই দলে আছে।

‘কথা সত্য মতলব খারাপ’ বলে একটা প্রবাদ আছে। এই সমস্ত নারীবাদীদের কথা মনে হলেই এই প্রবাদটি স্মরণ হয়ে যায়। কারণ তারা নারীর জন্য যে অধিকারের কথা বলে সেটা আসলে তাদের নিজেদের স্বার্থে। নারীর অধিকার বলতে তারা বুঝায় নারীর অবাধ চলাফেরার স্বাধীনতা। যাতে তাদের কল- কারখানা আর মেইল- ফ্যাক্টরি চালানোর জন্য কমদামী নারীশ্রমিকদের সহজেই পাওয়া যায়। নারী অধিকার আন্দোলনের গোড়ার দিকে তাকালে বিষয়টা কিছুটা স্পষ্ট হবে।


এটা পড়ুন ইসলাম ও নারীবাদ বা ফেমিনিজম


ইউরোপে শিল্প বিপ্লবের পরে ব্যাপক হারে কারখানা গড়ে উঠায় শ্রমিক সংকট দেখা দেয়।তখন মালিক পক্ষ সেই ঘাটতি পূরণ করতে নারীশ্রমিক নিয়োগ দেওয়া শুরু করে। কম বেতনে খাটতে রাজি থাকায় এবং মালিকদের নানা রকম জুলুম নির্যাতন অম্লান বদনে সয়ে যাবার ক্ষমতা থাকায় খুব সহজে তারা নিয়োগ পেতে থাকে। এবং কিছুটা অর্থনৈতিক স্বাবালম্বি হওয়ায় পুরুষের নাগপাশ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে শুরু করে। দিন দিন এই জাতীয় নারীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। বিভিন্ন কোম্পানি তাদের সমর্থন দিতে থাকে। এবং সেটা পরিপূর্ণ নিজেদের স্বার্থে।

এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ হল সেই সময়ে সিগারেট মুখে জিন্স পরা নারীর একটা ছবি পত্রিকার পাতায় আর রাস্তার পাশে বিল বোর্ডে ব্যাপক আকারে প্রচার করা হত। উদ্দেশ্য হল, পুরুষের যেমন সিগারেট খাওয়ার অধিকার আছে তেমনি নারীরও আছে। পরে জানা যায় এসব ব্যায়বহুল বিজ্ঞাপনের খরচ কিছু সিগারেট কোম্পানি বহন করত। কারণ পুরুষদের সাথে পাল্লা দিয়ে নারীরা অধিকারের নাম করে সিগারেট খাওয়া ধরলে তো তাদেরই লাভ।

চাকরির লোভ দেখিয়ে নারীদের অফিস পর্যন্ত আনা হল। কি চাকরি দেওয়া হল তাদের? কিছু ব্যাতিক্রম ছাড়া অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রিসিপ্সন, পার্সোনাল সেক্রেটারি, বিমানবালা, নার্স ইত্যাদি ক্ষেত্রেই তাদের বিচরণ সীমাবদ্ধ। উচ্চ ও সম্মানি পদে তাদের দেখা খুব কমই পাওয়া যায়। বিল বোর্ড বা কোন কিছুর মোড়কের দিকে তাকালেই বোঝা যায় কর্পোরেট দুনিয়ায় তাদেরকে কি পরিমানে পন্যে রূপান্তরিত করা হয়েছে।

আমাদের নারীদের উচিত ছিল তারা পাশ্চাত্য ধোঁকায় না পড়ে প্রথমে ইসলাম তাকে যে অধিকার দিয়েছে সে অধিকার প্রাপ্তি নিশ্চিত করা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল;
১; দেন মোহরের টাকা
২; বাবার রেখে যাওয়া মিরাস বা উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া সম্পত্তি।
৩; স্বামী কর্তৃক ভরণ-পোষণের দায়িত্ব।

আমাদের দেশের যেসব পুরুষ নারী অধিকারের নাম করে নারীকে পণ্যে পরিণত করতে ব্যস্ত ভাল করে খোঁজ নিলে দেখা যাবে তারা এখনও নিজের স্ত্রীকে তার মোহরের টাকাটাই ঠিকমত পরিশোধ করে নি। ভবিষ্যতে যে আদায় করবে সে লক্ষণও নেই। মহিলাগুলোও নাদান। অধিকার নিয়ে আন্দোলন যখন করবি তো স্বামীর থেকে নিজের পাওনা বুঝে নেওয়ার মাধ্যমেই শুরু কর। তা না করে এরা অন্যান্য অধিকার নিয়ে ব্যস্ত। স্বামীরাও হাত তালি দিয়ে তাদের উৎসাহ দেয়। তাহলে না আর স্ত্রীর মোহরের টাকা চাওয়ার কথা খেয়াল হবে না।

ইসলাম ভাইকে দুই ভাগ আর বোনকে এক ভাগ দিয়েছে। এটা নিয়ে সমালোচনার শেষ নাই। সমঅধিকারের নামে তাই কোরআনের ফয়সালা উলটিয়ে দিতে কিছু লোক জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ভায়েরা যে ঐ এক অংশও ছলে বলে কৌশলে মেরে দিচ্ছে, বোনদের মিরাস থেকে বঞ্চিত করছে সেটা নিয়ে কোন উচ্চ-বাচ্চ নাই। এই মেরে দেওয়াটাকে সহজ করতে নানা রকম গল্পও তারা ফাঁদে। যেমন মিরাস নিতে নাই , এতে নাকি ভাই-বোনের সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায়। আরও কত কি! এই সেদিনও আমার মেঝো বোন আমাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘বাপের বাড়ি থেকে হক নিয়ে আসলে নাকি আর হয় না?’ আমি বললাম, ‘কী হয় না?’ সে আবারও বললো, ‘হয় না। নষ্ট হয়ে যায়।’ পরে বুঝলাম সে আসলে বাচ্চার কথা বলতে চাচ্ছে। মানে, মেয়েরা বাপের বাড়ির ওয়ারেসি সম্পত্তি নিয়ে আসলে তাদের আর বাচ্চাকাচ্চা হয় না। হলেও নষ্ট হয়ে যায় বা মরে যায় কিংবা কোন না কোন ক্ষতির স্বীকার হয় বাচ্চা। আমি বললাম, ‘এগুলো তো ভাওতাবাজিমার্কা কথাবার্তা। যারা বোনদের ঠগাতে চায় তারাই এসব ফালতু কথাবার্তা সমাজের বুকে ছড়িয়েছে। বোন কী অন্যের জিনিস মেরে খাচ্ছে? সে তো নিজের পাওনাটুকুই শুধু নিচ্ছে। অতিরিক্ত কিছু না।’

স্ত্রী সন্তানের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব স্বামীকে দেয়া হয়েছে। কিন্তু মহিলা তাতে সন্তুষ্ট না। তাই সে নিজের সন্তানকে নার্সিং হোমে বা কাজের বুয়ার কাছে রেখে চলে যায় চাকরিতে। এখানে এসে নারী খেই হারিয়ে ফেলে। তার অধিকারের কথা মনে থাকে না। সে ভাবে না, আরে এটা তো আমার দায়িত্ব না। আমি তো পায়ের উপর পা তুলে শুধু খাব আর ঘুমাব। আমি কেন রোদ-বৃষ্টিতে ভিজে চাকরি নামক অন্যের ফুট-ফরমাশ খাটতে যাব?

সেদিন সিসিটিভিতে ক্যাপচার হওয়া একটা ভিডিও দেখে আঁতকে উঠেছিলাম। এসজন মা তার বাচ্চাকে বেবি-কেয়ারের এক মহিলাকে দিয়ে বের হয়ে গেলেন। ওই মহিলা বাচ্চাকে লিফটের বদ্ধ রুমে আচ্ছা মতো চড়-থাপ্পড় দিলো। অপরাধ কিছুই না। বাচ্চাটা কেন কান্না থামাচ্ছে না এটা ছিলো তার ক্ষোভ। মায়ের মমতা অন্যের কাছে কি কখনও আশা করা যায়!

রাস্তায় বের হলে যখন দেখি পাবলিক বাসে ঠেলাঠেলি করে মা বোনরা বাসে উঠছে তখন সত্যিই করুনা হয়। ইসলাম তো চাকরি করাকে হারাম করে নি। কেউ করতে চাইলে করবে। তবে সেক্ষেত্রে নারীদের জন্য আলাদা অফিস হবে। আলাদা বাস হবে। তারা যাবে তাদের মত।পুরুষরা যাবে পুরুষদের মত। পুরুষের সাথে বাসে লটকা-লটকি করে অফিসে যাবার কোনই দরকার হবে না তাদের জন্য। কিন্তু আজ পর্যন্ত এমন দাবি নিয়ে কেও আন্দোলনে নামে নি। ভায়েরা কেন বাবার মিরাস মেরে দেয় বা স্বামীরা কেন মোহরের টাকা ঠিক মত দেয় না এটা নিয়ে কোন সেমিনারের আয়োজন করেনি। এরা ইসলাম সমর্থিত এইসব অধিকার না চেয়ে পশ্চিমাদের বাতিয়ে দেয়া অধিকার চাওয়ায় তাদের একূলও যাচ্ছে ওকূলও যাচ্ছে।
—————
লেখক – আবদুল্লাহ আল মাসউদ, বহু গ্রন্থপ্রনেতা ।

স্মৃতিশক্তি বাড়ানো – জেনে নিন স্মৃতিশক্তি বাড়ানোর সেরা ১২ টি ইসলামী উপায় ।

মুসাফির শহীদ- আমরা যারা ইসলামকে সামান্য হলেও মেনে চলার চেষ্টা করি তাদের অনেকেরই ইচ্ছা থাকে নতুন নতুন দু’আ, কুর’আনের আয়াত ও সূরা মুখস্থ করার। হয়তো আমরা অনেকেই সে চেষ্টা করেছি। কেউ কেউ সফল হয়েছি এবং হচ্ছি। কেউবা আবার ব্যর্থ হয়ে হাল ছেড়েও দিয়েছি। মুখস্ত করতে ব্যর্থ হওয়ার পেছনের একটি অন্যতম কারণ হলো এটা মনে করা যে,আমাদের স্মৃতিশক্তি কমে গিয়েছে। তাহলে এই স্মৃতিশক্তি বাড়ানোর উপায় কী? আসুন এ ব্যাপারে জেনে নেই কিছু কৌশল। স্মৃতিশক্তি বাড়ানো —

স্মৃতি বলতে মূলত তথ্য ধারণ করে পুনরায় তা ফিরে পাওয়ার প্রক্রিয়াকে বোঝায়। বিজ্ঞানীরা আমাদের স্মৃতিকে প্রধানত দুভাগে ভাগ করেছেনঃ ১. স্বল্পস্থায়ী বা স্বল্প মেয়াদী স্মৃতি, ২. দীর্ঘস্থায়ী বা দীর্ঘ মেয়াদী স্মৃতি। খুব অল্প সময়ের জন্য আমাদের মস্তিষ্কে যে সব স্মৃতি স্থায়ী থাকে সেগুলো হচ্ছে স্বল্পস্থায়ী স্মৃতি। আর দীর্ঘ সময়ের জন্য আমাদের মস্তিষ্কে যেসব স্মৃতি সংরক্ষিত থাকে সেগুলো হচ্ছে দীর্ঘস্থায়ী স্মৃতি। এই লেখায় আমরা মূলত দীর্ঘস্থায়ী স্মৃতিশক্তি বাড়ানোর কিছু কৌশল নিয়ে আলোচনা করবো। স্মৃতিশক্তি বাড়ানো —-

১. ইখলাস বা আন্তরিকতাঃ যে কোনো কাজে সফলতা অর্জনের ভিত্তি হচ্ছে ইখলাস বা আন্তরিকতা। আর ইখলাসের মূল উপাদান হচ্ছে বিশুদ্ধ নিয়ত। নিয়তের বিশুদ্ধতার গুরুত্ব সম্পর্কে উস্তাদ খুররাম মুরাদ বলেন,

 

উদ্দেশ্য বা নিয়ত হল আমাদের আত্মার মত অথবা বীজের ভিতরে থাকা প্রাণশক্তির মত। বেশীরভাগ বীজই দেখতে মোটামুটি একইরকম, কিন্তু লাগানোর পর বীজগুলো যখন চারাগাছ হয়ে বেড়ে উঠে আর ফল দেওয়া শুরু করে তখন আসল পার্থক্যটা পরিস্কার হয়ে যায় আমাদের কাছে। একইভাবে নিয়ত যত বিশুদ্ধ হবে আমাদের কাজের ফলও তত ভালো হবে।

এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা’আলা বলেন,

তাদেরকে এছাড়া কোন নির্দেশ করা হয়নি যে, তারা খাঁটি মনে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর এবাদত করবে, নামায কায়েম করবে এবং যাকাত দেবে। এটাই সঠিক ধর্ম। [সূরা আল-বায়্যিনাহঃ ৫]

তাই আমাদের নিয়ত হতে হবে এমন যে, আল্লাহ আমাদের স্মৃতিশক্তি যেনো একমাত্র ইসলামের কল্যাণের জন্যই বাড়িয়ে দেন।

২. দু’আ ও যিকর করাঃ আমরা সকলেই জানি আল্লাহর সাহায্য ছাড়া কোনো কাজেই সফলতা অর্জন করা সম্ভব নয়। এজন্য আমাদের উচিত সর্বদা আল্লাহর কাছে দু’আ করা যাতে তিনি আমাদের স্মৃতিশক্তি বাড়িয়ে দেন এবং কল্যাণকর জ্ঞান দান করেন। এক্ষেত্রে আমরা নিন্মোক্ত দু’আটি পাঠ করতে পারি,

 

“হে আমার পালনকর্তা, আমার জ্ঞান বৃদ্ধি করুন।” [সূরা ত্বা-হাঃ ১১৪]

 

তাছাড়া যিকর বা আল্লাহর স্মরণও স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন,

“…যখন ভুলে যান, তখন আপনার পালনকর্তাকে স্মরণ করুন…” [সূরা আল-কাহ্‌ফঃ ২৪]

তাই আমাদের উচিত যিকর, তাসবীহ (সুবহান আল্লাহ), তাহমীদ (আলহামদুলিল্লাহ), তাহলীল (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ) ও তাকবীর (আল্লাহু আকবার) – এর মাধ্যমে প্রতিনিয়ত আল্লাহকে স্মরণ করা।

৩. পাপ থেকে দূরে থাকাঃ প্রতিনিয়ত পাপ করে যাওয়ার একটি প্রভাব হচ্ছে দুর্বল স্মৃতিশক্তি। পাপের অন্ধকার ও জ্ঞানের আলো কখনো একসাথে থাকতে  পারে না। ইমাম আশ-শাফি’ঈ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,

 

আমি (আমার শাইখ) ওয়াকীকে আমার খারাপ স্মৃতিশক্তির ব্যাপারে অভিযোগ করেছিলাম এবং তিনি শিখিয়েছিলেন আমি যেন পাপকাজ থেকে নিজেকে দূরে রাখি। তিনি বলেন, আল্লাহর জ্ঞান হলো একটি আলো এবং আল্লাহর আলো কোন পাপচারীকে দান করা হয় না।

আল-খাতীব ​আল-জামী'(২/৩৮৭) গ্রন্থে ​বর্ণনা করেন যে ইয়াহইয়া বিন ইয়াহইয়া বলেনঃ

এক ব্যক্তি মালিক ইবনে আনাসকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘হে আবদ-আল্লাহ, আমার স্মৃতিশক্তিকে শক্তিশালী করে দিতে পারে এমন কোন কিছু কি আছে? তিনি বলেন, যদি কোন কিছু স্মৃতিকে শক্তিশালী করতে পারে তা হলো পাপ করা ছেড়ে দেয়া।

যখন কোনো মানুষ পাপ করে এটা তাকে উদ্বেগ ও দুঃখের দিকে ধাবিত করে। সে তার কৃতকর্মের ব্যাপারে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে। ফলে তার অনুভূতি ভোঁতা হয়ে যায় এবং জ্ঞান অর্জনের মতো কল্যাণকর ‘আমল থেকে সে দূরে সরে পড়ে। তাই আমাদের উচিত পাপ থেকে দূরে থাকার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করা।

৪. বিভিন্ন উপায়ে চেষ্টা করাঃ একটু গভীরভাবে লক্ষ্য করলে আমরা দেখবো যে, আমাদের সকলের মুখস্থ করার পদ্ধতি এক নয়। কারো শুয়ে পড়লে তাড়াতাড়ি মুখস্থ হয়, কারো আবার হেঁটে হেঁটে পড়লে তাড়াতাড়ি মুখস্থ হয়। কেউ নীরবে পড়তে ভালোবাসে,কেউবা আবার আওয়াজ করে পড়ে। কারো ক্ষেত্রে ভোরে তাড়াতাড়ি মুখস্থ হয়, কেউবা আবার গভীর রাতে ভালো মুখস্থ করতে পারে। তাই আমাদের প্রত্যেকের উচিত নিজ নিজ উপযুক্ত সময় ও পারিপার্শ্বিক পরিবেশ ঠিক করে তার যথাযথ ব্যবহার করা। আর কুর’আন মুখস্থ করার সময় একটি নির্দিষ্ট মুসহাফ (কুর’আনের আরবি কপি) ব্যবহার করা। কারণ বিভিন্ন ধরনের মুসহাফে পৃষ্ঠা ও আয়াতের বিন্যাস বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। একটি নির্দিষ্ট মুসহাফ নিয়মিত ব্যবহারের ফলে মস্তিষ্কের মধ্যে তার একটি ছাপ পড়ে যায় এবং মুখস্থকৃত অংশটি অন্তরে গভীরভাবে গেঁথে যায়।

৫. মুখস্থকৃত বিষয়ের উপর আমল করাঃ আমরা সকলেই এ ব্যাপারে একমত যে, কোনো একটি বিষয় যতো বেশিবার পড়া হয় তা আমাদের মস্তিষ্কে ততো দৃঢ়ভাবে জমা হয়। কিন্তু আমাদের এই ব্যস্ত জীবনে অতো বেশি পড়ার সময় হয়তো অনেকেরই নেই। তবে চাইলেই কিন্তু আমরা এক ঢিলে দু’পাখি মারতে পারি। আমরা আমাদের মুখস্থকৃত সূরা কিংবা সূরার অংশ বিশেষ সুন্নাহ ও নফল সালাতে তিলাওয়াত করতে পারি এবং দু’আসমূহ পাঠ করতে পারি সালাতের পর কিংবা অন্য যেকোনো সময়। এতে একদিকে ‘আমল করা হবে আর অন্যদিকে হবে মুখস্থকৃত বিষয়টির ঝালাইয়ের কাজ।

৬. অন্যকে শেখানোঃ কোনো কিছু শেখার একটি উত্তম উপায় হলো তা অন্যকে শেখানো। আর এজন্য আমাদেরকে একই বিষয় বারবার ও বিভিন্ন উৎস থেকে পড়তে হয়। এতে করে ঐ বিষয়টি আমাদের স্মৃতিতে স্থায়ীভাবে গেঁথে যায়।

৭. মস্তিষ্কের জন্য উপকারী খাদ্য গ্রহণঃ পরিমিত ও সুষম খাদ্য গ্রহণ আমাদের মস্তিষ্কের সুস্বাস্থ্যের জন্য একান্ত আবশ্যক। অতিরিক্ত খাদ্য গ্রহণ আমাদের ঘুম বাড়িয়ে দেয়, যা আমাদের অলস করে তোলে। ফলে আমরা জ্ঞানার্জন থেকে বিমুখ হয়ে পড়ি। তাছাড়া কিছু কিছু খাবার আছে যেগুলো আমাদের মস্তিষ্কের জন্য খুবই উপকারী। সম্প্রতি ফ্রান্সের এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে যয়তুনের তেল চাক্ষুস স্মৃতি (visual memory) ও বাচনিক সাবলীলতা (verbal fluency) বৃদ্ধি করে। আর যেসব খাদ্যে অধিক পরিমাণেOmega-3 ফ্যাট রয়েছে সেসব খাদ্য স্মৃতিশক্তি ও মস্তিষ্কের কার্যকলাপের জন্য খুবই উপকারী। স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধির জন্য অনেক‘আলিম কিছু নির্দিষ্ট খাদ্য গ্রহণের কথা বলেছেন। ইমাম আয-যুহরি বলেন,

 

“তোমাদের মধু পান করা উচিত কারণ এটি স্মৃতির জন্য উপকারী।”

মধুতে রয়েছে মুক্ত চিনিকোষ যা আমাদের মস্তিষ্কের গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাছাড়া মধু পান করার সাত মিনিটের মধ্যেই রক্তে মিশে গিয়ে কাজ শুরু করে দেয়। ইমাম আয-যুহরি আরো বলেন,

“যে ব্যক্তি হাদীস মুখস্থ করতে চায় তার উচিত কিসমিস খাওয়া।”

 

৮. পরিমিত পরিমাণে বিশ্রাম নেয়াঃ আমরা যখন ঘুমাই তখন আমাদের মস্তিষ্ক অনেকটা ব্যস্ত অফিসের মতো কাজ করে। এটি তখন সারাদিনের সংগৃহীত তথ্যসমূহ প্রক্রিয়াজাত করে। তাছাড়া ঘুম মস্তিষ্ক কোষের পুণর্গঠন ও ক্লান্তি দূর করার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অন্যদিকে দুপুরে সামান্য ভাতঘুম আমাদের মন-মেজাজ ও অনুভূতিকে চাঙা রাখে। এটি একটি সুন্নাহও বটে। আর অতিরিক্ত ঘুমের কুফল সম্পর্কে তো আগেই বলা হয়েছে। তাই আমাদের উচিত রাত  জেগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দাওয়াহ বিতরণ না করে নিজের মস্তিষ্ককে পর্যাপ্ত বিশ্রাম দেওয়া। স্মৃতিশক্তি বাড়ানো ।


এটা পড়ুন – আপনি কি ধূমপায়ী ? আপনার জন্য সুখবর !


৯. জীবনের অপ্রয়োজনীয় ব্যাপারসমূহ ত্যাগ করাঃ বর্তমানে আমাদের মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা কমে যাওয়া ও জ্ঞান অর্জনে অনীহার একটি অন্যতম কারণ হলো আমরা নিজেদেরকে বিভিন্ন অপ্রয়োজনীয় কাজে জড়িয়ে রাখি। ফলে কোনো কাজই আমরা গভীর মনোযোগের সাথে করতে পারি না। মাঝে মাঝে আমাদের কারো কারো অবস্থা তো এমন হয় যে, সালাতের কিছু অংশ আদায় করার পর মনে করতে পারি না ঠিক কতোটুকু সালাত আমরা আদায় করেছি। আর এমনটি হওয়ার মূল কারণ হচ্ছে নিজেদেরকে আড্ডাবাজি, গান-বাজনা শোনা, মুভি দেখা, ফেইসবুকিং ইত্যাদি নানা অপ্রয়োজনীয় কাজে জড়িয়ে রাখা। তাই আমাদের উচিত এগুলো থেকে যতোটা সম্ভব দূরে থাকা।

১০. হাল না ছাড়াঃ যে কোনো কাজে সফলতার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায় হলো হাল না ছাড়া। যে কোনো কিছু মুখস্থ করার ক্ষেত্রে শুরুটা কিছুটা কষ্টসাধ্য হয়। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে আমাদের মস্তিষ্ক সবকিছুর সাথে মানিয়ে নেয়। তাই আমাদের উচিত শুরুতেই ব্যর্থ হয়ে হাল না ছেড়ে দিয়ে আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করে চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। স্মৃতিশক্তি বাড়ানো ।