18.8 C
New York
Saturday, June 28, 2025

Buy now

spot_img
Home Blog Page 3

শুক্রবার-সপ্তাহের শ্রেষ্ঠ দিন

মুসলিমদের জন্য শুক্রবার একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিন। সপ্তাহের অন্যান্য দিনের তুলনায় এটি অধিক গুরুত্বপূর্ণ ও কল্যাণকর কারণ এই দিন সমাজের অধিকাংশ মুসলিম এক সাথে সালাত আদায়ের জন্য একত্রিত হয়। সালাতের ঠিক পূর্বেই তারা একটি খুতবাহ্‌ শুনে যা তাদেরকে স্রষ্টা ও দ্বীন সম্পর্কে মূল্যবান জ্ঞানের অধিকারী হিসেবে গড়ে তোলার জন্য পরিকল্পিতভাবে প্রদান করা হয়। এটি একটি মহিমান্বিত দিন যার মর্যাদা আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) নিজেই দান করেছেন;

সপ্তাহের আর কোনও দিনই এমন মর্যাদার অধিকারী নয়।

একজন মুমিনের সমগ্র জীবনই ইবাদাত; এমনকি তিনি যা কিছু উদ্‌যাপন করেন তা-ও। যদিও আল্লাহর ইবাদাত করার জন্য বিশেষ কোন স্থান বা সময় নেই, তবে তিনি কিছু মুহূর্ত, দিন কিংবা সময়কে অধিক মর্যাদা দান করেছেন; আর শুক্রবার এমনই একটি দিন।
নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সুন্নাহ থেকে আমরা জানতে পারি,

আল্লাহর দৃষ্টিতে সর্বোত্তম দিন শুক্রবার, জুমু’আর দিন। 

জুমু’আর সালাত ইসলামের অধিক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বগুলোর একটি। এটি এমন এক সময় যখন সমাজের সকল মুসলমান একত্রিত হয় এক আল্লাহর ইবাদাত করার জন্য, আর পরস্পর কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে খুঁজে পায় দৃঢ়তা ও স্বাচ্ছন্দ এবং পূণরায় নিশ্চিত করে আল্লাহর প্রতি তাঁদের বিশ্বাস ও নিষ্ঠা।

মুমিনগণ, জুম’আর দিনে যখন নামাযের আযান দেয়া হয়, তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণের পানে ত্বরা কর এবং বেচাকেনা বন্ধ কর। এটা তোমাদের জন্যে উত্তম যদি তোমরা বুঝ।[সূরা আল-জুমু’আহঃ ০৯]

অনেক মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটি, কখনও কখনও বৃহস্পতিবার কিংবা শনিবারও এর সাথে যুক্ত থাকে। যাই হোক, জুমু’আর সালাতের সময় ব্যতীত ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ করার কোন বাধ্যবাধকতা নেই। তবে পশ্চিমা দেশগুলোতে মুসলিমরা চেষ্টা করে সালাতের সময়টাতে তাদের দুপুরের খাবারের বিরতি নিয়ে নিতে (ছুটি না থাকার কারণে)।

নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর অনুসারীদের বলেন,

পাঁচ ওয়াক্তের নামায, এক জুমু’আ থেকে আরেক জুমু’আ এবং এক রামাদান থেকে আরেক রামাদানেরমধ্যবর্তী দিনগুলোর ছোটখাট গুনাহের কাফ্‌ফারার পরিমাণ হয়, যদি বড় বড় গুনাহসমূহ থেকে বিরত থাকাযায়। 

এটা গুরুত্বপূর্ণ যে, কোন মুসলিম যেন তার কাজ, পড়াশুনা কিংবা অন্য কোন দুনিয়াবী ব্যাপারের জন্য জুম্য’আর সালাতকে অবহেলা না করে। প্রত্যেক মুমিনের উচিত অন্য যে কোন কাজের উপর জুমু’আর সালাতকে প্রাধান্য দিয়ে অংশগ্রহণ করা, কারণ কোন বৈধ কারণ ব্যতীত পরপর তিনবার জুমু’আর সালাত আদায় না করলে একজন মুসলমানের নাম মুমিনের তালিকা থেকে মুছে ফেলা হয়।

যদিও শুক্রবারে জুমু’আর সালাতে অংশগ্রহণ কেবলমাত্র পুরুষদের উপরই ফরয করা হয়েছে, তবে এই দিন কিছু মুস্তাহাব কাজ রয়েছে যেগুলো নারী, পুরুষ কিংবা শিশু সকলেই পালন করতে পারে। এই কাজগুলোর মধ্যে রয়েছে গোসল করা, পরিষ্কার জামা-কাপড় পরিধান করা, আল্লাহর কাছে বিভিন্ন ধরনের দু’আ করা, নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর উপর দুরুদ পড়া এবং কুর’আনের ১৮ নম্বর সূরা অর্থাৎ সূরাআল-কাহ্‌ফ তিলাওয়াত করা।

নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,
সূর্য উদিত হয় এমন সব দিনের মধ্যে শ্রেষ্ঠ দিন হল জুমু’আর দিন। এই দিনের মধ্যে এমন একটি মুহূর্ত বিদ্যামান কোন বান্দা যদি সেই মুহূর্তে আল্লাহর কাছে কিছু দু’আ করে, তবে অবশ্যই তিনি তার দু’আবাস্তবায়িত করেন। 

জুমু’আর দিনের বার ঘন্টার মধ্যে একটি বিশেষ মুহূর্ত আছে, তখন কোন মুসলমান আল্লাহর নিকট যাই দু’আকরে, আল্লাহ তাই কবুল করেন। তোমরা এই মুহূর্ত্বটিকে আসরের শেষে অনুসন্ধান কর। 

Whoever recites ‘Al-Qahf’ (The Cave) on Friday, God will give him a light to the next Friday. 

সূর্য উদিত হয় এমন সকল দিনের মধ্যে শ্রেষ্ঠ দিন হল জুমু’আর দিন।এই দিনেই আদম আলাইহিস সালাম)-কে সৃষ্টি করা হয়েছে। এদিনেই তাঁকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হয়। এই দিনেই তাঁকে তা থেকে বের করা হয়। আর এই জুমু’আর দিনেই কিয়ামত সংঘটিত হবে। 

আর শুক্রবারেই নাযিল হয়েছে কুর’আনের একটি বিখ্যাত আয়াত,
আজ আমি তোমাদের জন্যে তোমাদের দ্বীনকে পূর্নাঙ্গ করে দিলাম, তোমাদের প্রতি আমার অবদান সম্পূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্যে দ্বীন হিসেবে পছন্দ করলাম।[সূরা মায়িদাহঃ ০৩]

ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা উমার (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-এর জীবনের একটি ঘটনায় শুক্রবারের গুরুত্ব ফুটে উঠে। ইহুদীদের মধ্যে একজন জ্ঞানী উমার ইবনুল খাত্তাব (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-কে বললো, “কুর’আনের মধ্যে তোমরা একটি বিশেষ আয়াত পাঠ কর; যদি সেই আয়াতটি আমাদের উপর নাযিল হতো তবে দিনটিকে আমরা বাৎসরিকউৎসব হিসেবে পালন করতাম।” উমার (রাদিয়াল্লাহু আনহু) জিজ্ঞেস করলেন, “সেটি কোন আয়াত?”

লোকটি উত্তর দিলো, “আজ আমি তোমাদের জন্যে তোমাদের দ্বীনকে পূর্নাঙ্গ করে দিলাম”। তখন উমার (রাদিয়াল্লাহু আনহু) বললেন, “অবশ্যই আমি সেই দিন এবং স্থানটির কথা স্মরণ করি যেখানে এই আয়াতটি নাযিল হয়েছিলো। ইতিমধ্যেই এটা আমাদের জন্য দুটো উৎসবের দিন। প্রথমত, এটা ছিল শুক্রবার-সকল মুসলিমের জন্য ঈদের দিন এবং দ্বিতীয়ত, এটা ছিল আরাফাহ্‌র দিন-হজ্জের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিন।” উমার (রাদিয়াল্লাহু আনহু) আরও বলেন এই আয়াতটি আসরের পর নাযিল হয় যখন নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর উটের উপর বসে ছিলেন।

শুক্রবার একটি বিশেষ দিন; এই দিনে যে জুমু’আর সালাত আদায় করা হয় তা একজন মুসলিমের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অতীত এবং বর্তমানের অনেক ইসলামিক ‘আলিম এ ব্যাপারে আলোচনা করেছেন এবং এর গুরুত্ব স্বীকার করেছেন। ত্রয়োদশ শতকের বিখ্যাত ইসলামিক ‘আলিম ইবনে তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,
আলিমদের ঐকমত্যের ভিত্তিতে শুক্রবার সপ্তাহের সর্বোত্তম দিন। 

আর তাঁর ছাত্র ইবনুল কাইয়্যিম (রাহিমাহুল্লাহ) তাঁর বই যাদ আল-মা’দ এ শুক্রবারের ৩২ টি বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেছেন। নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,
নিশ্চয় আল্লাহ এই দিনকে মুসলিমদের ঈদের দিনরূপে নির্ধারণ করেছেন। 

আশা করি মুমিনরা সচেতন হয়ে শুক্রবারে আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তা’লা) তাঁর বান্দাদের উপর যে রহমত বর্ষণ করেন তার সুফল ভোগ করবে। শুক্রবার জুমু’আর দিন, একটি উৎসবের দিন এবং ইবাদাত ও দু’আর দিন।আসুন, আমরা সকলেই এই দিনের যথাযথ মর্যাদা দানের মাধ্যমের নিজেদের দুনিয়াবী ও আখিরাতের জীবনকে সাফল্যমণ্ডিত করে গড়ে তুলি।
জাযাক আল্লাহ খাইরান।

পাদটীকাঃ
১. বায়হাক্বী
২. সহীহ মুসলিমঃ ৪৫০
৩. জামে আত্‌-তিরমিযী
৪. আবূ দাউদ
৫. বায়হাক্বী
৬. সহীহ মুসলিম, আবূ দাউদ, আন-নাসাঈ, আত্‌-তিরমিযী
৭. মাজমু’আহফাতাওয়াহ
৮. ইব্‌ন মাজাহ

মূল লেখকঃ আ’ইশা স্ট্যাসি
উৎসঃ www.islamreligion.com

‘আন্দলুস’র একটুখানি সোনালি অতীত

আন্দালুসের (মুসলিমদের হারানো স্পেন) ইতিহাস নিয়ে লিখতে বসলে চোখের আগে মন কাঁদে। (কাজি কবির ভাষায়) ‘সে কাঁদনে আঁসু আনে’ অভাগা চোখে! নিজের অজান্তেই বারবার দৃষ্টি ঝাঁপসা হয়ে আসে। ইতিহাসকে আশ্রয় করে লিখতে চাইলেও তখন তা আর হয়ে ওঠে না। ঐতিহ্য হারানোর বেদনায় মনের সব সত্তায় করুণ একটা সুর বাজতে থাকে। বাজতেই থাকে। এ সুর-ব্যঞ্জনায় যেনো বিশ্বমানবতা কেবলই বিলাপ করতে থাকে। অশ্রু ছলোছলো চোখে কলম ধরে বসে থাকি। বসেই থাকি। কলম কি চলবে না?

ভাঙা-ভাঙা শব্দে বেদনার নীলগাথা হোক না একটু লিখা!
ইতিহাসের নদী এখন হয়ে যাক বেদনার নীলবাহিত স্রোত!
সবুজে সবুজে ‘জান্নাতময়’ আন্দালুস হারানোর স্মৃতিচারণ হয়ে উঠুক এখন কোনো তাযিয়াতি জলসা!
আন্দালুসপ্রেমীর মনে বয়ে চলুক শোকের নদী।
চোখে নেমে আসুক পূঞ্জীভূত বেদনার শত হাহাকার।
নতুন আন্দালুসের দিকে মহাযাত্রার মহাঅভিলাষে―
মন গগণ-বিদারি চীৎকারে আবার হয়ে উঠুক দুর্বিনীত!

দুই.
৭৭১ সাল। হিজরি ৯২। উমাইয়া সালতানাতের আমীরুল মুমিনীন তখন ওয়ালিদ ইবনে আবদুল মালিক। ইসলামী সালতানাতের সবুজ মানচিত্রে যোগ হয়েছে ভূ-খণ্ডের পর ভূ-খণ্ড। সামরিক কৌশলগত কারণে এবং ভিতরগত জুলুম-নিপীড়ন ও অরাজকতার কারণে আন্দালুস বিজয় করা― সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছিলো। বিশেষ করে রাজা রডারিক কাউন্ট জুলিয়ানের মেয়ের শ্লীলতাহানি করার পর এবং মুসলমানদের কাছে জুলিয়ানের সাহায্য চেয়ে পাঠানোর পর অনিবার্য হয়ে উঠেছিলো আন্দালুস অভিযান।

তাই ওয়ালিদ ইবনে আবদুল মালিকের কাছে অনুমতি চেয়ে পাঠালেন― আফ্রিকা বিজয়ের পর সেখানকার শাসনকর্তা―মূসা ইবনে নোসায়র। অনুমতি মিললে প্রথমে তিনি একটি ছোট অভিযান পরিচালনা করলেন ৫০০ সৈন্যের। তারা সীমান্ত এলাকায় বেশ কিছু সফল অভিযান পরিচালনা করে প্রচুর মালে গনিমত নিয়ে ফিরে আসে। এরপরই মূসা ইবনে নোসায়র মূল অভিযানের প্রস্তুতি গ্রহণ করে ৭ হাজার সৈন্যের এক বাহিনী প্রস্তুত করেন আর নেতৃত্ব তুলে দেন তারিক বিন যিয়াদের কাঁধে। তারিক বিন যিয়াদ মূসা ইবনে নোসাইয়র-এর হাত ধরেই ইসলাম কবুল করেছিলেন এবং তার আস্থাভাজন সেনাপতিতে পরিণত হন। ‘তানজা’ বিজয়ের পর মূসা তাকে সেখানকার শাসনকর্তা নিযুক্ত করেছিলেন।

তিন.
যেতে হবে সমুদ্রপথে। জাহাজ লাগবে অনেক। কারো মতে তখন ব্যবস্থা ছিলো মাত্র ৪টি জাহাজের। তাও আবার ভাড়া করা। কেউ বলেন― না, তখন এ অভিযানকে সামনে রেখেই তৈরী করা হয়েছিলো অনেক জাহাজ। কিন্তু জাহাজ-যে কম ছিলো― এটিই ঐতিহাসিকভাবে বেশি নির্ভরযোগ্য মত। যাইহোক; সেই জাহাজে করেই শুরু হলো আন্দালুস অভিমুখে নৌ-অভিযান। সবাই একসঙ্গে যাওয়া সম্ভব হলো না। যেতে হলো দলে দলে। যারা গেলো তারা পাহাড়ে গিয়ে নিরাপদ আশ্রয় বেছে নিলো। আত্মগোপনের মতো করে অবস্থান করলো। সবাই আসার পর তারিক বিন যিয়াদ যুদ্ধের জন্যে ধীরে ধীরে সবাইকে প্রস্তুত করতে লাগলেন। রণকৌশলের অংশ হিসাবে প্রথমেই আশপাশের এলাকাগুলো তিনি বিজয় করে ফেললেন। আলজাযিরাতুল খাযরা বা ‘সবুজ দ্বীপ’ এলাকাটি ছিলো পাহাড়ের (জাবালুত তারিক-এর) মুখোমুখি। প্রথমেই তিনি এ সবুজ-শ্যামল এলাকাটি দখল করে ফেললেন। সেই সঙ্গে আশপাশের আরো কিছু এলাকা। এরমধ্যেই সম্রাট লডারিকের কাছে সংবাদ পৌঁছে গেলো যে, মুসলিম সৈন্যরা আন্দালুসে পা রেখেছে। লডারিক অবিলম্বে তাদেরকে মুকাবিলা করার সিদ্ধান্ত নিলো। প্রথমেই পাঠালো একটি বিশেষ বাহিনী। কিন্তু সে বিশেষ বাহিনী শোচনীভাবে পরাস্ত হলো তারিক বাহিনীর কাছে। একজন মাত্র জানে বেঁচে পালিয়ে গিয়ে লডারিককে জানাতে পারলো শুধু নিজের বেঁচে-যাওয়ার আশ্চর্য কাহিনী!

এরপর লডারিক নিজেই যুদ্ধযাত্রার ঘোষণা দিলো। সাজসাজ রবে প্রস্তুত হলো এক লাখ সৈন্যের বিশাল বাহিনী। এক সময় যাত্রা হলো এ বাহিনীর। ওদের চোখে-মুখে দম্ভ ও অহমিকা ঠিকরে পড়ছিলো। লডারিকের নেতৃত্বে এগিয়ে আসছে খৃষ্টান বাহিনী― এ-খবর যথা সময়ে তারিক জানতে পারলেন। লডারিকের সাথে মহাযুদ্ধে নামার আগেই তারিক আরো সৈন্য চেয়ে চিঠি পাঠিয়েছিলেন মূসা ইবনে নোসায়রের কাছে। যথা সময়ে সে সাহায্যও এসে গেলো। আরো ৫০০০ সৈন্য এসে যোগ দিলো মুসলিম শিবিরে। এখন মুসলমানদের সৈন্যসংখ্যা ১২ হাজার।

‘শাদূনা’ শহরের কাছে ‘ওয়াদি লাক্কা’য় মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তারিক বাহিনী ও লডারিক বহর। মাত্র ১২ হাজার সৈন্য দেখে লডারিক বাহিনীর আনন্দের কোনো সীমা রইলো না। ওদের চোখে মুখে একটা ভাবই কেবল ফুটে উঠছিলো― তোমাদের যুদ্ধসাধ মিটিয়ে দেবো আমরা মাত্র কয়েকঘন্টায়!

একদিকে এক লাখ আরেকদিকে বার হাজার। ভীষণ অসম চিত্র। মুসলিম সৈন্যদের মনোবলে যেনো দুশমনের সংখ্যাধিক্য কোনো চির ধরাতে না পারে, সে জন্যে তারিক বিন যিয়াদ সৈন্যদের সামনে দাঁড়িয়ে ঈমান জাগানিয়া এক ভাষণ দিলেন― লডারিকের সাথে যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার ঠিক আগে। একটু পরই শুরু হবে যুদ্ধ। কিন্তু তার আগে আমরা নজর দেবো একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে।

চার.
না! সে ভাষণের আগে কিংবা তারও আগে―জাহাজ থেকে নেমে তিনি সবগুলো জাহাজ কিংবা কোনো একটি জাহাজ পুড়িয়ে দেন নি! যারা এ জাহাজ পুড়ানোর ঘটনা প্রচার করে, না-জেনে .. না-বোঝেই প্রচার করে।
কেনো তিনি জাহাজ পুড়িয়ে দেবেন?
কার জাহাজ পুড়িয়ে দেবেন?
যদি ভাড়া করা হয়ে থাকে তাহলে তো এগুলো অন্যের সম্পদ! অন্যের সম্পদ কে পুড়িয়ে দেয়? আর যদি রাষ্ট্রীয় সম্পদ হয়, তাহলে কেনো তিনি এতো দামী জিনিস পুড়িয়ে নষ্ট করে দেবেন? অপচয় হবে না কি?
আর যদি শুধু এ-অজুহাতে তিনি সবগুলো জাহাজ পুড়িয়ে দিয়ে থাকেন যে, এতে মুসলিম সৈন্যরা আর পালিয়ে যেতে পারবে না, যুদ্ধ তাদেরকে করতেই হবে, ইচ্ছায়-অনিচ্ছায়, তাহলে মুসলিম সৈনিকদের শিশিরশুভ্র চরিত্রে কি ছুরি চালানো হয় না?! এমন বাহিনীই কি তারিখ আন্দালুস বিজয়ের জন্যে নিয়ে এসেছিলেন― যারা পালিয়ে যেতে পারে সুযোগ পেলেই!
আস্তাগফিরুল্লাহ!

পাঁচ.
তারিক বিন জিয়াদের ভাষণে বুঝি যাদু ছিলো। ঈমানি চেতনায় ও সংগ্রামী জযবায় সৈন্যরা দ্যুতিময় বীরত্বের প্রহর গোনতে লাগলো। এরপর যুদ্ধ যখন শুরু হলো তখন সে চেতনা ও জযবা সত্যি সত্যি দ্যুতি ছড়াতে লাগলো। আটটি সূর্যোদয়-সূর্যাস্তের পর মুসলিম শিবিরের পূব আকাশে মহাবিজয়ের লাল সূর্যটি যেনো হাসতে হাসতে উদিত হলো!
সঙ্গে সঙ্গে আন্দালুসের বুকে সূচিত হলো মহাবিজয়ের এক পুণ্যযাত্রা!
আগামী আটশত বছরে গড়ে ওঠবে যে-কালজয়ী গর্বিত সভ্যতা, এ বিজয়ের মধ্য দিয়ে শুরু হলো তার মুবারক সফর!

এ অসম লড়াইয়ে শহীদ হলেন তিনহাজার মুসলিম সৈন্য। আর লডারিক পালিয়ে গেলো এবং হারিয়ে গেলো। আর কখনো এ নামটা আন্দালুসের ইতিহাসে প্রবেশ করতে পারেনি। কেউ বলেন: যুদ্ধেই সে মারা গিয়েছিলো। কেউ বলেন পালিয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু কিছুদূর যেতেই পানিতে ডুবে মারা গেলো।

বন্ধু!
যে-বাহিনীর প্রধান সেনাপতি ও বাদশার এ-করুণ পরিণতি, সে বাহিনীর অবস্থা ‘ঐ জিজ্ঞাসে কোন্ জন’? তা-যে আরো বেশি করুণ, তা না-বললেও তো বোঝা যায়!
তবুও অগভীর কৌতূহল মিটানোর জন্যে এক কথায় বলা যায়― ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিলো তার বিশাল সৈন্যবাহিনী!
আন্দালুসের এই অশ্রু ও রক্তগল্প অনেক দীর্ঘ! পাঠক চাইলে আবার আসবো!


ইয়াহইয়া ইউসুফ নদভী
লেখক, গ্রন্থাকার-অনুবাদক ও মাদরাসাশিক্ষক

এক পরিবারের এক রাতের ত্যাগে মুসলমান হলেন হাজার হাজার রোমানিয়ান

তুরস্কের ইস্তাম্বুলে বেড়াতে গেছেন রোমানিয়ান এক দম্পতি। একদিন একটি নির্জন বরফে ঢাকা পাহাড়ী এলাকা ঘুরতে যান তারা।

হাঁটতে হাঁটতে একসময় পাহাড়ী আঁকাবাঁকা রাস্তায় পথ হারিয়ে গেলেন ওই দম্পতি। পথ খুঁজতে খুঁজতে সন্ধ্যা নামলে দিশেহারা হয়ে পড়েন তারা। দ্রুত অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে চারদিক। কনকনে শীত, সঙ্গে হিমেল হাওয়া আর অদ্ভুত একটা ভয় গ্রাস করে তাদের। চারদিকে পিনপতন নিরবতা। মাঝে মাঝে শিয়ালের হুক্কা হুয়া ডাকে পরিবেশটাকে আরো ভারি করে তুলছে। হঠাৎ দেখতে পেলেন দূরে কোথাও হালকা একটা আলো জ্বলছে। মনে কিছুটা সাহস সঞ্চয় করে তারা সেদিকে হাঁটতে লাগলেন। কাছে গিয়ে দেখলেন, একটি কুঁড়েঘর।

দরজায় টোকা দিতেই একজন জীর্ণ-শীর্ণ মধ্য বয়স্ক লোক দরজা খুলে দিলেন। অসময়ে অপরিচিত মানুষ দেখে কিছুটা ভয় পেয়ে গেলেন গৃহকর্তা। আগন্তুক বিস্তারিত জানিয়ে লোকটির কাছ থেকে সহযোগিতা চাইলেন। অতি বিনয়ের সঙ্গে গৃহকর্তা তাদের ভেতরে এসে বসতে বললেন। কুঁড়েঘরে আরো ছিলেন লোকটির বৃদ্ধা মা, স্ত্রী এবং ছেলে-মেয়ে।

আগন্তুক গৃহকর্তাকে হোটেলের কার্ড দেখিয়ে যাওয়ার উপায় জানতে চাইলেন। অন্ধকারে পাহাড়ী আঁকা-বাঁকা রাস্তায় কয়েক কিলোমিটার দূরে অবস্থিত হোটেলে যাওয়া এই মুহুর্তে নিরাপদ নয় বললেন গৃহকর্তা। রোমানিয়ান দম্পতি মহা পেরেশানিতে পড়ে গেলেন। গৃহকর্তা তাদেরকে কুঁড়েঘরে রাত যাপনের জন্য বিনীত অনুরোধ করলেন। গরিব লোকটি আগন্তুকদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা এবং ঘুমানোর জন্য সাধ্যের মধ্যে যতটুকু সম্ভব ভালো ব্যবস্থা করলেন।

সকালে ঘুম থেকে উঠে রোমানিয়ান দম্পতি দেখেন, কুঁড়েঘরে একটি মাত্র রুম যাতে তারা ছিলেন।

‘তাহলে ৫ সদস্যের পরিবারটি গেলেন কোথায়’ আগন্তুকদের মনে প্রশ্ন জাগে।
তারা কুঁড়েঘরের আশে-পাশে খুঁজতে লাগলেন। একপর্যায়ে রোমানিয়ান স্বামী-স্ত্রীর দেখেন, দূরে একটি গাছের গোড়ায় কারা যেন শুয়ে আছে। কাছে গিয়ে দখেন, গরিব লোকটি বৃদ্ধা মা, স্ত্রী এবং সন্তানদের নিয়ে জবুথবু হয়ে শুয়ে আছে।

সারারাত এখানেই ছিলেন? গৃহকর্তার কাছে আগন্তুকের প্রশ্ন। হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লেন তিনি। আর কোথাও থাকার জায়গা নাই বলে এখানেই ছিলেন, জানালেন লোকটি।

খ্রীস্টান দম্পতির চোখে-মুখে রাজ্যের বিস্ময়। স্বামী-স্ত্রী কিছুক্ষণ একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। রাজ্যের নিরবতা যেন গ্রাস করেছে চারিদিক।

কেন আমাদের জন্য সব ছেড়ে দিয়ে কনকনে ঠান্ডায়, বরফে ঢাকা গাছের গোড়ায় আশ্রয় নিলেন? আমরা তো আপনাদের আত্মীয় কিংবা পাড়া-প্রতিবেশী না। এমনকি আপনাদের ইসলাম ধর্মের অনুসারীও না। তাহলে কেন এই অসামান্য ত্যাগ স্বীকার করলেন?
লোকটির ঝটপট উত্তর, পবিত্র গ্রন্থ কোরআন শরীফে মহান আল্লাহ বলেছেন, মানুষের সেবা করতে এবং কেউ বিপদে পড়লে সাহায্য করার জন্য কোরআনে বার বার বলা হয়েছে। আমরা আল্লাহর আদেশ পালন করেছি মাত্র। রোমানিয়ান দম্পতির চোখে পানি। কৃতজ্ঞতায় তাদের বুক ভরে গেল। কৌতূহলী হয়ে তারা জানতে চাইলেন, কোরআন শরীফে আর কী কী আছে?

আমি মুর্খ মানুষ। খুব বেশি জানিনা। আপনারা কোরআন কিনে পড়ে জেনে নিতে পারেন। লোকটির সরল স্বীকারোক্তি। রোমানিয়ান দম্পতি তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে হোটেলে যাওয়ার আগেই লাইব্রেরীতে গিয়ে কোরআন সংগ্রহ করলেন। মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় অল্প ক’দিনে তারা পবিত্র কোরআন পড়া শেষ করলেন।

সৌদি আরবের ‘হুদা’ চ্যানেলে এক সাক্ষাৎকারে রোমানিয়ান দম্পতি বলেন, ‘কোরআনের প্রতিটি পাতা পড়া শেষে মনের মধ্যে এক অন্যরকম আবহ তৈরি হতো। সৃষ্টিকর্তার প্রতি নিজের অজান্তে মাথা নুয়ে পড়ত। ভাবতাম, কতই না ভুলের মধ্যে ছিলাম এতদিন! এ এক অনন্য অনুভূতি ছিল, যা বলে বোঝানোর ভাষা নাই। প্রতিটি সূরা শেষ করে আকাশের দিকে তাকাতাম আর সৃষ্টিকর্তাকে খুঁজতাম! কান্নায় বুক ভেসে যেত। তবুও ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতাম আকাশ পানে।’

কোরআন পড়া শেষে কালক্ষেপন না করে স্বামী-স্ত্রী ইসলাম গ্রহন করেন। তারা বলেন, কোরআনের মর্মবাণী যারাই উপলব্ধি করবেন, সে যে-ই হোক তার চেতনায় পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী।

রোমানিয়ায় ফিরে গিয়ে তারা একটি ইসলামিক সেন্টার খোলেন। পরিচিত, অপরিচিতদের মাঝে পবিত্র কোরআনের বাণী পৌছে দেবার ব্রতে স্বামী-স্ত্রী মানুষের দোরগোড়ায় গেলেন। ব্যাপক সাড়া পেয়ে দ্বিগুন উৎসাহে ইসলামিক সেন্টারের কার্যক্রম চালিয়ে যেতে লাগলেন। তাদের অল্প কয়েকদিনের প্রচারণায় প্রায় চার হাজার রোমানিয়ান ইসলাম গ্রহন করেন।

পাদটিকাঃ একটি দরিদ্র পরিবারের এক রাতের ত্যাগের বিনিময়ে কেবল একটি দম্পতি ইসলাম গ্রহন করেননি, হাজার হাজার রোমানিয়ান মুসলমান হয়েছেন। এটাই নবীজির (সা.) শিক্ষা।

আসুন, আমরা কোরআন বুঝে পড়ি। কোরআনের মর্মার্থ অনুধাবনের চেষ্টা করি। মহান আল্লাহ এবং রাসূল (সা.) এর নির্দেশনা মেনে জীবন পরিচালিত করি এবং মানুষের সেবা করি; সবধরনের ভণ্ডামি পরিহার করি। সত্যিকারের ঈমানদার হই। তাহলে ওই গরিব লোকটির মতো আমরাও কামিয়াব হবো।

মহান রাব্বুল আলামিন আল্লাহ আমাদের কবুল করুন। আল্লাহুম্মা আমিন।


উনার সাক্ষাৎকার দেখুন এখানে
(সৌদি আরবের ‘হুদা’ চ্যানেলে দেয়া ওই রোমানিয়ান দম্পতির সাক্ষাৎকারের সারসংক্ষেপ তুলে ধরা হলো। )

রাসুল সাঃ এর সার্টিফাইড এক গ্রাম্য,বেদুইন জান্নাতি সাহাবীর গল্প

মহানবী (সাঃ) একদিন মসজিদে বসে আছেন। সাহাবীরা তাঁকে ঘিরে আছেন। এমন সময় মহানবী (সাঃ) বললেন, “এখন যিনি মসজিদে প্রবেশ করবেন,তিনি বেহেশতের অধিবাসী।”

একথা শুনে উপস্থিত সব সাহাবী অধীর আগ্রহে তাকিয়ে রইলেন মসজিদের প্রবেশ মুখে। সবার মধ্যে জল্পনা কল্পনা চলছে, হয়তো হজরত আবু বকর (রাঃ) বা হজরত উমর (রাঃ) অথবা এমন কেউ আসছেন যাঁদের বেহেশতের সুসংবাদ আল্লাহপাক ঘোষণা করেছেন।

সবাইকে অবাক করে দিয়ে মসজিদে প্রবেশ করলেন একজন সাধারণ আনসার সাহাবী। এমনকি তাঁর নাম পরিচয় পর্যন্ত জানা ছিল না অধিকাংশের। এরপরের দিনেও সাহাবীরা মসজিদে বসে আছেন নবীজি (সাঃ) কে ঘিরে।

নবীজি (সাঃ) আবার বললেন, “এখন যিনি মসজিদে প্রবেশ করবেন,তিনি বেহেশতের অধিবাসী।” সেদিনও মসজিদে প্রবেশ করলেন সেই সাহাবী। তৃতীয় দিন নবীজি(সাঃ) সাহাবীদের লক্ষ্য করে আবার ঘোষণা দিলেন, “এখন যিনি মসজিদে প্রবেশ করবেন, তিনি বেহেশতের অধিবাসী।”এবং সাহাবীরা দেখলেন সেই অতি সাধারণ সাহাবী মসজিদে প্রবেশ করলেন।

পরপর তিনদিন এই ঘটনা ঘটার পর, সাহাবীদের মধ্যে কৌতূহল হলো সেই সাধারণ সাহাবী সম্পর্কে জানার জন্য। তিনি কেন অন্যদের চেয়ে আলাদা তা জানতে হবে।

বিখ্যাত সাহাবী হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর আল আ’স (রাঃ) ভাবলেন, এই সাহাবীর বিশেষত্ব কী তা জানতে হলে তাকে নিবিড় ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে।

তিনি সেই সাহাবীর কাছে গিয়ে বললেন, “আমার বাবার সাথে আমার মনোমালিন্য হয়েছে, তোমার বাড়িতে কি আমাকে তিন দিনের জন্য থাকতে দেবে?’’সেই সাহাবী রাজী হলেন। হজরত আবদুল্লাহ (রাঃ) তাঁকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে থাকলেন, খুঁজতে থাকলেন কী এমন আমল তিনি করেন। সারা দিন তেমন কোন কিছু চোখে পড়ল না।

তিনি ভাবলেন হয়তো তিনি রাত জেগে ইবাদত করেন। না, রাতের নামায পড়ে তো তিনি ঘুমাতে চলে গেলেন। উঠলেন সেই ফজর পড়তে। পরের দুটি দিনও এভাবে কেটে গেল।

হজরত আবদুল্লাহ (রাঃ) কোন বিশেষ আমল বা আচরণ আবিষ্কার করতে পারলেন না যা অন্যদের চেয়ে আলাদা। তাই তিনি সরাসরি সেই সাহাবীকে বললেন, “দেখ আমার বাবার সাথে আমার কোন মনোমালিন্য হয় নি, আমি তোমাকে পর্যবেক্ষণ করার জন্য তোমার বাড়িতে ছিলাম। কারণ নবীজি (সাঃ) বলেছেন যে তুমি জান্নাতি। আমাকে বল তুমি আলাদা কী এমন আমল করো?’’

সেই সাহাবী বললেন, “তুমি আমাকে যেমন দেখেছ আমি তেমনই,আলাদা কিছুতো আমার মনে পড়ছে না।”এ কথা শুনে হজরত আবদুল্লাহ (রাঃ)তাঁকে বিদায় জানিয়ে চলে যেতে থাকলেন।

এমন সময় সেইসাহাবী হজরত আবদুল্লাহ (রাঃ) কে ডেকে বললেন, ‘আমার একটা অভ্যাসের কথা তোমায় বলা হয়নি –রোজ রাতে ঘুমাতে যাবার আগে আমি তাদেরকে ক্ষমা করে দেই, যারা আমাকে কষ্ট দিয়েছে,বা আমার প্রতি অন্যায় করেছে। তাদের প্রতি কোন ক্ষোভ আমার অন্তরে আমি পুষে রাখি না।”

হজরত আবদুল্লাহ (রাঃ) একথা শুনে বললেন, “এ জন্যই তুমি আলাদা, এ জন্যই তুমি জান্নাতি”। রাসূল (সাঃ) বলেছেন, যে মানুষের প্রতি দয়া করে না, আল্লাহও তার প্রতি দয়া করেন না।
[বুখারী ও মুসলিম]

ইসলাম এসেছে সকল যুগের জন্য, এর আবেদন সার্বজনীন।

ইসলামের প্রয়োগ কোন যুগ বিশেষের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না, বরং ইসলাম সকল যুগেই মানুষের জন্য সঠিক ও পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থা। এটা এজন্য যে, ইসলাম মানবীয় চাহিদাগুলোকে সুনিয়ন্ত্রিত করার জন্য এসেছে আর এই চাহিদাগুলো কোন যুগের মাঝে সীমাবদ্ধ নয়।

মানুষের দিকে তাকালে আমরা দেখব যে তার সুনির্দিষ্ট কিছু মানবীয় চাহিদা রয়েছে যেগুলোর উপর পৃথিবীতে তার বেঁচে থাকা ও জীবন-যাপন প্রক্রিয়া নির্ভর করে। এই চাহিদাগুলো পূরণের উপায়-উপকরণ সংগ্রহ ও এদের ক্রমোন্নতির পিছনে সে নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যায় যাতে করে এসব চাহিদা পূরণের উপায় সহজ থেকে সহজতর হয়।

আদিম মানুষ তার উপায়-উপকরণগুলোকে চিন্তা-ভাবনার মাধ্যমে ক্রমান্বয়ে উন্নত করতে করতে আজকের এই উন্নত প্রযুক্তিসম্পন্ন অবস্থায় এসেছে যেখানে রয়েছে উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা, চিকিৎসা ব্যবস্থা, খাদ্য-বস্ত্র বাসস্থানের উন্নততর সংস্থান, বিনোদনের নানা উপকরণ, বস্তু-জগত সম্পর্কে আরো ব্যাপক জ্ঞান ইত্যাদি।

এসবই হয়েছে একটি মাত্র কারনে; তা হলো মানবীয় চাহিদা ও প্রয়োজনগুলো মিটানোর সহজতর উপায় অনুসন্ধান আর এ চাহিদা ও প্রয়োজন সব যুগে সব মানুষেরই ছিলো। এসব চাহিদার ব্যাপারে তাদের মাঝে কোন মৌলিক পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যাবেনা। পার্থক্য কেবল এই যে, বিভিন্ন যুগে মানুষের এই চাহিদা পূরণের উপায়-উপকরণগুলো বিভিন্ন ছিলো যা একটি উপকরণগত পার্থক্য মাত্র। কাজেই সহজাত চাহিদাগুলোর ব্যাপারে প্রাচীনকাল থেকে আজ পর্যন্ত মানুষ একই অবস্থায় রয়েছে।

ইসলাম পৃথিবীতে এসেছে মানুষের সব ধরণের জৈবিক চাহিদাকে সর্বোচ্চ সাঠিক উপায়ে সুশৃংখল করার জন্য। ইসলাম যে ব্যবস্থা বা বিধি-বিধান দেয় তার প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে সমাজে মানুষের জৈবিক-চাহিদা পূরণের পদ্ধতিগুলোকে এমনভাবে নিয়মবদ্ধ করা যাতে করে এর ফলে সামগ্রিকভাবে সমাজে কোন বিশৃঙ্খলা তৈরী না হয়। ইসলাম এসব চাহিদা পূরণের বৈধ পদ্ধতিকে সুনির্দিষ্ট করেছে, উপকরণকে নয়।

যুগের কারনে যে উপকরণ গত পার্থক্য সৃষ্টি হয়েছে তাতে ইসলামের বিধি-বিধান প্রয়োগে কোনই বাধা সৃষ্টি হয় না। ইসলাম কোথাও বলেনি যে একস্থান থেকে আরেক স্থানে যেতে হলে উটের পিঠে করে যেতে হবে, তাই এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাবার জন্য গাড়ী, ষ্টীমার, উড়োজাহাজ যাই ব্যবহার করা হোক না কেন সবই একই ব্যাপার।

আসলে মানুষ যতদিন ‘মানুষ’ থাকবে ততদিনই তার মানবীয় সব চাহিদা ও প্রয়োজন অপরিবর্তিত থাকবে। একইভাবে সেগুলোকে সুনিয়ন্ত্রিতভাবে পরিচালনার জন্য একটা ব্যবস্থাও লাগবে সবসময়ই।

যেহেতু ইসলাম আল্লাহ্‌ তা’আলার কাছ থেকে আসা একটি ব্যবস্থা তাই কেবল এটিই পারবে উপকরণ নির্বিশেষে সব যুগে মানুষের চাহিদাগুলোকে এবং চাহিদা থেকে উৎপন্ন সামাজিক সমস্যাগুলোকে সবচেয়ে কার্যকরভাবে পরিচালনা করতে। ইসলাম তাই সব যুগের জন্য এবং সকল সময়ের জন্য।

আল্লাহ্‌ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেন,

“আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করলাম ও তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহকে সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্য দ্বীন হিসেবে মনোনীত করলাম।” [সূরা আল মায়িদা : ৩]

“এবং তোমার রবের বাণী সত্যতা ও ইনসাফের দিক দিয়ে পরিপূর্ণ হয়েছে, তাঁর বাণী পরিবর্তনকারী কেউই নেই, তিনি সবকিছু শোনেন ও জানেন।” [সুরা আল আন’আম : ১১৫]

জান্নাতের পরিচয় , জান্নাত-সম্পর্কিত নির্বাচিত আয়াত ।

জান্নাত আমাদের সকলেরই কাম্য। কুরআনে জান্নাতের পরিচয় দিয়েছেন স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা। আসুন দেখি আল্লাহ জান্নাতের কী বিবরণ দিলেন।

وَبَشِّرِ الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ أَنَّ لَهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ ۖ كُلَّمَا رُزِقُوا مِنْهَا مِنْ ثَمَرَةٍ رِزْقًا ۙ قَالُوا هَٰذَا الَّذِي رُزِقْنَا مِنْ قَبْلُ ۖ وَأُتُوا بِهِ مُتَشَابِهًا ۖ وَلَهُمْ فِيهَا أَزْوَاجٌ مُطَهَّرَةٌ ۖ وَهُمْ فِيهَا خَالِدُونَ
১। যারা ঈমান আনে এবং সৎকর্ম করে তাদেরকে শুভ সংবাদ দাও যে, তাদের জন্য রয়েছে জান্নাত, যার নিম্নদেশে  নদী প্রবাহিত। যখনই তাদেরকে ফলমূল খেতে দেওয়া হবে তখনই তারা বলবে, আমাদেরকে পূর্ব জীবিকারূপে যা দেওয়া হত ইহা তো তাই। তাদেরকে অনুরূপ ফলই দেওয়া হবে এবং সেখানে তাদের জন্য পবিত্র সঙ্গিনী রয়েছে। তারা সেখানে স্থায়ী হবে। [সূরা বাকারা : আয়াত ২৫]

  قُلْ أَؤُنَبِّئُكُمْ بِخَيْرٍ مِنْ ذَٰلِكُمْ ۚ لِلَّذِينَ اتَّقَوْا عِنْدَ رَبِّهِمْ جَنَّاتٌ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا وَأَزْوَاجٌ مُطَهَّرَةٌ وَرِضْوَانٌ مِنَ اللَّهِ ۗ وَاللَّهُ بَصِيرٌ بِالْعِبَادِ
২। বল, আমি কি তোমাদিগকে এই সব বস্তু হতে উৎকৃষ্টতর কোন কিছুর সংবাদ দিব? যারা তাকওয়া অবলম্বন করে চলে তাদের জন্য জান্নাত সমূহ রয়েছে যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত। আর সেখানে তারা স্থায়ী হবে, তাদের জন্য পবিত্র সঙ্গিগণ এবং আল্লাহর নিকট হতে সন্তুষ্টি রয়েছে। আল্লাহ বান্দাদের সম্পর্কে সম্যক দ্রষ্টা। [সূরা আলে-ইমরান : আয়াত ১৫]

وَأَطِيعُوا اللَّهَ وَالرَّسُولَ لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ
৩। তোমরা আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য কর যাতে তোমরা কৃপা লাভ করতে পার। [সূরা আলে-ইমরান : আয়াত ১৩২]

وَسَارِعُوا إِلَىٰ مَغْفِرَةٍ مِنْ رَبِّكُمْ وَجَنَّةٍ عَرْضُهَا السَّمَاوَاتُ وَالْأَرْضُ أُعِدَّتْ لِلْمُتَّقِينَ
৪। তোমরা ধাবমান হও স্বীয় প্রতিপালকের ক্ষমার দিকে এবং সেই জান্নাতের দিকে যার বিস্তৃতি আসমান ও যমীনের ন্যায়, যা প্রস্তুত রাখা হয়েছে মুত্তাকীদের জন্য। [সূরা আলে-ইমরান : আয়াত ১৩৩]

وَمَا كَانَ لِنَفْسٍ أَنْ تَمُوتَ إِلَّا بِإِذْنِ اللَّهِ كِتَابًا مُؤَجَّلًا ۗ وَمَنْ يُرِدْ ثَوَابَ الدُّنْيَا نُؤْتِهِ مِنْهَا وَمَنْ يُرِدْ ثَوَابَ الْآخِرَةِ نُؤْتِهِ مِنْهَا ۚ وَسَنَجْزِي الشَّاكِرِينَ
৫। আল্লাহর অনুমতি ব্যতীত কারও মৃত্যু হতে পারে না, যেহেতু তার মেয়াদ অবধারিত। কেউ পার্থিব পুরস্কার চাইলে আমি তাকে তার কিছু দেই এবং কেউ পরলৌকিক পুরস্কার চাইলে আমি তাকে তার কিছু দেই এবং শীঘ্রই কৃতজ্ঞদিগকে পুরস্কৃত করব। [সূরা আলে-ইমরান : আয়াত ১৪৫]

 رَبَّنَا إِنَّكَ مَنْ تُدْخِلِ النَّارَ فَقَدْ أَخْزَيْتَهُ ۖ وَمَا لِلظَّالِمِينَ مِنْ أَنْصَارٍ
৬। কিন্তু যারা তাদের প্রতিপালককে ভয় করে তাদের জন্য রয়েছে জান্নাত, যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত, সেখানে তারা স্থায়ী হবে। ইহা আল্লাহর পক্ষ হতে আতিথ্য; আল্লাহর নিকট যা আছে তা সৎকর্মপরায়ণদের জন্য শ্রেয়। [সূরা আলে-ইমরান : আয়াত ১৯৮]

 تِلْكَ حُدُودُ اللَّهِ ۚ وَمَنْ يُطِعِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ يُدْخِلْهُ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا ۚ وَذَٰلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ
৭। এসব আল্লাহর নির্ধারিত সীমা। কেউ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করলে আল্লাহ তাকে দাখির করবেন জান্নাতে, যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত; সেখানে তারা স্থায়ী হবে এবং ইহা মহাসাফল্য। [সূরা নিসা : আয়াত ১৩]

  وَالَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ سَنُدْخِلُهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا أَبَدًا ۖ لَهُمْ فِيهَا أَزْوَاجٌ مُطَهَّرَةٌ ۖ وَنُدْخِلُهُمْ ظِلًّا ظَلِيلًا
৮। যারা ঈমান আনে ও ভাল কাজ করে তাদেরকে দাখিল করব জান্নাতে যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত; সেখানে তারা চিরস্থায়ী হবে, সেখানে তাদের জন্য পবিত্র স্ত্রী থাকবে এবং তাদেরকে চির ¯িœগ্ধ ছায়ায় দাখিল করব। [সূরা নিসা : আয়াত ৫৭]

وَالَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ سَنُدْخِلُهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا أَبَدًا ۖ وَعْدَ اللَّهِ حَقًّا ۚ وَمَنْ أَصْدَقُ مِنَ اللَّهِ قِيلًا
৯। আর যারা ঈমান আনে ও সৎকাজ করে তাদেরকে দাখিল করব জান্নাতে, যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত, সেখানে তারা চিরস্থায়ী হবে; আল্লাহর প্রতিশ্রুতি সত্য, কে আল্লাহ অপেক্ষা কথায় অধিক সত্যবাদী?। [সূরা নিসা : আয়াত ১২২]

 وَمَنْ يَعْمَلْ مِنَ الصَّالِحَاتِ مِنْ ذَكَرٍ أَوْ أُنْثَىٰ وَهُوَ مُؤْمِنٌ فَأُولَٰئِكَ يَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ وَلَا يُظْلَمُونَ نَقِيرًا
১০। পুরুষ অথবা নারীর মধ্যে কেউ সৎকাজ করলে ও মু’মিন হলে তারা জান্নাতে দাখিল হবে এবং তাদের প্রতি অণু পরিমাণও যুলুম করা হবে না। [সূরা নিসা : আয়াত ১২৪]

 وَالَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ لَا نُكَلِّفُ نَفْسًا إِلَّا وُسْعَهَا أُولَٰئِكَ أَصْحَابُ الْجَنَّةِ ۖ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ
১১। আমি কাউকেও তার সাধ্যাতীত ভার অর্পণ করি না। যারা ঈমান আনে ও সৎকার্য করে তারাই জান্নাতবাসী, সেখানে তারা স্থায়ী হবে। [সূরা আ‘রাফ : আয়াত ৪২]

وَنَزَعْنَا مَا فِي صُدُورِهِمْ مِنْ غِلٍّ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهِمُ الْأَنْهَارُ ۖ وَقَالُوا الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي هَدَانَا لِهَٰذَا وَمَا كُنَّا لِنَهْتَدِيَ لَوْلَا أَنْ هَدَانَا اللَّهُ ۖ لَقَدْ جَاءَتْ رُسُلُ رَبِّنَا بِالْحَقِّ ۖ وَنُودُوا أَنْ تِلْكُمُ الْجَنَّةُ أُورِثْتُمُوهَا بِمَا كُنْتُمْ تَعْمَلُونَ
১২। আমি তাদের অন্তর হতে ঈর্ষা দূর করব, তাদের পাদদেশে প্রবাহিত হবে নদী এবং তারা বলবে, প্রশংসা আল্লাহরই যিনি আমাদেরকে তার পথ দেখিয়েছেন। আল্লাহ আমাদেরকে পথ না দেখালে আমরা কখনও পথ পেতাম না। আমাদের প্রতিপালকের রাসূলগণ তো সত্যবাণী এনেছিলেন। এবং তাদেরকে সম্বোধন করে বলা হবে, তোমরা যা করতে চাও তারই জন্য তোমাদেরকে জান্নাতের উত্তরাধিকারী করা হয়েছে। [সূরা আ‘রাফ : আয়াত ৪৩]

وَنَادَىٰ أَصْحَابُ الْجَنَّةِ أَصْحَابَ النَّارِ أَنْ قَدْ وَجَدْنَا مَا وَعَدَنَا رَبُّنَا حَقًّا فَهَلْ وَجَدْتُمْ مَا وَعَدَ رَبُّكُمْ حَقًّا ۖ قَالُوا نَعَمْ ۚ فَأَذَّنَ مُؤَذِّنٌ بَيْنَهُمْ أَنْ لَعْنَةُ اللَّهِ عَلَى الظَّالِمِينَ
১৩। জান্নাতবাসিগণ অগ্নিবাসীদেরকে সম্বোধন করে বলবে, আমাদের প্রতিপালক আমাদেরকে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন আমরা তো তা সত্য পেয়েছি। তোমাদের প্রতিপালক তোমাদেরকে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তোমরা তা সত্য পেয়েছো কি? তারা বলবে, হ্যাঁ, অতঃপর জনৈক ঘোষণাকারী তাদের মধ্যে ঘোষণা করবে, আল্লাহর লা‘নত যালিমদের উপর। [সূরা আ‘রাফ : আয়াত ৪৪]

وَعَدَ اللَّهُ الْمُؤْمِنِينَ وَالْمُؤْمِنَاتِ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا وَمَسَاكِنَ طَيِّبَةً فِي جَنَّاتِ عَدْنٍ ۚ وَرِضْوَانٌ مِنَ اللَّهِ أَكْبَرُ ۚ ذَٰلِكَ هُوَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ
১৪। আল্লাহ মু’মিন নর ও নারীকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন জান্নাতের, যার নি¤œদেশে নদী প্রবাহিত যেখানে তারা স্থায়ী হবে এবং স্থায়ী জান্নাতে উত্তম বাসস্থানের। আল্লাহর সন্তুষ্টিই সর্বশ্রেষ্ঠ এবং ইহাই মহাসাফল্য। [সূরা তাওবা : আয়াত ৭২]

إِنَّ الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ يَهْدِيهِمْ رَبُّهُمْ بِإِيمَانِهِمْ ۖ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهِمُ الْأَنْهَارُ فِي جَنَّاتِ النَّعِيمِ
১৫। যারা মুমিন ও সৎকর্মপরায়ণ তাদের প্রতিপালক তাদের ঈমান হেতু তাদেরকে পথ নির্দেশ করবেন; সুখদ কাননে তাদের পাদদেশে নহরসমূহ প্রবাহিত হবে। [সূরা ইউনুস : আয়াত ৯]

  دَعْوَاهُمْ فِيهَا سُبْحَانَكَ اللَّهُمَّ وَتَحِيَّتُهُمْ فِيهَا سَلَامٌ ۚ وَآخِرُ دَعْوَاهُمْ أَنِ الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ
১৬। সেখানে তাদের ধ্বনি হবে হে আল্লাহ! তুমি মহান, পবিত্র! এবং সেখানে তাদের অভিবাদন হবে, সালাম এবং তাদের শেষ ধ্বনি হবে এই, সকল প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক আল্লাহর প্রাপ্য! [ সূরা ইউনুস: আয়াত ১০]

 لِلَّذِينَ أَحْسَنُوا الْحُسْنَىٰ وَزِيَادَةٌ ۖ وَلَا يَرْهَقُ وُجُوهَهُمْ قَتَرٌ وَلَا ذِلَّةٌ ۚ أُولَٰئِكَ أَصْحَابُ الْجَنَّةِ ۖ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ
১৭। যারা মঙ্গলকর কাজ করে তাদের জন্য আছে মঙ্গল এবং আরও অধিক। কালিমা ও হীনতা তাদের মুখম-লকে আচ্ছন্ন করবে না। তারাই জান্নাতের অধিবাসী, সেখানে তারাই স্থায়ী হবে। [সূরা ইউনুস : আয়াত ২৬]

কিংবদন্তি বক্সার মোহাম্মদ আলী,ইসলামের জন্য অনন্য ত্যাগ স্বীকারকারী

“আমি ধূমপান করিনা, কিন্তু আমি আমার পকেটে একটি ম্যাচবক্স রাখি। যখন আমার হৃদয় কুপ্রবৃত্তির কারণে গুনাহ করতে চায় ,তখন আমি একটি কাঁঠি জ্বালাই এবং আমার হাতের তালুর কাছে নিয়ে তাপ দেই। এবং আমি নিজেকে জিজ্ঞেস করিঃ ”আলী তুমি সামান্য এই তাপ সহ্য করতে পারছ না, কিভাবে জাহান্নামের অসহ্য তাপ সহ্য করবে?” –কিংবদন্তি বক্সার মোহাম্মদ আলী

ক্যাসিয়াস মার্কাস ক্লে, ইসলাম ধর্ম গ্রহণের আগে এটাই ছিল তাঁর নাম। ১৯৪২ সালের ১৭ জানুয়ারি লুইসভিল কেন্টাকিতে আলী আফ্রিকান-আমেরিকান মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।আমেরিকান এই বক্সার চ্যাম্পিয়ান খ্রিষ্টান হতে মুসলমান হওয়ার জন্য তার খেতাব , সম্মান ও প্রাণ নিয়ে টানাটানি চলে কিন্তু বীরদর্পে তিনি ঘোষণা করলেন, আমার নাম ‘ক্যাসইয়াস ক্লে নয়, আমি এখন মোহাম্মদ আলী।’

১৯৬৪ সালে তিনি সৈনিক জীবনে প্রবেশ করতে ব্যার্থ হন পরীক্ষায় অনুত্তীর্ন হয়ার কারনে। ১৯৬৬ সালে তিনি উত্তীর্ন হন।ভিয়েতনামে যুদ্ধের জন্য তাকে মনোনয়ন দেয়া হলে তিনি যুদ্ধে যেতে অস্বীকৃতি জানান এই বলে যে, “এ যুদ্ধ পবিত্র কুরআন শিক্ষার বিরোধী। আমি এ যুদ্ধে সামিল হতে পারি না। আমরা আল্লাহ ও তার রাসুলের অনুমতি ছাড়া যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারি না। কোন খৃস্টানের কিংবা অবিশ্বাসীদের যুদ্ধে শরিক হওয়া আমাদের উচিত হবে না।” তিনি আরও বলেন, “তাদের (ভিয়েতনামীদের) সাথে আমার কোন বিবাদ নেই। তারা (ভিয়েতনামীরা) আমাকে কালো বলে গাল দেয় নি। অন্যত্র তিনি বলেন,” তারা (মার্কিনিরা) কেন আমাকে উর্দি পরিয়ে দশ হাজার মাইল দূরে পাঠিয়ে ভিয়েতনামীদের উপর বোমা আর বুলেট মারতে বলবে যখন লুইসভিলেই (আলীর গ্রাম) সামান্যতম মানবাধিকার অস্বীকার করে নিগ্রোদের সাথে কুকুরের মত আচরণ করা হয়।”

মোহাম্মদ আলী তিন তিনবার বিশ্ব হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন হয়ে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেন।১৯৬৭ সালে ভিন্ন ধর্মীয় বিশ্বাস ও ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরোধিতার কারণে গ্রেফতার হন এবং তার বক্সিং খেতাব কেড়ে নেয়া হয়। শুধু কি তাই, তার বক্সিং লাইসেন্সও স্থগিত করা হয়।

মোহাম্মদ আলী ১৯৬১ সালের দিকে মুসলমান হন।প্রথম দিকে তিনি বিভ্রান্ত সংগঠন ‘নেশন অব ইসলামে’ থাকলেও ১৯৭৫ সালে আলী সুন্নি মুসলমানে দীক্ষিত হন। Howard University ‘র চার হাজার উৎফুল্ল ছাত্রদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতায় তিনি বলেন, “Black Is Best”.

তিনি ৬১ টি বক্সিং প্রতিযোগিতার মধ্যে ৫৬ টিতে জয়ী হন। মাত্র ০৫ টিতে পরাজিত হন।১৯৮১ সালে এই মহান বক্সার অবসর গ্রহণ করেন।১৯৮৪ সালে আলীর পারকিসন্স রোগ ধরা পড়ে।বর্তমানেও তিনি এই রোগে ভোগছেন।

১৯৭৮ সালে বাংলাদেশে এসেছিলেন সর্বকালের সেরা এই ক্রীড়াবিদ। বিমানবন্দরে আলীকে স্বাগত জানাতে লাখ লাখ মানুষ উপস্থিত হয়েছিল। সেই সময় বাংলাদেশের নাগরিকত্বও দেওয়া হয়েছিল। বাংলাদেশে এসে এত খুশি হয়েছিলেন, ফিরে গিয়ে সবাইকে বলেছিলেন, ‘স্বর্গ দেখতে চাইলে বাংলাদেশে যাও।’


–লিখাটি উইকিপিডিয়া,বিভিন্ন ব্লগ,দৈনিক পত্রিকা থেকে সংগৃহীত এবং কিছু অংশ সংযোজন করে লিখা

এক মিসরি ভাইয়ের জীবনের গল্প ও একটি হাহাকারের সুন্দর পরিসমাপ্তি !

বিয়ের পর তিন বছর কেটে গেছে। সন্তান হয়নি। একটা সন্তানের জন্য আমরা দুজনেই হন্যে গেলাম। যেখানে যে চিকিৎসা পেয়েছি, আঁকড়ে ধরতে পিছপা হইনি। যে যা বলেছে, নির্দ্বিধায় বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে নিয়েছি।

হোমিও এলোপ্যাথি-কবিরাজি,ইউনানি কিছুই বাদ রাখিনি। কিছুতেই ফল মিলল না। প্রায় নিরাশ হয়ে পড়েছি। এমতাবস্থায় একদিন কুরআন কারীম করতে গিয়ে একটা আয়াত চোখে পড়ল। আরোও কতবার আয়াতটা পড়েছি, সেদিনের মতো চোখে লাগেনি। বারবার আয়াতটা পড়তে লাগলাম !

لَخَلۡقُ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ اَکۡبَرُ مِنۡ خَلۡقِ النَّاسِ وَ لٰکِنَّ اَکۡثَرَ النَّاسِ لَا یَعۡلَمُوۡنَ
মানুষের সৃষ্টি অপেক্ষা নভোমন্ডল ও ভূ-মন্ডলের সৃষ্টি কঠিনতর। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ বোঝে না।  (সূরা গাফির)

আয়াতটা পড়তে পড়তেই মাথায় চিন্তা ঝিলিক দিয়ে উঠল, মানুষ সৃষ্টিরর চেয়েও আসমান ও যমীন সৃষ্টি বেশি কঠিন। এত কঠিন কাজ যিনি পারেন ও করেন,তিনি কি একটা ভ্রণ সৃষ্টি করতে পারেন না?

আমাদেরকে একটা সন্তান দিতে পারেন না? অবশ্যই পারেন! স্ত্রীকেও আয়াতটা পড়ে শোনালাম! সেও ভীষণ আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ল! দু’জনে আয়াতটার কথা বলে বলে নতুন করে দু’আ করতে শুরু করলাম! আলহামদুলিল্লাহ! কিছুদিন পরই আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে ফুটফুটে একটি সন্তান দান করেছেন।

-মহসিন ফুয়াদ,আলজেরিয়া।

এক মিসরি ভাইয়ের জীবনের গল্প

বিয়ে হয়েছে বেশ কয়েক বছর হয়ে গেল। পড়াশোনা শেষ করার আগেই বিয়ে করেছিলাম। তাই প্রথম প্রথম সন্তান কেন হচ্ছে না, এটা নিয়ে তেমন মাথাব্যথা ছিল না। আমার স্ত্রীও তখন ছাত্রী। আব্বু দু’জনেরই খরচ চালাতেন। আমাকে গুনাহ থেকে বাঁচানোর জন্যে পঁচিশ বছর বয়েসেই বিয়ে করিয়ে দিয়েছেন। আগের মতো খরচাপাতি দিয়ে গেছেন পড়াশোনা শেষ হওয়া পর্যন্ত।
চাকুরি নিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়ালাম। ছেলেপিলে হচ্ছে না দেখে দু’জনেই ডাক্তারের শরণাপন্ন হলাম। দুআ‘-তদ্বির করলাম। আমার স্ত্রী একদিন বলল:
-আপনি কি একটা ব্যপার লক্ষ করেছেন!
-কোন ব্যাপার?
-ছেলেসন্তানও আল্লাহর দেয়া একপ্রকার রিযিক! অন্যতম শ্রেষ্ঠ রিযিক। কুরআন কারীমে যেখানেই এই সন্তানের রিযিকের কথা এসেছে, সেখানে হেবাহ (‏الهبة) শব্দটা ব্যবহৃত হয়েছে।

(১) ইবরাহীম আ. আল্লাহর কাছে দুআ করলেন:
رَبِّ هَبْ لِي مِنَ الصَّالِحِينَ
হে আমার প্রতিপালক! আমাকে এমন পুত্র দান করুন (هَبْ), যে হবে সৎলোকদের একজন (সাফফাত ১০০)।
আল্লাহ তা‘আলা এর জবাবে বললেন:
فَبَشَّرْنَاهُ بِغُلَامٍ حَلِيمٍ
সুতরাং আমি তাকে এক সহনশীল পুত্রের সুসংবাদ দিলাম

(২) পিতার সাথে মতের অমিল হল। ইবরাহীম আ. বাড়িঘর ছেড়ে সরে পড়লেন। আল্লাহ তা‘আলা তখন বললেন: আমি তাকে ইসহাক ও ইয়া‘কুবকে (وَهَبْنَا لَهُ) দান করলাম (মারইয়াম ৪৯)।

(৩) বৃদ্ধ বয়সে সন্তান করেছেন ইবরাহীম। মনটা আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতায় নুয়ে এসেছে। মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেছে: সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর, যিনি আমাকে বৃদ্ধ বয়েসে ইসমাইল ও ইসহাককে (وَهَبَ لِي) দান করেছেন (ইবরাহীম ৩৯)।

(৪) যাকারিয়্যা আ.-এর সন্তান হচ্ছে না। বৃদ্ধ হয়ে গেছেন। আল্লাহর কাছে অনবরত দু‘আ করে যাচ্ছেন। ইয়া রাব, আমাকে আপনার পক্ষ হতে পবিত্র সন্তান (هَبْ لِي) দান করুন (আলে ইমরান ৩৮)।

(৫) নিজের বন্ধ্যা স্ত্রীর কথা জানিয়ে ফরিয়াদ করছেন যাকারিয়্যা। তার মৃত্যুর পর দাওয়াতী কাজের উত্তরাধিকারী হওয়ার মত কেউ নেই। ইয়া আল্লাহ! আমাকে আপনার পক্ষ থেকে একজন উত্তরাধিকারী (هَبْ لِي) দান করুন (মারইয়াম ৫)।

(৬) আল্লাহর পক্ষ থেকে কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হলেন আইয়ুব আ.। অবিশ^াস্য সবর ধরলেন তিনি। আল্লাহ তা‘আলা আইয়ুবের সবরে খুশি হলেন। আগের মতো সব ফিরিয়ে দিলেন। বললেন: আমি তাকে (وَوَهَبْنَا لَهُ) দান করলাম তার পরিবারবর্গ এবং তার সাথে অনুরূপ আরও (সোয়াদ ৪৩)।

(৭) দাউদ আ.-কেও আল্লাহ তা‘আলা সন্তান দান করলেন। আল্লাহ তা‘আলা বললেন: আমি দাউদকে (وَوَهَبْنَا) দান করলাম সুলাইমান (সোয়াদ ৩০)।

(৮) স্বামী নেই। তবুও কিভাবে গর্ভবতী হলেন? মারইয়াম এমন অদ্ভুত ঘটনার ভীষণ অবাক! সীমাহীন অস্বস্তিতে পড়ে গেলেন। ইহুদিদের অপবাদের জ¦ালা সইবেন কী করে? সবার অগোচরে দূরের এক স্থানে চলে এলেন। এমন দিশেহারা অবস্থায় জিবরাঈল এসে বললেন: আমি আপনার প্রতিপালকের প্রেরিত (ফিরিশতা)। আমি এসেছি আপনাকে এক পবিত্র পুত্র সন্তান (لِأَهَبَ لَكِ) দান করার জন্যে (মারইয়াম ১৯)।

(৯) সূরা ফুরকানে আল্লাহ তা‘আলা কিছু বান্দার প্রশংসা করেছেন। সর্বশেষ প্রশংসা করেছেন, যারা বলে: ইয়া রাব, আমাদেরকে আমাদের স্ত্রী ও সন্তানদের পক্ষ হতে (هَبْ لَنَا) দান করুন নয়নপ্রীতি (৭৪)।

(১০) সূরা শুরায় বলা হয়েছে:
يَهَبُ لِمَن يَشَاءُ إِنَاثًا وَيَهَبُ لِمَن يَشَاءُ الذُّكُورَ
তিনি যাকে চান কন্যা দান করেন এবং যাকে চান পুত্র দান করেন (৪৯)।

শরীয়তের পরিভাষায়, হেবাহ (‏الهبة) বলা হয়, বিনিময়হীন দানকে। কোনও ধরনের বিনিময় ছাড়া কাউকে কোনও কিছু মালিক বানিয়ে দেয়া।

আল্লাহ তা‘আলা চাইলে আমাদেরকে সন্তান দান করতে পারেন। এবং সেটা কোনও বিনিময় ছাড়াই। আমরা দু’জনে কুরআন কারীমের উক্ত আয়াতগুলোর অর্থ ও ভাব মাথায় রেখে, নবীগনের কষ্ট ও প্রাপ্তির বিষয়টা স্মরণে রেখে গভীর মনোযোগের সাথে দু‘আ করে গেলে, আল্লাহ তা‘আলা নিশ্চয়ই শুনবেন! আমরা আল্লাহর দরবারে রিযিক হেবাহ চাইব! সন্তানের রিযিক।
.
স্ত্রীর কথামত আমরা দু’জনেই নিয়মিত কুরআন কারীমের আয়াতগুলো আলোচনা করতে শুরু করলাম। নবীগনের আদর্শ সামনে রেখে দু‘আয় মশগুল হয়ে গেলাম। আলহামদুলিল্লাহ! একমাসের মাথায় রাব্বে কারীম আমাদের ডাকে সাড়া দিলেন। আমার আহলিয়া মেয়ের নাম পছন্দ করেছে ‘মারইয়াম ফারিস’। আমার নাম ফারিস।

==================================

দাম্পত্যজীবন : অজ্ঞতা ও পরিণাম

দাম্পত্যজীবন : অজ্ঞতা ও পরিণাম-মাওলানা আবু তাহের মিসবাহ
কিছুদিন আগে আমার এক প্রিয় তালিবে ইলম দেখা করতে এসে বললো, হুযূর, আগামী পরশু আমার বিবাহ। চমকে উঠে তাকালাম। বড় ‘বে-চারা’ মনে হলো। কারণ আমিও একদিন বড় অপ্রস্তুত অবস্থায় জেনেছিলাম, আগামীকাল আমার বিবাহ! ভিতর থেকে হামদরদি উথলে উঠলো। ইচ্ছে হলো তাকে কিছু বলি, যিন্দেগির এই নতুন রাস্তায় চলার জন্য প্রয়োজনীয় কিছু পাথেয়, আল্লাহর তাওফীকে তাকে দান করি। আল্লাহর তাওফীক ছাড়া আমরা কে-ই বা কী করতে পারি!

তো তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, বিবাহের জন্য কী প্রস্তুতি নিয়েছো? বড় ভোলাভালা নওজোয়ান! সরলভাবে বললো, আমার কিছু করতে হয়নি, সব প্রস্তুতি আব্বা -আম্মাই নিয়েছেন। কেনাকাটা প্রায় হয়ে গেছে, শুধু বিয়ের শাড়ীটা বাকি।

অবাক হলাম না, তবে দুঃখিত হলাম। আমার এই প্রিয় তালিবে ইলম এখন একজন যিম্মাদার আলিমে দ্বীন। দীর্ঘ কয়েক বছর আমাদের ছোহবতে ছিলো, তার কাছে বিবাহের প্রস্তুতি মানে হলো জিনিসপত্র এবং বিয়ের শাড়ী! তাহলে অন্যদের অবস্থা কী?!

বড় মায়া লাগলো। বললাম, দেখো, মানুষ যে কোন কাজ করতে চায়, প্রথমে সে ঐ বিষয়ে প্রয়োজনীয় শিক্ষা গ্রহণ করে। কাজটির হাকীকত ও উদ্দেশ্য কী? কাজটি আঞ্জাম দেয়ার সঠিক পন্থা কী? শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কী কী সমস্যা হতে পারে, সেগুলোর সমাধান কী? এগুলো জেনে নেয়। এ জন্য দস্তুরমত আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষার আয়োজন আছে, এমনকি বাস্তব প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা আছে।

অথচ জীবনের সবচে কাঠিন ও জটিল অধ্যায়ে মানুষ প্রবেশ করে, বরং বলতে পারো ঝাঁপ দেয়, কিছু না শিখে, না জেনে এবং না বুঝে একেবারে অপ্রস্তুত অবস্থায়। ফল কী হতে পারে?! কী হয়?! অন্যদের কথা থাক, চোখের সামনে আমার কজন ছাত্রের ঘর ভেঙ্গে গেলো! একজনের তো এমনকি দুজন সন্তানসহ। কিংবা ঘর হয়ত টিকে আছে, কিন্তু শান্তি নেই। স্বাভাবিক শান্তি হয়ত বজায় আছে, কিন্তু বিবাহ যে দুনিয়ার বুকে মানবের জন্য আল্লাহর দেয়া এক জান্নাতি নেয়ামত, সুকূন ও সাকীনাহ, সে খবর তারা পায়নি, শুধু অজ্ঞতার কারণে, শুধু শিক্ষার অভাবে।

আশ্চর্য, মা-বাবা সন্তানকে কত বিষয়ে কত উপদেশ দান করেন; উস্তাদ কত কিছু শিক্ষা দেন, নছীহত করেন, কিন্তু জীবনের সবচে কঠিন ও জটিল বিষয়টি কেন যেন তারা সযত্নে এড়িয়ে যান!

তাকে বললাম, যদিও তুমি এ উদ্দেশ্যে আসোনি তবু তোমাকে কিছু কথা বলতে চাই, যা ইনশাআল্লাহ আগামী জীবনে তোমার কাজে আসবে।

খুব জযবা ছিলো, অাবেগের তোড় ছিলো, ‘দিল কো নিচোড় ক্যর’, বাংলায় যদি বলি তাহলে বলবো, হৃদয়নিংড়ে, কিন্তু দিল কো নিচোড়না-এর ভাব হৃদয় নিংড়ানোতে আসবে কোত্থেকে! যাক, বলছিলাম, হৃদয়টাকে নিংড়ে কিছু কথা তাকে বলেছিলাম। পরে আফসোস হলো যে, কথাগুলো তো সব হাওয়ায় উড়ে গেলো, যদি বাণীবদ্ধ করে রাখা যেতো কত ভালো হতো! হয়ত আল্লাহর বহু বান্দার উপকারে আসতো। শেষে বললাম, এককাজ করো, এ কথাগুলোর খোলাছা কাগজে লিখে আমাকে দেখিও।

আগামী পরশু বিয়ের খবর দিয়ে ছেলেটা সেই যে গেলো, তিন বছরে আর দেখা নেই! দাম্পত্যজীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে বিভিন্ন সময় দরসেও আমি অনেক কথা বলেছি। ‘সবচে’ বেশী বলেছি আমার নূরিয়ার জীবনের প্রিয় ছাত্র (বর্তমানের হাতিয়ার হুযূর) মাওলানা আশরাফ হালীমীকে, আশা করি তিনি সাক্ষ্য দেবেন, অনেকবার বলেছেন, আমার কথাগুলো তার জীবনে বে-হদ উপকারে এসেছে। আরো অনেকে বলেছে, কিন্তু কথাগুলো কেউ ‘কলমবন্দ’ করেনি।

তো এখন এই উপলক্ষকে কেন্দ্র করে তোমাদের মজলিসে ঐ কথাগুলো আবার বলতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু আফসোস, সেই আবেগ ও জযবা তো এখন নেই, যা ঐ প্রিয় তালিবে ইলমকে বলার সময় ছিলো। আবেগভরা দিলের কথা তো রসভরা ইক্ষু, আর শুধু চিন্তা থেকে বলা কথা হলো রস নিংড়ে নেয়া ইক্ষুর ছোবা! তবু কিছু না কিছু ফায়দা তো ইনশাআল্লাহ হবে।

আমি আমার প্রিয় ছাত্রটিকে বলেছিলাম, এখন তোমার জীবনের এই যে নতুন অধ্যায় শুরু হচ্ছে, উর্দূতে এটাকে বলে ইযদিওয়াজী যিন্দেগী। বাংলায় বলে দাম্পত্য জীবন। অর্থাৎ এটা জীবন ও যিন্দেগির খুবই এবং খুবই গুরুত্বপূর্ণ অংশ। শুধু গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং অত্যন্ত জটিল ও ঝুঁকিপূর্ণ। এটা তোমাকে ঘাবড়ে দেয়ার জন্য বলছি না; প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণ ও পাথেয় সংগ্রহ করার জন্য বলছি। যাতে পূর্ণ আস্থা ও সাহসের সঙ্গে তুমি তোমার এই নতুন জীবন শুরু করতে পারো। আল্লাহ যদি সাহায্য করেন তাহলে সবই সহজ।

এটা যে শুধু তোমার ক্ষেত্রে হচ্ছে তা নয়! আমার জীবনেও হয়েছে, আমার মা-বাবার জীবনেও হয়েছে! তোমার মা-বাবাও একদিন এ জীবন শুরু করেছিলেন। যদি সহজ ও অন্তরঙ্গ সম্পর্ক থাকে তাহলে তোমার মাকে, বাবাকে জিজ্ঞাসা করতে পারো, কীভাবে তারা এ দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে এসেছেন? জীবনের শুরুতে তারা কী ভেবেছিলেন, কী চেয়েছিলেন, কী পেয়েছেন?

কখন কী সমস্যা হয়েছে, সেগুলো কীভাবে সমাধান করেছেন। এই জীবনের শুরুতে তোমার প্রতি তাদের কী উপদেশ? এ ধরনের সহজ আন্তরিক আলোচনায় সংসার জীবনের পথচলা অনেক সহজ হয়ে যায়। অবশ্য সব মা-বাবার সঙ্গে সব সন্তানের এমন সহজ সম্পর্ক থাকে না, তবে থাকা উচিত। জীবনের যে কোন সমস্যার সমাধানের জন্য সন্তান মা-বাবার কাছেই আসবে, মা-বাবাকেই নিরাপদ আশ্রয় মনে করবে, বন্ধুবান্ধবকে নয়। কঠিন সমস্যার মুখে একজন অপরিপক্ব বন্ধু কীভাবে সঠিক পথ দেখাতে পারে! কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে এটাই ঘটে। সন্তান মা-বাবাকে ভয় করে, হয়ত কোন জটিলতায় পড়েছে; তখন তাদের প্রথম চেষ্টা হয় যে, মা-বাবা যেন জানতে না পারে, কারণ তাদের কানে গেলে সর্বনাশ! ছেলে তার বন্ধুর শরণাপন্ন হয়, মেয়ে তার বান্ধবীর কাছে বলে, তারা তাদের মত করে পরামর্শ দেয়। ফলে অবস্থা আরো গুরুতর হয়।

অতীতে যাই ছিলো, এখন তো অপরিহার্য হয়ে পড়েছে, মা-বাবার জন্য সন্তানের বন্ধু হওয়া। বিপদে সমস্যায় সন্তানকে তিরস্কার পরে করা, আগে তার পাশে দাঁড়ানো। তাহলে সন্তান আরো বড় অন্যায় করা থেকে এবং আরো গুরুতর অবস্থায় পড়া থেকে বেঁচে যায়। কিন্তু এখন অবস্থা হলো, সন্তান মা-বাবাকে ভয় করে, বন্ধুকে নিরাপদ আশ্রয়স্থল মনে করে। আমার ছেলেকে আমি এটা বোঝাতে চেয়েছি এবং আশা করি, কিছুটা বোঝাতে পেরেছি। অনেক সমস্যা থেকে সে রক্ষা পেয়েছে, কারণ সবার আগে সে আমার কাছে এসেছে। আর আমি বলেছি, ভয় নেই, আমি তোমার পাশে আছি। আগে তাকে সাহায্য করেছি। তারপর প্রয়োজনে দরদের সঙ্গে তিরস্কার করেছি, বা শিক্ষা দিয়েছি। বন্ধুর কাছে আগে পাওয়া যায় সাহায্য, মা-বাবার কাছ থেকে আগে আসে তিরস্কার। তাই সন্তান সমস্যায় পড়ে মা-বাবার কাছে আসে না, বন্ধুর কাছে আসে। এভাবে নিজের কারণেই সবচে কাছের হয়েও মা-বাবা হয়ে যায় দূরের, আর দূরের হয়েও বন্ধু হয়ে যায় কাছের। সন্তানের সমস্যা বন্ধু জানে সবার আগে। মা-বাবা জানে সবার পরে, পানি যখন মাথার উপর দিয়ে চলে যায় তখন।

তো আমি আশা করছি, জীবনের অন্যসকল ক্ষেত্রে যেমন তেমনি, আল্লাহ না করুন দাম্পত্যজীবনে যদি কোন রকম সমস্যার সম্মুখীন হয় তাহলে সন্তান সবার আগে আমার কাছে আসবে, তার মায়ের কাছে আসবে, আমাদের উপদেশ, পরামর্শ নেবে।

আলহামদু লিল্লাহ, সেই রকমের সহজ অন্তরঙ্গ সম্পর্কই সন্তানের সঙ্গে আমার, আমাদের।

আমার প্রিয় ছাত্রটিকে বললাম, কথা অন্য দিকে চলে গেছে, তো এই প্রসঙ্গে তোমাকে একটি আগাম নছীহত করি; আজ তোমরা স্বামী-স্ত্রী, দু’দিন পরেই হয়ে যাবে, মা এবং বাবা। সেটা তো জীবনের আরো কঠিন, আরো জটিল অধ্যায়। আমি প্রায় বলে থাকি, প্রাকৃতিক নিয়মে মা-বাবা হয়ে যাওয়া খুব সহজ। কিন্তু আদর্শ মা-বাবা হওয়ার জন্য প্রয়োজন দীর্ঘ শিক্ষা ও দীক্ষা। তো তোমরা দু’জন জীবনের শুরু থেকেই শিক্ষা গ্রহণ করতে শুরু করো যে, একটি মেয়ে কীভাবে একজন আদর্শ মা হতে পারে এবং একটি ছেলে কীভাবে একজন আদর্শ বাবা হতে পারে! আগে বলেছিলাম একটি নছীহত, এখন বলছি দু’টি নছীহত।

সন্তানের সামনে কখনো তার মাকে অসম্মান করো না। তোমাকে মনে রাখতে হবে, সে তোমার স্ত্রী, কিন্তু তোমার সন্তানের মা, তোমার চেয়েও অধিক শ্রদ্ধার পাত্রী। সন্তান যেন কখনো, কখনোই মা-বাবাকে ঝগড়া-বিবাদ করতে না দেখে। এ নছীহত আমি তোমাকে করছি, আল্লাহর শোকর নিজে আমল করে। আমার বড় সন্তানের বয়স ত্রিশ বছর, এর মধ্যে কখনো সে আমাদের বিবাদ করতে এমনকি তর্ক করতেও দেখেনি। দ্বিতীয়ত তোমরা উভয়ে সন্তানের বন্ধু হওয়ার চেষ্টা করো, এমন বন্ধু যাকে নিজের মনের কথা, সব কথা নিঃসঙ্কোচে জানাতে পারে।

আগের কথায় ফিরে আসি; আগামী পরশু তোমার বিবাহ। তার মানে, আজ তুমি নিছক একটি যুবক ছেলে, অথচ আগামী পরশু হয়ে যাচ্ছো, একজন দায়িত্ববান স্বামী। কত বিরাট পার্থক্য তোমার আজকের এবং আগামী পরশুর জীবনের মধ্যে। বিষয়টি তোমাকে বুঝতে হবে। কেন তুমি বিবাহ করছো? বিবাহের উদ্দেশ্য কী? দেখো, আমাদের দেশে পারিবারিক পর্যায়ে একটা নিন্দনীয় মানসিকতা হলো, সংসারের প্রয়োজনে, আরো খোলামেলা যদি বলি, কাজের মানুষের প্রয়োজনে ছেলেকে বিয়ে করানো। সবাই যে এমন করে তা নয়। তবে এটা প্রবলভাবে ছিলো, এখনো কিছু আছে। আমি নিজে সাক্ষী, আমার একজন মুহতারাম তাঁর মেয়েকে বিয়ে দিলেন, বিয়ে হওয়ামাত্র ছেলের বাবা স্বমূর্তি ধারণ করে বলতে লাগলেন, আর দেরী করা যাবে না, তাড়াতাড়ি মেয়ে বিদায় করেন। মেয়ের মা ও বাবা তো হতবাক!

মেয়ে বিদায় হলো। শশুরবাড়ীতে রাত পোহালো, আর পুত্রবধুর সামনে কাপড়ের স্তূপ নিক্ষেপ করে শাশুড়ী আদেশ করলেন, কাপড়ে সাবান লাগাও, দেখি, মায়ের বাড়ী থেকে কেমন কাজ শিখে এসেছো!

আমার এক ছাত্রের কথা, বিয়ের প্রয়োজন। কেন? কারণ মা-বাবার খেদমত করার কেউ নেই।

এটা কিন্তু বিবাহের উদ্দেশ্য বা মাকছাদ হতে পারে না। মা-বাবার খেদমত মূলত তোমার দায়িত্ব। এখন সে যদি স্বতঃস্ফূর্তভাবে তোমার সাথে এতে শরীক হয়, তবে সেটা তোমাদের উভয়ের জন্য সৌভাগ্যের কারণ হতে পারে। দেখো, আল্লাহ চাহে তো অচিরেই আমাদেরও ঘরে পুত্রবধূ আসবে। আমরা আমাদের না দেখা সেই ছোট্ট মেয়েটির প্রতীক্ষায় আছি। কিন্তু আমি আমার পুত্রকে অবশ্যই বলবো, বিবাহের উদ্দেশ্য মা-বাবার খেদমত করা হতে পারে না।

আমি দুআ করি, তোমার মা-বাবা তোমার যেমন, তেমনি তোমার স্ত্রীরও যেন মেহেরবান মা-বাবা হতে পারেন। আমার দুই মেয়ের শশুর, দুজনই এখন জান্নাতবাসী (ইনশাআল্লাহ)। আল্লাহর কাছে আমার সাক্ষ্য এই যে, সত্যি সত্যি তারা আমার মেয়েদু’টির ‘বাবা’ ছিলেন। আমার ছোট মেয়ের শশুর বড় আলিম ছিলেন, তাঁকে আমার একটি বই হাদিয়া দিয়েছিলাম এভাবে- ‘সাফফানার আববুর পক্ষ হতে সাফফানার আববাকে’। তিনি খুশী হয়ে অনেক দু’আ করেছিলেন, আর বলেছিলেন, ‘আপনি তো এই ছোট্ট একটি বাক্যে সম্পর্কের মহামূল্যবান এক দর্শন তুলে ধরেছেন!

আমার বড় মেয়ের অবস্থা হলো, মায়ের বাড়ী থেকে যাওয়ার সময় সে কাঁদে না, কাঁদে ‘আম্মার’ বাড়ী থেকে আসার সময়।

দুআ করি, আমার দেশের প্রতিটি মেয়ে যেন মা-বাবার ঘর থেকে এমন মা-বাবার ঘরে প্রবেশ করতে পারে। আর তুমি দুআ করো, আমরা দু’জন যেন আমাদের অনাগত মেয়েটির জন্য তেমন মা-বাবাই হতে পারি।

তো বলছিলাম বিবাহের উদ্দেশ্যের কথা। বৈধ উপায়ে স্ত্রী-পরিচয়ে কাউকে ভোগ করা, এটাও বিবাহের উদ্দেশ্য বা মাকছাদ হতে পারে না।

স্বামী-স্ত্রী পরস্পরকে বলা হয় শরীকে হায়াত, জীবনসঙ্গী এবং জীবনসঙ্গিনী। বস্তুত এই শব্দটির মধ্যেই দাম্পত্যজীবনের সুমহান উদ্দেশ্যটি নিহিত রয়েছে। আর যদি কোরআনের ভাষায় বলি তাহলে বিবাহের উদ্দেশ্য হল-

هن لباس لكم وانتم لباس لهن

তুমি তো কোরআন বোঝো। ভেবে দেখো, দাম্পত্য-সম্পর্কের কী গভীর তাৎপর্য এখানে নিহিত!

পেয়ারা হাবীব ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, বিবাহ হচ্ছে আমার সুন্নত। আর বলেছেন, যে আমার সুন্নতের প্রতি বিমুখ হবে সে আমার উম্মতভুক্ত নয়।

বিবাহ নবীর সুন্নত! সুতরাং সহজেই বোঝা যায়, বিরাট ও মহান কোন মাকছাদ রয়েছে এর পিছনে।

বিবাহের আসল মাকছাদ বা উদ্দেশ্য হলো স্বামী ও স্ত্রী- এই পরিচয়ে একটি নতুন পরিবার গঠন করা এবং মা ও বাবা- এই পরিচয়ে সন্তান লাভ করা। তারপর উত্তম লালন-পালন এবং আদর্শ শিক্ষা-দীক্ষা ও তারবিয়াতের মাধ্যমে নেক সন্তানরূপে গড়ে তুলে দুনিয়া থেকে বিদায় গ্রহণ করা। যাতে নসলে ইনসানি বা মানববংশ কেয়ামত পর্যন্ত আল্লাহর পছন্দমত আগে বাড়তে থাকে।

এটাই হলো বিবাহের আসল উদ্দেশ্য; অন্য যা কিছু আছে তা সব পার্শ্ব-উদ্দেশ্য। তো এখনই তুমি নিয়ত ঠিক করে নাও যে, কেন কী উদ্দেশ্যে বিবাহ করবে। উদ্দেশ্য যদি ঠিক হয়ে যায় তাহলে দেখতে পাবে, আল্লাহ চাহে তো এখনই তোমার ভিতরে কত সুন্দর পরিবর্তন আসছে! কী আশ্চর্য এক পরিপূর্ণতা নিজের মধ্যে অনুভূত হচ্ছে! আগামী জীবনের সকল দায়দায়িত্ব পালন করার জন্য গায়েব থেকে তুমি আত্মিক শক্তি লাভ করছো। আল্লাহ তাওফীক দান করেন।

এবার আসো জীবনের বাস্তবতার কথা বলি। এতদিন তোমার জীবনে ছিলেন শুধু তোমার মা, যিনি তোমাকে গর্ভে ধারণ করেছেন, প্রসববেদনা ভোগ করেছেন। নিজেকে তিলে তিলে ক্ষয় করে তোমাকে প্রতিপালন করেছেন। এতদিন তোমার উপর ছিলো তাঁর অখণ্ড অধিকার। হঠাৎ তিনি দেখছেন, তাঁর আদরের ধন, তাঁর অাঁচলের রত্ন পুত্রের জীবনে স্ত্রী-পরিচয়ে অন্য এক নারীর প্রবেশ (অনুপ্রবেশ?) ঘটেছে! এভাবে পুত্রের উপর তার অখণ্ড অধিকার খণ্ডি হতে চলেছে। যে পুত্র ছিলো এতদিন তাঁর একক অবলম্বন, এখন সে হতে চলেছে অন্য এক নারীর অবলম্বন। এ বাস্তবতা না তিনি অস্বীকার করতে পারছেন, না মেনে নিতে পারছেন।

সংসারে প্রত্যেক মায়ের জীবনে এ কঠিন সময়টি আসে। এমন এক অন্তর্জ্বালা শুরু হয় যা শুধু তিনি নিজেই ভোগ করেন, কাউকে বোঝাতে পারেন না। এমনকি এত দিনের আদরের ধন পুত্রকেও না। ফলে সামান্য সামান্য কারণে, এমনকি অকারণেও তিনি খুব সংবেদনশীল হয়ে পড়েন; তাঁর অনুভূতি আহত হয়। এমন সময় ছেলে (এবং তার স্ত্রী অজ্ঞতা, অনভিজ্ঞতা ও অপিরপক্বতার কারণে) যদি অসঙ্গত কিছু বলে বা করে বসে তাহলে তো মায়ের মনে কষ্টের শেষ থাকে না। প্রসববেদনা থেকে শুরু করে প্রতিপালনের সব কষ্ট একসঙ্গে মনে পড়ে যায়।

আম্মার কাছে শুনেছি, গ্রামের এক মা তার পুত্রবধূকে বলেছিলেন, ‘ততা ফানি আমি খাইছিলাম, না তুই খাইছিলি?’

তখনকার যুগে প্রসবপরবর্তী বেশ কিছু দিন মা ও শিশুর স্বাস্থ্যগত কল্যাণ চিন্তা করে মাকে গরম পানি খেতে দেয়া হতো, ঠান্ডা পানি দেয়া হতো না।

তো কথাটা কিন্তু নির্মম। আমার জন্য ‘তাতানো পানি’ আমার মা খেয়েছেন, আমার সব আবর্জনা আমার মা পরিষ্কার করেছেন। নিজের জীবন তিলে তিলে ক্ষয় করে তিনি আমাকে বড় করেছেন, উপযুক্ত করেছেন। সেই সব কষ্টের সুফল হঠাৎ করে অন্য একটি মেয়ে এসে অধিকার করে বসেছে। তখন সব হারানোর একটা বেদনা তাকে কুরে কুরে খায়। তো তোমার মায়ের অন্তরেও এ রকম অনুভূতি হওয়া স্বাভাবিক। মায়ের মনের এই কষ্টের উপশম, এই বেদনার সান্ত্বনা তোমাকেই চিন্তা করতে হবে।

মায়ের পর দ্বিতীয় পর্যায়ে আসে বাবার কথা, তারপর ভাই-বোনদের কথা। (এ সম্পর্কেও ছাত্রটিকে বিশদভাবে বলেছিলাম।)

তৃতীয়ত তোমার স্ত্রী। যদিও তৃতীয় বলছি, কিন্তু বাস্তবে এটাই হলো সবচে’ গুরুত্বপূর্ণ এবং সবচে’ নাযুক। তবে এটা থাকবে তোমার দিলে, তোমার অন্তরে। মা-বাবার সামনে মুখের কথায় বা আচরণে এটা প্রকাশ করা প্রজ্ঞার পরিচায়ক হবে না।

কেন বলছি স্ত্রীর বিষয়টি সবচে’ নাযুক? তার আগে আমার একটি প্রশ্নের উত্তর দাও; কোন বিবাহে কোন ছেলেকে কাঁদতে দেখেছো?! কোন ছেলের মা-বাবাকে বিষণ্ণ দেখেছো?! দেখোনি; (হয়তো ব্যতিক্রম এক-দুটি ঘটনা থাকতে পারে। কিন্তু সাধারণ অবস্থা এটিই, এদের কেউ কাঁদে না।) কেন? কারণ বিবাহের মাধ্যমে ছেলে কিছু হারায় না, ছেলের মা-বাবা কিছু হারায় না, বরং অর্জন করে। তাই তাদের মুখে থাকে অর্জনের হাসি এবং প্রাপ্তির তৃপ্তি।

বিবাহের আসরে কাঁদে শুধু মেয়ে, আর মেয়ের মা-বাবা। কেন কাঁদে একটি মেয়ে? কারণ তাকে সবকিছু হারাতে হয়, সবকিছু ত্যাগ করতে হয়। মা-বাবাকে ছেড়ে আসতে হয়, শৈশবের সব স্মৃতি তাকে মুছে ফেলতে হয়। একটি ছোট্ট মেয়ের জীবনে এটি অনেক বড় আঘাত। এ যেন একটি ছোট্ট গাছের চারাকে শিকড়শুদ্ধ উপড়ে ফেলে বহু দূরে ভিন্ন পরিবেশে নতুন মাটিতে এনে রোপণ করা। বাকি জীবন তাকে এই মাটি থেকেই রস আহরণ করে বেঁচে থাকতে হবে।

হিন্দিতে বলে, ‘আওর‌্যত কী ডোলী যাহা উত্যরতী হ্যয়, উসকী আর্থী ওহীঁ সে উঠতি হ্যয়।’ অর্থাৎ মেয়েদের পালকি যেখানে গিয়ে নামে, সেখান থেকেই তার জানাযা ওঠে।

কত বড় নির্মম সত্য! তো তোমার স্ত্রীরূপে তোমার ঘরে আসা এই ছোট্ট মেয়েটির যখমি দিলে তাসাল্লির মরহম তোমাকেই রাখতে হবে। এক মাটি থেকে উপড়ে এনে আরেক মাটিতে রোপণ করা একটি চারাগাছ থেকে দু’দিন পরেই ফল দাবী করা কতটা নিষ্ঠুরতা! ফল পেতে হলে তোমাকে ধৈর্য ধরতে হবে। চারা গাছটির পরিচর্যা করতে হবে, সকাল-সন্ধ্যা তার গোড়ায় পানি দিতে হবে। ধীরে ধীরে শিকড় যখন মাটিতে বসবে এবং মাটি থেকে রস সংগ্রহ করার উপযুক্ত হবে, তখন তোমাকে ফল চাইতে হবে না; সজীব বৃক্ষ নিজে থেকেই ফল দিতে শুরু করবে।

কত আফসোসের বিষয়, দাম্পত্য জীবনের শুরুতে যত আদেশ-উপদেশ সব ঐ ছোট্ট মেয়েটিকে উদ্দেশ্য করে বর্ষিত হয়। প্রথম দিনেই তাকে শুনতে হয়, এখন থেকে তাকে স্বামীর মন জয় করতে হবে, শ্বশুর-শাশুড়ি সন্তুষ্টি অর্জন করতে হবে, শ্বশুর বাড়ীর সবার মন যুগিয়ে চলতে হবে। তার নিজের যেন কোন ‘মন’ নেই। সুতরাং সেটা জয় করারও কারো গরজ নেই।

তো মায়ের মন তোমাকেই রক্ষা করতে হবে, আবার স্ত্রীর মনোরঞ্জনও তোমাকেই করতে হবে। সবদিক তোমাকেই শামাল দিয়ে চলতে হবে। কত কঠিন দায়িত্ব! অথচ না শিক্ষাঙ্গনে, না গৃহপ্রাঙ্গণে, কোথাও এ সম্পর্কে শিক্ষার নূন্যতম কোন ব্যবস্থা নেই। সম্পূর্ণ অপ্রস্ত্তত অবস্থায় দু’টি অপরিপক্ব তরুণ-তরুণীকে যেন সংসার সমুদ্রে ভাসিয়ে দেয়া! মেয়েটিও জানে না, আজ থেকে সে আর ছোট্ট মেয়েটি নেই। সে এখন স্ত্রী হয়ে একটি অপরিচিত মানুষের জীবনে প্রবেশ করছে, যার মা আছে, বাবা আছে, ভাইবোন আছে এবং তাদের প্রতি তার স্বামীর অনেক দায়-দায়িত্ব আছে। সহানুভূতির সঙ্গে কোমলতার সঙ্গে এই দায়িত্ববোধ কেউ তার মধ্যে জাগ্রত করে দেয়নি। এ দোষ কার!

তো আমার প্রিয় ছাত্রটিকে বলেছিলাম, কথা দ্বারা আচরণ দ্বারা তোমার মাকে তুমি বোঝাবে, মা, আমি আপনারই ছিলাম, আছি এবং থাকবো। স্ত্রী হলো আমার জীবনের নতুন প্রয়োজন; আপনি আমার প্রাণ, আপনার সঙ্গে আমার নাড়ির টান।

অন্যদিকে স্ত্রীকে বোঝাতে হবে, এই সংসার-সমুদ্রে তুমি একা নও; আমি তোমার পাশে আছি। নতুন জীবনে চলার পথে আমারও অনেক কষ্ট হবে, তোমারও অনেক কষ্ট হবে। তবে সান্ত্বনা এই যে, তুমিও একা নও, আমিও একা নই। আমার পাশে তুমি আছো, তোমার পাশে আমি আছি। আমার কষ্টের সান্ত্বনা তুমি, তোমার কষ্টের সান্ত্বনা আমি। আমরা পরস্পরের কষ্ট হয়ত দূর করতে পারবো না, তবে অনুভব করতে পারবো এবং হয়ত কিছুটা লাঘব করতে পারবো।

আল্লাহর কসম, এমন কোন নারী-হৃদয় নেই যা এমন কোমল সান্ত্বনায় বিগলিত হবে না।

তোমার স্ত্রীকে তুমি এভাবে বলবে, আমাদের জীবন তো আলাদা ছিলো। আমরা তো একে অপরকে চিনতামও না। আল্লাহ আমাদের কেন একত্র করেছেন জানো?! একা একা জান্নাতে যাওয়া কঠিন। আল্লাহ আমাদের একত্র করেছেন একসঙ্গে জান্নাতের পথে চলার জন্য। আমি যদি পিছিয়ে পড়ি, তুমি আমাকে টেনে নিয়ে যাবে; তুমি যদি পিছিয়ে পড়ো, আমি তোমাকে টেনে নিয়ে যাবো। তুমি সতর্ক থাকবে, আমার দ্বারা যেন কারো হক নষ্ট না হয়; আমিও সতর্ক থাকবো, তোমার দ্বারা যেন কারো প্রতি যুলুম না হয়।

প্রিয় ছাত্রটিকে আমি আরো বললাম, স্ত্রীকে বোঝানোর জন্য তার সন্তানকে সামনে আনতে হবে। অর্থাৎ তুমি তাকে বলবে, দেখো, জীবন কত গতিশীল! সবকিছু কত দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছে! দু’দিন আগে আমরা শুধু যুবক-যুবতী ছিলাম, আজ হয়ে গেছি স্বামী-স্ত্রী। দু’দিন পরেই হয়ে যাবো মা-বাবা। আমি বাবা, তুমি মা! আল্লাহর কাছে একজন মায়ের মর্যাদা কত! তোমার কদমের নীচে হবে তোমার সন্তানের জান্নাত! যেমন আমার মায়ের কদমের নীচে আমার জান্নাত। তো তোমার সন্তান কেমন হলে তুমি খুশী হবে? আমাকেও আমার মায়ের ঐ রকম সন্তান হতে তুমি সাহায্য করো। আমি যদি ভুল করি, মায়ের কোন হক নষ্ট করি, মায়ের সামনে ‘উফ’ করি, তুমি আমাকে সাবধান করো, আমাকে সংশোধন করো। তাহলে ইনশাআল্লাহ তোমার সন্তানও তুমি যেমন চাও তেমন হবে।

প্রয়োজন হলে স্ত্রীকে মা-বাবার সামনে তিরস্কার করবে, তবে ঘরে এসে একটু আদর, একটু সোহাগ করে বোঝাতে হবে, কেন তুমি এটা করেছো?! বোঝানোর এই তরযগুলো শিখতে হবে। আর এটা দু’একদিনের বিষয় নয়, সারা জীবনের বিষয়। কিন্তু আমরা ক’জন এভাবে ভারসাম্যপূর্ণ জীবন যাপন করি?! হয় মাতৃভক্তিতে স্ত্রীর প্রতি অবিচার করি, না হয়, স্ত্রীর ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে মা-বাবার দিলে আঘাত দেই, আর দুনিয়া-আখেরাত বরবাদ হয়। আমার একটা কথা মনে রেখো, মায়ের পক্ষ নিয়ে স্ত্রীর প্রতি অবিচার করা মূলত মায়ের প্রতি যুলুম, তদ্রূপ স্ত্রীর পক্ষ নিয়ে মায়ের হক নষ্ট করা আসলে স্ত্রীর প্রতি যুলুম। আমার এ কথার উৎস হলো-

أنصر أخاك ظالما أو مظلوما

অবশ্য সবকিছু হতে হবে হিকমত ও প্রজ্ঞার সঙ্গে।

একটি ঘটনা তোমাকে বলি, তোমার মত আলিমে দ্বীন নয়, সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত একজন মানুষ আমাকে বলেছেন, একবার তার মা তাকে বললেন, তোর বউ আজ তোর এত আপন হয়ে গেলো কীভাবে!

আমি বললাম, দেখো মা, তোমাকে আমি মা বলি; এই ‘মা’ ডাকটুকু পাওয়ার জন্য তোমাকে কত কষ্ট করতে হয়েছে! অথচ ‘পরের বাড়ীর মেয়েটি’র মুখ থেকে তুমি বিনা কষ্টে ‘মা’ ডাক শুনতে পাও! তোমাকে যে মা বলে ডাকে সে আমার আপন হবে না কেন মা?

আরেকটা ঘটনা, এক মা তার মেয়ের শাশুড়ী সম্পর্কে বললেন, মানুষ না, মেয়েটাকে আনতে পাঠালাম, দু’টো পিঠে বানিয়ে খাওয়াবো, দিলো না, ফেরত পাঠিয়ে দিলো!

দু’দিন আগে তিনিও একই কাজ করেছিলেন, ছেলের বউকে নিতে এসেছিলো মায়ের বাড়ী থেকে। তিনি বললেন, দু’দিন পরে আমার মেয়েরা আসবে এখন তুমি গেলে কীভাবে চলবে!

ভদ্রমহিলাকে বললাম, আপনার কাজটা কি ঠিক হয়েছিলো? আপনাকে কষ্ট দেয়া আমার উদ্দেশ্য নয়, সতর্ক করা উদ্দেশ্য। আল্লাহর কাছে যদি আটকা পড়েন তখন তো আপনিই বলবেন, তুমি তো হাদীছ-কোরআন পড়েছো, আমাকে সতর্ক করোনি কেন?

মোটকথা, মেয়েদেরকে তারবিয়াত করতে হবে যাতে তারা আদর্শ স্ত্রী, আদর্শ মা এবং আদর্শ শাশুড়ীরূপে আদর্শ জীবন যাপন করতে পারে। পুরুষ হচ্ছে কাওয়াম ও পরিচালক। সুতরাং তারবিয়াত ও পরিচালনা করা পুরুষেরই দায়িত্ব। স্ত্রী, মা ও শাশুড়ী, জীবনের এই তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ও কঠিন ধাপের জন্য ঘরে ঘরে আমরা যদি আমাদের মেয়েদের গড়ে তুলতে পারি, আদেশ দ্বারা, উপদেশ, সর্বোপরি নিজেদের আচরণ দ্বারা তাহলেই সংসার হতে পারে সুখের, শান্তির।

প্রিয় ছাত্রটিকে আরেকটি কথা বললাম, তোমার স্ত্রীর কোন আচরণ তোমার অপছন্দ হতে পারে। সেক্ষেত্রে প্রথমে তোমাকে ভাবতে হবে, তোমার সব আচরণ কি সুন্দর, তোমার স্ত্রীর পছন্দের? তাছাড়া তোমার স্ত্রীর ভালো দিক কি কিছু নেই। সেই ভালো দিকগুলোর জন্য শোকর করো, আর যা তোমার কাছে মন্দ লাগে তার উপর ছবর করো। আর যদি সংশোধন করতে চাও তাহলে ভালো দিকগুলোর প্রশংসা করো, তারপর কোমল ভাষায় বলো, তোমার এই বিষয়টা যদি না থাকতো তাহলে তুমি আরো অনেক ভালো হতে। তবে আল্লাহর পেয়ারা হাবীব ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সেই প্রজ্ঞাপূর্ণ উপদেশ মনে রাখতে হবে, একটু বাঁকা থাকবেই, এই বক্রতা, সাহিত্যের ভাষায় যাকে বলে নায, আন্দায, মান, অভিমান, লাস্যতা, এই বক্রতা নারীর সৌন্দর্য, নারীর শক্তি। এটাকে সেভাবেই গ্রহণ করে তার সঙ্গে জীবন যাপন করতে হবে। পূর্ণ সোজা করতে চাইলে ভেঙ্গে যাবে, আর সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে যাবে।

সত্যি সত্যি যদি তোমার স্ত্রীর গুরুতর কোন ত্রুটি থাকে তবে সেটা সংশোধনের দায়িত্ব ও কর্তব্য অবশ্যই তোমার। তবে সেক্ষেত্রেও সংশোধনের জন্য অত্যন্ত ধৈর্যের সঙ্গে দিনের পর দিন চেষ্টা করে যেতে হবে। ধমক দিয়ে, জোর খাটিয়ে সংশোধন করা যায় না, ঘরে অশান্তি আনা যায়, ঘর ভাঙ্গা যায়, আর সন্তানদের জীবনে বিপর্যয় আনা যায়।

ইসলামপুরে আমার আব্বার দোকানের অপর দিকে এক ভদ্রলোকের দোকান ছিলো। অবস্থা ছিলো এই যে, দোকানে বসেই মদ খেতো। আব্বা তাকে দাওয়াত দিলেন, আর সে খুব দুর্ব্যবহার করলো। কিন্তু আব্বা ধৈর্যের সঙ্গে দাওয়াত চালিয়ে গেলেন। দু’বছর পর তিনি মসজিদমুখী হলেন এবং এমন মুবাল্লিগ হলেন যে, বউকে তালাক দেবেন। কারণ সে দ্বীনের উপর আসছে না।

আব্বা তাকে এভাবে বুঝালেন, ‘আমার সঙ্গে আপনার আচরণ কি মনে আছে? আমি যদি ধৈর্যহারা হয়ে আপনাকে ত্যাগ করতাম! এই পুরো কথাটা যেহেনে রেখে স্ত্রীকে তালিম করতে থাকেন। ছবর করেন, ছবর করলে আমার প্রতি আপনার যুলুম আল্লাহ মাফ করবেন। আল্লাহ যদি প্রশ্ন করেন আমার বান্দা তোমাকে আমার ঘরের দিকে ডেকেছে, তুমি তার প্রতি যুলুম করেছো কেন? তখন আপনি বলতে পারবেন, হে আল্লাহ, আমিও আপনার বান্দীর পিছনে ছবরের সঙ্গে মেহনত করেছি।’

সেই লোকের স্ত্রী কিন্তু পরবর্তী সময়ে পরদানশীন হয়েছিলো। অথচ জোশের তোড়ে লোকটা তো ঘরই ভেঙ্গে ফেলছিলো।

আসলে দোষ আমাদের। আমরা তারবিয়াত করার তরীকা শিখিনি। বোঝানোর তরয আয়ত্ত্ব করিনি।

প্রিয় ছাত্রটিকে আরো অনেক কথা বলেছিলাম, প্রায় দু’ঘণ্টা সময় তার জন্য ব্যয় করেছিলাম। সবকথা এখন মনেও নেই।

তবে একটা কথা তাকে বলা হয়নি, এখন তোমাদের মজলিসে বলি, স্ত্রীর সঙ্গে আচরণ কেমন হবে, এ সম্পর্কে একজনকে যা বলতে শুনেছিলাম, তা ছিল খুবই মর্মান্তিক। তিনি বলেছিলেন, ‘মেয়েলোক যেন তোমার মাথায় চড়ে না বসে, তাই প্রথম দিন থেকেই তাকে শাসনের মধ্যে রাখবা। পূর্ণ ইতাআত ও আনুগত্য আদায় করে নিবা।

‘গোরবা কুশতান দর শবে আওয়াল।’ -এ প্রবাদ এমনই বিশ্ববিশ্রুত যে, আমাদের নিরীহ বাংলাভাষায়ও বলে, ‘বাসর রাতেই বেড়াল মারতে হবে’। কিন্তু জীবনের সর্বক্ষেত্রের মত এক্ষেত্রেও আমাদের অনুসরণীয় হলো সুন্নাতে রাসুল। আর তিনি ইরশাদ করেছেন,

خيركم خيركم لأهله وأنا خيركم لأهلي

তো জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত শরীয়তের সীমারেখায় থেকে স্ত্রীর সঙ্গে এমন আচরণই আমাকে করতে হবে, যাতে সে মনে করে, আমি সর্বোত্তম স্বামী, আমার মতো উত্তম স্বামী হয় না, হতে পারে না।

স্ত্রীগণের সঙ্গে নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আচরণ কী ছিলো তা জানতে হবে এবং অনুসরণ করতে হবে। স্বামীর খেদমত করার মাধ্যমে স্ত্রী অনেক আজর ও ছাওয়াবের অধিকারিণী হতে পারে, এটা আলাদা কথা। তবে আমাকে মনে রাখতে হবে যে, এটা স্ত্রীর মহত্ত্ব, স্বামীর অধিকার নয়। তারা যদি কখনো মায়ের বাড়ী যেতে চায়, আমরা প্রশ্ন করি, ‘আমার খাওয়া-দাওয়ার কী হবে?’ অথচ এটা তার বিবেচনার বিষয় হতে পারে, আমার প্রশ্ন করার বিষয় নয়।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সামান্য কথা বলেই মজলিস শেষ করছি। সহবাস দাম্পত্য জীবনের একটি অপরিহার্য সত্য। এ বিষয়ে আলোচনাকে হায়া-শরমের খেলাফ মনে করা হয়। ফলে বিষয়টি অজ্ঞতার মধ্যে থেকে যায়। এ কারণে এমনকি অনেক সময় দাম্পত্য জীবন বিষাক্ত হয়ে পড়ে।

স্ত্রী তোমার সারা জীবনের সম্পদ এবং সেরা সম্পদ।

متاع মানে সম্পত্তি নয়, ভোগের বস্তু নয়, متاع মানে সম্পদ, ঐশ্বর্য। বিষয়টি বুঝতে না পেরে আধুনিক বুদ্ধিজীবীরা হাদীছের সমালোচনা করেন। আমরা হাদীছটির তরজমা ও ব্যাখ্যা এমন খন্ডিতভাবে করি যে, তারাও সুযোগ পেয়ে যায়।

তো স্ত্রী তোমার সম্পত্তি নয়, স্ত্রী হলো তোমার জীবনের সর্বোত্তম সম্পদ, যা যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে তোমাকে রাখতে হবে এবং ব্যবহার করতে হবে।

প্রথমেই বর্বর ও পাশবিকরূপে নিজেকে স্ত্রীর সামনে তুলে ধরা বিরাট মুর্খতা ছাড়া আর কিছু নয়। স্ত্রী স্বামীর ভোগের পাত্রী নয়, বরং স্বামী-স্ত্রী হলো পরস্পরকে উপভোগ করার জন্য। যত দিন লাগে, দীর্ঘ সাধনা করে প্রথমে হৃদয় জয় করো, মনের দুয়ার খোলো, অন্তরের গভীরে প্রবেশ করো।

যিন্দেগীর এই কঠিন মারহালা সম্পর্কে কত কিছু যে বলার আছে, কত কিছু যে শেখার আছে! দেখি, যদি আবার কখনো সুযোগ হয়।

[দাম্পত্যজীবন সুখময় হওয়ার জন্য শুধু পুরুষের প্রচেষ্টা ও সচেতনতাই যথেষ্ট নয়, নারীরও সদিচ্ছা ও সচেতনতা অতি প্রয়োজন। এ বিষয়ে তারও আছে অনেক দায়িত্ব। কিন্তু নারীর তালীম-তরবিয়তের ভারও তো পুরুষেরই উপর। বিয়ের আগে পিতামাতা তার তরবিয়ত করবেন, বিয়ের পর স্বামী। দাম্পত্যজীবনে নারীর দায়িত্ব কী কী, সেই সকল দায়িত্ব সম্পর্কে তাকে সচেতন করার পদ্ধতি কী এবং তার তালীম-তরবিয়ত কীভাবে করতে হবে-এটি আলাদা একটি বিষয়।


দাম্পত্যজীবন : অজ্ঞতা ও পরিণাম-মাওলানা আবু তাহের মিসবাহ
(১৪৩৩ হি. শাবান মাসে এক খাছ মজলিসে এক বিশেষ উপলক্ষে আদীব হুজুরের একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা। মুসাজ্জিলা থেকে কপি করে মাসিক আলকাউসারে প্রকাশিত।)

রেওয়াজি উপহার : সামাজিকতার এক নিষ্ঠুর চেহারা

রেওয়াজি উপহার : সামাজিকতার এক নিষ্ঠুর চেহারা-মাওলানা শিব্বীর আহমদ।

বিয়ে-শাদি আকীকা কিংবা এ জাতীয় কোনো অনুষ্ঠানে কেউ যখন আমন্ত্রিত হয় তখন সেখানে কোনো উপহারসহ উপস্থিত হওয়া যেন আমাদের একপ্রকার সামাজিক বাধ্যবাধকতা। এ বাধ্যবাধকতা দুই দিক থেকেই। যিনি আমন্ত্রিত, তিনি ভাবেন-একটি মানসম্মত উপহার ছাড়া সেখানে যাওয়া যাবে না। আবার যারা আমন্ত্রক, তারা অতিথিদের বরণ করার তুলনায় উপহার গ্রহণের প্রতিই অধিক মনোযোগী হয়ে থাকেন। উপহার গ্রহণের জন্য থাকে ভিন্ন ব্যবস্থাপনা। এবং সেটাও অনেকটা এমনভাবে, যেন চক্ষুলজ্জার কারণে হলেও কেউ উপহার প্রদান না করে অনুষ্ঠানস্থলে প্রবেশ করতে না পারেন। এটাও এখন সামাজিকতা।

এ উপহার এখন নতুন রূপ গ্রহণ করেছে। কিছুকাল আগেও রেওয়াজ ছিল, উপহার দেওয়ার জন্য পছন্দসই কোনো কিছু কিনে ‘গিফট পেপার’ দিয়ে মুড়িয়ে তা নিয়ে যাওয়া হত। সে রেওয়াজ কিছুটা এখনো আছে। তবে এখনকার রেওয়াজ অনেকাংশেই নগদ টাকা।

কেউ চাইলে এটাকে কোনো রেস্টুরেন্টের বিল পরিশোধের সঙ্গেও মিলিয়ে ভাবতে পারেন। তবে পার্থক্য হল, রেস্টুরেন্টে বিল দিতে হয় খাবার পর, আর অনুষ্ঠানে দিতে হয় খাবারের আগে।

। ২।

আসলে এ সামাজিকতায় মৌলিকভাবে দুটি ভালো দিকও রয়েছে এবং দুটোই ইসলামসমর্থিত। কেবল সমর্থিত বললেও অবশ্য যথেষ্ট নয়, এ দুটি বিষয় ইসলামে কাঙ্ক্ষিতও ।

এক. উপহার প্রদান,
দুই. অন্যের আনন্দে শরিক হওয়া।

পারস্পরিক উপহার আদান-প্রদানের বিষয়টি কতটা গুরুত্বপূর্ণ-লক্ষ করুন; রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

যে সত্তার হাতে আমার প্রাণ তাঁর কসম, তোমরা কিছুতেই জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না যতক্ষণ তোমরা ঈমান না আনবে, আর যতক্ষণ তোমরা একে অন্যকে ভালো না বাসবে ততক্ষণ তোমরা (পূর্ণ) ঈমানদারও হতে পারবে না। আমি তোমাদেরকে এমন একটি কাজের কথা বলে দিই, যা করলে তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক ভালোবাসা সৃষ্টি হবে? তোমরা তোমাদের মধ্যে সালামের প্রচলন ঘটাও। -জামে তিরমিযী, হাদীস ২৬৮৮

আরেকটি হাদীস বর্ণনা করেছেন ইমাম বুখারী রাহ. তার ‘আলআদাবুল মুফরাদ’ নামক গ্রন্থে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

تَهَادَوْا تَحَابّوا.

তোমরা একে অন্যকে উপহার দাও, ভালোবাসা সৃষ্টি হবে। -আলআদাবুল মুফরাদ, হাদীস ৫৯৪

উল্লেখিত দুটি হাদীস থেকে আমরা জানতে পারি-

১. জান্নাতে যেতে হলে ঈমান আবশ্যক। ঈমান ছাড়া কেউ জান্নাতে যেতে পারবে না।

২. ঈমান যদিও আল্লাহ তাআলার ওপর এবং নবী-রাসূল, ফেরেশতা, আসমানী কিতাব, পরকাল ও তাকদীরের ওপর বিশ্বাসের নাম, কিন্তু পরিপূর্ণ ঈমানদার হতে হলে এবং ঈমানের পূর্ণ সুফল পেতে চাইলে এ বিশ্বাসের পাশাপাশি ঈমানদারদের পারস্পরিক সম্প্রীতি ও ভালোবাসাও জরুরি।

৩. পারস্পরিক এ ভালোবাসা সৃষ্টির জন্য দুই হাদীসে দুটি পথ বলে দেয়া হয়েছে- এক. অধিক হারে সালামের প্রচলন ঘটানো, দুই. পারস্পরিক উপহার আদান-প্রদান।

নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেছেন-

تَهَادَوْا فَإِنّ الهَدِيّةَ تُذْهِبُ وَحَرَ الصّدْرِ.

তোমরা একে অন্যকে হাদিয়া-উপহার দাও। এ উপহার অন্তরের শত্রুতা ও বিদ্বেষ দূর করে দেয়। -জামে তিরমিযী, হাদীস ২১৩০

উপহারের আদান-প্রদানে সামাজিক বন্ধন যে কতটা বৃদ্ধি পায় তা তো আর নতুন করে বলার কিছু নেই। এটা আমাদের দেখা বাস্তবতা। পারস্পরিক এ নেয়া-দেয়াটা যখন স্বতঃস্ফূর্তভাবে হয় তখন দূর-বহুদূরের কারও সঙ্গেও গড়ে ওঠে আত্মার সম্পর্ক। এ সম্পর্ক অনেক সময় ছাড়িয়ে যায় রক্ত ও আত্মীয়তার বাঁধনকেও। এসবই মানুষের স্বাভাবিকতা।

আবার কাছের বা দূরের কোনো আত্মীয় কিংবা কোনো প্রতিবেশী বা বন্ধুর যখন কোনো খুশির উপলক্ষ আসে তখন তার সে আনন্দ ভাগ করে নেওয়াটাও আত্মীয়তা, প্রতিবেশ কিংবা বন্ধুত্বের দাবি। সকলের তরে সকলে আমরা/ প্রত্যেকে মোরা পরের তরে-এটা তো ইসলামের শিক্ষাই। তাই কারও বিপদে যেমন পাশে দাঁড়াতে হয়, পাশে থাকতে হয় কারও সুখের সময়ও। এটাই সামাজিকতা। এ নিয়েই আমাদের সমাজ। পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে আল্লাহ তাআলা আমাদের আদেশ করেছেন আত্মীয়-স্বজন পাড়া-প্রতিবেশী প্রমুখের সঙ্গে সুন্দর আচরণ করতে। পড়–ন-

وَ اعْبُدُوا اللهَ وَ لَا تُشْرِكُوْا بِهٖ شَیْـًٔا وَّ بِالْوَالِدَیْنِ اِحْسَانًا، وَّ بِذِی الْقُرْبٰی وَ الْیَتٰمٰی وَ الْمَسٰكِیْنِ وَ الْجَارِ ذِی الْقُرْبٰی وَ الْجَارِ الْجُنُبِ وَ الصَّاحِبِ بِالْجَنْۢبِ وَ ابْنِ السَّبِیْلِ،     وَ مَا مَلَكَتْ اَیْمَانُكُمْ ،     اِنَّ اللهَ لَا یُحِبُّ مَنْ كَانَ مُخْتَالًا فَخُوْرَا.

তোমরা আল্লাহর ইবাদত করবে এবং কোনো কিছুকে তাঁর সঙ্গে শরিক করবে না। আর সদাচরণ কর বাবা-মায়ের সঙ্গে এবং আত্মীয়-স্বজন, এতীম-মিসকীন, নিকট প্রতিবেশী ও দূর প্রতিবেশী, সঙ্গীসাথী, মুসাফির এবং তোমাদের মালিকানাধীন দাস-দাসীদের সঙ্গেও। নিশ্চয়ই আল্লাহ কোনো দাম্ভিক অহংকারীকে পছন্দ করেন না। -সূরা নিসা (৪) : ৩৬

এই আয়াতে আমাদেরকে যেমন লা-শারিক আল্লাহর ইবাদত করতে আদেশ করা হচ্ছে, একই গুরুত্বের সঙ্গে বাবা-মায়ের সঙ্গে সদাচারের আদেশও করা হচ্ছে। আর বাবা-মায়ের পাশাপাশি উল্লেখিত হয়েছে আত্মীয়-স্বজন এতীম-মিসকীন, প্রতিবেশীসহ আরও কতজন। আদেশ করা হচ্ছে তাদের সঙ্গে সুন্দর আচরণের। সুন্দর আচরণ বলতে আমরা সাধারণত বুঝে থাকি-তাদের বিপদে সহযোগিতা করতে হবে, তাদের সঙ্গে কোনো মন্দ আচরণ করা যাবে না ইত্যাদি। সন্দেহ নেই, এগুলোও সুন্দর আচরণ। কিন্তু কেবল এগুলোই নয়, সুন্দর আচরণের সীমা আরও বিস্তৃত। সুন্দর আচরণ করতে হবে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই। কেউ যখন কোনো আনন্দ অনুষ্ঠান করে, তখনো সে চায়- তার কাছের সবাইকে নিয়ে সে আনন্দ উদ্যাপন করবে। আবার তার ঘনিষ্ঠ যারা তারাও আশা করে, তাদেরকে সঙ্গে নিয়েই সে অনুষ্ঠান করবে। একে অন্যের কাছে এটা সামাজিকতার দাবি, ঘনিষ্ঠতার দাবি। শরীয়তের নীতি ও বিধান অনুসারে উভয়েরই এ দাবি রক্ষা করা উচিত। কাছের কেউ যখন কোনো আমন্ত্রণে সাড়া না দেয় কিংবা কোনো অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ না জানায়, তখন আমরা অনুভব করি এর গুরুত্ব।

তাই বিয়ে-শাদিসহ এরকম কোনো অনুষ্ঠানে যদি কাউকে আমন্ত্রণ জানানো হয় এবং আমন্ত্রিত ব্যক্তির স্বাস্থ্যগত, পরিবেশগত কিংবা শরীয়তের দৃষ্টিতে কোনো সংকট না থাকে, তখন ওই আমন্ত্রণ সে রক্ষা করবে- এটাই ইসলামের শিক্ষা। এ শিক্ষা কতটা গুরুত্বপূর্ণ তাও দেখুন। প্রিয় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রিয় সাহাবী হযরত আবু হুরায়রা রা. বলেছেন-

شَرّ الطّعَامِ طَعَامُ الْوَلِيمَةِ يُدْعَى لَهَا الأَغْنِيَاءُ وَيُتْرَكُ الْفُقَرَاءُ، وَمَنْ تَرَكَ الدّعْوَةَ فَقَدْ عَصَى اللهَ وَرَسُولَهُ صلى الله عليه وسلم.

যে ওলিমায় কেবল ধনীদেরকেই আমন্ত্রণ জানানো হয় আর গরীবদেরকে বর্জন করা হয়, সে ওলিমার খাবার নিকৃষ্ট খাবার। আর যে আমন্ত্রণ রক্ষা করে না, সে তো আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লামের অবাধ্য হল। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৫১৭৭

এই হাদীস থেকে আমরা দুটি বার্তা পাই। এক. কেউ যখন বিয়ে-পরবর্তী ওলিমার আয়োজন করবে, তখন সেখানে বেছে বেছে কেবল ধনীদেরকেই আমন্ত্রণ করবে না, বরং ধনী আত্মীয়, ধনী প্রতিবেশী আর ধনী বন্ধুবান্ধবের পাশাপাশি তুলনামূলক অসচ্ছল গরীব আত্মীয়, প্রতিবেশী ও বন্ধুদেরও দাওয়াত করবে। আর যদি কাউকে কেবল এজন্যেই আমন্ত্রণ জানানো না হয় যে, সে গরীব, তাহলে সে ওলিমার খাবার হবে নিকৃষ্ট খাবার!

দুই. কাউকে যখন এমন কোনো অনুষ্ঠানে দাওয়াত করা হয়, সে যেন তাতে শরিক হয়। তাতে অংশগ্রহণ না করা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে অবাধ্যাচরণ করারই নামান্তর। আরেক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

حَقّ الْمُسْلِمِ عَلَى الْمُسْلِمِ خَمْسٌ رَدّ السّلاَمِ وَعِيَادَةُ الْمَرِيضِ وَاتِّبَاعُ الْجَنَائِزِ وَإِجَابَةُ الدّعْوَةِ وَتَشْمِيتُ الْعَاطِسِ.

এক মুসলমানের ওপর আরেক মুসলমানের পাঁচটি অধিকার- ১. সালামের জবাব দেওয়া, ২. অসুস্থ হলে দেখতে যাওয়া, ৩. জানাযায় শরিক হওয়া, ৪. দাওয়াত করলে তা রক্ষা করা, ৫. হাঁচির জবাবে দুআ পড়া। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১২৪০

তাই আমন্ত্রণ রক্ষা করা কেবল সামাজিকতার দাবিই নয়, এ দাবি বরং মুমিনের কাছে ঈমানের দাবি।

অনেকে আবার অসচ্ছলদের দাওয়াতকে পরোয়া করেন না। অথচ নৈতিকতার দাবি হল, সামাজিকভাবে পিছিয়ে থাকা কারও দাওয়াতেই অধিক গুরুত্বের সঙ্গে সাড়া দেওয়া উচিত। প্রিয় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রিয় জীবনাদর্শ আমাদেরকে এ শিক্ষা-ই দেয়। তাঁকে যখন কেউ আমন্ত্রণ করত, তিনি সে আমন্ত্রণ রক্ষা করতেন। আমন্ত্রণকারী ধনী না গরীব, সচ্ছল না অসচ্ছল, সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত না কোনো সাধারণ ব্যক্তি- এসব বিষয় তিনি মোটেও লক্ষ করতেন না। তিনি স্পষ্ট বলেছেন-

لَوْ دُعِيتُ إِلَى كُرَاعٍ لأَجَبْتُ.

আমাকে যদি (বকরির পায়ের) মাংসবিহীন চিকন হাড় খেতেও দাওয়াত করা হয় তবুও আমি সে দাওয়াত রক্ষা করব। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৫১৭৮

হাঁ, যদি আমন্ত্রণ রক্ষা করায় কোনো সংকট থাকে, যেমন, আমন্ত্রণকারী আয়-উপার্জনে হালাল-হারামের বিবেচনা না করে, আমন্ত্রণ রক্ষা করতে গেলে উল্টো আরও কিছু গোনাহে জড়িয়ে পড়ার আশংকা দেখা দেয় কিংবা অসুস্থতা বা অন্য কোনো বাস্তব সমস্যা, তাহলে সেখানে অংশগ্রহণ না করার সুযোগ রয়েছে, এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে সে দাওয়াতে না যাওয়াটাই অধিক কাক্সিক্ষতও হতে পারে।

। ৩।

এ তো হাদিয়া-উপহার আর অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ রক্ষা করার ক্ষেত্রে মৌলিক কথা। কিন্তু আমরা সামাজিকভাবে এ বিষয়টি যেভাবে নিজেদের ওপর চাপিয়ে নিয়েছি, এখন তা নিয়ে অবশ্যই ভাবনার অবকাশ আছে। স্বাভাবিক সময়ে কেউ যদি কারও অতিথি হয় তাহলে সাধারণত গৃহকর্তাদের জন্যে কিছু একটা নিয়েই যায়। এক্ষেত্রে অবশ্য কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। যার যা ইচ্ছা তা-ই নেয়। দামি-কমদামি নানান কিসিমের জিনিসই মানুষ নিয়ে যায় অতিথি হিসেবে। এটাও হাদিয়া, আবার অতিথির আপ্যায়নও তো একপ্রকার হাদিয়া।

কিন্তু সংকট হল বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতা নিয়ে। বিয়ে-শাদির অনুষ্ঠান, আকীকার অনুষ্ঠান- এ জাতীয় আরও যত অনুষ্ঠান, সেখানে যদি কাউকে আমন্ত্রণ জানানো হয়, তবে সে আমন্ত্রণ কেউ কেউ যেমন খুশিমনে গ্রহণ করে এবং তা সাগ্রহে রক্ষাও করে, আবার এই আমন্ত্রণ অনেকের জন্যেই বিপদেরও কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যাদের অভাবের বা টানাটানির সংসার, কিংবা যাদেরকে চলতে হয় অত্যন্ত মিতব্যয়িতার সঙ্গে এবং একটি নির্দিষ্ট আয় দিয়ে, তারা আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব আর প্রতিবেশীর এরকম আনন্দ অনুষ্ঠানের সংবাদে ও আমন্ত্রণে যেমন আনন্দিত হয়, পরক্ষণেই আবার দুশ্চিন্তায়ও ছেয়ে যায় তাদের চেহারা। কারণ সেখানে একটা মানসম্মত ‘গিফট’ দিতেই হবে। সামর্থ্য যতটুকু আছে তাতে মান রক্ষা হয় না। আর মান রক্ষা করতে গেলে নিজের ক্ষমতায় কুলায় না। আপনজন কারও বিয়েতে বা অন্য কোনো আয়োজনে শরিক না হওয়ার কোনো ইচ্ছাও নেই, আবার সামাজিকতা রক্ষা করে সেখানে শরিক হওয়ার মতো সচ্ছলতাও নেই। এ এক উভয়সংকট।

আর বিয়ের দাওয়াতের অর্থই হল- আপনাকে উপস্থিত হতেই হবে এবং মানসম্মত উপহারও নিয়ে যেতে হবে। এ উপহার গ্রহণ করার জন্য করা হয় নজরকাড়া আয়োজন। তা আবার ‘দলিলস্বরূপ’ লিখেও রাখা হয়। এরপর চলে হিসাব- কে কত দিল এবং কত খরচ হল আর কত টাকা উঠে এল। ব্যতিক্রম যে নেই তা নয়, তবে আমাদের সমাজের স্বাভাবিক বাস্তবতাটা এমনই।

একটা সময় যখন বিভিন্ন উপহারসামগ্রী কিনে দেওয়ার রেওয়াজ ছিল, তখন এ রেওয়াজের মধ্যেও একটু আন্তরিকতার ছোঁয়া ছিল। কিছু উপহার ঘরে স্মৃতি হিসেবে রেখে দেওয়া হত, কিছু আবার ভাই-বোন কিংবা এজাতীয় কাছের আত্মীয়দের মধ্যে বণ্টন করা হত। ওসব এখন আর নেই বললেই চলে। এখনকার বাস্তবতা হল- দাওয়াত দিলাম, আসবেন, খাবেন এবং টাকা দিয়ে চলে যাবেন। আরও মজার বিষয় হল, এ উপহার যেন ‘মানসম্মত’ হয় সেজন্য অনুষ্ঠানের তারিখটাও ‘সুবিধামতো’ নির্ধারণ করা হয়।

এর প্রতিক্রিয়া বিপরীত দিক থেকেও হয়। আমন্ত্রণ জানানো হল একজনকে, কিন্তু টাকা যা দিতে হবে তা তো একজন খেয়ে ‘পোষাতে পারবে’ না। তাই আমন্ত্রকের অনুমতি এবং মৌন সম্মতি ছাড়াই সে নিয়ে যায় তার ছেলে, ভাই কিংবা বন্ধুকে। যেন পুষিয়ে আসার একটু চেষ্টা! এতে যে আমন্ত্রণকারীর অতিথি-আপ্যায়নে ব্যাঘাত ঘটবে না- এ নিশ্চয়তা দেবে কে? একটি অন্যায় সামাজিকতা এভাবেই আরেকটি অন্যায়কে টেনে নিয়ে আসে।

কারও বাড়িতে বেড়াতে যাবার সময় যেমন কখনো ফল নিয়ে কখনো মিষ্টি নিয়ে কিংবা অন্য আরও কিছু নিয়ে যাই আমরা, এসব অনুষ্ঠানে উপহারের বিষয়টিকেও যদি এরকম উন্মুক্ত রাখা হত এবং সামাজিক বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্ত রাখা হত, তাহলে এখনকার মতো সংকটের সৃষ্টি হত না। কেউ যদি সামাজিক কিংবা পারিপার্শ্বিক চাপে পড়ে কাউকে হাদিয়া দেয় আর তা আন্দাজও করা যায়, তবে তা গ্রহণ করা কতটুকু বৈধ হবে- তাও ভাবনার বিষয়। হাঁ, কেউ যদি আন্তরিকভাবেই কাউকে উপহার দিতে চায়, কারও আনন্দে সেও একটু শরিক হতে চায়, তাহলে এ সুযোগ তো থাকবেই। তবে এজন্য আনুষ্ঠানিকতার বাধ্যবাধকতা কেন?

এভাবে কতরকমের রেওয়াজ যে আমাদের সমাজে ছড়িয়ে আছে! অবশ্য এর অধিকাংশই বিয়েশাদি কেন্দ্রিক। একবার বিয়েতে টাকা, এরপর ছেলেপক্ষের হলে নতুন বউকে আর মেয়েপক্ষের হলে নতুন জামাইকে সালামি। পরবর্তীতে ধাপে ধাপে এক পক্ষের আত্মীয়-স্বজনকে দাওয়াত করা এবং উপহার দেওয়ার বাধ্যবাধকতা এবং এর প্রত্যুত্তরে ওপক্ষ থেকেও একই মানের দাওয়াত ও উপহার। সামাজিকতার এ ছোবল সত্যিই ভয়ংকর।

আমরা যদি এ থেকে পরিত্রাণের পথ খুঁজতে চাই, তাহলে প্রথমেই এগিয়ে আসতে হবে আমন্ত্রকদের। তারা যদি অনুষ্ঠানে কেবল অতিথিকেই বরণ করে আর উপহার গ্রহণের আনুষ্ঠানিক কোনো ব্যবস্থা না রাখে, তবে অনেকাংশেই দুর্বল হয়ে পড়বে এ অন্যায় সামাজিকতা। আর যারা অতিথি, তারাও যদি একটু হিম্মত করতে পারেন, তাহলে তো দাফনই হয়ে যেতে পারে এ অন্যায়ের।

কিছু কিছু মানুষকে উদ্যোগী হতে দেখাও যায়। হয়ত এ উপলব্ধি থেকেই তারা ওলিমার দাওয়াতপত্রে লিখে দেন- ‘দয়া করে সাথে কোনো গিফট আনবেন না’। এ উদ্যোগ প্রশংসার দাবি রাখে। এর দ্বারা আমন্ত্রিত অতিথিদের অনেকেরই হয়ত টনক নড়বে। আরও মানুষ উদ্যোগী হবে।

যাইহোক, সামাজিক চাপ নয়; হাদিয়া আদান-প্রদান হওয়া উচিত আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে। ইসলামের হাদিয়ার যে ধারণা ও শিক্ষা সে অনুসারে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

যে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য (কাউকে কিছু) দেয়, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই দেওয়া থেকে বিরত থাকে; আল্লাহর জন্যই যে ভালোবাসে আর আল্লাহর জন্যেই যে ঘৃণা করে, … সে তার ঈমান পূর্ণ করল। -জামে তিরমিযী, হাদীস ২৫২১

তাই প্রচলিত সামাজিক রীতি-রেওয়াজের অন্ধ অনুসরণ নয়,পূর্ণ ঈমানের অধিকারী হতে চাইলে প্রাধান্য দিতে হবে আল্লাহর সন্তুষ্টিকেই। সমাজ কী বলল- সেটা দেখার বিষয় নয়। এটাই মুমিনের বৈশিষ্ট্য, মুমিনের পরিচয়। সামাজিকতার চাপে নয়, কাউকে যদি কিছু সে উপহার দেয়, তাহলে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই দেবে, যদি কাউকে না দেয়, তাহলে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই দেওয়া থেকে বিরত থাকবে। ঈমানের পূর্ণতার জন্য আমাদেরকে এখানে উঠে আসতেই হবে।


রেওয়াজি উপহার : সামাজিকতার এক নিষ্ঠুর চেহারা
মাওলানা শিব্বীর আহমদ।