8.8 C
New York
Saturday, October 25, 2025

Buy now

spot_img
Home Blog Page 9

আঁধার থেকে আলোর পথে : নাজমা আক্তার

মডার্ণ পরিবারের আধুনিকা মেয়ে মমতা। সে আমার শৈশবের বন্ধু ও বিদ্যালয়ের সহপার্ঠী। একসাথে যাই, একসাথে ফিরি। তাই আমার সাথে তার বন্ধুতা ও সখ্যতা বেশ পুরনো। আমি শৈশব থেকেই সম্পূর্ণ ধর্মীয় অনুশাসনের উপর প্রতিপালিত। সে কারণে স্বাভাবিকভাবেই পর্দা করাকে আমি নিজের জন্য আবশ্যক করে নিয়েছিলাম। কিন্তু মমতা এ সবের ধারধারতো না। তার কথা-বার্তা, চলা-ফেরা সবকিছুতেই থাকতো আধুনিকতার ছোঁয়া। তাই এ নিয়ে প্রায় সময় চলতো তার সাথে আমার ছোট খাটো বিতর্ক। আমার বোরকা দেখে সে বলতো, ‘এ কী পরেছো তুমি? এ যুগেকি এসব চলে? দেখতে একটা আস্ত ভূতের মতো লাগে?’ ইত্যাদি।

তার তিরস্কারগুলো আমি নীরবে হজম করতাম। আর খুব দরদের সাথে বুঝিয়ে বলতাম, ‘মমতা, নামায পড়া ও রোযা রাখা যেমন আল্লাহর হুকুম, পর্দা করাও তাঁরই হুকুম। তাঁর এ হুকুম মানতেই হবে। অন্যথায় আল্লাহর সন্তুষ্টি পাওয়া যাবে না। এভাবে আমি অনেকবার তাকে বুঝিয়েছি। কিন্তু সে বুঝল না। বুঝতে চাইল না। সে নিজের মতোই চলতে থাকলো। সময় গড়াতে থাকলো আপন গতিতে। এক সময় ৮ম শ্রেণীর বোর্ড পরীক্ষাটাও হয়ে গেলো। এতে মমতার ঈর্ষণীয় ফলাফল দেখে সবার মনে আনন্দের হিল্লোল বয়ে যায়। পিতা তাকে নিয়ে অনেক বড় স্বপ্ন দেখলেন। তাই মমতাকে এখন আর গ্রামে নয়, ভর্তি করলেন নেত্রকোনা শহরের গার্লস স্কুলে। পিতার এ সিদ্ধান্তে অনেকে খুশি হলেও আমি হলাম অত্যন্ত মর্মাহত এবং উদ্বিগ্ন। কারণ গ্রামের তুলনায় শহরের নৈতিক অবস্থা যে আরো শোচনীয়।

শুরু হলো মমতার শহুরে জীবন। এখন সে ছাত্রীমেসে থাকে। সকালে স্কুলে যায়। বিকেলে ফিরে আসে। মুক্ত বিহঙ্গের মতো সে এখন পূর্ণ স্বাধীন। আমি একজন মেয়ে হয়ে তার জন্য কীই-বা করতে পারি? শুধু দু’হাত তুলে তার জন্য মহান আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করেছি, ‘হে আল্লাহ! মমতাকে তুমি সঠিক পথে নিয়ে এসো। তুমি তাকে….।’

মমতা চলে যাওয়াতে আমি অনেকটা একাকী হয়ে পড়েছি। বেশ কয়েক মাস চলে গেছে তার সাথে আমার কোন সাক্ষাৎ নেই। এক শীতের সকালে কেন যেন আমি খুব ভোরে মাদরাসায় চলে এলাম।
কাশরুমে বসে বসে বই পড়ছি। হঠাৎ করে সামনের দিকে তাকিয়ে দেখি, হাতে পায়ে কালো মুজা, কালো বোরকায় আপাদমস্তক ঢাকা এক মেয়ে ধীরে ধীরে আমার দিকেই আসছে। হাটার ঢং একটু একটু চেনাচেনা লাগে। কে হতে পারে এই মেয়েটি?
আসসালামু আলাইকুম।
ওয়ালাইকুমুস সালাম ওয়ারাহমাতুল্লাহ। কে তুমি? মমতা নাকি?
হাঁ, নাজমা আমি সেই মমতা।
কী ব্যাপার, এমন সময় তুমি এখানে? এভাবে?
আল্লাহ তায়ালা আমার প্রতি দয়া করেছেন। তাই বিপদগামীদের পথ থেকে তিনি আমাকে ফিরিয়ে এনেছেন।
আমিতো জানি তোমার পিতা তোমাকে স্কুলে ভর্তি করিয়েছেন।

হাঁ, তা ঠিক। এবং আমিও ভেবেছিলাম এখন থেকে আমি আরো স্বাধীনভাবে চলতে পারবো। কিন্তু বেপরোয়াভাবে চলাফেরা করা কয়েকটি মেয়ের ঘটনা শুনে এবং বাস্তব কিছু চিত্র দেখে আমার বুঝ এসেছে যে, মহান আল্লাহর বিধান মানার মাঝেই রয়েছে শান্তি। সে কারণেই আমি অশালীনতা পরিহার করেছি। এবং কারো কারো রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে শান্তির পথে এসেছি। পর্দাকে অলংকার হিসেবে গ্রহণ করেছি। আমি এখন এ মাদরাসার ছাত্রী। তার কথা শুনে আমি আর চোখের পানি ধরে রাখতে পারি নি।

সত্যি তুমি ভ্রষ্টতা থেকে ফিরে এসেছো? সত্য ও সুন্দরের পথ বেছে নিয়েছো? আল্লাহ তোমার প্রতি রহম করুন। হে আল্লাহ! আপনার হাজার শোকর। বিপথগামীদের পথ থেকে আপনি তাকে রক্ষা করেছেন। হে আল্লাহ! পৃথিবীর সকল মমতাকে আপনি এভাবে রক্ষা করুন। পরিচালিতকরুন আপনার পথে।


লেখিকা : শিক্ষার্থী আসহাবে সুফ্ফা নূরানী হাফিজিয়া মহিলা মাদরাসা ও এতীমখানা, কয়রা. কলমাকান্দা, নেত্রকোনা

শতাব্দীর সবচে বড় ফিতনাঃ মডারেট ইসলাম

র‍্যান্ড পরিচিতিঃ

RAND Corporation। অ্যামেরিকান গ্লোবাল পলিসি থিংক ট্যাংক হিসেবে সারা পৃথিবীতে অত্যন্ত পরিচিত এক নাম। RAND Corporation শব্দের বিস্তারিত রূপ হলো Research and Development Corporation। র‍্যান্ড কর্পোরেশন হলো অ্যামেরিকার একটি এনজিও প্রতিষ্ঠান। এর কাজ হলো আমেরিকার অর্থনৈতিক, সামাজিক, সমরনৈতিক, রাজনৈতিক এবং কূটনৈতিক নীতিনির্ধারণী বা থিংক ট্যাংক হিসেবে গবেষণা করা। এই প্রতিষ্ঠানের গবেষণার ভিত্তিতেই চূড়ান্ত আলোচনা-পর্যালোচনার পর যেকোনো ধরনের মার্কিন নীতি বা সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৬ সালে অ্যামেরিকাকে সারাবিশ্বে একক পরাশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে জেনারেল হেনরি হাপ আর্নল্ডের নেতৃত্বে সর্বপ্রথম RAND Corporation -এর যাত্রা সূচিত হয়। এরপর ক্রমে ক্রমে তার গ্রহণযোগ্যতা ও সুখ্যাতি বৃদ্ধি পেতে থাকে।

যাত্রার শুরুর দিকেই RAND Corporation সফলভাবে মহাশূন্যে রকেট উৎক্ষেপণের মাধ্যমে সারাবিশ্বে ব্যাপক সাড়া ফেলে দেয়। এরপর ১৯৫৭ সালে মার্কিন বিমানবাহিনী RAND Corporation-এর প্রযুক্তি হায়ার করে মহাশূন্যে স্পাই স্যাটেলাইট তৈরি করতে সক্ষম হয়। এর নাম দেওয়া হয়েছিল Corona। মাত্র দুবছরের মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়নের মোকাবেলায় এই Corona অ্যামেরিকার সবচে মোক্ষম অস্ত্রে পরিণত হয়। এরই ভিত্তিতে Pravda নামক সোভিয়েত পত্রিকা RAND Corporation -এর নাম দেয় the academy of science and death and destruction। এভাবেই ১৯৬০ সালের মধ্যে RAND Corporation বেসরকারি প্রতিষ্ঠান হয়েও অ্যামেরিকাসহ সারাবিশ্বে পরিচিত হয়ে ওঠে।

এরপর সময় গড়াতে থাকে। RAND Corporation -এর পরিধিও বিস্তৃত হতে থাকে। তখন আর তারা শুধু যুদ্ধের জন্য প্রযুক্তি-অনুসন্ধানের মধ্যে ক্ষান্ত না থেকে কীভাবে শত্রুপক্ষকে বিভক্ত করা যায়, কীভাবে জাতিগত দাঙ্গা-হাঙ্গামা সৃষ্টি করে বিনা যুদ্ধে জয়ী হওয়া যায়—এসবের গবেষণা করতে থাকে। একেক দেশ ও জাতির জন্য তারা একেক ধরনের নীতি অনুসরণ করে; যাতে করে বিনা যুদ্ধে সেই দেশ ও জাতিকে অ্যামেরিকার কর্তৃত্বাধীন করা যায়। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করা মূলত RAND -এর গবেষণার বাস্তবায়ন মাত্র। মুসলিমরাও যাতে কখনো পরাশক্তি হয়ে উঠতে না পারে, সর্বদাই যেন তারা অ্যামেরিকার অধীনস্থ থাকে—সে লক্ষ্যে RAND বিপুল গবেষণা করে বেশ কয়েকটি অনুসন্ধানী রিপোর্টই বের করেছে। (০১) অ্যামেরিকান গভর্নমেন্টের কাছে সেই অনুসন্ধানী রিপোর্ট জমা দেওয়ার পর গভর্নমেন্ট তা বাস্তবায়ন করে চলছে। সেই ৬০-এর দশক থেকেই এভাবে তাদের কার্যক্রম এগিয়ে চলছে।

র‍্যান্ডের দৃষ্টিতে মুসলমানদের প্রকারঃ

RAND নিজেদের অ্যাজেন্ডাকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বাস্তবায়নের সুবিধার্থে সমগ্র বিশ্বের মুসলমানদের চার ভাগে ভাগ করে থাকে। যথাঃ

০১। ফান্ডামেন্টালিস্ট মুসলিমঃ অর্থাৎ মৌলবাদী ও চরমপন্থী মুসলিম। এরা হচ্ছে সে সকল মুসলিম, যারা ইসলামকে শুধু কতক আচার-অনুষ্ঠান এবং ব্যক্তিগত আচার-ইবাদতের ধর্ম মনে করে না; বরং ইসলামকে মনে করে এক পরিপূর্ণ দীন এবং মানবমুক্তির বিকল্পহীন জীবনব্যবস্থা। যারা চায় আল্লাহ তা’আলার নাজিলকৃত বিধান দিয়ে শাসন ও বিচারকার্য পরিচালনা করতে। চায় সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিসরেও ইসলামকে একচ্ছত্রভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে। এককথায়, তারা বিজয়ী ধর্মকে সবক্ষেত্রেই বিজয়ী রাখতে চায়। আল্লাহর ভূমিতে আল্লাহর শাসনকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। এরা হলো অ্যামেরিকার সর্বপ্রধান শত্রু। যেকোনো মূল্যে এদের বিনাশ করা অ্যামেরিকার গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য।

০২। ট্রেডিশনালিস্ট মুসলিমঃ অর্থাৎ ঐতিহ্যবাদী মুসলিম। এরা হচ্ছে সে সকল মুসলিম, যারা ইসলামের ঐতিহ্যকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে রেখেছে। ইলমচর্চা, ধর্মপ্রচার এবং আত্মশুদ্ধিকেন্দ্রিক কাজগুলোকেই যারা ব্রত হিসেবে গ্রহণ করে আছে। মসজিদ, মাদরাসা ও খানকাহ নিয়ে পড়ে থাকাই যাদের নিত্যনৈমিত্তিক কাজ। অ্যামেরিকা এদের ঝুঁকি মনে করে না। এরা অ্যামেরিকান সভ্যতা-সংস্কৃতির জন্য হুমকি কিংবা ক্ষতিকর নয়। হ্যাঁ, তবে এরা যদি কোনোভাবে ফান্ডামেন্টালিস্ট মুসলিমদের সঙ্গে মিলে যেতে পারে, তবে এরা অ্যামেরিকার জন্য বিপদ এবং মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। এ জন্য যেকোনো উপায়ে এদেরকে তাদের নিজ নিজ পরিমণ্ডলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। কোনোভাবে ফান্ডামেন্টালিস্ট মুসলিমদের সঙ্গে মিলতে দেওয়া যাবে না। বরং সাধ্যানুসারে উভয় দলের মধ্যে কোন্দল ও বিভেদ জিইয়ে রাখতে হবে।

০৩। মডারেট মুসলিম বা মডার্নিস্ট মুসলিমঃ অর্থাৎ আধুনিকতাবাদী মুসলিম। এরা আদি ও আসল ইসলামকে সেকেলে মনে করে। তাই ইসলামকে নতুনভাবে ব্যাখ্যা করতে চায়, ইসলামের পরিমার্জিত সংস্করণ বের করতে চায়। এদের এসব ব্যাখ্যার পেছনে মূল উদ্দেশ্য হলো, ইসলামকে প্রবৃত্তির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করা। ইসলামকে পাশ্চাত্য ধারার জীবনব্যবস্থা এবং তার সভ্যতা-সংস্কৃতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ করা; যাতে করে ইসলামের ইতিবাচক দিকগুলোও পালন করা যায়, আবার প্রবৃত্তিপূজার অংশ হিসেবে নেতিবাচক দিকগুলোর মধ্যেও অংশগ্রহণ করা যায়। এদের চেষ্টা-প্রচেষ্টার সুবাদেই বর্তমানে অস্তিত্বলাভ করেছে সবকিছুর ইসলামি (!) ভার্সন। ইসলামি মিউজিক, ইসলামি মদ, ইসলামি সুদ, ইসলামি জুয়া, ইসলামি পতিতালয়, ইসলামি সিনেমাহল, ইসলামি গণতন্ত্র, ইসলামি সমাজতন্ত্র প্রভৃতি।

মডারেট মুসলিমরা আল্লাহ তাআলার দীনকে পরিপূর্ণভাবে মানতে রাজি নয়; বরং তারা দীনের কেবল ততটুকু মানতে চায়, যতটুকু তাদের মনঃপুত হয়, যতটুকু মানতে তাদের কোনো কষ্ট-ক্লেশ সইতে হয় না কিংবা ত্যাগ-তিতিক্ষা করতে হয় না। এবং তা-ও কেবল সে উপায়েই মানতে চায়, যা তাদের সমাজে প্রচলিত কিংবা তাদের পূর্বসুরি বাপ-দাদাদের থেকে প্রাপ্ত। এ ছাড়া আল্লাহ তাআলার অন্যান্য বিধানগুলোকে তারা অবলীলায় প্রত্যাখ্যান করে।

র‍্যান্ডের পলিসি সাজেশন হলো, মডারেট মুসলিমদের সাহায্য করতে হবে, এদের জন্য ফান্ডের ব্যবস্থা করতে হবে। আর বিশেষভাবে প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় এদের প্রচারণার ব্যবস্থা করতে হবে। যেহেতু সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে এদের উল্লেখযোগ্য অবস্থান ও সবিশেষ গ্রহণযোগ্যতা নেই, তাই মিডিয়ার মাধ্যমে এদেরকে মানুষের কাছাকাছি নিয়ে আসতে হবে; যাতে তাদের আহ্বান মানুষের কর্ণকুহরে পৌঁছে যায়। (০২)

০৪। সেক্যুলারিস্ট মুসলিমঃ অর্থাৎ ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী মুসলিম। এরা প্রথম থেকেই অ্যামেরিকার পকেটে রয়েছে। তাই এদের নিয়ে আলাদা চিন্তা বা মাথাব্যথা নেই। এরা কারও জন্য কোনো ঝুঁকির কারণ নয়। সেক্যুলারিস্ট মুসলিমরা মূলত মুসলিমই নয়। কারণ, তারা ইসলামকে কেবল ব্যক্তিজীবনে পালনীয় ধর্ম মনে করে এবং রাষ্ট্রকে ধর্ম থেকে আলাদা মনে করে। এদের দৃষ্টিতে রাষ্ট্রের রাজনীতি, অর্থনীতি, বিচারব্যবস্থা ইত্যাদি থাকবে ধর্মের বলয় থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। এরাই মূলত তারা, যাদের সম্বোধন করে মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তবে কি তোমরা কিতাবের কিছু অংশের প্রতি ইমান রাখো, আর কিছু অংশকে অস্বীকার করো? তোমাদের মধ্যে যে-কেউ এমনটা করবে তার শাস্তি এ ছাড়া আর কিছুই নয় যে, ইহকালে তাদের জন্য থাকবে লাঞ্ছনা আর কিয়ামত দিবসে তাদের ফিরিয়ে দেওয়া হবে ভয়াবহ শাস্তির দিকে। তোমরা যা কিছু করো, আল্লাহ সে সম্পর্কে উদাসীন নন।’ (সুরা বাকারাহ)

আর প্রকাশ থাকে যে, ইসলাম গ্রহণ করার জন্য দীনের প্রতিটি বিষয়ের প্রতি ইমান আনয়ন করতে হয়। কোনো একটি বিষয়ের প্রতি অস্বীকৃতি বা সংশয় থাকলে ব্যক্তি কখনো মুমিন হতে পারে না। অনুরূপভাবে একবার ইসলাম গ্রহণ করার পর পুনরায় ইসলামহারা হওয়ার জন্য দীনের প্রতিটি বিষয়কে অস্বীকার করতে হয় না, বরং যেমনিভাবে ওজু সম্পন্ন করার জন্য নিদেনপক্ষে চারটি অঙ্গ ধৌত করা লাগলেও ওজু ভঙ্গ হওয়ার জন্য ওজু ভঙ্গের কারণগুলোর মধ্য থেকে যেকোনো একটি কারণ পাওয়া যাওয়াই যথেষ্ট, একইভাবে ইসলাম নষ্ট হওয়ার জন্য দীনের অন্তর্ভুক্ত স্বীকৃত বিষয়সমূহের মধ্য থেকে যেকোনো একটি বিষয়ের প্রতি অস্বীকৃতি বা সংশয় পাওয়া যাওয়াই ইসলামহারা হওয়ার জন্য যথেষ্ট।

প্রেক্ষিতঃ মডারেট ইসলাম প্রচার।

২০০৩ সালে অ্যামেরিকান গ্লোবাল পলিসি থিংক ট্যাঙ্ক RAND Corporation একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে। ঠিক কীভাবে ও কাদের সহায়তায় অ্যামেরিকার বৈশ্বিক পলিসির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এক নতুন ইসলাম প্রবর্তন করা যায়, Civil Democratic Islam: Partners, Resources & Strategies নামের এই রিপোর্টে তা আলোচিত হয়। অ্যামেরিকাবান্ধব এই নতুন ইসলামেরই নাম দেওয়া হয় ‘মডারেট ইসলাম’ বা Civil Democratic Islam। এরপর ২০০৭ সালে Building Moderate Muslim Networks নামে একটি বিস্তারিত ফলোআপ রিপোর্ট প্রকাশ করে RAND।

রিপোর্টগুলোতে মূলত ৩টি বিষয় আলোচিত হয়ঃ
ক) কেন অ্যামেরিকাবান্ধব এই নতুন ইসলামের প্রবর্তন ও প্রচার করা উচিত?
খ) একজন মডারেট মুসলিমের বৈশিষ্ট্য কী হবে?
গ) কীভাবে মুসলমানদের মধ্যে এই মডারেট ইসলামের প্রচার ও প্রচলন ঘটানো যায়?

RAND এর এই রিপোর্টে বেশ কিছু সম্ভাব্য পলিসি নিয়ে আলোচনা করা হয়। তার মধ্যে একটি হলো, ইসলামের ব্যাপারে পুরনো ধ্যান-ধারণাকে ভেঙ্গে দিয়ে সম্পূর্ণ নতুনভাবে ‘পশ্চিমা ইসলাম’, ‘অ্যামেরিকান ইসলাম’ ইত্যাদি ধারণাকে প্রমোট করা। তার ওপর একটি গুরুত্বপূর্ণ পলিসি সাজেশান ছিল, মডার্নিস্ট ও মডারেট দায়ি ও আলিমদের চিহ্নিত করা, তাদেরকে বিশ্বব্যাপী প্রমোট করা এবং তাদেরকে দিয়ে নতুন নতুন বই ও কারিকুলাম তৈরি করা। এ ছাড়াও কীভাবে আপাত রক্ষণশীলদের (Conservatives) এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজে ব্যবহার করা যায়, তা নিয়েও রিপোর্টগুলোতে আলোচনা করা হয়।

পরবর্তীতে ২০১৩ সালে Promoting Online Voices for Countering Violent Extremism নামে তৃতীয় একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে RAND। এই রিপোর্টে মডারেট ইসলামের প্রচারের জন্য এবং প্রকৃত ইসলামি শিক্ষাকে (যেটাকে RAND কট্টরপন্থা বলে) মোকাবেলার জন্য সোশ্যাল মিডিয়ার গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করা হয়। কট্টরপন্থার বিপরীতে ‘সহিষ্ণুতা ও ক্ষমা’-এর শিক্ষা দেওয়া অনেক ‘মডারেট শায়খ’ এবং মুসলিম কমিউনিটি লিডার ও সংগঠনের নাম নির্দিষ্টভাবে এই রিপোর্টে আলোচিত হয়। RAND-এর পলিসি বাস্তবায়নে এ ধরনের ব্যক্তি ও সংগঠনের সোশ্যাল মিডিয়া উপস্থিতিকে কীভাবে কাজে লাগানো যায়, তা নিয়েও আলোচনা করা হয় এই রিপোর্টে।

মডারেট ইসলামের লক্ষ্য।

২০০৭ সালে RAND Corporation তাদের Civil Democratic Islam নামে যে রিপোর্টটি প্রকাশ করে, তাতে তারা লিখেছেঃ

‘গোটা মুসলিম বিশ্বে আজ তাদের তাদের নিজেদের মধ্যে একটি লড়াই চলছে। যে লড়াই মূলত বিশ্বাস ও মতাদর্শের লড়াই। এই লড়াইয়ের ফলাফলই নির্ধারণ করবে, মুসলিম বিশ্বের ভাগ্য কী হবে।’

মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় পেন্টাগনের চতুর্মাসিক এক রিপোর্টে বলা হয়েছেঃ

‘যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে এমনই এক যুদ্ধে লিপ্ত, যা একই সঙ্গে সামরিক ও আদর্শিক। এ যুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয় কেবল তখনই অর্জিত হওয়া সম্ভব, যখন চরমপন্থীদেরকে (মুজাহিদদেরকে) তাদের স্বজাতি, পরোক্ষ সমর্থক এবং নিজেদের দেশের জনগণের চোখে খারাপ ও কলঙ্কিত করে তোলা যাবে।’

ইউ এস নিউজ অ্যান্ড ওয়ার্ল্ড রিপোর্টে রয়েছেঃ

‘৯/১১-এর আক্রমণের পর বারবার ভুল পদক্ষেপ নিলেও ওয়াশিংটন এখন ঠিকই লক্ষ্যভেদী পাল্টা আক্রমণ হেনে যাচ্ছে। স্নায়ুযুদ্ধ পরবর্তী সময়ের চেয়েও আরও ব্যাপক রাজনৈতিক যুদ্ধের প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র সরকার। সামরিক মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ এবং সি.আই.এ-এর গোপন অভিযান পরিচালনাকারী দলগুলো মিডিয়া এবং বিভিন্ন দেশের বুদ্ধিজীবীদের প্রকাশ্যে অর্থনৈতিক সাহায্য দেওয়া আরম্ভ করেছে। ওয়াশিংটন মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার ব্যয় করে যাচ্ছে এমন এক প্রচারণায়, যার উদ্দেশ্য কেবল মুসলিম সমাজকেই প্রভাবিত করা নয়; বরং স্বয়ং ইসলামকেই বিকৃত করে ফেলা।

‘ওয়াশিংটন গোপনে কমপক্ষে দুই ডজন দেশে অর্থ-সাহায্য দিয়ে আসছে। মডারেট ইসলামকে জনপ্রিয় করার উদ্দেশ্যে রেডিও-টেলিভিশনে ইসলামি অনুষ্ঠান (!) প্রচার করা, মুসলিম স্কুলে বিভিন্ন কোর্স চালু করা, রাজনৈতিক কর্মশালা করা, মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের ক্রয় করা, মসজিদ নির্মাণ, কুরআন ছাপা, ইসলামি স্কুল প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি কর্মকাণ্ডের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় সরকার অর্থ-সাহায্য দিয়ে আসছে।’

মডারেট মুসলিমের বৈশিষ্ট্যঃ

 

 

  1. একজন মডারেট মুসলিমকে গণতন্ত্রমনা হতে হবে। গণতন্ত্রমনা বলতে সেই গণতন্ত্রের প্রতি আস্থাশীল হতে হবে, উদারনৈতিক পশ্চিমা ঐতিহ্যে গণতন্ত্র হিসেবে যা পরিচিত। গণতন্ত্রের সমর্থককে ইসলামি রাষ্ট্র-ধারণার বিরোধী হতে হবে। কোনো দল নিজেদের গণতান্ত্রিক দল দাবি করার অধিকার রাখবে না, যদি গণতন্ত্রকে তারা নিছক ক্ষমতায় আরোহণ ও সরকার গঠনের মাধ্যম মনে করে। যেমন : মিশরের ইখওয়ানুল মুসলিমিন (মুসলিম ব্রাদারহুড)।
  2. একজন মডারেট মুসলিমের দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হলো, অসাম্প্রদায়িক (ধর্মনিরপেক্ষ) আইন গ্রহণ করে নেওয়া। চরমপন্থী (প্রকৃত) মুসলিম এবং মডারেট মুসলিমের মধ্যে আসল পার্থক্য হলো শরিয়াহ আইনের বাস্তবায়ন চাওয়া এবং না চাওয়া।
  3. নারী ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকারের (!) প্রতি সম্মান প্রদর্শন। সুতরাং হিজাব বাধ্যতামূলক করা নারী অধিকারে হস্তক্ষেপ করার নামান্তর। অমুসলিমদের ওপর জিযয়া কর আরোপ করা মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
  4. সন্ত্রাসবাদ ও অবৈধ সহিংসতাবিরোধী হতে হবে।

এ বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য তারা একটি প্রশ্নপত্র তৈরি করেছে। যার উত্তরের ভিত্তিতে তারা নির্ণয় করবে, কে মডারেট মুসলিম আর কে প্রকৃত মুসলিম। প্রশ্নগুলো নিম্নরূপ :

  • এই ব্যক্তি বা দল কি সহিংসতা (জিহাদ)-কে সমর্থন করে বা সেটাকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখে? এখন সমর্থন না করলেও কি অতীতে কখনো সমর্থন করেছে বা ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখেছে?
  • তারা কি গণতন্ত্রকে সমর্থন করে? করলে কি পশ্চিমা উদার গণতান্ত্রিক মানদণ্ডে নির্ধারিত ব্যক্তি অধিকারকে সমর্থন করে?
  • তারা কি (কুফফার গোষ্ঠী রচিত) আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মানদণ্ডকে সমর্থন করে?
  • এসব ক্ষেত্রে তারা কি কোনো ব্যতিক্রম করতে চায়? যেমনঃ ধর্মীয় স্বাধীনতার ক্ষেত্রে?
  • তারা কি বিশ্বাস করে যে, ধর্ম পরিবর্তন করা ব্যক্তিগত অধিকার?
  • তারা কি বিশ্বাস করে যে, শরিয়াহ কর্তৃক নির্ধারিত ফৌজদারি দণ্ডবিধি বাস্তবায়ন করা উচিত?
  • তারা কি মনে করে যে, তাদের রাষ্ট্রে শরিয়াহ বহির্ভূত পছন্দ মাফিক অন্য কোনো আইনে বিচার প্রার্থনার সুযোগ থাকা উচিত?
  • তারা কি বিশ্বাস করে যে, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকারও (!) একজন মুসলিম নাগরিকের সমান? তারা কি বিশ্বাস করে যে, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকেরাও মুসলিম দেশে মুসলিম নাগরিকদের মতো সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ পেতে পারে?
  • তারা কি বিশ্বাস করে যে, ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকেরা মুসলমানদের শাসিত দেশগুলোতে তাদের ধর্মের প্রচার-প্রসারের জন্য কোনো প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করতে পারে?
  • এই ইসলামি রাষ্ট্র কি অসাম্প্রদায়িক মূল্যবোধের ওপর প্রতিষ্ঠিত কোনো আইনি ব্যবস্থাকে গ্রহণ করে?

সিভিল ডেমোক্রেটিক ইসলামের প্রস্তাবনা।

  1. মডারেট মুসলিমদের লেখা বই-পুস্তক, প্রবন্ধ-নিবন্ধ ইত্যাদি ভর্তুকি দিয়ে প্রকাশ করা।
  2. সাধারণ জনগণ, বিশেষ করে যুবক শ্রেণির জন্য বইপত্র রচনা করতে মডারেট মুসলিমদের উদ্বুদ্ধ করা।
  3. মডারেট মুসলিমদের মতাদর্শকে ইসলামি শিক্ষার সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত করা।
  4. সংশ্লিষ্ট দেশের শিক্ষা-সিলেবাস ও প্রচারমাধ্যমে তাদের ইসলামপূর্ব জাহিলি সভ্যতা-সংস্কৃতির প্রচার-প্রসারের মাধ্যমে এর চর্চাকে উৎসাহিত করা।
  5. মুসলিম জনগণের মধ্যে সুফিবাদকে জনপ্রিয় ও গ্রহণযোগ্য করে তোলা।
  6. বেআইনি অবৈধ দলসমূহ ও তাদের কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে নিজেদের অবস্থান প্রকাশ করা।
  7. তাদের সহিংস (জিহাদি) কর্মকাণ্ডগুলোর পরিণাম জনসমক্ষে তুলে ধরা।
  8. মৌলবাদী, চরমপন্থী ও সন্ত্রাসীদের (মুজাহিদদের) প্রতি কোনো রকম সম্মান প্রদর্শন করা কিংবা তাদের কোনো প্রশংসা করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
  9. তাদেরকে জনগণের সামনে মানসিক বিকারগ্রস্ত এবং কাপুরুষ হিসেবে উপস্থাপন করতে হবে; প্রতিপক্ষের বীরযোদ্ধা হিসেবে উপস্থাপন করা যাবে না।
  10. মৌলবাদী ও সন্ত্রাসী (মুজাহিদ) ব্যক্তি ও সংগঠনের দুর্নীতি কপটতা ও অনৈতিক বিষয়াদি সম্পর্কে তদন্ত করে (মিথ্যার প্রলেপ লাগিয়ে) তা জনসমক্ষে প্রকাশ করা।

প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, ইউ এস নিউজ অ্যান্ড ওয়ার্ল্ড রিপোর্ট আরও বলেছে যে,

‘বিভিন্ন দেশে সিআইএ বর্তমানে বেশ কিছু অভিনব কার্যকরী পদক্ষেপ হাতে নিয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো, মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে জঙ্গি (মুজাহিদ) সংগঠনের সদস্য সংগ্রহকারী ও অ্যামেরিকাবিদ্বেষী আলিম-উলামাদের নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া।’

আলিম-উলামা পরিচয়ধারী লোকদের ব্যবহার করে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য তারা আরেক জঘন্য ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নিয়েছে। তারা প্রস্তাব করেছে,

‘তোমরা যদি দেখতে পাও যে, রাস্তার এক প্রান্তে মোল্লা ওমর একটি কাজ করছে, তাহলে রাস্তার অপর প্রান্তে তোমরা মোল্লা ব্রাডলি কে বসিয়ে দাও তার বিরুদ্ধাচারণ করার জন্য।’

অর্থাৎ আলেম সমাজের মধ্যে দলাদলি ও বিভাজন সৃষ্টি করা।

আমাদের করণীয়ঃ

এ পরিস্থিতিতে আমাদের করণীয় কী হতে পারে, এ ব্যাপারে সুন্দর দিকনির্দেশনা দিয়েছেন শহিদ আনওয়ার আওলাকি (রাহিমাহুল্লাহ) তার এক বক্তৃতায়।

অ্যামেরিকা যদি প্রকাশ্যে নির্লজ্জের মতো ঘোষণা দেয় যে, তারা ইসলামকে বিকৃত করতে বদ্ধপরিকর, তাহলে আমাদেরও উচিত, নিজেদের দীন ও আদর্শকে এই কুচক্রীদের ষড়যন্ত্র থেকে রক্ষা করার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করা। যার যা কিছু আছে, তা নিয়েই শয়তানদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া।

ইসলামের যেসব বিষয়কে এরা অপপ্রচারের মাধ্যমে বিতর্কিত করে ফেলেছে, আমাদের উচিত সেসব ব্যাপারে ইসলামের সঠিক বক্তব্যকে আপোষহীনতার সঙ্গে সুস্পষ্টভাবে বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরা। ইসলামি রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা ও তা প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি গোটা বিশ্ববাসীর কাছে ব্যাপকভাবে উপস্থাপন করা।
আল্লাহর জমিনে আল্লাহর শরিয়াহভিত্তিক শাসন তথা খিলাফাহ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে প্রকাশ্যে ও ব্যাপকভাবে কথা বলা। কুফফার গোষ্ঠীর ল্যাবরেটরিতে উদ্ভাবিত সম্পূর্ণ কুফরি মতাদর্শ গণতন্ত্রের ব্যাপারে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি জনগণের সামনে তুলে ধরা এবং ইসলামি শুরাব্যবস্থার সুফল ও কার্যকারিতা ব্যাখ্যা করা। ইসলামি দণ্ডবিধি, হদ-কিসাস, ইসলামি ফৌজদারি আইন, বহুবিবাহ, নারী অধিকার ও মানবাধিকার ইত্যাদি বিষয়ে ইসলামের বক্তব্য এবং আমাদের অবস্থান আপোষহীনভাবে জনসমক্ষে তুলে ধরা।

মুসলিম জনসাধারণ যেন পশ্চিমা কুফফার মিডিয়ার চক্রান্তের শিকার না হয়, তাদের মিথ্যাচার ও প্রোপাগান্ডার দ্বারা প্রতারিত না হয়, সে জন্য এসব ব্যাপারে সততা, স্বচ্ছতা ও আমানতদারির সঙ্গে আপোষহীনভাবে হৃদয়গ্রাহী করে ইসলামের আদর্শ তুলে ধরা এবং তা প্রচার করা।

অ্যামেরিকার যাবতীয় বিষয়ে সতর্ক থাকা উচিত। কারণ, তারা নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য যেকোনো উপায়-উপকরণ ব্যবহার করতে পিছপা হবে না। ইউ এস নিউজ অ্যান্ড ওয়ার্ল্ড রিপোর্ট তাদের নিবন্ধে লিখেছে,

‘মুসলিমদের পথভ্রষ্ট করার জন্য সম্ভাব্য যেকোনো উপায় অবলম্বন করতে হবে। এমনকি মিউজিক, কৌতুক, কবিতা, ইন্টারনেট ইত্যাদি সবকিছুর মাধ্যমে অ্যামেরিকার দৃষ্টিভঙ্গিকে গ্রহণযোগ্যভাবে গোটা আরব তথা মুসলিম বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে হবে।’

অতএব তাদের যেকোনো ব্যাপারে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।

  1. এই কুফফার গোষ্ঠী যেহেতু সত্যিকার মুসলিমদের হেয়-প্রতিপন্ন করতে এবং তারা যে সত্যের পথে লড়াই করছে, সেই শুভ্রোজ্জ্বল পথকে বিতর্কিত করতে বদ্ধপরিকর, এ জন্য আমাদের ওপর আবশ্যক যে, আমরা সত্যপন্থী আলিম-উলামা ও দায়িদের পক্ষাবলম্বন করব এবং তাদের বক্তব্য বেশি বেশি প্রচার করব। তারা যদি আমাদের চিরন্তন আদর্শকে নস্যাৎ করতে চায়, তাহলে আমাদের উচিত হবে নিজেদের আদর্শের প্রচার-প্রসার ও তা প্রতিষ্ঠায় আরও বেশি আত্মনিয়োগ করা।
  2. সত্যের বাণীসমৃদ্ধ যাবতীয় উপায়-উপকরণ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেওয়া উচিত। সত্যের মুখপত্র বই-পুস্তক, প্রবন্ধ-নিবন্ধ, পত্র-পত্রিকা, অডিও-ভিডিও, ওয়েবসাইট তথা যেকোনো উপায়-উপকরণকে নিজেদের অর্থ ব্যয় করে বেশি থেকে বেশি প্রচার করা উচিত।
  3. নিদেনপক্ষে আমাদের কথা ও সম্পদের জিহাদে অংশগ্রহণ করা উচিত। রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, ‘তোমরা সম্পদ, প্রাণ এবং কথার মাধ্যমে জিহাদ করো।’ সঠিকভাবে সত্যের প্রচারও জিহাদের একটি অংশ। …আল্লাহ তাআলা আমাদের বিজয় দান করবেন—এ কথা মনে করে আমাদের হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকার সুযোগ নেই। বরং আমাদের উচিত সকল ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। ‘আত-তায়িফাতুল মানসুরা’ বা ‘আল-ফিরকাতুন নাজিয়া’র অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্য আমাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে আমাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করা প্রয়োজন। কারণ, বিদআতের প্রসারে এখন আর শুধু স্বল্প সামর্থ্যবান ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলগুলোই নিয়োজিত নয়; বরং খোদ অ্যামেরিকা এবং তার দোসররা বিদআতের প্রচার-প্রসারে ব্যাপক অর্থায়ন শুরু করে দিয়েছে। অতএব হক ও বাতিলের এই আদর্শিক যুদ্ধে গোটা বিশ্ববাসীর সামনে সত্যকে তুলে ধরা সত্যপন্থীদের নৈতিক দায়িত্ব।

লেখক – আলী হাসান উসামা
সূত্রঃ
In Their Own Words, Voices of Jihad
Civil Democratic Islam. Partners, Resources, and Strategies.
Maritime Terrorism Risk and Liability
Counterinsurgency in Afghanistan.
Radical Islam in East Africa.
The Muslim World After 9/11

আমার সব কিছু ত্যাগের বিনিময়ে আল্লাহকে খুঁজে পেয়েছি : নওমুসলিম নার্গিস

অস্ট্রেলিয়ার নওমুসলিম মিসেস নার্গিস বালদাচিনের ইসলামে দীক্ষিত হওয়ার ঘটনা সম্পর্কে বলেছেন, “আমি প্রথমে সূরা এখলাস পড়ি। এ সূরার মাত্র কয়েকটি আয়াত পড়ে আমি খ্রিস্টান ধর্মের বিশ্বাস বা চিন্তাগত বহু সমস্যার সমাধান পেয়ে যাই এবং বুঝতে পারি, জীবনের পূর্ণতায় পৌঁছার জন্য ইসলাম ধর্মই একমাত্র অবলম্বন হতে পারে।”

তিনি আরো বলেন, “এতদিন বিভিন্ন বিষয়ে যেসব প্রশ্ন আমার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল তার সব কিছুর উত্তর আমি কোরআন শরীফে পেয়ে যাই। এরপর থেকে আমি নিয়মিত কোরআন পড়া ও এর অর্থ উপলব্ধি করার চেষ্টা শুরু করি।“

নার্গিসের আগের নাম ছিল ইয়াভেত বালদাচিনো। তিনি ছিলেন অস্ট্রেলিয়ার সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন আইন বিশেষজ্ঞ। ক্যাথলিক খ্রিস্টান এই নারী ইসলাম ধর্ম গ্রহণের পর নিজের নাম রাখেন নার্গিস বালদাচিনো।

ইসলাম একটি যুগোপযোগী ধর্ম এবং এ ধর্ম মানব প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। একমাত্র ইসলাম ধর্মই মানব সমাজের উন্নতি ও সৌভাগ্যের পথ দেখায়। এ কারণে আমরা দেখতে পাচ্ছি, যারা জীবনের প্রকৃত অর্থ খোঁজার বা উপলব্ধি করার চেষ্টা করছেন তারাই ইসলাম ধর্মের দিকে ঝুঁকে পড়ছেন এবং এ ধর্মের সুশীতল ছায়াতলে আত্মিক উৎকর্ষ অর্জনের চেষ্টা করছেন। নওমুসলিম মিসেস ইয়াভেত বালদাচিনো হচ্ছেন এদেরই একজন। তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণের কারণ তুলে ধরতে গিয়ে বলেছেন,

“ছোটবেলা থেকেই আমি ধর্মের বিষয়ে উৎসাহী ছিলাম এবং বলতে গেলে তখন থেকেই এ বিষয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করি। আমি লক্ষ্য করলাম, মানব জীবনের বহু সমস্যা, চাহিদা কিংবা প্রশ্নের কোনো সদুত্তর খ্রিস্টান ধর্মে নেই। তাই খ্রিস্টানদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি এড়িয়ে চলতাম।”

মিসেস ইয়াভেত বালদাচিনো আরো বলেন, “নিজের অজান্তেই আমি একক সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব অনুভব করতাম। দু’টি প্রশ্ন সবসময়ই আমাকে তাড়া করত। একটি হচ্ছে আমি এ পৃথিবীতে কিভাবে এসেছি, আমার লক্ষ্য-উদ্দেশ্যইবা কি? আর অপরটি হচ্ছে আমার ভবিষ্যত গন্তব্য কোথায়?”

ইয়াভেত বালদাচিনোর মতে, “খ্রিস্টান ধর্মের একটি বড় সমস্যা বা দুর্বলতা হচ্ছে, এ ধর্মের বক্তব্য বা নিদর্শনগুলোর মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই এবং এতে অসংখ্য পরস্পর বিরোধিতা লক্ষ্য করা যায়।” এ প্রসঙ্গে তিনি খ্রিস্টধর্মে প্রচলিত ‘ত্রিত্ববাদ’ বিশ্বাসের কথা উল্লেখ করেন যা খুবই অস্পষ্ট ও বিভ্রান্তিকর। তার মতে, “ত্রিত্ববাদে এক ঈশ্বরের মধ্যে পিতা, পুত্র ও পবিত্র আত্মার যে মিলনের কথা বলা হয়েছে তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।”

তিনি বলেন, “শৈশবকালে আমি বাবা মায়ের কাছে ধর্ম বিষয়ে নানা প্রশ্ন করতাম এবং তারা আমার প্রশ্নের জবাবও দিতেন। কিন্তু এরপরও সে সব উত্তর আমার অতৃপ্ত আত্মাকে তৃপ্ত করতে পারত না।”

একটি সফরের মধ্য দিয়ে নার্গিস বালদাচিনোর ইসলাম ধর্ম গ্রহণের কাহিনী শুরু হয়। তিনি মিশরে তার মায়ের কাছে কিছুদিন কাটিয়ে ইউরোপে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কিন্তু কিছুদিন মিশরে অবস্থান করার পর তিনি সেখানেই থেকে গেলেন। এ সম্পর্কে নার্গিস বলেন, “কথা ছিল তিনি মিশরে পাঁচ দিন এরপর ইউরোপে ছয় মাস কাটাবেন। কিন্তু ঘটনা ঘটল ঠিক এর উল্টো। অর্থাৎ তিনি মিশরে ছয় মাস থাকলেন এবং এটা তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়।

তিনি বলেন, “একটি বিষয়ে অবাক হলাম আর তা হচ্ছে, মিশরের মুসলমানরা অভাবগ্রস্ত হলেও তাদের মধ্যে এক ধরনের প্রশান্তি ছিল এবং তাদের মধ্যে পারস্পরিক দয়া ও ভ্রাতৃত্ববোধ লক্ষ্য করেছি। নিজ দেশ অস্ট্রেলিয়া এমনকি ইউরোপের অনেক দেশে আমি দেখেছি বহু মানুষ সম্পদশালী হলেও তাদের মধ্যে এক ধরনের শূন্যতা বিরাজ করে। কিন্তু কেনো এ শূন্যতা-তা তখন বুঝতে পারিনি। মিশরের জনগণের মধ্যে অভাব বা বৈষয়িক সমস্যা থাকলেও তাদের উত্তম চাল-চলন ও ব্যবহার আমাকে মুগ্ধ করে এবং মুসলমানদের ব্যাপারে আগ্রহী করে তোলে। এরই সূত্র ধরে আমি মুসলমানদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরআনের সঙ্গে পরিচিত হই।”

কোরআন শরীফ বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর একটি বড় মোজেযা এবং এটি মানব সমাজকে পথ নির্দেশকারী একটি মহাগ্রন্থ। খ্যাতনামা ফরাসি দার্শনিক আর্নেস্ট রেনান পবিত্র কোরআন শরীফকে একটি বিস্ময়কর ও চমৎকার গ্রন্থ হিসেবে অভিহিত করে বলেছেন, “আমার ব্যক্তিগত গ্রন্থাগারে রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাহিত্যসহ বিভিন্ন বিষয়ে অসংখ্য বই সংরক্ষিত আছে। এসব বই একবারের বেশি আমি কখনই পড়িনি। কিন্তু এগুলোর মধ্যে একটি বই ছিল আমার নিত্য সঙ্গী এবং যখনই ক্লান্ত হয়ে পড়তাম তখনই বইটি পড়তাম। বইটি একবার নয় বহুবার পড়েছি।”

অস্ট্রেলিয়ার নও মুসলিম নার্গিস যখন মিশরের নীল নদের তীরে কোরআন পড়তেন তখন তিনি অনুভব করতেন তার সামনে পূর্ণতা ও আধ্যাত্মিকতার বিশাল দরজা উন্মোচিত হচ্ছে। তিনি বলেন, “যখনই কোরআনের সুমধুর ধ্বনি আমার কানে ভেসে আসত তখনই আমি বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে যেতাম। আমি সুযোগ পেলেই নীল নদের তীরে গিয়ে কোরআন পড়তাম। কোনো গ্রন্থের সঙ্গেই এ ঐশী গ্রন্থের তুলনা হয় না এবং সব কিছুই এ গ্রন্থে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে।”

তিনি বলেন, “আমার সব প্রশ্নের উত্তর কোরআন শরীফে পেয়ে গেছি। আমি কোরআন অধ্যয়ন করার সময় অনুভব করতাম কোরআনে উল্লেখিত বক্তব্যগুলো এমন কারো যিনি এ পৃথিবী ও মানুষ সৃষ্টি করেছেন।”

বালদাচিনো মিশরের আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদে কালেমা শাহাদাত পড়ে পবিত্র ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। মুসলমান হওয়ার পরও তিনি ইসলামের শিক্ষার ব্যাপারে অধ্যয়ন ও গবেষণা অব্যাহত রাখেন। তিনি বলেন, “ইসলাম ধর্ম গ্রহণের ছয় বছর পর বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রিয় দৌহিত্র ইমাম হোসেন (আ.) এবং কারবালার বিয়োগান্তক ঘটনা সম্পর্কে জানতে পারি। এর ফলে ইসলামে শিয়া মাজহাব সম্পর্কে আমার গভীর আগ্রহ জন্মে। আমার মতে শিয়া মাজহাবে ভিন্নতা রয়েছে এবং মানুষের মধ্যে আলাদা চিন্তা-চেতনার জন্ম দেয়। শিয়া মাজহাব গ্রহণ করার পর আমি আধ্যাত্মিকতার একবারে গভীরে চলে যাই।”

ইসলাম ধর্মে মেয়েদের শালীন পোশাক বা হিজাব ব্যবহার বাধ্যতামূলক। হিজাব নারীদের আত্মসম্মানবোধ ও মানসিক প্রশান্তি দেয়। যে কোনো সমাজে সত্যিকারের উন্নতি ও নিরাপত্তা দেয় হিজাব। নওমুসলিম নারীরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণের পরপরই হিজাবের প্রতিও আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। কিন্তু হিজাব পছন্দ করলেও অনেক ক্ষেত্রেই তারা বিরোধিতা ও নানা প্রতিকূল পরিস্থিতির সম্মুখীন হন।

মিসেস বালদাচিনো এ বিষয়ে তার অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন, “আমি অস্ট্রেলিয়ার এমন এক সমাজে বাস করতাম যেখানকার সাংস্কৃতিক ও সামাজিক প্রভাবে আমি নিজের সৌন্দর্য প্রকাশে আগ্রহী ছিলাম। কারণ অস্ট্রেলিয়ার সমাজে একজন নারীর সৌন্দর্য প্রকাশ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ইসলাম ধর্ম গ্রহনের পর পরিবারের পক্ষ থেকে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া এবং পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে বিতাড়িত হওয়ার আশঙ্কায় প্রথমে হিজাব ব্যবহার থেকে বিরত থাকতাম। কিন্তু হজ্জ্ব করার পর হিজাব আমার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়। আগে আমি ভাবতাম হিজাব পোশাক মাত্র। কিন্তু পরে হিজাবের প্রয়োজনীয়তা ও এর গুরুত্ব  উপলব্ধি করতে পারি।”

বর্তমানে এ নও মুসলিম নিজের নাম রেখেছেন নার্গিস এবং তিনি ইসলামের নির্দেশনা মেনে চলছেন। তার মতে, “আল্লাহকে পাওয়ার জন্য এবং জীবনের লক্ষ্য অর্জনের জন্য যে কোনো ত্যাগ স্বীকারের মূল্য রয়েছে। তিনি বলেন, “আমার যা কিছু ছিল তার সবই ধর্মের জন্য ত্যাগ করেছি। বিনিময়ে আমি জীবনের লক্ষ্য এবং আল্লাহকে খুঁজে পেয়েছি।”-প্যারিস টুডে

অনুপ্রেরণা… ভীষণ অভাব অনটনের মাঝেও একজন জোবায়ের-এর সফল হওয়ার গল্প…

অনুপ্রেরণা…
ভীষণ অভাব অনটনের মাঝেও
একজন জোবায়ের-এর সফল হওয়ার গল্প…

অভাবের দিনগুলো। ২০০০ সন।
আমার মা তখন প্রেগন্যান্ট। মায়ের পেটে আমাদের গোল্ডেন সিস্টার আদুরে ছোট বোন আফসানা।আফসানা এই পর্যন্ত তিনটা গোল্ডেন জিপিএ ৫ পাওয়ায় তার এই নাম। মা খুব অসুস্থ ছিলেন তখন। আমাদের অভাবও তুঙ্গে। বাবা তখন বেকার। ঘরে বাজার নেই, চাল, ডাল, তেল, নুন কিছুই নেই। একটা নীরব হাহাকার এর ভিতর দিয়ে আমরা যাচ্ছি।

আমার এক কাকা তখন থাকতেন কুমিল্লা শহর এর নানুয়া দিঘীর দক্ষিণ পাড়ে শরীফ মঞ্জিলে। তিনি কুয়েতএ থাকতেন। অনেক টাকা উনার তখন। দেশে আসার পর আম্মা আমাকে নিয়ে উনার বাসায় গেলেন। ২০০০ টাকা ধার চাইলেন। মা অনেক কাকুতি মিনতি করলেন। আমরা না খেয়ে আছি। মা এর শরীরটা ভাল না। এইসব বুঝালেন। কাকা মাথা নাড়লেন। আমি ও মা একটা আশা নিয়ে রাত কাটালাম উনার বাসায়।

পরের দিন আসার সময় আমার হাতে উনি ২০ টাকার দুইটা নোট ধরিয়ে দিলেন। উনার বাসা থেকে টমছম ব্রিজ এর রিক্সা ভাড়া ছিল ৫ টাকা। বাসে টমছম ব্রিজ থেকে বলাকা বাসে বরুড়া হয়ে আড্ডা বাজার এর ভাড়া ছিল ১৭ টাকা। দুইজনের ৩৪ টাকা লাগল। উনি আমাদের ১ টাকা বেশি দিয়েছিলেন।

আমার মা বাস জার্নি করতে পারেন না। মোশন সিক্নেস এর জন্য উনি বমি করে অস্থির হয়ে যান। অনেক আশা নিয়ে কাকার বাসায় গিয়েছিলেন মা। আমরা যখন বাড়ি ফিরি, তখন অনেক বৃষ্টি হচ্ছিল। বৃষ্টি ও মা এর কান্না একাকার হয়ে ঝরছিল। সেদিন এর কথা আজো ভুলিনি।

আমি তখন ক্লাশ টেনের ছাত্র।
প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে জ্বর। সাথে বমি, খাবারে অরুচি, মাথা ব্যাথা। লেখাপড়া করতে পারছিলাম না। স্কুলে যেতে পারি না। জ্বর বেশি আসলে মা মাথায় পানির ঝর্ণা দিত। একটু একটু পানি মাথায় কপালে পড়ত, শান্তি লাগত। খেতে পারছিলাম না। হঠাৎ নাবিস্কোর ৫ টাকা দামের গ্লুকোজ বিস্কুট খেতে ইচ্ছে হল খুব। আমার মাকে সেদিন ৫ টাকা কেহ ধার দেয়নি।

আমার সেই কাকা শহর থেকে বাড়ি আসলেন। কাকা সাদা শার্টের সামনের পকেটে ৫০০ টাকার অনেকগুলো নোট রেখেছিলেন। টাকা দেখিয়ে বেড়ানো বড়লোকদের বিরাট ব্যাপার। আমার মরহুম দাদী কাকাকে আমাদের নাজুক অবস্থার কথা বলে আমাকে দেখে যেতে বললেন। কিছু সাহায্য করতে অনুরোধ করেছিলেন।
কাকা সেদিন বলেছিলেন, যে যেমন ইনকাম করবে, তার বাচ্চারা তেমন খাবে। ইনকাম না করতে পারলে না খেয়ে থাকবে। নাবিস্কোর গ্লুকোজ বিস্কুট খেতে না পারার সেই দিনটির কথা আজো ভুলিনি।

ঢাকায় ঘুরতে যাওয়াঃ
ক্লাশ টেনে পড়ার সময় আমার বন্ধু সরোয়ার এর সাথে ঢাকায় ঘুরতে গেলাম। উঠলাম বন্ধুর ভাই এর বাসায়।
রোজার মাস ছিল। বন্ধুকে নিয়ে বড় মুখ করে গেলাম মিরপুরের পাইক পাড়ায় বড়লোক খালার বাসায়।
৫ তলার বাসায়। সেদিন খালা বাসায় ছিলেন না। ইফতার এর সময় আসন্ন ছিল তখন। খালাত ভাই এর বউ ফোনে খালার সাথে কানেক্ট করে দিলেন। খালা
ইফতার করে চলে যেতে বল্লেন। আমি বললাম, খালাম্মা আমাকে ১০০ টাকা দেন। আমার কাছে টাকা নেই।
সেদিন ১০০ টাকা না পেয়ে বন্ধুর কাছে আর মুখটা বড় থাকেনি। অনেক টা মলিন হয়ে গিয়েছিল।

বন্ধুকে নিয়ে গেলাম গাজীপুর এর মামার বাসায়।
সেহেরী খেতে খেতে মামার কাছে ১০০ টাকার আবদার করেছিলাম। মামা মামীর কাছে জিজ্ঞেস করল আমাকে ১০০ টাকা দিবেন কিনা। মামীর উত্তর ছিল ‘উনি কি ব্যাংক নাকি? আমার বাবা কি উনার ব্যাংকে ১০০ টাকা জমা রাখছেন নাকি? যে আমাকে এখন টাকা দিবেন।
সেদিন মামার বাসায় ও ১০০ টাকা পাইনি। ভুলিনি সেই দিনের কথা।

২০০১ সন। এসএসসি পাশের পর।
আমি আমার স্কুলের ফাস্ট বয় ছিলাম। এসএসসিতে জিপিএ পেলাম ৪.২৫। আমরা গ্রেডিং এর ফাস্ট ব্যাচ হওয়াতে স্যারেরাই বোঝত না গ্রেডিং। না হলে পয়েন্ট আরো বেশি হত।

আমার খালা আমার এসএসসি পাশের খবর পেয়ে আমার মাকে বললেন: আমাকে কলেজে না পড়িয়ে অটোমোবাইল এর ওয়ার্কশপ এ ভর্তি করে দিতে। কাজ শিখা অবস্থায় ৫০০০ টাকা পাব। কাজ শিখে ফেললে বেতন ১০,০০০/ টাকা হবে। আমিও চলতে পারবো। মায়ের সংসারের হাল ও ধরতে পারব। ভুলিনি সেইদিনের খালার দরদী পরামর্শ।

কলেজে পড়ার সময় আমি ফাস্ট ইয়ার ফাইলাম এক্সাম না দিয়ে ঢাকা চলে গিয়েছিলাম। একদিন ছিলাম খালার বাসায়। আমরা গরীব বলে আমাকে খাটে শুতে দিলেন না। ড্রয়িং রুমে বিছানা করে দিলেন। তখন শীতকাল ছিল।খালা আমাকে খুব আদর করতেন। তাই কনকনে শীতের রাতে আমাকে একটা লেপ দিয়েছিলেন। আমার তখন ভাল কোন শার্ট ছিল না। খালার কাছে দুইটা পুরাতন শার্ট চাইলাম। খালা বললো: এখন ত বাসায় পুরাতন শার্ট নেই। সব ফকিরদের দান করে দিয়েছি। আচ্ছা তোর ভাইয়েরা শার্ট ফেলে দিলে ফকিরকে না দিয়ে তোদের জন্য রাখব। সেদিন বুঝেছিলাম খালা আমাদের ফকির ভাবে।

খালার চার সন্তান এর বিয়েতে আমাদেরকে দাওয়াত দেয়নি। কারন আমরা ফকির। আমাদের ভাল জামা নেই। বড় লোকের বিয়েতে কি কাপড় পরে যাব আমরা?
খালার একটা প্রেস্টিজ আছে না? বিয়েতে অন্য আত্নীয়রা যখন আম্মার কথা জিজ্ঞেস করত, তখন খালা বলত: আম্মা অসুস্থ তাই যেতে পারেননি।

১৯৯৬ সাল। ক্লাস সিক্সে পড়ি।
আমার খালাত ভাই এর ট্রাভেল এজেন্সি ছিল। আমার আব্বাকে মালয়েশিয়া পাঠাবেন বলে আমাদের জমি বিক্রির ৪০,০০০/টাকা নিয়েছিলেন। পরে আমার বাবাকে বিদেশ ও পাঠাননি এবং আমাদের টাকাও ফেরত দেন নি। আমার মা নীরবে অশ্রু ফেলতেন।
আমার খালা আমাদের টাকা মেরে দিলেন। বাবা প্রায়শই এই টাকা নিয়ে মায়ের সাথে ঝগড়া করে ভাত না খেয়ে থাকতেন। একটা দুর্বিষহ মানসিক যন্ত্রনার মধ্য দিয়ে আমাদের কৈশোর কেটেছে।

১৯৯৮ সন। চারদিকে বন্যা।
সব কিছুর চড়া দাম। দিনে এক বেলা খাওয়াও কঠিন।
বাজার থেকে ১/২ কেজি চাউল পলিথিনে ভরে হাতে করে আনতাম। গরম ভাত এর সাথে একটা পেয়াজ ও গুড়ো মরিচ। আহ কি স্বাদ। ভাতের সাথে মাছ মাংস খাব কল্পনাও করা সম্ভব ছিল না। কুরবানির ঈদ ছাড়া আমরা গরুর মাংস চোখে দেখতাম না। মা মাঝে মাঝে খেসারী ডালের বড়া বানাতেন। খেসারীর ডাল সস্তা ছিল। গরীবের ডাল। এক প্লেট গরম ভাত। সাথে দুই টা খেসারীর ডালের বড়া। মাঝে মধ্যে একটা ডিম পেয়াজ দিয়ে বিরাম করে চার ভাগের একভাগ জনপ্রতি।
একদিন বড় বোন স্কুল থেকে এসে ভাতের সাথে পেয়াজ ও গুড়ো মরিচ দেখে না খেয়ে ভাতের প্লেটটা মেলা মেরে ফেলে দিয়েছিলেন। সেই উড়ন্ত গরমভাতের প্লেটের ছবিটা আজো ভুলিনি।

১৯৯৯ সন।
আমরা তখন নানার বাড়িতে থাকতাম। মামা পুরো বাড়ি বিক্রি করে ঢাকায় চলে গেছেন ১৯৯৪ সালে। তখন আমরা কিছু অংশ কিনে রেখেছিলাম। অনেকটা পানির দরে এই বাড়ি বিক্রি করে আমরা দাদাবাড়ি ফিরলাম।
আমাদের বাড়ি বিক্রির টাকা দিয়ে বিদেশ গেল আমার ছোট কাকা। ছোট কাকার ঘরে থাকতেন দাদা দাদী।
আমার মা ছোট চাচার ঘরে ৫ কেজি চাউল আনতে গেছিলেন। দাদা ভাই এর জমির চাল। চাচী সেদিন চাউল না দিয়ে বললেছিলেন, ওনাদের ঘরে চাউলের জন্য গেলে আমার মায়ের পা ভেঙ্গে দিবেন। ঘরে ফিরে মায়ের অশ্রুভেজা চোখটা আজো ভুলিনি।

২০০৩ সন।
আব্বা তখন স্ট্যান্ডার্ড গ্রুপে স্টোর কীপার এর একটা চাকুরী পেলেন। ঢাকা থেকে বাড়ি এসে দেখেন আম্মা বাড়ি নেই। আমার বড় বোন ঘরের সামনে বসে কাঁদছে।
আফসানার তখন তিন বছর। আব্বাকে দেখে দৌড়ে ঘর থেকে বের হয়ে আব্বার কোলে উঠল। তারপর বলল দুই দিন ভাত খাইনি আব্বা। চিনি দিয়ে পানি গুলে খাইছি।
মাছ দিয়ে ভাত খাবো আব্বা। কয়েকদিন আগে আব্বা এই কথা বলে কেঁদে দিয়েছেন।

এইস এস সি পরীক্ষার ফরম ফিলাপ শুরু হইছে। আমার সাথের অনেকেরই ফরম ফিলাপ শেষ। আব্বা খুব টেনশনে আছেন। আমার আরেক কাকা বিদেশ থেকে আসলেন। তিনি বললেন, আমার ফরম ফিলাপের জন্য তিনি ৩০০০ টাকা দিবেন। আর একদিন বাকী।
সকালে কাকা বললেন আমি হাজীগঞ্জ যাচ্ছি, বিকালে এসে টাকা দিব। কাকা বিকেল গড়িয়ে রাতেও আর ফিরে আসেননি বাড়িতে। আমি কলেজের ফাস্ট বয় ছিলাম। শামীম কাকা, যিনি আমার বাবার চাচাতো ভাই, প্রিন্সিপাল স্যারকে বলে বিনা টাকায় আমার ফরম ফিলাপের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। আমার নিজের আপন কাকা তিন দিন পর বাড়ি ফিরে খুব স্বস্থি পেয়েছিলেন। যাক বাবা বুদ্ধি করে তিন দিন পর বাড়ি আসাতে ৩০০০/ টাকা বেঁচে গেল। সেই দিনের কথাও ভুলিনি।

মেডিকেল কোচিং
আমি ডাক্তার হতে চাইনি। কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার হবার খুব ইচ্ছে ছিল। বায়োলজি ছিল অপশনাল। আমি বায়োলজি পড়িনি বাবার উপর রাগ করে। এই সাব্জেক্ট পাল্টাতে আমি অনেক চেষ্টা করেছি। আমার বাবা পরীক্ষার পর একটা সমিতি থেকে সুদে ১০০০০/ টাকা এনে আমাকে নিয়ে ঢাকায় রওয়ানা দিলেন। রেটিনা কোচিং এ আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে ভর্তি করিয়ে দিলেন।
বাবা শুধু বলেছিলেন, আমার বিশ্বাস, দিলে টানে তুমি মেডিকেলে চান্স পাবে। ঠিকমত লেখাপড়া করবে।

পড়ার টেবিল এ বসলেই বাবার চেহারাটা ভেসে উঠত।
মেসে থাকতাম পূর্ব রাজা বাজারে। একদিন সকালে বুয়া আসেনি। নাস্তা কই খাবো। নগদ টাকা নেই। সেদিন আমার মেসের রুম মেট শাকিল ভাই ১২ টাকার নাস্তা ফ্রি করিয়েছিলেন। সেই ১২ টাকার স্নেহের কথা ভুলিনি।
ঢাকায় আমার খালার বাসা। মামার বাসা। কারো বাসায় যাইনি।

২০০৪ সন। ১০ এপ্রিল।
আমি সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজের ৪২তম ব্যাচের ছাত্র হিসেবে মেডিকেল জীবনের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করি। আমার বাবার বিশ্বাসটা বাস্তব হয়েছিল। সেই দিন থেকেই আমি আমার পরিবারের দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছিলাম।

অভাবের দিনগুলি-২য় পর্ব।
অতীত কে ভুলা যায়না। অতীত এর শক্তিশালী স্মৃতি সামনে এগিয়ে যেতে প্রেরণা দেয়। আম্মা বলতেন উনার জীবনের কষ্টগাঁথা লিখলে হাজারো পৃষ্ঠার উপন্যাস হয়ে যাবে। আমার মা, বাবা আমাদেরকে এমন একটা পৃথিবীতে বড় করেছেন যেখানে আমাদের মামা ছিল না। খালা ছিল না। চাচা জেঠা কেউ ছিল না। আমাদের কোন আত্মীয় ছিল না। বেড়ানোর কোন জায়গা ছিল না।
আমার জীবনে রক্তের সম্পর্কের মানুষদের কোন ভুমিকা নেই। কোন স্নেহের স্মৃতি নেই। এই যে আমি লেখাপড়া করে ডাক্তার হয়েছি। ক্লাসে ক্লাসে ভাল রেজাল্ট করেছি। বৃত্তি পেয়েছি। কেহ কোন দিন আদর করে ১ টাকা দিয়ে উৎসাহ দিয়েছেন বলতে পারবে না। মানুষ দাদাবাড়িতে বঞ্চিত হলেও নানা বাড়িতে আদর পায়। আমরা কোথাও পাইনি।

দাদীর স্মৃতি ও ভালবাসাঃ
আমার দাদা ভাই হজ্জে গেলেন। কুরবানির ঈদের পর গরুর চামড়া বিক্রির ১২০০ টাকা আমার দাদি আমাকে দিয়েছিলেন। কাগজ কলম কেনার জন্য। সেই ১২০০ টাকা দেওয়ার অপরাধে আমার দাদি অন্য চাচীদের তোপের মুখে পড়েছিলেন। দাদী অপমানে কেঁদেছিলেন।
সেই দিনকে ভুলা যায় না। আমাদেরকে খুব ভালবাসতেন দাদী। বাবা ছিলেন দাদীর কলিজা। কিন্ত ৬ ছেলে ২ মেয়ে এর বিশাল সংসারে দাদি ছিলেন অসহায়।
আমাদেরকে দেবার মত শুধু ভালবাসা ও দোয়া ছাড়া আর কিছু ছিলনা উনার।

এস এস সি এক্সাম এর সময়ে আমার বড় বোনের এক জোড়া জুতা ছিল না। সে দাদির কাছে বায়না ধরল, এক জুড়া জুতার টাকার জন্য। দাদী দাদার আলমারি থেকে চুরি করে ২৫০ টাকা এনে দিয়েছিলেন। সেইদিন দাদির মুখে একটা সুখের ছায়া দেখেছিলাম। আমাদের বায়না ধরার এই একটা জায়গা ছিল। আম্মাকে দাদি মাঝে মাঝে ২০/৫০ টাকা এনে দিতেন সাবান, লবন, ডাল কেনার জন্য।

২০০০ সালে আমাদের ঘরের সবার চিকেনপক্স হল।
বাবার এত বেশী হয়েছিল, এখন মনে করলেও ভয় লাগে। সেদিন দাদী একটা ছাগল সদকা দেওয়ার মানত করেছিলেন, বিনিময় আল্লাহ যেন বাবাকে সুস্থ করে দেন।

দাদী গরুর মাংস খুব পছন্দ করতেন। আমি মেডিকেলে চান্স পাবার পর যতদিন বাসায় গিয়েছি, যাওয়ার সময় দাদির জন্য গরুর মাংস নিয়ে যেতাম। দাদীর গরুর মাংস খাওয়ার দৃশ্যটা আজো ভুলিনি।

মৃত্যুর কয়েক বছর আগে দাদী আমাদের উপর খুব নির্ভর হয়ে গেলেন। আমাদের ঘরে ঢুকে নিজ হাতে খাবার নিয়ে খেয়ে দাদাভাই এর জন্য নিয়ে যেতেন।
এই স্বাধীনতা অন্য কোথাও ছিল না।

আমরা যেদিন ১১ সেপ্টেম্বর ২০১১ তে কুমিল্লা শহরে চলে আসি সেদিন দাদী ও দাদাভাই খুব কেঁদেছিলেন।
বলেছিলেন আমাদেরকে কার কাছে রেখে যাচ্ছো তোমরা। আমরা যখন চলে আসি, অশ্রুসিক্ত দাদির আমাদের পথ পানে চেয়ে থাকাটা আজো ভুলিনি।
ভালবাসার মানুষ এর অশ্রুজল এর কথা ভুলতে নেই।
দাদি ইন্তেকাল করেন ২৫ জানুয়ারি ২০১২ এর বিকেল বেলা। আমি তখন ফেনীর কসমোপলিটন হাসপাতাল এর Resident Medical Officer. ছুটি ম্যানেজ করে পরদিন ভোরে গ্রামে ফিরি। দাদির কাফন দাফনের সব খরচ আমি দেই। একটি টাকাও উনার সন্তানদের লাগেনি। ভালবাসি দাদিকে। কিছু ভালবাসা ফিরিয়ে দিতে পারায় মন হাল্কা লাগছে।

দাদার স্মৃতিঃ
আমার দাদাভাই প্রিন্সিপ্যাল মাওলানা আব্দুল মান্নান ওয়াজেদী ছিলেন আমাদের এলাকায় সু-পরিচিত এক ইসলামী ব্যক্তিত্ব। হাজারো আলেমের উস্তাদ তিনি।
অন্য ছেলেদের বিরোধিতায় তিনি আমাদের জন্য খুব বেশি ভুমিকা রাখতে না পারলেও দোয়া দিয়ে গেছেন প্রাণভরে। উনি প্রতি মুনাজাতে বলতেন: আল্লাহ যেন আমাকে উনার বংশের প্রদীপ বানিয়ে দেন। এই দোয়া আমি ভুলি কীভাবে?

দাদীর ইন্তেকাল এর পর আব্বা বাড়ি গেলেন উনাকে দেখতে। টাকা দিলেন। তখন আমি ব্যাংককে Australian Medical Council CaT 1 দিতে।
আব্বা দাদাভাই কে বললেন, জোবায়ের এর জন্য দোয়া করবেন। দাদাভাই বললো: তার দোয়া চাইতে হবে না।
দোয়া যে পৌঁছে তা কি টের পাচ্ছো না? আমাদের জীবনে দাদাভাই এর দোয়ার ভুমিকা বিশাল। দাদাভাইকে যখন ল্যাব এইড এর আইসিইউতে নিয়ে যাই তখন এম্বুলেন্স চলতে শুরু করার পর দাদাভাই গাড়ি থামিয়ে আব্বাকে আবার ডাকলেন।
আব্বার হাত ধরে বলেছিলেন “সফর যদি সংক্ষিপ্ত হয় তাহলে তোমার সাথে দেখা হবে, আর যদি সফর দীর্ঘ হয় তাহলে হাশর এর মাঠে দেখা হবে”। দাদার সফর দীর্ঘ হয়ে গিয়েছিল।

কুমিল্লা মেডিকেল সেন্টারে দাদাভাই এর টেস্ট এর টাকা দেওয়ার লোক ছিল না সেদিন। যারা উনার সব সম্পদ গিলে খেয়েছে তারা কেহ দেয়নি। আমাদের তখন ক্রাইসিস। আমি ব্যাংকক থেকে ফিরছি মাত্র। বেকার। মাত্র ৫০০০/= টাকা ছিল। আমি আব্বার হাতে দিয়ে বললাম আমার কাছে আর ১ টাকাও নেই। দাদাভাইয়ের সময় আর বেশি নেই। এটা উনার হাতে দেন। দাদাভাই মৃত্যুর আগে আমার দেওয়া টাকা ই হাতে নিলেন। আর কারো সেই সৌভাগ্য হয়নি।

ল্যাব এইডে যখন দাদাভাইকে ভেন্টিলেটরে দেওয়া হয় তখন তিনি আমার হাতে ধরে বলেছিলেন, তোদের অনেক বঞ্চিত করেছি, তোদের জন্য মায়া হয়। রাতে ফ্লোরে ঘুমিয়ে দাদার অন্তিম সময়ে সেবা করে পাশে থেকে যে দোয়া পেয়েছি, তার জন্যই আজকের এই আলোময় জীবন।

অভাবের দিনগুলিতে খাবারের পাশাপাশি কাপড় চোপড়েও আমরা অনেক কষ্ট পেয়েছি। আম্মার একটা কাপড় ছিল। দিনে গোসল করতেন না। রাতে গোসল করে পেটিকোট আর ব্লাউজ পরে ঘুমাতেন। ভেজা কাপড়টা শুকালে সকালে পড়তেন। ১৫ দিন পর আব্বা বেতন পাওয়ার পর দুইটা জনি প্রিন্টের কাপড় এনেছিলেন। সেই দিন ভুলতে পারবো না। তাই এখন আমি যতবার কুমিল্লায় যাই আম্মার জন্য আড়ং থেকে কাপড় কিনে নিয়ে যাই। আজকে যখন আম্মাকে বল্লাম সেই দিনের কথা, আম্মা বললেন: সেইদিন কাপড় ছিল না বলে আজ শুধু আড়ং এর ৫০ টা কাপড়, আলহামদুলিল্লাহ।

একদিন বিকেল বেলা সবাই ঘুমাচ্ছে। আমি উঠে দেখি সকালে যেই কাপড়টা সিলেট থেকে নিয়েছি সেটা
একা একা গায়ে জড়িয়ে আয়নায় নিজেকে দেখছেন।
আমি চুপিচুপি পুরো ব্যাপারটা খেয়াল করলাম।
যদিও সকালে কাপড় টা নেওয়াতে খুব রাগ দেখালেন। মিতব্যয়ী হওয়ার জন্য লেকচার দিলেন। বাবা মা এর জন্য আমি আজীবন অপচয় করব। সেই দৃশ্য যে কতটা সুখের তা আমি জানি।

১৯৯৩ সালে কুয়েত গিয়ে ১৯৯৬ সালে বাবা দেশে চলে আসেন। আমি তখন সিক্স এ পড়ি। ১৯৯৬ থেকে ২০০৪ এই আট বছর আব্বা বেকার ছিলেন। আমাদের জীবনের বেশি নিষ্ঠুরতা এসেছিল এই সময়টাতে।
অভাব আস্তে আস্তে আমাদের গ্রাস করে নিল। আব্বা ১৯৯৬ সালে একটা লুঙ্গি কুয়েত ফেলে এসেছিলেন। ৪ বছর পর জেঠা ২০০০ সালে দেশে আসার সময় এই লুঙ্গিটা নিয়ে এসে উনি বাড়িতে তিন মাস পরেন। যেদিন উনি আবার বিদেশ গেলেন সেদিন আম্মা সেই লুঙ্গি এনে গরম পানি দিয়ে ধুয়ে শুকিয়ে আব্বাকে দেন। আব্বা সেই লুঙ্গি এক বছর পরেছিলেন। সেই মলিন লুঙ্গির চেহারা আজো ভুলতে পারিনি। কত টা খারাপ ছিল সেই সময়। গত বছর শুধু আব্বার কাপড় রাখার জন্য আমি ৪৬হাজার টাকা দিয়ে হাতিল থেকে একটা আলমারি দেই।

আমি যখন এস এস সি পরীক্ষা দেই। তখন আমার একটা প্যান্ট ছিল না। আমি আমার বাবার একটা পুরাতন প্যান্ট ছোট করে পড়েছিলাম। আমি ক্লাস এইটে যেই প্যান্ট বানিয়েছিলাম সেটা ক্লাস 10 এ গিয়ে ছোট হয়ে গেল। সেটা পরলে ক্লাসের বান্ধবীরা হাসাহাসি করত। স্যান্ডেল পায়ে দিয়ে এস এস সি এক্সাম দিয়েছি।
এক জোড়া জুতা ছিল না। কাপড়চোপড় এর কষ্টগুলো আমি নিতে পারি না। যখন এইস এস সি এক্সাম দেই তখন পুরো পরীক্ষা একটা ৪০ টাকার বাঘ এর চিত্র আঁকা টি শার্ট পড়ে দিয়েছি। আজ আমার জামা কাপড় অনেক মানুষ গায়ে দেয়, আলহামদুলিল্লাহ। অনেককে আমি জামা কাপড় কিনে দেই। কিন্ত সেই দিনের কথাগুলো কেম্নে ভুলিব। প্রথম ও ২য় লেখার প্রতিটি শব্দ আগের লিখা পড়ে যারা অশ্রুসিক্ত হয়েছেন, সেই অশ্রুজল এর মত পবিত্র ও সত্য। এটা আমাদের নিষ্ঠুর যাপিত জীবনের কিছু খন্ড চিত্র।

অভাবের দিনগুলি। তৃতীয় পর্ব।

আমি যখন টিউমার ছিলামঃ
আমার বাবা তখন বি এ তে পড়েন। ফাইনাল পরীক্ষা সামনে। খুব ব্যস্ত সময় পার করছিলেন। একদিন পড়ার টেবিলে দাদি গিয়ে বাবাকে বিয়ের সুখবর দিলেন। তখনো তিনি আমার বাবা হননি। সুখবর শুনে মানুষের চোখে মুখে আনন্দ চিকচিক করে। কিন্ত উনি মুখ গোমরা করে ফেললেন। দাদি গিয়ে দাদাকে জানালেন উনার রিয়েকশন। আমার বাবা উনার বাবাকে যতটুকু সম্মান, মর্যাদা দিয়েছেন এতটুকু হৃদয় নিংড়ানো ভালবাসা খুব কম সন্তান তাদের বাবাকে দিয়ে থাকেন।
বাবা মা এর বিরুদ্ধাচরণ ইহজীবনে করেন নি। দাদা ভাই আমার বাবাকে সাথে নিয়ে গেলেন জৈনপুর এর পীরসাহেব হযরত মাওলানা এমরান আহমেদ সিদ্দিকী এর খানকায়। হুজুর বুজুর্গ ব্যক্তি ছিলেন। আমাদের এতদাঞ্চলে উনার খুব সুখ্যাতি ছিল। হুজুর সব শুনলেন, আব্বাকে স্নেহ করতেন। দাদাকে বললেন, আমি ইস্তিখারা করে এক সপ্তাহ পর সিদ্ধান্ত দিব।

এক সপ্তাহ পর দাদাভাই বাবাকে নিয়ে হাজির হলেন।
হুজুর হঠাৎ ঘোষণা দিলেন নুরুল আমিন (আমার বাবা) এর বিয়ে আমি পড়াব। আমার বাবার আর না করার সুযোগ থাকল না। জৈনপুরের পীরসাহেব হুজুর উনার পুরো জীবনে দুইটা বিয়ে পড়িয়েছিলেন। এর মধ্যে আমার বাবা মা এরটা একটা।

বছর ঘুরে আমার মা এর কোল জুড়ে বড় বোন আসে।
প্রথম সন্তান যার কন্যা, সেই বাবা ভাগ্যবান। ছয় মাস পর আম্মা একদিন আব্বাকে জানালেন উনার পেটে কি যেন একটা চাকা নড়ে। অনেকটা টিউমার এর মত। মা খুব ঘাবড়ে গেলেন। আব্বা আম্মাকে নিয়ে গ্রাম থেকে পিজিতে হাজির। তখন পিজির গাইনী বিভাগের সম্ভবত রেজিস্টার ছিলেন জাতীয় অধ্যাপক প্রফেসর ডাঃ শায়লা খাতুন।

ম্যাডাম আম্মাকে চেকআপ করে আব্বাকে নিশ্চিত করলেন আপনারা যেটাকে টিউমার ভাবছেন, সেটা টিউমার নয়। ম্যাডাম মিষ্টি খেতে চাইলেন। ১৯৮৪ সালের ২০ সেপ্টেম্বর বিকাল বেলায় সেই টিউমার আমার বাবা মা এর দ্বিতীয় সন্তান ও বড় ছেলে হিসেবে এই ধরনী তে ল্যান্ড করে। আমার মা খুব মায়া নিয়ে গালে চুমু দিয়ে প্রায়ই উনার সেই টিউমারকে আদর করেন এবং টিউমার এর ডাক্তার হয়ে উঠা নিয়ে আবেগ তাড়িত হয়ে উঠেন।

আমার মায়ের অতীতের পাড়ি দেওয়া দুঃখ নদীর কাছে আমি শিখেছি অনেক কিছু। ঢেউ জানা নদীর কাছে শিখার আছে অনেক কিছু। আমার মা একজন নির্লোভ ও নরম মনের সাহসী নারী। কোন চাওয়া পাওয়া, কোন অভিযোগ তখনো ছিল না। আজো নেই।

আম্মাকে প্রশ্ন করলাম কেমন সুখে আছেন? মায়ের উত্তর সুখের শেষ নেই। জীবনে এমন সুখের দিন আসবে সেটা উনার কল্পনাতীত ছিল। উনি বিশ্বাস রেখেছেন নিজ লক্ষ্যে। কি পেয়েছেন, কি খেয়েছেন, কি পরেছেন সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করেননি। একটাই স্বপ্ন ছিল ছেলে মেয়েরা লেখাপড়া করে মানুষ হয়ে মানুষ এর পাশে দাঁড়াবে।

আমরা কুমিল্লা শহরে যেই ফ্লাটে ভাড়া থাকি, অনেকেই বলে কাজের লোকের অভাব। কিন্ত মা এর কাজের লোকের অভাব হয় না। যে একবার মা এর মায়া পেয়েছে সে আর যেতে চায় না। এইবার কুরবানিতে দেখলাম অনেকগুলো ছোট ছোট প্যাকেট করেছেন। আমি বললাম কাকে দিবেন? অনেকগুলো কাজের লোকের নাম বললেন।

সেই মা ই আমার শক্তি। আমার সাহস এর বাতিঘর।
মা এর পাওয়া সব কষ্টগুলো ই আমার সম্পদ। এগুলো আমাদের আজকের এই সময়ে নিয়ে আসতে প্রেরণা দিয়েছে এবং দিয়ে যাবে।

পাতা কুড়ানো সেই দিনগুলো।
আমি রান্না ঘরে গেলেই আমার স্মৃতিতে পড়ে কত কষ্ট করে মা রান্নার লাকড়ি/পাতা সংগ্রহ করতেন। সেদিন আমার ডাঃ নাবিলাকে অটো গ্যাস স্টোভ কিনে দিয়ে বললাম মায়ের পাতা কুড়ানোর কথা। একদিন আমি কলেজ থেকে দুপুরে বাড়ি এসেছি। এসে দেখি মা ঘর্মাক্ত কিন্ত মন ভীষণ খারাপ। জিজ্ঞেস করাতে ছোট বোন মিনা বললো, আম্মা দুই পুকুর এর ভিতর থেকে পাতা কুড়িয়ে বড় উঠানে রোদে দিয়েছেন শুকাতে, এক মহান চাচা খুব চিল্লাফাল্লা করেছেন। বলছেন, এগুলো তাড়াতাড়ি না সরালে উনি ফেলে দিবেন। আমাদেরকে তো সহ্য করতেন না-ই, আমার মায়ের কুড়ানো পাতাকেও উনারা সহ্য করতেন না। আজ আর মাকে পাতা কুড়াতে হয় না।

ফ্রিজ কেনার গল্পঃ ২০১০ সাল।
আমি তখন সিওমেক এ ইন্টার্নী ডাক্তার। একদিন সকালে বাড়ি পৌঁছে দুপুরে আমাদের আড্ডা বাজারে গেলাম। ফিরলাম সন্ধ্যায়। আসার পর গোল্ডেন সিস্টার আফসানা বলল। আম্মা আজকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছে বিকালে। কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করাতে বললো বেয়াল (খালের উপর বাশ ফেতে মাছ ধরার গ্রামীণ পদ্ধতি) থেকে অনেকগুলো কই ও টেঙরা মাছ কিনে আনছে আম্মা। কিছু আমার ইমিডিয়েট ছোট ভাই সোহাগ এর জন্য ফ্রিজে রাখতে গেছিল, কিন্ত কারো ফ্রিজে জায়গা দেয়নি কেহ। সেদিন আমি আবার রাতে বাজারে গেলাম। তারপর আমাদের ইউনিয়ন এর সাবেক চেয়ারম্যান বাদল কাকা এর গোল্ডেন সমবায় সমিতি থেকে এক বছর এর কিস্তি তে HAIER এর একটা ফ্রিজ কিনে আনি। আজকের দিনগুলোতে যতবার ফ্রিজ খুলি ততবার সেই কথা মনে পড়ে।

সোহাগের কথাঃ
আমরা তিন ভাই এর দ্বিতীয় হল সোহাগ। সোহাগ যখন ক্লাস ১০ এ পড়ত তখন আমার এক চাচাত ভাইকে প্রাইভেট পড়াত। মাসে ১০০ টাকা। প্রথম মাস পড়ানোর পর টাকা দেওয়ার দিন চাচী বলল, সোহাগ তোর আম্মার কাছে ১০০ টাকা পাই। তোর এই মাসের বেতন দিয়ে সেই টাকা পরিশোধ হয়ে গেল। তার সেই দিনের চাপা কান্না ও কষ্টটা আমি ভুলিনি। আজ সোহাগ NSU থেকে বায়োটেকনোলজিতে মাস্টার্স শেষ করে USA তে PhD করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। সেই চাচাত ভাই কতদূর আগালো, সেটা আর নাই বা বললাম।

অভাবের দিনগুলি। শেষ পর্ব।।
একটা মন খারাপের স্মৃতি থেকে লেখাটি লিখেছিলাম।
আমাদের জীবনের বিষাদময় নিষ্ঠুরতার কিছু খন্ড চিত্র দেখে আপ্নারা অনেকেই অশ্রুজলে সিক্ত হয়েছেন। আপনাদের আবেগ ও হৃদয় এর হাহাকার জানিয়ে আমাদের অনুপ্রেরণা দিয়েছেন যা আগামীর পথ চলায় সাহস যোগাবে।

প্রাদোষে প্রাকৃতজন বই টা যারা পড়েছেন সেখানে একটা প্রশ্ন করা হয় ‘এটা কি মানুষ এর জীবন? সুখ নেই, স্বস্থি নেই। এই জীবন কি যাপন করা যায়?
আমাদের জীবনটা তেমনই ছিল। এত করুণ ও নিষ্ঠুর যা কল্পনার অতীত। আমার নানী মাকে সাহস দিতেন, ধৈর্য্য রাখো, একদিন সুখ আসবে। নানী একবার উনার বাবার বাড়ি শ্রীরামপুর গেলে আম্মার মামীরা বললো, এই যে আপনার ছোট মেয়ে এত কষ্টে আছে, আপনার বড়লোক মেয়েকে অনুরোধ করতে পারেন না ওকে সাহায্য করতে? নানী উত্তর দিয়েছিলেন, যতক্ষণ বান্দার ঠ্যাং এ ধরব, ততক্ষণ আল্লাহ এর কাছে বলব। একদিন আল্লাহকে আমার কথা শুনতে হবে। আল্লাহ রেস্পন্স করেছেন নানীর দোয়ায়।

নানীকে ১৯৯৪ থেকে ২০১৭ আমাদের কাছেই ছিলেন।
মাঝে কিছুদিন ঢাকায় মামা ও খালার বাসায়। নানী ছিল মায়ের সাহস এর বাতিঘর। সব অবস্থায় আমার বাবা মা শুধু আল্লাহ এর উপর ভরসা করেছিলেন।

আল্লাহ এমন দুইজন লোককে আমাদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য পাঠিয়েছেন যা আমরা কল্পনাও করিনি।
একজন আমার প্রিয় বুয়েট এর সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রফেসর ড. দেলোয়ার হোসেন কাকা।
উনি আমার মায়ের সংগ্রামকে সম্মান দিয়ে বোন বলে ডেকেছেন। মায়া ও ভালবাসায় আমাদের জীবন উনি ভরিয়ে দিয়েছেন। উনি আমার এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা।
উনি আমাদের রক্তের কেহ না। কিন্ত আমাদের হৃদয় মাঝখানেই উনি বসবাস করেন। উনি যখন হাসি দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরতেন পিঠ চাপড়ে সাহস দিতেন তখন সবকষ্ট ভুলে যেতাম। এত ব্যস্ততার মাঝেও মেডিকেলে পড়াকালীন উনি প্রতি মাসে আমার কাছে চিঠি লিখতেন। আজো সেই চিঠি গুলো যত্নে রেখে দিয়েছি। এখনো মন খারাপ এর রাতে এগুলো পড়ি।

২০০৪ সাল। মেডিকাল ভর্তি পরীক্ষার পর প্রথম কলটা আম্মাকে দেই। আমাদের মোবাইল ছিল না। ছোট চাচীর মোবাইলে কল দিয়ে আম্মাকে জানাই। আমি ঢাকায় বসে বুঝতে পেরেছি মায়ের অশ্রুঝরা। দ্বিতীয় কল দিয়েছিলাম ড. দেলোয়ার কাকাকে। উনি আমাকে উনার বুয়েটের অফিসে ডাকলেন। তারপর আমার শিক্ষার সব দায়িত্ব উনি নিয়ে নিলেন পাশাপাশি আমার পরিবারে জন্য উনি সহযোগিতার হাত বাড়ালেন। আমাদের সব চাওয়া পাওয়ার কেন্দ্র হয়ে উঠলেন কাকা।

২০০৫ সাল। আম্মার পিত্তথলিতে পাথর। প্রায়শই ব্যাথা হয়। সাথে Dysfunctional Uterine Bleeding.
একসাথে দুইটা অপারেশন দরকার। আম্মা অপারেশন এর কথা শুনার পর থেকেই মানুষিক ভাবে ভেঙে পড়লেন। আমি তখন মেডিকেলের সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি।
আমি গেলাম দেলোয়ার কাকার বাসায়। উনি আমাকে দেখে হাসি দিলেন। তারপর সব শুনে বুয়েট এর Teachers Associations থেকে ১ লক্ষ টাকা লোন তুলে আমাকে দিলেন। সেই অবদান ভুলার নয়।
আমাদের পরিবারের সারা বছর এর চাউল উনি কিনে দিয়েছেন। ড. দেলোয়ার কাকার একদিন আমাকে বললেন জীবনে সুখী হতে চাও, কারো কাছে কিচ্ছু প্রত্যাশা করবে না। এটা জীবনে সুখী হওয়ার সুত্র।
প্রতিদান প্রত্যাশা না করেই উনি আমাদের জীবন মায়ায় ভরিয়ে দিয়েছেন। অফুরন্ত ভালবাসা ও সম্মান প্রিয় ড. দেলোয়ার কাকার জন্য।

শামীম কাকার কথাঃ
২০০১ সালঃ এস এস সি পাশ করেছি। কলেজে কীভাবে ভর্তি হব এই চিন্তায় মগ্ন। একরাশ হতাশা ঘিরে ছিল।
একদিন পড়ন্ত বিকেল বেলা আব্বা আমাকে নিয়ে গেলেন শামীম কাকার কাছে। তখন কাকা গ্রামে এসেছেন। উনি আব্বার চাচাত ভাই। SQ GROUP এর চেয়ারম্যান। কাকা আব্বার সব কথা শুনলেন। সাথে দাদী বসা ছিলেন। সব শুনে হতবিহ্বল হয়ে গেলেন উনারা। আমরা কেন কষ্টে থাকব এটা উনারা কুল কিনারা করতে পারলেন না? দাদী তদন্ত করলেন। মরহুম হাবিব উল্লাহ দাদাভাই ও আমাদের ইউনিয়ন এর সাবেক চেয়ারম্যান আব্বার চাচা মরহুম খালেক দাদাভাই উনাদের বিস্তারিত জানালেন। একদিন দাদি ঢাকা থেকে খবর পাঠালেন, আব্বা যেন শামীম কাকার সাথে দেখা করে। আব্বা গেলেন। কাকা আমাকে আড্ডা কলেজে ভর্তি হতে বললেন। ২০ হাজার টাকা পরিবারে দিলেন।
আমি আড্ডা কলেজ এ পড়েছি দুই বছর। হোস্টেল এ থাকা ও খাওয়া, প্রাইভেট পড়ার স্যারদের সম্মানি, কলেজ এর বেতন, ফরম ফিলাপের জন্য আমার ১ টাকাও লাগেনি। সব কাকার অবদান।

আব্বা ২০০৪ এ আবার কুয়েত গেলেন। প্লেন এর টিকেট ভাড়ার জন্য কাকা ৩০ হাজার টাকা দিয়েছিলেন।
ড. দেলোয়ার কাকার পাশাপাশি শামীম কাকাও আমাকে মেডিকেল এর ৫ বছর ফিন্যান্সিয়াল সাপোর্ট দিয়েছেন।
আমি এক কাকার টাকায় নিজে চলতাম। আরেকজন এর টাকায় ভাইবোনকে সাপোর্ট দিতাম। নিজে কোচিং ও টিউশন এর টাকা মা এর জন্য পাঠাতাম। এই দুইজন মানুষ এর কাছে আমরা চিরঋণী।

ডাক্তার হওয়ার পর ২০১০ সাল থেকে পুরো পরিবারের দায়িত্ব আমি নিজ কাঁধে নিয়ে নেই। ভাইবোনগুলো লেখাপড়া করে অনেক দূর আগালো। আমার মায়ের দুই মেয়ে মাস্টার্স এ পড়ে। সোহাগ PhD প্রোগ্রাম এর প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ত। গোল্ডেন সিস্টার আফসানা কলেজ এ।
আমার বড় বোনের টুইন বাচ্চা ইরফান কুমিল্লা জিলা স্কুল এ ক্লাস সেভেন এ, আর ইন্তিহা মর্ডান স্কুলে।
বাবাকে হজ্জ করিয়ে আনলাম গতবছর। ২০১১ সাল থেকে আমরা কুমিল্লা শহরে থাকি।

আমি একজন সেল্ফ এম্পলয়েড ডাক্তার। নিজের প্রজেক্ট ডাঃ জোবায়ের মেডিকেয়ার সেন্টার এ কাজ করছি। অনেক ভাল আছি। বিসিএস আমাকে আকর্ষণ করতে পারেনি। যেতে হবে বহু দূর। আমাকে যদি প্রশ্ন করেন “সুখ কি? আমার উত্তর মা-বাবার মুখের হাসি।

লেখক: Dr. Jobayer Ahmed
ওযায়ের আমীন সম্পাদিত। লেখাটা ভীষণ অনুপ্রেরণার। তাই ঈষৎ সেচ্ছা সম্পাদনা করে প্রকাশ করলাম। ডাক্তার জোবায়ের অাহমদ। তোমার প্রতি শুভকামনা অবিরাম। তোমার মা-বাবার প্রতি দোয়া রইলো। কেউ অনুপ্রাণিত হলে সার্থক অনুভব করবো।

সমকামিতা,আর রিজালু বির রিজাল..আন নিসা বিন নিসা…

সমকামিতা। হালের আলোচিত টপিক। কারো কাছে মানবিক, স্বাভাবিক। কারো কাছে পাশবিক, বিকৃতি। কারো কাছে ‘ঘেন্নার’, তবে ‘এটাও একটা ধরন’, ওদেরও আছে সমাজে বসবাসের অধিকার, ইত্যাদি। নিজের পছন্দমত যৌনচর্চার অধিকার। কেউ তো আবার আগ বাড়িয়ে জিনগত-জন্মগত- প্রাকৃতিক প্রমাণ করেও ছেড়েছে। আজিব হ্যায় ইয়ে দুনিয়া। যা ইচ্ছে প্রমাণ করে ফেলা যায়। সত্যকে মিথ্যা আর মিথ্যাকে সত্য করে ফেলা যায়। নিজের চাহিদাকে বৈধতা দেয়া কেন ব্যাপারই না। প্রতারণার যুগ, এইজ অব দাজ্জাল (দাজ্জাল অর্থ চরম প্রতারক)। সব সম্ভবের যুগ।
ডাক্তার হওয়ার জন্য ম্যালা বইপত্র পড়তে হয়েছে। ১১ টা সাবজেক্টে প্রতিটার ২ টা মেইন বই, একটা গাইড ধরলে ৩৩ টা কেতাব খতম দিয়ে লাইসেন্স মিলেছে রোগীর গায়ে হাত দেয়ার। তাই, একটা দুটো বই পড়ে আপনি যেমন খুব সহজে ‘গে জিন’ এর অস্তিত্ব বিশ্বাস করে সমকামিতা-কে ‘হাতের স্পর্শ ছাড়াই প্রাকৃতিক’ বলে বিশ্বাস করে ফেলতে পারেন। আমি পারি না। জেনেটিক্সে ‘সমকামিতা’ প্রাকৃতিকভাবে প্রোগ্রামড কি না, তা নিয়ে পক্ষ বিপক্ষ তৈরি হলেও, মেডিকেল সায়েন্সে সমকামিতার ‘অপ্রাকৃতিকতা’ নিয়ে কোনই সন্দেহ নেই।

সমকামিতা যদি প্রাকৃতিকই হয়, স্বাভাবিকই হয়; তাহলে আমাদের শরীরের গঠন তা সাপোর্ট করার কথা। আমাদের এনাটমি ও শারীরতত্ত্ব তো সমকামবান্ধব হবার কথা। সমকামের জন্য যা যা প্রয়োজন, আমাদের গঠনও তেমনটাই হবার কথা। যেহেতু এটা প্রাকৃতিক দাবি করা হচ্ছে। সমকামের সাথে যায়- এমন বৈশিষ্ট্য পায়ু-লিঙ্গে পাওয়া গেলেই তো দাবিটা সঠিক হয় যে, সমকাম সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীন ও সুস্থ স্বাভাবিক যৌনক্রিয়া, তাই না? যেমন ধরেন যোনির গঠনটাই এমন যে পুরো জায়গাটা—

- ঘর্ষণ উপযোগী
- প্রচুর পিচ্ছিলকারী তরল তৈরির ব্যবস্থা
- এসিডিক পরিবেশ, ফলে বহিরাগত জীবাণু প্রতিরোধী
- প্রসারণশীল- আনন্দের অনুভূতি সৃষ্টিকারী স্নায়ুসমৃদ্ধ
এসব বৈশিষ্ট্যই প্রমাণ করে যে, যোনিপথে মিলন একটা প্রাকৃতিক ব্যাপার। অপরপক্ষে নাকের ছিদ্র বা কানের ছিদ্রে এই বৈশিষ্ট্যগুলো নেই। যা প্রমাণ করে নাকের ছিদ্রে বা কানের ছিদ্রে মিলন, চাই সেটা যত আগে থেকেই প্র্যাকটিস করা হোক না কেন, কোনভাবেই প্রাকৃতিক নয়। এমন কোন জায়গায় মৈথুন আর যা-ই হোক প্রাকৃতিক হতে পারে না। অনুপযুক্ত স্থানে অনুপযুক্ত চর্চা অবশ্যই প্রকৃতিবিরুদ্ধ এবং ‘গে-জিন’ এর রূপকথা বানিয়ে দিলেই পায়ু মৈথুনের উপযুক্ত হয়ে যাবে না। মনে রাখবেন, কোন জিনেই লেখা থাকে না যে এটা ‘গে-জিন’। বরং এগুলো ধারণা করা হয় যে, হতে পারে এই জিন এই কাজের জন্য দায়ী। কিছু ভাইয়াকে এইসব ধারণাগত বিষয়কে এত বেশি বিশ্বাস করতে দেখা যায়, যদিও তারা দাবি করে তারা না দেখে কিছু বিশ্বাস করে না। যেহেতু গে-জিন আমার আলোচ্য বিষয় না, তাই আজ এখানে তা আলোচনা করছি না। চলুন দেখি, মানবদেহের গঠন আমাদের কী বলে।

ভূমিকাঃ

আগে কিছু কথা শিখে নিই যাতে পরের কথাবার্তা বুঝা যায়। আমাদের শরীর বহু কোষের সমন্বয়ে গঠিত। একই ধরনের একাধিক কোষ ভ্রূণদশায় যদি একই উৎস থেকে তৈরি হয়, আর যদি একই ধরনের কাজ করে সেই কোষের গ্রুপকে কলা/টিস্যু (Tissue) বলে। যেমন ধরেন নার্ভটিস্যু বা স্নায়ু কলা। ভ্রূণ অবস্থায় সবচেয়ে বাইরের লেয়ার থেকে এরা উৎপন্ন হয়ে সারা দেহে বিস্তার লাভ করে এবং নার্ভ তৈরি করে। সেন্স আনা-নেয়ার কাজটাই করে। আবার ধরেন, পেশীকলা। ভ্রূণের মধ্যস্তর থেকে তৈরি হয়, সারা শরীরে ছড়ায়, মাসল তৈরি করে, ওজন নেয়ার ও হাড্ডিকে বাঁকিয়ে নানান নড়াচড়ার কাজটা করে। অনেকগুলো কলা মিলেঝিলে যখন একটা কাজ করে তাকে বলে ‘অঙ্গ’। যেমন ধরেন, হার্ট ????????????

???????? এর মধ্যে পেশীকলা-স্নায়ু কলা-যোজক কলা- আবরণী কলা সব মিলে রক্ত পাম্পের কাজটা করে।

কলাগুলোর মধ্যে আবরণী কলাটা (Epithelium) ডিটেইলস জানা দরকার। দেহের বাইরের ও ভিতরের আবরণ তৈরী করে যে কোষরা তাদেরকে আবরণী কলা বলে। চামড়ায় আছে, মুখের ভিতরের আবরণে এরা, রক্তনালীর ভিতরের আবরণে এরা, শ্বাসনালীর ভিতরের লেয়ারটায় এরা, ফুসফুস-ব্লাডার-পেশাবের নালী, সব সব। সব ধরনের আবরণ এরা সারি সারি কোষ বসে বসে তৈরি করে। এদেরকে সাংগঠনিকভাবে একসাথে কাজের ভিত্তিতে আবরণী কলা বলে।

সমকামিতা
ফুসফুসে আঁইশাকার কোষ

এরা আবার কয়েক ধরনের। যেখানে বিভিন্ন প্রয়োজনীয় অণুর আদানপ্রদান দরকার, সেখানে আছে চ্যাপ্টা চ্যাপ্টা মাছের আঁইশের মত কোষওয়ালা আবরণী কলা। যেমন ফুসফুসের শেষ মাথায় (Alveolus) যেখানে অক্সিজেন-কার্বনডাইঅক্সাইড আদানপ্রদান হবে সেখানে অন্যগুলো থাকলে হবে না, সেখানে আছে এই আঁইশাকার আবরণী কলা, যাতে লেনদেন সম্ভব হয়। আবার এগুলো আছে রক্তনালীর ভিতরের লেয়ারে, কারণ সেখানে (বিশেষত কৈশিকজালিকায়) গ্লুকোজ, এমিনো এসিড, স্নেহ পদার্থ সরবরাহ করতে হবে, আবার বর্জ্য নিতে হবে রক্তে, আদানপ্রদানের জন্য সেখানেও একস্তর আঁইশাকার কোষ (Simple Squamous Epithelium)। কেন আইশাকার? যাতে অণুগুলোকে কম দৈর্ঘ্য অতিক্রম করতে হয়। কোষের বেধ কম, আঁইশের মত।

আবার যে আবরণকে ঘর্ষণ সহ্য করতে হবে বেশি সেখানে বহুস্তর আঁইশাকার আবরণী কলা (Stratified Squamous Epithelium)। যাতে অল্প পুরুত্বে কয়েকস্তর কোষ দেয়া যায়। উপরের লেয়ার ঘষায় উঠে গেলেও (Desquamation) তলায় আরও কয়েক লেয়ার থাকে যা জীবাণু প্রতিরোধ করবে। যেমন ধরেন মুখগহ্বরের ভিতরের লেয়ারটা। গোশত-হাড্ডি চাবায়ে, লাকড়ির মত টোস্ট কুড়মুড় করে খাচ্ছেন, এই কোষগুলো আছে বলে। অন্যকোষ থাকলে সারাবছর ঘা হয়ে থাকত। আবার অন্ননালী জুড়েও এই কোষ, কারণ আমরা একদম তরল করে গিলি না, কিছুটা চিবিয়েই গিলে ফেলি, শক্ত শক্ত ।

আবার কিছু জায়গা আছে যেখানে রস উৎপন্ন করাটাই কাজ। যেমন বিভিন্ন গ্ল্যান্ড। এখানে রস বানানোর কাঁচামাল জমানো লাগবে, রস বানানোর মেশিনপত্র রাখা লাগবে, আবার বানানো রস রাখারও জায়গা লাগবে। তাই এখানে আঁইশের মত চ্যাপ্টা হলে কাজ হচ্ছে না। এসমস্ত রসের কারখানার জন্য আছে ছক্কার গুটির মত (Cube) একস্তর কোষের আবরণী কলা। কিছুটা স্পেস যাতে পাওয়া যায়। যেমন ধরেন: লালাগ্রন্থি, থাইরয়েডগ্রন্থি।

পরিপাক আবরণী কোষ (একস্তর স্তম্ভাকার)

আর যেখানে রস উৎপাদনের চেয়ে রস শোষণ মুখ্য উদ্দেশ্য। সেখানে কন্টিনিউয়াস শোষণ হতে হবে। এজন্য আরও স্পেস বেশি লাগবে। এজন্য সেখানে একস্তরবিশিষ্ট স্তম্ভাকার কোষের আবরণ (Simple Columnar Epithelium)। থামের মত লম্বা লম্বা। পুরো পরিপাক নালী জুড়ে এরা। এখানে পদে পদে উৎপাদন আর শোষণ। রস উৎপাদন করে হজম, খাবারকে সরল তরল করা আর শোষণ। এজন্য এই ধরনের কোষকে পরিপাক আবরণী কলাও (Digestive/ Gastrointestinal Epithelium)বলে। পাকস্থলী-ক্ষুদ্রান্ত্র-কোলন-মলাশয়।

যেখানে যেটা দরকার সেখানে সেটা, কোন ব্যত্যয় নেই। অবশ্য একশ্রেণীর মানুষ একে দুর্ঘটনা মনে করে। এমনি এমনিই এমন ছন্দের মত, নিখুঁত নকশা তৈরি হয়েছে বলে তাঁরা দাবি করে। এনারা রোবটের কাজকাম নিখুঁত হলে এঞ্জিনিয়ারের প্রশংসা করে, কিন্তু এতো অতি-আণুবীক্ষণিক লেভেলের পারফেকশন নাকি লক্ষ লক্ষ ঠাডা পড়ে নিখুঁত হয়েছে বলে তিনারা বিশ্বাস করেন।

আচ্ছা, অন্য প্রসঙ্গে না গেলাম। যে ধরনের আবরণী কলার যেটা সহ্য করার ক্ষমতা নেই, সেখানে সেটা হলে (Stess) একটা সমস্যা হয়। যেমন ধরেন, পাকস্থলীর ভিতরের আবরণে আছে স্তম্ভাকার কোষ। এরা সেখানে এসিড, শ্লেষ্মা ও অন্যান্য রসটস তৈরি করে। এখন, অন্ননালীর আবরণ আবার আঁইশাকার।

মেটাপ্লাসিয়া (দেখেন স্তম্ভ কোষ কীভাবে আঁইশ হচ্ছে)

যদি কারও দীর্ঘদিন পেটের খাবার উপরে উঠে আসার সমস্যা থাকে (Reflux), তাহলে ঐ আঁইশাকার কোষগুলো এসিডের ছ্যাঁকায় ছ্যাঁকায় পরিবর্তন হয়ে স্তম্ভাকার হয়ে যায়, এই প্রক্রিয়াকে বলে মেটাপ্লাসিয়া (Metaplasia)। এটা ভালো জিনিস না, ক্যান্সারপূর্ব লক্ষণ হিসেবে বিবেচিত। এই অসুখকে বলে ‘ব্যারেটস ইসোফ্যাগাস’। আবার পিত্তথলিতে পানি শোষণ ও পিত্তরস সংগ্রহ হয়, এখানে আবরণী কলা ‘স্তম্ভাকার’।

যদি দীর্ঘদিন কোন পাথর থাকে, তাহলে পাথরের ঘষায় ঘষায় এখানেও মেটাপ্লাসিয়া হতে পারে। কেননা ঘষার উপযোগী তো আঁইশকার কোষ। একই কাহিনী হতে পারে পেশাবের ব্লাডারেও। আবার শ্বাসনালীতে থাকে স্তম্ভাকার কোষ যাদের কাজ শ্লেষ্মা উৎপাদন। শেষপ্রান্তে গ্যাস অণু বিনিময়ের জন্য থাকে আঁইশাকার। ধূমপানের কারণে যে ক্যান্সার হয় তা মূলত নিকোটিনের কারণে না, তামাকের অন্যান্য উপাদানের কারণে, যেমন টার, বেনজিন। এসব কেমিক্যাল সহ্য করা স্তম্ভাকার কোষেরও কাজ নয়, একস্তর আঁইশেরও কাজ নয়।

বামে শ্বাসনালীর মূল স্তম্ভ কোষ, ডানে আঁইশাকার ক্যান্সার কোষ

কেমিক্যাল সহ্য করতে চাই ত্বকের মত বহুস্তর আঁইশাকার কোষ, তাও আবার উপরে থাকতে হবে জড় কেরাটিন স্তর। ফলে এখানেও হবে মেটাপ্লাসিয়া। এবং ক্যান্সারে রূপ নেবে যদি কেমিক্যাল টর্চার চলতেই থাকে। স্তম্ভগুলো আঁইশে রূপান্তরিত হয়ে যে ক্যান্সার হবে তাকে বলে ‘আঁইশাকার কোষ ক্যান্সার’ (Sqamous Cell Carcinoma, SCC)। আর আঁইশগুলো ঘনকাকার হয়ে যে ক্যান্সার হবে তার নাম ‘ঘনকাকার কোষ ক্যান্সার’(Small Cell Carcinoma)। আশা করি এতটুকু ক্লিয়ার।

যোনির ভিতরের আবরণ (মাল্টিলেয়ার আঁইশ কোষ)

এবার মূল আলোচনা শুরু। পয়লা আমরা যোনিপথের (Vagina) গঠন দেখব। এটা একটা নালী বা টিউবের মত অঙ্গ। স্বাভাবিক অবস্থায় এর দৈর্ঘ্য থাকে ২.৭৫ ইঞ্চি থেকে ৩.২৫ ইঞ্চি। আর নারীর উত্তেজিত অবস্থায় বেড়ে দাঁড়ায় ৪.২৫-৪.৭৫ ইঞ্চি। [1] পুরো যোনিপথ তো বটেই, সেই সাথে পুরুষাঙ্গ যেখানে গিয়ে ধাক্কা দিতে পারে, মানে সারভিক্সের যে অংশ যোনিপথের দিকে বেরিয়ে থাকে (Ectocervix), সে অংশও মাল্টিলেয়ার আঁইশ কোষে আবৃত (ঘর্ষণ উপযোগী)। যদিও মূল সারভিক্সের (Endocervix) আবরণ একস্তর স্তম্ভ কোষের [2]। বামের ছবিতে দেখুন যোনিপথ ও বহিঃসারভিক্সের মাল্টিলেয়ার আঁইশ কোষ দেখা যাচ্ছে।

আর ডানের ছবিতে দেখুন জরায়ুর একটা অংশ যোনিপথের দিকে বেরিয়ে আছে। ঐ অংশটাও (বহিঃসারভিক্স) যোনিপথের মত একই ঘর্ষণযোগ্য মাল্টিলেয়ার আঁইশ কোষ আবরণ দিয়ে আবৃত।

বহিঃসারভিক্স ও যোনির আবরণ মাল্টিলেয়ার আঁশ কোষ ঘর্ষণ উপযোগী

এবার, পায়ুর গঠনটা দেখি চলেন। ছবিটা দেখতে হবে খুব ভালো করে। পায়ু একটা নালী (Tube)। মাঝখান থেকে লম্বালম্বি চিরে ফেললে এমন দেখাবে। ছোট ছোট ঢেউয়ের মত কাল দাগ দেয়া আছে দেখেছেন?
ঐ বর্ডার থেকে লোমওয়ালা বর্ডার পর্যন্ত

পায়ুপথ ও মলদ্বার

এলাকাটা হল ‘পায়ুপথ’ (Anal canal), মাত্র ৪ সে.মি. (৩-৫ সেমি) [3]। এই এলাকাটুকু মার্ক করে ‘Anoderm’ লেখা আছে, মানে হল এখানে আবরণ আমাদের চামড়ার মতই, কেবল লোম-ঘামগ্রন্থি এসব নেই। এর উপর থেকে রেক্টাম বা মলাশয় শুরু। মানে হল কালো ঢেউ ঢেউ দাগের নিচের টুকু জড় কেরাটিন যুক্ত মাল্টিলেয়ার আঁইশাকার কোষের আবরণ (ত্বকের মত), আর উপরের অংশ রেক্টামে একস্তর স্তম্ভটাইপ কোষের আবরণ (পৌষ্টিকনালীর বাকি অংশের মত)[4]

মলদ্বার ও পায়ুপথের আবরণী হঠাত পরিবর্তন

ডানের ছবিতে তীর চিহ্নিত অংশে লক্ষ্য করুন, আবরণ হঠাৎ বদলে গেছে। বাম পাশে গোল গোল শ্লেষ্মাগ্রন্থি বিশিষ্ট পরিপাক আবরণী (digestive epithelium), আর ডানে মাল্টিলেয়ার আঁইশ টাইপ কোষ। বামে রেক্টাম, আর ডানে পায়ুপথ। আগের ছবিতে দেখেন সুপরিসর রেক্টাম থেকে বেশ চিকন পায়ুপথে মল আসার সময় বেশ ঘর্ষণের ঘটনা ঘটে, তাই মাল্টিলেয়ার আঁইশ দেয়া হয়েছে। এখন আমার কথা হলঃ

১.
এখানে আমরা দেখলাম, পায়ুপথের মাত্র ৪-৫ সেমি জায়গা ঘর্ষণ উপযোগী। পরের এলাকাগুলো মোটেও ঘর্ষণ উপযোগী নয়। পুরুষের গড় উত্থিত লিঙ্গের দৈর্ঘ্য ৫ ইঞ্চি, আমরা এক ইঞ্চি কমিয়ে ধরলাম। ৪ ইঞ্চি মানে ১০ সেমি। মানে লিঙ্গের বাকি ৫ সেমি গিয়ে আঘাত করবে রেক্টামের স্তম্ভাকার কোষের আবরণে, যা ঘর্ষণের জন্য অনুপযোগী। আর আমরা আগেই দেখেছি যে কাজের জন্য যা উপযোগী না, সেখানে সে কাজ হলে মেটাপ্লাসিয়া ঘটে। কোষের ধরন বদলে যায়, যা উপযুক্ত পরিবেশে ক্যান্সারে রূপ নিতে পারে। সমকামীদের মলদ্বারের ক্যান্সারের ঘটনা সাধারণ মানুষের চেয়ে ২০ গুণ বেশি। [5] আমেরিকান ক্যান্সার সোসাইটি জানাচ্ছে, পায়ুমিলন পায়ুক্যান্সারের সম্ভাবনা বাড়ায়। আরও বেশি সম্ভাবনা বাড়ে সমকামী পায়ুমিলনে।[6]
২.
যেহেতু এমন জায়গায় গিয়ে আঘাত হচ্ছে যা একস্তরী স্তম্ভ কোষ, মাল্টিলেয়ার না। ফলে প্রতিবার সেক্সে ইনজুরি হবেই। আবরণী ক্ষতিগ্রস্ত হবেই। ফলে এইডস ভাইরাস, প্যাপিলোমা ভাইরাস ইনফেকশন ছড়ায় দ্রুত। এইডস তো এইডস-ই, আর প্যাপিলোমা ভাইরাস-ই মূলত ৮০-৯০% মলদ্বারের ক্যান্সারের জন্য দায়ী [7]
৩.
টিউমার-এর খারাপ জাতটাকেই (malignant) বলে ক্যান্সার। টিউমার বড় হতে সাহায্য করে আমাদের দেহে উৎপন্ন প্রোস্টাগ্লান্ডিন (PG) নামক কেমিক্যাল গ্রুপের PGE2 ও PGF2. আর টিউমার তৈরি শুরু হতে সাহায্য করে PGE2, PGF2, ও PGE1. এবং এই ৩ ধরনের PG-ই অত্যধিক পরিমাণে আছে বীর্যে। দেহস্থ অন্য যেকোন রস বা টিস্যুর চেয়ে বেশি। [8] মানে বীর্য সহ্য করার ক্ষেমতাও পায়ুর নেই, যা জরায়ুর আছে।
৪.

এবার একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের মতামত তুলে ধরব। ডাক্তার Stephen E. Goldstone, MD সাহেব Mount Sinai School of Medicine, New York এ assistant clinical professor হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এবং তিনি gayhealth.com এর মেডিকেল ডিরেক্টর। তিনি ২০০০ সালের American Society of Colon and Rectal Surgeons এর বার্ষিক সম্মেলনে বলেন, ১৯৯৭ সালের আগে আমি আমার পুরো ক্যারিয়ারে একটা পায়ু ক্যান্সারের রোগী পেয়েছি।

১৯৯৭ থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত আমি আমার চেম্বারে রেফার হয়ে আসা ২০০ পুরুষ রোগীর ডাটা সংগ্রহ করি। এদের সবাই নন-ক্যান্সার সমস্যা নিয়ে এসেছিল। এদের ৬৬% ছিল এইচআইভি পজেটিভ। বায়োপসি করে পেলাম, এদের ৬০% এর হাইগ্রেড আঁইশ কোষের টিউমার ক্যান্সার যা এখনও ছড়িয়ে পড়েনি (high-grade squamous intraepithelial lesions (HSIL) আর ৩% এর পেলাম ছড়িয়ে পড়া (invasive) ক্যান্সার। যদিও এদের কারোরই ক্যান্সারের লক্ষণ প্রকাশ পায়নি। [9] ফাইনালি তিনি সিদ্ধান্ত দেন, সমকামী পুরুষেরা পায়ুপথের যেকোন সমস্যা নিয়ে এলেই তাদের গভীর পরীক্ষা (aggressive screening) করা দরকার। হতে পারে ভিতরে ক্যান্সার-পূর্ব আরও মারাত্মক কোন সমস্যা লুকিয়ে আছে।

৬.

পায়ুপথের অধিকাংশ ক্যান্সার Adenocarcinoma টাইপ, মানে গ্ল্যান্ড টাইপ। আঁইশকোষ ক্যান্সার (Sqamous Cell Carcinoma, SCC) খুব বিরল। কিন্তু অধুনা এই আঁইশকোষ ক্যান্সার বৃদ্ধি পেয়েছে বলে জানান University of California-র professor of clinical pathology জনাবা Teresa M. Darragh, MD ও associate director for gynecologic pathology জনাবা Barbara Winkler, MD.[10]

এই ক্যান্সার হচ্ছে ঠিক যে জায়গায় স্তম্ভাকার-টু-আঁইশাকার চেঞ্জটা হয়েছে তার সংলগ্ন উপরের অংশে যেখানে পুরোটাই স্তম্ভকোষ (squamo-columnar junction with the rectal columnar mucosa)। তাঁরা বলেন, পায়ুমৈথুনে (receptive anal intercourse) আঘাত-ইনজুরি-মেরামত চলতে থাকে, যা মেটাপ্লাসিয়া প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে। (In this area of transition, there is active changeover of columnar epithelium to squamous epithelium through the process of squamous metaplasia. This process is accelerated by trauma, healing, and repair such as might be expected to occur with receptive anal intercourse.)

পায়ুপথ ও মলদ্বার

আবার দিলাম ছবিটা। কালো জিগজ্যাগ দাগটা হল সেই জাংশন। এর উপরে শার্পলি স্তম্ভকোষ শুরু, নিচে শার্পলি মাল্টিলেয়ার আঁইশ কোষ শুরু। দাগের ঠিক উপরের জায়গাটাতেই মেটাপ্লাসিয়া বেশি হয় আমরা জানলাম, সমকামীদের ক্ষেত্রে। দেখেন এই জায়গাটা বাকি রেক্টামের চেয়ে উঁচু, লম্বা লম্বা ভার্টিকাল ভাঁজ আছে । মানে ঘষা এখানে লাগে বেশি, বাকি রেক্টামের চেয়ে। যা ঘষা লাগার জন্য তৈরি হয়নি, তাতে ঘষা লাগতে লাগতে একসময় তাই ঘটে যা আমরা আগে বলেছি—মেটাপ্লাসিয়া। এই মেটাপ্লাসিয়া থেকে হচ্ছে এই ক্রমবর্ধমান হারে আঁইশ কোষ ক্যান্সার।

উপরের নীল আর নিচের নীল মিলিয়ে দেখুন

৭.

এবার উপরের ছবির নীল রঙের জায়গাটা লক্ষ্য করুন। নীল যেগুলো দেখছেন, এগুলো শিরা, উচু জায়গাটাকে বলে ‘কুশন’ (coushion)। এখানে যে বিখ্যাত অসুখটা হয়, তার নাম আপনারা সবাই জানেন— পাইলস (haemorrhoid)। দেখুন, ঐ নীল অংশটাই বেড়ে গোটার মত হয়েছে।

 

 

দুটো ভিন্ন রক্ত পরিবহন সিস্টেমের মিলনস্থল (Porto-systemic anastomosis)

 

পায়ুর এই জায়গাটা অতিমাত্রায় রক্তনালীসমৃদ্ধ। দুটো ভিন্ন রক্ত পরিবহন সিস্টেমের মিলনস্থল এটা (Porto-systemic anastomosis)। আবরণীর নিচেই রয়েছে প্রচুর রক্তজালক (venous plexus)। আঘাত/ঘর্ষণের জন্য এ জায়গাটা মোটেই নিরাপদ না। আসলে এই শিরাজালিকা চওড়া হয়ে ও মোটা হয়ে ঝুলে পড়ে হয় পাইলস। পাইলসের কারণগুলো যদি আমরা দেখিঃ [11]

– শিরা থেকে কম রক্ত ব্যাক করাঃ দীর্ঘসময় টয়লেটে বসে থাকা, গর্ভাবস্থা, পায়ুপেশীর অধিক সংকোচন
– কোষ্ঠকাঠিন্য
– পেটে অধিক চাপ দেয়া
– গর্ভাবস্থা
– পারিবারিক ইতিহাস
– Lack of erect posture
– Familial tendency
– Higher socioeconomic status
– Chronic diarrhea
– Colon malignancy
– Hepatic disease
– Obesity
– Elevated anal resting pressure
– Spinal cord injury
– Loss of rectal muscle tone
– Rectal surgery
– Episiotomy
– Anal intercourse *****
– Inflammatory bowel disease, including ulcerative colitis, and Crohn disease

তাহলে দেখা গেল পাইলসের একটা কারণ হল পায়ুসঙ্গম। পায়ুসঙ্গম নিজেই অনেকগুলো রোগের কারণ। এটা ন্যাচারাল বিহেভিয়ার হলে তা এতো অসুখবিসুখের কারণ হবে কেন? ন্যাচার সাপোর্ট করে না বলেই তো এত সমেস্যা। ন্যাচারের বিরুদ্ধে যায় বলেই তো ন্যাচার বিদ্রোহ করে।
৮.

রয়টার্সের রিপোর্ট। ৬১৫০ জন নরনারীর ডাটা বিশ্লেষণ করলেন গবেষকগণ। এদের ৩৭% মহিলা একবার হলেও পায়ুসঙ্গম করেছেন। আর ৫% পুরুষ পাওয়া গেল যারা একবার হলেও পায়ুসঙ্গম করেছেন। প্রধান গবেষক Dr. Alayne Markland, University of Alabama জানান, পায়ুসঙ্গমের সাথে ‘পায়খানা ধরে রাখতে না পারা’র (fecal incontinence) সম্পর্ক আছে। এবং সেটা মেয়েদের চেয়ে পুরুষের ক্ষেত্রে বেশি। এই ৩৭% মহিলার ৫০% এরই মাসে একবার হলেও fecal incontinence হয়, মানে কাপড় নষ্ট হয় আর কি। আর পুরুষের ৩ গুণ বেশি হয় এই দুর্ঘটনা, প্যান্ট ভরায়ে ফেলে। [12]

লিঙ্গের প্রস্থচ্ছেদ

৯.

পিরোনীজ ডিজিজ (Peyronie’s Disease) নামে একটা অসুখ আছে। গবেষকগণ মনে করেন, লিঙ্গে ইনজুরি হয়ে লিঙ্গের অভ্যন্তরে রক্তপাত হতে পারে। অনেকসময় ইনজুরি লক্ষ্য করার মত না-ও হতে পারে, তবে ভিতরে রক্তপাত হয়ে থাকে [13]। কারণ লিঙ্গ কোন মাংসপেশী নয়। এটা বিশেষ একধরনের স্পঞ্জের মত টিস্যু যার ভিতরে রক্ত প্রবেশ করে তা শক্ত হয়। আবার রক্ত বেরিয়ে গেলে নরম হয়ে পড়ে। নিচের ছবি দুটো দেখুন। CC-CS লেখা জায়গাগুলো স্পঞ্জের মত রক্ত ধরে রাখে, ফলে শক্ত হয়।

লিঙ্গের প্রস্থচ্ছেদ

অত্যধিক পরিমাণে রক্তনালী থাকার কারণে সামান্য ইনজুরি হলেও রক্তক্ষরণ হতেই পারে, আপনার অজ্ঞাতেই। ফলে সেখানে তৈরি হয় স্কার (বাংলায় ‘চল্টা’ বলা যেতে পারে), এদের বলা হয় ‘প্লাক’। ফলে লিঙ্গ বেঁকে যেতে পারে বা এবড়োখেবড়ো হয়ে যেতে পারে।

কারো কারও প্রচণ্ড ব্যথা হতে পারে, এমনকি লিঙ্গ উত্থিত হবার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলতে পারে। জানাচ্ছে American Urological Association.[14]

Southern Illinois University-র urologist Tobias Köhler, M.D. সাহেব জানাচ্ছেন ‘নিউইয়র্ক টাইমস’ পত্রিকাকে, বেশি চাপ দিয়ে হস্তমৈথুন করলে হতে পারে এই অসুখটা [15]। তার মানে সামান্য এই ‘হাতের চাপেই’ রক্তক্ষরণ হয়ে যেতে পারে লিঙ্গের ভিতরে, কেউ তো আর কিল-ঘুষি দিয়ে মাস্টারবেশান করে না।

বিছানা বা বালিশে ঘষাঘষি তো আরও মারাত্মক ব্যাপার। নিচের টেবিলটা খেয়াল করুনঃ

(ছবির ১ নং রেফারেন্স [16] ছবির ২ নং রেফারেন্স [17] ছবির ৩ নং রেফারেন্স [18])

167 mm Hg মানে 22264.8 প্যাসকেল চাপ। অর্থাৎ ৩.২২ পাউন্ড ওজন এক বর্গইঞ্চিতে যে পরিমাণ চাপ দেয়। মানে ১.৪৬ অর্থাৎ প্রায় দেড় কেজি একটা বাটখারা লিঙ্গে বেঁধে দিলে যে চাপ অনুভব হবে অতখানি চাপ দেয় মলদ্বার সংকোচন (লিঙ্গের গোড়ার ক্ষেত্রফল এক বর্গইঞ্চি ধরেছি)। অনেক প্রেসার। লিঙ্গের মত সেন্সিটিভ অঙ্গের জন্য এটা অনেক প্রেসার। লিঙ্গ প্রবেশনের জন্য মলদ্বার খুবই রিস্কি জায়গা। মলদ্বারের চাপ নেবার মত ক্ষমতা নেই পুরুষাঙ্গের। আর স্কুইজ ছাড়া সারাক্ষণ প্রেসার থাকে ৭৭০ গ্রাম ওজন ঝুলিয়ে দিলে যেমন লাগবে, তেমন। হস্তমৈথুনেও এত চাপ দেয়া হয় না। নিঃসন্দেহে পেনিসে ইনজুরি হতেই হবে। পেনিস আর মলদ্বারে ইনজুরি না করে সমকাম করা অসম্ভব।
আমরা পায়ুপথে আঙুল দিয়ে একটা পরীক্ষা করি (Digital Rectal Exam, DRE)। তখন টের পাওয়া যায়, কত শক্তভাবে মলদ্বার চাপ দেয়। এছাড়া একটা স্বয়ংক্রিয় সংকোচন আছে মলদ্বারের যাকে বলে Anal Reflex/Anal wink. অর্থাৎ পায়ুর আশেপাশের ত্বকে কোন খোঁচা/ চিমটি দিলে পায়ু সংকোচন হয়। [19] পায়ুমৈথুনে এই চাপ অতিক্রম করে চাপের বিরুদ্ধে লিঙ্গ প্রবেশ ও চালনা করাতে হয়। আবার ভিতরেও রেস্টিং প্রেসারের বিপরীতে লিঙ্গচালনা করতে হয়। সেখানে প্রচুর শিরাজালকের উপস্থিতিও আমরা দেখলাম। মোদ্দাকথা লিঙ্গ ও পায়ুর দৃশ্যমান কিংবা অদৃশ্যমান ইনজুরি না করে পায়ুমৈথুনের কোন সুযোগই নেই।
এজন্যই পায়ুমৈথুনে ২০ গুণ বেশি এইডসের সম্ভাবনা । আর এই রিস্ক আরও বাড়ে যদি আগে থেকেই রেক্টামে কোন ইনফেকশন থাকে [20]। আর আমরা দেখলাম, ইনজুরি ছাড়া পায়ুমৈথুন অসম্ভব। এক তো আবরণ ঘর্ষোণোপযোগী না, সিঙ্গেল লেয়ার, তার উপর আবার প্রেসার বেশি, ইনপুট প্রেসারও দিতে হবে বেশি, আবার রক্তজালিকা বেশি। তার উপর এখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ জীবাণু প্রজাতি E. coli যারা রক্তে এন্ট্রি পেলেই ইনফেকশন করে।
১০.

যোনিপথের Skene’s ও Bartholin’s গ্রন্থি থেকে প্রচুর পিচ্ছিল তরল নির্গত হয়। একজন মহিলার কোন উত্তেজনা ছাড়াই প্রতিদিন ১.৫ গ্রাম তরল বের হয়। আর উত্তেজিত হলে তা বহুগুণে বেড়ে যায় (arousal fluid)। আর অর্গাজমের সময় তা আরও বৃদ্ধি পায় [21]

যোনিপথের মত পায়ুতে যথেষ্ট পিচ্ছিলকারকের উৎপাদনও নেই, ফলে প্রচুর লুব্রিকেন্ট ব্যবহার করতে হয়। অনেক বিজ্ঞ সমকামী ভাইয়া বলতে পারেন, জেলী ব্যবহার করলেই তো আর আঘাত-ঘর্ষণের ফলে ইনজুরি আর হলো না। আচ্ছা, ২০১০ সালে International Conference on Microbicides এ ২ টা গবেষণা উপস্থাপন করা হয়। ৪৭ টি দেশের সহস্রাধিক মাইক্রোবায়োলজিস্ট অংশ নেন।

এই দুটি রিপোর্টের সারমর্ম হল, পায়ুকামে জেলী (lubricants) ব্যবহারে এইডসের রিস্ক আরও বাড়ে [22]। একটিতে বাল্টিমোর ও লস এঞ্জেলসের ৯০০ পুরুষ ও মহিলার ডেটা নেয়া হয়। গবেষকগণ দেখেন, যারা জেলী ব্যবহার করে তারা ৩ গুণ বেশি যৌনবাহিত রোগের (rectal sexually transmitted infections) ঝুঁকিতে আছে। আরেকটা স্টাডি বলছে, জনপ্রিয় জেলীগুলোকে ল্যাবে নিয়ে দেখা গেছে, সেগুলোর অনেকগুলো রেক্টাল কোষের জন্য মরণঘাতী (toxic)। যার ফলে এগুলো ব্যবহারে এইডসের ভাইরাসের প্রবেশ হয় আরও সহজ।

এমনকি পুরুষ না কি নারী, এইডস আছে না কি নেই, কোন শহরে থাকে, কনডম ইউজ করে কি না, গত মাসে কতজন যৌনসঙ্গীর সাথে মিলিত হয়েছে— এই সবগুলো ফ্যাক্টরকে সমান সমান নিয়েও দেখা গেছে, পায়ুমৈথুনের (receptive rectal intercourse) আগে জেলী (lubricant) ব্যবহার করার সাথে পায়ুর যৌনবাহিত রোগের সম্পর্ক জোরালোই রয়ে গেছে। (Even after controlling for gender, HIV status, city, condom use, and number of sex partners in the past month, the association between use lubricant before receptive rectal intercourse and rectal STIs remained strong) জানাচ্ছেন গবেষকদলের প্রধান Dr Pamina Gorbach যিনি School of Public Health এবং University of California, Los Angeles-এর David Geffen School of Medicine-এর একজন চিকিৎসক।

University of Pittsburgh ও Magee-Womens Research Institute এর Charlene Dezzutti, Ph.D এর নেতৃত্বে পরিচালিত আরেকটা গবেষণার রিপোর্টে বহুল প্রচলিত ৬ টা জেলী নিয়ে গবেষণায় দেখা গেছে,

– এতে অনেক বেশি পরিমাণে লবণ ও শুগার থাকে যা কোষের পানি টেনে নেয়। ডিহাইড্রেশান হয়ে মারা যায় আবরণী কোষ। ইনফেকশনের জায়গা করে দেয়।
– আবার কোনটা পায়ুর ভালো ব্যাকটেরিয়ার পুরো বসতিই জ্বালিয়ে দেয়। ফলে খারাপ ব্যাকটেরিয়া আসার সুযোগ পায়।

মোটকথা, যোনিতে যেখানে প্রচুর লুব্রিক্যান্ট ক্ষরণের ব্যবস্থা আছে, সে তুলনায় পায়ুতে প্রায় জিরো। লুব্রিক্যান্ট নিয়েও শেষরক্ষা নেই, ইনফেকশান হবেই। কেননা আগেই দেখেছি, কেমিক্যাল সহ্য করার জন্য চাই মাল্টিলেয়ার আঁইশ কোষের আবরণ। রেক্টামের একস্তর স্তম্ভকোষ মারা যাবে অহেতুক কেমিক্যাল টর্চারে।

সামারিঃ

মেয়েদের সমকামিতায় প্রবেশন (penetration) নেই বলে একে প্রকৃত মিলন বলা হয় না, তাই আজকের আলোচনায় জায়গা পায়নি। আর পুং সমকামিতা ছাড়াও নারীর সাথে পায়ুমৈথুনও আমাদের আলোচনার আওতায় এসেছে। মোদ্দাকথা, মানবদেহের প্রাকৃতিক গঠন সমকামিতার বা পায়ুমিলনের সাথে যায় না, এটা স্বাভাবিক প্র্যাকটিস না। কোনভাবেই প্রাকৃতিক তো নয়ই, বরং প্রকৃতিবিরুদ্ধ, যার বহিঃপ্রকাশ প্রাণঘাতী রোগ উৎপাদন (disease process).

আমরা ফরেনসিক মেডিসিন বইয়ে ‘প্রকৃতিবিরুদ্ধ যৌন অপরাধ’ (Unnatural Sexual Offence) অধ্যায়ে সমকামিতা, পশুকামিতা এসব পড়েছি, ইন্ডিয়ান রাইটারের লেখা বই। আজ ইন্ডিয়া সমকামিতার মত ‘প্রকৃতিবিরুদ্ধ যৌন অপরাধ’-কে অপরাধের লিস্ট থেকে উঠিয়ে দিলেই এর প্রকৃতিবিরুদ্ধতা চলে যাবে, প্রকৃতিবান্ধব হয়ে যাবে, তা না। যা টের পাবে প্রতিটি সমকামী তাদের জীবনের কোন এক পর্যায়ে। ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুর প্রহর গুণবে আর স্মরণ করবে সেই সব অগ্নিঝরা দিনগুলোর কথা, আর অপেক্ষা করবে সামনের অগ্নিঝরা ভবিষ্যতের।

আর তিনারাই তো বিশ্বাস করেন— সারভাইভাল ফর দ্য ফিটেস্ট। পায়ুমিলনে তো ফিটেস্ট কোন প্র্যাকটিস না, প্রজাতির ধারা রক্ষায় এর কোন ভূমিকা নেই। সমকামীরা সামাজিক ও নৃতাত্ত্বিকভাবে আনফিট। মানবসমাজ ও মানবপ্রজাতি রক্ষায় তাদের কোন ভূমিকা নেই। এখন এই আনফিট অংশ মানবপ্রজাতির জন্য অপচয়, ওয়েস্টেজ। আগে হলে হিটলার ও স্ট্যালিন ‘সোশ্যাল ডারউইনিজম’ (আনফিট জনসংখ্যাকে সমাজ থেকে ঝেড়ে ফেলা) এপ্লাই করত।

ভবিষ্যতে এরাও একা একাই বিলুপ্ত হয়ে যাবে, তবে সমাজে যেন এদের প্রভাব না পড়ে সেদিকে লক্ষ্য রাখা দরকার। সমকামিদের প্রতি ইসলামের বিধান এজন্যই দেয়া হয়েছে, যাতে এই ভয়ংকর আনন্যাচারাল রোগ সমাজে ছড়াতে না পারে। টপ ও বটম দুজনকেই হত্যা করার বিধান দেয়া হয়েছে, কেননা একজন বেঁচে থাকলেই সে আরেকজনকে প্ররোচিত করবে।

ইসলামী শাসনব্যবস্থা না থাকায় এই ভয়াবহ অপরাধীদের থাবা থেকে সমাজ আজ নিরাপদ নয়। প্রতিকার সম্ভব নয় বলে আমাদের প্রতিরোধ করতে হবে এই ঘাতক ব্যাধি। আমার আপনার সন্তান যেন এই অপরাধের শিকার না হয়, এই ব্যাধিতে আক্রান্ত না হয়। নোট বেশি বড় হয়ে যাচ্ছে বলে আলোচনা এখানেই শেষ করছি। সমকামিতা প্রতিরোধ, কারণ, করণীয় সম্পর্কে একজন যুগসচেতন আলিমের লেখা আশা করছি। এ বিষয়ে আমার মনের কথাগুলো আমি চাই একজন আলিম বলুক। কিছু বিষয়ে কথা বললে নিজের গায়েই থুথু এসে পড়ে। আত্মসমালোচনার দিক দিয়ে উলামাদের লেখনী এ বিষয়ে আরও ভারসাম্যপূর্ণ হবে ইনশাআল্লাহ।

শেষকথাঃ

নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিখ্যাত হাদিসটা মনে আছে না তাবারানী শরীফের সূত্রেঃ হে ইবনে মাসঊদ, কিয়ামাতের আলামত ও শর্তগুলো হল— এরপর আল্লাহর রাসূল একের পর এক কিয়ামাতের আলামাতসমূহ উল্লেখ করতে থাকেনঃ

– শিশুরা হয়ে যাবে ক্ষিপ্ত, দুর্ব্যবহারকারী
– বৃষ্টি হবে জ্বালাময় (এসিড রেইন)
– মানুষ যোগাযোগ করবে থালার সাহায্যে (ডিশ এন্টেনা)
– এজন্য আত্মীয়তার সম্পর্ক নষ্ট হবে
– বাদ্যযন্ত্র থাকবে মানুষের মাথার উপর (হেডফোন)
– তাদের হৃদয়ে ফিতনা প্রদর্শন করা হবে ‘ম্যাট’ এর মত (টিভি)
– নেতৃত্ব থাকবে সমাজের নিকৃষ্ট লোকদের হাতে
– চোরকে সাধু ও সাধুকে চোর মনে করা হবে
– মুমিনকে ছাগলের চেয়েও বেইজ্জত করা হবে
– তাদের চুল থাকবে ‘বুখতি উট’ এর মত (Bactrian Camel)- আধুনিক ঘোড়া কাট

ভাবার্থ বললাম, এরকম আরও কিছু লক্ষণ উল্লেখ করেন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। তার মধ্যে একটা ছিল— আর রিজালু বির রিজাল, ওয়ান নিসাউ বিন নিসা। পুরুষ পুরুষের সাথে মিলিত হবে, আর নারী নারীর সাথে।

১৪০০ বছর আগেই নবীজীকে জানানো হয়েছিল, কওমে লুত (আঃ) যেমন অফিসিয়ালি সমকাম প্র্যাকটিস করত, ১৪০০ বছর পরে তেমনি অফিসিয়ালি আবার ফিরে আসবে সেই ঘৃণ্য পাপাচার। কী? টেনশন? টেনশন লেনেকা নেহি, স্রেফ দেনে কা হ্যায়। বিজয় ঈমানওয়ালাদেরই হবে নিশ্চিত। সে বিজয়ে আমার কী অবদান রইল, সেটাই টেনশনের বিষয়।
সুবহানাল্লাহ।
সাদাকা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।

আলহামদুলিল্লাহি আলা দীনিল ইসলাম।

লেখক – ড. শামসুল আরেফিন শক্তি 


রেফারেন্সঃ

[1] https://www.webmd.com/women/features/vagina-size#1

[2] Junqueira’s Basic Histology – Text and Atlas (13th Ed), Page 1031, 1034

[3] https://emedicine.medscape.com/article/1990236-overview

[4] Junqueira’s Basic Histology – Text and Atlas (13th Ed), Page 709-710

[5] Daling, J., Weiss, N., Hislop, T., Maden, C., Coates, R., Sherman, K., et al. (1987). Sexual practices, sexually transmitted diseases, and the incidence of anal cancer. The New England Journal of Medicine, 317(16): 973–7.
অস্ট্রেলিয়ান ফেডারেশন অব এইডস অর্গানাইজেশান এর সাইট (https://www.afao.org.au/article/gay-men-anal-cancer/#n17)

[6] https://www.cancer.org/cancer/anal-cancer/causes-risks-prevention/risk-factors.html

[7] ঐ আর্টিকেলেই আছে। বরাতঃ International Journal of Cancer এর দুইটি রিসার্চ পেপার।
(1) De Vuyst, H., Clifford G., Nascimento, M., Madeleine, M., Franceschi, S. (2009). Prevalence and type distribution of human papillomavirus in carcinoma and intraepithelial neoplasia of the vulva, vagina and anus: a meta-analysis. International Journal of Cancer, 124(7), 1626–36.
(2) Hoots, B., Palefsky, J., Pimenta, J., Smith, J. (2009). Human papillomavirus type distribution in anal cancer and anal intraepithelial lesions. International Journal of Cancer, 124(10), 2375–83.

[8] Journal of American Medical Association (JAMA) এর

[9] http://www.cancernetwork.com/gastrointestinal-cancer/anal-cancer-incidence-rising-homosexual-men

[10] http://www.captodayonline.com/Archives/pap_ngc/NGC_analrectalcyto.html

[11] https://emedicine.medscape.com/article/775407-overview#a6

[12] American Journal of Gastroenterology, published online January 12, 2016 এর বরাতে রয়টার্স https://www.reuters.com/article/us-health-analsex-incontinence-idUSKCN0VD2RH

[13] https://www.webmd.com/men/peyronies-disease#1

[14] https://www.urologyhealth.org/urologic-conditions/peyronies-disease

[15] https://nypost.com/2016/02/01/if-this-happens-to-you-youre-masturbating-too-much/

[16] https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC3968922/

[17] https://obgyn.onlinelibrary.wiley.com/doi/abs/10.1034/j.1600-0412.2001.801003.x

[18] https://www.researchgate.net/figure/Recordings-of-vaginal-squeeze-pressure-measured-by-fiberoptic-microtup-transducer_fig1_286686766

[19] https://www.ncbi.nlm.nih.gov/books/NBK424/

[20] https://www.sciencedaily.com/releases/2010/05/100525094900.htm

[21] Lentz, Gretchen M. (2012). Comprehensive Gynecology (6th ed.). Philadelphia, PA: Elsevier. pp. 532–533.

[22] https://www.sciencedaily.com/releases/2010/05/100525094900.htm

 

ইমাম মনসুর শিশানি – ককেশাসের সিংহ

ইমাম মনসুর শিশানি। ১৭৪৮ সালে চেচনিয়ার রাজধানী গ্রোজনীর নিকটে, সুনজা নদী বিধৌত, আলদাই শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার মূল নাম মুহাম্মদ। রাশানরা তাকে ‘আশুরমা’ উপাধি দেয়। আঠার শতকের শেষদিকে রুশদের বিরুদ্ধে যমদূত হয়ে আবির্ভূত হন। ককেশাসের আধ্যাত্মিক সাধক আত্মোৎসর্গী যুবকদের নিয়ে ১৭৮৫ সালে রুশ আধিপত্যবাদীদের বিরুদ্ধে হারাকাত আল-মুরিদিয়্যাহ নামে বিপ্লব কায়েম করেন। প্রথমে রুশ সম্রাজ্ঞী ক্যাটরিন [১৭২৯-১৭৯৬] তার বিপ্লবের প্রতি কোনো ভ্রুক্ষেপ করেনি। কিন্তু রুশ কমান্ডার কলোন্যাল বেরি ইমাম মনসুরের হাতে পরাজিত হবার পর সম্রাজ্ঞীর টনক নড়ে ওঠে!

ইমাম মনসুর ছোটবেলায় দাগিস্তানে কুরআনে কারিম হিফজ করেন। উজবেকিস্তানের বুখারায় ইলমে দীন হাসিল করেন। সেখানেই তিনি হাজার হাজার হাদিস মুখস্ত করেন। পরে নিজ এলাকায় ফিরে আসেন। তিনি নকশবন্দি তরিকার অনুসারী একজন আলেম থেকে ক্রমান্বয়ে চেচনিয়ার জনপ্রিয় একজন আধ্যাত্মিক সম্রাট হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। ককেশাসে ইমাম মনসুর হিসেবে সবার শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে ওঠেন। তিনি অত্যন্ত সাদামাটা জীবনযাপন করতেন। মাটির ঘরে বাস করতেন। কয়েকটি ঘোড়া আর গরু ছাড়া নশ্বর এই দুনিয়ার কোনোকিছুর মালিক ছিলেন না। নিজের সব সম্পদ তিনি জিহাদ ফি সাবিলিল্লায় ব্যয় করতেন।

ইমাম মনসুর দেখতে পেলেন ক্রুশের পূজারি রুশ ক্রমেই গ্রাস করে ফেলছে গোটা ককেশাসের মুসলিম জনপদগুলো। উসমানি খিলাফত তাদের দমাতে পারছে না। ভয়াবহ এই সংকটপূর্ণ মুহূর্তে ককেশাসকে বাঁচাতে প্রতিরোধ যুদ্ধ ছাড়া আর কোনো বিকল্প পথ দেখলেন না তিনি। ককেশাসের প্রায় ৩০টি জাতিগোষ্ঠীর প্রায় সবাই মুসলমান। নিজেরা বিভিন্ন সংস্কৃতি ও ভাষায় বিভক্ত হলেও ইসলাম তাদের প্রধান সেতুবন্ধন। সবাই মুসলিম। ইমাম মনসুর এসব মুসলমানকে একতাবদ্ধ করে রুশ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে জেহাদের ডাক দেন। তার ডাকে সাড়া দেন তার হাজার হাজার মুরিদ।

১৭৮৫ সালে ঐতিহাসিক সুনজা নদীর তীরে রুশ সম্রাজ্ঞী ক্যাটরিনের বিশাল বাহিনীর সাথে তার যুদ্ধ সংঘটিত হয়। রাশানরা ছিল তারচে দশগুণ বেশি। তার মুরিদ মুজাহিদরা রাশনদের ব্যুহ ভেঙে ফেলে। অসংখ্য সৈনিকের মৃতদেহ পেছনে ফেলে রুশ বাহিনী পালিয়ে যায়। মুজাহিদরা বিজয় অর্জন করার পর ইমাম মনসুরের নেতৃত্বে চেচনিয়া, দাগিস্তান, ইঙ্গুশেটিয়া ও উত্তর ককেশাসের আরো কয়েকটি এলাকা নিয়ে একটি স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি ছিল ককেশাসের প্রথম ইমাম শাসিত রাষ্ট্র। কিন্তু রুশ আগ্রাসী শক্তি ছিল নাছোড়বান্দার মতো। তারা আরো বেশি শক্তি নিয়ে হামলা অব্যাহত রাখে। ইমাম মনসুরও বিভিন্ন সীমান্তে প্রতিরোধ যুদ্ধ চালিয়ে যান। সর্বশেষ ১৭৯১ সালে কৃষ্ণ সাগরের তীরবর্তী এক এলাকায় যুদ্ধ করতে গিয়ে ইমাম মনসুর উসমানিদের আনাপা দূর্গে আবস্থান নেন।

রুশ সেনাবাহিনী দীর্ঘদিন এ দুর্গ অবরোধ করে রাখে। অবশেষে দূর্গের পতন হলে ইমাম মনসুরকে বন্দি করা হয়। বন্দি হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি তলোয়ার হাতে বীরবিক্রমে যুদ্ধ করেন। কিন্তু অসংখ্য রুশ সৈন্যের আক্রমণের মুখে টিকতে পারেননি। তিনি যুদ্ধ করতে করতে শাহাদত বরণ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সম্রাজ্ঞীর নির্দেশ ছিল, তাকে যে কোনোভাবে জীবিত বন্দি করতে হবে। তিনি তাকে একনজর দেখতে চান। রুশ সেনারা অনেক কৌশলে ক্ষত-বিক্ষত শরীরে বন্দি করতে সক্ষম হয়। তাকে সেন্ট পিটার্সবার্গে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানকার দুর্ধর্ষ শ্লুসেলবার্গ কারাগারে বন্দি করা হয়।

তাকে রুশ সম্রাজ্ঞী ক্যাটরিনার কাছে মাফ চাইতে প্রস্তাব দেয়া হয়। তিনি তা নাকচ করে দেন। কারাগারেও কয়েকবার বিভিন্ন প্রলোভনের মাধ্যমে চেষ্টা করা হয় সম্রাজ্ঞীর বশ্যতা স্বীকার করাতে। কিন্তু ককেশাসের সিংহ ইমাম মনসুর মাথা নত করেননি। অবশেষে ১৭৯৪ সালে কারাগারেই শাহাদাতবরণ করেন। সম্রাজ্ঞীর নির্দেশে তার কারারক্ষী তাকে হত্যা করে।
——


লেখক – আইনুল হক কাসেমী (বা-রাকাল্লাহু ফি ইলমিহি)
সূত্র: تاريخ القوقاز، نسور الشيشان في مواجهة الدب الروسي- পৃষ্ঠা: ৫৫-৬৪, মাহমুদ আবদুর রহমান


instagram ucuz takipçi satın al

ইলম তলব করা – একটি সুন্নাহকে বাঁচাবো বলে: ৪

একটি সুন্নাহকে বাঁচাবো বলে:৪


এক: নবিজীর (সা.) সবচেয়ে চমৎকার আর মজার সুন্নাত কোনটা?

-আমি বলবো, ইলম তলব করার সুন্নাতটা।

আমরা যখন কিছু পড়ি, তখন খেয়ালই থাকে না, আমরা একটা সুন্নাত আদায় করছি। কী অসাধারণ এক মানুষ আমাদের এই মহানবি। আমাদের প্রতিটা বৈধ কাজকেই তিনি সওয়াবের আওতায় নিয়ে গেছেন।

.

দুই: আমাদের পেয়ারা নবিজী (সা.) বলেছেন:

-যে ব্যক্তি ইলম তলব করার জন্যে পথ চলবে, আল্লাহ তার জন্যে জান্নাতের পথকে সুগম করে দেন।

তিন: আরে কী অসম্ভব সুন্দর একটা কথা! শিখছি আমার প্রয়োজনে, অথচ হাঁটছি জান্নাতের দিকে! কল্পনা করা যায়?

চার: এই সুন্নাতটা আদায় হতে পারে:

(ক) মসজিদে সামান্য সময়ের জন্যে তালীমে বসে।

(খ) নেটের ছোট্ট একটা লেখা পড়ে।

(গ) দেয়ালের এক লাইনের একটা সুন্দর কথা পড়ে।

(ঘ) এমনকি দ্বীনের খিদমাতের উদ্দেশ্যে পড়া ডাক্তারি-ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের একেকটা তথ্য জানলেও সুন্নাত আদায় হতে থাকবে। ইনশাআল্লাহ।

(ঙ) ফেসবুকের একটা দ্বীনি পোস্ট পড়লেও এই সুন্নাত আদায় হবে।

(চ) অডিও-ভিডিও ওয়াজ শুনলেও একটা সুন্নাত আদায় হয়ে যাবে।

(পাঁচ) জান্নাতে যাওয়া, নবিজীর (সা.) সুপারিশ লাভ করাটা তো খুবই সোজা! আলহামদুলিল্লাহ।

*** ইয়া রাব! আমাদেরকে এই সুন্দর সুন্দর, মজার মজার সুন্নাহগুলো নিয়মিত আমলে নিয়ে আসার তাওফীক দান করুন। আমীন।

আমাদের শি‘আর (স্লোগান) হলো:

– ইন তুতীঊহু তাহতাদু (وَإِنْ تُطِيعُوهُ تَهْتَدُوا): যদি তার (নবিজীর) অনুসরণ করো, হিদায়াত পেয়ে যাবে


================
লেখক – শাইখ মুহাম্মদ আতিক উল্লাহ্‌
শিক্ষক – মাদরাসাতুল কুরআনিল কারীম,
শ্যামলী,ঢাকা।


একটি সুন্নাহকে বাঁচাব বলে সিরিজ

পর্ব ০১ – তাহলীলের সুন্নাহ
পর্ব ০২ –অন্যকে আহার করানো
পর্ব ০৩ – আযানের পাঁচ সুন্নাহ
পর্ব ০৪ – ইলম তলব করা
পর্ব ০৫ – মিলিয়ে দেয়া
পর্ব ০৬ – দ্রুত ইফতার করা

 

instagram türk takipçi satın al

তিনি ছিলেন তাঁর সময়ের একজন ‘সেলিব্রিটি’ – আরিফুল ইসলাম

তিনি ছিলেন তাঁর সময়ের একজন ‘সেলিব্রিটি’। তিনি যে পারফিউম ব্যবহার করতেন সেটা এতোটাই ইউনিক ছিলো যে, রাস্তা দিয়ে কেউ হেঁটে গেলে বুঝতে পারতো, একটু আগে ‘তিনি’ এই রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেছেন।

এই সময়ে ‘সোনার চামচ’ মুখে নিয়ে জন্মানো একজন ছেলের যে ফিচারগুলো থাকতে পারে: হাতে Rolex এর ঘড়ি, পকেটে i-phone X, পরনে Armani স্যুট, আর Lambirghini কার।

আমাদের আজকের গল্পের মানুষটিও ‘সোনার চামচ’ মুখে নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।

মুস’আব ইবনে উমাইর রাদিয়াল্লাহু আনহু। আরবের প্রখ্যাত কুরাইশ বংশে জন্মগ্রহণ করেন। বড়লোক বাবা-মা’র সন্তান। তখনকার সবচেয়ে দামী জামা গায়ে দিয়ে তিনি যখন রাস্তা দিয়ে হাঁটতেন, তাঁর জামা তখন রাস্তার ধুলোময়লা মুছে নিয়ে যেতো। এতো বড় জামা ছিলো যে, জামা মাটি পর্যন্ত গড়াতো। জুতোর ক্ষেত্রে তখনকার সময়ের সবচেয়ে মূল্যবান ব্রান্ড ছিলো ইয়েমেনী জুতোর। তাঁর পায়ে সেরা ব্রান্ডের সেরা জুতো থাকতো। তিনি যে সুগন্ধি ব্যবহার করে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতেন, সেই সুগন্ধির সুভাষ অনেকক্ষণ রাস্তায় থেকে যেতো। মানুষ বুঝতে পারতো, এই রাস্তা দিয়ে একটু আগে মুস’আব হেঁটে গেছেন।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সম্পর্কে বলেন, “মক্কায় মুস’আবের চেয়ে সুদর্শন আর উৎকৃষ্ট পোশাকধারী আর কেউ ছিলো না।”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন কালিমার দাওয়াত দেওয়া শুরু করলেন, সেই খবর মুস’আবের কাছে পৌঁছলো। তিনি চলে গেলেন দারুল আরকামে, যেখানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবীদের নিয়ে মিটিং করতেন।

দারুল আরকাম, যাকে এখনকার সময়ের টাউন হল মিটিং এর সাথে তুলনা করা যায়। সেখানে গিয়ে দেখা হলো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে প্রথম সাক্ষাৎ এ মুস’আব ইবনে উমাইর (রাদিয়াল্লাহু আনহু) ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা দেন।

এটা ছিলো সেই সময় যখন কেউ মুসলমান হলে তাঁর উপর নেমে আসতো অকথ্য নির্যাতন। খাব্বাব রাদিয়াল্লাহু আনহুর চামড়া পোড়ানো হয়েছে, বিলাল রাদিয়াল্লাহু আনহুকে উত্তপ্ত রোদের মধ্যে অত্যাচার করা হয়েছে।

এইরকম সময়ে একজন মানুষ যিনি এখনকার সময়ের কথা চিন্তা করলে বলা যায় এসির রুমে বসে থাকার কথা, তিনি কিনা নিজের জীবনকে ‘ঝুঁকি’র মধ্যে ফেলে দিয়ে সাক্ষী দিচ্ছেন ‘আল্লাহ ছাড়া কোনো মা’বুদ নাই’!

সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মগ্রহণ করা মুস’আব ইবনে উমাইর এর ইসলাম গ্রহণের কথা তাঁর মা খুন্নাস বিনতে মালিক জেনে যান। মা তাকে একটা ঘরের মধ্যে বন্দি করে রাখেন এবং চাপ প্রয়োগ করতে থাকেন ইসলাম ত্যাগ করার জন্য।

কিন্তু যে মুস’আব সত্যের সন্ধান পেয়েছেন তিনি কিভাবে পারেন এই বন্দিত্বের শৃঙ্খলের ভয়ে সত্য ত্যাগ করতে? মায়ের প্রস্তাব কোনোভাবে মানলেন না তিনি।

একদিন গার্ডরা তাঁর বাঁধন কিছু সময়ের জন্য খুলে দিলে এই সুযোগ লুফে নিলেন মুস’আব। ছুটলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে। তখন মুসলমানদের একটা দলকে আবিসিনিয়ায় হিজরতে পাঠানো হচ্ছে। মক্কার নিরাপদ জীবন, আর নিজের সমস্ত সম্পদের মায়া ত্যাগ করে পলিটিকাল রিফিউজি হিসেবে পাড়ি জমান আবিসিনিয়ায়।

গুজবে কান দিয়ে তিনি যখন আবিসিনিয়া থেকে মক্কায় ফিরেন তখন আবার দেখা হলো তাঁর মায়ের সাথে। মা আবার তাকে বন্দি করার ভয় দেখান। তিনি মাকে ইসলামের দাওয়াত দেন এবং পাল্টা হুমকি দেন, গার্ডরা যদি তাকে বন্দি করতে চায় তাহলে তিনি তাদেরকে হত্যা করবেন।

ছেলের মুখ থেকে এমন কথা শুনে মা রেগে বললেন, “এখন থেকে তাহলে তোমাকে কোনো সম্পদ দেওয়া হবেনা, তুমি সম্পত্তির উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত”।

যে মুস’আব আড়ম্বরপূর্ণ জীবনযাপন করতেন, ইসলাম গ্রহণের জন্য সেই মুস’আবকে তাঁর মা ‘ত্যাজ্যপুত্র’ ঘোষণা করেন! অভাব অনটনের কথা চিন্তা না করে মুস’আব (রাদিয়াল্লাহু আনহু) ইসলামের প্রতি অটল থাকেন।

একবার মুস’আব (রাদিয়াল্লাহু আনহু) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একটা মিটিং এ উপস্থিত হন। তাকে দেখে সাহাবীরা চোখ নামিয়ে ফেলেন, কেউ কেউ কান্না শুরু করেন। কারণ তাঁর পরনে ছিলো তালি দেওয়া এক জীর্ণ জোব্বা। যে মুস’আব আরবের সবচেয়ে দামী জামা পরতেন, যে মুস’আব ছিলেন আরবের একজন মডেল, ইসলাম গ্রহণ করার পর সেই মুস’আবের গায়ে কিনা তালি দেওয়া এক জীর্ণ জামা!

ইসলাম মেনে চলতে গিয়ে নিজের বিলাসী জীবন ত্যাগ করতে বিন্দুমাত্র বিচলিত ছিলেন না এই সাহাবী।

তাকে এই অবস্থায় দেখে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “…মুস’আব এসবকিছু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ত্যাগ করে এসেছে এবং সে রাসূলের কাজে নিবেদিত করেছে।”

প্রথম আকাবার শপথের পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুস’আব ইবনে উমাইর রাদিয়াল্লাহু আনহুকে ইসলামের প্রথম এম্বাসেডর হিসেবে মদীনায় প্রেরণ করেন। তাঁর প্রচেষ্টায় মদীনার অনেকেই ইসলাম গ্রহণ করে।

উহুদ যুদ্ধের দিন মুস’আব ইবনে উমাইর রাদিয়াল্লাহু আনহু পান ইসলামের পতাকা বহন করার মহান দায়িত্ব। যুদ্ধের ময়দানে যখন গুজব রটলো, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শাহাদত বরণ করেছেন তখন অনেক সাহাবী যুদ্ধ করা থেকে বিরত থাকলেন। কিন্তু মুস’আব ইবনে উমাইর রাদিয়াল্লাহু আনহু যুদ্ধ চালিয়ে যেতে লাগলেন আর ঘোষণা করতে লাগলেন ‘ওয়ামা মুহাম্মাদুন ইল্লা রাসূল, কাদ খালাত মিন কাবলিহির রাসূল’ – মুহাম্মদ একজন রাসূল ছাড়া কিছুই নন, তাঁর পূর্বে বহু রাসূল অতিবাহিত হয়েছেন।

কাফিররা তাঁর ডান হাত কেটে ফেললে তিনি বাম হাতে পতাকা তুলে ধরেন। তাঁর বাম হাতটি কেটে ফেললে তিনি দুই হাতের বাহুর মাঝখানে ইসলামের ঝাণ্ডা তুলে ধরেন। এক পর্যায়ে একটা তীর এসে তাকে আঘাত করে। তীরের আঘাতে তিনি শহীদ হন। (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজীউন)

যুদ্ধ শেষে যখন লাশগুলো দাফনের ব্যবস্থা করা হচ্ছিলো, তখন মুস’আব (রাদিয়াল্লাহু আনহুর) জন্য ছিলো মাত্র এক টুকরো কাপড়। যে কাপড় দিয়ে মাথা ঢাকলে পা খালি থেকে যায়, পা ঢাকলে মাথা খালি থেকে যায়।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঐ টুকরো কাপড় দিয়ে তাঁর মাথা আর ‘ইখলিস’ নামক ঘাস দিয়ে পা ঢেকে দিতে বলেন।

তিনি কাঁদতে কাঁদতে তেলাওয়াত করেন:

مِّنَ الْمُؤْمِنِينَ رِجَالٌ صَدَقُوا مَا عٰهَدُوا اللَّهَ عَلَيْهِ ۖ فَمِنْهُم مَّن قَضٰى نَحْبَهُۥ وَمِنْهُم مَّن يَنتَظِرُ ۖ وَمَا بَدَّلُوا تَبْدِيلًا

মুমিনদের মধ্যে কিছু লোক রয়েছে যারা আল্লাহর সাথে কৃত তাদের প্রতিশ্রুতি সত্যে বাস্তবায়ন করেছে। তাদের কেউ কেউ [যুদ্ধে শাহাদাত বরণ করে] তার দায়িত্ব পূর্ণ করেছে, আবার কেউ কেউ [শাহাদাত বরণের] প্রতীক্ষায় রয়েছে। তারা (প্রতিশ্রুতিতে) কোন পরিবর্তনই করেনি।
[ সূরা আহযাব ৩৩:৩৩]

তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘোষণা দেন, “আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি এরাই হলো শহীদ। তোমরা আসো, তাদের দেখে যাও। সেই সত্তার শপথ যার হাতে আমার প্রাণ, কিয়ামতের আগ পর্যন্ত যারাই তাদেরকে সালাম দেবে, তাদেরকে তারা সালামের উত্তর প্রদান করবে।”

আসসালামু আলাইকুম ইয়া মুস’আব
আসসালামু আলাইকুম মা’শার আশ-শুহাদা।
– আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হোক হে মুস’আব
– সকল শহীদদের উপর শান্তি বর্ষিত হোক।

[ইসলাম মেনে চলতে গিয়ে যখন সুদ খাবার অফার আসে, ইসলাম মানতে গিয়ে যখন ঘুষ খাবার অফার আসে, ইসলাম মানতে গিয়ে যখন হারাম উপার্জনের অফার আসে তখন আমরা মুস’আব ইবনে উমাইর রাদিয়াল্লাহু আনহুর কথা স্মরণ করতে পারি।
ইসলাম মানতে গিয়ে যিনি বিসর্জন দিয়েছিলেন বিলাসী জীবন, ইসলাম মানতে গিয়ে যিনি ‘নিরাপদ’ ক্যারিয়ারের মায়া ত্যাগ করে বেছে নিয়েছিলেন দুর্গম পথ।

ইসলাম মানতে গিয়ে যখন দেখবো জীবন সংকটময় হয়ে উঠছে, যখন দেখবো আয়-উপার্জনের রাস্তা সংকুচিত হয়ে আসছে তখন স্মরণ করতে পারি এই মহান সাহাবীকে; ইসলাম গ্রহণের আগে যার জামা মাটির ধুলোবালি মুছে নিতো আর ইসলাম গ্রহণের পর দাফনের সময় শরীর পুরোপুরি ঢাকার মতো জামা ছিলো না।]


instagram garantili takipçi satın al

এক নারীর কারণে মুসলমান হলো পুরো গ্রাম

ইথিওপিয়ার নারী ‘হালিমি গোবো সোরা’ ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার পর গ্রামের অধিবাসীদের মধ্যে ইসলাম ধর্মের প্রচার করতে শুরু করেন। তার তাবলিগের ফলে তার প্রতিবেশী এবং গ্রামের সকলে মুসলমান হন।

ইথিওপিয়ার হালিমি ইসলাম ধর্ম গ্রহণের পর নিজের নাম পরিবর্তন করে ‘রাবেয়া’ রাখেন। দেশটির ইয়াবিলু শহরের অদূরে সিমু গ্রামে ৫ সন্তানকে নিয়ে তিনি বসবাস করেন।

ইসলাম ধর্ম গ্রহণের পর তিনি প্রথমে নিজের পরিবার ও আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে দাওয়াত শুরু করেন এবং ইসলাম ধর্মের প্রতি আমন্ত্রণ জানান। তার পরিবারের অন্যান্য সদস্য এবং আত্মীয়রা ইসলাম ধর্ম গ্রহণের পর রাবেয়া তার গ্রামে দীনের দাওয়াত শুরু করেন।

রাবেয়া বলেন, এই গ্রামে অনেকবার খৃস্টান ধর্মের প্রচারক গ্রুপ আসে। তাদের নির্দয় আচরণ এবং অনৈতিকতার কারণে বেশ কয়েকবার পরিলক্ষিত করেছি। কিন্তু মুসলমানদের মধ্যে এটা কখনোই দেখতে পায়নি।

মুসলমানদের সুন্দর আখলাকের কারণেই তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন এবং তিনি আশা করছেন গ্রামের সব মুসলিম প্রতিবেশীর সাথে নিরাপত্তা এবং সম্মানের সাথে জীবন যাপন করতে পারেন।

উল্লেখ্য, ইথিওপিয়া আফ্রিকার একটি দেশ। এটি আফ্রিকার দশম বৃহত্তম দেশ। এই দেশের রাজধানী ‘আদিস আবাব’। সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী দেশটির মোট জনসংখ্যার ৩৩ শতাংশ জনগণ মুসলমান।
আওয়ার ইসলাম

ঈশ্বর আসলে কে, এই কৌতুহল আমাকে ইসলামের ছায়াতলে নিয়ে আসে

মর্নিং ওয়ার্কের জন্য কাতজা তার বন্ধু আহমেদের জন্য রেস্টুরেন্টে বসে অপেক্ষা করছেন আর একটু একটু করে কফিতে চুমুক দিচ্ছেন। এমন সময় সূর্যের আলো তার ফ্যাকাশে চামড়া উপর ঝিকমিক করছিল। বন্ধু আহমেদ সকালের প্রার্থনার মসজিদে যাওয়ায় তাকে সেখানে বসে অপেক্ষা করতে হচ্ছিল।

আযান শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রেস্টুরেন্টের ওয়েটাররা ধীরেসুস্থে মসজিদটির দিকে এগিয়ে যায়। মিশরের এই দৃশ্য তাকে আবেগে আচ্ছন্ন করে ফেলে। এটি যে তার রাশিয়ার কানস্ক শহর থেকে অনেকটাই আলাদা। রাশিয়ার সাইবেরিয়ায় তুষারময় শহর কানস্ক শহর ছেড়ে একটি স্বেচ্ছাসেবক সফরের জন্য তাকে মিশর যেতে হয়েছিল।

শিশুদের জন্য একটি এনজিওতে কাজ করার কাদজা সেখানে ৪০ দিন ব্যয় করেছিলেন। এসময়ে তিনি সেখানে অসংখ্য মুসলিম বন্ধু তৈরি করেন। তিনি এসব মুসলিমের জীবন ধারাকে অত্যন্ত কাছ থেকে দেখতে পান। এরপর হঠাৎ করেই তার মনে প্রশ্নের জন্ম দেয়।

তিনি বলেন, ‘আমি ছিলাম একজন অর্থডক্স খ্রিস্টান। কিন্তু আমি ঈশ্বরকে বিশ্বাস করি নি এবং হঠাৎ করেই আমি প্রায় সব কিছু নিয়ে নিজেকে প্রশ্ন করি। ঈশ্বর সম্পর্কে আমার মুসলিম বন্ধুদের কথা আমার মনে আগ্রহ জন্মায়। এই ঈশ্বর আসলে কে- তা জানতে আমি অত্যন্ত কৌতুহলী হয়ে উঠি।’

তিনি আরো বলেন, ‘সেখান থেকে রাশিয়ায় ফিরে আসার পর আমি পুনরায় মিশরে ফিরতে ছটফট করতে থাকি। আমি কিছুতেই রাশিয়ায় অবস্থান করতে পারছিলাম না এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষ করা মাত্রই আমি মিশরে ফিরে আসি।’

কোনো চাকরি বা থাকার জায়গা নিশ্চিত না হওয়া সত্ত্বেও ২১ বছর বয়সী শিক্ষক কায়রোতে চলে যান এবং ‘আধ্যাত্মিক যাত্রা’ শুরু করেন।

তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘এটি ছিল এমন একটি মুহূর্ত যে সময়ে আমি বুঝতে পারছিলাম না কি করতে হবে। আমি নিজেকে জিজ্ঞাসা করতে শুরু করেছিলাম: জীবনের উদ্দেশ্য কী, কেন আমি এখানে? আমার ভিতরে এমন এক শূন্যতা ছিল যা আমার চারপাশের সবকিছুকে প্রভাবিত করেছিল।’

কাতজা’র অনুসন্ধান প্রথমেই তাকে ক্যাথলিক চার্চে নিয়ে যায়। তিনি তার একজন বন্ধুকে নিয়ে চার্চের একটি অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু রাশিয়ান একটি মুসলিম পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাতের পর তার সবকিছুই পরিবর্তিত হয়ে যায়।

তিনি বলেন, ‘আমি অন্য ধর্ম গ্রহণ করতে পারতাম, কিন্তু ইসলাম আমার অধিকাংশ প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিল এবং সঠিক ও ভুল সম্পর্কে আমার মধ্যে যে যুদ্ধ চলছিল তা বন্ধ করে দিয়েছে। ইসলাম খুবই স্পষ্ট এবং যখন আপনি ভয় ও কঠিন চাপের মধ্যে থাকেন, তখন এটি আপনার আত্মাকে শান্তি দেয়।’

তিনি আরো বলেন, ‘আমি যা পছন্দ করি তা হচ্ছে আল্লাহর কাছে যাওয়ার রাস্তা। আমি বুঝতে পারছিলাম যে আমি প্রার্থনা করতে চেয়েছি, কিন্তু কিভাবে করতে হবে আমি তা জানতাম না।

ইসলামে একটি নির্দিষ্ট ধর্ম পদ্ধতি রয়েছে। আপনাকে নির্দিষ্ট পোশাক পরতে হবে এবং একটি নির্দিষ্ট ভঙ্গিতে বসতে হবে। এটি শিক্ষা দেয় যে আপনাকে আপনার জীবন আল্লাহর জন্য ত্যাগ করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, এটা অনেকটা আপনার স্বামী থাকার মতোই। সম্পর্ক লালন পালন করতে একে অপরকে কিছু সময় উৎসর্গ করতেই হবে।’

ধর্মান্তরের পর কাতজা তার জীবনধারার মধ্যে এক অসাধারণ পরিবর্তনকে লক্ষ্য করেন নি এবং উপলব্ধি করতে পারেন- কেন তার বন্ধুরা সবসময় বলত যে ধর্মান্তর আগেই তিনি একজন মুসলিম চিন্তার মানুষে পরিণত হয়েছেন।

কাতজা বলেন, ‘আমি অ্যালকোহল পান করতাম না। আমি এমন এক সংস্কৃতি থেকে এসেছি যেখানে অধিকাংশ মানুষই মদ পান করেন এবং আমি দেখেছি যখন লোকেরা খুব বেশি মদ পান করে তখন কি ঘটেছে। আমার একমাত্র চ্যালেঞ্জ ছিল আমার পরিবারকে জানানো।’

====================================
কায়রো সিন অবলম্বনে
কৃতজ্ঞতা – Revert stories:journey to islam


instagram gerçek takipçi satın al

ইহুদী ফরাসী নারী লায়লা হুসাইন এর ইসলাম গ্রহণের মর্মস্পশী কাহিনী

ইহুদী ফরাসী নারী লায়লা হুসাইন এর ইসলাম গ্রহণের মর্মস্পশী কাহিনী

ইসলামের আলোকিত বিধি-বিধান, বিশ্বাস, সংস্কৃতি এবং নানা প্রথা যুগ যুগ ধরে সত্য-সন্ধানী বহু অমুসলিম চিন্তাশীল মানুষকে আকৃষ্ট করেছে। যেমন, জ্ঞান-চর্চার ওপর ইসলামের ব্যাপক গুরুত্ব আরোপ অনেক অমুসলিম গবেষককে অভিভূত করেছে। ইসলামী হিজাব বা শালীন পোশাক তথা পর্দার বিধানও আকৃষ্ট করে আসছে অমুসলিম নারী সমাজকে। ফরাসি নারী লায়লা হোসাইনও ওদের মধ্যে একজন।

পাশ্চাত্যের বঞ্চিত ও প্রতারিত নারী সমাজ ইসলামী শালীন পোশাকের মধ্যে প্রশান্তি, নিরাপত্তা ও পবিত্রতা খুঁজে পাচ্ছেন। পাশ্চাত্যের অনেক নারীই সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, তারা এই পশ্চিমা ভূবনে মুসলিম মহিলাদের হিজাব দেখেই ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে জানতে আগ্রহী হয়েছেন।

ইসলাম ধর্ম গ্রহণের পর তারা বলেছেন, আমরা হিজাবের মধ্যে সত্যিকারের সুখ, প্রশান্তি ও নিরাপত্তা অনুভব করছি। ইসলামী হিজাবের এই প্রভাবের কারণে পশ্চিমা সরকারগুলো নানা অজুহাতে হিজাব পরিহিতা নারীদের ওপর সীমাবদ্ধতা আরোপ করছে। এ ছাড়াও এসব সরকার পর্দানশীন নারীদেরকে একঘরে করার ও দমিয়ে রাখার চেষ্টা করছে।

ফরাসি নও-মুসলিম লায়লা হোসাইন ছিলেন একজন ইহুদি। টেলিভিশনে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, হিজাবের সৌন্দর্য দেখেই তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন এবং বেছে নিয়েছেন পরিপূর্ণ হিজাব।

লায়লা হোসাইন বলেছেন, ‘মুসলমানদের সম্পর্কে সব সময়ই এক ধরনের বীতশ্রদ্ধা ছিল আমার মধ্যে। আমি এভাবেই বড় হয়েছি। কিন্তু আমি সব সময়ই হিজাব পরা মুসলিম নারীদের প্রতি আকৃষ্ট ছিলাম। তাদের পবিত্রতা ও বিনম্রতা আমাকে মুগ্ধ করত’।

‘আমার দৃষ্টিতে তাদের রয়েছে এক ধরনের নিজস্ব সৌন্দর্য। আমি ইহুদি সমাজের সদস্য হওয়ায় ইসলামী হিজাব রপ্ত বা আয়ত্ত্ করা আমার জন্য কঠিন কাজ ছিল না। কিন্তু ঈমান বা বিশ্বাস সম্পর্কে মানুষের ধারণাগুলো সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের। তারা (অর্থাৎ ইহুদিরা) মুসলিম মহিলাদের চেয়ে ইহুদি মহিলাদেরকেই বেশি শ্রদ্ধা করত।’

ইসলামের অন্য অনেক সৌন্দর্য গবেষণার মাধ্যমে স্পষ্ট হয় লায়লা হোসাইনের কাছে। পবিত্র কোরআন অধ্যয়ন ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব উপলব্ধিতে তাকে সহায়তা করেছে। তিনি বলেছেন, ‘কোরআন ছিল আমার প্রথম অনুপ্রেরণা। যেসব সাক্ষ্য-প্রমাণ আমি পেয়েছি তা থেকে বুঝতে পেরেছি যে, ইসলাম সত্য ও খাঁটি ধর্ম।

কারণ, এ ধর্ম সব নবী-রাসূলকেই শ্রদ্ধা করে। আর আমার দৃষ্টিতেও এটা খুবই যৌক্তিক। ধীরে ধীরে আমার কাছে এটা স্পষ্ট হয় যে ইসলামের শুধু বাহ্যিক দিক নয়, আছে অভ্যন্তরীণ দিকও। তাই ভেতর থেকেও ইসলামকে রক্ষা করতে হবে।’

ইসলামে মানুষের আত্মা ও দেহ- উভয়ই গুরুত্ব পেয়েছে। প্রকৃত মুসলমান হওয়ার জন্য ইসলামী বিশ্বাসের শুধু মৌখিক স্বীকৃতি ও বাহ্যিক আচার-আচরণ বা ইবাদতই যথেষ্ট নয়। মন বা হৃদয়ের গভীরে ইসলাম কতটা স্থান করে নিয়েছে-লায়লা হোসাইনের মতে তাও গুরুত্বপূর্ণ।

পশ্চিমা সরকারগুলো ইসলাম সম্পর্কে সঠিক চিত্র তুলে না ধরায় নও-মুসলিমরা অনেক সমস্যার শিকার হন। কিন্তু ইসলামের সৌন্দর্য ও বাস্তবতা নওমুসলিমদের কাছে এতই হৃদয়গ্রাহী যে সব ধরনের কঠোরতা, ক্লেশ ও বাধা-বিঘ্ন সহ্য করা তাদের জন্য সহজ হয়ে পড়ে।

লায়লা হোসাইন এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘হিজাব পরার মাধ্যমে আমি নিজেকে অনেক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করছি-এই ভেবে আমার পরিবার উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। কারণ, ফ্রান্সে হিজাব নিষিদ্ধ। স্কার্ফ বা ওড়না মাথায় দিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কর্মস্থলে যাওয়া এ দেশে নিষিদ্ধ, ফলে হিজাবধারীকে সামাজিক অনেক অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে হয়। শুধু বিশেষ পোশাক পরার কারণে আমি আমার সামাজিক জীবনকে বিপদাপন্ন করেছি বলে আমার পরিবার মনে করত। এ অবস্থা মেনে নেয়া তাদের জন্য খুবই কষ্টকর ছিল।’

‘তারা মনে করত আমি আমার মুসলমান হওয়ার বিষয়টি হিজাবের মাধ্যমে প্রকাশ না করলেই ভাল হত। ইসলামের প্রতি আমার বিশ্বাস কেবল মনের মধ্যে লালন করলেই তা যথেষ্ট হত বলে তারা মনে করত। কিন্তু আমার কাছে বিষয়টি ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’

‘কারণ, পবিত্র কোরআনে ও রাসূল (সা.)’র অনেক হাদিসে বা সুন্নাতে হিজাবের ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। মুসলিম পরিচয়ের জন্যেও যে তা জরুরি তা স্পষ্টভাবে বলা হয়েছ কোরআন-হাদিসে। তাই হিজাব পরিত্যাগ করতে রাজি হইনি আমি। আমার কাছে হিজাব শুধু হাত ও মাথা ঢাকার বিষয় নয়, বরং এর চেয়েও বড় কিছু।’

ইসলামের সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হয়ে অনেক ইহুদি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করছেন। এ ধরনের ঘটনা দিনকে দিন বাড়ছে। কিন্তু বর্তমান যুগে প্রচলিত ইহুদি ধর্ম (যা আসলে আদি বা অকৃত্রিম ইহুদি ধর্ম নয়) অনুযায়ী এ ধর্ম ত্যাগ করা যায় না। ফলে নও-মুসলিম ইহুদিরা অনেক সমস্যার শিকার হচ্ছেন।

তাসুয়ি ইহুদা লাভ নামের একজন ইহুদি পুরোহিত বলেছেন, ইহুদির মেয়েরা অন্য ধর্ম গ্রহণের পরও ইহুদি থেকে যায়। কারণ, ইহুদি ধর্ম অনুযায়ী, ইহুদি মায়ের গর্ভে জন্ম নেয়া ইহুদি অন্য ধর্ম গ্রহণ করার পরও ইহুদি থেকে যায়।

এ ছাড়াও বিশ্বের ইহুদিদের অভিভাবক হওয়ার দাবিদার দখলদার ইহুদিবাদী ইসরাইল ফিলিস্তিনের বাইরে ইহুদিদের ইসলাম ধর্ম গ্রহণ ঠেকানোর জন্য ব্যাপক ব্যবস্থা ও পদক্ষেপ নিয়েছে।

তা সত্ত্বেও ইসরাইলি দৈনিক মারিভ সম্প্রতি লিখেছে, ‘ইসরাইলের ভেতরেই প্রতি বছর শত শত ইহুদি নিজ ধর্ম ত্যাগ করে ধর্মীয় পরিচয় পরিবর্তনের ও ইসলাম ধর্ম গ্রহণের জন্য ইসরাইলি বিচার-বিভাগের কাছে আবেদন জানাচ্ছে। ইসরাইলি ইহুদিদের মধ্যে এ ধরনের আবেদনের সংখ্যা ২০০৮ সালে উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে।’

‘আবার অনেক ইহুদি ধর্ম পরিবর্তন সংক্রান্ত এ ধরনের আবেদন করছেন না, কিংবা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে গেলে যেসব সীমাবদ্ধতা ও হয়রানির শিকার হতে হবে তা এড়ানোর জন্য এ পবিত্র ধর্ম গ্রহণের কথা প্রকাশ করছেন না।’

গবেষণায় দেখা গেছে, ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরাইলি হত্যাযজ্ঞ ও সহিংসতা এবং ইহুদিবাদীদের হাতে তাদের সম্পদ দখল ও লুণ্ঠনের ঘটনাগুলো অধিকৃত ফিলিস্তিনে আসা ইহুদিদেরকে বিকৃত হয়ে পড়া ইহুদি ধর্ম ত্যাগের অন্যতম প্রধান চালিকা শক্তি হিসেবে ভূমিকা রাখছে।

ইহুদিদের মধ্যে অন্য ধর্ম গ্রহণের প্রবণতা বাড়তে থাকায়, বিশেষ করে ইসলামের আকর্ষণ তাদের মাঝে বাড়তে থাকায় ইহুদিবাদী ইসরাইল অ-ইহুদি বিয়ে করাকে ইহুদি যুব সমাজের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। অ-ইহুদি স্বামী বা স্ত্রীর প্রভাবে ইহুদি যুব সমাজ নিজ ধর্ম ত্যাগ করছে বলেই ইসরাইল তা ঠেকাতে এ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।

ইহুদিবাদী রাজনৈতিক নেতা আভরি আভরবাখ বলেছেন, প্রত্যেক ইহুদির নিজ ধর্ম ত্যাগের ঘটনা ইহুদি গ্রুপগুলোর জন্য অত্যন্ত বেদনাদায়ক ক্ষতি বয়ে আনছে।

কিন্তু লায়লা হোসাইনের মতে, সত্য ধর্ম তার স্বচ্ছতা ও স্পষ্ট নানা শিক্ষার কারণেই মানুষের অন্তর জয় করছে এবং জীবন, ভালবাসা ও বিশ্বাসের প্রকৃত অর্থ তুলে ধরছে।

পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেছেন, ‘তারা তাদের মুখের ফুৎকারে আল্লাহর নূরকে নিভিয়ে দিতে চায়। কিন্তু আল্লাহ অবশ্যই তাঁর নূরের পূর্ণতা বিধান করবেন, যদিও কাফেররা তা অপছন্দ করে।’

লায়লা হুসাইন এর সাক্ষাত এখানে

====================================
কৃতজ্ঞতা – Revert stories: journey to Islam


instagram düşmeyen takipçi satın al