পৃথিবীতে আগমনের পূর্বেই বিভিন্ন আসমানি কিতাবে নবী জির আগমনের সুসংবাদ ও আলামত লিপিবদ্ধ ছিল। সর্বপ্রথম যেই রমজানে নবীজির ওপর ওহি অবতীর্ণ হয়, জিবরাইলের প্রচ- চাপায় নবীজি জ্বরে আক্রান্ত হন। শরীরে কম্পন আরম্ভ হয়। কোনো মতে বাড়িতে এসে হযরত খাদিজাকে বললেন, আমাকে কম্বল দিয়ে জড়িয়ে দাও। হযরত খাদিজা নবীজিকে কম্বলে জড়িয়ে দিলেন। কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ার পরে নবীজি খাদিজার নিকট ওহি অবতীর্ণ হওয়ার ঘটনা খুলে বললেন। আতঙ্কিত কণ্ঠে নবীজি বললেন, আমি জীবনের আশঙ্কা করছি।

হযরত খাদিজা ছিলেন এক মহীয়সী ও বিদুষী নারী। একজন আদর্শ স্ত্রী। নবীজির মানসিক বিপর্যয়ের এই মুহূর্তে তিনি নবীজিকে পরম সান্ত¡নার বাণী শোনালেন। তিনি বললেন: আল্লাহর কসম, তিনি কখনো আপনাকে লাঞ্ছিত করবেন না। আপনি আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করেন। সর্বদা সত্য কথা বলেন। অসহায় মানুষের বোঝা বহন করেন। আপনি বিশ্বস্ত। আপনি আমানতদার। মেহমানদের আপ্যায়ন করেন। মানুষকে সাহায্য করেন। যার মধ্যে এমন সুন্দর চরিত্রমাধুরি বিদ্যমান সে কখনো লাঞ্ছিত হবে না।

হযরত খাদিজার কথায় নবীজি সান্ত¡না লাভ করলেন। এরপরে হযরত খাদিজা তার চাচাত ভাই ওয়ারাকা ইবনে নওফেলের কাছে গেলেন। ওয়ারাকা ছিল একজন খ্রিস্টান ধর্মযাজক। ইঞ্জিল ও তাওরাতের প-িত। মূর্তিপূজা পছন্দ করত না। বয়সের ভারে ন্যূব্জ ও অন্ধ ওয়ারাকা ঘটনার বিবরণ শুনে বলল, তুমি যদি সত্য বলে থাক তাহলে তাঁর কাছে সেই ফেরেশতা এসেছেন যিনি হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের কাছে আগমন করতেন।

পরে নবীজির থেকে ঘটনার বিবরণ শুনে ওয়ারাকা বলল, হায়, আমি যদি তোমার নবুয়তির সময়ে শক্তিমান ও সক্ষম থাকতাম, যখন তোমার সম্প্রদায় তোমাকে দেশান্তরিত করবে অন্তত তখন যদি আমি জীবিত থাকতাম! নবীজি আশ্চর্য হয়ে জানতে চাইলেন, আমাকে দেশ থেকে বের করে দেওয়া হবে!

মক্কার মানুষ ছিল মূর্তিপূজক। তাদের কাছে আসমানি কিতাবের জ্ঞান ছিল না। নবীজি ইসলাম প্রচার শুরু করলে বিষয়টি যাচাইয়ের জন্য তারা নযর ইবনে হারিস ও উকবা ইবনে আবি মুয়িত নামে দুই ব্যক্তিকে মদীনায় ইহুদি ধর্মের প-িতদের কাছে প্রেরণ করল। যেন তারা আসমানি কিতাবের আলোকে নবীজির নবুয়তির সত্যতা বা অসারতা প্রমাণ করে। মদীনার ইহুদি আলেমরা তাদের বলল: মুহাম্মাদকে এই তিনটি প্রশ্ন করবে :
১. কারা গুহায় আত্মগোপন করেছিল?
২. কোন মহান ব্যক্তি পৃথিবীর পূর্ব থেকে পশ্চিম প্রান্ত পুরা দুনিয়া চষে বেড়িয়েছেন?
৩.রূহ কী?
যদি প্রথম দুটি প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দেয় এবং তৃতীয় প্রশ্নের উত্তর না দেয় তাহলে তিনি আল্লাহর প্রেরিত নবী, অন্যথায় মিথ্যাবাদী।
নযর ও উকবা মক্কায় এসে নবীজির নিকট প্রশ্ন তিনটি পেশ করল। আল্লাহ তাআলা ওহির মাধ্যমে নবীজিকে প্রথম দুটি প্রশ্নের উত্তর জানিয়ে দিলেন। যার প্রেক্ষিতে সুরায়ে কাহাফ অবতীর্ণ হয়েছে। যার মধ্যে গুহাবাসী তথা আসহাবে কাহাফ ও হযরত যুলকারনাইনের ঘটনার বিবরণ পেশ করা হয়েছে। আর রূহ সম্পর্কে কোনো উত্তর না দিয়ে শুধু বলা হলো, রূহ আল্লাহর একটি নির্দেশ। এর দ্বারা প্রমাণিত হলো নবীজির নবুয়ত সত্য।

শৈশবে নবীজি চাচা আবু তালেবের সাথে বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে সিরিয়া গমন করেন। সফরের অসহনীয় দুর্ভোগ ও যন্ত্রণার কথা চিন্তা করে আবু তালেব প্রথমে কিশোর মুহাম্মাদকে সঙ্গে নিতে চাননি। কিন্তু যাত্রার সময় তাঁর চেহারায় বিষণœতার ছাপ দেখে তাকেও সাথে নিয়ে নেন। বসরার কাছাকাছি এক খ্রিস্টান ধর্মযাজক বাস করতেন। তার নাম জারজিস। বোহায়রা রাহেব নামে প্রসিদ্ধ ছিল। মক্কার ব্যবসায়িক কাফেলা বোহায়রা রাহেবের গির্জার পাশে অবতরণ করল। কিশোর মুহাম্মাদের চেহারা দেখেই সে বোহায়রা নিশ্চিত হয়ে গেল, এই কিশোরই হবে শেষ নবী, পূর্ববর্তী কিতাবসমূহে যার নিদর্শন বর্ণিত হয়েছে। বোহায়রা গির্জা থেকে বের হয়ে এসে কিশোর মুহাম্মাদের হাত ধরে বলল:

“এ হলো দোজাহানের সর্দার। বিশ্বপ্রতিপালকের প্রেরিত রাসূল। আল্লাহ তাকে পৃথিবীর জন্য রহমতস্বরূপ প্রেরণ করেছেন।”
কোরায়শের নেতৃবৃন্দ বলল: আপনি কিভাবে বললেন?  বোহায়রা বলল, তোমরা তাঁবু থেকে বের হওয়ার পর এমন কোনো গাছ ও পাথর ছিল না, যে তাঁকে সিজদা করেনি। তাছাড়া তাঁর পিঠ ও গর্দানের মধ্যে অঙ্কিত মোহরে নবুয়ত দেখে তাকে চিনেছি। ( আসমানি কিতাবে নবী — )

পরে বোহায়রা তাদের বলল: তোমরা তাঁকে রোম দেশে নিও না। তারা নিদর্শন দেখে তাঁকে চিনে ফেলবে এবং হত্যা করে ফেলবে। এর মধ্যেই হঠাৎ বোহায়রা দেখলেন কিছু রোমীয় লোক কাকে যেন সন্ধান করছে। বোহায়রা তাদের ডেকে জিজ্ঞেস করল, তোমরা কি খোঁজছ? তারা বলল: আমরা সেই নবীর সন্ধান করছি। তাওরাত ও ইঞ্জিলে বর্ণিত আছে এই মাসে সে সফরে বের হবে। আমরা সবদিকে লোক নিযুক্ত করেছি। বোহায়রা বলল: আচ্ছা, মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ যাকে প্রেরণের ইচ্ছা করেছেন তোমরা তাকে প্রতিহত করতে পারবে? তারা বলল: না। তারপর তারা নবীকে অনুসন্ধান না করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে চলে গেল।

আবদে আশহাল গোত্রের এক ইহুদি পতি। একদিন লোকদের জড়ো করে কেয়ামত আখেরাত হিসাব নিকাশ ও জান্নাত জাহান্নাম সম্পর্কে আলোকপাত করল। পরকালের আলোচনা শুনে এক মুশরিক পৌত্তলিক মূর্তি পূজারী বলে উঠল: তোমার জন্য আফসোস, তুমি কি আবোল তাবোল বকছ? এসব কি সত্যি হবে বলে তুমি মনে কর? মৃত্যুর পর মানুষ পুনর্জীবিত হবে? সবাই একত্রিত হবে? সেখানে জান্নাত জাহান্নাম থাকবে? প্রত্যেককে নিজ নিজ কাজের বিনিময় দেওয়া হবে?

ইহুদি বলল: হ্যাঁ এমনি হবে। যারা এটা মানে না তাদের জন্য সেখানে একটা বিশাল চুলা থাকবে। সেখানে তারা দগ্ধ হবে। মূর্তি পূজারী লোকটি বলল: বল কি? তাহলে তার কিছু লক্ষণ বল?
ইহুদি প-িত বলল: এই অঞ্চল থেকে অচিরেই একজন নবী হতে যাচ্ছেন। লোকেরা বলল, কত দিনে মধ্যে তিনি আবির্ভূত হবেন?


এটা পড়ুন – দেখতে মহানবী সাঃ যেমন ছিলেন ?


বর্ণনাকারী বদরি সাহাবি হযরত  সালামা রাযি. বলেন, ইহুদি প-িত আমার দিকে ইশারা করে উত্তর দিলেন, এই বালক যদি পূর্ণ আয়ু পায় তাহলে সে নবীকে দেখতে পারবে।
হযরত সালামা বলেন, এর কিছুদিন পরেই নবীজির আবির্ভাব হয়। আমরা নবীজির প্রতি ঈমান আনি। কিন্তু সেই ইহুদি হিংসা বশত নবীজির প্রতি ঈমান আনল না।

সিরিয়ার অধিবাসী ইবনে হাইয়্যাবান সিরিয়া ছেড়ে মদীনায় এসে বসবাস করতে আরম্ভ করেন। আমল নামাজ ও অত্যধিক ইবাদত বন্দেগির কারণে তার প্রতি ইহুদিদের ভক্তি ছিল অনেক বেশি। তাকে দিয়ে বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়ানো হত। মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে এলে তিনি ইহুদিদের ডেকে বললেন: কি কারণে সিরিয়ার মতো প্রাচুর্যের দেশ ছেড়ে আমি এই ক্ষুধার দেশে এসেছি তা জান? তারা বলল, না। বৃদ্ধ বললেন, আমি একজন নবীর আগমনের অপেক্ষায় রয়েছি। তার আগমনের সময় আসন্ন। এ শহরে তিনি হিজরত করবেন। আমার আশা ছিল, আমার জীবদ্দশায় তিনি আসবেন এবং আমি তাঁর অনুসারী হব। যদি আমি বেঁচে থাকতে তিনি না আসেন তাহলে তিনি আসার পর তোমরা তাঁর উপর ঈমান আনতে বিলম্ব কর না। কেননা তাঁর হাতে তাঁর বিরোধীদের অনেক রক্তপাত হবে। শিশু ও নারীরা বন্দি হবে। দেখ, তোমাদের আগে যেন অন্যরা তাঁর ওপর ঈমান আনতে না পারে।

হযরত খাদিজা ছিলেন মক্কার সম্ভ্রান্ত ধনাঢ্য মহিলা। বেতনভুক্ত কর্মচারী রেখে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে তিনি ব্যবসা পরিচালনা করতেন। এর জন্য প্রয়োজন ছিল বিশ্বস্ততা ও নিষ্ঠার। বালক মুহাম্মাদের সততা নিষ্ঠা বিশ্বস্ততা ও চারিত্রিক মহত্ত্বের কথা অন্যদের ন্যায় খাদিজার কানেও পৌঁছল। একদিন খাদিজা বালক মুহাম্মাদকে ব্যবসায়িক পণ্যসম্ভার নিয়ে সিরিয়া যাওয়ার প্রস্তাব করলেন। জানালেন, সম্মানি বাবত অন্যদের তুলনায় তাঁকে বেশি দিবেন। সাথে খাদিজার চাকর মাইসারাকে সঙ্গে দিতে চাইলেন।

বালক মুহাম্মাদ খাদিজার পণ্য সামগ্রী নিয়ে সিরিয়ায় গেলেন। সিরিয়ার কাছাকাছি এক গির্জার পাশে তাবু গাড়লেন। সবাই বিশ্রামে গেল। বালক মুহাম্মাদও একটি গাছের নিচে বিশ্রাম গ্রহণ করলেন। অদূরবর্তী গির্জা থেকে এক পাদ্রি এই দৃশ্য দেখছিল। সে বিস্ময়াভিভূত! পাদ্রি মাইসারাকে ডেকে গোপনে জিজ্ঞেস করল: গাছের নিচে বিশ্রামরত ভদ্রলোকটি কে? মাইসারা উত্তর দিল, কাবা শরিফের কাছাকাছি বসবাসকারী এক কোরায়শী যুবক। তার নাম মুহাম্মাদ। ধর্মযাজক বলল : এই গাছের নিচে নবী ছাড়া কেউ কখনো বিশ্রাম নেয়নি।

লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, মাসিক কিশোর পথ, প্রাবন্ধিক, শিক্ষক, গ্রন্থকার।

Facebook Comments