8.3 C
New York
Friday, October 24, 2025

Buy now

spot_img
Home Blog Page 23

মহানবীর ﷺ বিছানা – যেমন বিছানায় ঘুমাতেন রাসুল সাঃ ।

আদনান ফয়সালঃ মসজিদে নববীর ভিতরে মহানবীর ﷺ ছোট একটা কামরা ছিল। কখনো-সখনো তিনি ঐ কামরায় বিশ্রাম নিতেন। এই ঘরে আসবাব-পত্র বলতে কিছুই ছিল না। শুধু ছিল একটা পানির কলস আর একটা বিছানা। একে বিছানাই বা কিভাবে বলা যায়? এটা ছিল খেজুরের ডালের কিছু চাটাই মাত্র।

বিছানা
ছবিতে দেখতে পাচ্ছেন মদিনা জাদুঘরে সংরক্ষিত মহানবী ﷺ  এর বিছানার মডেল

একদিন উমার ইবনুল খাত্তাব (রা) মহানবীর ﷺ সেই কামরায় প্রবেশ করলেন। মহানবী ﷺ শুয়ে ছিলেন। উমার (রা) আসায় উঠে বসলেন, সালাম বিনিময় করলেন। উমার (রা) দেখলেন খেজুরের চাটাই এ শোয়ার কারণে রাসূলুল্লাহ ﷺ এর পিঠে লাল-লাল দাগ হয়ে গেছে। রাসূলের ﷺ পিঠের এই অবস্থা দেখে ডুকরে কেঁদে উঠলেন উমার (রা) – “ও রাসূলুল্লাহ! দুনিয়ার বাদশা কাইসার ও কিসরা বিলাসবহুল আয়েশী জীবন যাপন করছে, আর আপনি আল্লাহর রাসূল দোজাহানের সরদার হয়েও সামান্য খেজুরের ছালের বিছানায় শুয়ে আছেন!”

এ সময় মুসলিমদের অর্থনৈতিক অবস্থা কি খারাপ ছিল? না, মোটেও না। এই ঘটনাটি ৭ম / ৮ম হিজরীর দিকে হয়েছে – যখন কিনা মুসলিমরা ইতোমধ্যেই আরব ভূখন্ডের একটা বিশাল অংশে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছে – যার নেতৃত্বে আছেন রাসূলুল্লাহ ﷺ । এ কারণেই, উমার (রা) রাসূলুল্লাহ ﷺ কে তৎকালীন বিশ্বের সবচেয়ে পরাক্রমশালী দুই বাদশা – রোমান বাদশা হিরাক্লিয়াস (কাইসার) ও পারস্যের বাদশা কিসরা এর বিলাসী জীবনের কথা মনে করিয়ে দিয়ে বলতে চাইছিলেন – ঐসব বাদশাহরা যেখানে এত আরাম-আয়েশে প্রাসাদ নিয়ে থাকতে পারে – সেখানে আপনি একটু আরামদায়ক বিছানায় ঘুমালে ক্ষতি কি?

ভেবে দেখুন – আপনি যদি খুব কষ্টদায়ক কোন বিছানায় শুয়ে থাকেন, আর আপনার বন্ধু তখন আপনার প্রতি সমবেদনা জানিয়ে বলে – “আহা এই বিছানায় তোমার বড় কষ্ট হচ্ছে বন্ধু!” – তাহলে আপনি এর জবাবে কি বলবেন? আমরা হয়তো বলব – “হ্যাঁ বন্ধু, ঠিকই বলেছ। আসলেই অনেক কষ্ট হচ্ছে, এটা বদলে ফেলা দরকার”।

রাসূলুল্লাহ ﷺ কি এরকম কিছু বলেছিলেন? তিনি ﷺ কি উমার (রা) এর এই সমবেদনা প্রকাশে খুশী হয়েছিলেন? মোটেই না! কারণ, তিনি আমাদের মত সাধারণ মানুষ না, তিনি ছিলেন অসাধারণ, তিনি ﷺ আল্লাহর রাসূল। তিনি লক্ষ্য রাখতেন – পার্থিব সুখ-স্বাচ্ছন্দ যাতে মাত্রাতিরিক্ত হয়ে না যায়, অতিরিক্ত আরামদায়ক বিছানা যেন তাহাজ্জুদের নামাজে উঠার বাধা না হয়ে দাঁড়ায়। উমার (রা) এর কথায় রাসূলুল্লাহ ﷺ বরং কিছুটা বিরক্তই হলেন। তিনি ﷺ বললেন – “উমার। তুমি কি এতে খুশী নও তাদের জন্য দুনিয়া আর আমাদের জন্য আখিরাত?”

মুহাম্মদ-সাঃ-বিছানা
ছবিতে দেখতে পাচ্ছে জেদ্দাহ এর কিছু আলেমের গবেষণা অনুসারে মহানবী ﷺ  এর বিছানার মডেল।

এ তো গেল মসজিদের কামরার বিছানা। মহানবীর ﷺ নিজের বাসার বিছানা কেমন ছিল? তাঁর স্ত্রী আয়িশা (রা) বলেন – “আল্লাহর রাসূল যে বিছানায় ঘুমাতেন তা চামড়ার ছিল, এর ভেতরে খেজুর গাছের পাতা ভরা হত”।

লক্ষ্যনীয় যে, চামড়া কিন্তু ম্যাট্রেস তৈরির উপাদান না, চামড়ার বিছানা আরামদায়কও না। আরবরা চামড়া ব্যবহার করত উট বা ঘোড়ার জিন তৈরীতে। চামড়ার সেই শক্ত বিছানাকে কিছুটা সহনীয় করার জন্য সাহাবীরা এর ভেতর খেজুর পাতা ভরে দিতেন।

আরেক স্ত্রী হাফসার (রা) ঘরে রাসূলুল্লাহ ﷺ এর বিছানা বলতে ছিল পাতলা এক চট। রাসূলুল্লাহ ﷺ এর এই কষ্টদায়ক বিছানা লক্ষ্য করে হাফসা (রা) একবার এক কাজ করে বসলেন। তিনি রাসূলুল্লাহ ﷺ এর ঘুমানোর চট – যেটাকে সচরাচর দুই ভাঁজ করা হতো, সেটাকে এক রাতে চার ভাঁজ করে দিলেন। হাফসা (রা) ভেবেছিলেন এতে রাসূলুল্লাহ ﷺ এর ঘুমের কিছুটা আরাম হবে। অপেক্ষাকৃত আরামদায়ক বিছানার কারণে সেই রাতে রাসূলুল্লাহ ﷺ একটু বেশী ঘুমালেন। সকালে তিনি ﷺ যখন ঘুম থেকে উঠলেন তখন জিজ্ঞেস করলেন – বিছানার বিষয়টা কি? হাফসা (রা) তখন তাঁকে ﷺ অতিরিক্ত ভাঁজের ব্যাপারটা বললেন। এতে তিনি ﷺ মোটেও খুশী হলেন না। বরং নির্দেশ দিলেন – “একে আগের মতই করে দিও, এটা গতকাল আমাকে তাহাজ্জুদ পড়া থেকে বিরত রেখেছে।”


দেখতে মহানবী সাঃ যেমন ছিলেন ?


সুতরাং, আমরা বুঝতে পারি যে – রাসূলুল্লাহ (সা) এর আরামদায়ক বিছানায় না ঘুমানোর অন্যতম কারণ ছিল, বিছানার অতিরিক্ত উষ্ণতা তাঁকে (সা) যেন তাহাজ্জুদ সালাত পড়া থেকে বিরত রাখতে না পারে।

একবার কয়েকজন সাহাবী মিলে রাসূলুল্লাহ ﷺ এর কাছে এসে তাঁর ﷺ জন্য আরামদায়ক বিছানার ব্যবস্থা করে দিবেন বলে আর্জি পেশ করলেন। জবাবে তিনি ﷺ বললেন – “দুনিয়ার আরাম আয়েশের কি প্রয়োজন? আমি তো একজন পথিকের মত, যে বিরামহীনভাবে চলতে থাকে। চলতে চলতে ক্লান্ত হয়ে একটু আরামের জন্য গাছের ছায়ায় বসে। কিছুক্ষণ আরাম করে আবার সে চলতে থাকে।”

রেফারেন্স ও টীকা: 

  • সিরাহ সংক্রান্ত ড. ইয়াসির কাযির লেকচার – পর্ব ২
  • ৪৬তম অনুচ্ছেদ, শামায়েলে তিরমিযী – মাহমুদিয়া লাইব্রেরী
  • ২য় ছবিতে দুই ধরনের বিছানাই রাখা হয়েছে – ফ্রেমসহ ও ফ্রেম ছাড়া। ফ্রেমের ব্যাপারে সরাসরি কোন সাহিহ হাদিস পাওয়া না গেলেও কোন কোন আলেম অন্য হাদিসের ব্যাখা থেকে এরকম ফ্রেম থাকতে পারে বলে ধারণা করেছেন।

দেখতে মহানবী সাঃ যেমন ছিলেন ?

আদনান ফয়সালঃ যে সৌন্দর্য বর্ণনা করা যায় না মানুষ যখন কোন কিছুকে চরম পর্যায়ের সুন্দর বলে মনে করে, ভাষায় যখন আর সে কোন কিছুকে বর্ণনা করতে পারে না, তখন সে অসম্ভবের আশ্রয় নেয়। আপনি যদি একজন মা কে জিজ্ঞেস করেন – তোমার সন্তান দেখতে কেমন? সে বলবে – আমার ছোট্ট সোনামনিটা চাঁদের মত সুন্দর। আবার আপনি যখন কোন তরুনকে তার সবচেয়ে প্রিয় ব্যক্তিত্বের কথা জিজ্ঞেস করবেন, সে হয়ত বলবে – তাঁর ব্যক্তিত্ব সূর্যের মত তেজদীপ্ত। সৌন্দর্য বর্ণনা করতে যেয়ে অসম্ভবের আশ্রয় নেয়া শুধু আমাদের মধ্যে আছে তা নয়, সাহাবীদের মধ্যেও ছিল।

রাসূলুল্লাহ ﷺ  এর ইন্তেকালের পরে সাহাবীরা রাসূলুল্লাহ ﷺ কে নিয়ে বিভিন্ন স্মৃতিচারণ করত, আর তরুন তাবেঈরা দলে দলে এসে মুগ্ধ হয়ে সেই ঘটনাগুলোকে গিলে খেত। রুবাইয়া বিনতে মুয়াই-উইত (রা) নামক মহিলা সাহাবী যখন অনেক বৃদ্ধ হয়ে গিয়েছিল তখন তার ছেলে একদিন তাকে জিজ্ঞেস করেছিল  – “আচ্ছা মা, আল্লাহর রাসূল দেখতে কেমন ছিলেন?” জবাবে রুবাইয়া বলেছিল – “বাবা তুমি যদি তাকে দেখতে পেতে, তাহলে মনে করতে এই বুঝি সুর্য উঠেছে! ” (কাবির আত-তাবারানি, মানাকিব আল-বুখারী)

আবার অন্যদিকে কা’ব ইবনে মালিক (রা) রাসূলুল্লাহ ﷺ সম্পর্কে বলেছে –“আল্লাহর রাসূল যখন খুশী হতেন তখন তাঁর চেহারা এমন জ্বল-জ্বল করত যেন পূর্ণিমার চাঁদ!”

সবচাইতে শেষের দিকে যেসব কুরাইশ নেতা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল তাদের মধ্যে একজন ছিল আমর ইবনে আস (রা)। সে কুরাইশদের অন্যতম নেতা ছিল এবং পরবর্তীতে মুয়াউইয়ার (রা) উজির ছিল। এই আমর ইবনে আস তার বৃদ্ধ বয়সে বলেছিল – “আমার কাছে আল্লাহর রাসূলের চেহারার দিকে তাকানোর চেয়ে মিষ্টি আর কোন কিছুই ছিল না। আমি যতই তাকে দেখতাম আমার মন ভরত না। অথচ তুমি যদি আমাকে জিজ্ঞেস করতে – উনি দেখতে কেমন ছিলেন? আমি বর্ণনা করত পারতাম না। কারণ, যদিও আমার চরমভাবে ইচ্ছা করত শুধুই তাঁকে দেখি, কিন্তু সম্মানের কারণে তাঁর দিকে আমি চোখ তুলে তাকাতাম না। ”

নবী ইউসুফ(আ) এর সৌন্দর্যের কথা আমরা সবাই জানি। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন যে – “নবী ইউসুফ (আ) কে সৌন্দর্যের অর্ধেক দেয়া হয়েছিল” (মুসলিম ও আহমাদ)। কোন কোন আলেমের মতে এই অর্ধেক হলো সমস্ত মানবজাতির কাছে যে সৌন্দর্য আছে তার অর্ধেক; আর অন্য আলেমদের মতে এখানে বুঝানো হয়েছে – ইউসুফ (আ) এর সৌন্দর্য রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সৌন্দর্যের অর্ধেক ছিল, কারণ রাসূলুল্লাহ ﷺ এর চেয়ে সুন্দর আর কোন মানুষকে সৃষ্টি করা হয়নি।

মহান আল্লাহর সুন্নাহ (অনুসরণকৃত নিয়ম) হলো যে তিনি নবী ও রাসূলদেরকে পাঠিয়েছেন সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ গুনাবলির আধার স্বরুপ – এই গুনাবলিগুলো যেমন বাহ্যিক, তেমনই আত্মিক। এর কারণ হলো – মানুষ যাতে মনের ভেতর থেকেই এই নবী/রাসূলদের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করে, তাদের অনুসরণ করতে আগ্রহ বোধ করে। প্রত্যেক নবী ও রাসূলই সকল রকম মানবীয় গুনাবলীতে গুণান্বিত ছিলেন, প্রত্যেকেই বাহ্যিক সৌন্দর্যে অলংকৃত ছিলেন। কিন্তু, এই সবার মধ্যেও সবচেয়ে বেশী সুন্দর, সবচেয়ে বেশী মানবীয় গুনের অধিকারি ছিলেন আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মাদ ﷺ ।

রাসূলুল্লাহ ﷺ দেখতে কেমন ছিলেন?

আমরা যদি রাসূলুল্লাহ ﷺ এর শারীরিক গঠন সংক্রান্ত হাদিসগুলোর দিকে লক্ষ্য করি তাহলে দেখব এই হাদিসগুলোর বেশীরভাগই এসেছে অল্প-বয়সী সাহাবীদের কাছ থেকে। বয়স্ক সাহাবীরা সম্মান ও শ্রদ্ধার কারণে রাসূলুল্লাহ ﷺ এর চেহারার দিকে সরাসরি খুব বেশী তাকাতেন না, অন্যদিকে ‘বাচ্চা’ সাহাবীরা রাসূলুল্লাহ ﷺ এর খুব কাছে চলে আসত, তাঁর সাথে খেলত, তাঁকে খুব কাছ থেকে দেখত। এই যেমন আনাস বিন মালিক (রা) এর কথাই ধরা যাক। আনাস (রা) এর বয়স যখন মাত্র ৭ বছর ছিল তখন তার মা তাকে রাসূলুল্লাহ ﷺ এর কাছে গিফট করেছিলেন।  বালক আনাস ﷺ সারাদিন রাসূল ﷺ এর সাথে থাকত, তাকে এটা-ওটা এগিয়ে দিয়ে সাহায্য করত, আর রাতের বেলা মায়ের কাছে ফিরে যেত।

রাসূলুল্লাহ ﷺ এর শারীরিক গঠন সম্পর্কে সুন্দর এক হাদিস পাওয়া যায় আনাস(রা) থেকে। তিনি বলেছেন – “নবী ﷺ এমন লম্বা ছিলেন না যে তিনি সবাইকে ছাড়িয়ে যেতেন, অথবা তিনি এত ছোট ছিলেন না যে তাঁকে চোখে পড়ত না।

তিনি অনেক বেশী ফর্সা ছিলেন না, না তিনি ছিলেন তামাটে বর্ণের। তাঁর চুল না ছিল কোকড়া, না ছিল সরল”। এই হাদিসের ব্যাখায় স্কলারেরা বলেন আল্লাহ্‌র রাসূলের সব কিছুই মাঝামাঝি প্রকৃতির ছিল – তিনি মধ্যম উচ্চতার ছিলেন, তাঁর গায়ের রঙ ছিল উজ্জ্বল বাদামী। লক্ষ্যণীয় যে, সাহাবীরা রাসূলুল্লাহর ﷺ শারীরিক গঠনের বর্ণনায় খুবই সতর্ক ছিলেন।  আর তাই তিনি দেখতে কেমন ছিলেন জিজ্ঞেস করা হলে অনেক সময় তারা – তিনি  ﷺ কেমন ছিলেন তা সরাসরি না বলে তিনি ﷺ কেমন ছিলেন না তা বর্ণনা করতেন।

আনাস (রা) আরো বলেন –  “আমি কখনো এমন কোন ভেলভেট বা সিল্ক স্পর্শ করিনি যা আল্লার রাসূলের ﷺ হাতের চাইতে নরম।  আর আমি কখনো এমন কোন সুগন্ধীর ঘ্রাণ নেইনি যার সুবাস আল্লাহর রাসূলের ﷺ ঘামের চেয়ে মিষ্টি। ” অন্য হাদিস থেকে আমরা জানি রাসূলুল্লাহﷺ এর স্ত্রী উম্মে সালামা ও অন্য সাহাবীরা বোতলে করে তাঁর ﷺ ঘাম জমিয়ে রাখতেন এবং পরে তা সুগন্ধী ও ওষুধ হিসাবে ব্যবহার করতেন।

আল-বারা ইবনে আযিব (রা) বলেন: “আল্লাহর রাসূল ﷺ ছিলেন মাঝারি গঠনের। তাঁর ﷺ প্রশস্ত কাঁধ ছিল। তাঁর ﷺ চুল ছিল মোটা (অর্থাৎ পাতলা না), তাঁর ﷺ দাড়ি ছিল ঘন। ” অন্য হাদিস থেকে আমরা জানি রাসূলুল্লাহ ﷺ কানের লতি পর্যন্ত তাঁর চুল বড় করতেন। আর উমরা/হজ্ব বা অন্য সময় যখন চুল কাটতেন তখন পুরো চেঁছে ফেলতেন। জীবনের শেষের দিকেও তাঁর খুব বেশী পাকা চুল ছিল না। আনাস(রা) বলেছেন রাসূলুল্লাহ ﷺ এর মোট ১৭টি পাকা চুল-দাড়ি ছিল।

আল-বারা ইবনে আযিব (রা) আরো বলেন: “রাসূলুল্লাহকে ﷺ আমি একবার লাল রঙের হুল্লা পরা অবস্থায় দেখেছিলাম (হুল্লা = ওভারকোটের মত এক ধরনের আরবীয় পোশাক)।  এর চেয়ে সুন্দর কোন কিছু আমি আমার জীবনে দেখিনি!”


মহানবীর ﷺ কিছু অনন্য বৈশিষ্ট্য


আলী (রা) ছিলেন রাসূলুল্লাহ ﷺ এর চাচাত ভাই। ছোটবেলা থেকে রাসূলুল্লাহ ﷺ এর ঘরেই তিনি বড় হয়েছেন, আর তাই তাঁকে ﷺ অনেক কাছে থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল তার। আলী(রা) বলেন: “নবী ﷺ এর মুখে অনেক বেশী মাংস ছিল না। তাঁর মুখ গোলাকৃতির ছিল না, বরং কিছুটা ওভাল আকৃতির ছিল। তাঁর গায়ের রঙ ছিল লালচে ফর্সা / উজ্জ্বল বাদামী। তাঁর ডাগর চোখ ছিল, চোখের মণি ছিল নিকষ কালো, পাপড়ি ছিল লম্বা। তাঁর হাড়ের গাঁটগুলো উন্নত (স্পষ্ট) ছিল, কাঁধের পেছনটা ছিল প্রশস্ত। তাঁর সারা শরীরে পশম ছিল না, কিন্তু তাঁর বুক থেকে নাভী পর্যন্ত পশমের একটা পাতলা লম্বা রেখা ছিল।

হাঁটার সময় তিনি ﷺ দ্রুত হাঁটতেন, মনে হত যেন তিনি কোন ঢাল বেয়ে নিচের দিকে নামছেন। কারো দিকে তাকানোর সময় তিনি (আড়চোখে না তাকিয়ে) শরীর সহ মাথা ঘুরিয়ে সেদিকে তাকাতেন।  তাঁর দুই কাঁধের মাঝে নবুওয়তের ‘খাতম’ ছিল, আর তিনি নিজেও ছিলেন নবুওয়তের খাতম (খাতম = চিহ্ন বা সীল। রাসূলুল্লাহ ﷺ এর দুই কাঁধের মাঝখানে ভিন্ন রঙের কিছু চুল ছিল এবং এটা ওভাল আকৃতির ছিল – এটাই ছিল তাঁর ﷺ নবুওয়তের খাতম)।

কারো চোখ যদি অনভিপ্রেতভাবে (unexpectedly) রাসূলুল্লাহর ﷺ উপর পড়ে যেত, সে সমীহ করে থমকে যেত। তাঁর ﷺ সাথে যে সাক্ষাত করত, তাঁকে যে জানত, সে-ই তাঁকে ভালবাসত। তাঁর সম্পর্কে যে-ই কথা বলবে সে-ই বলবে যে, আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ কে দেখার আগে বা পরে তাঁর মত আর কাউকে দেখিনি”। (শামায়েলে তিরমিযী)

রাসূলুল্লাহ ﷺ এর চেহারার মধ্যে আল্লাহ্‌ এক ধরনের মায়া, এক ধরনের আকর্ষণ দিয়েছিলেন। জাবির বিন সামুরা (রা) পূর্ণিমার এক রাতে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন। পথে তার দেখা হয়ে গেল রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সাথে। রাসূলুল্লাহ ﷺ সেদিন তাঁর লাল হুল্লাটি পরে ছিলেন (হুল্লা = ওভারকোটের মত এক ধরনের আরবীয় পোশাক)। জাবির (রা) বলেন: “আমি একবার আল্লাহর রাসূলের চেহারার দিকে তাকাচ্ছিলাম আরেকবার পূর্ণিমার চাঁদের দিকে দেখছিলাম। শেষে আমি এই উপসংহারে আসলাম যে, আল্লাহর রাসূল পূর্ণিমার চাঁদের চাইতেও বেশী আকর্ষণীয়, সুন্দর, উজ্জ্বল। ”

বহু মানুষ রাসূলুল্লাহ ﷺ এর শুধু চেহারা দেখেই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল। আব্দুল্লাহ ইবনে সালাম ছিল মদীনার ইহুদীদের প্রধান র‍্যাবাই (ইহুদীদের ধর্মযাজক)। রাসূলুল্লাহ ﷺ যেদিন মক্কা থেকে মদীনায় আসলেন তখন আব্দুল্লাহ ইবনে সালাম রাসূলুল্লাহ ﷺ কে দেখতে গিয়েছিল – তার মনে রাসূলুল্লাহ ﷺ সম্পর্কে কৌতুহল ছিল – কে এই ব্যক্তি যে নিজেকে নবী বলে দাবী করছে? রাসূলুল্লাহ ﷺ কে দেখামাত্র বিমোহিত হয়ে পড়ল আব্দুল্লাহ ইবনে সালাম (রা), তাঁর নিজের ভাষায় : “যেই মাত্র আমি তাঁকে ﷺ দেখেছি তখনই আমি বুঝেছি যে এটা কোন মিথ্যুকের মুখমন্ডল নয়। (বুখারী)” রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সাথে মাত্র একবার কথোপকথনের পরেই আব্দুল্লাহ ইবনে সালাম (রা) ইসলাম গ্রহণ করেছিল।
===========
লেখক- আদনান ফয়সাল

রেফারেন্স  টীকা:

  • সিরাহ সংক্রান্ত ড. ইয়াসির কাযির লেকচার – পর্ব ২
  • শামায়েলে তিরমিযী – মাহমুদিয়া লাইব্রেরী
  • জাবির বিন সামুরার (রা) হাদিস http://ahadith.co.uk/hadithbynarrator.php?n=Jabir&bid=12&let=J

কুরআন-হাদীসে শবে বরাত । তাৎপর্য, ফজীলত,আমল ও বর্জনীয় কাজ।

মুফতী মাহফুজুর রহমানঃ শবে বরাত বা লাইলাতুল বারাআতকে হাদীস শরীফে “লাইলাইতুন নিসফি মিন শা‘বান” নামে উল্লেখ করা হয়েছে। আর উক্ত রাতের ফজীলতের দিকে খেয়াল করে উলামায়ে উম্মত এ রাতকে “লাইলাতুল বারাআত” নামকরণ করেছেন।
এর অর্থ–লাইলাতুল বারাআতি মিনাজ জুনূব অর্থাৎ গুনাহ থেকে মুক্তির রাত। যেমনিভাবে “তারাবীহ নামায” নামের কোন উল্লেখ হাদীস শরীফে নেই, হাদীস শরীফে উক্ত নামাযকে “কিয়ামুল লাইল ফী রামাজান” বলা হয়েছে এবং উক্ত নামায সকল মুসলমানের জন্য পালনীয়, তেমনিভাবে শবে বারাআত নাম উল্লেখ না থাকলেও লাইলাতুন নিসফি মিন শা‘বান নামে উক্ত রাতের ফজীলত ও আমলের কথা হাদীস শরীফে বর্ণিত হওয়ায় তা মুসলমানদের জন্য পালনীয় হবে।

লাইলাতুল বারাআত বা শবে বারাআতের ফজীলত ও আমলের বিষয় সহীহ ও নির্ভরযোগ্য হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। তেমনি এ ব্যাপারে বর্ণিত সকল হাদীসের সমষ্টি এ রাতের বিশেষ ফজীলতের বিষয়কে প্রমাণিত করে। তাই একে অস্বীকার করার কোন অবকাশ নেই।

শবে বারাআত সম্পর্কে নিম্নে সহীহ হাদীস উল্লেখ করা হলো-

ﻋﻦ ﻣﻌﺎﺫ ﺑﻦ ﺟﺒﻞ رضي الله عنه ﻋﻦ ﺍﻟﻨﺒﻰ صلي الله عليه وسلم ﻗﺎﻝ ﻳﻄﻠﻊ ﺍﻟﻠﻪ ﺍﻟﻰ ﺧﻠﻘﻪ ﻓﻰ ﻟﻴﻠﺔ ﺍﻟﻨﺼﻒ ﻣﻦ ﺷﻌﺒﺎﻥ ﻓﻴﻐﻔﺮ ﻟﺠﻤﻴﻊ ﺧﻠﻘﻪ ﺇﻻ ﻟﻤﺸﺮﻙ ﺃﻭ ﻣﺸﺎﺣﻦ

হযরত মু‘আয ইবনে জাবাল (রা.) হতে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, “আল্লাহ তা‘আলা অর্ধ-শা‘বানের রাতে (শা‘বানের চৌদ্দ তারিখের দিবাগত রাত শবে বারাআতে) সৃষ্টির দিকে (রহমতের) দৃষ্টি দেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যতীত সকলকে ক্ষমা করে দেন।”

(সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস নং ৫৬৬৫/ সুনানে বাইহাকী–শু‘আবুল ঈমান, হাদীস নং ৩৮৩৩/ মু‘জামে তাবরানী, কাবীর, হাদীস নং ৩৫৪৩)

উপরোক্ত হাদীসটি অনেক নির্ভরযোগ্য হাদীসের কিতাবেই নির্ভরযোগ্য সনদের মাধ্যমে বর্ণিত হয়েছে। ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে হিব্বান (রহ.) তার ‘কিতাবুস সহীহ’ গ্রন্থে (যা সহীহ ইবনে হিব্বান নামে প্রসিদ্ধ এ হাদীসটি উদ্ধৃত করেছেন। হাদীসটির সনদ সহীহ বলেই তিনি একে তাঁর কিতাবুস সহীহ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন। কেউ কেউ হাদীসটিকে পারিভাষিক দৃষ্টিকোণ থেকে হাসান বলেছেন; কিন্তু হাসান হাদীস সহীহ বা নির্ভরযোগ্য হাদীসেরই একটি প্রকার। তাই ইমাম মুনযিরী, আল্লামা ইবনে রজব, আল্লামা নূরুদ্দীন হাইসামী, কাস্তাল্লানী, যুরকানী এবং অন্যান্য হাদীস বিশারদ এই হাদীসটিকে গ্রহণীয় ও আমলযোগ্য বলেছেন।
(বিস্তারিত দেখুন : আত-তারগীব ওয়াত-তারহীব, ২য় খণ্ড, ১৮৮ পৃষ্ঠা/ মাজমা‘উয যাওয়ায়িদ, ৮ম খণ্ড, ৬৫ পৃষ্ঠা/ শারহুল মাওয়াহিবিল লাদুন্নিয়্যা, ১০ম খণ্ড, ৫৬১ পৃষ্ঠা)

আহলে হাদীস সম্প্রদায় এ হাদীসকে কীভাবে অস্বীকার করবেন–যেখানে স্বয়ং তাদের মুকতাদা (অনুসরণিয়) শাইখ নাসিরুদ্দীন আলবানী (রহঃ) এ হাদীসকে সহীহ বলে গণ্য করে তার “সিলসিলাতুল আহাদসিস সাহীহা” গ্রন্থের ৩য় খণ্ড-১৩৫ পৃষ্ঠায় এ হাদীসকে স্থান দিয়েছেন এবং এর সমর্থনে আরো ৮টি হাদীস উল্লেখ করে বলেছেন–

ﻭﺟﻤﻠﺔ ﺍﻟﻘﻮﻝ ﺃﻥ ﺍﻟﺤﺪﻳﺚ ﺑﻤﺠﻤﻮﻉ ﻫﺬﻩ ﺍﻟﻄﺮﻕ ﺻﺤﻴﺢ ﺑﻼﺭﻳﺐ ﻭﺍﻟﺼﺤﺔ ﺗﺜﺒﺖ ﺑﺄﻗﻞ ﻣﻨﻬﺎ ﻋﺪﺩﺍ ﻣﺎﺩﺍﻣﺖ ﺳﺎﻟﻤﺔ ﻣﻦ ﺍﻟﻀﻌﻒ ﺍﻟﺸﺪﻳﺪ ﻛﻤﺎﻫﻮ ﺍﻟﺸﺄﻥ ﻓﻰ ﻫﺬﺍﺍﻟﺤﺪﻳﺚ

“সারকথা হলো, এ হাদীসটি এ সকল রিওয়াতের মাধ্যমে সমষ্টিগতভাবে নিঃসন্দেহে সহীহ। আর কোন হাদীস সহীহ হওয়া তো এর চেয়ে কমসংখ্যক রিওয়ায়াতের সমষ্টিতেই হয়ে যায় যখন তা প্রচণ্ড দুর্বলতা থেকে মুক্ত থাকে–যেমন অবস্থা এ হাদীসের ক্ষেত্রে।”
(সিলসিলাতুল আহাদসিস সাহীহা, ৩য় খণ্ড, ১৩৮ পৃষ্ঠা)

অধিকন্তু আলবানী সাহেব সেখানে ওই সব লোকের বক্তব্য খন্ডন করে শক্ত প্রতিবাদ করেছেন, যারা কোন ধরনের খোঁজখবর ছাড়াই বলে দেন যে, শবে বারাআতের ব্যাপারে কোন সহীহ হাদীস নেই।
(সিলসিলাতুল আহাদসিস সাহীহা, ৩য় খণ্ড, ১৩৯ পৃষ্ঠা)

বলা বাহুল্য, শবে বারাআতের ব্যাপারে যদি শুধু এ হাদীসটিই থাকতো এবং অন্য কোন হাদীস না থাকতো, তবুও এ হাদীস দ্বারাই শবে বারাআত প্রমাণিত হওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিলো। কারণ, এটা নির্ভরযোগ্য সহীহ হাদীস। তারপরও আমরা দেখতে পাই, এ রাতের ফজীলত সম্পর্কে আরো বহু হাদীস বর্ণিত হয়েছে, যার মধ্য থেকে আলবানী সাহেব ৮টি হাদীস উদ্ধৃত করেছেন এবং বলেছেন, এগুলো জয়ীফ হলেও প্রচণ্ড ধরনের জয়ীফ নয়। তাই এগুলোর সপক্ষে উল্লিখিত হাদীস বিদ্যমান থাকায় এগুলো প্রহণযোগ্য পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে।

উল্লিখিত সহীহ হাদীস দ্বারা শবে বারাআতের ফজীলত ও আমল উভয়ই প্রমাণিত হয়। কেননা, যখন এ হাদীসে শবে বারা্আতে বান্দাদেরকে ক্ষমা করার ঘোষণা দেয়া হলো, সুতরাং সেই ক্ষমা লাভের জন্য অবশ্যই তাদের এর উপযুক্ত আমল করা কর্তব্য। তথাপি এ রাতের আমল সম্পর্কে সুস্পষ্ট নির্দেশনা সম্বলিত নির্ভরযোগ্য হাদীসও রয়েছে। যেমন, এ সম্পর্কে একটি নির্ভরযোগ্য হাদীস নিম্নে উল্লেখ করা হলো–

عن عائشة بنت أبي بكر قالت قام رسول الله صلي الله عليه وسلم من الليل يصلي فأطال السجود حتى ظننت أنه قد قبض فلما رأيت ذلك قمت حتى حركت إبهامه فتحرك فرجعت فلما رفع إلي رأسه من السجود وفرغ من صلاته قال يا عائشة أظننت أن النبي قد خاس بك؟ قلت لا والله يا رسول الله ولكنني ظننت أنك قبضت لطول سجودك فقال أتدرين أي ليلة هذه؟ قلت الله ورسوله أعلم قال هذه ليلة النصف من شعبان، إن الله عز وجل يطلع على عباده في ليلة النصف من شعبان فيغفر للمستغفرين ويرحم المسترحمين ويؤخر أهل الحقد كما هم

হযরত আয়িশা বিনতে আবু বকর (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক রাতে রাসূলুল্লাহ (সা.)নামাযে দাঁড়ালেন। তখন তিনি সিজদা এত দীর্ঘ করলেন যে, আমি ধারণা করলাম–তাঁর প্রাণবিয়োগ হয়েছে। যখন আমি তা ভাবলাম, তখন উঠে তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুলি নাড়া দিলাম। তাতে তা নড়ে ওঠলো। তখন আমি ফিরে এলাম। এরপর যখন তিনি সিজদা থেকে উঠলেন এবং নামায শেষ করলেন, তখন আমাকে লক্ষ্য করে বললেন, হে আয়িশা! তোমার কি এই আশংকা হয়েছে যে, আল্লাহর রাসূল তোমার হক নষ্ট করবেন? আমি উত্তরে বললাম–না, ইয়া রাসূলুল্লাহ। আপনার দীর্ঘ সিজদা থেকে আমার এই আশংকা হয়েছিল, আপনার প্রাণবিয়োগ হয়েছে। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সা.) জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি জান–এটা কোন্ রাত? আমি বললাম–আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই ভাল জানেন। তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করলেন– “এটা হল অর্ধ শাবানের রাত (শাবানের চৌদ্দ তারিখের দিবাগত শবে বারাআত)। আল্লাহ তা‘আলা অর্ধ-শাবানের রাতে স্বীয় বান্দাদের প্রতি মনোনিবেশ করেন। অতঃপর তিনি ক্ষমাপ্রার্থনাকারীদেরকে ক্ষমা করেন এবং অনুগ্রহপ্রার্থীদেরকে অনুগ্রহ করেন আর বিদ্বেষ পোষণকারীদেরকে তাদের বদকর্মের কারণে ফিরিয়ে দেন।”

(বাইহাকী-শুআবুল ঈমান, ৩য় খণ্ড, ৩৮২ পৃষ্ঠা)

এ হাদীসটিও নির্ভরযোগ্য। ইমাম বাইহাকী (রহ.) এ হাদীসটি বর্ণনার পর এর সনদের ব্যাপারে বলেন– ﻫﺬﺍ ﻣﺮﺳﻞ ﺟﻴﺪ “এই হাদীসটি উত্তম সনদের মুরসাল হাদীস।”
(বাইহাকী-শুআবুল ঈমান, ৩য় খণ্ড, ৩৮৩ পৃষ্ঠা)

এ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হলো, শবে বারাআতে নফল নামায পড়া এবং তাকে এভাবে দীর্ঘ করা, যাতে সিজদাও দীর্ঘ হবে–এটা মাসনূন আমল। আবার সুনানে ইবনে মাজাহর এক হাদীসে রাতে নফল নামায পড়া ও নফল ইবাদত করার সাথে পরদিন রোযা রাখার নির্দেশনাও বর্ণিত হয়েছে। এ সম্পর্কিত একটি হাদীস নিম্নে উল্লেখ করা হলো–

عن علي بن أبي طالب ﺭﺿﻰ الله ﻋﻨﻪ قال قال رسول الله ذا كانت ليلة النصف من شعبان فقوموا ليلها وصوموا نهارها فإن الله ينزل فيها لغروب الشمس إلى سماء الدنيا، فيقول ألا من مستغفر فأغفر له، ألا مسترزق فأرزقه، ألا مبتلى فأعافيه، ألا كذا ألا كذا حتى يطلع الفجر

হযরত আলী ইবনে আবু তালিব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন–“মধ্য-শাবানের রাত (চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাত) যখন আসে, তখন তোমরা এ রাতটি ইবাদত-বন্দেগীতে কাটাও এবং দিনের বেলা রোযা রাখ। কেননা, এ রাতে সূর্যাস্তের পর আল্লাহ তা‘আলা প্রথম আসমানে আসেন এবং বলেন, কোন ক্ষমাপ্রার্থী আছে কি? আমি তাকে ক্ষমা করব। আছে কি কোন রিযিকপ্রার্থী? আমি তাকে রিযিক দেব। কেউ আছে কি আপদগ্রস্ত? তাকে আমি নিষ্কৃতি দান করব।আছে কি এমুক, আছে কি ওমুক–এভাবে আল্লাহ তা‘আলা আহবান সুবহে সাদিক পর্যন্ত ।”

(সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ১৩৮৪)

এ হাদীসটি জয়ীফ। তবে এর সমর্থনে উপরে বর্ণিত সহীহ হাদীস থাকায় এটা গ্রহণযোগ্য। তা ছাড়া আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যহ রাতে প্রথম আসমানে এসে বান্দাদেরকে ঐরূপে আহবান করার ব্যাপারে সহীহ হাদীস বর্ণিত হয়েছে–যা এ হাদীসের বর্ণনাকে শক্তিশালী করে। এ ছাড়াও শাবান মাসে বেশী বেশী নফল রোযা রাখার কথা সহীহ হাদীসে এসেছে এবং ১লা শা‘বান থেকে ২৭ শা‘বান পযন্ত সবগুলো দিনই রোযা রাখার ক্ষেত্রে বিশেষ ফজীলতময়। শুধু কেবল রামাজানের ২/১ দিন আগে রোযা রেখে রামাজানকে এগিয়ে না এনে শেষবিরতি দিয়ে রামাজানের রোযা সুন্দরভাবে রাখার জন্য হাদীস শরীফে বলা হয়েছে। তবে যাদের প্রতিমাসে এদিন রোযা রাখার অভ্যাস তাদের কথা ভিন্ন। অপরদিকে আইয়ামে বীয অর্থাৎ প্রতি চান্দ্র মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে রোযা রাখার বিষয়টি সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। ফিকহের অনেক কিতাবে এদিনসমূহের রোযাকে মুস্তাহাব বা মাসনূন বলা হয়েছে। এ হিসেবে যাদের ইচ্ছা হয়, শবে বারাআতের দু’দিন আগের থেকে রোযা রেখে শবে বারাআতের রোযা সহকারে মোট তিনদিন রোযা রাখতে পারেন। এক্ষেত্রে এটাই উত্তম।


শবে বরাত নিয়ে মুফতী আব্দুল মালেক সাহেবের  শবে বরাত,বাড়াবাড়ি-ছাড়াছাড়ি কোনটাই কাম্য নয়  পড়ুন


সুতরাং শবে বারাআতের বিশেষ আমল হিসেবে এ রাতে নফল ইবাদত-বন্দেগী করা তথা নফল নামায পড়া, কুরআন তিলাওয়াত করা, তাসবীহ-তাহলীল পড়া, দরূদ শরীফ পড়া ও ইস্তিগফার করা প্রভৃতি আমল মুস্তাহাব। আর পরদিন অথবা আগের দুইদিন সহ মোট তিনদিন রোযা রাখা এর সংশ্লিষ্ট উত্তম আমল।

এ রাতে নফল নামায যার যতটুকু ইচ্ছা আদায় করতে পারে। এজন্য কোন সীমা নির্ধারিত নেই। আবার এ রাতের নামাযের জন্য কোন সূরাহও নির্দিষ্ট নেই যে, এই রাক‘আতে এই সূরাহ এতবার পড়তে হবে। তেমনি এ রাতের গোসলেরও কোন হুকুম নেই বা এমন কোন ফজীলত নেই যে, যত পানির ফোটা পড়বে, ততগুনাহ মাফ হবে। এ সবই গর্হিত বানোয়াট কথা। তেমনি এ রাত উদযাপনে বাড়াবাড়ি করা, হালুয়া-রুটি বিতরণ, মোমবাতি জ্বালানোর রুসম পালন ও পটকা ফুটানো গর্হিত কাজ।

এ রাতের নফল আমলসমূহ বিশুদ্ধ মতানুসারে একাকীভাবে করণীয়। ফরজ নামাযতো পুরুষদের অবশ্যই মসজিদে আদায় করতে হবে। এরপর যা কিছু নফল পড়ার, তা নিজ নিজ ঘরে একাকী পড়া বাঞ্ছনীয়। এসব নফল আমলের জন্য দলে দলে মসজিদে এসে সমবেত হওয়ার কোন প্রমাণ হাদীস শরীফে নেই।
তাই শবে বারাআত উপলক্ষে মসজিদে জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজন বা সমারোহ বাঞ্ছনীয় নয়। তেমনি দলবদ্ধ হয়ে এ রাতে কবরস্তান যিয়ারতেরও নিয়ম নেই। তবে একাকি কেউ কবর যিয়ারত করতে গেলে যেতে পারে এবং তা শুধু এ রাতের জন্য খাস নয়, যখন খুশী তখনই যেতে পারে। আর রাত জেগে যাতে ফজরের নামায কাজা না হয়, সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে এবং রাতে ইবাদত-বন্দেগী করতে করতে ঘুমের জরুরত অনুভূত হলে, তাও পূরণ করা বাঞ্ছনীয়।

এভাবে হাদীসে বর্ণিত সহীহ তরীকায় শবে বারাআতে আমল করা মুস্তাহাব। এদিকে লক্ষ্য করেই অনেক আইম্মায়ে মুহাদ্দিসীন তাদের কিতাবে শবে বারাআত নিয়ে ভিন্ন বাব কায়েম করেছেন এবং মুহাক্কিক মাশায়িখে উম্মত শবে বারাআত-এর ফজীলত ও আমলের ওপর পৃথকভাবে গ্রন্থ রচনা করেছেন। তাই এ রাতের বিশেষত্ব ও ফজীলতকে অস্বীকার করা হাদীস সম্পর্কে জাহালাতের শামিল।

[হাওয়ালা : ইকতিযাউস সিরাতিল মুসতাকীম, ২য় খণ্ড, ৬৩১-৬৪১ পৃষ্ঠা/ মারাকিল ফালাহ, ২১৯ পৃষ্ঠা প্রভৃতি]

আরো বিস্তারিত দেখুন – শবে বরাত ভিত্তিহীন নয় : প্রামাণ্যতা করণীয় ও বর্জনীয়

শবে বরাত,বাড়াবাড়ি-ছাড়াছাড়ি কোনটাই কাম্য নয় ।

মুফতি আব্দুল মালেক : এতোদিন পর্যন্ত শবে বরাতকে কেন্দ্র করে এক শ্রেণীর মানুষ বাড়াবাড়িতে লিপ্ত ছিলো। তারা এ রাতটি উপলক্ষে নানা অনুচিত কাজকর্ম এবং রসম-রেওয়াজের অনুগামী হচ্ছিলো। উলামায়ে কেরাম সব সময়ই এই সবের প্রতিবাদ করেছেন এবং এখনো করছেন। ইদানীং আবার এক শ্রেণীর মানুষের মধ্যে ছাড়াছাড়ির প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। তাদের দাবী হলো ইসলামে শবে বরাতের কোনো ধারণা নেই। এ ব্যাপারে যতো রেওয়ায়েত আছে সব মওজু বা জয়িফ (জাল বা দুর্বল)। এসব অনুযায়ী আমল করা এবং শবে বরাতকে বিশেষ কোনো ফজিলতপূর্ণ রাত মনে করা শরিয়তের দৃষ্টিতে জায়েয নয়। তারা এসব বক্তব্য সংবলিত ছোটখাট পুস্তিকা ও লিফলেট তৈরি করে মানুষের মধ্যে বিলি করে। বাস্তব কথা হলো, আগেকার সেই বাড়াবাড়ির পথটিও যেমন সঠিক ছিলো না, এখনকার এই ছাড়াছাড়ির মতটিও শুদ্ধ নয়। ইসলাম ভারসাম্যতার দীন এবং এর সকল শিক্ষাই প্রান্তিকতা মুক্ত সরল পথের পথ নির্দেশ করে।

শবে বরাতের ব্যাপারে সঠিক ও ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান হলো, এ রাতের ফজিলত সহি হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। সম্মিলিত কোনো রূপ না দিয়ে এবং এই রাত উদযাপনের বিশেষ কোনো পন্থা উদ্ভাবন না করে বেশি ইবাদত করাও নির্ভরযোগ্য রেওয়ায়েত দ্বারা প্রমাণিত।

এই রাতকে অন্য সব সাধারণ রাতের মতো মনে করা এবং এই রাতের ফজিলতের ব্যাপারে যতো হাদিস এসেছে, তার সবগুলোকে মওজু বা জয়িফ মনে করা ভুল যেমন অনুরূপ এ রাতকে শবে কদরের মতো বা তার চেয়েও বেশি ফজিলতপূর্ণ মনে করাও ভিত্তিহীন ধারণা।

শবে বরাতের (পনের শাবানের রাত) ফজিলত ও করণীয় এখানে শবে বরাতের (পনের শাবানের রাত) ফজিলত ও করণীয় বিষয়ক কিছু হাদিস যথাযথ উদ্ধৃতি ও সনদের নির্ভরযোগ্যতার বিবরণসহ উল্লেখ করা হলো।

একটি হাদিস

ﻋﻦ ﻣﻌﺎﺫ ﺑﻦ ﺟﺒﻞ رضي الله عنه ﻋﻦ ﺍﻟﻨﺒﻰ صلي الله عليه وسلم ﻗﺎﻝ ﻳﻄﻠﻊ ﺍﻟﻠﻪ ﺍﻟﻰ ﺧﻠﻘﻪ ﻓﻰ ﻟﻴﻠﺔ ﺍﻟﻨﺼﻒ ﻣﻦ ﺷﻌﺒﺎﻥ ﻓﻴﻐﻔﺮ ﻟﺠﻤﻴﻊ ﺧﻠﻘﻪ ﺇﻻ ﻟﻤﺸﺮﻙ ﺃﻭ ﻣﺸﺎﺣﻦ
মুয়াজ ইবনে জাবাল রা. বলেন, নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ তায়ালা অর্ধ-শাবানের রাতে (শাবানের চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাতে) সৃষ্টির দিকে (রহমতের) দৃষ্টি দেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যতীত আর সবাইকে ক্ষমা করে দেন।

(সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস নং ৫৬৬৫/ সুনানে বাইহাকী–শু‘আবুল ঈমান, হাদীস নং ৩৮৩৩/ মু‘জামে তাবরানী, কাবীর, হাদীস নং ৩৫৪৩)

এই হাদিস দ্বারা প্রমাণিত হচ্ছে যে, এ রাতে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে রহমত ও মাগফিরাতের দ্বারা ব্যাপকভাবে উন্মুক্ত হয়। কিন্তু শিরকি কাজ-কর্মে লিপ্ত ব্যক্তি এবং অন্যের ব্যাপারে হিংসা-বিদ্বেষ পোষণকারী মানুষ এই ব্যাপক রহমত ও সাধারণ ক্ষমা থেকেও বঞ্চিত থাকে।

যখন কোনো বিশেষ সময়ের ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে রহমত ও মাগফিরাত ঘোষণা হয়, তখন তার অর্থ এই হয় যে, এই সময় এমন সব নেক আমলের ব্যাপারে যত্ববান হতে হবে যার মাধ্যমে আল্লাহর রহমত ও মাগফিরাতের উপযুক্ত হওয়া যায় এবং ঐ সব গুনাহ থেকে বিরত থাকতে হবে। যার কারণে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে রহমত ও মাগফিরাত থেকে বঞ্চিত হয়। যেহেতু উপরোক্ত হাদিস এবং অন্যান্য হাদিসে অর্ধ-শাবানের রাতে ব্যাপক মাগফিরাতের ঘোষণা এসেছে, তাই এ রাতটি অনেক পূর্ব থেকেই শবে বরাত তথা মুক্তির রজনী নামে প্রসিদ্ধ হয়েছে। কেননা, এ রাতে গুনাহসমূহ থেকে মুক্তি লাভ হয় এবং পাপের অশুভ পরিণাম থেকে রেহাই পাওয়া যায়।

যদি শবে বরাতের ফজিলতের ব্যাপারে দ্বিতীয় কোনো হাদিস না থাকতো, তবে এই হাদিসটিই এ রাতের ফজিলত সাব্যস্ত হওয়ার জন্য এবং এ রাতে মাগফিরাতের উপযোগী নেক আমলের গুরুত্ব প্রমাণিত হওয়ার জন্য যথেষ্ট হতো। অথচ হাদিসের কিতাবসমূহে নির্ভরযোগ্য সনদে এ বিষয়ক আরো একাধিক হাদিস বর্ণিত হয়েছে।

হাদিসটির সনদ বিষয়ক আলোচনা
উপরোক্ত হাদিসটি অনেক নির্ভরযোগ্য হাদিসের কিতাবেই নির্ভরযোগ্য সনদের মাধ্যমে বর্ণিত হয়েছে। ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে হিব্বান তার কিতাবুস সহি-এ -যা সহি ইবনে হিব্বান নামেই সমধিক প্রসিদ্ধ- এই হাদিসটি উদ্ধৃত করেছেন। এটি এই কিতাবের ৫৬৬৫ নং হাদিস। এছাড়া ইমাম বাইহাকি রহ. শুআবুল ঈমান-এ (৩/৩৮২, হাদিস ৩৮৩৩); ইমাম তাবরানি আলমুজামুল কাবির ও আলমুজামুল আওসাত-এ বর্ণনা করেছেন। এ ছাড়াও আরো বহু হাদিসের ইমাম তাদের নিজ নিজ কিতাবে হাদিসটি উল্লেখ করেছেন।

হাদিসটির সনদ সহি। কেউ কেউ হাদিসটিকে পারিভাষিক দৃষ্টিকোণ থেকে হাসান বলেছেন; কিন্তু হাসান হাদিস সহি তথা নির্ভরযোগ্য হাদিসেরই একটি প্রকার। ইমাম মনজিরি, ইবনে রজব, নুরুদ্দিন হাইসামি, কাস্তাল্লানি, জুরকানি এবং অন্যান্য হাদিস বিশারদ এই হাদিসটিকে আমলযোগ্য বলেছেন।
[দেখুন আত-তারগিব ওয়াত তারহিব ২/১৮৮; ৩/৪৫৯. লাতায়েফুল মাআরিফ ১৫১; মাজমাউজ জাওয়ায়েদ ৮/৬৫; শারহুল মাওয়াহিবিল লাদুন্নিয়্যা ১০/৫৬১]

বর্তমান সময়ের প্রসিদ্ধ শায়খ নাসিরুদ্দিন আলবানি রহ. সিলসিলাতুল আহাদসিস-সাহিহা ৩/১৩৫-১৩৯ এ এই হাদিসের সমর্থনে আরো আটটি হাদিস উল্লেখ করার পর লেখেন, ‘এ সব রেওয়ায়েতের মাধ্যমে সমষ্টিগতভাবে এই হাদিসটি নিঃসন্দেহে সহি প্রমাণিত হয়। তারপর আলবানি রহ. ওই সব লোকের বক্তব্য খন্ডন করেন যারা কোনো ধরনের খোঁজখবর ছাড়াই বলে দেন যে, শবে বরাতের ব্যাপারে কোনো সহি হাদিস নেই।
ইদানিং আমাদের কতক সালাফি বা গাইরে মুকাল্লিদ বন্ধুকে দেখা যায়, তারা নানা ধরনের লিফলেট বিলি করেন। তাতে লেখা থাকে যে, শবে বরাত (লাইলাতুল নিস্ফি মিন শাবান) এর কোনো ফজিলতই হাদিস শরিফে প্রমাণিত নেই। ওই সব বন্ধুরা শায়খ আলবানি রহ. এর গবেষণা ও সিদ্ধান্ত থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেন। কেননা, তাদেরকে আলবানি রহ. এর বড় ভক্ত মনে হয় এবং তার কিতাবাদি অনুবাদ করে প্রচার করতেও দেখা যায়।

এই রাতের আমল
উল্লেখিত হাদিস শরিফে এ রাতের কী কী আমলের নির্দেশনা-ইঙ্গিত পাওয়া যায়, তা আমি ইতিপূর্বে উল্লেখ করেছি। নিম্নে এ বিষয়ে আরেকটি হাদিস পেশ করছি।
عن عائشة بنت أبي بكر قالت قام رسول الله صلي الله عليه وسلم من الليل يصلي فأطال السجود حتى ظننت أنه قد قبض فلما رأيت ذلك قمت حتى حركت إبهامه فتحرك فرجعت فلما رفع إلي رأسه من السجود وفرغ من صلاته قال يا عائشة أظننت أن النبي قد خاس بك؟ قلت لا والله يا رسول الله ولكنني ظننت أنك قبضت لطول سجودك فقال أتدرين أي ليلة هذه؟ قلت الله ورسوله أعلم قال هذه ليلة النصف من شعبان، إن الله عز وجل يطلع على عباده في ليلة النصف من شعبان فيغفر للمستغفرين ويرحم المسترحمين ويؤخر أهل الحقد كما هم

হজরত আলা ইবনুল হারিস রহ. থেকে বর্ণিত, হজরত আয়েশা রা. বলেন, একবার রাসুলুল্লাহ সা. রাতে নামাজে দাঁড়ান এবং এত দীর্ঘ সেজদা করেন যে, আমার ধারণা হলো তিনি হয়তো মৃত্যুবরণ করেছেন। আমি তখন উঠে তার বৃদ্ধাঙ্গুলি নাড়া দিলাম। তার বৃদ্ধাঙ্গুলি নড়লো। যখন তিনি সেজদা থেকে উঠলেন এবং নামাজ শেষ করলেন তখন আমাকে লক্ষ্য করে বললেন, হে আয়েশা! অথবা বলেছেন, ও হুমাইরা, তোমার কি এই আশঙ্কা হয়েছে যে, আল্লাহর রাসুল তোমার হক নষ্ট করবেন? আমি উত্তরে বললাম, না, ইয়া রাসুলুল্লাহ। আপনার দীর্ঘ সেজদা থেকে আমার এই আশঙ্কা হয়েছিলো, আপনি মৃত্যুবরণ করেছেন কি না। নবীজী জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি জান এটা কোন রাত? আমি বললাম, আল্লাহ ও তার রাসুলই ভালো জানেন। রাসুলুল্লাহ সা. তখন ইরশাদ করলেন, ‘এটা হলো অর্ধ শাবানের রাত (শাবানের চৌদ্দ তারিখের দিবাগত রাত)। আল্লাহ তায়ালা অর্ধ-শাবানের রাতে তার বান্দার প্রতি মনযোগ দেন এবং ক্ষমাপ্রার্থনাকারীদের ক্ষমা করেন এবং অনুগ্রহ প্রার্থীদের অনুগ্রহ করেন আর বিদ্বেষ পোষণকারীদের ছেড়ে দেন তাদের অবস্থাতেই।’ [শুআবুল ঈমান, বায়হাকি ৩/৩৮২-৩৬৮]

ইমাম বায়হাকি রহ. এই হাদিসটি বর্ণনার পর এর সনদের ব্যাপারে বলেছেন, ‘এই হাদিস দ্বারা প্রমাণিত হয়, এ রাতে দীর্ঘ নফল পড়া, যাতে সেজদাও দীর্ঘ হবে, শরিয়তের দৃষ্টিতে কাম্য। তবে মনে রাখতে হবে যে, অনেক অনির্ভরযোগ্য ওজিফার বই-পুস্তকে নামাজের যে নির্দিষ্ট নিয়ম-কানুন লেখা আছে অর্থাৎ এতো রাকাত হতে হবে, প্রতি রাকাতে এই সুরা এতোবার পড়তে হবে- এগুলো ঠিক নয়। হাদিস শরিফে এসব নেই। এগুলো মানুষের মনগড়া পন্থা। সঠিক পদ্ধতি হলো, নফল নামাজের সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী দুই রাকাত করে যতো রাকাত সম্ভব হয় পড়তে থাকা।
কুরআন কারিম তিলওয়াত করা। দরুদ শরিফ পড়া। ইস্তেগফার করা। দোয়া করা এবং কিছুটা ঘুমের প্রয়োজন হলে ঘুমানো। এমন যেনো না হয় যে, সারা রাতের দীর্ঘ ইবাদতের ক্লান্তিতে ফজরের নামাজ জামাতের সাথে পড়া সম্ভব হলো না।

পরদিন রোজা রাখা
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে, হজরত আলি ইবনে আবি তালেব রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, পনের শাবানের রাত (চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাত) যখন আসে তখন তোমরা এ রাতটি ইবাদত-বন্দেগিতে কাটাও এবং দিনের বেলা রোজা রাখ। কেননা, এ রাতে সূর্যাস্তের পর আল্লাহ তায়ালা প্রথম আসমানে আসেন এবং বলেন, কোনো ক্ষমাপ্রার্থী আছে কি? আমি তাকে ক্ষমা করবো। আছে কি কোনো রিজিক প্রার্থী? আমি তাকে রিজিক দেব। এভাবে সুবেহ সাদিক পর্যন্ত আল্লাহ তায়ালা মানুষের প্রয়োজনের কথা বলে তাদের ডাকতে থাকেন। [সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস ১৩৮৪] এই বর্ণনাটির সনদ জয়িফ বা দুর্বল। কিন্তু মহাদ্দিসিনে কেরামের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হলো, ফাজায়েলের ক্ষেত্রে জয়িফ হাদিস গ্রহণযোগ্য। তাছাড়া শাবান মাসে বেশি বেশি নফল রোজা রাখার কথা সহি হাদিসে এসেছে এবং আইয়ামে বিজ অর্থাৎ প্রতি চন্দ্র মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে রোজা রাখার বিষয়টিও সহি হাদিস দ্বারা প্রমাণিত।

বলা বাহুল্য, পনের শাবানের দিনটি শাবান মাসেরই একটি দিন এবং তা আইয়ামে বিজের অন্তর্ভুক্ত। এজন্য ফিকেহর একাধিক কিতাবেই এদিনে রোজাকে মুস্তাহাব বা মাসনুন লেখা হয়েছে। আবার অনেকে বিশেষভাবে এ দিনের রোজাকে মুস্তাহাব বা মাসনুন বলতে অস্বীকার করেছেন। এ প্রসঙ্গে হজরত মাওলানা মুহাম্মাদ তকি উসমানি দা.বা. তার ইসলাহি খুতুবাতে বলেন, ‘আরো একটি বিষয় হচ্ছে শবে বরাতের পরবর্তী দিনে অর্থাৎ শাবানের পনের তারিখে রোজা রাখা। গভীরভাবে বিষয়টি উপলব্ধি করা প্রয়োজন। হাদিসে রাসুলের বিশাল ভাণ্ডার হতে একটি মাত্র হাদিস এর সমর্থনে পাওয়া যায়। তাতে বলা হয়েছে, শবে বরাতের পরবর্তী দিনটিতে রোজা রাখ। সনদ বর্ণনার সূত্রের দিক থেকে হাদিসটি দুর্বল। তাই এ দিনের রোজাকে এই একটি মাত্র দুর্বল হাদিসের দিকে তাকিয়ে সুন্নাত বা মুস্তাহাব বলে দেয়া অনেক আলেমের দৃষ্টিতে অনুচিত।’

এ রাতের নফল আমলসমূহ সম্মিলিত নয়, ব্যক্তিগত
এ বিষয়টিও মনে রাখতে হবে যে, এ রাতের নফল আমলসমূহ, বিশুদ্ধ মতানুসারে একাকীভাবে করণীয়। ফরজ নামাজ তো অবশ্যই মসজিদে আদায় করতে হবে। এরপর যা কিছু নফল পড়ার তা নিজ নিজ ঘরে একাকী পড়বে। এসব নফল আমলের জন্য দলে দলে মসজিদে এসে সমবেত হওয়ার কোনো প্রমাণ হাদিস শরিফেও নেই আর সাহাবায়ে কেরামরে যুগেও এর রেওয়াজ ছিলো না। [ইক্তিযাউস সিরাতিল মুসতাকিম ২/৬৩১-৬৪১; মারাকিল ফালাহ ২১৯]


আরও জানতে পড়ুন শবে বরাত এর তাৎপর্য, ফজীলত ও আমল।


তবে কোনো আহ্বান ও ঘোষণা ছাড়া এমনিই কিছু লোক যদি মসজিদে এসে যায়, তাহলে প্রত্যেকে নিজ নিজ আমলে মশগুল থাকবে, একে অন্যের আমলের ব্যাঘাত সৃষ্টির কারণ হবে না। কোনো কোনো জায়গায় এই রেওয়াজ আছে যে, এ রাতে মাগরিব বা ইশার পর থেকেই ওয়াজ-নসিহত আরম্ভ হয়। আবার কোথাও ওয়াজের পর মিলাদ-মাহফিলের অনুষ্ঠান হয়। কোথাও তো সারা রাত খতমে-শবিনা হতে থাকে। উপরন্তু এসব কিছুই করা হয় মাইকে এবং বাইরের মাইকও ছেড়ে দেয়া হয়। মনে রাখতে হবে, এসব কিছুই ভুল রেওয়াজ। শবে বরাতের ফাজায়েল ও মাসায়েল আগেই আলোচনা করা হয়েছে। এ রাতে মাইক ছেড়ে দিয়ে বক্তৃতা-ওয়াজের আয়োজন করা ঠিক নয়। এতে না ইবাদতে আগ্রহী মানুষের পক্ষে ঘরে বসে একাগ্রতার সাথে ইবাদত করা সম্ভব হয়, আর না মসজিদে। অসুস্থ ব্যক্তিদের প্রয়োজনীয় আরামেরও মারাত্মক ব্যাঘাত ঘটে। আল্লাহ আমাদের এসব ভুল কাজকর্ম পরিহার করার তাওফিক দিন।

এ রাতের আপত্তিকর কাজকর্ম
খিচুড়ি বা হালুয়া-রুটির প্রথা, মসজিদ, ঘর-বাড়ি বা দোকান-পাটে আলোক-সজ্জা, পটকা ফুটানো, আতমবাজি, কবরস্থান ও মাজারসমূহে ভিড় করা, মহিলাদের ঘরের বাইরে যাওয়া, বিশেষ করে বেপর্দা হয়ে দোকানপাট, মাজার ইত্যাদি স্থানে ভিড় করা, এসব কিছুই এ রাতের আপত্তিকর কাজ। এসব কাজের কোনো কোনোটা তো অন্য সময়েও হারাম। আর কিছু কাজ সাধারণ অবস্থায় জায়েজ থাকলেও (যেমন : খিচুড়ি রান্না করে গরিব-মিসকিনদের মাঝে বণ্টন করা) এগুলোকে শবে বরাতের কাজ মনে করা বা জরুরি মনে করা এবং এসবের পেছনে পড়ে এ রাতের মূল কাজ তওবা, ইস্তেগফার, নফল ইবাদত ইত্যাদি থেকে বঞ্চিত থাকার কোনো বৈধতা থাকতে পারে কি? এসব কিছুই শয়তানের ধোঁকা। মানুষকে আসল কাজ থেকে বিরত রাখার জন্যই শয়তান এসব কাজ-কর্মে মানুষকে লাগিয়ে রাখে। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে শাবান মাসে সকল গুনাহ ও পাপরাশি থেকে পবিত্র হয়ে যথাযথভাবে রমজান মাসকে বরণ করার তাওফিক দান
করুন। আমিন।
– লেখক : গবেষণামূলক উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মারকাযুদ্ দাওয়াহ আলইসলামিয়া ঢাকা

 

আলীমুল গায়েব বা অদৃশ্যের জ্ঞানী

হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  কি আলীমুল গায়েব তথা পূর্বাপর এবং বর্তমানের সকল বিষয়ে অবগত ছিলেন ?

গায়েব জানা বলা হয়! অদৃশ্যের সকল খবর জানা, এবং অদৃশ্যের সকল বিষয় কেউ জানানো ব্যতিত নিজস্বভাবে জানা। এধরণের গায়েব একমাত্র আল্লাহ তা‘আলাই জানেন।

হুযূর সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের গায়েব জানা সম্পর্কে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের আক্বীদা:

পৃথিবী সৃষ্টির শুরু থেকে ইহকালীন ও পরকালীন দৃশ্য-অদৃশ্যের সকল বিষয়ের বিস্তারিত জ্ঞান একমাত্র আল্লাহ তা‘আলারই রয়েছে। তবে আল্লাহ তা‘আলা আম্বিয়ায়ে কিরামকে ওহী ও ইলহামের মাধ্যমে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিষয়ে অবগত করেছেন। বিশেষ করে আমাদের নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তাঁর শান অনুযায়ী আল্লাহ তা‘আলার স্বত্বা ও সিফাত সম্পর্কে এবং অতীত ও ভবিষ্যতের অসংখ্য ঘটনার মাধ্যমে আলমে বরযখ, কবরের অবস্থা, হাশরের ময়দানের চিত্র, জান্নাত ও জাহান্নামের পরিস্থিতি ইত্যাদি বিষয়ে অনেক জ্ঞান দান করেছেন যা অন্য কোন নবী এবং নৈকট্য লাভকারী ফেরেশতাকেও দেওয়া হয়নি। এবং এর অনেক বিষয় নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম উম্মাতকে জানিয়ে ছিলেন। এটাকে গায়েব জানা বলা হয় না। কারণ এগুলি অদৃশ্যের সকল গায়েব না। দ্বিতীয়ত যতটুকু জেনেছেন তা আল্লাহ তা‘আলা তাকে জানিয়েছেন, তিনি আবার উম্মাতকে জানিয়েছেন।

সুতরাং হুযূর সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দৃশ্য-অদৃশ্যের সকল বিষয়ের তিনি জানতেন এবং পৃথিবীর শুরুলগ্ন থেকে যা কিছু ঘটেছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত যা কিছু ঘটবে সবকিছুই তিনি জানেন, অথবা তাঁর জীবদ্দশায় কিংবা মৃত্যুপরবর্তী সময়ে কখন কোথায় কী হচ্ছে, তা সবকিছুই তিনি জানেন বা দেখছেন, এমন আক্বীদা পোষন করা স্পষ্ট কুফুরী ও শিরিকী আকীদা,যা ঈমান বিধ্বংসী বিশ্বাস।

মনে রাখতে হবে যে, হুযূর সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে সাধারণ থেকে সাধারণ বেআদবী যেমন কুফুরীর কারণ, ঠিক তেমনিভাবে তাকে খোদায়ী গুণ, যেমন ‘আলীমুল গায়েবের গুণে গুণান্বিত করে খোদার আসনে বসানোও সুস্পষ্ট শিরক এবং শানে উলূহিয়্যাতের সাথে চরম বেআদবী। আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে সঠিক আক্বীদা পোষন করার তাওফীক দান করুন । (আমীন)

কুরআনের অসংখ্য আয়াত এবং নবীয়ে কারীম (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর অগণিত হাদীস দ্বারা উল্লেখিত আক্বীদা প্রমানিত। সেগুলোর মধ্য হতে কয়েকটি আয়াত ও হাদীস এখানে পেশ করা হল।

১নং আয়াতঃ

قُلْ لَا يَعْلَمُ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ الْغَيْبَ إِلَّا اللَّهُ وَمَا يَشْعُرُونَ أَيَّانَ يُبْعَثُونَ

অর্থ: (হে নবী) আপনি বলুন! আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া আসমান-যমীনে অন্য কেউ অদৃশ্যের জ্ঞান রাখেনা। এবং তারা জানে না কখন তারা উত্থিত হবে। (সূরা নামল, আয়াত-৬৫)

২নং আয়াতঃ 

قُلْ لَا أَقُولُ لَكُمْ عِنْدِي خَزَائِنُ اللَّهِ وَلَا أَعْلَمُ الْغَيْبَ وَلَا أَقُولُ لَكُمْ إِنِّي مَلَكٌ إِنْ أَتَّبِعُ إِلَّا مَا يُوحَى إِلَيَّ –

অর্থ: (হে নবী) আপনি বলুন! আমি তোমাদেরকে বলি না যে, আমার নিকট আল্লাহর ধন-ভান্ডার রয়েছে। এবং আমি গায়েব জানি না, এবং আমি তোমাদের এটাও বলিনা যে, আমি একজন ফেরেশতা। আমার নিকট যা প্রত্যাদেশ হয় আমি কেবল তারই অনুসরন করি। (সুরা আন‘আম, আয়াত- ৫০)


এটা পড়ুন জনসংখ্যা ও বিশ্বাস



৩ নং আয়াতঃ

إِنَّ اللَّهَ عِنْدَهُ عِلْمُ السَّاعَةِ وَيُنَزِّلُ الْغَيْثَ وَيَعْلَمُ مَا فِي الْأَرْحَامِ وَمَا تَدْرِي نَفْسٌ مَاذَا تَكْسِبُ غَدًا وَمَا تَدْرِي نَفْسٌ بِأَيِّ أَرْضٍ تَمُوتُ إِنَّ اللَّهَ عَلِيمٌ خَبِيرٌ (34)

অর্থ: কিয়ামতের জ্ঞান কেবল আল্লাহরই রয়েছে। তিনি বারি বর্ষণ করেন, এবং তিনি জানেন জরায়ুতে কী রয়েছে। কেউ জানে না আগামীকাল সে কী অর্জন করবে। এবং কেউ জানে না কোন স্থানে তার মৃত্যু ঘটবে। নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা সর্বজ্ঞ, সর্ববিষয়ে অবগত । (সুরা আন‘আম, আয়াত- ৩৪)

৪ নং আয়াতঃ   وَعِنْدَهُ مَفَاتِحُ الْغَيْبِ لَا يَعْلَمُهَا إِلَّا هُوَ

অর্থ: অদৃশ্যের চাবিকাঠি কেবল আল্লাহর নিকট রয়েছে, তিনি ছাড়া অন্য কেউ জানেনা। (সুরা আন‘আম, আয়াত- ৫৯)

৫নং আয়াতঃ

قُلْ لَا أَمْلِكُ لِنَفْسِي نَفْعًا وَلَا ضَرًّا إِلَّا مَا شَاءَ اللَّهُ وَلَوْ كُنْتُ أَعْلَمُ الْغَيْبَ لَاسْتَكْثَرْتُ مِنَ الْخَيْرِ وَمَا مَسَّنِيَ السُّوءُ

অর্থ: (হে নবী) আপনি বলুন! আল্লাহ তা‘আলা যা ইচ্ছা করেন, তা ব্যতিত আমার নিজের ভাল মন্দের উপরও আমার কোন অধিকার নেই। যদি আমি গায়েব জানতাম তাহলে আমি প্রভূত কল্যাণ লাভ করতাম এবং কোন অকল্যাণ আমাকে স্পর্শ করত না। (সুরা আ‘রাফ, আয়াত-১৮৮)

উল্লেখিত সবগুলো আয়াতে স্পষ্ট বলে দেওয়া হয়েছে একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া অন্য কেউ (চাই সে নবী হোক কিংবা ফেরেশতা) অদৃশ্যের জ্ঞান রাখে না।

হাদীস নং ১:

عن عَائِشَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا، قَالَتْ: «وَمَنْ حَدَّثَكَ أَنَّهُ يَعْلَمُ الغَيْبَ، فَقَدْ كَذَبَ، وَهُوَ يَقُولُ: لاَ يَعْلَمُ الغَيْبَ إِلَّا اللَّهُ»

অর্থ: হযরত আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, যে ব্যক্তি তোমাকে বলে নবীজি (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) গায়েব জানেন, সে মিথ্যাবাদী। কারণ নবীজি (স.) নিজেই বলতেন, আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া অন্য কেউ গায়েব জানে না। (বুখারী, হাদীস নং- ৭৩৮০)

২নং হাদীস:

عن اياس بن سلمة عن ابيه قَالَ: كَانَ رَسُولُ اللهِ صَلَّ اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي قُبَّةٍ حَمْرَاءَ، إِذْ جَاءَهُ رَجُلٌ عَلَى فَرَسٍ عَقُوقٍ يَتْبَعُهَا مُهْرُهُ، فَقَالَ: مَنْ أَنْتَ؟ قَالَ: «أَنَا رَسُولُ اللهِ» قَالَ: مَتَى السَّاعَةُ؟ قَالَ: «غَيْبٌ، وَلَا يَعْلَمُ الْغَيْبَ إِلَّا اللهُ» قَالَ: فَمَتَى نُمْطَرُ؟ قَالَ: «غَيْبٌ، وَلَا يَعْلَمُ الْغَيْبَ إِلَّا اللهُ» قَالَ: فَمَا فِي بَطْنِ فَرَسِي؟ قَالَ: «غَيْبٌ، وَلَا يَعْلَمُ الْغَيْبَ إِلَّا اللهُ»

উপরোক্ত হাদীসের সারাংশ হল, এক অশ্বারোহী নবীয়ে কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর খিদমতে উপস্থিত হয়ে তাঁকে গায়েবের বিষয়ে তিনটি প্রশ্ন করল, ১. কিয়ামত কখন সংঘটিত হবে? ২. আমাদের উপর বৃষ্টি কখন বর্ষন হবে? ৩. আমার ঘোড়ার পেটের বাচ্চাটি কি (নর না মাদী)?

নবীয়ে কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম সবগুলোর উত্তরে বলেছেন, এটা গায়েবের বিষয় আর গায়েব আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া আর কেউ জানেনা ।

এখন আমার প্রশ্ন হল যদি নবীয়ে কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম গায়েব জানতেনই তাহলে তিনি উল্লেখিত প্রশ্নগুলোর উত্তর না দিয়ে একথা কেন বললেন যে, ইহা গায়েবের বিষয় ,আর গায়েব আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না? (আল মু‘জামুল কাবীর,হাদীস নং : ৬৬৪৫)

৩নং হাদীস:

عَنِ أَبِي سَعِيدٍ قَالَ: دَخَلَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَلَى بَعْضِ أَهْلِهِ فَوَجَدَ عِنْدَهُمْ تَمْرًا أَجْوَدَ مِنْ تَمْرِهُمْ، فَقَالَ: «مِنْ أَيْنَ هَذَا؟» فَقَالُوا: أَبْدَلَنَا صَاعَيْنِ بِصَاعٍ،

নবীয়ে কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম একবার তার কতক বিবির নিকট গমন করলেন, তখন তাদের ঘরে যে খেজুর ছিল তার চেয়ে উত্তম খেজুর দেখে বললেন, তোমরা এ খেজুর কোথা থেকে পেলে? তারা বলল, আমরা আমাদের দুই সা’ (নিম্নমানের খেজুর) এর বিনিময়ে এক সা’ (উত্তম খেজুর) গ্রহন করেছি। (মুসান্নাফে আব্দুর রায্যাক,হাদীস নং : ১৬১৯১)

এবার বলুন, নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম যদি গায়েব জানতেনই তাহলে বিবিদেরকে কেন প্রশ্ন করলেন যে, তোমরা এ খেজুর কোথা থেকে পেলে?

৪নং হাদীস:   

আমের ইবনে মালেক নামে এক ব্যক্তি নবীয়ে কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর দরবারে উপস্থিত হয়ে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! যদি নজদবাসীর নিকট কিছু সাহাবী প্রেরণ করা হয়  আর তারা নজদবাসীকে ইসলামের দাওয়াত দেয়, তাহলে আমি আশা করি তারা ইসলাম গ্রহন করবে। নবীজি সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তাদের ব্যাপারে আমার আশংকা হয়। তখন সে বলল, আমি তাদের দায়িত্ব নিব। সুতরাং তার দায়িত্ব গ্রহনের শর্তে নবীজি সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম সত্তরজন  সাহাবীর এক জামা‘আত যারা ক্বারী হিসেবে প্রসিদ্ধ ছিলেন,তাদেরকে নজদে প্রেরণ করলেন। যখন এই কাফেলা বীরে মা‘ঊনা নামক স্থানে পৌঁছলেন, তখন নজদবাসী এই সত্তরজন সাহাবীর কাফেলাকে শহীদ করে ফেলল।(বুখারী, হাদীস নং: ৩০৬৪)

সম্মানিত পাঠক! নবীজি সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম যদি গায়েব জানতেন যে, তারা সত্তরজন জালীলুর কদর সাহাবীকে শহীদ করে ফেলবে, তাহলে কি নবীজি সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদেরকে প্রেরণ করতেন? তিনি কি এতটাই নির্দয়? (নাঊযুবিল্লাহ)

৫নং হাদীস:

খাইবার যুদ্ধের পর যাইনাব বিনতে হারিস নামক এক ইয়াহুদী মহিলা কোন কৌশলে নবীয়ে কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বিষ মিশ্রিত বকরীর গোশত হাদিয়া পেশ করল। নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম গোশত মুখে দেওয়া মাত্রই ‘গোশতের টুকরাটিই’ বিষ মিশ্রিত হওয়ার বিষয়টি নবীজীকে জানিয়ে দিল। সাথে সাথে নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম গোশত রেখে দিলেন। ইতিমধ্যে নবীজীর সঙ্গী সাহাবী বিশর ইবনে বারা (রাযি.) তা গলধঃকরণ করে ফেলেন। ফলে এর বিষক্রিয়ায় তিনি ইন্তিকাল করেন। নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামও এর বিষক্রিয়ায় কিছুটা আক্রান্ত হয়েছিলেন। ফলে তিনি চিকিৎসা স্বরূপ শিংগা লাগান। এবং পরবর্তীতে যখন নবীজী মৃত্যরোগে আক্রান্ত হন তখনও তিনি উক্ত বিষক্রিয়া অনুভব করেছিলেন। (বুখারী, হাদীস নং- ৪২৪৯, আল বিদায়া ওয়ান নিহয়া: ৪/১২৭-১২৮)

এখন পাঠকের নিকট আমার প্রশ্ন হল, নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম যদি গায়েব জানতেন তাহলে কি তিনি বিষমিশ্রিত গোশত নিজে মুখে দিতেন এবং নিজ সাহাবীকে খেতে দিতেন?

উপরোল্লিখিত আয়াত ও হাদীস দ্বারা একথা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়ে গেল যে নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম আলীমুল গায়েব ছিলেন না।

নবীয়ে কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের গায়েব জানা সম্পর্কে প্রচলিত ভ্রান্ত আক্বীদা

বিদ‘আতী ও রেজাখানীদের আক্বীদা হল, পৃথিবীর শুরুলগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত যা কিছু ঘটেছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত যা কিছু ঘটবে, সবকিছুই নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম জানেন। এবং তার মৃত্যুপূর্ববর্তী ও পরবর্তী সময়ে যখন যেখানে যা কিছুই ঘটছে, সবকিছুই তিনি জানেন। তারা এর স্বপক্ষে কয়েকটি আয়াত ও হাদীস পেশ করেন। নিম্নে সেগুলো জাওয়াব সহ উল্লেখ করা হল।

১নং আয়াত: وَمَا كَانَ اللَّهُ لِيُطْلِعَكُمْ عَلَى الْغَيْبِ وَلَكِنَّ اللَّهَ يَجْتَبِي مِنْ رُسُلِهِ مَنْ يَشَاءُ

অর্থঃ আল্লাহ তা‘আলার শান এটা নয় যে, তিনি তোমাদেরকে গায়েবের বিষয়ে অবগত করবেন, তবে তিনি স্বীয় রাসূলগণের মধ্যে যাকে ইচ্ছা মনোনিত করেন। (সূরা আলে ইমরানঃ আয়াত- ১৭৯)

বিদ‘আতীদের বক্তব্য হল, উক্ত আয়াত দ্বারা বুঝা যায় যে, আল্লাহ তা‘আলা আম্বিয়ায়ে কিরামকে গায়েবের বিশেষ জ্ঞান দান করেছেন।

২য় আয়াত:              فَلَا يُظْهِرُ عَلَى غَيْبِهِ أَحَدًا     (26) إِلَّا مَنِ ارْتَضَى مِنْ رَسُولٍ

অর্থঃ আল্লাহ তা‘আলা তাঁর মনোনিত রাসূল ব্যতিত গায়েবের বিষয়ে কাউকে অবহিত করেন না। (সূরা জিন্ন-আয়াত-২৬-২৭)

তারা বলে, এই আয়াত স্পষ্টরূপে প্রমাণ করে যে, আল্লাহ তা‘আলা নবীজীকে অদৃশ্যের বিশেষ জ্ঞান দান করেছেন।

খন্ডনঃ এ কথা সর্বস্বীকৃত যে, আল্লাহ তা‘আলা আম্বিয়ায়ে কিরামকে ওহী ও ইলহামের মাধ্যমে প্রয়োজন অনুযায়ী কিছু বিষয়ে গায়েবের জ্ঞান দান করেছেন। কিন্তু এর দ্বারা এটা প্রমানিত হয় না যে, নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অদৃশ্যের সকল জ্ঞান দেওয়া হয়েছে।

২নং আয়াতের পূর্বের আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, قُلْ إِنْ أَدْرِي أَقَرِيبٌ مَا تُوعَدُونَ أَمْ يَجْعَلُ لَهُ رَبِّي أَمَدًا (25)

এ আয়াতে مَا تُوعَدُونَ দ্বারা উদ্দেশ্য হল, আযাব অথবা কিয়ামত, তাহলে আয়াতের অর্থ হয়, হে নবী আপনি বলে দিন, তোমাদেরকে যে (আযাব বা কিয়ামতের) প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, তা নিকটে নাকি আমার প্রভু তার জন্য কোন সময় নির্ধারন করেছেন, তা আমার জানা নেই। (সূরা জিন-আয়াত-২৫)

এ আয়াত দ্বারা স্পষ্ট হল যে, নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম আযাব অথবা কিয়ামতের সময় সম্পর্কে জানেন না। তাহলে এ কথা বলা কিভাবে সহীহ হল যে, নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম অদৃশ্যের সকল বিষয়ে অবগত?

উপরোল্লিখিত আলোচনা দ্বারা একথা দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট হয়ে গেল যে, নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম আলীমুল গায়েব ছিলেন না। সাথে সাথে একথাও মনে রাখতে হবে যে, নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম আলীমুল গায়েব না হওয়ায় আল্লাহ তা‘আলা তাকে যে মর্যাদা দান করেছেন তাতে সামান্যতমও ঘাটতি আসবে না, বরং যথার্থই বাকী থাকবে। কারণ নবী বা রাসূল হওয়ার জন্য গায়েবের ইলম থাকা শর্ত নয়, তার নিকট ওহী আসা শর্ত। আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে সঠিক আক্বীদা পোষন করার তাওফীক দান করুন। (আমীন)

মহানবীর ﷺ কিছু অনন্য বৈশিষ্ট্য

প্রিয়নবী মুহাম্মাদ ﷺ কে আল্লাহ্‌ এমন কিছু বৈশিষ্ট্য দিয়েছিলেন যা তিনি সৃষ্টিজগতের আর কোন মানুষকে এমনকি অন্য কোন নবী-রাসূলকেও দেননি। ইসলামী পরিভাষায় এগুলোকে আল্লাহর রাসূলের “খাসাইস” (অনন্য বৈশিষ্ট্য) বলে। কোন কোন স্কলার কুরআন-হাদিস ঘেঁটে প্রিয়নবী মুহাম্মাদ ﷺ  এর প্রায় ৫০টি অনন্য বৈশিষ্ট্য বের করেছেন। এরকম কিছু বৈশিষ্ট্য নিচে তুলে ধরা হলো:

১) প্রিয়নবী মুহাম্মাদ ﷺ হলেন সর্বশেষ নবী।

আল্লাহ্‌ বলেন: “মুহাম্মাদ তোমাদের মধ্যে কোন পুরুষের পিতা নন, বরং তিনি আল্লাহর রাসূল ও শেষ নবী। আল্লাহ্‌ সর্ববিষয়ে সর্বজ্ঞ।” (সূরা আহযাব ৩৩:৪০)

২) আল্লাহ্‌  আদি পিতা আদম (আ) এর দেহে রুহ ফুঁকে দেয়ারও আগে মুহাম্মাদ ﷺ এর নবুওয়তের বিষয়টি নির্ধারণ করেছিলেন।

এক সাহাবী একবার জিজ্ঞেস করল: হে আল্লাহর রাসূল? আপনি যে নবী হবেন সেটা আল্লাহ্‌ কবে নির্ধারণ করেছিলেন? রাসূলুল্লাহ ﷺ জবাবে বলেছিলেন – যখন আদম মাটি (ত্বীন) ও রুহ এর মধ্যবর্তী ছিলেন (অর্থাৎ, আদমের মাটির দেহে তখনও রুহ ঢুকানো হয়নি)।

৩) পূর্ববর্তী প্রত্যেক নবীকে পাঠানো হয়েছিল তাঁর যুগের ও তাঁর জাতির মানুষের জন্য। এক্ষেত্রে একমাত্র ব্যতিক্রম হলেন আমাদের নবী মুহাম্মাদ ﷺ।  তিনি একমাত্র নবী যাকে সমস্ত মহাবিশ্বের সকল জাতির জন্য, কেয়ামত অবধি সকল যুগের জন্য নবী হিসাবে পাঠানো হয়েছে। শুধু তাই না – তিনি একমাত্র নবী যাকে কেবল মানবজাতিরই নয়, বরং সমস্ত জ্বীন জাতির জন্যেও নবী করে পাঠানো হয়েছে।

৪) প্রিয়নবী মুহাম্মাদ ﷺ কে আল্লাহ্‌ দিয়েছিলেন রু’উব। আল্লাহর রাসূল বলেন – “আল্লাহ্‌ আমাকে রু’উব দিয়ে সাহায্য করেছেন। রু’উব এমন এক রকম ভয় যার ফলে আমি আমার শত্রুদের কাছে পৌঁছানোর আগেই তারা আমার ভয়ে ভীত হয়ে পড়ে। এমনকি আমি তাদের থেকে এক মাস ভ্রমণ পরিমাণ দূরত্বে অবস্থান করলেও তারা আমার ভয়ে ভীত থাকে।”

৫) তাঁকে দেয়া হয়েছে সর্ববৃহৎ উম্মাহ। সাহিহ বুখারীতে বর্ণিত এক হাদিস থেকে জানা যায়, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন – আল্লাহ্‌ আমাকে বিভিন্ন নবীর উম্মাতদেরকে দেখালেন। তার মধ্যে এক নবীর উম্মাহ বিশাল বড় ছিল। আমি বললাম – এরা বোধহয় আমার উম্মাহ। আমাকে বলা হল – না, এরা মুসা (আ) এর উম্মাহ। এরপর আমার চোখে পড়ল তার চাইতেও বড় এক উম্মাহ – যা কিনা দিগন্ত পর্যন্ত ছাড়িয়ে গিয়েছিল। আমাকে বলা হলো – এরাই আপনার উম্মাহ ।

আরেক হাদিসে বলা হয়েছে – একবার রাসূলুল্লাহ ﷺ সাহাবীদের প্রশ্ন করলেন – “তোমরা কি চাও জান্নাতের এক-তৃতীয়াংশ তোমাদের মানুষেরা হবে?”

তারা খুশীতে বলে উঠল – “আল্লাহু আকবার!”

“তোমরা কি একথা শুনে খুশী হবে যে জান্নাতের অর্ধেকটা তোমাদের মানুষেরা হবে?”

“আল্লাহু আকবার!”

“আল্লাহর কসম – আমি আশা করি জান্নাতবাসীর দুই-তৃতীয়াংশ হবে আমার উম্মাহ”।

লক্ষণীয় যে, আজকে আমাদের কাছে এই হাদিসটাকে নিতান্ত সাধারণ মনে হতে পারে, কিন্তু তৎকালীন সাহাবীদের জন্য এটা ছিল এক বিরাট ঈমান-উদ্দীপক বাণী। সে সময় দুনিয়ার মোট মুসলিমের সংখ্যা সর্বসাকুল্যে দেড়-দু’হাজার ছিল, আর সেখানে খ্রিষ্টান ছিল কয়েক মিলিয়ন, ইহুদী ছিল কয়েক লক্ষ। মুসলিমদের সংখ্যা এক সময় সব জাতিকে ছাড়িয়ে যাবে, এটা চিন্তা করে সাহাবীরা তখন কতটা অনুপ্রানিত হয়েছিলেন তা এখন আমাদের কল্পনারও বাইরে।

৬) আল্লাহ ﷻ প্রিয়নবী মুহাম্মাদ ﷺ কে দিয়েছেন সকল মু’জিযার (miracle) শ্রেষ্ঠ মু’জিযা – “আল-কুরআন”।  আমরা জানি – মুসা(আ) লাঠির আঘাতে লোহিত সাগর দ্বিখন্ডিত করেছিলেন, ঈসা(আ) মৃতকে পুনরজ্জিবীতে করেছিলেন, নূহ(আ) তাঁর বিশাল কিস্তিতে ভেসে তাঁর অনুসারীদের রক্ষা করেছিলেন – কিন্তু ভেবে দেখুন এই মু’জিযাগুলো সবই ঐতিহাসিক ব্যাপার। আমরা কেউই মুসা(আ) কে লোহিত সাগর দ্বিখন্ডিত করতে দেখিনি, কেউই ঈসা(আ) কে দেখিনি মৃতকে পুনরজ্জীবিত করতে বা নূহ(আ) কে তাঁর বিশাল কিস্তি পানিতে ভাসিয়ে দিতে; কিন্তু আমরা সবাই কুরআন দেখেছি, যার ইচ্ছা হয় পড়েছি। কুরআন এমন এক মু’জিযা যা নাজিলের ১৪শত বছর পরেও আমরা নিজের চোখে দেখতে পারি, হাত দিয়ে ছুঁতে পারি, নিজের জ্ঞান-বুদ্ধি দিয়ে বুঝতে পারি এটা কত আশ্চর্য এক গ্রন্থ!

– আরবী ভাষার যে কোন পন্ডিত স্বীকার করবেন যে আরবী সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ হলো কুরআন। এত উচ্চ মার্গীয় ব্যাকরণ ও কাব্যিকতা আরবী ভাষার আর কোন গ্রন্থে খুঁজে পাওয়া যায় না। আরবী ভাষার মূল ব্যাকরণই কুরআন থেকে উদ্ভূত হয়েছে।

– কুরআন মানবজাতির ইতিহাসকে যেভাবে পরিবর্তিত করেছে, পৃথিবীর ইতিহাসে আর কোন একক গ্রন্থ এ কাজ করে দেখাতে পারেনি। কুরআনকে অনুসরণের কারণে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সভ্যতায় পৃথিবীতে সবচেয়ে অন্ধকারে থাকা আরব জাতি আজ থেকে ১৪ শত বছর আগে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী ও উন্নত জাতিতে পরিণত হয়েছিল। কুরআনের প্রভাব এমনকি ছড়িয়ে পড়েছিল বিভিন্ন অনারব ভূখন্ডেও, আর এর প্রভাবে দলে দলে বিভিন্ন জাতি ইসলাম গ্রহণ করেছিল। এক কুরআনের প্রভাবে নগ্ন-পদের বেদূঈনরা তৎকালীন সুপার-পাওয়ার রোমানদেরকে পরাজিত করেছিল, ছেড়া কাগজের মত টুকরো টুকরো করে ফেলেছিল মহাপরাক্রমশালী ফার্সী বাদশা খসরুর সাম্রাজ্য। ইসলামের স্বর্ণযুগে পৃথিবীর এক-তৃতীয়াংশ ছিল মুসলিমদের শাসনে। পদার্থ বিজ্ঞান, চিকিৎসা বিজ্ঞান, রসায়ন বিজ্ঞান, গণিত, ইতিহাস, অর্থনীতি সহ জ্ঞানের প্রতিটি শাখায় মুসলিমরা সে সময় নেতৃত্ব দিয়েছে। আর এ সবই হয়েছিল একটি মাত্র গ্রন্থ – আল-কুরআনকে অনুসরণের কারণে। আর বর্তমান সময়ে বিশ্বজুড়ে মুসলিমরা মার খাচ্ছে ঠিক তার বিপরীত কারণে – কুরআনকে জীবন নির্দেশিকা হিসাবে গ্রহণ না করার কারণে।

– পৃথিবীতে কুরআন যত বইয়ের জন্ম দিয়েছে, যত স্কুলের জন্ম (মাদ্রাসা শব্দের ইংরেজী হলো স্কুল) দিয়েছে, আর কোন একক বই তা দেয়নি। আজ বিশ্ব জুড়ে যে লক্ষ লক্ষ হাদিস গ্রন্থ, তাফসির গ্রন্থ, সীরাহ গ্রন্থ, ফিকহী গ্রন্থ – আমরা দেখতে পাই, এই সমগ্র ইসলামী সাহিত্যের উৎস হলো একটি মাত্র বই – আল-কুরআন।

– কুরআন এমন এক গ্রন্থ যাতে আছে ধর্মীয় বিশ্বাসের মূলনীতি (theology), ইবাদত করার পদ্ধতি, নৈতিকতা শিক্ষা ,অতীতের ইতিহাস, ভবিষ্যতে কি হবে তার বর্ণনা, পারিবারিক/সামাজিক/রাষ্ট্রীয় আইন, বিভিন্ন রকম বৈজ্ঞানিক নিদর্শনের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা, এমনকি একজন মানুষ তার ব্যক্তিগত জীবন কিভাবে পরিচালিত করবে, কিভাবে নিজেকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখবে তা-ও। অবতীর্ণ হওয়ার ১৪শত বছর পরেও এই পৃথিবীর ১.৬ বিলিয়ন মুসলিম এই গ্রন্থের প্রতিটা অক্ষরকে যেভাবে বিশ্বাস করে, যেভাবে সম্মান প্রদর্শন করে, এই বইয়ে যেভাবে লেখা আছে সেভাবে অযু করে নিজেকে পবিত্র করে, সালাত আদায় করে, রমজানে রোজা রাখে, যাকাত আদায় করে, হজ্জ্ব পালন করে – তা সত্যিই এই বিশ্বের সবচেয়ে বিস্ময়কর ঘটনা, কিন্তু প্রতিদিন আমরা এটা ঘটতে দেখি বলে এটা আমাদের চোখে পড়ে না।


এটাও পড়ুন মহানবীর সাঃ এর কিছু নাম


– পৃথিবীতে যত বেশী মানুষ কুরআন পড়েছে, আর অন্য কোন গ্রন্থকে মানবজাতি সেভাবে পড়েনি। প্রতিবছর শুধু রমজান মাসে যে পরিমাণ কুরআন পড়া হয়, ৫০ বছরেও পৃথিবীর আর কোন গ্রন্থ এতবার পড়া হয় না। পৃথিবীতে কুরআনকে প্রথম থেকে শেষ অক্ষর পর্যন্ত যতবার, যত মানুষ মুখস্থ করেছে – আর কোন গ্রন্থকেই এভাবে করা হয়নি, করা হয় না।

সুতরাং, একথা নি:সন্দেহে বলা যায় যে – যদিও প্রত্যেক নবীর প্রত্যেক মু’জিযাই আল্লাহর ﷻ অসামান্য ক্ষমতার বহি:প্রকাশ, কিন্তু কুরআনের সাথে অন্য মু’জিযাগুলোর কোন তুলনা হয় না।

৭) প্রিয়নবী মুহাম্মাদ ﷺ কে সম্মানিত করা হয়েছে ইসরা ও মি’রাজ এর মাধ্যমে – যখন তাঁকে একেবারে আল্লাহর ﷻ আরশের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। অন্য কোন মানুষ, এমনকি কোন ফেরেশতাকেও কখনো আল্লাহর ﷻ এত কাছে যেতে দেয়া হয়নি। এই যাত্রার একটা সময় জিব্রিল(আ) প্রিয়নবী মুহাম্মদ ﷺ কে  বলেছিলেন – “হে আল্লাহর রাসূল বাকী পথ আপনাকে একা যেতে হবে, কারণ এর উপরে যাওয়ার অনুমতি আমার নেই”।

৮) প্রিয়নবী মুহাম্মদ ﷺ হলেন সমগ্র মানবজাতির নেতা। এক হাদিসে তিনি বলেছেন – “আমি হলাম সমস্ত আদম-সন্তানের সাইয়েদ (নেতা, রোল-মডেল)”।

৯) শিঙ্গায় দ্বিতীয় ফুতকারের পর সর্বপ্রথম যিনি কবর থেকে পুনরুত্থিত হবেন তিনি আমাদের প্রিয়নবী মুহাম্মদ ﷺ (বুখারী)। পুনরুত্থান দিবসে সব মানুষ নগ্ন অবস্থায় উত্থিত হবে। এদের মধ্যে সর্বপ্রথম কাপড় পড়ানো হবে প্রিয়নবী মুহাম্মদ ﷺ কে।

১০) পুনরুত্থান দিবসে প্রিয়নবী মুহাম্মদ ﷺ কে দেয়া হবে সর্ববৃহৎ হাউস “আল-কাউসার”, যা আমরা সূরা আল-কাউসার এর তাফসীর থেকে জানি। আল-কাউসার হলো বর্গাকৃতির একটি হাউস (Pool), যার একেকটি বাহুর দৈর্ঘ্য হবে মক্কা থেকে ইয়েমেনের সান’আ  পর্যন্ত – যা কিনা প্রায় ১ হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ। আবার, আল-কাউসার বলতে জান্নাতের মূল নদীটাকেও বুঝায়, জান্নাতের অন্য সকল নদী হলো এই আল-কাউসার নদীর শাখা-প্রশাখা। এর ব্যাখায় স্কলারেরা বলেছেন – প্রিয়নবী মুহাম্মদ ﷺ কে আল্লাহ্‌ যে আল-কাউসার উপহার দিয়েছেন, তার বরকতে যেন সকল জান্নাতবাসীর তৃষ্ণা মিটবে।

১১) সর্বপ্রথম পুলসিরাত পার হওয়ার গৌরব অর্জন করবেন আমাদের নবী মুহাম্মদ ﷺ । সর্বপ্রথম মানুষ হিসাবে জান্নাতে প্রবেশের সম্মানও দেয়া হবে প্রিয়নবী মুহাম্মদ ﷺ কে। যখন তিনি জান্নাতের দরজায় এসে কড়া নাড়বেন তখন ফেরেশতা তাকে জিজ্ঞেস করবে – “কে আপনি?” তিনি বলবেন – “আমি মুহাম্মাদ রাসূলুল্লাহ”। সে উত্তর দিবে –“শুধু আপনি আসলেই আমাকে জান্নাতের দরজা খোলার অনুমতি দেয়া হয়েছে!”। একথার পর নিজের ডান পা রাখার মাধ্যমে আল্লাহ্‌ রাসূল ﷺ সর্বপ্রথম মানুষ যিনি জান্নাতে প্রবেশ করবেন। তাঁর পিছু পিছু প্রবেশ করবে তাঁর উম্মতেরা – যারা যুগের হিসাবে সর্বশেষ, কিন্তু জান্নাতে প্রবেশের ক্ষেত্রে সর্বপ্রথম উম্মত হবে।

১২) প্রিয়নবী মুহাম্মদ ﷺ কে আল্লাহ্‌ জান্নাতুল ফেরদৌসের সর্বশিখরে বসবাস করার একক সম্মান দিবেন। জান্নাতের লোকসংখ্যার বন্টন হলো পিরামিডের মত – লেভেল যত নিচের দিকে হবে, মানুষদের সংখ্যা তত বেশী হবে, আর লেভেল যত উপরে হবে মানুষের সংখ্যাও তত কম হবে। এই লেভেল উপরে উঠতে উঠতে সর্বোচ্চ যে লেভেলটা থাকবে – সেই লেভেলে যাওয়ার মত মর্যাদা কেবল একজন মানুষেরই থাকবে – আর তিনি হলেন আমাদের প্রিয়নবী মুহাম্মদ ﷺ । এই লেভেলটি আল্লাহর ﷻ আরশের ঠিক নিচে অবস্থিত আর এর নাম হলো “আল-ফাদিলাহ”। প্রিয়নবী মুহাম্মদ ﷺ বলেছেন – “আল-ফাদিলাহ হলো জান্নাতের একটি লেভেল যা কিনা আল্লাহ্‌ কেবল তাঁর একজন মাত্র বান্দাকে দিবেন “, এরপর তিনি ﷺ স্বভাবসুলত বিনয়ের সাথে বলেছেন, “আর আমি আশা রাখি যে আমি-ই সেই বান্দাহ” – যদিও তিনি নিশ্চিত জানতেন যে তিনি নিজেই হলেন আল-ফাদিলাহ পাওয়ার জন্য উপযুক্ত একমাত্র ব্যক্তি।

প্রত্যেকবার আযানের পর আমরা যে দু’আ করি তাতেও কিন্তু আমরা বলি – “আ-তি মুহাম্মাদানিল ওয়াসিলাতা ওয়াল ফাদিলাহ” –  হে আল্লাহ আপনি মুহাম্মাদ ﷺ কে আল-ওয়াসিলাহ ও আল-ফাদিলাহ দিন।

সূত্র ও কৃতজ্ঞতা:

  • শেইখ ইয়াসির কাযীর সীরাহ লেকচার

    লেখক-আদনান ফয়সাল

 

মহানবীর সাঃ এর কিছু নাম

আরবী ভাষায় কোন কিছুর গুরুত্ব বোঝাতে ও কোন কিছুর প্রতি ভালবাসা প্রকাশ করার অন্যতম একটা উপায় হচ্ছে তাকে বিভিন্ন নামে ডাকা। এই কারণেই, মহান আল্লাহ্‌ ﷻ কে আমরা বিভিন্ন নামে ডাকি – আর তার মধ্যে ৯৯টি নাম প্রসিদ্ধ। একইভাবে, রাসূলুল্লাহ ﷺ এরও বহু নাম আছে – যার কিছু দিয়েছেন স্বয়ং আল্লাহ্‌ ﷻ, কিছু দিয়েছেন সাহাবীরা, আর কিছু দিয়েছেন তাঁর প্রতি ভালবাসার প্রকাশ-স্বরূপ তাবে’ইরা ও পরবর্তী যুগের স্কলারেরা।  কোন কোন স্কলারের মতে রাসূলুল্লাহ ﷺ এর ২৫০টিরও বেশী গুণবাচক নাম আছে। এখানে আমরা তাঁর এমন কিছু নাম নিয়ে আলোচনা করব যেগুলো স্বয়ং মহান আল্লাহ্‌ তাঁকে দিয়েছেন।

কুরআন মাজিদে বর্ণিত রাসূলের ﷺ নাম: 

কুরআন মাজিদে রাসূলুল্লাহ ﷺ কে অনেকগুলো বিশেষণে (Adjective) ভূষিত করা হয়ে থাকলেও তাঁর জন্য দুইটি মাত্র বিশেষ্য (Noun) ব্যবহার করা হয়েছে। এই দুইটি হলো –মুহাম্মাদ ও আহমাদ। মুহাম্মাদ নামটা কুরআনে মোট চারবার আছে, আর আহমাদ নামটা আছে একবার।

মুহাম্মাদ ও আহমাদ দুইটি নামই এসেছে “হামিদা” শব্দমূল থেকে। “হামদ” শব্দের অর্থ হলো প্রশংসা করা – এ প্রশংসা যেন-তেন রকমের প্রশংসা নয়, সর্বোচ্চ পর্যায়ের প্রশংসা, স্থান-কালের উর্দ্ধের প্রশংসা, যে প্রশংসা ধন্যবাদ জানানোর জন্য নয়, বরং গুণের কারণে করা হয়। রাসূলুল্লাহ ﷺ এর নামের মূলে “হামদ” ব্যবহারের অর্থ হলো – তিনি এমন একজন মানুষ যিনি সর্বসময়, সর্বাবস্থায় প্রশংসনীয়, তিনি যা তিনি তারই জন্য প্রশংসনীয়, তিনি তাঁর কর্মের কারণে প্রশংনীয়, আবার তিনি কিছু যদি না-ও করে থাকতেন তবুও শুধু সৃষ্টিগত কারণেই তিনি প্রশংসনীয়। তিনি বেঁচে থাকতে প্রশংসনীয়, মৃত্যুর পরেও প্রশংসনীয়, দুনিয়াতে প্রশংসনীয়, হাশরের মাঠে প্রশংসনীয়, এমনকি জান্নাতে প্রবেশের পরেও প্রশংসনীয় ।

এতো গেল সর্বসময়ে রাসূলুল্লাহ ﷺ এর  প্রশংসিত হবার কথা। এবার আসুন দেখি কে কে তাঁর প্রশংসা করে? রাসূলুল্লাহ ﷺ এমন একজন মানুষ যার প্রশংসা স্বয়ং আল্লাহ্‌ ﷻ করেছেন, নবীরা করেছে, ফেরেশতারা করেছে, সমস্ত মানবজাতি করেছে – মুসলিমরা করেছে এমনকি অমুসলিমরাও করেছে।

মুসলিমরা তাঁর প্রশংসা করে তাঁর বাণীকে অনুসরণ করে। আর অমুসলিমরাও তাঁর প্রশংসা করে, যদিও তা সরাসরি নয়। অমুসলিমরা কিভাবে তাঁর প্রশংসা করে? তাঁর যে মানবীয় গুনাবলী – সত্যবাদীতা, দানশীলতা, দয়া, মায়া, ভালোবাসা, স্নেহ, ন্যায়বিচার, কঠোর সংগ্রাম, মানব প্রেম, সেন্স অফ হিউমার – সেগুলো সকল যুগের সকল মানুষের কাছে গ্রহনীয়, প্রশংসনীয় – আর এই গুনগুলোর প্রশংসা করার মাধ্যমে অমুসলিমেরা ইনডাইরেক্ট ভাবে তাঁর প্রশংসা করে। মানব ইতিহাসে আমাদের প্রিয়নবী মুহাম্মাদ ﷺ এর চেয়ে বেশী প্রশংসিত মানুষ আর একটিও আসে নাই, আর একটিও আসবে না।


রাসুল সাঃ এর অনন্য গুণাগুণ মহানবী সাঃ এর ব্যতিক্রমধর্মী বিনয় এটা পড়ুন


মুহাম্মাদ আর আহমাদ নাম দুইটার পার্থক্য কি? মুহাম্মাদ শব্দের অর্থ হচ্ছে যাকে অনবরত, একের পর এক প্রশংসা করে যাওয়া হয়। কাজেই, মুহাম্মাদ নামের মাধ্যমে আমাদের প্রিয়নবীর প্রশংসার সংখ্যাধিক্য কে বুঝানো হয়েছে (Quantity of praise)। আর আহমাদ বলতে বুঝায় সবচেয়ে ভালো উপায়ে যাকে প্রশংসা করা হয় (Quality of praise)। কাজেই, আহমাদ নামের মাধ্যমে আমাদের প্রিয়নবীর প্রশংসার গুনগত মানকে বুঝানো হয়েছে।  সকল ভালো গুণের সমারোহ , আর সকল ভালো গুনের আধিক্য – এই দুইয়ের সমন্বয়ই হলেন আমাদের প্রিয়নবী সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ মুহাম্মাদ ﷺ ইবনে আব্দুল্লাহ।

আমরা যদি কুরআনে  রাসূলুল্লাহ ﷺ এর নামগুলো কিভাবে ব্যবহৃত হয়েছে  সেদিকে তাকাই তাহলে দেখব – যখনই নবী মুসা (আ) এর মুখ দিয়ে রাসূলের ﷺ নাম উচ্চারিত হয়েছে তখনই ‘মুহাম্মাদ’ ব্যবহৃত হয়েছে; অন্যদিকে যখনই নবী ঈসা (আ) এর মুখ দিয়ে রাসূলের ﷺ নাম উচ্চারিত হয়েছে তখনই ‘আহমাদ’ ব্যবহৃত হয়েছে। কুরআনে রাসূলের ﷺ নামের ব্যবহারের এই পার্থক্য নিয়ে খুব চমৎকার একটা ব্যাখা দিয়েছেন ইবনুল কাইয়ূম (মৃত্যু ৭৫১ হিজরী)।

ইবনুল কাইয়ূম বলেন – আমরা জানি ‘মুহাম্মাদ’ নামের অর্থ হলো যাকে অনেক অনেক মানুষ প্রশংসা করে (Quantity of praise) আর ‘আহমাদ’ নামের অর্থ হলো যাকে সবচেয়ে ভালো গুণের মাধ্যমে প্রশংসা করা হয় (Quality of praise)। আমরা যদি নবী মুসা (আ) এর উম্মতের দিকে লক্ষ্য করি তাহলে দেখব আমাদের নবী মুহাম্মাদের ﷺ পরে সবচেয়ে বেশী সংখ্যক উম্মত ছিল মুসা (আ) এর। যেহেতু মুসা (আ) এর উম্মতেরা তাদের নিজেদের সংখ্যার কারণে গর্বিত, তাই মুসা (আ) তাঁর উম্মতদের জানিয়ে দিচ্ছেন যে, আমার পরে এমন এক নবী আসবে যে হবে কিনা ‘মুহাম্মাদ’ তথা তার উম্মতের সংখ্যা হবে তোমাদের চাইতেও বেশী। অন্যদিকে, নবী ঈসা (আ) এর হাওয়ারিদের (শিষ্য/Disciple) সংখ্যা ছিল কম, কিন্তু তাদের ইমান ছিলো খুবই মজবুত – শত অপবাদ, নিপীড়ন, অত্যাচারের মুখেও তারা নবী ঈসা (আ) কে দৃঢ়তার সাথে অনুসরণ করে গেছে। নবী ঈসা তার পরবর্তী নবীকে ‘আহমাদ’ নামে তাঁর উম্মতদের কাছে পরিচয় করিয়ে দেয়ার অর্থ হচ্ছে – তিনি বলছেন – শোন, আমার পরে এমন এক নবী আসবে যে কিনা হবে আমার চেয়েও বেশী গুণে গুণান্বিত, ফলে তাঁর যারা হবে ছাত্র – সেই সাহাবা ও তাঁর উম্মতেরাও তোমরা হাওয়ারিদের চাইতেও বেশী গুণান্বিত হবে।

হাদিসে বর্ণিত রাসূলের ﷺ কিছু নাম:

“যুবাইর ইবনে মুত’ইম থেকে বর্ণিত। মহানবী ﷺ বলেছেন – আমার অনেকগুলো নাম আছে। আমি মুহাম্মাদ; আর আমি আহমাদ; আর আমি আল-মাহি, অর্থাৎ যার মাধ্যমে আল্লাহ্‌ কুফরী কে দূরীভূত করবেন; আর আমি আল-হাশির, কারণ আমার পদ অনুসরণ করে (অর্থাৎ আমার পরে) মানুষকে হাশর (উত্থান) করা হবে; আর আমি আল-‘আকিব, অর্থাৎ যার পরে আর কোন নবী আসবে না, আর আমি রহমতের নবী, আমি তাওবার নবী (অর্থাৎ আমাকে অনুসরণ করলে মানুষ ক্ষমা পাবে), আর আমি আল-মুকাফফা (একটা বৃহৎ চেইন এর সর্বশেষে এসে যে কোন কিছুকে পূর্নতা দেয়); আর আমি মালাহিমের নবী” । – (সাহিহ মুসলিম ও অন্যান্য) 

মালাহিম শব্দের অর্থ হলো – যিনি অনেক ফিতনার (trials and tribulations) বার্তা নিয়ে আসেন। রাসূল ﷺ নিজেকে মালাহিমের নবী বলেছেন কারণ – মানুষ সৃষ্টির পর থেকে সবচেয়ে বড় ফিতনা হলো দাজ্জাল, আর এই দাজ্জাল আসবে আমাদের নবী মুহাম্মাদ ﷺ এর উম্মাতের উপর। এছাড়া কেয়ামতের ছোট ও বড় যত আলামত আছে – সবই আসবে এই উম্মাতের উপর। নিজেকে মালাহিমের নবী বলার মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ ﷺ আমাদের সতর্ক করে দিয়েছেন যে – তাঁর মৃত্যুর পর আমরা অনেক বেশী ফিতনা দেখতে পাব।

এগুলো ছাড়াও আল্লাহ্‌ তায়ালা রাসুল সাঃ কে অনেক গুনবাচক নামে ডেকেছেন । সেগুলো অন্য প্রবন্ধে আলোচনা করব ইনশা–আল্লাহ্‌ ।

প্রাসঙ্গিক রেফারেন্স:

৩) http://corpus.quran.com/

৪) Meaning of Muhammad and Ahmad – http://en.islamtoday.net/quesshow-14-738.htm

লেখক-
আদনান ফয়সাল

তোমাদের রবীন্দ্রনাথ ও কিছু কথা-মুসা আল হাফিজ

শুনতে খারাপ শোনা গেলেও এটা সত্য, রবীন্দ্রনাথের পৈতৃক ব্যবসার মধ্যে অন্যতম সফল ব্যবসা ছিলো পতিতালয় ব্যবসা।
রবীন্দ্রনাথের দাদা দ্বারকানাথের কলকাতা নগরীতে ৪৩টা বেশ্যালয় ছিলো। এছাড়া ছিলো মদ আর আফিমের ব্যবসাও।
(সূত্র: এ এক অন্য ইতিহাস, অধ্যায়: অসাধারণ দ্বারকানাথ, লেখক: গোলাম আহমদ মর্তুজা, পৃষ্ঠা: ১৪১) “রবীন্দ্রনাথের দাদা দ্বারকানাথ ছিলেন
দেড়শ টাকা বেতনের ইংরেজ ট্রেভর প্লাউডেনের চাকর । দ্বারকানাথ ধনী হয়েছিলেন অনৈতিক ব্যবসার দ্বারা। রবীন্দ্রনাথের দাদা দ্বারকানাথ ঠাকুরের তেতাল্লিশটা বেশ্যালয় ছিল কলকাতাতেই।
( তথ্যসূত্র: কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকা,২৮শে কার্তিক,১৪০৬, রঞ্জন
বন্দ্যোপাধ্যায়)”

তবে রবীন্দ্রনাথ পতিতাদের মধ্যেও যে সাহিত্য রস খুজে পেয়েছেন সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। রবীন্দ্রনাথ ঢাকায় বুড়িগঙ্গার পাশে বিখ্যাত গঙ্গাজলী’র (একটি এলাকার নাম যেখানে ঐ সময় বিশাল পতিতালয় ছিলো) পাশে এসে লিখেছিলেন “বাংলার বধূ বুকে তার মধু”।

সত্যি কথা বলতে, ঐ সময় কলকাতায় বিশেষ কারণে যৌনরোগ সিফিলিস খুব কমন ছিলো। তাই ১৯২৮ সালে অবতার পত্রিকায় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সিফিলিস রোগের খবরটা তেমন গুরুত্ব পায় নি। (রবীন্দ্রনাথের সিফিলিস হয়েছিলো এর সূত্র: বই-নারী নির্যাতনের রকমফের, লেখক: সরকার সাহাবুদ্দিন আহমদ, পৃষ্ঠা: ৩৪১,)

রবীন্দ্রনাথকে যারা দেবতা ভাবতে চান,তাদের বলছি, সিফিলিস – গনোরিয়া কাদের হয়? বলবেন দয়া করে?

##দুই

আজকাল ভারতের উগ্র জাতীয়তাবাদী দল বিজেপি প্রায়ই বলে থাকে ভারতের সকল মুসলমানই হিন্দু।ফলে তাদেরকে ঘরে ওয়াপসি করতে হবে। পুরোপুরি হিন্দু হয়ে যেতে হবে। কথাটা কিন্তু ভারতের জাতীয় কবি রবীন্দ্রনাথই প্রথম চালু করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন: “মুসলমানরা ধর্মে ইসলামানুরাগী হলেও জাতিতে তারা হিন্দু। কাজেই তারা ‘হিন্দু মুসলমান’।” (সূত্র: আবুল কালাম শামসুদ্দিনের লেখা অতীত দিনের স্মৃতি, পৃষ্ঠা: ১৫০)

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এমন ব্যক্তি, যিনি মুসলমানদের আবার হিন্দুতে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য যে কমিটি হয় সেই কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন। এই কমিটির কাজ ছিল নিম্নবর্ণের যেসব হিন্দু মুসলিম হয়েছে তাদের আবার হিন্দু ধর্মে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া । (উৎসঃ প্রশান্ত পালের রবি জীবনী ৬ষ্ঠ খন্ডের ২০৭ এবং ২০৮ পৃষ্ঠা, আনন্দ পাবলিশার্স লিমিটেড, কলকাতা।)

গোড়া হিন্দুদের মত সতীদাহ প্রথাকে সমর্থন করে কবিতাও লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। লিখুন,সমস্যা নেই। কিন্তু স্বামীর চিতায় জীবন্ত স্ত্রীর পুড়ে যাওয়াকে মুসলমানরা অপছন্দ করেন বলে তিনি ‘যবন ‘ গালি দিয়ে মুসলমানদের হুমকি দিচ্ছেন
“জ্বল জ্বল চিতা ! দ্বিগুন দ্বিগুন
পরান সপিবে বিধবা বালা
জ্বলুক জ্বলুক চিতার আগুন
জুড়াবে এখনই প্রাণের জ্বালা
শোনরে যবন, শোনরে তোরা
যে জ্বালা হৃদয়ে জ্বালালি সবে
স্বাক্ষী রলেন দেবতার তার
এর প্রতিফল ভুগিতে হবে”
(জ্যোতিন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা জ্যোতিন্দ্রনাথের নাট্য সংগ্রহ, কলকাতা: বিশ্ব ভারতী ১৯৬৯, পৃষ্ঠা: ২২৫)

যারা রবী ঠাকুরকে অসাম্প্রদায়িক বানাতে চান,দয়া করে বলুন কোন অর্থে তিনি অসাম্প্রদায়িক?

##তিন

“রবীন্দ্রনাথের প্রতিষ্ঠিত শান্তিনিকেতনে এক সময় কোনো মুসলমান ছাত্রের প্রবেশাধিকার ছিল না। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে চাঁদা চেয়েছিলেন হায়দ্রাবাদের নিজামের কাছেও। নিজাম তাকে চাঁদা দেন এক লাখ টাকা। এক লাখ টাকা সে সময় ছিল অনেক। রবীন্দ্রনাথ ভাবতে পারেননি নিজাম এতটা চাঁদা দেবেন। নিজামের চাঁদার সুত্র ধরেই সামান্য কিছু মুসলিম ছাত্র সুযোগ পায় বিশ্বভারতীতে লেখাপড়া শেখার। সাহিত্যিক মুজতবা আলী হলেন যাদের মধ্যে একজন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয় ১৯২১ সালের জুলাই মাসে। হিন্দুরা চাননি ঢাকাতে একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হোক। এমনকি ঢাকার হিন্দুরাও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের বিরুদ্ধে ছিলেন। তারা মনে করেছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হবে আসলে একটি মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়। শোনা যায়, রবীন্দ্রনাথও চাননি ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হোক। (সেক্যুলারদের অতিমাত্রায় রবীন্দ্রপুজার রহস্য উন্মোচন – এবনে গোলাম সামাদ :০৭ মে,২০১১, শনিবার, বিডিনিউজ টুয়েন্টি ফোর ডট কমে প্রকাশিত)

১৯১২ খ্রিস্টাব্দের ২৮ মার্চ কলিকাতার গড়ের মাঠে এক বিরাট সমাবেশ করা হয়। ঠিক তার দু’দিন পূর্বে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ মিটিং হয়েছিল। সেখানেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল যে, ঢাকায় ইউনিভার্সিটি হতে দেওয়া যাবে না। উক্ত উভয় সভার সভাপতি ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ( তথ্যসূত্র: কলকাতা ইতিহাসের
দিনলিপি, ড. নীরদ বরণ হাজরা, ২য় খণ্ড, ৪র্থ পর্ব)।

” ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে কলকাতার গড়ের মাঠে যে সভা হয়, তাতে সভাপতি ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এসব বাধার কারণে ১৯১১ সালে ঘোষণা দিলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রস্তাবটি আঁতুর ঘরে পড়ে থেকে মৃত্যুর প্রহর গুনছিল। অবশেষে নানা বিষয়ে সমঝোতা হয়, যার মধ্যে ছিল মনোগ্রামে ‘সোয়াস্তিকা’ এবং ‘পদ্ম’ ফুলের প্রতীক থাকবে।
প্রতিবাদকারীরা খুশি হন। এরপর ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়।” ( তথ্যসূত্র: ডক্টর কাজী জাকের হোসেন : দৈনিক ইনকিলাব, ১০ মার্চ, ২০০২)।”

১৯১২ সালের ২৮শে মার্চ কলিকাতা গড়ের মাঠে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভাপতিত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রতিবাদে এক বিশাল জনসভার আয়োজন করা হয়। [ তথ্যসূত্র: আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ধারাবাহিকতা এবং প্রাসঙ্গিক কিছু কথা, লেখক,মেজর জেনারেল (অব.) এম এ মতিন (সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা)] ১৯১২ সালের ১৮ই মার্চ কলিকাতার গড়ের মাঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করে হিন্দুরা যে সভা করল, সেই সভায় সভাপতিত্ব করলেন স্বয়ং কবি রবীন্দ্রনাথ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে সেদিন নেমেছিল হিন্দু সংবাদপত্রগুলো, হিন্দু বুদ্ধিজীবী ও নেতারা। গিরিশচন্দ্র ব্যানার্জী, রাসবিহারী ঘোষ এমনকি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর স্যার আশুতোষ মুখার্জির নেতৃত্বে বাংলার এলিটরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে ১৮ বার স্মারকলিপি দেন লর্ড হার্ডিঞ্জকে এবং বড়লাটের সঙ্গে দেখা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা বাধা দান করতে। (ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি কমিশন রিপোর্ট, খ- ৪, পৃ. ১৩০)

যারা এ দেশে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য লবেজান, দয়া করে বলুন কীসের ঋন পরিশোধে তাঁর নামে বিশ্ববিদ্যালয়?

##চার

‘প্রায়শ্চিত্ত’ নাটকে প্রতাপাদিত্যের মুখ দিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলাচ্ছেন-
“খুন করাটা যেখানে ধর্ম, সেখানে না করাটাই পাপ। যে মুসলমান আমাদের ধর্ম নষ্ট করেছে তাদের যারা মিত্র তাদের বিনাশ না করাই অধর্ম।” ‘রীতিমত নভেল’ নামক ছোটগল্পে মুসলিম চরিত্র হরণ করেছেন – “আল্লাহো আকবর শব্দে বনভূমি প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠেছে। একদিকে তিন লক্ষ যবন (অসভ্য) সেনা অন্য দিকে তিন সহস্র আর্য সৈন্য।
… পাঠক, বলিতে পার …
কাহার বজ্রমন্ডিত ‘হর হর বোম বোম’ শব্দে তিন লক্ষ ম্লেচ্ছ (অপবিত্র) কণ্ঠের ‘আল্লাহো আকবর’ ধ্বনি নিমগ্ন হয়ে গেলো। ইনিই সেই ললিতসিংহ। কাঞ্চীর সেনাপতি। ভারত-ইতিহাসের ধ্রুব নক্ষত্র ”

রবীন্দ্রনাথ তার ‘কণ্ঠরোধ’ (ভারতী, বৈশাখ-১৩০৫) নামক প্রবন্ধে বলেন, “কিছুদিন হইল একদল ইতর শ্রেণীর অবিবেচক মুসলমান কলিকাতার রাজপথে লোষ্ট্রখন্ড হস্তে উপদ্রবের চেষ্টা করিয়াছিল। তাহার মধ্যে বিস্ময়ের ব্যাপার এই যে- উপদ্রবের লক্ষ্যটা বিশেষ রুপে ইংরেজদেরই প্রতি। তাহাদের শাস্তিও যথেষ্ট হইয়াছিল। প্রবাদ আছে- ইটটি মারিলেই পাটকেলটি খাইতে হয়; কিন্তু মূঢ়গণ (মুসলমান) ইটটি মারিয়া পাটকেলের অপেক্ষা অনেক শক্ত শক্ত জিনিস খাইয়াছিল।” (রবীন্দ্র রচনাবলী, ১০ খন্ড,৪২৮ পৃষ্ঠা)

ঐতিহাসিক ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদারকে তাই লিখতে হলো –
“হিন্দু জাতীয়তা জ্ঞান বহু হিন্দু লেখকের চিত্তে বাসা বেঁধেছিল, যদিও স্বজ্ঞানে তাঁদের অনেকেই কখনই এর উপস্থিতি স্বীকার করবে না। এর প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত হচ্ছে, ভারতের রবীন্দ্রনাথ যাঁর পৃথিবীখ্যাত আন্তর্জাতিক মানবিকতাকে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে কিছুতেই সুসংগত করা যায় না। তবুও বাস্তব সত্য এই যে, তার কবিতাসমূহ শুধুমাত্র শিখ, রাজপুত ও মারাঠাকুলের বীরবৃন্দের গৌরব ও মাহাত্ম্যেই অনুপ্রাণিত হয়েছে, কোনও মুসলিম বীরের মহিমা কীর্তনে তিনি কখনও একচ্ছত্রও লেখেননি। যদিও তাদের অসংখ্যই ভারতে আবির্ভূত হয়েছেন।” (সূত্রঃ Dr. Romesh Chandra Majumder, History of Bengal, p 203.)

যারা রবীন্দ্রনাথকে সর্বজনীন কবি হিসাবে গ্রহণ করতে চান, দয়া করে বলুন – মুসলিমদের অপমান করে,হত্যার উস্কানি দিয়ে এবং হিন্দুত্বের নিবেদিত প্রচারক হয়েও তিনি কোন বিচারে সর্বজনীন?

##পাঁচ

কয়েক পুরুষ ধরে প্রজাদের উপর পীড়ন চালিয়েছেন জোড়াসাকোর ঠাকুর পরিবার। রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর ব্যতিক্রম ছিলেন না।
রবীন্দ্রনাথের পরিবারের জমিদারী ছিল কুষ্টিয়ার শিলাইদহ, পাবনার শাহজাদপুর, রাজশাহীর পতিসর প্রভৃতি অঞ্চলে। আর এই অঞ্চলগুলি ছিল মুসলিম প্রধান। মুসলিম প্রজাগণই তার রাজস্ব জোগাতো। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ব্যর্থ হন সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রজাদের সাথে মনের সংযোগ বাড়াতে। তাদের সমস্যাগুলোর সমাধান নিয়েও তিনি কোনদিন মাথা ঘামাননি। প্রজাদের জোগানো অর্থ দিয়ে মুসলিম প্রধান কুষ্টিয়া, পাবনা বা রাজশাহীতে তিনি একটি প্রাথমিক স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছেন – তার প্রমাণ নাই। অথচ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছেন হিন্দুপ্রধান পশ্চিম বাংলার বোলপুরে। উল্টো তার সাহিত্যে প্রকাশ পেয়েছে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমদের বিরুদ্ধে উগ্র সাম্প্রদায়িক মনভাব। উৎকট মুসলিম বিরোধী সংলাপ দেখা যায় তার নাটকে। ( ফিরোজ মাহবুব কামালঃ বাঙালীর রবীন্দ্রাসক্তি ও আত্মপচন-৬ জুন ২০১৫-শেখনিউজডটকম )

“১৮৯৪ সনে রবীন্দ্রনাথ চাষীদের খাজনা বাড়িয়ে দিয়েছিলেন, খাজনা আদায়ও করেছিলেন [ তথ্যসূত্র: শচীন্দ্র অধিকারি, শিলাইদহ ও রবীন্দ্রনাথ পৃঃ ১৮, ১১৭]।”

সব জমিদারা খাজনা আদায় করত একবার,কিন্তু রবীন্দ্রনাথ এলাকার কৃষকদের থেকে খাজনা আদায় করত দুইবার। একবার জমির খাজনা দ্বিতীয় বার কালী পূজার সময় চাদার নামে খাজনা। ( তথ্যসূত্র: ইতিহাসের নিরিখে রবীন্দ্র-নজরুল চরিত, লেখক সরকার শাহাবুদ্দীন আহমেদ ) কর বৃদ্ধি করে বল প্রয়োগে খাজনা আদায়ের ফলে প্রজাবিদ্রোহ ঘটলে তা তিনি সাফল্যের সঙ্গে দমন করেন।
” শোষক রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে শিলাইদহের ইসলাইল মোল্লার নেতৃত্বে দু’শঘর প্রজা
বিদ্রোহ করেন। [ তথ্যসূত্র: অমিতাভ চৌধুরী, জমিদার রবীন্দ্রনাথ, দেশ শারদীয়া, ১৩৮২।]”

কবিতায় তো মানবতার কথা বলেছেন খুব সবলে। কিন্তু জীবনাচারে যিনি এমন,তিনি কেমন মানবতাবাদী?

##ছয়

” মরহুম মোতাহার হোসেন চৌধুরী শান্তি নিকেতনে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, আপনার লেখায় ইসলাম ও বিশ্বনবী সম্পর্কে কোনো কথা লেখা নেই কেন? উত্তরে কবি বলেছিলেন, ‘কোরআন পড়তে শুরু করেছিলুম কিন্তু বেশিদূর এগুতে পারিনি আর তোমাদের রসুলের জীবন চরিতও ভালো লাগেনি।” [ তথ্যসূত্র: বিতণ্ডা,লেখক সৈয়দ মুজিবুল্লা, পৃ -২২৯ ]”

অবাক হই, যখন কোনো কোনো মুসলিম রবীন্দ্রচর্চাকে ইবাদত বলে ঘোষণা করেন !

##সাত

রবীন্দ্রনাথ বর্ণবাদী নন এমনকি হিন্দুত্ববাদী নন,তা প্রমাণ করার জন্য ব্রাম্মধর্মকে হাতিয়ার বানানো হয়,ভুলে যাওয়া হয়, ব্রাম্মধর্ম হিন্দুত্ববাদেরই এক শাখা। রবীন্দ্রনাথের বাবা দেবেন্দ্রনাথকে বলা হয় ব্রাহ্ম সমাজের প্রচারক ও দার্শনিক (উইকি দেখুন) অথচ ইতিহাস কি বলে! “পুরো পরিবারকে দুর্গা পূজার ব্যবস্থা করে দিয়ে নিজে একটু আড়লে থাকতেন এই আরকি। (সূত্র: বসন্তকুমার চট্টপাধ্যায়ের লেখা জ্যোতিন্দ্রনাথের জীবনস্মৃতি, ১৯২০ পৃষ্ঠা: ৩৬)।

নিজে ব্রাহ্ম দাবি করলেও বাবার শ্রাদ্ধ হিন্দু পদ্ধতিতেই করেছেন দেবেন্দ্রনাথ। ব্রাহ্মদের মধ্যে পৈতা ত্যাগ করা জরুরী ছিলো, অথচ রবীন্দ্রনাথকে অনুষ্ঠান করে পৈতা দেওয়া হয়েছিলো (সূত্র: এ এক অন্য ইতিহাস, লেখক: গোলাম আহমদ মর্তুজা)। শুধু তাই না, ব্রাহ্ম সমাজে জাতিভেদ নিষিদ্ধ। অথচ রবীন্দ্রনাথের পৈতা পরার অনুষ্ঠানে রাজনারায়ণ বসু নামক এক ব্যক্তিকে শূদ্র বলে অপমানিত করে বের করে দেওয়া হয়। (রাজনারায়ন বসুর লেখা আত্মচরিত, পৃ:১৯৯)

বর্নবাদ ও হিন্দুত্বে যিনি মজ্জমান,তার পিছে আমাদের সংস্কৃতিকে হাকিয়ে নেয়ার আগে পরিণতি ভেবে নেয়া উচিত নয় কি মুসলমান?

##আট

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ইংরেজি লেখার কারিগর ছিলো সি. এফ অ্যানড্রুজ । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একজন প্রধান সহযোগী ছিল মি. অ্যানড্রুজ। রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর যার নাম দিয়েছিলেন ‘দীনবন্ধু’। (তথ্যসূত্র: আত্মঘাতী রবীন্দ্রনাথ-অখণ্ড সংস্করণ,দ্বিতীয় খণ্ড, কলকাতা, পৃষ্ঠা ১০৮)

এই রবীন্দ্রই ড.ডেভিসের মধ্যস্থতায় এন্ডারসনের কাছ থেকে টাকা নিয়ে ‘চার অধ্যায়’লেখেন। শুধু তাই নয়, ‘ঘরে বাইরে’ও তাকে টাকা দিয়ে লেখানো হয়।” (তথ্যসূত্র: দৈনিক বাংলাবাজারে প্রকাশিত ড.আহমদ শরীফের সাক্ষাৎকার, তারিখ ০১/০৫/১৯৯৭ ইং ) ” কালীপ্রসন্ন বিদ্যাবিশারদ তার ‘মিঠেকড়া’তে পরিষ্কার বলেই দিয়েছিলেন যে, রবীন্দ্রনাথ মোটেই লিখতে জানতেন না, স্রেফ টাকার জোরে ওর লেখার আদর হয়। পাঁচকড়ি বাবু একথাও বহুবার স্পষ্ট বলে দিয়েছেন, রবীন্দ্রনাথের প্রায় যাবতীয় সৃষ্টিই নকল। বিদেশ থেকে ঋণ স্বীকার না করে অপহরণ। ( তথ্যসূত্র: জ্যোতির্ময় রবি,ও কালোমেঘের দল, লেখক : সুজিত কুমার সেনগুপ্ত, পৃ. ১১১)।” (এ বক্তব্যের সাথে একমত নই)

রবীন্দ্রনাথ ১৯১৩ সালে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছিলেন গীতাঞ্জলির জন্য নয়, বরং
গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদ ‘Osong offerings’-এর জন্য। রবীন্দ্র হলেন বাংলা ভাষী,ইংরেজিতে কবিতা লিখে নোবেল প্রাইজ পাওয়াটা তার মতো ব্যক্তির পক্ষে একদমই অসম্ভব। কিন্তু এই অসম্ভবটাই সম্ভব হয়েছিল, কারণ পর্দার আড়ালে থেকে কলম ধরেছিল সি. এফ. অ্যানড্রুজ। ‘গীতাঞ্জলি’র ইংরেজি অনুবাদ কিন্তু বাংলা থেকে হুবহু অনুবাদ ছিল না,বরং তা ছিল ভাবানুবাদ। সেই ইংরেজি অনুবাদের ভাব সম্পূর্ণ মিলে গিয়েছিল খ্রিস্টানদের বাইবেল ও তাদের ধর্মীয় সাধকদের রচনার সাথে। যে প্রসঙ্গে গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদের ভূমিকার লেখক,কবি ইয়েটস বলেছিলেন –
‘Yet we are not moved because of its
strangeness, but because we have met our own image’ অর্থাৎ ‘গীতাঞ্জলি’র ভাব ও ভাষার সাথে
পশ্চিমাদের নিজস্ব মনোজগতে লালিত খ্রিস্টীয় ভাবধারা সম্পূর্ণ মিলে গিয়েছিল। ইয়েটস তার বক্তব্যের যৌক্তিকতা তুলে ধরতে সেন্ট বার্নার্ড, টমাস-এ- কেম্পিস ও সেন্ট জন অফ দি ক্রসের সাথে ‘গীতাঞ্জলি’র ইংরেজি অনুবাদের মিল উল্লেখ করেছিলেন। অন্যান্য পশ্চিমা সাহিত্য সমালোচকরাও ‘গীতাঞ্জলি’র ইংরেজি অনুবাদের ২৬নং কবিতা ও ইংরেজি বাইবেলের Songs of Solomon – এর ৫: ২-৬ নম্বর শ্লোক, তাছাড়া সেন্ট ফ্রান্সিসের রচিত খ্রিস্টীয় গান Canticle এবং ইংরেজি গীতাঞ্জলির ৮৬নং কবিতা এই দুটো পাশাপাশি রেখে তাদের মিল দেখিয়েছেন। (তথ্যসূত্র: আত্মঘাতী রবীন্দ্রনাথ -১ম খণ্ড ,পৃষ্ঠা ১৪৫)।

ভাগ্য রবী ঠাকুরের! ইংরেজী অনুবাদটি রবীন্ড্রোজের নবসৃষ্টি হলেও নোবেল পেয়েছেন শুধু রবীন্দ্রনাথ, এতে আমরা বেজার হবার কে ?


বৈশাখনামা-বাংলা নববর্ষের ইতিহাস ও ইসলাম



##
নয়

” ‘শিবাজী উৎসব্’ (১৯০৪) কবিতাটি যখন
রবীন্দ্রনাথ রচনা করেন তখন তিনি কবি
হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। একই সঙ্গে কলকাতার
বুদ্ধিজীবী মহলেও তিনি সম্মানের সাথে
সমাদৃত। পারিবারিক এবং আর্থিক কারণে
তিনি কলকাতার অভিজাত মহলের নেতৃস্থানীয় পর্যায়ে অবস্থান করছেন। বয়সের পরিসীমায়ও তিনি পরিণত। বলা যেতে পারে উনিশ শতকের শেষ এবং বিশ শতকের শুরুর পর্বের রবীন্দ্রনাথের চিন্তা ও কর্মের ধারাবাহিকতার সাথে কবিতাটির মর্মার্থ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মহারাষ্ট্রের বালগঙ্গাধর তিলক ১৮৯৫ সালের ১৫ এপ্রিল সেখানে শিবাজী উৎসব প্রতিষ্ঠা করেন।
তিলক শিবাজী উৎসব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন
উগ্র হিন্দু জাতীয়তা ও সাম্প্রদায়িকতা প্রচার ও প্রসারের জন্য। ক্রমে শিবাজী উৎসবের অনুকরণে চালু হয় গণপতি পূজা। ইতিপূর্বে ১৮৯৩ সালে প্রতিষ্ঠিত গো-রক্ষিণী সভা ঐ অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে। মহারাষ্টের শিবাজী উৎসবের অনুকরণে সখারাম গণেশ দেউস্করের প্রচেষ্টায় কলকাতায় শিবাজী উৎসব প্রচলিত হয় ১৯০২ সালের ২১ জুন তারিখে। সরলা দেবী ১৯০২ সালের অক্টোবর মাসে দূর্গাপূজার মহাষ্টমীর দিনে বীরাষ্টমী উৎসব প্রচলন করেন। তিনি ১৯০৩ সালের ১০ মে শিবাজী উৎসবের অনুকরণে প্রতাপাদিত্য উৎসব প্রচলন করেন এবং একই বছরের ২০ সেপ্টেম্বর তারিখে প্রবর্তন করেন উদয়াদিত্য উৎসব। কলকাতার বাইরে থাকার কারণে রবীন্দ্রনাথ এই তিনটি উৎসবে উপস্থিত ছিলেন না। কিন্তু ২৯ সেপ্টেম্বর ১৯০৩ সালে দূর্গাপূজার মহাষ্টমীর দিনে ২৬ বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে জানকীনাথ ঘোষালের বাড়িতে যে বীরাষ্টমী উৎসব অনুষ্ঠিত হয় রবীন্দ্রনাথ তাতে সক্রিয়ভাবে যোগ দেন। … শিবাজী উৎসবের মূল মন্ত্র ছিল চরম মুসলিম বিদ্বেষ, সন্ত্রাস এবং সাম্প্রদায়িকতা। বস্তুত এই শিবাজী উৎসবের সূত্র ধরেই বাংলায় সন্ত্রাসবাদী রাজনীতির এবং সাম্প্রদায়িক ভেদনীতির ভিত্তি স্থাপিত হয়।
——“কবিতার শুরুতে রবীন্দ্রনাথ শিবাজীর
কর্মকান্ড ও জীবনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেন :
কোন দূর শতাব্দের এক অখ্যাত দিবসে
নাহি জানি আজ
মারাঠার কোন শৈল অরণ্যের অন্ধকারে ব’সে
হে রাজা শিবাজী
তব ভাল উদ্ভাসয়া এ ভাবনা তরিৎ প্রভাবৎ
এসেছিল নামি
‘একরাজ্যধর্ম পাশে খন্ড ছিন্ন বিক্ষিপ্ত ভারত
বেধে দিব আমি’।
এখানে রবীন্দ্রনাথ শিবাজীকে ভারতের ঐক্যের প্রতীক হিসেবে তুলে ধরেছেন। তিনি বলতে চেয়েছেন যে খন্ড, ছিন্ন, বিক্ষিপ্ত ভারত ধর্মের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ করা ছিল শিবাজীর জীবনের উদ্দেশ্য। মহারাষ্ট্রে শিবাজী উৎসবের প্রচলন, পরবর্তী সময়ে কলকাতাসহ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে শিবাজী উৎসব প্রচলনের এবং এই উৎসবকে জনপ্রিয় করে তোলার জন্য নিবেদিত প্রাণ বালগঙ্গাধর তিলক এবং সখারাম দেউস্করের মূল উদ্দেশ্য ছিল শিবাজীর আদর্শে ভারতকে ঐক্যবদ্ধ করা। এখানে এটা স্পষ্টত:ই লক্ষ্যণীয় যে তিলক, দেউস্কর আর রবীন্দ্রনাথের ভাবনা সম্পূর্ণ অভিন্ন।
( – ড. নুরুল ইসলাম মনজুর / শতবর্ষ পরে ফিরে দেখা ইতিহাস : বঙ্গভঙ্গ ও মুসলিম লীগ ॥ [ গতিধারা – জুলাই, ২০১০ । পৃ: ৫২-৮৬ ])

যারা বলেন রবীন্দ্রনাথের বাংলাদেশ, বাংলাদেশের রবীন্দ্রনাথ, তারা কি জানেন না – রবীন্দ্রনাথের বাংলাদেশ হিন্দুত্ববাদের মহাভারতে বিলিন হয়ে যায়? তখন সে আর স্বাধীন থাকে না!

##দশ

“এখন ভারতের ‘ইতিহাস ব্যবসায়ী’দের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের সংখ্যাই বেশি। তাঁহারা সাড়ে পাঁচশত বত্সরের মুসলিম শাসনকে বিদেশি শাসনই মনে করেন ” (সলিমুল্লাহ খান-সাম্প্রদায়িকতা )
জনাব খানের এ প্রবন্ধের সমালোচনায় মাসুদ রানা লিখেন -” “১৯৪৭ সালে আসিয়া ভারত দুই ভাগ হইল কেন? সবাই বলে, হিন্দু-মুসলমান দুই জাতি। তাই দুই আলাদা দেশ হইল। দ্বিজাতি তত্ত্বের মূল কথা এই। এই বাবদ মুহম্মদ আলী জিন্নাহকে বাহবা দিয়া থাকেন সকলেই। এখানে তাঁহার কৃতিত্ব কি? এ তো ষোল আনা রবীন্দ্রনাথ পথিকের কৃতিত্ব।” ডঃ খানের প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম বারবারই ফিরে এসেছে। তাঁকে সাম্প্রদায়িক হিসেবে চিহ্নিত করেই তিনি ক্ষান্ত হননি। এ-প্রবন্ধে তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ‘চুতিয়া’ বানিয়ে ছেড়েছেনঃ“ বৌধায়ন চট্টোপাধ্যায় সিপিআইয়ের অনেক বড় নেতা ছিলেন। ১৯৬৮ সালে দাস ক্যাপিটালের শতবর্ষ উপলক্ষে তাঁহারা একটি বই প্রকাশ করেন। দিল্লির পিপলস পাবলিশিং হাউস প্রকাশ করে বইটি। ‘মার্কস অ্যান্ডউ ইন্ডিয়াস ক্রাইসিস’ নামের নিবন্ধে বৌধায়ন বলেন, ‘ভারতের বুদ্ধিজীবীরা সবাই চুতিয়া; দুইজনই শুধু ব্যতিক্রম – গান্ধীজি ও রবীন্দ্রনাথ।’ ‘চুতিয়া’ বলিয়া তিনি ঠিক বলিলেন; কিন্তু ওই দুইজনের ব্যাপারে ব্যতিক্রম কেন? ভারতের সব বুদ্ধিজীবীই যদি চুতিয়া, রবীন্দ্রনাথও ব্যতিক্রম নহেন।”
“চুতিয়া” শব্দটি হিন্দি, যা এসেছে ‘চুত’ থেকে। হিন্দিতে ‘চুত’ মানে হচ্ছে অক্ষত যোনি বা কুমারী। আর “চুতিয়া” হচ্ছে অক্ষত যোনিজাত বা কুমারী মাতার সন্তান, যার বাংলা অর্থ হচ্ছে জারজ।
ডঃ সলিমুল্লাহ খান মনে করেন, কমিউনিষ্ট নেতা বৌধায়ন চট্টোপাধ্যায় ভারতের বুদ্ধিজীবীদেরকে চুতিয়া বলে ঠিক করেছেন। কিন্তু ডঃ খান তাঁর ওপরও তিনি সন্তুষ্ট নন, কারণ তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও গান্ধীকে রেহাই দিয়েছেন। ডঃ খানের দাবী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও “চুতিয়া”।(সাপ্তাহিক পত্রিকা-15–01-2014)

কিন্তু কেন ? কেন বামপন্থী সলিমুল্লাহ খান এমন আক্রমণ করলেন ? জবাব পাবো ইতিহাসে। ১৯০৫ সালে বঙ্গ প্রদেশকে দ্বিখন্ডিত করে নিরস্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম প্রধান পূর্ববঙ্গ ও আসামকে নিয়ে যে প্রদেশ গঠন করা হয়, তার পক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগনের সমর্থন ছিল । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এ প্রদেশ বাতিল করার জন্য প্রবল গণআন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। এই প্রদেশেকে বিলীন করার জন্য সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনসমূহের নেতা কর্মীদের অত্যন্ত দক্ষতার সাথে বীর হিসেবে উপস্থাপন করা হয় এখন। এখন বলা হয় না, মুসলিম প্রধান প্রদেশ সৃষ্টির ফলে অনগ্রসর ও শোষিত মুসলিম সম্প্রদায় কি সুফল পেয়েছিল ?

রবীন্দ্রনাথ ও সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের নেতা কর্মিরা কেনই বা এই প্রদেশকে রদ করার জন্য তৎপরতা চালালেন ? ১৯০৫ সালে পূর্ববঙ্গ ও আসামকে নিয়ে প্রতিষ্ঠিত মুসলিম প্রধান নতুন প্রদেশ সৃষ্টির প্রথম বছরই এই প্রদেশ সৃষ্টি প্রথম বছরই এই প্রদেশের বৈদেশিক বাণিজ্য, ২,৯৮,২৭,৩৯৭ টাকা থেকে বেড়ে ৩,১৭,৭৭,৮৪৬ টাকায় উন্নীত হয়। ১৯০৫ সালেই শিক্ষাখাতে ব্যয় হয় ৭৩,০৫,২৬০ টাকা। স্কুল ছাত্র সংখ্যা বেড়ে ৬,৯৯,০৫১ থেকে ৯,৩৬,৬৫৩তে দাড়ায়। নারী শিক্ষার আশানুরূপ উন্নতি সাধিত হয়। বালিকা বিদ্যালয় সংখ্যা ৮১৯ থেকে বেড়ে ১৯১০-১১ সালে ৪৫৫০ তে বৃদ্ধি পায় এবং ছাত্রী সংখ্যা ২৪,৪৯৩ থেকে বেড়ে ১৩১১৩৯ এ উন্নীত হয়। ( উৎস : ১. Report on the Administration of Eastern Bengal and Assam,1905- 06 and 1910 -11 I The pioneer mail 23rd February, 1912 ২. এসম্পর্কে আরো তথ্য : বাঙালী বুদ্ধিজীবী ও বিচ্ছিন্নতাবাদ – অমলেন্দু দে , ৩য় অধ্যায় , পশ্চিম বঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ )

এ প্রদেশ ছয় বছর টিকে না থাকলে আর ঢাকাবিশ্ববিদ্যালয় না হলে আজ যারা রবীন্দ্রনাথকে প্রনম্য মনে করছেন তাদেরে হিন্দু জমিদারদের গরু-ছাগলের রাখাল হয়ে থাকতে হত কি না – একটু ভেবেছেন কি ?
রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন তারা সেভাবেই থাকুক।

আপনি কী দুঃশ্চিন্তা  বা হতাশায় ভুগছেন ? লেখাটি আপনার জন্য ।

আপনি কী দুঃশ্চিন্তা  বা হতাশায় ভুগছেন ? আপনার সমাধান একটা জিনিসের মধ্যে রয়েছে।

একবার এক গুনাহগার লোক শাইখ আব্দুল আযীয ইবনে বায (রাহিঃ) কাছে এসে বলেছিল সাত বছর যাবত তিনি একটা সন্তানের প্রতীক্ষায় আছেন কিন্তু তার সন্তান হচ্ছেনা।শাইখ ইবনে বায তাকে এক বাক্যে উত্তর দিয়েছিলেন, ইস্তিগফারের পরিমান বাড়িয়ে দাও।’ এক বছর পরে সেই লোক শায়েখ ইবনে বাযের কাছে এসে বললেন,’ইয়া শাইখ, আমি যে জিনিস চেয়েছি সেটা পেয়েছি আলহামদুলিল্লাহ। ‘

আরেকবার বিখ্যাত তাবেঈ হাসান আল বসরী রাহিমাহুল্লার কাছে এক লোক এসে বললেন,আকাশ থেকে বৃষ্টি নামছে না। কি আমল করা যায় বৃষ্টির জন্য? হাসান আল বসরী তাকেও ইস্তিগফার করতে বললেন। আরেকজন এসেছে দারিদ্র্যতার ব্যাপারে তাকে ও তিনি ইস্তিগফার করতে উপদেশ দিলেন। আরেকজন এসেছে সন্তান লাভের আমল জানার জন্য তাকে ও তিনি ইস্তিগফারের পরিমান বাড়িয়ে দিতে উপদেশ দিলেন।

তখন হাসান আল বাসরী রাহিমাহুল্লার মজলিসে উপস্থিত তার ছাত্ররা সবাই উনাকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার কাছে একেক জন একেক সমস্যা নিয়ে এসেছে আপনি সবাইকেই ইস্তিগফার করতে পরামর্শ দিলেন কেন? হাসান আল বসরী রাহিমাহুল্লাহ জবাব দিলেন তোমরা কি কুরানের সে আয়াত পড়ো নি যেখানে আল্লাহ বলেছেন,

“অতঃপর বলেছিঃ তোমরা তোমাদের পালনকর্তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর। তিনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল।তিনি তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি বাড়িয়ে দিবেন, তোমাদের জন্যে উদ্যান স্থাপন করবেন এবং তোমাদের জন্যে নদীনালা প্রবাহিত করবেন। তোমাদের উপর অজস্র বৃষ্টিধারা ছেড়ে দিবেন। ” {সুরা নুহঃ ১০-১২}


বিপদের আশংকা যখন


আল্লাহতায়ালা বলেন,হে মুমিনগন তোমরা সকলে আল্লাহর কাছে ইস্তেগফার কর তাহলে অবশ্যই তোমরা সফলহবে।যারা ইস্তেগফার করে না তারাই জালেম। সুরা নুর আয়াত ৩১+সুরা হুজুরাত ১১ আয়াতের শেষাংশ।

লা ইলাহা ইল্লা আন্তা সুবহানাকা ইন্নিকুন্তু মিনাজ্জলিমীন।
আল্লাহ পাক ছাড়া মহাবিশ্বের আর ভিন্ন অন্য কোন প্রভু নেই। তিনি মহান ও পবিত্র আর অবশ্যই আমি জালিমদের দলভুক্ত)
(ইস্তেগফার এর কারনে) তখন আমি নবী ইউনুসের ডাকে সারা দিয়েছিলাম তাকে নাজাত দিয়েছিলাম দুশ্চিন্তা থেকে বস্তুত আমি মুমিনদের নাজাত দিয়ে থাকি।
সুরা আম্বিয়া – ৮৮

‘যে ব্যক্তি নিয়মিত ইস্তেগফার করবে আল্লাহ তার সব সংকট থেকে উত্তরণের পথ বের করে দেবেন, সব দুশ্চিন্তা মিটিয়ে দেবেন এবং অকল্পনীয় উৎস থেকে তার রিজিকের সংস্থান করে দেবেন।

আবূ দাঊদ : ১৫২০; ইবন মাজা : ৩৮১৯; তাবরানী : ৬২৯১

আনাস(রাঃ) বলেন, রাসূল(সাঃ) বলেছেন,প্রত্যেক আদম সন্তানই গুনাহগার।উত্তম গুনাহগার তারাই যারা তওবা করে, ক্ষমা চায়।

[মিশকাত ২৩৪০]

রাসুলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন তোমাদের কারো হারান জিনিস ফিরে পেলে সে বেক্তি যেভাবে খুশি হয়। ঠিক তেমনি তোমাদের কেউ আল্লাহ পাকের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করলে আল্লাহ পাক সে বেক্তির থেকেও বেশি খুশি হন।

সহিহ তিরমিজি ৩৫৩৮ ইবনে মাজা ৪২৪৭, মুসলিম

রাসুলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন তোমরা যদি গুনাহ না করতে তাহলে অবশ্যই আল্লাহ তায়ালা এমন এক জাতিকে সৃষ্টি করতেন যারা গুনাহ করত, তারপর আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে মাফ করে দিতেন।

সহিহ মুসলিম,তিরমিজি ৩৫৩৯ ইবনে মাজাহ

আনাস ইবন মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত ,তিনি বলেনঃ আমি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কে বলতে শুনেছি যে, আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেছেনঃ হে আদম সন্তান! তুমি যতদিন আমাকে ডাকতে থাকবে এবং আমার কাছে আশা করতে থাকবে তোমার পাপ যাই হোক না কেন ,আমি তা ক্ষমা করে দিব, এতে আমার কোন পরওয়া নেই। হে আদম সন্তান! তোমার পাপরাশি যদি আকাশের মেঘমালায়ও উপনীত হয়, এর পর তুমি যদি আমার কাছে ক্ষমা চাও, তবুও আমি সব ক্ষমা করে দিব, এতে আমার কোন পরওয়া নেই। হে আদম সন্তান! তুমি যদি যমীন পরিমান পাপরাশি নিয়েও আমার কাছে এসে উপস্থিত হও, আর আমার সঙ্গে যদি কিছুর শরীক না করে থাক, তবে আমি সি পরিমান ক্ষমা ও মাগফিরাত তোমাকে দান করব।
[ সুনান তিরমিজী – ৩৫৪০ ]

এক হাদিসে এসেছে রাসুলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন আমি দৌনিক এক শত বার এস্তেগফার করি।

? “আপনি বলে দিন যে, (আল্লাহ বলেন) হে আমার বান্দাগণ! যারা নিজেদের উপর অত্যাচার করেছো, তোমরা আল্লাহ তা’আলার রহ্মত হতে নিরাশ হয়ো না। নিঃসন্দেহে আল্লাহ (অতীতের) সমস্ত গুনাহ্ ক্ষমা করবেন; নিশ্চয়ই তিনি বড়ই ক্ষমাশীল, দয়ালু। আর তোমরা তোমাদের রবের দিকে প্রত্যাবর্তন কর এবং তার নিকট আত্মসমর্পণ কর আযাব আসার পূর্বেই, অতঃপর আর সাহায্য করা হবেনা।” সুরা আযযুমার: ৫৩-৫৪

বৈশাখনামা-বাংলা নববর্ষের ইতিহাস ও ইসলাম

চৈত্র্যের শেষদিকের উত্তাপে বাহিরে বের হওয়াও যেন কষ্টসাধ্য। সেই উত্তাপ এই অঞ্চলের কতিপয় বুড়োবুড়িদেরকে জীবনের নতুন আরেকটি বছরে প্রবেশ করার কথা মনে করিয়ে দেয়; কারণ সত্যিই তারা এখনও বাংলায় বছর গোণে। আর বাকিরা ইংরেজি এপ্রিল মাসের তারিখ গুণে গুণে নতুন বছর আগমনের হিসেব কষে, সারাবছর কোনো খবর না থাকলেও অন্তত নতুন বছরের শুরুর দিনটিতে নিজ সংস্কৃতির, নিজ ভাষার ক্যালেন্ডারের হক আদায় করা চাই। অন্যান্য নববর্ষগুলোর মত এখানকার নববর্ষের শুরুরও একটি নাম রয়েছে – পহেলা বৈশাখ
উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া যে বিষয়াদিগুলোতে দরদ থাকে কম, অনাদর আর অবহেলা থাকে বেশি সেগুলোর মধ্যেও ‘মুসলিম’ পরিচয়টা সবকিছুকে হার মানিয়েছে। সেই অনাদর আর অবহেলায় তাই সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর নির্ধারণ করে দেওয়া ফিতরাতের ভাঙ্গাগড়া করা হয়েছে। আর পরিশষে তা অন্যরূপ ধারণ করে বসেছে… যার কেন্দ্র হয়েছে খেয়াল-খুশি আর কামনা-বাসনা – যে করেই হোক একটু আনন্দ পাওয়া, একটু সুন্দর সময় কাটানো অথবা পড়াশোনা, চাকরি, ব্যবসার নিয়মমাফিক ব্যস্ততাকে একটু ভুলে থাকার প্রয়াস – এসবের জন্য এমন সুযোগ খুব কমই আসে।
পহেলা বৈশাখ
এর উপর সাথে রয়েছে সংস্কৃতিপ্রেম দেখানোর অযুহাত। এমনকি সারাবছর হলিউড-বলিউডের মুভি, ইংলিশ আর হিন্দি গান, ইংলিশ সিরিজ আর হিন্দি সিরিয়াল নিয়ে পড়ে থাকলেও এই একটা দিনে সংস্কৃতিপ্রেমের অযুহাতের আড়ালে সবাই পাক্কা বাঙ্গালী হয়ে উঠে। ‘হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি’ নাকি ‘মুখোশের আড়ালে হিন্দু সংস্কৃতি’ সেই ইতিহাসের কথা কারও মনে থাকে না। সেক্যুলার চেতনাবাজ আর হলুদ মিডিয়ার পৃষ্ঠপোষকতায় মূর্তিপূজার আর কুসংস্কারের সংস্কৃতি অসাম্প্রদায়িকের আখ্যা পেয়ে যায়। আর ইসলামের সমস্ত বিষয়ে কলা বিভাগের বিজ্ঞানীদের আস্ফালন দেখা গেলেও এই অবৈজ্ঞানিক বৈশাখ পালনে তাদের কোনো মাথাব্যাথা দেখা যায় না। বরং এই সময়ে তারা তাদের কলা জ্ঞানের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করে মূর্তি আর মুখোশ তৈরিতে ব্যস্ত হয়।

মিথ্যার নাম অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতি

ভারতবর্ষে মুঘল সম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর সম্রাটরা হিজরী পঞ্জিকা অনুসারে কৃষি পণ্যের খাজনা আদায় করত। কিন্তু হিজরি সন চাঁদের উপর নির্ভরশীল হওয়ায় তা কৃষি ফলনের সাথে মিলত না। এতে অসময়ে কৃষকদেরকে খাজনা পরিশোধ করতে বাধ্য করতে হত। খাজনা আদায়ে সুষ্ঠুতা প্রণয়নের লক্ষ্যে মুঘল সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। তিনি মূলত প্রাচীন বর্ষপঞ্জিতে সংস্কার আনার আদেশ দেন।
সম্রাটের আদেশ মতে তৎকালীন বাংলার বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদ ফতেহউল্লাহ সিরাজি সৌর সন এবং আরবি হিজরী সনের উপর ভিত্তি করে নতুন বাংলা সনের নিয়ম বিনির্মাণ করেন। ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০ই মার্চ বা ১১ই মার্চ থেকে বাংলা সন গণনা শুরু হয়। তবে এই গণনা পদ্ধতি কার্যকর করা হয় আকবরের সিংহাসন আরোহণের সময় (৫ই নভেম্বর, ১৫৫৬) থেকে। প্রথমে এই সনের নাম ছিল ফসলি সন, পরে “বঙ্গাব্দ” বা বাংলা বর্ষ নামে পরিচিত হয়।
[সিরাজুল ইসলাম, সম্পাদক (জানুয়ারি ২০০৩)। “পহেলা বৈশাখ”। বাংলাপিডিয়া (বাংলা ভাষায়)। ঢাকা: এশিয়াটিক সোসাইটি বাংলাদেশ।]
মুশরিকদের দ্বারা প্রভাবিত শাসক আকবরের রূহে শির্কী সংস্কৃতি গুলে ছিল। তার উদ্ভাবিত জগাখিচুড়ী ধর্ম ‘দ্বীন-ই-ইলাহী’র মত সব ধর্মের অংশগ্রহণে একটি উৎসব হওয়া তার কাম্য ছিল। বৈশাখের অনুষ্ঠান হয়ে ওঠে তার আকাংক্ষিত মিশ্র উৎসব। এতে মূলত উৎফুল্ল হয় তার হিন্দু স্ত্রী ও হিন্দু প্রজারা। উল্লেখ্য, আকবরের প্রায় পাঁচ শতাধিক স্ত্রী ছিল আর তাদের এক বিরাট অংশ ছিল হিন্দু।
বাংলা বর্ষের মাসগুলোর নামকরণ হয়েছে হিন্দু জ্যোতিষ শাস্ত্রের বিভিন্ন গ্রহ নক্ষত্রের নামানুসারে। আবার সেই নামকরণগুলো হয়েছিল বিভিন্ন দেবদেবী বা পৌরাণিক চরিত্র থেকে। যেমন ‘বৈশাখ’ মাসেরই নামকরণ করা হয়েছে ‘বিশাখা’ থেকে, যার ঋগ্বেদিক নাম হল ইন্দ্র, আগুনের দেব ইত্যাদি।
আর বর্তমানে যে রকম ঢাকঢোল পিটিয়ে, বাদ্যবাজনা বাজিয়ে বা শোভাযাত্রা করে বৈশাখের প্রথম দিনকে আমন্ত্রন জানানো হয়, পেছনে ফিরে তাকালে আমরা এসব কোনকিছুই দেখতে পাবো না। বস্তুত আধুনিক নববর্ষ উদযাপনের খবর প্রথম পাওয়া যায় ১৯১৭ সালে। যে বছর প্রথম মহাযুদ্ধে ব্রিটিশদের বিজয় কামনা করে পহেলা বৈশাখে ‘হোম কীর্ত্তণ’ আর পূজার ব্যবস্থা করা হয়। এরপর ১৯৩৮ সালেও অনুরূপ কর্মকান্ডের উল্লেখ পাওযা যায়। পরবর্তী সময়ে ১৯৬৭ সনের আগে ঘটা করে পহেলা বৈশাখ পালনের রীতি তেমন একটা জনপ্রিয় হয় নি। এই হল হাজার(!) বছরের সংস্কৃতি।
অতীতে পহেলা বৈশাখে প্রধান কাজ ছিল সারা বছরের দেনা-পাওনার হিসাব নিকাশ, খাজনা আদায়, শুল্ক পরিশোধ করা ইত্যাদি। এদিনে হিন্দু জমিদাররা নিজ নিজ প্রজাদের মিষ্টি খাইয়ে আপ্যায়ণ করতো এবং এ অনুষ্ঠানকে বলা হতো “পূণ্যাহ”।
চৈত্র্যের শেষ দিনে, বাঙ্গালী সনাতন ধর্মালম্বীরা ‘চৈত্রসংক্রান্তি’র উৎসব পালন করতো। এটি তাদের একটি ধর্মীয় উৎসব। এদিন তারা ঘরদুয়ার ধুয়েমুছে পরিস্কার করে সারা বছরের আবর্জনা দূর করতো। এখনও পুরনো ঢাকার হিন্দুরা এদিন ঝাড়ু হাতে ওঝা সেজে ভূতপ্রেত, অমঙ্গল বা অনিষ্টকে দূর করে। হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় এ উৎসবকে কেন্দ্র করেই পহেলা বৈশাখে চৈত্রসংক্রান্তির মেলা হতো, যা এখনও হয়।
সনাতন ধর্মাবলম্বীরা তাদের সিদ্ধেশ্বরী দেবীর পুজোর জন্য ঈশা খাঁর সোনারগাঁওয়ে সমবেত হতো এবং এখনও হয়ে থাকে। এবং পূজার উদ্দেশ্যে ব্যতিক্রমী এক মেলা মেলার আয়োজন করেছিল। সেখান থেকেই পহেলা বৈশাখ উপলক্ষ্যে মেলার আয়োজন হয়।
কলকাতার বিখ্যাত কালীঘাট মন্দিরে, আসাম, বঙ্গ, কেরল, মনিপুর, নেপাল, উড়িষ্যা, পাঞ্জাব, তামিল নাড়ু এবং ত্রিপুরার জায়গায় এখনো পহেলা বৈশাখ উপলক্ষ্যে পূজা অর্চনা হয়ে থাকে অনেকে পুরানিক অর্থে দেবতাদের রাজা ইন্দ্রের স্ত্রী ঋতু দেবিকে সন্তুষ্ট করার আশায় তারা পুজা করে থাকে। তাদের বিশ্বাস এতে তাদের ফসল ফলাদি ভাল হয়।
শিখদের বসন্তের ফসল তোলাকালীন আর তাদের সৌর নববর্ষের উৎসবের নাম ‘ভৈসাখী’। ১৬৯৯ সালে গোবিন্দ সিং এই উৎসবের আধুনিক ধারার প্রচলন করলেও প্রাচীনকাল থেকেই ফলন ভাল হওয়ার আশায় শিখরা এই উৎসব পালন করতো।
পহেলা বৈশাখের অন্যতম আকর্ষণ মঙ্গল শোভাযাত্রা। হিন্দুদের বিভিন্ন দেবদেবীর বাহনের মূর্তি যেমন: কার্তিকের বাহন ময়ূর, স্বরস্বতীর বাহন হাঁস, লক্ষীর বাহন পেঁচা ইত্যাদি সহ বিভিন্ন রাক্ষস-খোক্ষস ও জীবজন্তুর বিশাল মূর্তি নিয়ে শোভাযাত্রা করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে পহেলা বৈশাখে সকালে এই শোভাযাত্রাটি বের হয়ে শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে পুনরায় চারুকলা ইনস্টিটিউটে এসে শেষ হয়। ১৯৮৯ সাল থেকে এই মঙ্গল শোভাযাত্রা পহেলা বৈশাখের উৎসবের একটি অন্যতম আকর্ষণ।
এছাড়া, দিনের প্রথম প্রত্যুষে নতুন সূর্যকে যেভাবে সুরের মূর্ছনায় বরণ করে নেয়া হয়, সেটাও হাজার বছরে পূর্বের সূর্যপূজারী বা প্রকৃতিপূজারী সম্প্রদায়ের অন্ধ অনুকরণ। বৈশাখের প্রথম দিনে নতুন সূর্যের কাছে প্রকৃতিপূজারীদের মতোই নিজেদের অমঙ্গল থেকে রক্ষার জন্য সূর্যের নিকট প্রার্থনা করা হয়।
সুতরাং, পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে মেলা, মঙ্গল শোভাযাত্রা কিংবা নতুন বছরকে স্বাগত জানানো প্রতিটি আনুষ্ঠানিকতাই পুরোপুরি সনাতন ধর্মালম্বীদের বিভিন্ন বিশ্বাস ও কর্মকান্ড থেকে উদ্ভূত। পহেলা বৈশাখের আনুষ্ঠানিকতাও তাই কোনভাবেই অসাম্প্রদায়িক নয়, বরং সর্বাংশে সাম্প্রদায়িক।
তাই সংস্কৃতির দোহাই দিয়ে বৈশাখ উদযাপনের জন্য এর বিরোধিতাকারীদের ‘গোঁড়া’, ‘ধর্মান্ধ’ বলে দিয়ে নিজের কাছে ব্যাপারটা ধামাচাপা দেওয়া যেতে পারে, কিন্তু আল্লাহর কাছে মোটেই ধামাচাপা দেওয়া যাবে না। ‘গোঁড়া’, ‘ধর্মান্ধ’ এসব বলে পাশ কাটিয়ে গেলেও ওই আখিরাতমুখী গোঁড়া মানুষগুলো যে আসলে তাদের মুসলিম ভাইবোনদের জান্নাত চায় বলেই এত কথা খরচ করে, এত কাঠখড় পোড়ায় সেকথা অল্পই অনুধাবণ করতে পারে। একদিনের যে আনন্দটুকুর জন্য জাহান্নামে শতবছর পুড়তে হতে পারে সেই আনন্দের চেয়ে ঠুনকো আর যে কিছুই হতে পারে না।

পহেলা বৈশাখে মোটামোটি পাঁচ ধরনের মুসলিম দেখা যায় –

১) যারা সত্যিই বিশ্বাস করে যে নতুন বছরের নতুন দিন ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ করলে বা ভাল সময় কাটালে সারাটা বছর ভাল কাটবে বা সারা বছর ভাল কাটলেও কাটতে পারে।
২) যারা উপরের এসব বিশ্বাস করে না, কিন্তু এমনিতেই একটু ঘুরে বেড়িয়ে বা স্রেফ একটু ভাল সময় কাটানোর বের হয়।
৩) যারা মৌলিক আকিদাহ সঠিকই পোষণ করে এবং বৈশাখী কার্যকলাপে সরাসরি অংশ নেয় না। তবে কেবলই বাঙালি সংস্কৃতির অংশ হিসেবে ঘরে বসে পারিবারিকভাবে বৈশাখ পালন জায়েজ মনে করে বা এভাবে বৈশাখ পালনকে ইসলামবিরোধী কিছু মনে করে না; অথবা এভাবে বৈশাখ পালন অসমর্থন করে না।
৪) যারা সত্যিই কোনো প্রয়োজনীয় কাজে বৈশাখের দিন বের হয়।
৫) যারা প্রবল অনিচ্ছা সত্ত্বেও জবরদস্তিপূর্বক কোন আনুষ্ঠানিকতায় জড়াতে বাধ্য হন।

[১]

যারা সত্যিই বিশ্বাস করে যে নতুন বছরের নতুন দিন ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ করলে বা ভাল সময় কাটালে সারাটা বছর ভাল কাটবে বা সারা বছর ভাল কাটলেও কাটতে পারে
আমাদের ভাল খারাপ কেবলই আল্লাহ রব্বুল আলামীনের হাতে এবং তিনি না চাইলে কস্মিনকালেও কোনো মঙ্গল বা অমঙ্গল সম্ভব নয়।
“… আর যদি তাদের কোন অকল্যাণ হয় তবে বলে এটা হয়েছে তোমার পক্ষ থেকে, আপনি বলে দিন, (ভাল-মন্দ) সমস্তকিছুই আল্লাহর পক্ষ থেকে। আর এই মানুষগুলোর সমস্যা আক্রান্ত যারা কখনও কোন কথা বুঝতেই চেষ্টা করে না।”
(সূরা নিসা, ৭৮)
ঈমানের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হল ‘তাকদীর’ বা ভাগ্যে বিশ্বাস আর তাকদীরে বিশ্বাসের অবিচ্ছেদ্য একটি অংশ হল ‘যা কিছু হয় তা আল্লাহর অনুমতিক্রমেই হয়, আর আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কোনোকিছুই সম্ভব নয়।’
রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, “এ পৃথিবীর সমস্ত জাতি যদি একত্রিত হয়ে তোমাদের মঙ্গল করতে চায়, তবে তারা কেবল ততটুকুই করতে পারবে, যতটুকু আল্লাহ তোমাদের জন্য নির্ধারণ করেছেন। আবার, সমস্ত জাতি যদি একত্রিত হয়ে তোমাদের অমঙ্গল করতে চায় তবে ততটুকুই সক্ষম হবে যতটুকু আল্লাহ তোমাদের জন্য নির্ধারণ করেছেন….।” (তিরমিজী)
তাই যারাই আল্লাহর ইচ্ছা ব্যতীত অন্যকোনো কার্যকলাপ বা অন্য কোনোকিছুতে মঙ্গল-অমঙ্গল আছে মনে করল বা থাকতেও পারে বলে সন্দেহ পোষণ করল তারাই ‘একমাত্র আল্লাহর পক্ষেই সম্ভব’ এমন একটি বিষয়ে আল্লাহর সাথে শরীক করে ফেলল। অর্থাৎ তারা শির্ক করে ফেলল।
তাই রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন –
الطِّيَرَةُ شِرْكٌ
অর্থাৎ, ‘কুলক্ষণে বিশ্বাস করা শির্ক’।
(আবু দাউদ ৩৯১২; ইবনে-মাজাহ ৩৫৩৮; তিরমিযী, মিশকাত ৪৫৮৪)
রাসূলুল্লাহ ﷺ আরো বলেন, “যে কুলক্ষণে বিশ্বাস করে এবং যাকে সে বিশ্বাস করায়, যে ভাগ্য গণনা করে এবং যাকে সে ভাগ্য গণনা করে দেয়, যে জাদু করে এবং যাকে সে জাদু করে দেয়- তারা আমাদের (উম্মাতে মুহাম্মাদীর) অন্তর্ভুক্ত নয়।”
(সিলসিলা সহীহাহ, ২১৯৫)
তাই ‘মঙ্গল শোভাযাত্রায়’ গেলে সকল অমঙ্গল দূরীভূত হয়ে মঙ্গল আসবে বা আসতেও পারে এমন ধারণা যে পোষণ করল; অথবা যে নববর্ষের প্রথম দিন ভাল কাটাচ্ছে বলে বাকি বছর ভাল কাটবে বা কাটতেও পারে মনে করল সে নিঃসন্দেহে মুশরিকদের অন্তর্ভূক্ত হয়ে গেল। মুসলিমদের অধিকাংশেরই দ্বীনের আকিদাহগত বা মৌলিক বিষয়াদিতেই পর্যাপ্ত জ্ঞান না থাকার দরুণ তারা শিরকি আকিদায়, শিরকি কার্যকলাপে লিপ্ত থাকে। ফলে তারা মুশরিকদের অন্তর্ভূক্ত হয়ে যায়।

[২]

যারা উপরের এসব বিশ্বাস করে না, কিন্তু এমনিতেই একটু ঘুরে বেড়িয়ে বা স্রেফ একটু ভাল সময় কাটানোর বের হয়
বর্তমানে এই শ্রেণিরই সংখ্যাধিক্য লক্ষ্য করা যায়। তরুণ ছাত্র ছাত্রী ছাড়াও চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী এমনকি রিটায়ার্ড মানুষেরাও একটুখানি আনন্দের খোঁজে, পরিবার-আত্নীয়স্বজনদের সাথে একটুখানি ভাল সময় কাটানোর জন্য বৈশাখে ঘুরে বেড়ায়। ব্যস্ত আর নির্লিপ্ত জীবনের একটু অবসাদ খুঁজে ফেরে তারা, খুঁজে ফেরে তারা আনন্দের উপলক্ষ্য।
আপনি হয়তো শোভাযাত্রার, বছরের প্রথম দিন ভাল কাটানোর বা অন্যকোনো বিষয়াদির মঙ্গল অমঙ্গলের ব্যাপারগুলো বিশ্বাস করেন না, বরং আপনি বিশ্বাস করেন ‘সমস্ত মঙ্গল-অমঙ্গল কেবল আল্লাহরই অনুমতিক্রমে সম্ভব’ কিন্তু তবুও কোনো একটি শির্কযুক্ত কাজ করে মুশরিকদের তালিকায় নাম লিখাতে পারেন। আল্লাহ বলছেন –
“অধিকাংশ মানুষ ঈমান আনে, কিন্তু সাথে সাথে শির্কও করে” (সূরা ইউসুফ, ১০৬)
এখানে আল্লাহ রব্বুল আলামীন ঈমানদার মুশরিকদের কথা বলেছেন! তারা আল্লাহকে বিশ্বাস করে কিন্তু সাথে সাথে শির্কের মত জঘন্য গুনাহের কাজেও লিপ্ত হয়!
এই ধরনের শির্ক হল ‘তাওহীদুল উলূহিয়্যাহ’ অর্থাৎ ‘ইবাদাতে আল্লাহ্‌র একত্ব অক্ষুন্ন রাখা’ এর বিপরীত। ‘তাওহীদুল উলূহিয়্যাহ’ এর মাধ্যমে যেমনি ‘ইবাদাতে আল্লাহ্‌র একত্ব অক্ষুন্ন রাখা’ হয়, তেমনি এর বিপরীতে অন্তরে বিশ্বাস না করলেও মানুষ কোনো একটি কাজের মাধ্যমে শির্কে, কুফরিতে লিপ্ত হতে পারে; আবার কখনো ইসলাম থেকেই খারিজ হয়ে যেতে পারে। তাই অন্তরে বিশ্বাস না করলেও শোভাযাত্রায় যাওয়ার মতো শির্কের কার্যাবলি থেকে নিজেকে হিফাজত রাখাও মু’মিনদের অবশ্যকর্তব্য।
কারণ শির্ক হল কবীরাহ গুনাহের মধ্যেও সবচেয়ে বড় কবীরাহ গুনাহ। এতই মারাত্নক যে, অন্য যেকোনো গুনাহ করা ব্যক্তি তাওবাহ না করলেও আল্লাহ রব্বুল আ’লামীন তাঁর রহমতের অসিলায় ক্ষমা করে দিতে পারেন, কিন্তু শির্ক করে তাওবাহ না করেই মৃত্যুবরণ করলে আল্লাহ তা কখনো ক্ষমা করবেন না বলে দিয়েছেন।
“নিশ্চয়ই আল্লাহ তাকে ক্ষমা করেন না, যে তাঁর সাথে কাউকে শরীক করে। এছাড়া যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন। আর যেই আল্লাহর সাথে কোনকিছু শরীক করে সে তো (সরলপথ থেকে) সুদূরে ভ্রান্তিতে পতিত হয়।” (সূরা নিসা, ১১৬)
“যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে শির্ক করবে, নিশ্চয়ই আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দিবেন এবং তার ঠিকানা হবে জাহান্নাম। আর এরূপ অত্যাচারী লোকদের জন্য কোন সাহায্যকারী থাকবে না।” (সুরা মায়িদাহ, ৭২)
শুধুমাত্র এই শির্কের ভয়াবহতা নিয়ে শত পৃষ্ঠা লিখা সম্ভব। তার চেয়ে হতভাগা তো কেউ নেই যে কিনা এতকিছু জানলো কিন্তু তবুও গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে ঈমানদার হয়েও শির্কে লিপ্ত হল। তার চেয়ে হতভাগা তো কেউ নেই যে কিনা সামান্য একদিন আনন্দ ফূর্তি করার জন্য রব্বের দেওয়া বিধান ভুলে গিয়ে নিজের খেয়াল খুশিকেই, প্রবৃত্তিকেই রবের আসনে বসিয়ে দিল।
“আপনি কি তাকে লক্ষ্য করেছেন, যে তার প্রবৃত্তিকেই স্বীয় উপাস্য করে নিয়েছে?”
(সূরা জাসিয়া, ২৩)
অনেকে হয়তো একটি হাদিসের কথা ভাবেন যে রাসূলুল্লাহ ﷺ তো বলেছেন “সকল কাজের ফলাফলই নিয়্যাতের উপর নির্ভরশীল।” (সহীহ বুখারী, ১) অথচ বেশিরভাগই জানেন না যে, এখানে আসলে ‘ইবাদাত বিষয়ক কাজ’ গুলোর কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ যে কাজগুলো ইবাদাত হিসেবেও গণ্য হতে পারে, আবার দুনিয়াবি উদ্দেশ্যে ঐচ্ছিকও হতে পারে সেগুলো। যেমন কেউ হিজরত করল কিন্তু আল্লাহর জন্য না করে বিয়ে করার জন্য করল এমনসব কাজ এর অন্তর্ভূক্ত হবে। কারণ ভাল নিয়্যাত হলেও কিছু কাজ প্রকৃতিগত কারণেই নিষিদ্ধ আর শির্ক, বিদআতের মত কাজগুলো সেগুলোরই অন্তর্ভূক্ত।
যেমনঃ বিদআতীরা মনে করে যে তারা তাদের নব উদ্ভাবিত ইবাদাত দিয়ে আল্লাহর ইবাদাত করছে আর আল্লাহকে খুশি করছে অথচ এর মাধ্যমে তারা রাসূলুল্লাহ ﷺ এর নবুয়্যাতকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে। ফলে তাদের মনের নিয়্যাত ভাল হলেও বিদআতী ইবাদাত বাতিল ও গুনাহ আকারে গ্রাহ্য হয়। তাহলে ইবাদাতের নিয়্যাতে করা কাজও গুনাহে পরিণত হতে পারলে আল্লাহর সাথে শির্ক করা হয় এমন কাজের পিছনে ‘নিয়্যাত ঠিকই আছে’ বা ‘বিশ্বাস ঠিকই আছে’ এসব কথা বলে তো মোটেই পার পাওয়া যাবে না। আল্লাহ আমাদেরকে দ্বীনের সহীহ বুঝ দান করুন।

[৩]

যারা মৌলিক আকিদাহ সঠিকই পোষণ করে এবং বৈশাখী কার্যকলাপে সরাসরি অংশ নেয় না। তবে কেবলই বাঙালি সংস্কৃতির অংশ হিসেবে ঘরে বসে পারিবারিকভাবে বৈশাখ পালন জায়েজ মনে করে বা এভাবে বৈশাখ পালনকে ইসলামবিরোধী কিছু মনে করে না; অথবা এভাবে বৈশাখ পালন অসমর্থন করে না
উৎসবের ছুটির দিনগুলো অন্যান্য সাধারণ ছুটির দিন থেকে হয় আলাদা। কারণ উৎসবের একটা প্রস্তুতি, একটা আয়োজন থাকে। পহেলা বৈশাখ এর ব্যতিক্রম তো নয়ই, বরং প্রস্তুতির দিক দিয়ে আদর্শও বলা যেতে পারে। কয়েকদিন আগে থেকেই শুরু হয় জোরশোর প্রস্তুতি। সেই প্রস্তুতিতে থাকে এলাকার মাঠগুলোতে মেলা আয়োজন করে স্টল দেওয়া, রাস্তাগুলোতে আলপনা এঁকে পরে সারাবছর ধরে সেগুলো পাড়িয়ে বেড়ানো আর বটমূলে-হিলে, প্রতিষ্ঠানে-রাস্তায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে নাচ-গানের রিহার্সেল। আবার অনেকের থাকে বৈশাখ উপলক্ষ্যে নতুন কাপড় কিনবার, ঘরে স্পেশাল খাবার বানানোর প্রস্তুতি। পত্র-পত্রিকার বিশেষ ক্রোড়পত্র, টিভি আর রেডিও চ্যানেলগুলোর বিশেষ অনুষ্ঠানের কথা তো বাদই; পান্তা-ইলিশ, কাপড়-চোপড়, মূর্তি মুখোশ থেকে শুরু করে রাস্তার পাশের চটপটি ফুচকা সব ধরনের ব্যবসার এমন রমরমা উপলক্ষ্য তো খুব কমই আসে। সব মিলিয়ে বাঙালিয়ানা যেন ধর্ম, আর বৈশাখ যেন সেই ধর্মের ঈদ।
আমার মতো কোনো আব্দুল্লাহ বলে ফেললেই মেনে নিবেন, তা নয়। বরং কুরআন আর সুন্নাহই আপনার দলিল হোক। বাঙালি পরিচয় বড় নাকি মুসলিম পরিচয় বড় আগে সেটা নির্ধারণ করুন।
উত্তরটা বাঙালি হলে আপনি এখনও পূর্ণাঙ্গ ঈমানদারই হতে পারেন নাই। শুধু তাই নয়, আপনি ‘আস-সাবিয়্যাহ’ তে আক্রান্ত এবং জাহিলিয়াতে রয়ে গেছেন। আর ‘আস-সাবিয়্যাহ’ তে আক্রান্তদের মত বোকা আর অথর্ব খুব কম মানুষই হতে পারে। কারণ জন্মভিত্তিক পরিচয়গুলো স্বয়ং আল্লাহর পক্ষ হতে নির্ধারিত এবং মানুষের ইচ্ছাশক্তির বাহিরে। কেউ ধনীর ঘরে জন্মাবে নাকি গরীবের ঘরে সেটা নিজে যেমনি নির্ধারণ করতে পারে না, তেমনি বাঙ্গালীর ঘরে জন্মাবে নাকি ইংরেজদের ঘরে জন্মাবে সেটাও তার ক্ষমতার বাহিরে। তাই বর্ণ, গোত্র, জাতীয়তা, ভাষা নির্বিশেষে যেকোনও মানুষই আল্লাহর কাছে প্রিয় বা ঘৃণ্য হতে পারে সে বিষয়টির মাধ্যমে যেটা বেছে নেওয়ার ও মেনে চলার পছন্দ মানুষকে দেওয়া হয়েছে – আল্লাহর নিকট আত্নসমর্পণ তথা মুসলিম হওয়া ও সে অনুযায়ী জীবন পরিচালিত করা।
তাহলে কেউ কেউ মুসলিমের ঘরে আর কেউ কেউ অমুসলিমের ঘরে জন্ম নিচ্ছে সেটা? আল্লাহ কারও উপর সাধ্যের অতিরিক্ত বোঝা চাপিয়ে দেন না। কেউ অমুসলিম ঘরে জন্মালে সেটাই তার জন্য উপযুক্ত পরীক্ষা। আর সে শেষ বয়সেও মুসলিম হলে যে তার পূর্বের সমস্ত গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে সেটাও তো এক ঈর্ষণীয় পাওয়া। আর অবশ্যই আল্লাহ কারও প্রতি জুলুম করবেন না।
আর আপনার কোন পরিচয়টা বড় সেই প্রশ্নের উত্তরটা ‘মুসলিম’ হলে আপনার জন্য কুরআন সুন্নাহের দালিলিক আলোচনাই যথেষ্ট হবে।
রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, “প্রত্যেক জাতির নিজস্ব উৎসব রয়েছে, আর আমাদের জন্য সেটা ঈদ।” (সহীহ বুখারী: ৯৫২; সহীহ মুসলিম: ৮৯২)
অর্থাৎ বাঙালি জাতির উৎসব পহেলা বৈশাখ থাকলেও একজন মুসলিমের জন্য তা নয়। মুসলিমের জন্য উৎসব হল দুই ঈদ।
আগেই আলোচনা করা হয়েছে যে এই তথাকথিত বাঙালি সংস্কৃতি আসলে সনাতন ধর্মালম্বীদের বিভিন্ন শির্কযুক্ত কুসংস্কার আর মূর্তিপূজার সংস্কৃতি। আর ইসলামী জীবনব্যবস্থার রয়েছে সম্পূর্ণ নিজস্ব আচার-আচরণ ও সংস্কৃতি: মুসলিমদের জন্য ভিন্ন কোন সম্প্রদায় যেমন: মুশরিক কিংবা অগ্নিপুজারীদের সংস্কৃতি, ইহুদী, নাসারা, বা আচার-আচরণ অনুকরণ করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
রাসুল ﷺ বলেছেন: “কেউ যদি কোন সম্প্রদায়কে অনুকরণ করে, তবে তাকে (শেষবিচারের দিনে) তাদের একজন বলে গণ্য করা হবে।” ( আবূ দাঊদ, ৪০৩১)
একারণে ঘরে বসে পারিবারিকভাবেও বাঙালি সংস্কৃতির নামে বৈশাখ পালন করা যাবে না, যাবে না এর সমর্থন করাও।
হযরত আনাস (রদিআল্লাহু আ’নহু) থেকে বর্ণিত আছে যে যখন আল্লাহর রাসূল মদিনায় আসলেন, তখন মদিনার অধিবাসীদের দুটো উৎসবের দিন ছিল, যে দিনগুলোতে তারা আনন্দ-উৎসব করতো।
তিনি ﷺ সাহাবিদের জিজ্ঞেস করলেন, “এ দিনগুলো কীসের জন্য?”
তারা বলল, “জাহেলিয়াতের যুগে আমরা এ দিনগুলোতে আনন্দ উৎসব করতাম।”
তখন আল্লাহ’র রাসুল (সা) বললেন, “আল্লাহতায়ালা তাদের এই দুটো দিনের চাইতে উত্তম দুটো দিন তোমাদের দান করেছেন। আর তা হল: ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা’র দিন।”
(আবু দাউদ, ১১৩৪)
উৎসব অনুষ্ঠানের ব্যাপারে এত সুস্পষ্ট নির্দেশনা আসার পরও ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’ কথাটিকে রীতিমত কালাম বানিয়ে বৈশাখ পালন করা সহজ, কঠিন হল মুসলিম হিসেবে কেবল আল্লাহর ইচ্ছাকেই সর্ববিষয়ে প্রাধান্য দেওয়া। কারণ, মুসলিম শব্দের অর্থই তো ‘যে নিজের ইচ্ছাকে আল্লাহর ইচ্ছার কাছে সমর্পণ করে দিয়েছে’।
এছাড়া ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’ কথাটিকে তর্কের খাতিরে মেনে নিলেও ‘ইসলাম’ অন্যসব ধর্ম থেকে আলাদা। কারণ ইসলাম কেবলই ধর্মবিশ্বাসে সীমাবদ্ধ নয়। বরং ইসলাম হল একমাত্র সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর পক্ষ থেকে মনোনীত ‘দ্বীন’ তথা পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান।
“বিধান হচ্ছে আল্লাহর এবং তিনি বিধান দিয়ে দিয়েছেন যে তোমরা আল্লাহ ব্যতীত অন্য কিছুর ইবাদাত করো না।” (সূরা ইউসুফ, ৪০)
আর এই পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধানে উৎসবের ব্যাপারেও যে সুনির্দিষ্ট আদেশ নিষেধ দেওয়া হয়েছে তা তো উপরের আলোচনাতেই প্রতীয়মান। এরপরও যদি নিজ খেয়াল খুশিকে রবের আসনে বসাতে চান তাহলে আপনার ব্যাপার।
“এবং যে কেউই ইসলাম ছাড়া অন্য কোন জীবনব্যবস্থা আকাঙ্খা করবে, তা কখনোই তার নিকট হতে গ্রহণ করা হবে না, এবং আখিরাতে সে হবে ক্ষতিগ্রস্তদের একজন৷” (সূরা আলে ইমরান, ৮৫)

[৪]

যারা সত্যিই কোনো প্রয়োজনীয় কাজে বৈশাখের দিন বের হয় ।
প্রথমেই প্রয়োজনের সংজ্ঞা নির্ধারণ করা যাক। প্রয়োজনের সংজ্ঞার দুটো দিক বিবেচনা করা উচিত আর সেগুলো হল – এক, এমন অত্যাবশ্যকীয় পরয়োজন যা আপনার পহেলা বৈশাখের দিনেই করতে হবে। দুই, আপনি এই প্রয়োজন সম্পর্কে আল্লাহর সামনে দাঁড়াতে পারবেন।
পহেলা বৈশাখের কুসংস্কার বা শিরকি কার্যকলাপ সম্বন্ধে বান্দা ওয়াকিবহাল। তাই সে শোভাযাত্রা, মূর্তিযাত্রা হেন তেন ইত্যাদিতে গেল না। কিন্তু বিকাল বা সন্ধ্যার দিকে মেলায় কিছু একটা কিনবার অসিলায় বা এমনিতেই ঘুরতে বের হল। বোঝা উচিত, এগুলো প্রয়োজনের সংজ্ঞাতেই পড়বে না। বাদবাকি যারা মনে করেন যে আপনারা আল্লাহর সামনে নিজের এই কাজ নিয়ে দাঁড়াতে পারবেন তাদের জন্য এই অংশ।
পহেলা বৈশাখ আর অন্যান্য জাহিল উৎসবে যে পরিমাণ অবাধ মেলামেশা আর বেপর্দা বেহাপনার সৃষ্টি হয় শুধু এই কারণেই মুসলিম হিসেবে এই পহেলা বৈশাখ সম্পূর্ণ বর্জন করা অবশ্য কর্তব্য। এই ধরনের জাহিলিয়াপনায় যে শুধু চোখের জিনাই সমস্ত রেকর্ড ভেঙ্গে ফেলে তা বিবেকবান প্রত্যেকেই উপলব্ধি করতে পারে।
“…চোখের জিনা হল (অশ্লীল উদ্দেশ্যে) তাকানো, জিহ্বার জিনা হল (অশ্লীল) কিছু বলা…” (বুখারি ৫৮৮৯, মুসলিম ২৬৫৭)
কিন্তু এই বেহায়াপনা যে শুধু চোখে আর মুখেই সীমাবদ্ধ থাকে নাই তার প্রমাণও পেয়ে গেছে মানুষ। কিন্তু তারও আগে আরও কত বোনকে যে ভিড়ের মধ্যে সুযোগের বলি হতে হয়েছে তা তো কেবল আল্লাহই জানেন। এখানে উল্লেখ্য যারাই এমন দিনে বের হয়ে নিজেদেরকে ফিতনার মধ্যে ফেলে দিচ্ছে, আর নিজেরা সেজে গুজে ফিতনাহ হয়ে বের হচ্ছে উভয়ই অপরাধী। ক্ষেত্রবিশেষে কেউ কম বা বেশি হতে পারে, কিন্তু এদের কেউই নিরপরাধ নয়। আল্লাহ ক্ষমা করুন।
“মুমিনদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি নত রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হেফাযত করে। এতে তাদের জন্য খুব পবিত্রতা আছে। নিশ্চয়ই তারা যা করে তা সম্পর্কে আল্লাহ অবহিত আছেন।” (সূরা নূর, ৩০)
“ঈমানদার নারীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নত রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হেফাযত করে। তারা যেন যা সাধারণতঃ প্রকাশমান, তা ছাড়া তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে এবং তারা যেন তাদের মাথার ওড়না বক্ষ দেশে ফেলে রাখে … … … তারা যেন তাদের গোপন সাজ-সজ্জা প্রকাশ করার জন্য জোরে পদচারণা না করে। মুমিনগণ, তোমরা সবাই আল্লাহর সামনে তওবা কর, যাতে তোমরা সফলকাম হও।” (সূরা নূর, ৩১)
আল্লাহ রব্বুল আ’লামীন মুমিন-মুমিনা উভয়ের জন্য আলাদা আয়াত নাযিল করে পর্দা ফরজ করেছেন। এই বিষয়ে বিস্তারিত বলতে গেলেও বই হয়ে যায়। যেসব বোনেরা মনে করেন যে হিজাব করেও বাহিরে বের হওয়া যায় তারা আসলে হিজাবকে বুঝতেই পারেন নাই। এই বিষয়ে ‘ইসলামে নিকাব নেই’ নোটে কিছুটা বিস্তারিত আলোচিত হয়েছে।
ফিতনার এই ব্যাপারটি জাহিলরাও অস্বীকার করে না, অথচ অনেক মুসলিমকেই কেবল একদিনের সস্তা আনন্দের লোভে রবের ভয় ভুলে যায়। ‘বখাটে ছেলেদের ভীড়ে ললনাদের রেহাই নাই’ যখন গানের লিরিকসে চলে এসেছিল তা জেনেবুঝেই এসেছিল। আমাদের এখন নিজেদের দোষত্রুটিগুলো মেনে নিয়ে আল্লাহকে যথার্থ ভয় পাওয়া উচিত।
উল্লেখ্য, যে পুরুষ পরিবারের দায়িত্বে নিয়োজিত, তিনি যদি পাঁচ ওয়াক্ত সলাত পড়েন, তাহাজ্জুদ পড়েন, নফল ইবাদাতে মশগুল থাকেন, মুখে দাঁড়ি রেখে ভাব-গাম্ভীর্যের সাথে চলাফেরা করেন, সমাজে ভদ্রজন হিসাবে পরিচিতিও পান, কিন্তু তিনি পরিবারের সদস্যদেরকে বেহায়াপনায় বাধা প্রদান করেন না, উত্তমভাবে নজরদারি করেন না, এমন ‘ভদ্রজন’দেরকেও হাদীসে ‘দাইয়ূস’ বলা হয়েছে।
দাইয়ূস হলো সে ব্যক্তি যে তার পরিবারকে বেহায়াপনার সুযোগ দেয়।
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহ তিন ব্যক্তির উপরে জান্নাত হারাম করেছেন; মদ্যপায়ী, পিতামাতার অবাধ্য ও দাইয়ূস। যে তার পরিবারে অশ্লীলতাকে স্বীকৃতি দেয়’ (দাইয়ূস)।”
(সহীহুল জামি’ ৩০৫২)
তাই অভিভাবক মহল, আপনাদের নিজেদের সন্তানদেরকে গুনাহে জারিয়ার উপলক্ষ্য বানাবেন না। সচেতনতার অভাবে যদি আপনার সন্তান নষ্ট হয় তবে আপনি আল্লাহর নিকট কী জবাব দেবেন। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,
‘তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল। আর প্রত্যেকেই তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে’। (মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত ৩৬৮৫)
তাই যেসব প্রয়োজন নিয়ে আল্লাহর সামনে দাঁড়ানো যাবে না, সেগুলো অনুধাবণ করুন আর তা থেকে দূরে থাকুন। সলাত, অসুস্থতা যার কারণে ডাক্তারের কাছে যাওয়া অয়াবশ্যক হয়ে পড়ে এই ধরনের প্রয়োজন ছাড়া যেসব প্রয়োজনীয় কাজ একদিন পরেও করা সম্ভব সেগুলো আল্লাহর সন্তুষ্টির রাহে পরেই করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে।

[৫]

যারা প্রবল অনিচ্ছা সত্ত্বেও জবরদস্তিপূর্বক কোন আনুষ্ঠানিকতায় জড়াতে বাধ্য হন ।
এই বিষয়টি আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষ পরীক্ষাস্বরূপ এবং এক্ষেত্রে পরিস্থিতিভেদে শিথিলতা আসতে পারে। বিষয়টি আলেমদের সাথে পরমার্শ করাই বাঞ্চনীয়। তবে এখানেও অন্য যেকোনো কিছুর চেয়ে আল্লাহই সবচেয়ে বেশি ভয়ের দাবিদার।
একেবারে বাধ্য হলেও আল্লাহর কাছে বিষয়টির জন্য ইস্তিগফার করতে হবে এবং তাওবাহের সমস্ত শর্তগুলো পূরণ করে আন্তরিকভাবে তাওবাহ করতে হবে। ভাগ্যের পরিহাসে লিখাটি যাদের ‘পহেলা বৈশাখ’ পালন শেষে পড়া হবে তাদের জন্যও তাওবাহ বাঞ্চনীয়। তানাহলে চৈত্র্যের শেষে বৈশাখের উত্তাপ কোনোরকম সহ্য করতে পারলেও জাহান্নামের উত্তাপ কিন্তু সহ্য হবে না মোটেও।
বৈশাখ আল্লাহর ভয়
“…নিঃসন্দেহে সর্বোত্তম পাথেয় হচ্ছে আল্লাহর ভয়।…” (সূরা বাকারাহ, ১৯৭)
“হে ঈমানদারগণ! আল্লাহকে যেমন ভয় করা উচিৎ ঠিক তেমনিভাবে ভয় করতে থাক। এবং অবশ্যই মুসলমান না হয়ে মৃত্যুবরণ করো না।” ( সূরা আল-ইমরান, ১০২)
“কিন্তু যারা ভয় করে নিজেদের পালনকর্তাকে তাদের জন্যে রয়েছে জান্নাত যার তলদেশে প্রবাহিত রয়েছে প্রস্রবণ।…” ( সূরা আল-ইমরান, ১৯৭)
ওয়ামা তাওফিকি ইল্লা বিল্লাহ।
আল্লাহ আমাদেরকে তাঁর দ্বীনকে সঠিকভাবে বুঝার, দ্বীনে পরিপূর্ণরূপে প্রবেশ করার তাওফিক দিন এবং সিরতল মুস্তাকিমে অটল অবিচল থাকার তাওফিক দিন। আল্লাহ আমাদেরকে উত্তম তওবাকারীদের অন্তর্ভূক্ত করুন। আলহামদুলিল্লাহি রব্বিল আ’লামীন, ওয়াসসলাতু ওয়াসসালামু আ’লা রসূলিহী ওয়া আস-হাবিহি ওয়াসাল্লাম তাসলিমান কাসি-র।
====================
লেখক- তানভীর আহমেদ