9.7 C
New York
Sunday, October 26, 2025

Buy now

spot_img
Home Blog Page 12

ইসলামের প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় নারীর অবদান

নারী ও পুরুষের সমন্বিত প্রয়াস ও অংশীদারিত্বে মানব জাতির বিকাশ হয়েছে। সমাজ ও সভ্যতা নির্মাণে নারী বা পুরুষ কারো ভূমিকা কোন অংশে কম নয়। কিন্তু ইতিহাসের বাস্তবতা হচ্ছে, মানব জাতি যখন যেখানে আসমানী শিক্ষা হতে দূরে সরে গেছে, সেখানে সমাজের ভারসাম্য নষ্ট হয়েছে এবং অশান্তির আগুন মানব জীবনকে ঘিরে ফেলেছে। বিশেষ করে পৃথিবীর শুরু হতে নারী পুরুষ একত্রে বসবাস করা সত্ত্বেও উভয়ের মাঝে আকাশ পাতাল ব্যবধান ও বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে। এতে সবচে বেশি শোষণ ও বঞ্চনার শিকার হয়েছে সৃষ্টিগতভাবে অপেক্ষাকৃত দুর্বল ও লোভনীয়-মাহনীয় রূপের আধার নারী সমাজ। নারী তখন পুরুষের ফুর্তি ও ভোগের সামগ্রীতে পরিণত হয়েছে। বলা হয়েছে সমাজের চরম নিগৃহ ও বঞ্চনা নারীর ভাগ্যফল আর পুরুষ হল স্বামী ও পতি।

ইসলামের আবির্ভাবকালে আরবে ও ভারতের নারী সমাজ

প্রায় দেড় হাজার বছর পূর্বে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন ইসলামের দাওয়াত দেন তখনকার আরব সমাজে নারীরা কতভাবে বঞ্চনার শিকার ছিল, তার চিত্র ইতিহাস সংরক্ষণ করেছে। এর সামান্য একটি নমুনা ছিল, মেয়ে শিশুর জন্মকে গোটা পরিবারের জন্য কলঙ্কজনক মনে করা হত। তাই জন্মের সাথে সাথে তাদেরকে জীবন্ত কবরে পুতে ফেলা হত। ঠিক একই সময়ে ভারতীয় সমাজে চলছিল অন্যরকম চিত্র ও নিগ্রহ। ভারতীয় সভ্যতায় নারীকে মনে করা হত স্বামীর ভোগের সামগ্রী। তাই স্বামী মারা গেলে স্ত্রীকে স্বামীর লাশের সাথে চিতায় গিয়ে আগুনে পুড়ে প্রাণ দিতে হত। এমন পরিস্থিতিতেই মহানবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ধূলির ধরায় আবির্ভূত হন। তার প্রচারিত ইসলামের ছায়াতলে নারী তার অধিকার ও সম্মান ফিরে পায়। এ কারণে দেখা যায় নারী তার মানবিক সত্তার পূর্ণ প্রকাশ ঘটিয়ে ইসলামের প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় কালজয়ী ভূমিকা পালন করেন।

প্রথম যেভাবে ওহী নাযিল হল:

মক্কার ছয় কিলোমিটার উত্তর পূর্বে জাবলে নূর, নূর নামক পবর্ত। এই পর্বতের উপরে একটি গুহায় কয়েক বছর থেকে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক মাসের জন্য চলে যেতেন আল্লাহর নিরবচ্ছিন্ন আরাধনা ও ধ্যানমগ্নতায় কাটানোর জন্য। একদিন রাতে তিনি ঘুমিয়েছিলেন। কেউ এসে তাকে ঘুম থেকে জাগালেন আর সবুজ মখমল কাপড়ে জড়ানো একটি ফলক মেলে ধরে বলেন, পড়–ন। নবীজি বললেন, আমি পড়তে পারি না। ফেরেশতা তাকে বুকে আলিঙ্গন করে প্রচ- চাপ দেন। তাতে তিনি প্রাণান্তকর কষ্ট অনুভব করেন। ফেরেশতা আবারো বলেন, পড়–ন। তিনি আবারো জবাব দেন, আমি পড়তে পারি না। ফেরেশতা আবারো তাকে বুকে আলিঙ্গন করে প্রচ- চাপ দেন, এবারও তিনি প্রাণান্তকর কষ্ট অনুভব করেন। ফেরেশতা বললেন, ‘পড়–ন আপনার প্রভুর নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন। মানুষকে তিনি সৃষ্টি করেছেন শুক্রবিন্দু হতে। পড়–ন, আপনার প্রভু অতিশয় দয়ালু, যিনি মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন কলমের সাহায্যে। সূরা আলাকের প্রথম পাঁচটি আয়াত আগন্তুক ফেরেশতা পাঠ করার সাথে সাথে হযরতের অন্তরে অঙ্কপাত করল। তিনিও আয়াতগুলো আবৃত্তি করলেন। ফেরেশতা নিজের পরিচয় দিলেন ফেরেশতা জিব্রাঈল বলে। অপ্রত্যাশিত এই ঘটনায় নবীজি আতঙ্কিত হলেন। তিনি কম্পিত দেহে বাড়ি ফিরে ঘরের লোকদের ডেকে বলেন, যাম্মিলুনী, যাম্মিলুনী। তোমরা আমাকে চাদর ঢেকে দাও। আমাকে চাদর জাড়িয়ে দাও। আমি আমার জীবন নিয়ে শংকিত।

বিবি খদিজা রা. নবীজির অনুপম চরিত্রের সাক্ষী
স্ত্রী খদিজা স্বামীর মুখে ঘটনার বর্ণনা শুনে ভয়ে আতঙ্কে আরো ঘাবড়ে যাওয়ার কথা। জিব্রাঈল নামে কারো কথা তো তিনি এর আগে শুনেন নি। না জানি, কোনো বিপজ্জনক দৈব কিছু ঘটল কিনা। বুদ্ধিমতি বিচক্ষণ খদিজা চিন্তা করলেন, আজীবন তার স্বামী সত্য ও সুন্দরকে লালন করেছেন। কাজেই তার জীবন কখনো বিপত্তির মুখে পড়তে পারে না। তবে প্রথম কাজ হবে স্বামীর মন থেকে অজানা আতঙ্ক দূর করা। কাজেই চাদর মুড়ি দিয়ে তাকে বিশ্রাম নিতে দিলেন। এরপর প্রচ- আত্মবিশ^াস নিয়ে অভয় দিলেন, (সীরাতে ইবনে হিশামের বর্ণনায় ) ‘আপনি আনন্দিত হোন। সুসংবাদ আপনার জন্য। আমি তো আশা করি, আপনি হবেন এই জগতের জন্য আল্লাহর বার্তা বাহক প্রেরিত পুরুষ। আপনি হবেন শেষ জমানার নবী। ’ তিনি তার এই আশাবাদের পেছনে যে যুক্তি প্রমাণ পেশ করলেন তাও অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এবং তার মধ্যে নবী জীবনের এক সুন্দর আলোকিত দিক ফুটে উঠেছে। বুখারী শরীফের বর্ণনায় হযরত খদিজা নবীজির উদ্দেশ্যে বললেন, ‘কক্ষণো না, ভয়ের কিছু নেই। আল্লাহর কসম, আল্লাহ কখনই আপনাকে অপমানিত করবেন না। কারণ, আপনি নিজ আত্মীয়-স্বজনের সাথে সদ্ব্যবহার করেন। দুর্বল ও দুস্থ লোকদের সেবা করেন। বঞ্চিত ও অভাবীদের উপার্জনক্ষম করেন। মেহমানদের আতিথেয়তা করেন এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপদগ্রস্থদের সাহায্য করেন।’

ভালো মানুষ কিনা দেখার আয়না নিজের স্ত্রী:
হযরত খদিজাতুল কুবরার এই সাক্ষ্য প্রমাণ করে নবুয়াত লাভের আগে থেকেই মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল মানব সেবা ও মানুষের প্রতি ভালোবাসা। দ্বিতীয়ত তিনি কত মহান মানুষ ছিলেন তার সবচে উজ্জ্বলতম দৃষ্টান্ত নিজের স্ত্রীর সাক্ষ্য। মানুষ বাইরের সমাজে বিরাট কিছু হতে পারে। কিন্তু ভেতরে আসল মানুষটি কেমন তা অবশ্যই ধরা পড়ে স্ত্রীর আয়নায়। স্ত্রীর কাছে কোনো কিছু গোপন থাকে না, রাখতে পারে না। এ জন্যে হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে ‘তোমাদের মধ্যে সে ব্যক্তিই উত্তম যে নিজের স্ত্রীর কাছে উত্তম।’ নিঃসন্দেহে নবুয়াত লাভের পূর্বে খদিজা রা. নবীজির চরিত্র এবং ভবিষ্যতে মানব জাতির পথপ্রদর্শক হওয়ার যে ভবিষ্যতবাণী করলেন, তার গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। মানুষ যখন কোনো নতুন কাজের উদ্যোগ নেয়, তখন স্ত্রী তথা পরিবার থেকে সামান্য সমর্থন কাজটি এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে কীরূপ ভূমিকা রাখে তার অভিজ্ঞতা কম বেশি আমাদের সবার আছে। নবী করিম সা. এর নবুয়াতী জীবনে খাদিজাতুল কুবরার অকুণ্ঠ সমর্থনের জন্য গোটা উম্মত কিয়ামত পর্যন্ত তার প্রতি কৃতজ্ঞচিত্ত।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, জগতের সর্বপ্রথম মুসলমান ছিলেন একজন নারী আর তিনি নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সহধর্মীনী আমাদের মা হযরত খাদিজাতুল কুবরা রা.। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বয়স যখন চল্লিশ বছর ও একদিন তখন তাঁর উপর ওহী নাযিল হয়। ওহী নাযিলের অত্যন্ত কঠিন ও স্পর্শকাতর মুহূর্তে হযরত খাদিজা যে সাহসিকতা ও দূরদর্শিতার সাথে পরিস্থিতি সামাল দেয়ায় অসাধারণ যোগ্যতার পরিচয় দেন তা ইতিহাসের বিস্ময়।

বিবি খাদিজা রা. যেভাবে পরিস্থিতি সামাল দিলেন
দূরদর্শী খাদিজার নবীজিকে মৌখিক সান্ত¡না দিয়েই ক্ষান্ত হন নি। তিনি জানতে চান, জিব্রাঈল নামে যিনি তার স্বামীর কাছে আসল তার পরিচয় কী? পরিস্থিতি বিশ্লেষণের জন্য তিনি চলে গেলেন ওয়ারাকা ইবনে নওফেলের কাছে। ওয়ারাকা ছিলেন খ্রিস্টান পাদ্রী। ইঞ্জিল লিখতেন এবং ধর্মগুরু হিসেবে তার খ্যাতি ছিল। খাদিজা রা. তার কাছে একা গিয়েছিলেন বা নবীজিকে সাথে নিয়ে গিয়েছিলেন বলে দুটি বর্ণনা পাওয়া যায়। বুখারী শরীফের বর্ণনায় ‘খাদিজা নবীজিকে সঙ্গে নিয়ে তার চাচাত ভাই ওয়ারাকা ইবনে নওফেল ইবনে আসাদ ইবনে আব্দুল ওযযার কাছে গেলেন। ওয়ারাকা জাহেলী যুগে ঈসায়ী ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। তিনি হিব্রু ভাষায় কিতাব লিখতেন। তাই আল্লাহর ইচ্ছা ও তওফীক অনুযায়ী তিনি ইঞ্জিলের অনেকাংশ (সুরয়ানী ভাষা থেকে) হিব্রু ভাষায় রূপান্তরিত করেছিলেন। তিনি বৃদ্ধ ও অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। খাদিজা তাকে বললেন, হে চাচাত ভাই। আপনার ভাতিজা (অর্থাৎ নবীজি) এর কাছ থেকে সবকথা শুনুন।
ঘটনার বিবরণ শুনে ওয়ারাকা তাকে বললেন, এই সেই নামুস, (পবিত্র ফেরেশতা) যাকে আল্লাহ মূসা এর নিকট নাযিল করেন। হায়! আমি যদি তোমার নবুয়তের সময় বলবান যুবক থাকতাম। হায়! যদি আমি সেই সময় জীবিত থাকতাম, যখন তোমার জাতি তোমাকে মক্কা থেকে বের করে দেবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওয়ারাকাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তারা কি সত্যিই আমাকে বের করে দেবে? ওয়ারাকা বললেন, হ্যাঁ তুমি যা নিয়ে দুনিয়ায় এসেছ তদ্রুপ কোনো কিছু নিয়ে যে ব্যক্তিই এসেছে তার সাথে শত্রুতা করা হয়েছে। তারপর ওয়ারাকা বেশিদিন জীবিত ছিলেন না। এরপরই ওহী নাযিলে বিরতি ঘটে।

আগন্তুক ফেরেশতা না শয়তান জানার অভিনব পরীক্ষা
ওহী নাযিলের প্রথম দিকে নবীজিকে মনোবল যোগানো, আগত ফেরেশতার প্রকৃত পরিচয় জানা এবং পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য খাদিজাতুল কুবরা রা. আরো পদক্ষেপ নেন। সীরাতের কিতাবসমূহে তার বিস্তারিত বিবরণ বিধৃত। সীরাতে ইবনে হিশামে একটি রেওয়াত বিধৃত হয়েছে ইসমাঈল ইবনে আবি হাকাম সূত্রে। তাতে খদিজা রা. নবীজিকে বলেন, আপনার কাছে যখন আপনার সাথী আসে তখন কি আমাকে জানাতে পারেন? বললেন, হ্যাঁ, জানাব। একদিন যখন জিব্রাঈল এলেন নবীজি খদিজাকে ডেকে বললেন, খদিজা আমার সাথী এখন এসেছে। খদিজা রা. বললেন, হে আমার চাচাত ভাই! কাউকে সম্বোধন করতে চাচাত ভাই বলা তখনকার আরব সমাজে একটি রেওয়াজ ছিল। খাদিজা বললেন, আপনি উঠে আমার বাম হাঁটুর উপর বসুন তো। নবীজি দাঁড়িয়ে তার হাঁটুর উপর বসলেন। খাদিজা বললেন, আপনি কি তাকে এখন দেখতে পাচ্ছেন। তিনি বললেন, হ্যাঁ। এরপর বললেন, এবার পাল্টে এসে আমার ডান হাঁটুর উপর বসুন। হযরত সরে এসে খাদিজা রা. এর ডান হাঁটুর উপর বসলেন। এবার জিজ্ঞাসা করলেন, এখন কি তাকে দেখতে পাচ্ছেন? বললেন, হ্যাঁ। বললেন, এবার উঠে আমার পাশে বসুন। নবীজি সরে এসে তার পাশে বসলেন। এরপর তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, এখন কি দেখতে পাচ্ছেন? বললেন, হ্যাঁ। এ সময় খাদিজা রা. মাথার ওড়না খুলে ফেললেন। তখনও নবীজি তার পাশেই বসা ছিলেন। এবার জানতে চাইলেন আপনার আগন্তুক সঙ্গীকে কি দেখতে পাচ্ছেন? নবীজি বললেন, না দেখছি না। তখন খদিজা রা. আনন্দে উচ্চৈঃস্বরে বলে উঠলেন, হে চাচাত ভাই! আপনি আনন্দিত হোন। আপনি অবিচল থাকুন। আপনার জন্য সুসংবাদ। আপনি যাকে দেখতে পান তিনি ফেরেশতা। শয়তান (দুষ্টজিন) নয়। (কারণ ফেরেশতা বেপর্দা মহিলার কাছে থাকে না। আগন্তুক শয়তান বা জিন হলে মাথার কাপড় ফেলে দিলে চলে যেত না। )

হযরত খদিজাতুল কুবরার অবর্ণনীয় ত্যাগ
হযরত খদিজাতুল কুবরা রা. মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দাওয়াতী মিশনের জন্য যে ত্যাগ, বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন তাতে তিনি বিশে^র বুকে আল্লাহ আল্লাহর রসূল ও তাঁর আনীত বাণীর প্রতি প্রথম বিশ^াস স্থাপনকারীর মর্যাদায় অভিষিক্ত হয়েছেন। বিশে^র বুকে প্রথম মুসলমান একজন মহিলা এটি কি মুসলিম নারীদের জন্য কম গৌরবের বিষয়? ওহী নাযিলের আগেও হেরাগুহায় নবীজি যখন ধ্যানমগ্ন থাকতেন তখন তাঁর খাবার ও পানীয় সরবরাহ করতেন হযরত খদিজা রা.। সাধারণত মহিলারা স্বামীর আয় উপার্জনের দিকেই দৃষ্টি রাখে। অথচ স্বামীর প্রতি খদিজাতুল কুবরার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল অন্যরকম। খদিজা ছিলেন আরবের ধনাঢ্য মহিলা। তার পুঁজি নিয়েই বিবাহের আগে নবীজি সিরিয়ায় বাণিজ্যে গিয়েছিলেন। কিন্তু বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার পর নিজের সমস্ত সম্পদ তিনি উৎসর্গ করেন নবীজির কদমে। তাঁর গোটা জীবন, জীবনের সবকিছু বিলিয়ে দিয়েছিলেন ইসলামের সেবায় মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জন্যে। ইসলামের জন্য হযরত খদিজার আত্মত্যাগ কতখানি তা বুঝার জন্য একটি হাদীসের মর্মবাণী সামনে রাখাই যথেষ্ট।

হযরত আয়েশা রা. বর্ণনা করেন, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখনই খদিজার কথা স্মরণ করতেন তাঁর প্রশংসা করতেন। এবং এই প্রশংসা হত অনেক দীর্ঘ ও সুন্দর। একদিন খদিজার অতিবেশি প্রশংসা শুনে আমার আত্মমর্যাদায় লাগল। আমি নবীজিকে বলে ফেললাম, আপনি একজন বুড়ির প্রশংসায় এভাবে আত্মহারা হয়ে যান। সে তো মরে গেছে আর আল্লাহ আপনাকে তার চেয়ে অনেক উত্তম স্ত্রী দান করেছেন। একথা শুনে নবীজি বললেন, হে আয়েশা! আল্লাহ আমাকে খাদিজার চেয়ে উত্তম স্ত্রী দান করেন নি। (খাদিজার চেয়ে উত্তম কেউ হতে পারে না। কেননা, ) মানুষ যখন আমাকে অস্বীকার করেছিল তখন সে আমার উপর ঈমান এনেছিল। লোকেরা যখন আমাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছিল খাদিজা তখন আমাকে সত্য বলে বিশ^াস করেছিল। মানুষ যখন আমাকে বঞ্চনার শিকার করেছিল তখন আল্লাহর তার সম্পদ দিয়ে আমাকে অভাবমুক্ত করেছিল। আর আল্লাহর তার ঘরে আমার সন্তানদের দিয়েছেন (ইবরাহীম ছাড়া বাকী সবাই খদিজার ঘরের সন্তান)
খাদিজার ইন্তেকালে নবীজির দুঃখ ও শোক:
বুখারীসহ সব হাদীস ও সীরাত গ্রন্থে এই হাদীসের বর্ণনা এসেছে। বস্তুত হযরত খাদিজা ছিলেন নবীজির পারিবারিক শান্তি, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ও শান্তির ঠিকানা। এ কারণে নবুওয়াতের ১০ম সালে যখন চাচা আবু তালেবের ইন্তিকালের পরপর বিবি খাদিজাও ইন্তিকাল করেন তখন নবীজি সামাজিকভাবে চরম অসহায়ত্বের শিকার হয়েছিলেন। তিনি সেই বছরটিকে আম্মুল হাযান বা দুঃখের বছর হিসেবে জীবনভর স্মরণ করেছেন। নবীজির পাশে থেকে খাদিজাতুল কুবরার ত্যাগ ও কুরবানী প্রমাণ করে, শুরু থেকে মহিলারা ইসলামের প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় শুধু যে অবদান রেখেছিলেন তা নয়; বরং এ ক্ষেত্রে তারা পুরুষের চেয়ে অগ্রগামী ছিলেন।

মহানবী সা. এর বহুবিবাহের রহস্য
এখানে একটি প্রশ্নের জবাব দিয়ে সামনে এগুতে চাই। নবীজির সংসারে আমাদের মায়েদের সংখ্যা ছিল বরাবর ৯ জন। খাদিজা রা. ও আরো কয়েকজনকে হিসাবে আনলে এই সংখ্যা ১১ বা ১৩। পশ্চিমা দুনিয়ার বিদ্বেষী অন্ধদিল নিন্দুকদের গাত্রদাহ হল, ইসলামের নবীর সংসারে স্ত্রীর সংখ্যা এতবেশি কেন? তারা একে ‘নাউজু বিল্লাহ’ নবীজি নারীলোভী ছিলেন বলে অপপ্রচার চালাতে সুখ অনুভব করে।

আমাদের আলোচনা ইসলামে নারীর অবদান নিয়ে। তাই এই প্রশ্নে এখানে বিস্তারিত আলোচনায় যেতে চাই না। খুব সংক্ষেপে বলতে চাই, একজন পুরুষের যৌবনের তাড়না বা কামনা থাকে ১৫ বছরের পর থেকে চল্লিশ বছর বা বড়জোর পঞ্চাশ বছর পর্যন্ত। কেউ নারীলোভী হলে এ সময়েই তার চারিত্রিক অধঃপতন ঘটে। অথচ আমরা দেখি যে, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বয়স যখন ২৫ বছর তখন কুরাইশ বংশের অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত বিদুষী মহিলা খাদিজা, যার বয়স চল্লিশের কোটায় এবং ইতিমধ্যে দুজন স্বামীর সাথে ঘর করেছেন, সন্তান আছে তার সাথেই পারিবারিক ব্যবস্থাপনায় পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন। নবুয়াত লাভের পরের কঠিন দিনগুলোতে সে স্ত্রীই তার আশ্রয়স্থলের ভূমিকা পালন করেন।

পঞ্চাশ বছর বয়সে দ্বিতীয় বিবাহ
নবুয়াতের দশ সাল অর্থাৎ নবীজির বয়স যখন পঞ্চাশ বছর তখন পঁয়ষট্টি বছর বয়সে স্ত্রী খাদিজা মারা গেলে তিনি শোক ও দুঃখের সাগরে নিমজ্জিত হন, যে কারণে বছরটিকে তিনি দুঃখের বছর হিসেবে অভিহিত করেন। খাদিজা রা. এর ইন্তিকালের পর যে মহিলার সাথে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন, তিনি ছিলেন আবিসিনিয়া হিজরতকারী ও পরে মৃত সাহাবী সুকরানের বিধবা স্ত্রী সাদিয়া বিনতে যামআ রা.।

নবুয়তের ১৩ বছরে তিনি মদীনায় হিজরত করেন। হিজরতের ২ বছর আগে অর্থাৎ ৫১ বছর বয়সে যাকে বিবাহ করেন তিনি ছিলেন হযরত আবু বকর সিদ্দিক রা. এর ছয় বছর বয়েসী কন্যা হযরত আয়েশা রা.। বিয়ে হলেও স্ত্রী হিসেবে তাকে ঘরে তোলেন তিন বছর পরে, তখন আয়েশা রা. এর বয়স হয়েছিল ৯ বছর।

চার বছরের ব্যবধানে আটজন স্ত্রী গ্রহণ:
হিজরতের ৩ থেকে ৭ বছরে নবীজি আরবের বিভিন্ন গোত্রের বিদুষী রমনী, যুদ্ধে শহীদ বা এমনিতে মারা যাওয়া সাহাবীর বিধবা স্ত্রীকে। এই সংখ্যা ছিল ৮জন। এসব বিবাহের পেছনে উদ্দেশ্য ছিল যুদ্ধ এড়ানো, গোত্রীয় সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা ও অসহায় নারীকে আশ্রয় দান। ইতিহাস বলে ৮ম হিজরীতে মক্কা বিজয়ের পর যখন পরিস্থিতি ইসলামের অনুকুলে এসে যায় তখন থেকে ওফাতের পূর্ব পর্যন্ত নবীজি আর কোনো নারীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন নি। কাজেই যে মহাপুরুষ যৌবনের শুরু থেকে ৫৫ বছর বয়স পর্যন্ত একজন মাত্র স্ত্রীকে নিয়ে ঘর সংসার করলেন, পরে যাদের বিয়ে করলেন, একজন বাদে তাদের সবাই ছিল বিধবা এবং জীবনের শেষ তিন বছর আর কোনো নারীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেন না, যারা তার চরিত্র হনন করার  দুঃসাহস দেখায় তারা আল্লাহর দুনিয়ায় সবচে বড় পাপিষ্ঠ।

ইতিহাসের সাক্ষ্য অনুযায়ী নবীজির বহুবিবাহের মূল কারণ ছিল মানব জাতির অর্ধেক নারী সমাজে ইসলামের বিস্তার ও ইসলামী জীবন প্রণালী শিক্ষা দান। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এসেছিলেন গোটা মানব জাতির জন্য। কিন্তু মানব জাতির অর্ধেক তো নারী সমাজ। কিন্তু নিজে পুরুষ হওয়ার কারণে নারীদের একান্ত বিষয়াদি সরাসরি শিক্ষা দেয়া তার পক্ষে অসম্ভব ছিল, ফলে তার সতীসাধ্বী বিবিগণের মাধ্যমে শিক্ষা দিয়েছেন। এই শিক্ষা দানের ক্ষেত্রে আমাদের প্রত্যেক মায়ের নিজস্ব গৌরবময় ভূমিকা ছিল। তবে যাদের অবদান ইসলামের ইতিহাসকে অধিক আলোকিত করেছে তারা হলেন হযরত আয়েশা রা. ও হযরত উম্মে সালামা রা.।

হযরত আয়েশা রা. এর অনন্য সাধারণ ব্যক্তিত্ব:
আমাদের মা হযরত আয়েশা রা. কে নবীজি আদর করে ডাকতেন হুমায়রা। তবে আসল নাম আয়েশা। সিদ্দিকা ছিল তার উপাধি। এই উপাধি পিতা আবু বকর আতীক ইবনে আবি কুহাফা সূত্রে প্রাপ্ত। তার উপাধি ছিল সিদ্দিক (পরম সত্যবাদী)। তিনি ইসলামের প্রথম খালিফা ও পয়গাম্বর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পর সর্বাধিক সম্মানের পাত্র। হযরত আয়েশা রা. এর বয়স যখন ৬ বছর, তখন হিজরতের দুই বছর পূর্বে রাসূলে আকরম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সঙ্গে তাকে বিয়ে দেন আবু বকর সিদ্দিক রা.। দ্বিতীয় হিজরীতে তিনি হযরত সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সংসারে গমন করেন। তখন তার বয়স হয়েছিল ৯ বছর। তিনি ছিলেন অন্যান্য বিবিগণের মাঝে সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে সর্বাদিক প্রিয়। এ কারণে পালাক্রমে যেদিন হযরত সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার ঘরে থাকতেন, সেদিন সাহাবায়ে কেরাম হযরতের কাছে হাদিয়া উপহার বেশি পাঠাতেন। হযরত সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আয়েশার ঘরে ও তাঁর কোলে ওফাত লাভ করেন। সেই ঘরেই তিনি সমাহিত হন। সে ঘরই এখন রওযা আকদাস হিসেবে দুনিয়ার মুসলমানদের কাছে সবচে প্রিয় স্থান।

হযরত আয়েশা রা. ছিলেন নবীজির প্রাণের সান্তনা:
হযরত আয়েশা রা. সূত্রে হাদীসের জ্ঞান ছাড়াও মহিলা সংক্রান্ত শরীয়তের অনেক বিধান লাভ করে মুসলিম উম্মাহ। তবে সবচে বড় অবদান ছিল তিনি ছিলেন নবীজির মনের সান্ত¦না। কোনো ব্যস্ততা বা আধ্যাত্মিক ভাবের তন্ময়তায় যখন নবীজির মন ভারি হয়ে যেত তখন মনের সান্ত¡নার খুঁজে হযরত আয়েশাকে ডেকে বলতেন: কাল্লিমীনী ইয়া হুমাইরা। ‘হে হুমায়রা তুমি আমার সাথে কথা বল, আমার মন হলকা কর।’ নবুয়তের দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে একজন মহিলার এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার দৃষ্টান্ত আর কি হতে পারে? বর্ণিত আছে, নবীজি যখন একই বিছানায় একই চাদরের নিচে হযরত আয়েশার ঘরে বিশ্রাম নিতেন তখনও তার উপর ওহী নাযিল হত।

হযরত আয়েশা রা. এর ব্যক্তিত্ব ও অবদান:
হযরত আয়েশা রা. এর প্রচুর কবিতা মুখস্থ ছিল। অর্থাৎ সাহিত্য চর্চায় তিনি অগ্রণি ছিলেন। এছাড়া তিনি রোগীদের চিকিৎসা করতেন। মানুষ চিনতে তার মেধা ও প্রজ্ঞা ছিল অত্যন্ত প্রখর। তিনি ইসলামের প্রথম শ্রেণীর আলেম ও ফকীহ ছিলেন। সাহাবীদের মধ্যে যে ৭ জন ফিকাহশাস্ত্রে শিরোমণি ছিলেন, হযরত আয়েশা রা. তাদের অন্যতম। সেই ৭ জন ছিলেন হযরত উমর রা., হযরত আলী রা, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মসউদ রা., হযরত আয়েশা রা. হযরত যায়দ ইবনে সাবেত রা., হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. ও হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা.। বাকী ১৩৩ বা ১৩৯ জন ফকীহ সাহাবীর অবস্থান এই ৭ জনের পরে। হযরত আয়েশা রা. হতে ২ হাজার ২শ ১০ টি হাদীস বর্ণিত। হযরতের জীবদ্দশায় ও ওফাতের পরে নানা ঘটনা প্রবাহে হযরত আয়েশা রা. মূখ্য ভূমিকা পালন করেন। হযরত ওসমান রা. এর খেলাফতের শেষদিকে উটের যুদ্ধে তিনি অগ্রণি ভূমিকা পালন করেন। কিন্তু তার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। এ নিয়ে তিনি মৃত্যু পর্যন্ত মনস্তাপে ভুগেছেন। তিনি ৫৭ বা ৫৮ হিজরীতে ওফাত লাভ করেন এবং মদীনার কবরস্থান বাকীতে সমাহিত হন।

হুদায়বিয়ার সন্ধি : মুসলমানদের অগ্নিপরীক্ষা:
উম্মহাতুল মুমেনীনদের মধ্যে হযরত উম্মে সালমা রা. জাতীয় জীবনের জটিল সমস্যা সমাধানে যে ভূমিকা পালন করেছিলেন তার কারণে তাকে ইসলামে রাষ্ট্রপ্রধানের উপদেষ্টার মর্যাদায় স্মরণ করা হয়। নবীজি মক্কা অভিযানের উদ্দেশ্যে ১৪০০ সাহাবীর বিরাট বাহিনী নিয়ে মদীনা থেকে মক্কার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিলেন। হুদায়বিয়া নামক স্থানে পৌঁছে তিনি জানতে পারেন কুরাইশরা তাকে মক্কা প্রবেশ ও উমরা পালন করতে দেবে না। তিনি আলোচনার জন্য মক্কার ধনাঢ্য ব্যক্তি হযরত উসমানকে পাঠান। ঘটনা প্রবাহের মধ্য দিয়ে কুরাইশদের সাথে শান্তিচুক্তি হয়। কিন্তু বাহ্যত এই চুক্তি ছিল মহানবী ও মুসলমানদের জন্য অবমাননাকর। শান্তির স্বার্থে ও ভবিষ্যতের বৃহত্তর সুফলের আশা নিয়ে নবীজি এই চুক্তি স্বাক্ষর করেন। চুক্তির শর্ত ও চুক্তি স্বাক্ষরকালে মক্কার মুশরিকদের ঔদ্ধত্বপূর্ণ আচরণে মুসলমানরা ভীষণ ক্ষিপ্ত ছিল। বিপুল সংখ্যক জানবাজ যোদ্ধা সঙ্গে থাকা সত্ত্বেও মহানবীর পক্ষ হতে মুশরিকদের অযৌক্তি সব শর্ত মেনে নেয়াকে সহজভাবে মেনে নিতে পারছিল না, হযরত উমর রা. এর মত বিশাল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন সাহাবীও। শেষ পর্যন্ত চুক্তি স্বাক্ষর হল। শর্ত অনুযায়ী মুসলমানরা উমরা পালন না করেই ফেরত যাবে। মক্কার হেরেমে কুরবানীর জন্য যেসব পশু তারা সাথে এনেছিল সেগুলো হুদায়বিয়াতেই যবাই করতে হবে। এখানেই উমরার ইহরাম খুলতে হবে।

রাষ্ট্রপ্রধানের উপদেষ্টার মর্যাদায় হযরত উম্মে সালামা রা.
নবীজি সাহাবীদের উদ্দেশ্যে ঘোষণা দিলেন, তোমরা কুরবানীর পশু জবাই কর। মাথার চুল ছেঁটে ফেল। ইহরাম খুলে স্বাভাবিক হয়ে যাও। কিন্তু আশ্চর্য যে, যারা নিজের জান বাজি রেখে হযরতের নির্দেশে প্রাণ দিতে হুদাইবিয়া প্রান্তর পর্যন্ত এসেছেন, তারা এখন হযরতের আদেশ পালনে তৎপর হচ্ছেন না। নবীজি তার আদেশটি তিনবার ঘোষণা করলেন। কিন্তু কেউ আদেশ পালনে অগ্রসর হয় না। এ অবস্থা দেখে নবীজি চিন্তিত মনে তাঁবুতে ঢুকে উম্মে সালামাকে লোকদের অবস্থার কথা জানালেন। নেতৃত্বের আনুগত্য ও প্রশাসনিক দৃষ্টিকোণ থেকে এর চেয়ে গভীর ও জটিল সংকট আর কিছু হতে পারে না। এই সংকট সমাধানে প্রচ- আত্মবিশ^াস নিয়ে এগিয়ে এলেন নবীজির যোগ্য সহধর্মীনী আমাদের মা উম্মে সালামা। তিনি বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি কি চান যে তারা আপনার আদেশ পালন করুক। তাহলে আপনি তাদের কারো সাথে একটি কথাও বলবেন না। শুধু সবার সামনে গিয়ে আপনার উটনীটি নহর (জবাই) করুন। তারপর আপনার নাপিতকে ডেকে আপনার মাথা মু-ানোর ব্যবস্থা করুন। এই পরামর্শ পেয়ে নবীজি তাঁবু হতে বের হলেন এবং কারো সাথে কোনো কথা না বলে নিজের উটনী নহর করলেন। তারপর নাপিত ডেকে মাথা মু-ন করলেন। লোকেরা যখন এই দৃশ্য দেখল, সবাই তাদের কুরবানীর পশু নহর করল। একজন আরেকজনের মাথা মু-ন শুরু করল। এতক্ষণ তারা ভাবছিল যে, মুশরিকদের সাথে দৃশ্যত অবমাননাকর চুক্তি হয়ত পুনর্বিবেচনা হবে, পশু জবাই ও মাথা মু-নের জন্য নবীজির আদেশ পালনে তাই তারা ইতস্তত করছিল। কিন্তু যখন প্রমাণ হল যে, নবীজি তাঁর সিদ্ধান্ত ও আদেশের ব্যাপারে অবিচল তখন তারা সেই আদেশ পালনে হুমড়ি খেয়ে পড়লেন। বস্তুত জাতীয় জীবনের সমস্যা সমাধানে হযরত উম্মে সালমার এই বিচক্ষণতা ও ভূমিকা মুসলিম মহিলাদের জন্য সামাজ ও জাতীয় জীবনের সমস্যা সমাধানে অবদান রাখতে আলোকবর্তিকা হিসেবে কাজ করছে।

হাবশায় হিজরতে মহিলাদের ভূমিকা:
এ পর্যন্ত আমরা তিনজন উম্মুল মুমিনীনের ভূমিকার উপর সংক্ষেপে আলোকপাত করেছি। এর বাইরে সাধারণ মুসলিম মহিলারাও দ্বীনী দায়িত্ব পালনে যে ভূমিকা পালন করেছেন তা অনেক বিস্তৃত ও গৌরবজনক। নবুয়াতের ৫ম বর্ষে মক্কায় যখন মুশরিকদের আত্যাচার নির্যাতন চরম আকার ধারণ করেছিল তখন নবীজির আদেশে দুই দফায় মুসলমানরা হাবশায় হিজরত করেন। দেখা যায় দেশত্যাগের কঠিন কষ্ট যারা মাথায় নিয়েছিলেন তাদের মধ্যে বিশ জনের মত ছিলেন মহিলা। ইসলামের জন্যে প্রথম যুগের মুসলিম মহিলাদের এই আত্মত্যাগ প্রমাণ করে যে কোনো পরিস্থিতিতে ইসলামের জন্য ত্যাগ স্বীকার করতে মুসলিম মহিলারা পিছপা হন নি।

মক্কায় মজলুম পাঁচ কৃতদাসী:
আবু বকর সিদ্দিক রা. মক্কায় যারা আল্লাহর পথে আসার কারণে নির্যাতিত হচ্ছিল তাদের মধ্যে সাতজন পুরুষ ও পাঁচজন মহিলাকে মুক্তি দান করেন। পুরুষদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন বেলাল ইবনে রেবাহ ও আমের ইবনে ফাহির, যাকে গারে সৌরে আত্মগোপন অবস্থায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গুহায় আসা যাওয়ার ব্যাপারে নিজের জন্য নিরাপদ মনে করেছিলেন। তিনি মদীনায় হিজরত করেন এবং বী’রে মাউনার হত্যাকা-ের সময় তিনি শাহাদত বরণ করেন। পাঁচজন মহিলার মধ্যে ছিলেন হযরত নাহদিয়া ও তাঁর মেয়ে, উম্মে উমাইস ও বনি আমর ইবনে মুআম্মাল এর দাসী ও যুনাইরা। বর্ণিত আছে, যুনাইরা ছিলেন দুর্বল দৃষ্টিশক্তির একজন মহিলা। তিনি ইসলাম গ্রহণের পর শায়বা ইবনে রাবিয়া, উতবা ইবনে রাবিআ ও উমাইয়া ইবনে খালাফ প্রমূখ কুরাইশ নেতা দলবলসহ তাকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করত। তাকে বসিয়ে নানা কথা বলে হাসাহাসি করত। তারা বলত যে, আল্লাহর কসম, মুহাম্মদ যে ধর্ম নিয়ে এসেছে তা যদি ভাল হত তাহলে যুনাইরা আমাদের পেছনে ফেলে সেদিকে যেতে পারত না। এ মর্মে কুরআনের একটি আয়াত নাযিল হয়। এক সময় যুনাইরার দৃষ্টিশক্তি সম্পূর্ণ চলে গেল। তখন কুরাইশের নেতারা বলতে লাগল, তুমি লাত ও ওজ্জার ধর্মের বিরোধীতা করেছ; এ জন্যে লাত ও ওজ্জা তোমার দৃষ্টিশক্তি কেড়ে নিয়েছে। যুনাইরা তাদের জবাবে বলতেন, না, আল্লাহর কসম, তারা আমার কোনো ক্ষতি করে নি এবং আমার কোনো ক্ষতি করার শক্তি ওদের নাই। পরবর্র্তীতে আল্লাহ তাআলা তার দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন।

প্রথম মহিলা শহীদ সুমাইয়া রা.:
ইসলামের জন্য পুরুষদের পাশাপশি মহিলাদের আত্মত্যাগের কাহিনী বড়ই করুণ। হযরত সুমাইয়া রা. ছিলেন আবু হুযাইফার বাঁদী। ইয়াসের তাঁর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের ঘর আলোকিত করে আম্মার নামক ছেলে সন্তান। আম্মার রাসূলুল্লাহর আহ্বানে সাড়া দিয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। তাঁর দাওয়াত পেয়ে তাঁর পিতা ইয়াসের এবং পরে মা সুমাইয়া ইসলামের ছায়ায় আশ্রয় নেন। অত্যন্ত করুণ ও কঠিন অবস্থায় এই পরিবার নবীজির প্রতি ঈমান আনয়ন করে। মুশরিকরা এই দুর্বল পরিবারটির উপর তাদের নৃশংসতার মাত্রা পরীক্ষা করে। মুশরিকরা ইয়াসির পরিবারের উপর চরম নির্যাতন চালিয়ে অন্যদের কাছে এই বার্তা দিতে চেয়েছিল যে, মুহাম্মদের ধর্ম গ্রহণ করলে এ রকম মাসুল গুণতে হবে। সুমাইয়ার উপর তারা যে নির্যাতন চালায় তা ছিল লোমহর্ষক, অবর্ণনীয়। বলা হয়েছে, সুমাইয়ার দুই পা দুই উটের সাথে বেঁধে উট দুটিকে বিপরীত দিকে ধাবড়ানো হয়। আরো বর্ণিত আছে, মুশরিকরা হযরত সুমাইয়ার লজ্জাস্থানে বর্শা ঢুকিয়ে তাকে শহীদ করেছিল। ইসলামের প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় মহিলাদের এই ত্যাগ ও ভূমিকা আজকের বিশে^র মুসলিম মহিলাদের জন্য গৌরবের।

হযরত উমর রা. এর খুতবার প্রতিবাদ করলেন নারী:
নারী পুরুষের সম্মিলিত প্রয়াসে ইসলাম দেশে দেশে বিজয় ও বিস্তার লাভ করেছে। ইসলামের স্বর্ণালী যুগে কখনো মহিলাদেরকে অন্তপুরের অবরোধবাসীনী হয়ে নির্বিকার করে রাখা হয় নি। সমাজ জীবনে তাদের সক্রিয় ভূমিকার একটি উদাহরণ হযরত উমর রা. এর খেলাফতকালের একটি ঘটনা। হযরত উমর রা. মসজিদে খুতবা দিচ্ছিলেন। মহিলাদের নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করছিলেন। সামাজিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য বিয়েকে সহজ করার পরামর্শ দিচ্ছিলেন। বলছিলেন যে, বিয়েকে সহজ করতে হলে বিরাট অঙ্কের মোহরানার প্রবণতা ছাড়তে হবে। জুমার নামাযে উপস্থিত একজন মহিলা দাঁড়িয়ে গেলেন। খলিফার বক্তৃতার প্রতিবাদ করে বললেন, কুরআন মাজিদে আল্লাহ তাআলা মহিলাদেরকে বিরাট অঙ্কের মোহরানার ব্যবস্থা রেখেছেন। কাজেই আল্লাহ যেখানে আমাদেরকে বিরাট অঙ্কের মোহরানা দেয়ার কথা বলেছেন সেখানে তা কেড়ে নেয়ার আপনি কে? চিন্তা করা যায়, ভরা মসজিদে খলিফার ভাষণের সরাসরি প্রতিবাদ করছেন একজন মহিলা। বিশেষজ্ঞগণ এই ঘটনাকে মুসলিম মহিলাদের পার্লামেন্ট সদস্য হওয়ার পক্ষে দলীল হিসেবে উপস্থাপন করেন। সমাজের বৃহত্তর আঙ্গিনায়, জাতীয় জীবনে, সাহিত্য সংস্কৃতিতে, শিক্ষা ও চিকিৎসায় এমনকি যুদ্ধের ময়দানে মুসলিম মহিলাদের অবদান ইতিহাসের পাতায় চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছে।

আধ্যাত্মিক অঙ্গনে নারী:
আমরা এখানে আধ্যাত্মিক অঙ্গনে মহিলাদের অবদানের ব্যাপারে আলোকপাত করতে চাই। ইসলামের ইতিহাসে আধ্যাত্মিক সাধনায় শিরোমণি একজন মহিলার নাম সবাই জানি। তিনি হলেন রাবেয়া আদবিয়া। হিজরী প্রথম শতকে তিনি সওয়াবের আশায় বা আযাবের ভয়ে নয়, আল্লাহর মহব্বতে ইবাদত বন্দেগী করার দর্শন প্রচার করেন।

মাওলানা আব্দুর রহমান জামী রহ. ইসলামের ইতিহাসের প্রাতঃস্মরণীয় একজন মনিষী। তার রচিত শরহে জামী আরবি ব্যাকরণের অনবদ্য গ্রন্থ। তিনি শেখ ফরিদ উদ্দীন আত্তার রহ. এর তাযকিরাতুল আউলিয়ার আদলে একটি আউলিয়া জীবনী গ্রন্থ রচনা করেছেন নাম নাফাহাতুল উন্স। এই কিতাবের শেষ ভাগ তিনি বরাদ্দ করেছেন আধ্যাত্মিক জগতের বরেণ্য সাধক রমনীদের বিষয়ে।

বইয়ের ৭১৬ পৃষ্ঠা হতে শুরু হয়েছে পুরুষ সাধকদের মর্যাদায় উন্নীত আধ্যাত্মিক মহিলা সাধকদের জীবন চরিত আলোচনা। সেই আলোচনা শেষ হয়েছে গ্রন্থের শেষভাগে ৫৭৮ পৃষ্ঠায়। মোট ৩৩ জন মহিলা সাধকের জীবন চরিত তিনি আলোচনা করেছেন তন্মধ্যে প্রথমজন রাবেয়া আদবিয়া বা রাবেয়া বসরী রহ. আর যার জীবন চরিত নিয়ে গ্রন্থের যবনিকাপাত করেছেন তিনি হলেন ইমরাআত ফারসিয়া র। মওলানা জামীর এই বর্ণনা প্রমাণ করে আল্লাহর প্রেমের আধ্যাত্মিক সাধনায় মহিলারা কত অগ্রণী ছিলেন এবং মানব সভ্যতার নির্মাণ ও পরিচর্যায় তাদের অবদান কতখানি সুদূর প্রসারী।

মা হাজেরার অনুকরণের উপর ইসলামের ভিত নির্মিত:
শুনে প্রথমে অবাক হবেন যে, ইসলামের যে বিশ্বজনীন ব্যবস্থা তার ভিত নির্মিত হয়েছে একজন মহিলার অবদানের উপর। ইতিহাস বলে, হযরত ইবরাহীম আ. দ্বিতীয় স্ত্রী হযরত হাজেরা আ. কে কোলের শিশু ইসমাঈলসহ রেখে এসেছিলেন জনমানবহীন মক্কার মরুপ্রান্তরে। ইব্রাহীম আ. বাস করতেন বর্তমান ফিলিস্তিনে। সেখান থেকে গিয়ে তিনি শিশু ইসমাইলকে মায়ের কোলে রেখে আসেন ঠিক সেই জায়গায়, যেখানে বর্তমানে কাবাঘর ও হেরেম শরীফ প্রতিষ্ঠিত। জনমানবহীন খাদ্য ও পানীয় শুন্য একটি মরুভূমিতে স্ত্রী ও দুগ্ধপোষ্য সন্তানকে রেখে আসা ইব্রাহীমের জন্য যতখানি অসহনীয় ছিল তার চেয়েও বিস্ময়কর ছিল হযরত হাজেরার এমন নির্বাসিত জীবন মেনে নেয়া। অথচ আল্লাহর আদেশ বলে তারা হাসিমুখে বরণ করে নেন যাবতীয় মানসিক ও দৈহিক কষ্ট। ইবরাহীম আ. এর প্রত্যয় ছিল যেহেতু এই কাজ আল্লাহর হুকুমে আঞ্জাম দিয়েছি বাকিটুকু তিনি দেখবেন।

একটি থলিতে রাখা খেজুর ও মশকের পানি ফুরিয়ে গেলে কোলের যাদুর প্রাণ নাশের আশংকায় হযরত হাজেরা অস্থির হয়ে যান। পানির সন্ধান পাবেন আশায় একবার সাফা পাহাড়ের উপর উঠেন, আবার মারওয়া পাহাড়ের দিকে দৌঁড়ে যান। মনে হয় পানি সাফা পাহাড়ের উপর টলমল করছে। আবার দৌঁড়ে সাফা পাহাড়ে গিয়ে নিরাশ হন। মনে হচ্ছে পানি মারওয়া পাহাড়ে ঝিলমিল করছে। আসলে মরুভূমির প্রখর রোদে মরিচিকার মায়াজালকে পানির অথৈ তরঙ্গ বলে ভ্রম হচ্ছিল। এভাবে হাজেরা আ. সাত বার দুই পাহাড়ের মাঝখানে দৌঁড়ান।

শেষবারে লক্ষ করেন, শিশুকে যেখানে রেখে পানির জন্য ছুটাছুটি করছেন সেখানে ইসমাঈলের পায়ের নিচ থেকে পানির ঝর্ণা উৎসারিত হচ্ছে। হাজেরা তাড়াতাড়ি সেই ঝর্ণার চারপাশে আল তুলে দেন। এই ঝর্ণাই বর্তমান যমযম কূপ। সেই কূপকে কেন্দ্র করে মক্কায় জুরহুম সম্প্রদায়ের বসতি গড়ে উঠে। কাবাঘর নির্মিত হয়। হজের প্রবর্তন হয়। তখন থেকে যত নবী রাসূল দুনিয়াতে এসেছেন, যত আলেম ওলী এসেছেন, কিয়ামত পর্যন্ত আসবেন, প্রতি বছর লাখ লাখ হাজি হজ করেন, সারা বছর ওমরা করেন, তাদের সবাইকে মহিয়সী নারী বিবি হাজেরার অনুকরণ করতে হয়। তিনি যেভাবে দৌঁড়িয়েছেন সেভাবে সাফা মারওয়ায় সায়ী করতে হয়। তারপর মা হাজেরার স্মৃতিধন্য যমযমের পানি পান করে আমরা প্রাণ জুড়াই। ইসলামের প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় নারীদের ভূমিকার এর চেয়ে বড় উদাহরণ আর কী হতে পারে? আর নারীর প্রতি ইসলাম যে সম্মান দিয়েছে তা কি মানুষের কল্পনায় আসতে পারে?


লেখক: ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী
সাবেক শিক্ষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, কলামিস্ট, বহুগ্রন্থ প্রণেতা।

মিসওয়াকের ফজিলত, গুরুত্ব ও পদ্ধতি

আল্লাহ তায়ালা মানব জাতীকে সৃষ্টি করেছেন তারই ইবাদত করার জন্য। এবং তা হতে হতে হবে রাসূল সাঃ এর তরীকায় । তাই মানুষের প্রতিটি কাজে রয়েছে সুন্নাতে নববির দিক নির্দেশনা। এক জন মুসলিম তার প্রতিটা কাজে রাসূল সাঃ এর সুন্নাত অনুযায়ী আমল করে থাকে। রাসূল সাঃ এর সুন্নাত হলো অগনিত।
ঠিক মিসওয়াক করাও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের গুরুত্বপূর্ণ একটি সুন্নাত। মিসওয়াক করার মাঝে রয়েছে ইহ ও পরকালীন কল্যাণ ও উপকারিতা। আসুন আজ আমরা মিসওয়াকের গুরুত্ব, ফজিলত ও পদ্ধতি সম্পের্কে জেনে নেব।

মিসওয়াক কি?
মিনওয়াক হলো গাছের ডাল বা শিকড়। যা দিয়ে দাঁত মাজা ও পরিষ্কার করা হয়। দাঁত মাজাকেও মিসওয়াক বলা হয়।

মিসওয়াকের গুরুত্ব!!
মেসওয়াকের মাধ্যমে দাঁত পরিস্কার করা আল্লাহ তাআলার নিকট অত্যান্ত পছন্দনীয় কাজ। তাই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি বিশেষ যত্নবান ছিলেন এবং উম্মতকে অনেক তাকিদ দিয়েছেন। এ প্রসংগে হযরত আবু উমামা (রা) কর্তৃক বর্ণিত হাদীসটি সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।
তিনি বলেনঃ
عن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال: ما جاءني جبريل قط إلا أمرني بالسواك حتى لقد خشيت أن أحفي مقدم فمي
অর্থ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, এমনটি কখনো হয়নি যে, জিবরাইল (আ) আমার নিকট এসেছেন আর আমাকে মেসওয়াকের আদেশ দেননি। এতে আমার আশংকা হচ্ছিল যে, (মেসওয়াকের কারণে) আমার মুখের অগ্রভাগ ছিলে না ফেলি।
(আল মুযামুল কাবীর লিত তবারানী, হাদীস নং৭৮৪৭, মুসনাদে আহমদ, হাদীস নং ২২২৬৯)

অন্য হাদিসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
لولا أن أشق على أمتي أو على الناس لأمرتهم بالسواك مع كل صلاة
অর্থ, আমি যদি উম্মতের উপর (কষ্ট হবার) আশংকা না করতাম তাহলে প্রত্যেক নামাজেই মেসওয়াক করার আদেশ দিতাম।
(বুখারী শরীফ, হাদীস নং৮৮৭, মুসলিম শরীফ, হাদীস নং২৫২)

মিসওয়াক করার ফজিলত!!

মিসওয়াকের বহু ফজিলত হাদীসে বর্ণিত আছে। এব্যপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
السواك مطهرة للفم مرضاة للرب
অর্থ, মেসওয়াক মুখের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার মাধ্যম ও আল্লাহর সন্তুষ্টির উপায়
(নাসায়ী শরীফ, হাদীস নং ৫)

অন্য এক হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: «فضل الصلاة التي يستاك لها على الصلاة التي لا يستاك لها سبعين ضعفا» تفرد به يحيى بن معاوية بن يحيى الصدفي ويقال إن ابن إسحاق أخذه منه
অর্থ, মেসওয়াক করে যে নামাজ আদায় করা হয়, সে নামাজে মেসওয়াকবিহীন নামাজের তুলনায় সত্তরগুন বেশী ফযীলত রয়েছে।
(শুয়াবুল ঈমান, বাইহাকী, হাদীস নং ২৫১৯)

এছাড়া আরো বহু উপকার রয়েছে।

ইহকালীন উপকার!!!

১) মিসওয়াক করার মধ্যমে আল্লাহর রিজামন্দি হাসিল হয়।
২) দারিদ্র্যতা দূর হয়ে।
৩) সচ্ছলতা আসে এবং উপার্জন বাড়ে।
৪) পাকস্থলী ঠিক থাকে।
৫) শরীর শক্তিশালী হয়।
৬) স্মরণশক্তি ও জ্ঞান বাড়ে।
৭) অন্তর পবিত্র হয়।

৮) সৌন্দর্য বাড়ে।
৯) ফিরিশতা তার সঙ্গে মুসাফাহা করেন।
১০) নামাজে বের হলে সম্মান করেন, নামাজ আদায় করে বের হলে আরশ বহনকারী ফিরিশতারা তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন।
১১) শয়তান অসন্তুষ্ট হয়।
১২) ফুলসিরাত বিজলীর ন্যায় দ্রুত পার হবেন
১৩) ডান হাতে আমলনামা পাবে।
১৪) ইবাদতে শক্তি পাবে।
১৫) মৃত্যুর সময় কালিমা নসিব হবে।
১৬) জান্নাতের দরজা খুলে দেয়া হবে।
১৭) জাহান্নামের দরজা বন্ধ করা দেয়া হবে।
১৮) পূত-পবিত্র হয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় নিবে।
১৯) দাঁতের মাড়ি শক্ত হয়।
২০) মুখের দুরগন্ধ দূর হয় ইত্যাদি।

মিসওয়াক করার পদ্ধতি!

রাসূল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যাইতুন ও খেজুর গাছের ডাল দিয়ে মেসওয়াক করেছেন। তাই এই দুটো হলে উত্তম।  এছাড়া তিক্তস্বাধ যুক্ত গাছের ডাল হলেও ভাল। মেসওয়াক কাচা ও নরম গাছের ডাল হওয়া উচিত, এতে মেসওয়াকে বাড়তি ফায়দা হাসিল হয়।

মেসওয়াক নিজ হাতের আঙ্গুলের মত মোটা ও এক বিঘত পরিমাণ লম্বা হওয়া উচিত। এতে মেসওয়াক করতে যেমন সুবিধা হবে তেমনি বেশী ফায়দাও পাওয়া যাবে।

অধিকাংশ উলামায়ে কেরামের মতে উযুতে হাত ধোয়ার পর কুলি করার পূর্বে মেসওয়াক করা উত্তম। তবে কোন কোন আলিম উযুর পূর্বে মেসওয়াক করার কথাও বলেছে। উযুর সময় ছাড়াও যে কোন সময় মেসওয়াক করা যাবে।

মেসওয়াক ধরার পদ্ধতি হল, ডান হাতের কনিষ্ঠাঙ্গুলি মেসওয়াকের নিচে থাকবে। মধ্যমা ও তর্জনী উপরে ও বৃদ্ধাঙ্গুলি নিচে রেখে মেসওয়াক ধরা। এতে করে মুখের ভিতর ভালভাবে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে মেসওয়াক করা যায়। এপদ্ধতিটি হযরত ইবনে মাসউদ রাযি থেকে বর্ণিত আছে।

মেসওয়াক করার মাসনূন পদ্ধতি হল, মুখের ডান দিক থেকে শুরু করা এবং উপর থেকে নিচে মেসওয়াক করা। আড়াআড়ি ভাবে না করা। মেসওয়াক করার সময় দাঁতের ভিতর বাহির সহ মেসওয়াক করা এবং জিহবাও গোড়া পর্যন্ত মেসওয়াক করা।

মেসওয়াসের মাঝে দুটি বিষয় সুন্নত, এক. মুখ পরিষ্কার করা। দুই. গাছের ডাল হওয়া। তাই গাছের ডাল ছাড়া অন্য কিছুর মাধ্যমে দাঁত মাজলে একটি সুন্নত আদায় হবে। অপরটি হবেনা। সুতরাং মেসওয়াক না থাকলে আঙ্গুল ও শুকনো কাপড় দ্বারাও মেসওয়াক করা যেতে পারে। ব্রাশের মাধ্যমেও দাঁত মাজা যেতে পারে।

ঘুম থেকে জাগ্রত হওয়ার পর ও ঘুমানোর পূর্বে, নামাজের আগে, মজলিসে উপস্থিত হবার পূর্বে, কুরআন ও হাদীস পাঠের পূর্বে, খাওয়ার পর মেসওয়াক করা মুস্তাহাব

আল্লাহ আমাদের মেসওয়াকের গুরুত্ব অনুধাবন করে এর উপর আমল গড়ার তাউফিক দান করুন।
আমীন ।


শায়েখ মাওলানা মুহাম্মদ জাহেদুল ইসলাম
সিনিয়র শিক্ষক জামিয়াতুল উলূম আল ইসলামিয়া মাদ্রাসা। পূর্ব মায়ানী, মিরসরাই , চট্টগ্রাম

নবীজির সমাজে নারী -পুরুষ সম্পর্ক

অনেককেই আফসোস করতে দেখা যায় যে আমরা আর রাসূল (সা) -এর সাহাবিদের মতো নই; তাদের সময় ও পরিস্থিতি ছিল ভিন্ন। আমরা কখনোই যেন তাদের মতো হতে পারব না। এই ধারণাটি সেসব সময়েই বেশি টেনে আনা হয় যখন মুসলিম যুবক-যুবতীদের সাপেক্ষে নারী-পুরুষের সম্পর্কের বিষয়টি আলোচনা করা হয়। বলা হয় সেই মহান প্রজন্ম থেকে আজকের প্রজন্ম কতটা দূরে!

কিন্তু যে ধারণাটি আমাদের মধ্যে অধিক প্রচলিত, প্রকৃত সত্য তার বিপরীত। নবীজি (সা)-এর সমাজের তরুণ-তরুণীদেরও তাদের কামনার সঙ্গে লড়তে হয়েছে। তাঁরাও হোঁচট খেয়েছিলেন, তাঁদেরও ভুল হয়েছিল। তাঁদের পরিবেশ-পরিস্থিতির ভেতর দিয়েই নবী (সা) তাঁদেরকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন, শিখিয়েছেন আর সাহায্য করেছেন মহৎ মানুষে পরিণত হতে।

তো আসুন আমরা দেখি নবীজি (সা) কীভাবে তাঁর সমাজে নারী-পুরুষ সম্পর্কের বিষয়টি মোকাবিলা করেছিলেন। এতে করে আমরা আজকের দিনে অনুসরণের জন্য সেখান থেকে কিছু শিখতে পারব।

ইবন ‘আব্বাস (রা) বলেছেন, “সবচেয়ে সুন্দরী নারীদের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর এক নারী রাসূল (সা)-এর পেছনে নামাজ আদায় করতেন। কিছু কিছু লোক প্রথম কাতারে নামাজ আদায় করতেন যাতে সেই নারীকে তাদের দেখতে না-হয়। অন্যদিকে কিছু লোক পুরুষদের শেষ কাতারে নামাজ আদায় করতেন, আর বগলের নিচ দিয়ে সেই নারীকে দেখতেন। তাদের এই কাজের জন্য আল্লাহ অবতীর্ণ করলেন, “আমি তোমাদের মধ্যে পূর্বে আগমনকারীদেরকেও জানি আর পরে আগমনকারীদেরকেও জানি।” [সূরা আল-হিজ্‌র, ১৫:২৪] [১]

এই হাদীস থেকে আমরা দেখি যে, নবীজি (সা)-এর শহরে বসবাসকারী এবং তাঁর মাসজিদে নামাজ আদায়কারী কিছু লোকও হোঁচট খেয়েছিলেন, তারা একজন নারীকে দেখতেন। কিন্তু তারপরও রাসূল (সা) এ ব্যাপারে কী করেছিলেন?

তিনি কি নারী ও পুরুষের মধ্যে দেওয়াল তৈরি করেছিলেন? না। নারীরা যাতে পুরুষদের প্ররোচিত করতে না-পারে সেজন্য নারীদেরকে মাসজিদে আসতে বারণ করেছিলেন? কখনো না। বরং তিনি (সা) এর উল্টোটাই করেছিলেন। আল্লাহর ঘরে যাওয়ার ক্ষেত্রে নারীদের যাতে বাধা দেওয়া না-হয় সেই আদেশই দিয়েছিলেন তিনি। [২]

নারী ও পুরুষ যেন একই সমাজের অংশ হতে পারে, একই সমাজের হয়ে একত্রে কাজ করতে পারে, পাশাপাশি অবস্থান করতে পারে সেটাই করেছিলেন তিনি। তবে একই সঙ্গে তিনি (সা) তাঁর সমাজকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন যাতে তারা তাদের কামনাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।

নিচে আমরা এমন কিছু ঘটনার বর্ণনা তুলে ধরছি যা থেকে আমরা বুঝতে পারব কীভাবে তিনি এ কাজগুলো করেছেন:

১. ‘আবদুল্লাহ ইব্‌ন ‘আব্বাস (রা) বর্ণনা করেছেন, “কুরবানির ঈদের দিনে রাসূল (সা) সঙ্গী হিসেবে তাঁর উটনীর পেছনে উঠেছিলেন আল-ফাদ্‌ল বিন ‘আব্বাস। সে ছিল খুবই সুদর্শন এক পুরুষ। রাসূল (সা) এক জায়গায় থামলেন মানুষদের বিভিন্ন প্রশ্নের সমাধান দেবার জন্য। এদিকে খাসাম গোত্রের এক সুন্দরী নারী এল আল্লাহর রাসূল (সা) এর কাছে সিদ্ধান্ত জানতে। সেই নারীর সৌন্দর্য আল-ফাদ্‌লকে এতটাই আকর্ষণ করেছিল যে, সে তার দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারছিল না। আল-ফাদ্‌ল যখন সেই নারীর দিকে তাকিয়ে ছিল, রাসূল (সা) পেছন ফিরে তা দেখলেন। তিনি তার হাত পেছন দিকে বের করে আল-ফাদ্‌লের চিবুক (থুতনি) ধরে অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিলেন যাতে সে তাকে আর দেখতে না পারে…” [৩]

খেয়াল করে দেখুন রাসূল (সা) আল-ফাদ্‌লকে কীভাবে প্রশিক্ষণ দিলেন যাতে তিনি একজন দায়িত্বশীল পুরুষে পরিণত হতে পারে। সে তার কামনাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি দেখে তিনি কিন্তু তাকে কোনো ধমক দেননি। এরচেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, তিনি কিন্তু আল-ফাদ্‌লকে এমন কোনো কথা বলেননি যে, যাতে তার মনে এই বিশ্বাস জাগে যে, সমস্যার গোড়া হচ্ছে ঐ নারীর অস্তিত্ব; আর এখানে আল-ফাদ্‌লের কোনো দায়িত্ব ছিলো না। উল্টো তিনি আলতো করে আল-ফাদ্‌লের মুখ ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন। তাকে শিখিয়েছেন যে তার কাজের জন্য তাকেই দায়িত্ব নিতে হবে।

নারীদের সাথে কীভাবে আচরণ করতে হবে তাও তিনি উম্মাহর বাকী অংশকে শিক্ষা দিলেন।

সেই নারীকে রাসূল (সা) “ফিতনা” হওয়ার কারণে কোনো অভিশাপ দেননি। তাকে এজন্য দায়ীও করেননি যে, সে আল-ফাদ্‌লকে প্ররোচিত করেছে। তিনি তাকে দূরেও সরিয়ে দেননি। বরং সে যাতে রাসূল (সা)-কে প্রশ্ন করে উত্তর জেনে নিতে পারে তার জন্য সেই কাজটিকে সহজ করে দিলেন। আবার একই সঙ্গে কেউ যেন তাকে দেখতে না পারে সে ব্যবস্থাও করে দিলেন।

এখানে আমরা এটাও দেখছি না যে, নবী কিংবা অনাত্মীয় পুরুষদের কাছে আসার সময় মুখ না ঢাকায় সেই নারীকে নবী তিরস্কার করছেন। এই বর্ণনায় আমরা এটাও দেখছি না যে, পুরুষরা নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না বলে, কিংবা তাঁর সৌন্দর্য পুরুষদের প্ররোচিত করতে পারে বলে তাকে ভবিষ্যতে পর্দার আড়াল থেকে কথা বলার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

বরং উল্টোটাই ঘটেছে এখানে। রাসূল (সা) আল-ফাদ্‌লকে তাকিয়ে থাকা অবস্থায় দেখলেন এবং তার দৃষ্টি ঐ মহিলার দিক থেকে অন্যদিকে সরিয়ে দিলেন। আল-ফাদ্‌লকে তিনি এটাই শিক্ষা দিলেন সে যেন নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে। যে নারী তার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল তাকে ধমকালেন না বরঞ্চ তিনি আল-ফাদ্‌লের ঘাড়েই এই ঘটনার দায় দিলেন।

আল-ফাদ্‌লও নবীজির কাজের বিরোধিতা করেননি। আল-ফাদ্‌ল বলেননি যে, “কিন্তু নবীজি, ঐ নারীই তো ফিতনা (প্ররোচনা)!” বা “হে আল্লাহর রাসূল, তাকে বলুন সে যেন নিজেকে ঢেকে রাখে ও আড়াল করে রাখে, যাতে অন্য পুরুষের দৃষ্টি কখনো তার উপর না পড়ে!”

আমাদের সমাজে পুরুষদের অধঃপতনের জন্য প্রায়ই নারীদের দিকে আঙুল তোলা হয়। নারীরা অন্য নারীদের অভিযোগ করে অশালীন পোশাক পরার দায়ে, অতিরিক্ত মেক-আপ করার জন্য কিংবা পুরুষদের সঙ্গে রসিয়ে কথা বলার জন্য। পুরুষরাও নারীদের ওপর একই ধরণের দোষ চাপায়। দোষটা সব সময় নারী হওয়ার ওপর এসেই দাঁড়ায়, আমরাই শেষ পর্যন্ত নারী-পুরুষ সম্পর্কের বোঝা হিসেবে হাজির হই। কিন্তু আল্লাহর রাসূল (সা) আমাদের কী শিখিয়েছেন?

নিশ্চয় আমাদের জন্য নির্দিষ্ট পোশাকের নীতিমালা ও মেলামেশার নীতিমালা রয়েছে, কিন্তু তা এখানেই শেষ নয়। উপরে আমরা যে নারীর ব্যাপারে কথা বললাম (আল্লাহ তার উপর সন্তুষ্ট থাকুন) তিনিও কিন্ত সুন্দরী ছিলেন। তা সত্ত্বেও রাসূল (সা) তাঁর সৌন্দর্যের নিন্দা করেননি। কিংবা তাঁকে প্রশ্ন করা, তাঁর সাথে কথা বলা থেকে বারণ করেননি। তাহলে আমাদের সমাজে কেন এমনটা করা হয়? আসুন শুধু নারীদের উপর দায় চাপানোর সংস্কৃতি থেকে আমরা বেরিয়ে আসি। সত্যিকার অর্থেই নবীর আদর্শ অনুসরণ করি, যেখানে প্রত্যেক নর-নারীই তার কাজের ব্যাপারে দায়িত্বশীল হবে—একে অপরকে দোষারোপ করবে না।

২. আমরা আরেকটি উদাহরণ দেখি। অন্য আরেক পুরুষ সাহাবি কেবল দেখেই ক্ষান্ত হননি। তিনি বরং এক নারীকে চুমু খেয়েছিলেন! নিচের বর্ণনা থেকে আমরা বুঝতে পারব আল্লাহ কীভাবে সেই ব্যক্তির আন্তরিক দোষ স্বীকার এবং রাসূল (সা) এর কাছ থেকে ক্ষমা ও দিকনির্দেশনা চাওয়ার ব্যাপারটিকে নির্দেশ করেছেন।

“এক লোক এক নারীকে চুমু খেয়েছিল। তো সে পরে আল্লাহর রাসূলের কাছে এসে তাঁকে ব্যাপারটা জানায়। এরপর আল্লাহ এই আয়াত অবতীর্ণ করেন, ‘নামাজ আদায় করো: দিনের দুই প্রান্তে আর রাতের কিছু সময়ে। ভালো কাজ নিঃসন্দেহে খারাপ কাজকে মুছে দেয়,’ [সূরা হুদ, ১১:১১৪] লোকটি আল্লাহর রাসূল (সা)-কে জিজ্ঞেস করলেন এটা কি কেবল তার জন্য প্রযোজ্য? আল্লাহর রাসূল জবাবে বললেন, ‘এটা আমার উম্মাহর সবার জন্যে প্রযোজ্য।’” [৪]

এই ঘটনা থেকে আমরা কী বুঝতে পারি? এই ঘটনা থেকে আমরা শিখি যে, আল্লাহ—যিনি আমাদের স্রষ্টা, আমাদের প্রিয় পালনকর্তা—আমাদের কাছে এটাই চান যে, আমরা যদি কোনো অপরাধ করেই বসি, তাহলে যেন সাথে সাথে তাঁর সঙ্গে আমরা সম্পর্ক জোরদার করি। তিনি একটি আয়াত পাঠিয়ে আমাদের এটাই বললেন যে, আমরা যদি কোন ভুল করে বসি তাহলে আমরা যেন তাঁর কাছে ফিরে যাই, আমাদের দৈনন্দিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ বজায় রাখি। দৈনন্দিন নামাজ “সকল অশ্লীলতা ও খারাপ কাজ থেকে আমাদের দূরে রাখে।” [৫] আর এই সম্পর্ক ধরে রাখলে তা লাগাতার ক্ষমার পাথেয়ও হয়ে উঠবে। [৬]

তার মানে কিন্তু আমি এটা বলছি না যে, যারা অবৈধ সম্পর্কে লিপ্ত আছে, তারা দৈহিক মিলন করে সাথে সাথে নামাজ পড়ে নেবে। এরপর আবার পুরোনো পাপে ফিরে যাবে। ঐ সাহাবি রাসূল (সা)-এর কাছে অনেক পরিতাপ ও দৃঢ় সংকল্প নিয়ে হাজির হয়েছিলেন। রাসূল (সা)-এর কাছে নিজের দোষ স্বীকার করে তিনি সমাধান খুঁজছিলেন। তবে আমরা এখান থেকে যা বুঝতে পারি, তা হচ্ছে অনেক মহামানুষদেরও ভুল হয়। কখনো কখনো মানবিক প্রবৃত্তির কাছে তারা হেরে বসেন।

কিন্তু আমরা যখন তাদের কারও কারও মতো কোনো ভুল করে বসব, তখন পরিবর্তনের জন্য তারা যা করেছিলেন, আমাদেরও তা-ই করতে হবে। আমাদেরকে পরিতাপ করতে হবে। তাৎক্ষণিকভাবে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। পরে যেন আর কখনো এমন ভুলে না জড়াই সেজন্য দৃঢ়চিত্ত হতে হবে। আর যদি আবার ভুল করেই ফেলি তাহলে ক্ষমা চাওয়ার এই চক্র পুনরায় শুরু করতে হবে।

৩. কিন্তু কেউ যদি পুরোপুরি সীমালঙ্ঘন করতে চায় তার বেলায় কী হবে? সত্যি সত্যিই এমন কাজ করতে চেয়েছিলেন এমন একজনকে রাসূল (সা) কীভাবে বাধা দিয়েছিলেন? একবার এক যুবক রাসূল (সা)-এর কাছে এলেন এই অনুরোধ করতে যে, তাকে যেন বিবাহ বহির্ভূত দৈহিক মিলন করার অনুমতি দেওয়া হয়। আশেপাশের লোকেরা একথা শুনে বিষম খেলেন। যুবককে চুপ করাতে চাইলেন। রাসূল (সা) তাকে একাধারে বেশ কয়েকটি প্রশ্ন করলেন: “তোমার মা’র সঙ্গে কেউ এমন করতে চাইলে তুমি কি এটা পছন্দ করতে?” তিনি (সা) তাকে এরপর জিজ্ঞেস করতে লাগলেন, তার মেয়ের সঙ্গে, তার বোনের সঙ্গে, তার কোনো মহিলা আত্মীয়ের সাথে এরূপ করা হলে কি সে তা পছন্দ করত? যুবকটি প্রতিটি প্রশ্নেরই নেতিবাচক উত্তর দিলেন। রাসূল (সা)-এর যুক্তির সামনে তিনি বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে আশ্বস্ত হলেন। অবশেষে রাসূল (সা) তার বরকতময় হাত যুবকটির উপর রাখলেন এবং আল্লাহর কাছে দু‘আ করলেন, “আল্লাহ, আপনি তার অপরাধ মার্জনা করে দিন, তার অন্তরকে পরিশুদ্ধ করে দিন। এবং তাকে পবিত্র করে দিন।” বর্ণনা করা হয়েছে যে, সেই যুবক এই ঘটনার পর কখনো তিনি যা করতে অনুরোধ করেছিলেন তাতে জড়াননি। [৭]

যুবকটি রাসূল (সা)-এর যুক্তি সংস্পর্শ ও দু‘আ দ্বারা বুদ্ধিবৃত্তিক ও আধ্যত্মিকভাবে রহমতপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। শারীরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে পরামর্শ দেওয়ার ব্যাপারে আমাদেরকেও রাসূল (সা)-এর মতো হতে শিখতে হবে। আমি অনেক মুসলিম নারীদের জানি যারা বিয়ে করতে প্রচণ্ড ভয় পান। কারণ, যৌনতার ব্যাপারটা তাদের বাবা-মা’রা এমন নিষিদ্ধ এক বিষয় বানিয়ে রেখেছেন যে, বিয়ের পর দৈহিক অন্তরঙ্গতার প্রতি তাদের মনে রয়েছে প্রচণ্ড ভয়।

আমি এমন অনেক তরুণ ছেলে ও মেয়েদের ব্যাপারেও জানি যারা বিয়ে করতে চায় কিন্তু তাদের বাবা-মা তাদেরকে বিয়ে দিতে আপত্তি জানায় শুধু একারণেই যে তাদের বংশ মেলে না। অবশেষে এসব ছেলে-মেয়েরা নিজেদের আর নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে বিয়ে-বহির্ভূত দৈহিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে।

অভিভাবক হিসেবে, যৌনতা ও শারীরিক সম্পর্কের ব্যাপারগুলো আলোচনার সময় আমাদেরকে রাসূল (সা)-এর কর্মপন্থা বিবেচনা করতে হবে। রাসূল (সা) জনসম্মুখে যুবকটির যৌনতা সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা করেছেন। একে কোনো নিষিদ্ধ বিষয় বানাননি। রাসূল (সা) যদি প্রকাশ্যে মানুষের সামনে এ ধরনের বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে পারেন, তাহলে ঘরের নিভৃতে আপনার সন্তানদের সঙ্গে একাকী কেন আপনি এসব বিষয় নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা করতে পারবেন না?

তবে, তাই বলে ব্যাপারটাকে তাদের সামনে বিব্রতকরভাবে তুলে ধরারও প্রয়োজন নেই। তারা বড় হয়ে ওঠার আগেই তাদের সঙ্গে আন্তরিক ও উন্মুক্ত সম্পর্ক গড়ে তুলুন যাতে করে পরবর্তীকালে যখন এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করবেন তখন ব্যাপারটা বিব্রতকর বা অস্বস্তিকর হবে না। যদি আপনাদের মধ্যে উন্মুক্ত সম্পর্ক থাকে তাহলে এ ধরনের আলোচনাও হবে গঠনমূলক, ইনশা’আল্লাহ।

উপরন্তু, সমাজের নেতা হিসেবে সমাজের সদস্যদের সঙ্গে এসব বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা হওয়া প্রয়োজন। যৌনতা এবং এ সম্পর্কিত বিষয়গুলো আলোচনার জন্য আমাদের পরিবারগুলোতে যদি প্রয়োজনীয় পরিবেশ না থাকে, তাহলে আমাদেরকেই এগিয়ে আসতে হবে। সমাজের সঙ্গে শক্তিশালী সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে যাতে করে আমরা সমাজের জন্য দিকনির্দেশকের ভূমিকা পালন করতে পারি।

৩. আজকের দিনে যেমনটি ঘটে রাসূল (সা)-এর সময়েও বিবাহিত নারী-পুরুষ সাহাবিরা ব্যাভিচার করেছেন। ব্যাভিচার ইসলামে খুবই সাংঘাতিক এক ইস্যু। কারণ এটা পরিবারের অনুভূতিকে আঘাত করে। কিন্তু এ সংক্রান্ত যে ঘটনাগুলো বর্ণিত হয়েছে তাতে দেখা যায় যে, রাসূল (সা) তড়িঘড়ি করে কাউকে শাস্তি দেননি। একবার এক নারী এসে তাঁকে বারবার বলছিলেন যে তাকে শাস্তি দেওয়া হোক, যাতে তিনি নিজেকে পরিশুদ্ধ করতে পারেন। রাসূল (সা) তাকে অনেক সুযোগ দিচ্ছিলেন যাতে সেই নারী আর তাঁর কাছে শাস্তির অনুরোধ করতে না আসেন এবং কোনো শারীরিক শাস্তির মুখোমুখি না হন। শুধু তাওবা করেই যেন কাটিয়ে দেন। কিন্তু সেই নারী অন্য আর সকলের মতোই বারবার এসে শাস্তি মাথে পেতে নেওয়ার অনুরোধ করেছেন। আর ফলস্বরূপ তাকে শাস্তি ভোগ করতে হয়েছে। [৮]

এই ঘটনা উল্লেখ করার কারণ হচ্ছে এটাই দেখানো যে, রাসূল (সা)-এর সময়ে বিশ্বের সবচেয়ে সেরা প্রজন্মের মধ্যেও এগুলোর অস্তিত্ব ছিল। তারাও ভুল করেছিলেন। কিন্তু তারপরও তারা ছিলেন প্রকৃত পুরুষ বা প্রকৃত নারী যাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়ার মতো সাহস ছিল। ছিল ভুল স্বীকার করার মানসিকতা। আর এধরনের ভুলত্রুটি হওয়ার পরও, এবং বিয়ে-বহির্ভূত দৈহিক মিলনের মতো কাহিনী হওয়ার পরও রাসূল (সা) নারী-পুরুষের একত্রে কাজ করার ক্ষেত্রকে নিষিদ্ধ করেননি। বরং তিনি তাদের শিখিয়েছেন কীভাবে পেশাদারিত্ব বজায় রেখে শ্রদ্ধার সঙ্গে তারা একসাথে কাজ করতে পারেন। আবার একইসাথে নারী-পুরুষের পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব ও ভগিনীত্বও বজায় থাকে।

নারী-পুরুষ সম্পর্কের ক্ষেত্রে যেসব দৃষ্টান্ত আমি উল্লেখ করেছি, তার অধিকাংশতেই পুরুষদেরকে তাদের কামনাতাড়িত হয়ে কাজ করতে বা কাজ করতে চাওয়ার উল্লেখ থাকলেও নারীদের বেলায়ও একই কথা সত্য। নারীদের জৈবিক চাহিদা ও আকাঙ্ক্ষা ব্যাপারে যখন কথা বলা হয় তখন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নারীদেরকে এক্ষেত্রে সক্রিয় মনে করা হয় না। এই বাস্তবতা উপেক্ষা করা হয় যে, অনেক নারীদের মধ্যেও জৈবিক তাড়না শক্তভাবে কাজ করে। এবং এগুলোর সঙ্গে লড়াই করেই তাদের চলতে হয়।

রাসূল (সা)-এর সমাজে বসবাসরতদের যেসব ঘটনা আমরা উল্লেখ করেছি, আজকের দিনে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই এ থেকে শিক্ষা নিতে পারেন। নিজেদের মধ্যে দায়িত্বশীলতা, স্রষ্টার সঙ্গে ক্রমাগত সংযোগ এবং প্রবৃত্তি মোকাবিলা করার জন্য বুদ্ধিবৃত্তিক ও আধ্যত্মিক শক্তি দিয়ে অথবা অনুশোচনা করে এবং পদস্খলন হলেই সাথে সাথে আল্লাহর দিকে ফিরে আসার ধারণা বাস্তবায়ন করতে পারেন।

আমাদের আজকের সমাজে অনেকের মধ্যেই নারী-পুরুষ সম্পর্কের ব্যাপারে পরিষ্কার ধারণা নেই। কখনো কখনো নারীদেরকে মসজিদে এই ভয়ে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না যে, তারা হয়তো পুরুষদের মধ্যে অস্থিরতা সৃষ্টি করবে। নারী-পুরুষ সম্পর্কের ক্ষেত্রে পুরুষদের বিচ্যুত হওয়ার জন্য অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নারীদেরকে মূল কারণ হিসেবে দায়ী করা হয়। আমি আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, খুব কম সময়েই পুরুষদের এ ব্যাপারে সতর্ক করা হয়। নারীদের অস্তিত্বকে অস্বীকার করা কিংবা তারা যাতে পুরুষদের জন্য ফিতনা না হয়ে উঠে তা নিশ্চিত করার জন্য নারীদেরকে মসজিদের দেয়ালের বাইরে রাখা বাদ দিয়ে নারী-পুরুষ সম্পর্কের ক্ষেত্রে তাদের যে দায়িত্ব আছে তা পালনের জন্য পুরুষদের খুব কমই বলা হয়। আমার মতে নারী-পুরুষ সম্পর্কের ক্ষেত্রে রাসূল (সা)-এর প্রশিক্ষণ পদ্ধতি আর যাই হোক কম্যুনিটির সম্পূর্ণ পৃথকীকরণ ছিলো না।

আমাদের সমাজে নারী-পুরুষের সম্পর্ক কীভাবে মোকাবিলা করব সে জন্য কিছু সাধারণ পরামর্শ: [৯]

১. নিজের জন্য: আমাদেরকে বুঝতে হবে যে, আমাদের নিজেদের ব্যাপারে, নিজেদের পোশাক ও কাজের ব্যাপারে আমরা নিজেরাই দায়ী। নারী-পুরুষ উভয়েরই রয়েছে মেলামেশা ও পোশাকের ব্যাপারে নির্দিষ্ট নীতিমালা। প্রত্যেককেই সেসব নির্দেশনা মেনে চলার সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে। তবে কাউকে যদি এই নির্দেশনা মেনে চলতে সংগ্রাম করতে হয়, তাহলে সে জন্য কখনোই অন্য কেউ তাকে দায়ী করতে পারেন না। কারও প্রতি যদি আপনার আকর্ষণ জাগে, তা সে যেভাবেই পোশাক পরুক না কেন, নারী কিংবা পুরুষ হিসেবে এটা আপনার নিজের দায়িত্ব: অন্যকে দোষ না দিয়ে চোখ সরিয়ে নেওয়া। আপনার কাজের হিসাব আপনাকেই দিতে হবে। যদি আপনি ভুল করেন, তাহলে সেজন্য আপনিই দায়ী।

২. পুরুষদের জন্য: আপনার পুরুষ হিসেবে যে সুবিধা আপনি পান তা এমনভাবে ব্যবহার করুন যাতে নারীরা এগিয়ে যেতে পারে, জ্ঞান অর্জন করতে পারে, দাওয়াহ দিতে পারে, মসজিদে উপস্থিত হতে পারে। নারীদের অস্তিত্ব কোনো সমস্যা নয়। আপনি যদি তাদের সঙ্গে শ্রদ্ধাপূর্ণ ও পেশাদার সম্পর্ক বজায় রাখতে না পারেন তাহলে এজন্য তাদের অস্তিত্বকে দায়ী করবেন না। নবীজির পদ্ধতি অনুসরণের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করুন। নিজের কাজের জন্য নিজেকেই দায়ী করুন। ঠিক যেভাবে সাহাবিরা তাদের কৃতকর্মের দায়-দায়িত্ব নিয়েছিলেন। আপনারা যেমন নারীদের ‘সঙ্গী’ [১০]নারীরাও তেমনি আপনাদের সঙ্গী – এটি উপলব্ধ করুন।

৩. নারীদের জন্য: সাধারণভাবে সমাজ আমাদেরই দায়ী করে। আর তাই দায়িত্বের বোঝা আমাদেরই নিতে হবে। নারী হিসেবে দাবি করতে হবে আমাদের জন্য যাতে সেই জায়গা তৈরি করা হয় যাতে আমরা জ্ঞান অর্জন ও প্রসার করতে পারি। সমাজের অগ্রগতিতে ভূমিকা রাখতে পারি। অন্য কারও মানসিক ও মৌখিক আচরণ যেন আপনাকে মসজিদে উপস্থিত হতে কিংবা জ্ঞান অর্জনে বাধা না দেয়। প্রতিনিয়ত আমরা যেসব ঘটনার মুখোমুখি হই, সেগুলো মোকাবিলার জন্য আমাদের উঠে দাঁড়াতে হবে, জায়গা করে নিতে হবে। আল্লাহ চায় তো, এবং আমাদের পুরুষ সঙ্গীদের সাহায্যে আমরা দেখব নতুন দিগন্ত, যেখানে রাসূল (সা)-এর সমাজের মতো শ্রদ্ধাশীল সহাবস্থান ও ক্ষমতায়ন হবে ।

৪. তরুণদের জন্য: আমরা জানি আপনাদের অধিকাংশের হরমোন এখন উন্মত্ত। আর বাস্তবতা হচ্ছে আপনাদের ভুল ও কামনাকে মোকাবিলা করার জন্য আলাপ-আলোচনার যথেষ্ট খোলা পরিবেশও নেই। অভিভাবকদের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলার পরিবেশ না থাকায় ভারসাম্য বজায় রাখা বেশ কঠিন। কাজেই আপনাদের সমাজ থেকে এমন কোনো মেনটরকে খুঁজে বের করুন যাঁর সঙ্গে আলাপ করতে পারবেন, সহায়তা পাবেন। আর আপনি যদি ভুল করেই থাকেন, তাহলে জেনে রাখুন তাওবার দরজা, আল্লাহর কাছে যাওয়ার দরজা সবসময় খোলা!

৫. অভিভাবক ও সমাজের নেতাদের জন্য: আমাদের কিশোর তরুণদের যাতে সুস্থ বিকাশ ঘটে সেজন্য আপনাদের প্রয়োজন। আপনাদের প্রজন্ম থেকে তাদের প্রজন্মে সফল পরিবর্তনের জন্য চাই উন্মুক্ত আলাপ। তাদেরকে সফল নারী-পুরুষ সম্পর্কের ব্যাপারে বাস্তব উদাহরণ দেখান। নারীর প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান দেখানোর পরামর্শ দিন। ব্যক্তিগত দায়িত্ব নিজের কাঁধে নেওয়া এবং নারীদের ক্ষমতায়নে সাহায্য করার মাধ্যমে পুরুষরা কীভাবে নিজেদের ক্ষমতায়িত করতে পারে সে দিক-নির্দেশনা দিন। আপনাদের প্রজন্ম থেকে পরবর্তী প্রজন্মে নেতৃত্ব হস্তান্তরের জন্য এ বিষয়গুলো খুব জরুরী।

৬. সবার জন্য: আমরা সবাই ভুল করি, এমনকি সাহাবিরাও করেছেন! প্রতিটা ভুলকে যেন আল্লাহর কাছে যাওয়ার সুযোগে পরিবর্তন করতে পারি সেই চেষ্টা করুন। তিনি সবসময় আমাদের জন্য প্রস্তুত।

নারী-পুরুষ সম্পর্কের ক্ষেত্রে উৎকর্ষ অর্জন করে সাহাবিরা জন্মগ্রহণ করেননি। পেছনের ভুলত্রুটি নিয়েই তারা ইসলামে প্রবেশ করেছিলেন। সেগুলোর কিছু কিছু মুসলিম জীবনে তারা টেনেও এনেছিলেন।

নারী-পুরুষ সম্পর্কের ক্ষেত্রে কুর’আনের একটি আয়াত গুরুত্বপূর্ণ একটি মূলনীতি প্রস্তাব করে। তাদের প্রচেষ্টা দ্বারা সাহাবীরা এই আয়াতকে বাস্তবায়নের চেষ্টা করেছেন। নারী-পুরুষ সম্পর্কের ক্ষেত্রে আমাদের মধ্যে বিভিন্ন দ্বিধা, সাংস্কৃতিক ভুল বোঝাবোঝি ও অনেক কাঠ-খোড় পোড়াতে হলেও আমাদেরকেও এক্ষেত্রে এই আয়াতটিই বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করতে হবে।

“আর ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার নারী একে অপরের সহায়ক। তারা সৎ কাজের আদেশ দেয় এবং মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখে। নামাজ প্রতিষ্ঠা করে, যাকাত দেয় এবং আল্লাহ ও তাঁর রসূলের নির্দেশ অনুযায়ী জীবন যাপন করে। এদেরই উপর আল্লাহ তা’আলা দয়া করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ পরাক্রমশীল, সুকৌশলী।” [১১]


লেখক – 

[১] ইব্‌ন মাজাহ, আবু দাউদ, তায়ালিসি, বায়হাকি, আহমাদ, তিরমিযি ও নাসা’ই। আল-আলবানি একে সহীহ বলেছেন (দেখুন সিলসিলাত আল-আহাদীস আল-সহীহ, ৩৪৭২)

[২] বর্ণনাটি পাওয়া যাবে সহীহ মুসলিমে

[৩] সহীহ বুখারি

[৪] সহীহ বুখারি

[৫] আল-কুর’আন ২৯:৪৫

[৬] “পাঁচ ওয়াক্ত সালাত এবং এক জুমু’আহ থেকে আরেক জুমু’আহ এর মধ্যবর্তী সময়ে করা অপরাধের প্রায়শ্চিত্তস্বরূপ; যদি না কোনো বড় অপরাধ (কবিরা গোনাহ) করা হয়ে থাকে।” [সাহীহ বুখারি]

[৭] আল-হাকিম

[৮] সহীহ মুসলিম

[৯] আমার প্রিয় বন্ধু সানা ইকবাল থেকে অনুপ্রাণিত

[১০] রাসূল (সা)-এর শেষ খুতবা থেকে: “তোমাদের নারীদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করো, তাদের প্রতি সদয় হও, কারণ তারা তোমাদের সঙ্গী ও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ সহযোগী।” [সহীহ বুখারি]

[১১] আল-কুর’আন ৯:৭১

সূত্রঃ VirtualMosque

আল-জাহরাভী – আধুনিক চিকিৎসার পথিকৃৎ

মুসলিম স্পেনের মহান ব্যক্তিত্বদের অন্যতম একজন হলেন মধ্যযুগে ইসলামের শ্রেষ্ঠ সার্জন “আবু আল-কাসিম আল-জাহরাভী”। চিকিৎসার নতুন কৌশল ও যন্ত্রপাতি আবিষ্কারের মাধ্যমে তিনি চিকিৎসাবিজ্ঞানে আমূল পরিবর্তন আনেন। তাঁর রচিত ৩০ খণ্ডের এনসাইক্লোপেডিয়া (জ্ঞানকোষ) শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ইউরোপে মূল পাঠ্য হিসেবে ব্যবহৃত হতো। বিভিন্ন ধরনের চিকিৎসার কলা-কৌশল কেমন হবে সে ব্যাপারে তাঁর অবদান ছিল যুগান্তকারী।

জন্ম এবং পেশা
আল-জাহরাভী এর জীবনকালে উমাইয়া খিলাফত ছিল এর শক্তি ও ক্ষমতার উচ্চ শিখরে। তিনি ৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন, মৃতুবরণ করেন ১০৩০ খ্রিস্টাব্দে। জীবনকালে উমাইয়া খলিফা দ্বিতীয় আল-হাকাম ও সামরিক শাসক আল-মানসুর এর হয়ে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর গোটা জীবন জুড়েই তিনি ছিলেন রাজ-দরবারের চিকিৎসক। চিকিৎসাক্ষেত্রে তাঁর মেধার বদৌলতে তিনি আল-আন্দালুস শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতা এবং স্বীকৃতি পেয়েছিলেন। এভাবেই তিনি একজন চিকিৎসক হিসেবে ৫০ বছর ধরে তাঁর দায়িত্ব পালন করেন।

আজ এই আধুনিক বিশ্বের অধিকাংশ ডাক্তার কিংবা হাসপাতালের মতো নয়, আল-জাহরাভী রোগী দেখতেন রোগীদের আর্থিক অবস্থা বিবেচনা না করেই। প্রতিদিন বিভিন্ন রোগী দেখে তাদের রোগ ও চিকিৎসার বর্ণনা লিখে রাখতেন যা পরবর্তীতে চিকিৎসাবিজ্ঞানের অমূল্য গ্রন্থঃ “আল-তাস্‌রিফ”-রূপে প্রকাশিত হয়।

আল-তাস্‌রিফ

১০ম শতকে আল-জাহরাভী লিখিত আল-তাস্‌রিফ গ্রন্থের মূল কপির একটি পাতা

চিকিৎসাবিজ্ঞানের উপর লেখা তাঁর এনসাইক্লোপেডিয়াটি ৩০ খণ্ডে বিভক্ত। এক একটি খণ্ডে বিভিন্ন ধরনের ঔষধ এবং পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। প্রথম দিকের একটি খণ্ডে তিনি রোগ নির্ণয়ের ব্যাপারে আলোচনা করেন। তিনি বলেন, একজন ভাল ডাক্তার সবসময় রোগী নিজের ব্যাপারে কি বলছে তার পরিবর্তে নিজের ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ ও রোগীর লক্ষণসমূহের উপর নির্ভর করবে – যে চর্চা আজও ডাক্তাররা করে আসছেন।

আল জাহরাভী চিকিৎসার ক্ষেত্রে এক সার্বজনীন পদক্ষেপ নেন। শুধু রোগ নিরাময় নিয়েই নয়, কিভাবে রোগ প্রতিরোধ করা উচিত তাও তিনি ব্যাখ্যা করেন। তাঁর লিখিত বইগুলোর একটি বড় অংশে তিনি আলোচনা করেন সুস্থতার জন্য কি ধরনের খাবার এড়িয়ে চলা প্রয়োজন, কিভাবে স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস বজায় রাখা যায় এবং কিভাবে খাদ্যকে সুচিকিৎসার পরিকল্পনার একটি অংশ হিসাবে ব্যবহার করা যায়। মদ পানের খারাপ দিকগুলো তিনি বিশেষভাবে তুলে ধরেন। এ ব্যাপারে তিনি বলেনঃ

“মদ শরীরের বেশীরভাগ স্নায়ু দুর্বল করে দেয়, কথা বলায় সমস্যা সৃষ্টি করে, দুর্বলতার কারণে শরীরের স্বাভাবিক নড়াচড়া, হাঁটাচলায় সমস্যা সৃষ্টি হয়। তাছাড়া হাড়ের রোগ, গেটে বাত ও যকৃতে ব্যাঘাত ঘটায় যার ফলে টিউমার ও নানাবিধ অসুখ এর সৃষ্টি হয়, পেটে পানি জমে যকৃত অকৃতকার্য হয়ে পড়ে।” (১)

আল-তাস্‌রিফ এর ৩০তম খণ্ডটি হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খণ্ড যেখানে তিনি সার্জারী নিয়ে আলোচনা করেছেন। কিছু নির্দিষ্ট রোগের নিরাময়ের জন্য যে নির্দিষ্ট সার্জারীগুলো যেভাবে করতে হবে তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি জোর প্রকাশ করেন যে প্রত্যেক সার্জনকে অবশ্যই সবার আগে দক্ষ হতে হবে চিকিৎসাপদ্ধতি, দেহের গঠনের ব্যাপারে, এবং এমনকি সেসকল দার্শনিকদের লেখাও পড়তে হবে যারা চিকিৎসাবিজ্ঞানে পড়ালেখা করেছেন।

আজ এই আধুনিক যুগে অপারেশন থিয়েটারে ব্যবহৃত বেশীরভাগ চিকিৎসা পদ্ধতি এবং অপারেশনের যন্ত্রপাতির প্রবর্তক ছিলেন আল-জাহরাভী। তিনিই সর্বপ্রথম (অপারেশনের পর চামড়া জোড়া লাগাতে) সেলাইয়ের কাজে বিড়ালের নাড়িভুঁড়ি থেকে তৈরি একধরনের সুতা ব্যবহার করেন। সেলাইয়ের পর এই সুতা নিজে নিজেই শরীরের সাথে মিশে যায় যার কারণে সেলাইয়ের পর সুতো খোলার জন্য দ্বিতীয় অপারেশন করতে হয়না। তিনিই সর্বপ্রথম সন্তান প্রসবের ক্ষেত্রে ‘ফরসেপ’ নামক যন্ত্রের ব্যবহার করেন যা মা ও শিশু মৃত্যুহার অনেক কমিয়ে দিয়েছিল।

বর্তমানে টনসিল অপসারনে ব্যবহৃত ‘টনসিলেক্‌টমী’ অপারেশন এবং এতে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি দিয়েই তিনি এই অপারেশন করতেন। অপারেশনের সময় কোন কিছু কাটার সময় তিনি এক ধরনের লুকোনো ছুড়ি ব্যবহার করতেন যাতে রোগীরা বুঝতে না পারে।

রোগীদের যাতে কষ্ট কম হয় সেজন্য তিনি প্রয়োজন ও অবস্থা অনুযায়ী শরীরে এবং মুখে, উভয় স্থানে অ্যানাসথেসিয়া (অসাড়করণ) পদ্ধতি ব্যবহার করতেন। নারীদের স্তন ক্যান্সারে তিনি ‘মাসটেক্‌টমী’ পদ্ধতি ব্যবহার করতেন যেখানে স্তন অপসারণ করে ফেলা হয়, এ পদ্ধতি স্তন ক্যান্সারে আজও ব্যবহৃত হয়ে আসছে। তিনি ব্যাখ্যা করেন কিভাবে ভাঙ্গা হাড় জোড়া লাগাতে হয়, প্রয়োজনে বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কেটে ফেলতে হয়, এমনকি কিভাবে মূত্রাশয়ের পাথর সরাতে হয়। চিকিৎসাবিজ্ঞানে তার করা সকল “সর্বপ্রথম আবিষ্কার” এর বর্ণনা দিতে গেলে এ বিষয়ের উপরই একটি আলাদা বই লিখতে হবে।

আল-জাহরাভী আবিষ্কৃত ইন্‌হেলার (শ্বাসকষ্টের রোগীরা যেটা নিয়মিত ব্যবহার করেন)। ছবিতে উপরের দিকে মূল আরবী এবং নিচে ল্যাটিন অনুবাদ।

তার অপরিমেয় জ্ঞান ও দক্ষতা সত্ত্বেও রোগীর জন্য শারীরিক এবং মানসিকভাবে খুবই কঠিন হবে এমন ঝুঁকিপূর্ণ ও অজানা কোন অপারেশন করতে তিনি সবসময় অস্বীকৃতি জানাতেন। তাঁর কাছে মানুষের জীবনই সবচেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তাই সবসময় কোন জীবনকে যতদিন সম্ভব বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করতেন। রোগীদের সাথে আচরণ, শয্যাপাশে তাদের সাহস ও প্রশান্তি দেয়ার ক্ষেত্রে তাঁর নজির অন্য সকল চিকিৎসকের কাছে একটি উদাহরণ হয়ে থাকবে।

উত্তরাধিকার
তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ আল-তাস্‌রিফ, আল-আন্দালুস থেকে মুসলিম বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তে এবং পরবর্তীতে গোটা খ্রিস্টানবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। কয়েক শতাব্দী ধরে ল্যাটিন এবং অন্যান্য ইউরোপীয় ভাষায় এর অনুবাদ করা হয়। যার ফলে তাঁর আবিষ্কৃত অনেক পদ্ধতিরই এমন নাম দেয়া হয় যা দেখে বুঝার কোন উপায়ই নেই যে পদ্ধতিগুলো তাঁর আবিষ্কার। উদাহরণস্বরূপ, সন্তানপ্রসবে “Walcher position” এবং স্থানচ্যুত হওয়া কাঁধ ঠিক করার জন্য “Kocher method” আবিষ্কারের কৃতিত্ব পরবর্তীতে চলে যায় ইউরোপীয় চিকিৎসকদের কাছে।

তাঁর কৃতিত্ব যদি আমরা অগ্রাহ্যও করি, তৎকালীন সময়ে চিকিৎসাবিজ্ঞানে এবং বিশেষ করে সার্জারীতে তাঁর অবদান ছিল অবিস্মরণীয়। তাঁর আবিষ্কৃত পদ্ধতি ও যন্ত্রপাতিগুলো ছাড়া আজ এই আধুনিক যুগেও হয়তো অপারেশন হতো এক বর্বর অনিশ্চয়তার খেলা। তাঁর দক্ষতা এবং নিয়মিত রেকর্ড করে রাখা বিভিন্ন পদ্ধতি আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের অগ্রগতিতে অনেক বড় ভূমিকা রেখেছে। আমরা আজও এই মেধাবী চিকিৎসাবিজ্ঞানীর কাছে ঋণী।

অনুবাদ করা হয়েছেঃ Al-Zahrawi – The Pioneer of Modern Surgery আর্টিকেল থেকে।
অনুবাদকঃ সাদাত ইফতেখার

Footnotes:
১ – Awadain, M. Reda. “A Recent Look and Study of Some Papers of al-Zahrawi’s Book “al-Tasrif”.” IslamSet. N.p.. Web. 16 Dec 2012.

Bibliography – গ্রন্থপঞ্জিঃ
al-Hassani, Salim. 1001 Inventions: The Enduring Legacy of Muslim Civilization. Washington D.C.: National Geographic Society, 2012. Print.

Awadain, M. Reda. “A Recent Look and Study of Some Papers of al-Zahrawi’s Book “al-Tasrif”.” IslamSet. N.p… Web. 16 Dec 2012.

Morgan, M. (2007). Lost History. Washington D.C.: National Geographic Society.


এক নজরে আল জাহরাভী –
https://www.youtube.com/watch?v=I8P0fhceQgA

বিশ্বের প্রাচীনতম কুরআনের পাণ্ডুলিপি

ইউনিভার্সিটি অফ বার্মিংহাম এর এক সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গিয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে সংরক্ষিত পবিত্র কুরআন এর এক পুরনো পাণ্ডুলিপি হয়তো বিশ্বের সবচেয়ে পুরনো হস্তলিখিত কুরআন। রেডিওকার্বন ডেটিং পরীক্ষা অনুযায়ী ধারণা করা হচ্ছে পশুর চামড়ার উপর লিখিত এই পাণ্ডুলিপিটি ৫৬৮ থেকে ৬৪৫ খ্রিস্টাব্দের মাঝে কোন এক সময় লেখা হয়েছিল।

গবেষণাটি যদি সঠিক হয়ে থাকে, তবে এটিই প্রতীয়মান হবে যে ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে রাসূল ﷺ এর মৃত্যুর কয়েক বছরের মধ্যেই তাঁর এক সাহাবী পাণ্ডুলিপিটি লিখেছিলেন।

পাণ্ডুলিপিটি হিজাযী স্ক্রিপ্ট এ লেখা, যা বর্তমানে প্রায় বিলুপ্ত এবং অব্যবহৃত। এই স্ক্রিপ্টে বিন্দু এবং স্বরবর্ণ চিহ্নর ব্যবহার খুবই কম হওয়ায় শুধুমাত্র যারা আয়াতগুলোর সাথে সুপরিচিত তারা ছাড়া বাকিদের জন্য আয়াতগুলো পড়া খুবই কষ্টসাধ্য হবে। ৭ম শতাব্দীর শেষদিকে এসে কুর’আন লেখার জন্য ‘কুফিক’ স্ক্রিপ্ট ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে উঠে।

নিম্নে পাণ্ডুলিপিটির কিছু স্ক্যান করা কপি এবং বিস্তারিত পড়ার জন্য আরো কিছু লিঙ্ক দেয়া হলোঃ

সূরা মারয়াম এর ৯১-৯৮ নং আয়াত এবং এরপর সূরা তাহা এর প্রথম ১২ আয়াত
সূরা তাহা এর ১২ থেকে ৩৯ নং আয়াত
সূরা আল-কাহফ এর ১৭ থেকে ২৩ নং আয়াত
সূরা আল-কাহফ এর ২৩ থেকে ৩১ নং আয়াত

ইউনিভার্সিটি অফ বার্মিংহাম এর ওয়েবসাইট এ পাণ্ডুলিপিটির স্ক্যান করা কপির লিঙ্ক

আলবা ফেদেলি লিখিত পাণ্ডুলিপিটির আধুনিক প্রতিলিপি

অনুবাদ করা হয়েছেঃ The World’s Oldest Quran Manuscript আর্টিকেল থেকে।
অনুবাদকঃ আহমেদ রাকিব

সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মাদ এবং রাসূল ﷺ এর প্রতিশ্রুতি

ফাতিহ্‌ সুলতান মুহাম্মাদ

রাসূল মুহাম্মদ ﷺ আরব মরুভূমিতে তাঁর অনুসারীদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে একদিন তারা তৎকালীন বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর এবং কিংবদন্তি নগরী কনস্ট্যান্টিনোপোল (বাইজেন্টাইন [পূর্ব রোমান] সাম্রাজ্যের রাজধানী) জয় করবে। তবে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এটি মুসলিমদের জন্য অধরাই থেকে গিয়েছিল। কনস্ট্যান্টিনোপোল (বর্তমানে তুরস্কের রাজধানী “ইস্তানবুল”) বিজয় মনে হচ্ছিল যেন এক অসম্ভব কাজ। শহরটি ছিল খুবই সুরক্ষিত। উপদ্বীপ হওয়াতে একদিকে বসফরাস প্রণালী দ্বারা জলবেষ্টিত এবং অন্য দিক দিয়ে সুবিশাল দেয়াল শহরটির প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে করে তুলেছিল অপ্রতিরোধ্য, যা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে কনস্ট্যান্টিনোপোল বিজয়ের স্বপ্নে বিভোর সকল বিজেতাদেরকে নিরস্ত ও নিবৃত্ত করে এসেছিল। উমাইয়া খিলাফতের সময় মুসলিম সেনাবাহিনী কনস্ট্যান্টিনোপোল অবরোধ করেছিল, তবে সেই অবরোধগুলো শহরটির অতিকায় দেয়ালগুলোকে ঘায়েল করতে পারেনি।

১৪শ শতকের শুরুর দিকে পশ্চিম আনাতোলিয়ার এক ছোট বেইলিক হিসেবে ওসমানী সাম্রাজ্যের উত্থান হওয়ার পর এটি বাইজেন্টাইন (পূর্ব রোমান) সাম্রাজ্য এবং এর রাজধানী কনস্ট্যান্টিনোপোলের নিরাপত্তার হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। ১৪৫১ খ্রিস্টাব্দে সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মাদ সিংহাসনে আরোহণের সময়ে ওসমানীরা ইতিমধ্যে কনস্ট্যান্টিনোপোলের চারদিকে ইউরোপ ও এশিয়া উভয় মহাদেশের ভূখণ্ডেই নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করে নিয়েছে। সুলতান হওয়ার মুহূর্তেই সুলতান মুহাম্মাদ এই কিংবদন্তি নগরী বিজয়কে নিজের লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারণ করেন। এ উদ্দেশ্যে তিনি বসফরাস প্রণালীতে কনস্ট্যান্টিনোপোলের উত্তরদিকে একটি দুর্গ নির্মাণের উদ্যোগ নেন যাতে শহরটিতে আসা-যাওয়া করা জাহাজগুলোর নিয়ন্ত্রণ নেয়া যায়। রাসূল মুহাম্মাদ ﷺ ঘোষণা দিয়েছিলেন যে মুসলিমরা একদিন কনস্ট্যান্টিনোপোল বিজয় করবে। তাই রাসূল ﷺ এর সম্মানে সুলতান মুহাম্মাদ এমনভাবে দুর্গটি নির্মাণ করেছিলেন যেন উপর থেকে দেখলে দুর্গটিকে আরবী “মুহাম্মাদ” (محمد) বানান এর মতো দেখা যায়।

বর্তমানে ইস্তানবুল

১ এপ্রিল, ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দ। সুলতান মুহাম্মাদ এবং তাঁর এক লক্ষাধিক সৈন্যবিশিষ্ট ওসমানী সেনাবাহিনী কনস্ট্যান্টিনোপোল নগরীর প্রাচীরের সামনে এসে পৌঁছায়। তাঁরা সেখানে গিয়ে যে দৃশ্য দেখেছিলেন তা নিশ্চয়ই আতঙ্কজনক ছিল। কনস্ট্যান্টিনোপোলের প্রাচীরের ভেতরের অংশের দেয়াল ছিল ৫ মিটার পুরু এবং ১২ মিটার উঁচু। ভেতরের দেয়াল থেকে ২০ মিটার দূরে ছিল বাহিরের দেয়াল, যেটা ২ মিটার পুরু এবং ৮.৫ মিটার উঁচু। এই দেয়ালগুলো ইতিহাসে কোনদিনই বিজিত হয়নি। ইতিপূর্বে ওসমানীদের অনেকগুলো অবরোধ পরাস্ত হয়েছিল বারবার, এবং ৭ম শতকে মুয়াবিয়া (রাঃ) এর আমলেও উমাইয়াদের অবরোধ ব্যর্থ হয়েছিল।

দুর্ভেদ্য দেয়ালগুলোর পাশাপাশি শহরের “গোল্ডেন হর্ন” এ স্থাপন করা ছিল একটি অতিকায় লোহার শিকল। গোল্ডেন হর্ন হচ্ছে কনস্ট্যান্টিনোপোলের উত্তরদিকে অবস্থিত এক ছোট খাল। লোহার শিকলের মাধ্যমে গোল্ডেন হর্নে জাহাজ আগমন নিয়ন্ত্রণ করা যেত। যার ফলে বহিঃআক্রমণের বিরুদ্ধে তুলনামূলকভাবে কম সুরক্ষিত শহরের উত্তর উপকূলটিও যথেষ্ট নিরাপদ ছিল। এই শিকলের কারণে যেকোন নৌবাহিনীর আক্রমণ প্রতিরোধ করা যেত। যার ফলে যুদ্ধ শুরুর আগেই বাইজেন্টাইনরা পরিষ্কারভাবে প্রতিরক্ষার দিক দিয়ে অনেক বেশী সুবিধাজনক অবস্থানে ছিল। তাই ওসমানীদের তুলনায় লোকবলে ও অস্ত্রশস্ত্রে অনেক কম হওয়া সত্ত্বেও বাইজেন্টাইনরা সুনিশ্চিত ছিল তাদের “আসন্ন বিজয়” এর ব্যাপারে। বিশেষ করে ইতালির জেনোয়া থেকে সাহায্য হিসেবে অতিরিক্ত যোদ্ধা ও সেনাপতি পাওয়ার পর তাদের আত্মবিশ্বাস আরো বেড়ে গিয়েছিল।

তৎকালীন কনস্ট্যান্টিনোপোলের মানচিত্র। শহরের উত্তরদিকে গোল্ডেন হর্ন এবং লোহার শিকল চিহ্নিত রয়েছে।

সুলতান মুহাম্মাদ বাইজেন্টাইনদেরকে আত্মসমর্পণ করার সুযোগ দেন এবং আত্মসমর্পণ করলে সকলের জীবন, অর্থ-সম্পদ ও পরিবারের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেন। তবে বাইজেন্টাইন সম্রাট ১১তম কনস্ট্যান্টিন এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। ফলশ্রুতিতে, সুলতান মুহাম্মাদ এপ্রিল মাসের ৬ তারিখে কনস্ট্যান্টিনোপোল আক্রমণ শুরু করেন। ওসমানী সৈন্যদের সর্বোত্তম প্রচেষ্টা এবং বিশ্বের সবচেয়ে বড় কামানের গোলাবর্ষণ সত্ত্বেও কনস্ট্যান্টিনোপোল কয়েক সপ্তাহ ধরে প্রতিরোধ চালিয়ে যায়। গোল্ডেন হর্নের লোহার শিকলের কারণে যেহেতু শহরটির দুর্বল প্রান্তে আক্রমণ করা যাচ্ছেনা, তাই ২২ এপ্রিল সুলতান মুহাম্মাদ ওসমানী নৌবাহিনীকে নির্দেশ দেন ভূমির উপর দিয়ে জাহাজগুলো বয়ে গোল্ডেন হর্নে নিয়ে যেতে। এক রাতেই, ৭২ টি জাহাজ ভূমির উপর দিয়ে বহন করে গোল্ডেন হর্নে নিয়ে যাওয়া হয় এবং শহরের উত্তরদিক থেকে চাপ প্রয়োগ করা হয়।

গোল্ডেন হর্ন এবং বসফরাস প্রণালী

যেহেতু ওসমানীরা ইতিমধ্যে সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে তাই মনে হচ্ছিল শহরের যুদ্ধটি শীঘ্রই শেষ হয়ে যাবে। ২৮ মে তে সুলতান মুহাম্মাদ তাঁর আক্রমণ স্থগিত করেন এবং সেনাবাহিনীকে নিয়ে গোটা দিন আল্লাহ্‌র কাছে বিজয়ের জন্য দোয়া করেন। পরের দিন ২৯ মে ওসমানী বাহিনী শহরের দেয়ালে চূড়ান্ত আক্রমণ শুরু করে এবং সকাল শেষ হবার আগেই কনস্ট্যান্টিনোপোলের অজেয় দেয়ালগুলো জয় করে নিয়ে কনস্ট্যান্টিনোপোল নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়।

সম্ভবত এই ঐতিহাসিক ঘটনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল পরাজিত বাইজেন্টাইনদের সাথে সুলতান মুহাম্মাদের আচরণ। তিনি শহরের অধিবাসীদের হত্যা করেননি, বরং কর পরিশোধ থেকে অব্যাহতি দিয়ে তাদেরকে কনস্ট্যান্টিনোপোলে থেকে যেতে উৎসাহিত করেন। কনস্ট্যান্টিনোপোলের গ্রীক অর্থোডক্স বিশপকে তিনি শহরে থেকে যেতে অনুরোধ করেন এবং তাঁর হয়ে শহরের খ্রিস্টানদের শাসন করার ব্যাপারে জোর প্রদান করেন। অন্যদিকে ইউরোপের অন্যান্য প্রান্তে “ধর্মীয় সহিষ্ণুতা” ছিল এক অপরিচিত এবং বিদেশী ধারণা। অমুসলিমদের সাথে আচরণের ক্ষেত্রে সুলতান মুহাম্মাদ ইসলামী নিয়ম-নীতির অনুসরণ করেন এবং কনস্ট্যান্টিনোপোলের খ্রিস্টানদেরকে তাদের নিজ ধর্ম পালনের অধিকার ও স্বাধীনতা প্রদান করেন। যুদ্ধ পরিচালনায় তাঁর দক্ষতা ও পারঙ্গমতা এবং একইসাথে ন্যায়পরায়ণ গুণাবলীসমূহের কারণে তিনি লাভ করেছেন الفاتح (“আল-ফাতিহ্‌”, ইংরেজিঃ the Conqueror, বাংলায় “বিজেতা”) উপাধি, যে নামে ইতিহাসের পাতায় তাঁর নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে।

অনুবাদ করা হয়েছেঃ Mehmed II and the Prophet’s Promise আর্টিকেল থেকে।
অনুবাদকঃ সাদাত ইফতেখার

Sources:

Freely, J. (2009). The Grand Turk. New York: Overlook Press.

Ochsenwald, W., & Fisher, S. (2003). The Middle East: A History. (6th ed.). New York: McGraw-Hill.

খ্রিস্টানধর্ম এবং মুসলিমদের স্পেন বিজয়

৭ম শতাব্দীর ২য় দশকে আইবেরিয়া উপদ্বীপ (Iberian peninsula — বর্তমান স্পেন এবং পর্তুগাল) জয় ছিল মুসলিমদের এক ঐতিহাসিক বিজয়। এমন বিজয় ইসলামের ইতিহাসে বিরল। ৭১১ খ্রিস্টাব্দে এক ছোট্ট মুসলিম সেনাদল আইবেরিয়ার দক্ষিণ উপকূলে এসে পৌঁছায় এবং ৭২০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যেই পুরো আইবেরিয়া উপদ্বীপ মুসলিমদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। কেউ কেউ এই বিজয়কে অ্যাখ্যা দেন ‘সাম্রাজ্যবাদী’ এবং ‘আক্রমণাত্মক’ মুসলিমদের সন্ত্রাস, আতঙ্ক এবং জোর-জবরদস্তির মাধ্যমে খ্রিস্টানদের পরাধীনতার কাহিনী হিসেবে।

১০০০ খ্রিস্টাব্দে আল-আন্দালুস

বাস্তবে, প্রকৃত সত্য এর থেকে অনেক দূরে। এই লড়াই এর প্রেক্ষাপট ও বাস্তবতা খুবই জটিল ছিল। তাই সহজেই “ইসলাম বনাম খ্রিস্টানধর্ম” কিংবা “পূর্ব বনাম পশ্চিম” এর পরিভাষায় আবদ্ধ করে রাখা যাবেনা। মুসলিমদের স্পেন আক্রমণ ছিল এক ন্যায়বিচার, স্বাধীনতা এবং ধর্মীয় সহিষ্ণুতার গল্প। আল-আন্দালুস, কিংবা “মুসলিম স্পেন”-জুড়ে বহুধর্মের মানুষ একসাথে শান্তিতে বসবাস করে এসেছিল শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে। এর ইতিহাস বুঝতে হলে আইবেরিয়াতে মুসলিমদের আক্রমণের পেছনের কারণগুলো সতর্কতার সাথে যাচাই করে দেখতে হবে।

খ্রিস্টান একেশ্বরবাদীগণ

আল-আন্দালুসে মুসলিমদের আগমনের ঘটনা জানতে হলে আমাদেরকে ফিরে যেতে হবে প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মাদ ﷺ এর জন্মের শত বছর পূর্বে। ঈসা (আঃ) এর মৃত্যুর পর খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি হয়। এর ফলে ঘটনা কোনদিকে মোড় নেয় তা জানা খুবই জরুরী।

বর্তমানে যখন খ্রিস্টান ধর্মের প্রায় সকল অনুসারীগণ ‘ত্রিতত্ত্ব’ ধারণায় বিশ্বাসী, ব্যাপারটা সবসময়ই এমন ছিলনা। ত্রিতত্ত্ব হচ্ছে এমন এক বিশ্বাস যেখানে বিশ্বাস করা হয় ঈশ্বরের তিনটা অংশ আছেঃ পিতা, পুত্র ও ‘পবিত্র আত্মা’। ঈসা (আঃ) [যীশু] কে যেখানে ঈশ্বরের পুত্র হিসেবে বলা হয়েছে (নাউজুবিল্লাহ্‌)। অর্থাৎ, অন্য কথায় ঈশ্বরের অংশ হিসেবেই। এই বিশ্বাসের উত্থান হয় ৪০-৬০ খ্রিস্টাব্দের দিকে যখন ‘পল’ নামক এক খ্রিস্টান মিশনারি এই ধারণার সূত্রপাত ঘটান। মূলত খ্রিস্টাধর্মকে বহু ঈশ্বরে বিশ্বাসী রোমান সাম্রাজ্যের মাঝে জনপ্রিয় করে তোলার জন্য।

যারা যীশুর প্রকৃত বাণী একেশ্বরবাদ (একমাত্র ঈশ্বরের উপর বিশ্বাস) এ বিশ্বাস করতো এবং ঈশ্বরের একনিষ্ঠ উপাসনা করতো তাদের কাছে ঈশ্বরে বিশ্বাসের এই নতুন প্রথা খুবই বিরক্তিকর হয়ে ওঠে। ফলে খুব শীঘ্রই খ্রিস্টানধর্মের ইতিহাসের গোড়ার দিকেই গীর্জাতে দু’টি ভিন্ন দলের সৃষ্টি হয়ঃ

১) ত্রিত্ববাদীঃ যারা যীশুকে ঈশ্বরের পুত্র হিসেবে বিশ্বাস করেছিল, তথা ‘ত্রিতত্ত্ব’ ধারণায় বিশ্বাস করেছিল।
২) একেশ্বরবাদীঃ যারা সাদামাটাভাবে প্রকৃত সত্য, তথা যীশুকে ঈশ্বরের একজন বার্তাবাহক হিসেবে গ্রহণ করেছিল।

রোমান সাম্রাজ্যের শাসকবর্গের কাছে এই দুই ভিন্ন দলের মধ্যে কোন ধরনের পার্থক্য ছিলনা। খ্রিস্টাব্দের প্রাথমিক সময়ে ত্রিত্ববাদী এবং একেশ্বরবাদী, উভয় দলই রোমানদের দ্বারা নির্যাতিত হয়েছিল। ঘটনার মোড় নেয় ২য় শতাব্দীর শেষে এবং ৩য় শতাব্দীকের শুরুর দিকে। এ সময়, ‘আরিউস’ নামক লিবিয়ার এক একেশ্বরবাদী ধর্মযাজক উত্তর আফ্রিকায় একেশ্বরবাদ এর বাণী প্রচার করতে থাকেন। দ্রুত তাঁর অনুসরণকারীর সংখ্যাও বাড়তে থাকে। তাঁর মূল বাণী ছিল ঈশ্বরের একত্ববাদ, এবং যীশু ঈশ্বরের বার্তাবাহক মাত্র, পুত্র নয়। যার ফলে তিনি ত্রিত্ববাদীদের তীব্র বিরোধিতার শিকার হন। যারা পরবর্তীতে আরিউসকে আক্রমণও করে এবং ‘পাগল’ উপাধি দিয়ে একঘরে করে ফেলে। ত্রিত্ববাদীদের বিরোধিতা সত্ত্বেও আরিউস এর বিশ্বাস এবং প্রচারণা তার জন্মভূমি, তথা লিবিয়াতে এবং উত্তর আফ্রিকা জুড়ে বিদ্যমান থাকে।

এ সময়ে রোমান সম্রাট ছিলেন কনস্ট্যান্টিন। পতনমুখী রোমান সাম্রাজ্যকে নানা পরিবর্তনের সাধনের মাধ্যমে পুনরায় জাগিয়ে তোলার জন্য রোমান সম্রাটদের মধ্যে তিনি সর্বাধিক পরিচিত। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল রোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী রোম থেকে কনস্ট্যান্টিনোপোল (বর্তমান ইস্তানবুল) এ সরিয়ে নেয়া। নিজের নামানুসারে কনস্ট্যান্টিন শহরটির নামকরণ করেছিলেন। এর মাধ্যমে তিনি বেশকিছু বর্বর জাতিকে পরাজিত করতে পেরেছিলেন যারা বারবার উত্তর দিক থেকে রোমকে আক্রমণ করে আসছিল।

কনস্ট্যান্টিনোপোল এ রাজ্যের রাজধানী স্থানান্তর করার পর কনস্ট্যান্টিন ত্রিত্ববাদীদের যাজকসম্প্রদায়ের ব্যাপারে জানতে পারেন। ত্রিত্ববাদীরা কনস্ট্যান্টিনকে জানায় তিনি যদি খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন তাহলে তার পূর্ববর্তী সব পাপ মোচন হয়ে যাবে। কনস্ট্যান্টিন খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করলেন ঠিকই, তবে ধর্মীয় কারণে নয় বরং রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করার জন্যে। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন ত্রিত্ববাদীদের বাণী প্রচারের মাধ্যমে তিনি নিজের রাজনৈতিক শক্তি আরো জোরদার করতে পারবেন। ফলশ্রুতিতে, তিনি ত্রিত্ববাদীদের বাণী প্রচার করা শুরু করলেন এবং পাশাপাশি আরিউস থেকে শুরু করে সকল একেশ্বরবাদীদের ওপর নির্যাতন শুরু করলেন। এই সময়, ৩২৫ খ্রিস্টাব্দে রোমান সাম্রাজ্যের ‘নিকা’ শহরে একটি পরিষদ গঠিত হয় যাদের উদ্দেশ্য ছিল যীশু কি ঈশ্বরের পুত্র ছিলেন কি ছিলেন না সে ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া।

সম্রাট কনস্ট্যান্টিন এর নির্দেশে পুড়িয়ে ফেলা হচ্ছে আরিউস এর বই

স্বাভাবিকভাবেই পরিষদের নেয়া চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ছিল যীশু ঈশ্বরের একটি অংশ এবং তাঁর পুত্র, এবং যারাই এর বিরোধীতা করবে তাদের সমাজ এবং ধর্মীয় সম্প্রদায় থেকে বহিষ্কার করা হবে। সরকারীভাবে একেশ্বরবাদীদের নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়, যারা ইতিমধ্যেই আইবেরিয়া উপদ্বীপ (স্পেন ও পর্তুগাল) এবং উত্তর আফ্রিকাতে সংখ্যাগরিষ্ঠ। ফলে গোপনে নিজেদের বিশ্বাস ও ধর্মীয় রীতি-নীতি গোপনে পালন করা ছাড়া আর কোন উপায় তাদের ছিলনা। এমনকি কনস্ট্যান্টিন একেশ্বরবাদীদের ধর্মীয় দলিলসমূহ পুড়িয়ে ফেলার নির্দেশ পর্যন্ত দেন, এবং আরিউসকে নির্বাসনে পাঠিয়ে দেন।

স্পেনে ইসলামের অনুপ্রবেশ

একেশ্বরবাদীদের উপর নির্যাতন চলতে থাকে গোটা ৭ম শতাব্দী পর্যন্ত, যখন আইবেরিয়া উপদ্বীপ ‘ইসলাম’ নামে নতুন এক শক্তির সাথে পরিচিত হয়। মুসলিম সেনাবাহিনী যখন রোমান সাম্রাজ্যের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যায়, তখন উত্তর আফ্রিকার একেশ্বরবাদী জনসাধারণ দেখতে পেলো তাদের ধর্মের সাথে এই নতুন ধর্মের অনেক মিল। উভয়েই ঈশ্বরের একত্ববাদে বিশ্বাসী। উভয়েই যীশুকে ঈশ্বরের একজন বার্তাবাহক মনে করে। উভয়েই বিশ্বাস করেন যে গীর্জার ত্রিতত্ত্ব এর পক্ষে অবস্থান হচ্ছে একটি আবিষ্কার, যার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। এভাবে একেশ্বরবাদীরা বুঝতে পারে ইসলাম মূলত একটি ধর্ম যা মূলত যীশুর মূল শিক্ষারই উপসংহার মাত্র, এবং ৭ম শতাব্দীতেই প্রায় গোটা উত্তর আফ্রিকা ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়।

রাসূল ﷺ এর মৃত্যুর পর শত বছরের মধ্যেই উমাইয়াদের নেতৃত্বে নতুন মুসলিম সাম্রাজ্য (উমাইয়া শাসনামলঃ ৬৬১ ― ৭৫০ খ্রিস্টাব্দ) পশ্চিমে আটলান্টিক মহাসাগর থেকে পূর্বে ভারতের সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। মুসলিমদের শাসনব্যবস্থা, ন্যায়বিচার এবং সাম্যের গল্প দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে থাকে নিজেদের সীমানা অতিক্রম করে অন্যান্য জায়গাতেও, বিশেষ করে আইবেরিয়া উপদ্বীপে।

৮ম শতাব্দীর প্রথম দিকে আইবেরিয়ার নিয়ন্ত্রণে ছিল এক অত্যাচারী ভিসিগোথিক রাজা, রডারিক। রোমানদের ত্রিতত্ত্ববাদ নীতিও রডারিক অব্যাহত রাখে এবং নিজের এই বিশ্বাস জনসাধারণের উপরও চাপিয়ে দেয়ার জোর প্রচেষ্টা করে, যদিও জনসাধারণের বেশীরভাগই ছিল একেশ্বরবাদী। মুসলিম ইতিহাসবীদ, বিশেষ করে ইবন খাল্‌দুন, উত্তর আফ্রিকার একজন অভিজাত বংশীয় ব্যক্তি ‘জুলিয়ান’ এর কাহিনী বর্ণনা করেন। জুলিয়ান এর কন্যা রডারিক দ্বারা অপহৃত এবং ধর্ষিত হয়। জুলিয়ান উত্তর আফ্রিকার এক মুসলিম নেতার কাছে যান যার নাম ছিল ‘তারিক বিন জিয়াদ’, এবং রডারিককে অপসারণের ব্যাপারে তাঁর কাছে সাহায্য চান।

ফলশ্রুতিতে, ৭১১ খ্রিস্টাব্দে তারিক এর নেতৃত্বে কয়েক হাজার সৈন্যের এক বাহিনী আইবেরিয়ান পেনিনসুলার দক্ষিণ উপকূলে আক্রমণ করেন। ছোটখাট কিছু বাধা পেরিয়ে তাঁর বাহিনী রডারিক এর বিশাল বাহিনীর মুখোমুখি হন ‘গুতালেতে এর যুদ্ধ’-তে ১৯ জুলাই ৭১১ খ্রিস্টাব্দে। যুদ্ধের ফলাফল ছিল তারিক এর চূড়ান্ত বিজয় এবং রডারিক এর মৃত্যু। ভিসিগোথিকদের রাজসিংহাসন কালের গর্ভে হারিয়ে যায়, মুসলিমরা বাকি আইবেরিয়া জয় করে নেয় ৭ বছরের মধ্যেই।

একেশ্বরবাদীগণ এবং মুসলিমগণ

উপরে বর্ণনা শুনে মুসলিমদের স্পেন বিজয়ের কাহিনী খুব সহজ সরল এক ঘটনা মনে হয়। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে মাত্র কয়েক হাজার সৈন্যের এক বাহিনী মাত্র সাত বছরে ৫ লক্ষ ৮২ হাজার বর্গ কিলোমিটার অঞ্চল জয় করে ফেলবে, ব্যাপারটা বোধগম্য নয়। কিন্তু আইবেরিয়া জুড়ে একেশ্বরবাদীদের উপস্থিতির ব্যাপারটা বিবেচনায় আনলে ব্যাপারটা বোধগম্য মনে হয়।

যখন ৭১১ খ্রিস্টাব্দে আইবেরিয়াতে মুসলিমদের আগমন ঘটে, একেশ্বরবাদীরা তাদের একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী ভাইদেরকে খুশীমনে সাহায্য করে ত্রিত্ববাদে বিশ্বাসী অত্যাচারী সাম্রাজ্যের বিপক্ষে। যার কারণে রডারিক এর বিরুদ্ধে মূল যুদ্ধ হয়ে যাওয়ার পর স্পেনের বেশীরভাগ শহরের অধিবাসীরা কোন যুদ্ধ ছাড়াই তারিক এবং তাঁর সৈন্যবাহিনীর জন্য তাদের শহরের দরজা খুলে দেয়। মুসলিমরা তাদেরকে প্রদান করে ন্যায়পরায়ণ আইন ও বিচার-ব্যবস্থা, নিজ ধর্ম পালনের স্বাধীনতা, এবং বন্ধ করে দেয় অন্যায় ও অন্যায্য সব খাজনা। এসব ঘটনা বিবেচনা করে দেখলে বুঝা যায়, কয়েক বছরের মধ্যেই তারিক এর বাহিনীর গোটা আইবেরিয়া উপদ্বীপ জয় করার ব্যাপারটি মোটেই আশ্চর্যজনক কিছু নয়।

মুসলিমদের স্পেন বিজয় কখনোই একটা বৈদেশিক আক্রমণ কিংবা স্থানীয় অধিবাসীদের অধীনে আনার কোন প্রক্রিয়া ছিল না। বরং এটা ছিল ত্রিত্ববাদে বিশ্বাসী এক অত্যাচারী সাম্রাজ্যের বিপক্ষে একেশ্বরবাদীদের এক অভ্যুত্থান (মুসলিমদের সাহায্য নিয়ে)। মুসলিমরা এই অঞ্চলে বিশেষভাবে আমন্ত্রিত হয়েছিল অন্যায়-অত্যাচারের উৎপাটন এবং ন্যায় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে, যা মুসলিমরা সম্ভব করেছিল স্থানীয় অধিবাসীদের সহায়তা নিয়েই। ন্যায় এবং নৈতিকতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করায় মুসলিমরা শত-সহস্র মানুষের মন জয় করেছিল যারা পরবর্তীতে ইসলাম গ্রহণ করে। এখানে উল্লেখ্য যে, আইবেরিয়ার এমন বিশাল জনসংখ্যার ইসলাম গ্রহণ করার পেছনে একেশ্বরবাদীদের এবং মুসলিমদের বিশ্বাসের অভিন্নতাই এক বড় ভূমিকা পালন করেছিল। ৭১১ খ্রিস্টাব্দে প্রথম আক্রমণের পর ২০০-৩০০ বছরের মধ্যেই স্পেনের ৮০ শতাংশেরও বেশী মানুষ ছিল মুসলিম, সংখ্যায় যা ৫০ লক্ষেরও বেশী। এদের বেশীরভাগই স্পেনের স্থানীয় অধিবাসী, যাদের পূর্বপুরুষগণ ইসলাম গ্রহণ করেছিল, বহিরাগত অভিবাসী নয়।

অনুবাদ করা হয়েছেঃ Christianity and the Muslim Conquest of Spain আর্টিকেল থেকে।
অনুবাদকঃ আহমেদ রাকিব

Bibliography – গ্রন্থপঞ্জিঃ

‘Ata ur-Rahim, Muhammad. Jesus: Prophet of Islam. Elmhurst, New York: Tahrike Tarsile Quran, Inc. , 1991. Print.

Carr, Matthew. Blood and Faith: The Purging of Muslim Spain. New York: The New Press, 2009. Print.

Khaldun, Ibn. Tarikh Ibn Khaldun. Beirut: Dar al-Fikr, 1988. Web. http://shamela.ws/index.php/book/12320 .

গ্রানাডা স্পেনের সর্বশেষ মুসলিম সাম্রাজ্য

৭১১ খ্রিস্টাব্দে আইবেরিয়া উপদ্বীপে (বর্তমান স্পেন ও পর্তুগাল) ইসলাম পৌঁছায়। সেখানকার রাজা রডারিক এর অত্যাচারী শাসনের ইতি ঘটাতে আইবেরিয়ার নির্যাতিত-নিপীড়িত খ্রিস্টানদের থেকে আমন্ত্রণ পাওয়া মুসলিম বাহিনী তারিক বিন জিয়াদের নেতৃত্বে মরক্কো ও স্পেনের মধ্যবর্তী জিব্রাল্টার প্রণালী অতিক্রম করে। এরপর সাত বছরের মধ্যেই আইবেরিয়া উপদ্বীপের বেশিরভাগ অঞ্চলই মুসলিম নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। আর এই অঞ্চলের বিভিন্ন অংশ পরবর্তী ৭০০ বছর ধরে মুসলিম নিয়ন্ত্রণেই থাকে।

১০ম শতকের মাঝামাঝিতে আল-আন্দালুসের ইসলাম স্বর্ণযুগে পৌঁছায়। প্রায় ৫০ লক্ষ মুসলিমের আবাসস্থল হয় আল-আন্দালুস, যা সেখানকার মোট জনসংখ্যার ৮০% এরও বেশী। এক শক্তিশালী, সমৃদ্ধ এবং ঐক্যবদ্ধ উমাইয়া খিলাফত এই অঞ্চল শাসন করছিল। আর আল-আন্দালুস (বা আন্দালুসিয়া) হয়ে উঠেছিল ইউরোপের সবচেয়ে অগ্রগামী এবং স্থিতিশীল অঞ্চল। আল-আন্দালুসের রাজধানী কর্ডোবা আকর্ষণ করছিল গোটা মুসলিম বিশ্বের এবং ইউরোপের জ্ঞানপিপাসুদের। যাই হোক, এই স্বর্ণযুগ আজীবন স্থায়ী ছিলনা। ১১শ শতকের দিকে খিলাফত ভেঙ্গে যায় এবং অসংখ্য ছোট ছোট রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়ে পড়ে যেগুলোকে বলা হতো ‘তাইফা’। মুসলিম তাইফাগুলো বিভক্ত ও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, সাথে সাথে আল-আন্দালুসের উত্তর দিকের খ্রিস্টান রাজ্যগুলো থেকে আক্রমণের আশঙ্কা বেড়ে যায়। পরবর্তী ২০০ বছরে তাইফাগুলো এক এক করে খ্রিস্টান “রিকনকুইস্তা”-র কাছে ধরাশায়ী হতে থাকে। ১২৪০-এর দশকে এসে আল-আন্দালুসের একমাত্র মুসলিম তাইফা বাকি থাকে, সেটা হচ্ছে গ্রানাদা। এই প্রবন্ধে আমরা আইবেরিয়া উপদ্বীপের এই শেষ মুসলিম রাজ্যের পতনের উপর আলোকপাত করব।

[রিকনকুইস্তা (Reconquista) হচ্ছে একটি স্পেনীয় ও পর্তুগীজ শব্দ যার ইংরেজি হচ্ছে Reconquest (অর্থঃ পুনর্দখল)। ঐতিহাসিকরা ৭১৮ বা ৭২২ থেকে ১৪৯২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় ৭৭০ বছরের সময়কালকে “রিকনকুইস্তা” হিসেবে অভিহিত করে থাকেন, যা মূলত খ্রিস্টানদের স্পেন পুনর্বিজয়ের আন্দোলনকে বুঝানো হয়।]

গ্রানাডা আমিরাত
রিকনকুইস্তার সময় আল-আন্দালুসের উত্তরদিক থেকে আসা হানাদার খ্রিস্টান রাজ্যগুলোর হাতে একের পর এক মুসলিম রাজ্যগুলোর পতন হতে থাকে। কর্ডোবা, সেভিয়া এবং টলেডোর মতো বড় বড় শহরগুলোর পতন হয় ১১শ থেকে ১৩শ শতকের মধ্যে। যদিও উত্তর আফ্রিকার মুরাবিতুন এবং মুওয়াহিদুন আন্দোলনগুলো খ্রিস্টানদের আক্রমণের এই স্রোতকে মন্থর করতে সাহায্য করেছিল, তবে মুসলিমদের মাঝে চরম অনৈক্য শেষ পর্যন্ত তাদের রাজ্যহীন ও ভূমিহীনে পরিণত হওয়ার দিকেই ধাবিত করে।

গ্রানাদা আমিরাতের সীলমোহর, যাতে লেখা রয়েছে “আল্লাহ ছাড়া কোন বিজয়ী নেই”

একটিমাত্র মুসলিম প্রদেশ — গ্রানাডা – ১৩শ শতকে খ্রিস্টানদের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছিল। ১২৩৬ খ্রিস্টাব্দে কর্ডোবার পতনের পর গ্রানাদা আমিরাতের শাসকগণ শক্তিশালী খ্রিস্টান ক্যাস্টিলে সাম্রাজ্যের সাথে এক বিশেষ চুক্তি স্বাক্ষর করে। অর্থাৎ তারা “গ্রানাদা আমিরাত” হিসেবে স্বাধীন থাকার অনুমতি পেয়েছিল ঠিকই, কিন্তু ক্যাস্টিলে সাম্রাজ্যের আক্রমণের মুখোমুখি হওয়ার পরিবর্তে তাদেরকে চড়া মূল্যে ক্যাস্টিলে সাম্রাজ্যের কাছে কর প্রদান করতে হয়েছিল। এই কর প্রদান করতে হতো প্রতি বছর স্বর্ণমুদ্রা হিসেবে। এটি গ্রানাদার মুসলিমদের আরো দুর্যোগপূর্ণ অবস্থায় ফেলে দেয় যেহেতু তারা নিজেরাই নিজেদের শত্রুদের কাছে কর প্রদানের মাধ্যমে শত্রুদের ধীরে ধীরে আরো শক্তিশালী করে তুলছিল।

এছাড়াও গ্রানাডা আমিরাতের স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ থাকার পেছনে অন্যান্য আরো কারণগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে এর ভৌগলিক অবস্থান। গ্রানাদা দক্ষিণ স্পেনের সিয়েরা নেভাদা পর্বতমালার মধ্যে অনেক উঁচু স্থানে অবস্থিত যা আক্রমণকারী বহিঃশক্তির বিরুদ্ধে একটা প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করতো। একারণে খ্রিস্টান ক্যাস্টিলে সাম্রাজ্যের চেয়ে সামরিক শক্তির দিক দিয়ে দুর্বল হওয়া সত্ত্বেও এই পর্বতমালা গ্রানাদাকে দিয়েছিল আত্মরক্ষার ক্ষেত্রে বিশাল এক সুবিধা।

গ্রানাডার যুদ্ধ এবং অস্তিত্বের লড়াই
প্রায় ২৫০ বছরেরও বেশী সময় ধরে গ্রানাদা টিকে ছিল শক্তিশালী খ্রিস্টান ক্যাস্টিলে সাম্রাজ্যকে কর প্রদান করে যাওয়ার মাধ্যমে। শত্রুভাবাপন্ন খ্রিস্টান রাজ্যবেষ্টিত হওয়ায় গ্রানাদা প্রতিনিয়ত হুমকির মুখে ছিল। ১৫শ শতকের শুরুর দিকে আল-আন্দালুসের সর্বশেষ এই রাজ্য নিয়ে এক মুসলিম স্কলার লিখেছিলেনঃ

“গ্রানাডা কি এক উত্তাল সমুদ্র এবং ভয়ানক অস্ত্রশস্ত্র-সজ্জিত হিংস্র এক শত্রু দ্বারা বেষ্টিত নয়, যারা উভয়ই রাতদিন গ্রানাদার জনগণের উপর ভীতির সঞ্চার করে?”

খ্রিস্টানদের গ্রানাডা বিজয়ের মূল চালিকাশক্তিটি আসে ১৪৬৯ খ্রিস্টাব্দে, যখন অ্যারাগন রাজ্যের রাজা ফার্দিনান্দ এবং ক্যাস্টিলে রাজ্যের রাণী ইসাবেলা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়। এর মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ হয় আইবেরীয়া উপদ্বীপের সবচেয়ে শক্তিশালী দু’টি খ্রিস্টান রাজ্য। একজোট হয়েই তারা তাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ করে গ্রানাডার দিকে, উপদ্বীপের সর্বশেষ এই মুসলিম রাজ্যকে সমূলে উৎপাটন করাই হয়ে পড়ে তাদের লক্ষ্য।

রাজা ফার্দিনান্দ এবং রাণী ইসাবেলা আল-আন্দালুসের সর্বশেষ মুসলিম আমিরাত ধ্বংসের জন্য উঠেপড়ে লাগেন

১৪৮২ খ্রিস্টাব্দে স্পেনের এই নতুন খ্রিস্টান রাজ্যের সাথে গ্রানাডা আমিরাতের যুদ্ধ শুরু হয়। শক্তিমত্তার দিক দিয়ে অপেক্ষাকৃত অনেক দুর্বল হওয়া সত্ত্বেও গ্রানাডার মুসলিমরা নির্ভীক হয়ে বীরের মতো যুদ্ধ করে। এক স্পেনীয় খ্রিস্টান গল্পকার মুসলিম সৈন্যদের বীরত্বের প্রতি সম্মান জানিয়ে বলেন, “মুসলিমরা তাদের সর্বশক্তি দিয়ে এবং হৃদয় উজাড় করে যুদ্ধ করেছে ঠিক যেমনটা একজন সাহসী ও নির্ভীক ব্যক্তি তাঁর নিজের, নিজের স্ত্রী ও সন্তানদের জীবন রক্ষা করতে করে থাকে।” এই যুদ্ধে মুসলিম জনসাধারণ এবং গ্রানাডা আমিরাত সেনাবাহিনীর সৈন্যগণ অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে নিজেদের অস্তিত্বের জন্য লড়াই করেছে, আল-আন্দালুসের ইসলামকে বাঁচানোর জন্য লড়াই করেছে। অন্যদিকে মুসলিম শাসকদের ভূমিকা ছিল সম্পূর্ণ উল্টো, তারা তেমন সাহসিকতা ও বীরত্বের পরিচয় দিতে পারেননি।

যুদ্ধের গোটা সময়জুড়ে খ্রিস্টানরা ঐক্যবদ্ধ ছিল এবং নিজেদের মধ্যে কোন রকমের দ্বন্দ্ব-বিবাদ কিংবা দলাদলিতে জড়িত হয়ে পড়েনি। যদিও অতীতে এমন ঘটনা খ্রিস্টানদের মাঝে অহরহ ঘটতো। এমন ঘটনা ছিল খ্রিস্টানদের মাঝে খুবই স্বাভাভিক এক ব্যাপার। অন্যদিকে মুসলিমদের অভ্যন্তরীণ দলাদলির কারণে গ্রানাডা বড় এক রাজনৈতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। মুসলিম নেতা ও গভর্ণরেরা একে অপরের সাথে বিবাদে জড়িয়ে পড়ছিল এবং একে অপরকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য বিভিন্ন ধরনের ফন্দি আঁটতে ব্যস্ত ছিল। এদের বেশিরভাগই আবার অর্থ-সম্পদ, ভূমি এবং ক্ষমতার বিনিময়ে গোপনে বিভিন্ন খ্রিস্টান রাজ্যের যোগসাজশে কাজ করে যাচ্ছিল। আর এতো খারাপ পরিস্থিতির মধ্যেও সবচেয়ে খারাপ ঘটনাটি ছিল গ্রানাডা আমিরাতের সুলতানের ছেলে মুহাম্মাদের বিদ্রোহের ঘটনা। ১৪৮৩ খ্রিস্টাব্দে, যুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রায় এক বছর পরে মুহাম্মাদ তার পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করে গ্রানাডায় তুমুল এক গৃহযুদ্ধ বাধিয়ে দেয়। আর একই সময়ে খ্রিস্টান স্প্যানীয় বাহিনীও বাহির থেকে গ্রানাদায় আক্রমণ করা শুরু করে।

রাজা ফার্দিনান্দ এই গৃহযুদ্ধকে নিজের সুবিধার্থে কাজে লাগায়। গ্রানাডা আমিরাতকে সামগ্রিকভাবে দুর্বল এবং মেরুদণ্ডহীন করে দেয়ার জন্য সে মুহাম্মাদকে তার পিতার বিরুদ্ধে (এবং পরবর্তীতে মুহাম্মাদের চাচাকেও) বিদ্রোহে সহায়তা করে। মুহাম্মাদকে নিজের পরিবারের বিরুদ্ধে এই লড়াইয়ে ফার্দিনান্দ অস্ত্র ও যোদ্ধা দিয়ে সহায়তা করে এবং শেষ পর্যন্ত মুহাম্মাদ সফলও হয়। গোটা বিদ্রোহের সময়জুড়ে খ্রিস্টান বাহিনী ধীরে ধীরে গ্রানাদা আমিরাতের সীমান্তে চাপ প্রয়োগ করতে করতে আমিরাতের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রবেশ করতে থাকে এবং দখল করতে থাকে। ফলে ১৪৯০ খ্রিস্টাব্দে মুহাম্মাদ যখন বিদ্রোহে জয়ী হয়ে ক্ষমতা নিজের হাতে কুক্ষিগত করে, ততদিনে শুধুমাত্র গ্রানাদা শহরটিই তার শাসনাধীন অঞ্চল হিসেবে থাকে এবং গ্রাম অঞ্চলের সমগ্র অংশ খ্রিস্টানদের হাতে চলে যায়।

গ্রানাডার সর্বশেষ প্রতিরোধ
গ্রানাডায় মুহাম্মাদের ক্ষমতা ও শাসন পাকাপোক্তভাবে প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর তার কাছে রাজা ফার্দিনান্দ একটি চিঠি পাঠায়। চিঠিতে রাজা ফার্দিনান্দ মুহাম্মাদকে চিঠি পাওয়া মাত্রই আত্মসমর্পণ করার ও গ্রানাডাকে খ্রিস্টানদের হাতে তুলে দেয়ার নির্দেশ দেয়। ফার্দিনান্দের এই দাবিতে মুহাম্মাদ খুবই বিস্মিত ও হত-বিহ্বল হয়ে পড়ে কারণ ফার্দিনান্দ ইতিপূর্বে তাকে বুঝিয়েছিল যে সে তাকে গ্রানাডা শাসন করার অনুমতি দিবে। পরিষ্কারভাবে, বহু দেরীতে হলেও মুহাম্মাদ বুঝতে পারে যে আসলে গ্রানাডা দুর্বল করার জন্য ফার্দিনান্দ তাকে দাবাখেলার এক গুটি হিসেবে ব্যবহার করেছে মাত্র।

খ্রিস্টানদেরকে সামরিকভাবে প্রতিরোধ করতে মুহাম্মাদ উত্তর আফ্রিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে বিভিন্ন মুসলিম সাম্রাজ্যের কাছে সাহায্যের আবেদন করে। কিন্তু কেউই তার এই ডাকে সাড়া দেয়নি, শুধুমাত্র ওসমানী সাম্রাজ্যের নৌবাহিনীর এক ছোট্ট অংশ স্পেনীয় উপকূলে হানা দিয়েছিল তবে তাও তেমন কোন কাজে আসেনি। ১৪৯১ খ্রিস্টাব্দের শেষদিকে ফার্দিনান্দ ও ইসাবেলার সেনাবাহিনী গ্রানাদা শহর চতুর্দিক দিয়ে ঘেরাও করে ফেলে। মুহাম্মাদ তার আলহাম্বরা প্রাসাদের মিনার থেকে দেখতে পায় যে খ্রিস্টান বাহিনী গ্রানাডা শহর বিজয়ের জন্য জড়ো হচ্ছে এবং আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে মুহাম্মাদ সবকিছু অন্ধকার দেখতে পায় এবং শেষমেশ কোন উপায়ান্তর না দেখে ১৪৯১ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে খ্রিস্টানদের সাথে একটি চুক্তি করে যা খ্রিস্টানদেরকে গ্রানাডা শহরের নিয়ন্ত্রণ দিয়ে দেয়।

২ জানুয়ারী ১৪৯২ খ্রিস্টাব্দে আলহাম্বরা প্রাসাদে খ্রিস্টান সাম্রাজ্যসমূহের পতাকা এবং ক্রস বা ক্রুশচিহ্ন লাগিয়ে দেয়া হয়

২ জানুয়ারী ১৪৯২ খ্রিস্টাব্দে এই চুক্তি কার্যকর হয় এবং স্পেনীয় বাহিনী গ্রানাডায় প্রবেশ করে আনুষ্ঠানিকভাবে আল-আন্দালুসের সর্বশেষ মুসলিম রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ নেয়। খ্রিস্টান সৈন্যরা সকাল বেলা ঐতিহাসিক আলহাম্বরা প্রাসাদে প্রবেশ করে এবং তাদের বিজয়ের চিহ্ন হিসেবে প্রাসাদের দেয়ালে দেয়ালে বিভিন্ন স্পেনীয় খ্রিস্টান রাজবংশ, রাজা-রাণীদের পতাকা ও নিশান লাগাতে থাকে। প্রাসাদের সবচেয়ে উঁচু মিনারের উপরে সৈন্যরা রূপার তৈরী বিশাল এক ক্রুশ্চচিহ্ন বা ক্রস খাড়াভাবে স্থাপন করে এবং এর মাধ্যমে গ্রানাডার ভীত সন্ত্রস্ত মুসলিম অধিবাসীদের জানিয়ে দেয় যে খ্রিস্টান-বিশ্ব মুসলিমদের আল-আন্দালুসের বিরুদ্ধে বিজয়ী হয়েছে। শহরের মুসলিম অধিবাসীরা ঘর থেকে বের হতে সাহস পাচ্ছিলনা এবং শহরের রাস্তাগুলো জনমানবশূন্য হয়ে পড়ে।

সুলতান মুহাম্মাদকে নির্বাসনে পাঠিয়ে দেয়া হয়। গ্রানাডা ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় পথে সুলতান এক পর্বতমালার গিরিপথে থেমে গ্রানাদার দিকে ফিরে তাকায় এবং কাঁদতে আরম্ভ করে। তার এই আকস্মিক অনুশোচনা ও আক্ষেপে তার মা কোনরূপ প্রভাবিত না হয়ে বরং তাকে তিরস্কার করে বলেনঃ

“যে জিনিষ তুমি একজন পুরুষ হয়ে রক্ষা করতে পারোনি সে জিনিষের জন্য নারীদের মতো কান্নাকাটি করোনা।”

যদিও বিজয়ী খ্রিস্টানরা গ্রানাডার অধিবাসীদের ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং বেশকিছু সুবিধাজনক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তবে শীঘ্রই সকল প্রতিশ্রুতিই ভঙ্গ করা হয়। ১৫০২ খ্রিস্টাব্দে আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলামকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়, ফলে শত-সহস্র মুসলিম অধিবাসী উত্তর আফ্রিকায় হিজরত করতে কিংবা ধর্মীয় বিশ্বাস গোপন করতে বাধ্য হয়। ১৭শ শতকের শুরুর দিকে এসে গোটা স্পেনে আর একজন মুসলিমের অস্তিত্বও খুঁজে পাওয়া যায়না।

১১শ শতকে মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তি থেকে ১৫শ শতকের শেষদিকে এসে শক্তিহীন এক রাজ্যে পরিণত হয়ে খ্রিস্টানদের অধীনে চলে যাওয়া— আন্দালুসিয়ার পতনের এই গল্প ইসলামের ইতিহাসে অদ্বিতীয়। মুসলিমদের নিজেদের মাঝে প্রতিনিয়ত দ্বন্দ্ব-বিবাদ, অন্যান্য মুসলিম সাম্রাজ্যগুলোর সমর্থন ও সাহায্যের অভাব এবং ইসলামী ঐক্যের বদলে ব্যক্তিগত স্বার্থ ও ক্ষমতাকে প্রাধান্য দেয়া এসবকিছুই আল-আন্দালুসকে পতনের দিকে ঠেলে দিয়েছে। আর ১৪৯২ খ্রিস্টাব্দে গ্রানাদা পতনের মাধ্যমে, এই গল্পেরও ইতি ঘটে।

অনুবাদ করা হয়েছেঃ Granada – The Last Muslim Kingdom of Spain আর্টিকেল থেকে।
অনুবাদকঃ মুরাদ গাজী খান

Bibliography:

Carr, Matthew. Blood and Faith: The Purging of Muslim Spain. New York: The New Press, 2009. Print.

Najeebabadi, Akbar Shah. The History of Islam. 3. Riyadh: Darussalam, 2001. Print.

মদীনা সনদ – পৃথিবীর সর্বপ্রথম লিখিত সংবিধান ।

হজরত মুহাম্মদ (সা.) দৃঢ় ভিত্তির ওপর ইসলামী রাষ্ট্রের বুনিয়াদ প্রতিষ্ঠা করতে সচেষ্ট হন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, সাম্রাজ্যের সব সম্প্রদায়ের লোকের সহযোগিতা ও সমর্থন না পেলে রাষ্ট্রের ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়বে। যে দেশে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীর বাস সে দেশে সব ধর্মের প্রতি সহিষ্ণুতা বিশেষ প্রয়োজন। এদিক থেকে হজরতের নীতি ছিল- ‘নিজে বাঁচ এবং অপরকেও বাঁচতে দাঁও।’ তিনি মদিনা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলসমূহের মুসলমান, ইহুদি ও পৌত্তলিকদের নিয়ে একটি সাধারণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। তদনুসারে এ তিন সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি আন্তর্জাতিক সনদ স্বাক্ষরিত হয়। এটা ‘মদিনার সনদ’ নামে পরিচিত। এর ধারাগুলো নিচে উল্লেখ করা হলো –

(০১) এটি নবী মুহাম্মাদ (সাঃ) হতে (জারীকৃত) একটি দলিল, যার ভিত্তিতে মুমিন, কুরাইশ ও ইয়াসরিব (মদীনার) গোত্রভূক্ত মুসলিম, এবং যারা তাদের অনুসারী কিংবা তাদের সাথে কর্মের বন্ধনে (বা লেনদেনে) আবদ্ধ, তাদের সকলের পারষ্পরিক সম্পর্ক নির্ধারিত হবে। তারা সকলে মিলে এক জাতিগোষ্ঠী- একটি উম্মাহ হিসেবে পরিগণিত হবে।

(০২) কুরাইশ মুহাজিরগণ তাদের প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী রক্তপণ আদায় করতে থাকবে।

(০৩) যে কোন যুদ্ধে যুদ্ধবন্দীদেরকে দয়া এবং ইনসাফপূর্ণ রীতিতে ব্যবহার করা হবে, যা মুমীনদের স্বভাবসুলভ। (জাহেলীযুগের প্রচলিত সহিংসতা এবং শ্রেণীভেদ বর্জনীয়)

(০৪) বনি আউফ (মদীনার একটি মূল গোত্র) তাদের মধ্যকার রক্তপণ নির্ধারণ করবে, তাদের প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী।

(০৫) যে কোন যুদ্ধে, যদিও তা মুসলিম বাদে অপর গোত্রগুলোর মধ্যেও সংঘটিত হয়, সে ক্ষেত্রেও যুদ্ধবন্দীদের প্রতি দয়াদ্র এবং ইনসাফপূর্ণ আচরণ করতে হবে, ইসলামপূর্ব রীতিতে নয়।

(০৬) বনি সা’য়েদা, বনি হারিছ, বনি জুশাম এবং বনি নাজ্জারও উপরোক্ত মূলনীতি অনুযায়ী পরিচালিত হবে।

(০৭) বনি আমর, বনি আউফ, বানি আন-নাবিত এবং বনি আল আউসও একই মূলনীতি অনুসরণ করবে।

(০৮) বিশ্বাসী মুসলিমগণ তাদের যুদ্ধবন্দীদের মুক্ত করার জন্য মুক্তিপণের ব্যবস্হা করবে, এবং এ দায়িত্ব সামগ্রিকভাবে উম্মাহ (জাতিগোষ্ঠী)-এর সকলের উপরেই বর্তাবে, শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট পরিবারের উপরে নয়।

(০৯) কোন মু’মিন অপর মু’মিনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার আজাদকৃত দাসের সাথে মিত্রতা গড়ে তুলবে না।

(১০) আল্লাহকে ভয় করে এমন সকল মু’মিন, যেকোন ধরণের বিশ্বাসঘাতকদের প্রতিরোধ করবে। সেই সাথে যারাই (জুলম) বেইনসাফি, পাপাচার, দূর্নীতি কিংবা শত্রুতার ইন্ধনদাতা তাদেরকে প্রতিরোধ করবে।

(১১) এ ধরণের কার্যক্রমে জড়িত যে কেউ, এমনকি সে যদি আপন পুত্র বা স্বজনদের মধ্য হতেও হয়, তাকেও ছাড় দেয়া হবেনা।

(১২) কোন মু’মিন অপর কোন মু’মিন ভাইকে হত্যা করবে না, কোন কাফিরের স্বার্থে (এমনকি সে কাফির যদি তার নিকটাত্নীয়ও হয়)।

(১৩) কোন বিশ্বাসী মু’মিন কোন কাফিরকে অপর বিশ্বাসী মু’মিনের বিরুদ্ধে সহায়তা করবে না।

(১৪) আল্লাহর নামে দেয়া সুরক্ষা সকলের জন্যই মান্য এবং প্রযোজ্য হবে। মু’মিনদের মধ্যে দূর্বলতম কেউ যদি কাউকে সুরক্ষার প্রতিশ্রুতি দেয়, তা সকল মু’মিনের জন্য অবশ্যপালনীয় হবে।

(১৫) সকল বিশ্বাসী মু’মিন (গোত্র নির্বিশেষে) পরষ্পর বন্ধু হিসেবে পরিগণিত হবে।

(১৬) যে সকল ইহুদী মু’মিনদের মিত্র হবে, তাদেরকে সকল প্রকার সহায়তা করা হবে, এবং তাদের সমানাধিকার স্বীকৃত হবে। (রাষ্ট্রের আনুগত্য স্বীকার সাপেক্ষে তারা অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং আইনগত সকল অধিকার ভোগ করবে)

(১৭) কোন ইহুদীকেই ইহুদী হওয়ার জন্য কোন প্রকার বৈষম্য করা হবেনা।

(১৮) ইহুদীদের শত্রুদের (এমনকি সে যদি বিশ্বাসীদের মিত্রও হয়) সহায়তা করা হবে না।

(১৯) মদীনার অধিবাসীদের সাথে আংশিক শান্তিচুক্তি অগ্রহনযোগ্য। (অর্থ্যাৎ মদীনার অধিবাসী সকলে একই শত্রুতা বা মিত্রতার অধীন, আলাদা আলাদা ভাবে নয়)

(২০) মু’মিনগণ যখন আল্লাহর রাস্তায় জিহাদে লিপ্ত থাকবে, সে যুদ্ধাবস্হায় মদীনার কারো সাথে আলাদাভাবে মিত্রতা চুক্তি করা যাবেনা।

(২১) যুদ্ধাবস্হা বা শান্তির সময়কার সকল শর্তাবলী, এবং অবস্হাসমূহ মদীনার সকলের উপরেই সমভাবে প্রযোজ্য হবে।

(২২) যে কোন যুদ্ধযাত্রায়, একজন ঘোড়সওয়ার একজন সহযোদ্ধার সাথে তার বাহন ভাগাভাগি করবে।

(২৩) একজন মু’মিন আল্লাহর পথে লড়াই রত অপর বিশ্বাসী মু’মিনের রক্তের প্রতিশোধ নেবে।

(২৪) বিশ্বাসী মু’মিনগণ ঈমানের বলে বলীয়ান এবং কুফরের বিরুদ্ধে দৃঢ়পদ, এবং ফলশ্রুতিতে আল্লাহর প্রদত্ত হিদায়েতের সম্মানে ভুষিত। অপরাপর গোত্রসমূহও এ মর্যাদা অর্জনে অভিলাষী হওয়া উচিৎ।

(২৫) কোন কাফির মক্কার কুরাইশদের (যুদ্ধলব্ধ) শত্রুসম্পত্তি নিজ আওতায় রাখার অধিকার রাখেনা। যেকোন শত্রু সম্পত্তি রাষ্ট্রের জিম্মায় প্রত্যার্পন করতে হবে।

(২৬) কোন কাফির/অবিশ্বাসী কুরাইশদের সপক্ষে সুপারিশ করবে না কেননা কুরাইশগন মদীনা নিবাসীদের সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে।

(২৭) যদি কোন কাফির কোন মু’মিনকে হত্যা করে, কোন যথাযথ কারণ ব্যতীত- তবে তাকেও হত্যা করা হবে, যতক্ষণ না তার স্বজনেরা সন্তষ্ট হয়। সকল মু’মিন এ ধরণের খুনীর বিপক্ষে থাকবে এবং হত্যাকারীকে কখনোই আশ্রয় বা প্রশ্রয় দেবেনা।

(২৮) কোন ব্যাপারে পারষ্পরিক মতবিরোধের ক্ষেত্রে সে’টি সমাধানের জন্য আল্লাহ ও তার রাসূল (সাঃ)- এর কাছে ন্যস্ত করা হবে।

(২৯) ইহুদীরাও যে কোন যুদ্ধে সহযোগিতায় মু’মিনদের সাথে সমভাবে অবদান রাখবে।

(৩০) বনি আউফ গোত্রের অধীন ইহুদীগণ মু’মিনদের সাথে একই সমাজের অধীন হিসেবে পরিগণিত হবে। তাদের মুক্ত গোলামদের জন্যও একই বিধান প্রযোজ্য হবে। যারা অন্যায় এবং পাপাচারে লিপ্ত, তাদের এবং তাদের পরিবারবর্গের জন্য এ ঘোষণা প্রযোজ্য হবে না।

(৩১) বনি নাজ্জার, বনি আল হারিস, বনি সায়েদা, বনি জুশাম, বনি আল আউস, সা’লাবা এবং জাফনা এবং বনি শুতাইবা গোত্রভূক্ত সকল ইহুদীদের জন্যও উপরোক্ত ঘোষণা প্রযোজ্য হবে।

(৩২) আস্হা এবং আনুগত্যই বিশ্বাসঘাতকতার দূর্বলতার প্রতিষেধক।

(৩৩) সা’লাবা গোত্রের আজাদকৃত দাস, সা’লাবা গোত্রের সমান মর্যাদার অধিকারী হবে। এ সমানাধিকার প্রযোজ্য হবে ভারসাম্যপূর্ণ লেনদেন, যথার্থ নাগরিক দায়িত্ব পালন এবং যুদ্ধে অংশগ্রহনে।

(৩৪) যারা ইহুদীদের সাথে মিত্রতা চুক্তিতে আবদ্ধ, তাদের সাথে সেমতেই আচরণ করা হবে।

(৩৫) এ চুক্তিনামায় অংশীদার কেউই মুহাম্মাদ (সাঃ)- এর অনুমতি ব্যতিরেকে যুদ্ধ যাত্রা করতে পারবে না। যে কোন অন্যায়ের প্রতিবিধান করা হবে।

(৩৬) যে কেউ কোনধরণের সতর্কবার্তা ব্যতীত অন্যায়ভাবে অপরকে হত্যা করলে সে নিজেকে এমনকি তার পরিবারবর্গকে হত্যার যোগ্য করে তুলবে।

(৩৭) মুসলিম এবং ইহুদী, উভয়েই তাদের নিজ নিজ যুদ্ধযাত্রার খরচ বহন করবে।

(৩৮) যেকোন বহিঃশত্রুর আক্রমণে, উভয়েই একে অপরের নিরাপত্তাবিধানে এগিয়ে আসবে।

(৩৯) চুক্তিবদ্ধ সকল পক্ষই পারষ্পরিক মন্ত্রণা এবং পরামর্শে অংশ নেবে।

(৪০) আস্হা এবং আনুগত্যই বিশ্বাসঘাতকতার দূর্বলতার প্রতিষেধক। যারা পারষ্পরিক পরামর্শকে অবজ্ঞা করে তারা মূলতঃ আস্হা এবং আনুগত্যের সংকটে ভুগে।

(৪১) কোন ব্যক্তি তার মিত্রদের কাজের দায় বহন করবে না।

(৪২) কারো প্রতি জুলম করা হলে তার সহায়তা করা সকলের অবশ্যকর্তব্য।

(৪৩) ইহুদীরা কোন যুদ্ধে অংশ না নিলেও সে যুদ্ধের খরচ বহনে সহায়তা করবে।

(৪৪) চুক্তিবদ্ধ সকলের জন্য ইয়াসরিব (মদীনা) হবে নিরাপত্তার শহর।

(৪৫) কোন অপরিচিত ব্যক্তি চুক্তিভুক্ত যে গোত্রের মিত্রতায় আবদ্ধ, তাকে সে গোত্রের একজন হিসেবেই আচরণ করা হবে, যতক্ষন পর্যন্ত সে কোন অন্যায় অথবা বিশ্বাসঘাতকতা না করছে। রাষ্ট্রবিরোধী যে কোন উস্কানীমূলক কার্যকলাপ শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

(৪৬) কোন নারীকে কেবলমাত্র তার গোত্রের অনুমতিক্রমেই অপর কেউ নিরাপত্তাধীন করতে পারবে।

(৪৭) কোন ধরণের মতবিরোধ কিংবা মতদ্বৈততার ক্ষেত্রে, যা পারষ্পরিক বিবাদের কারণ হতে পারে, সে’টি আল্লাহ এবং তার রাসূলের (সাঃ) নিকট সমাধানের জন্য ন্যস্ত করা হবে। তিনি এ দলীলের মধ্যকার যথার্থ কল্যাণকর অংশ অনুসরণ করবেন।

(৪৮) কুরাইশ এবং তাদের মিত্রদের সাথে কোন প্রকার নিরাপত্তাচুক্তি নয়।

(৪৯) মদীনার উপরে যেকোন আক্রমন, এ চুক্তিবদ্ধ সকলেই সমভাবে প্রতিহত করবে।

(৫০) যদি এ চুক্তির মুসলিম ব্যতীত অপর পক্ষসমূহ কারো সাথে কোন প্রকার শান্তিচুক্তিতে আবদ্ধ হয়, তবে তারা তা মান্য করবে। যদি মুসলিমদেরকেও এ শান্তিচুক্তি মান্য করতে আহবান করা হয়, তারা সেটাকে মান্য করবে, শুধুমাত্র যখন তারা আল্লাহর রাস্তায় জিহাদে লিপ্ত সে সময় ব্যতীত।

(৫১) প্রত্যেকেই তার নিজস্ব দল বা গোত্রের কর্মকান্ডের দায়িত্ব বহন করবে, ভালো কিংবা মন্দ। গোত্রীয় শৃংখলা রক্ষায় এর বিকল্প নেই।

(৫২) আল আউস গোত্রভুক্ত ইহুদী এবং তাদের আজাদকৃত দাসগণ, যতদিন এ চুক্তি মান্য করবে, ততদিন পর্যন্ত সমানাধিকার ভোগ করবে। আস্হাই বিশ্বাসঘাতকতার প্রতিষেধক।

(৫৩)যে কেউ আস্হার সাথে কাজ করবে, তা তার নিজের জন্যই কল্যানকর হবে।

(৫৪) আল্লাহ এই চুক্তিকে অনুমোদন দিয়েছেন।

(৫৫) কোন অপরাধী কিংবা অন্যায়কারীকে এ চুক্তি নিরাপত্তা দেয় না।

(৫৬) এ চুক্তির আওতাধীন যে কেউ, চাই সে যুদ্ধক্ষেত্রে থাকুক কিংবা স্বগৃহে অবস্হান করুন, নিরাপত্তাধীন হবে যতক্ষণ পর্যন্ত কোন অন্যায় অপরাধ সংঘটন করে (ব্যক্তিগত দূর্বলতার কারণে যুদ্ধে অংশ না নিলে তা শাস্তিযোগ্য হবে না)।

(৫৭) আল্লাহ তাদেরকেই রক্ষা করেন যারা সৎ এবং তাঁকে ভয় করে, এবং মুহাম্মাদ সাঃ তাঁর প্রেরিত রাসূল।

সনদের ফলাফল : মদিনার সনদ মদিনার রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও নাগরিক জীবনে বিরাট পরিবর্তন আনে। প্রথমত, এ সনদ রাজনৈতিক ঐক্য স্থাপনে সাহায্য করে। হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর নেতৃত্বে নিয়ত যুদ্ধরত গোত্রগুলোর শহর শান্তিপূর্ণ প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয়। দ্বিতীয়ত, আল্লাহর রসুলের দেওয়া নতুন সংবিধান অনুযায়ী এটা গৃহযুদ্ধ ও অনৈক্যের স্থলে শান্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করে। নবী কারিম (সা.) মদিনার প্রত্যেক মানুষের (মুসলমান বা ইহুদি) জানমালের নিরাপত্তা বিধান করেন। তৃতীয়ত, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মদিনার সব নাগরিককে এ সনদ সমানাধিকার দান করে। চতুর্থত, এটা মদিনার মুসলমান ও অমুসলমানদের মধ্যে সম্প্রীতি গড়ে তোলে এবং মোহাজেরদের মদিনায় বসবাসের জীবিকা উপার্জনের ব্যবস্থা করে। পঞ্চমত, মদিনায় ইসলামের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ক্ষমতা বৃদ্ধি করে, এ সনদ প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করে।

মদিনার সনদের গুরুত্ব : মদিনার সনদ হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, কূটনৈতিক দূরদর্শিতা ও অসাধারণ প্রতিভার পরিচয় বহন করে। তার প্রণীত সনদ ‘দুনিয়ার ইতিহাসে সর্বপ্রথম লিখিত শাসনতন্ত্র’। এটা নাগরিক সাম্যের মহান নীতি, আইনের শাসন, ধর্মের স্বাধীনতা ও ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ঘোষণা করে। তাই এটাকে ইসলামের ‘মহাসনদ’ বলা হয়।

মদিনার সনদে সব সম্প্রদায়ের শুভেচ্ছা ও সহযোগিতার প্রয়োজনকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। গোত্র প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিলুপ্ত না করে প্রত্যেকের ধর্মীয় স্বাধীনতাকে অক্ষুণ্ন রেখে এ সনদ উদারতার ভিত্তিতে একটি বৃহত্তর জাতি গঠনের পথ উন্মুক্ত করে।

এ সনদের দ্বারা আল্লাহর সার্বভৌমত্বকে স্বীকার করা হয়। রাষ্ট্র ও ধর্মের সহাবস্থানের ফলে ঐশীতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। বস্তুত, মদিনার সনদ ইসলামী প্রজাতন্ত্রের বীজ বপন করে। ঐতিহাসিক বার্নার্ড লুইসের মতে, এ দ্বৈত সনদ (ধর্ম ও রাজনীতি) তখন আরবে অপরিহার্য ছিল। সে সময়ে রাষ্ট্রব্যবস্থার মাধ্যম ছাড়া ধর্ম সংগঠিত হওয়ার উপায় ছিল না। রাজনৈতিক দিক থেকে পশ্চাৎপদ আরবদের কাছে ধর্ম ছাড়া রাষ্ট্রের মূলভিত্তি গ্রহণীয়ও হতো না। অধ্যাপক হিট্টি বলেন, ‘পরবর্তীকালের বৃহত্তর ইসলামী রাষ্ট্রের ভিত্তিমূল ছিল মদিনার প্রজাতন্ত্র।’

মদিনার সনদের দ্বারা হজরতের ওপর মদিনার শাসনতান্ত্রিক কর্তৃত্ব অর্পিত হয়। কুরাইশদের বিরুদ্ধে ইসলাম প্রচারের ক্ষেত্রে এটা তার ক্ষমতা ও মর্যাদাকে যথেষ্ট বৃদ্ধি করে। সনদের শর্ত ভঙ্গ করার অপরাধে নবী কারিম (সা.) ইহুদিদের মদিনা থেকে বহিষ্কৃত করেন। এ সনদে সংঘর্ষ বিক্ষুব্ধ মদিনার পুনর্গঠনে হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর পরিকল্পনা ঘোষণা করা হয়েছে। যুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত আরব জাহানকে একতাবদ্ধ করার একটি মহৎ পরিকল্পনাও এতে ছিল। মদিনার সনদ দ্বারা এটাও প্রমাণিত হয়, হজরত মুহাম্মদ (সা.) শুধু ধর্ম প্রচারকই ছিলেন না, তিনি পৃথিবীর একজন শ্রেষ্ঠ রাজনীতিজ্ঞও ছিলেন। উইলিয়াম মূরের মতে, ‘হজরতের বিরাট ব্যক্তিত্ব ও অপূর্ব মননশীলতা শুধু তৎকালীন যুগের নয়, বরং সর্বযুগের ও সর্বকালের মহামানবের জন্য শ্রেষ্ঠত্বের পরিচায়ক।

চাঁদকে ঘিরে তারাদের মেলা

মূল : আল্লামা সায়্যিদ আব্দুল মজীদ নাদীম রূপান্তর- তাহমীদ বিন ইকরাম ।

আল্লাহর রাসুল বসেছেন প্রিয় সাহাবিদেরকে নিয়ে। আবু বকর, উমর, উসমান, আলী আরো কতো প্রোজ্জ্বল তারকা মেলা জুড়েছে পূর্ণিমা চাঁদের সান্নিধ্যে। সবাই তাকিয়ে আছে অপলক নেত্রে। কী বলেন আল্লাহর মহান দূত! নবীজী বললেন, পৃথিবীতে আমার কাছে তিনটি জিনিস সবচে প্রিয়। সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে এক অদ্ভুত আলোড়ন শুরু হলো। কী সেই সৌভাগ্যবান জিনিসগুলো, আল্লাহর রাসুল যেগুলোকে নিজের প্রিয় বলেছেন! মহানবী সা. নিজেই বলে ফেললেন, খুশবু, খুশবুই আমার প্রিয় জিনিসগুলোর প্রথম।

আসলে নবীজীর পবিত্র সত্তাই ছিল সম্পূর্ণ সুগন্ধিময়। হযরত উম্মে সুলাইম রা. বলছেন। “একদিন দেখি, কোথেকে জানি এক অপূর্ব মনমাতানো খুশবু বেসে আসছে। আমি তো অবাক! হঠাৎ দেখতে পেলাম যে আল্লাহর রাসুল সা. আমার বাড়ির পথ ধরেই এগিয়ে আসছেন। ধীরে ধীরে সুঘ্রাণ তীব্র হলো। আমি নিশ্চিত হলাম যে, এটি নবীজীর গা’মোবারক থেকেই নিঃসৃত। রাসুল সা. আমার বাড়ির আঙ্গিনায় পা’ রাখলেন। দেখতে পেলাম। নবীজীর কপালে মুক্তোদানার মতো চিকচিক ঘামবিন্দু জমে আছে। আর তা থেকেই হৃদয়কাড়া সুরভি ছড়াচ্ছে।” মহানবী যে পথেই যেতেন, অনেকক্ষণ পর্যন্ত সেই পথ খুশবু মোহিত হয়ে থাকতো।

তারপর নবীজী বললেন, দ্বিতীয়ত আমার সবচে’ পছন্দনীয় হলো সচ্চরিত্রা স্ত্রী। সন্তান তেমনই হবে, সন্তানের মায়েরা যেমন হবে। তাই তো হাসান-হুসাইনের মতো জান্নাতের যুবক সর্দার জন্ম নিয়েছেন বেহেশতী রমণীদের নেত্রী ফাতেমা রা. এর গর্ভে। ইসলামও ইসলামের নবীর জন্যে জীবন উৎসর্গকারিণী হিসেবে মাখদুমাতুল মুসলিমীন খাদিজা রা. এর সত্যিই কি কোন তুলনা হতে পারে? তাই তোমরাও প্রিয় পাঠক, মহান আল্লাহর দরবারে যখন কিছু চাইবে, জীবন সঙ্গিনীর জন্যেও চাইবে।

সে যেন কৃতজ্ঞ হয়, যাকে আল্লাহ সচ্চরিত্রা স্ত্রী দান করেছেন। কারণ, তার ঘরকে সে নিজেই জান্নাত করে সাজিয়ে তুলবে। বিপরীতে কারো ঘরে যদি ‘খোদা না খাস্তা’- দুশ্চরিত্রা বিবি থাকে। তবে তার ঘরকে জাহান্নামে রূপান্তরিত করার জন্যে সে নিজেই যথেষ্ট।

তৃতীয়ত রাসুল বলেন, আমার দু’চোখের শীতলতা নামাযের মধ্যে রাখা হয়েছে। নবীপত্নী  হযরত আয়েশা রা. বলেন, আল্লাহর রাসুল যখন নামাযের জন্যে দাঁড়াতেন, তখন মনে হতো আমাদের কারো সাথে তাঁর কোন সম্পর্কই নেই। তাঁর সম্পর্ক কেবল তাঁর এবং শুধু তাঁরই সাথে। গযব-গোস্বার আয়াতে খুব কাকুতি মিনতি করতেন।


আর রহমতের আয়াত পড়াকালে তাঁর চেহারায় আশার চিহ্ণ ফুটে উঠতো। কতো রাত এমন হয়েছে যে, একেকটি আয়াতে পুরো রাত কাটিয়ে দিয়েছেন। একরাতে সুরা মায়েদার একশ’ আঠারো নম্বর আয়াত পড়ছিলেন- “যদি তুমি এদেরকে শাস্তি দাও, তবে এরা তো তোমারই বান্দা। (তোমাকে বাঁধা দেয়ার তো কেউ নেই।) আর যদি তুমি এদেরকে ক্ষমা করে দাও, তাহলে (কে তোমাকে  কৈফিয়ত তলব করতে পারে?) তুমিই তো মহাপরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।” তিনি এই আয়াত বারবার পড়ছিলেন। আর তার দুচোখ বেয়ে অঝোর ধারায় অশ্র“ নামছিলো। তিনি কাঁপছিলেন আর ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠছিলেন। এক পর্যায়ে সুবহে সাদিক হয়ে গেলো।

তারপর হযরত আবু বকর রা. দাঁড়িয়ে গেলেন। বললেন, আমার কাছেও পৃথিবীতে তিনটি জিনিস সবচে পছন্দনীয়। পিছনেই ছিলেন উমর ফারুক রা.। ভালো কাজে তাঁর প্রতিযোগী মনোভাব ছিলো সুপরিচিত ও প্রশংসিত। তিনি মনে মনে বললেন, আমি আগে থেকেই তিনটি প্রিয় জিনিস তৈরি করে রাখি। যা দিয়ে রাসুল না হোক, কমপক্ষে আবু বকর থেকে আজ আগে বাড়া যাবে। কিন্তু আবু বকর রা. তো আবু বকরই ছিলেন। রাসুল থেকে অনুমতি পাওয়ার পর তিনি বললেন, পৃথিবীতে আমার প্রথম সবচে পছন্দনীয় হলো আপনার চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকা। আর কেন বা হবে না? আজকের আকাশ-বাতাস তো চৌদ্দশ’ বছর পূর্বের সেই দৃশ্যের প্রত্যক্ষ সাক্ষী।


একটি অসম্ভাব্য কথোপকথন


যেদিন আবু বকর রা. সওর পর্বতের গুহায় প্রিয় হাবীবের জন্যে নিজের উরুদ্বয় বিছিয়ে দিয়েছিলেন। আর আল্লাহর রাসুলের চেহারা মোবারক তাঁর রাণের উপর আরাম করেছিলো। বুখারি শরিফের বরেণ্য ব্যাখ্যাকার ইবনে হাজার আছকালানী রহ. সেই দৃশ্যের বর্ণনা দিচ্ছেন; যেন প্রস্ফুটিত কুরআন রেহালের অন্তরঙ্গতায় কেমন অসাধারণ দৃশ্য হয়ে আছে! যেখানে আবু বকর রা. তাঁর প্রিয় নবীর বুক ঘেঁষে শুয়ে আছেন।

হযরত আবু বকর রা. এর জানাজা যখন রওজায়ে আতহারের কাছে নিয়ে যাওয়া হল, তখন নিজে নিজেই রওজা খুলে গেলো। আর ভিতর থেকে আওয়াজ এলো “আদখিলিল হাবীবা ইলাল হবীব। বন্ধুকে তার পরম বন্ধুর কাছে নিয়ে এসো।” একবার আবু বকরকে ডান হাতে এবং উমরকে বামহাতে ধরে রাসুল সা. বললেন “এভাবেই আমরা কিয়ামতের দিন পুনরুত্থিত হবো।”

হযরত আবু বকর রা. দ্বিতীয়তে বললেন, আপনার দির্দেশের পথে আমার সম্পদ খরচ করা। তৃতীয়ত, আমার কন্যাকে আপনার সাথে বিয়ে দেয়া।
তারপর উমর রা. দাঁড়ালেন। বললেন, পৃথিবীতে আমার কাছেও তিনটি জিনিস সবচে’ প্রিয়। নবীজী বললেন, বলো কী কী? হযরত উমর রা. বললেন, এক. সৎকাজের আদেশ করা, দুই. অন্যায় কাজে বারণ করা। তিন. ছেড়াঁফাঁড়া কাপড় পরে থাকা। সত্যিই যথার্থ বলেছেন অর্ধ্ব জাহানের মুকুট ও সিংহাসনবিহীন শাসক উমর রা.। ওই তো তিনি সিরিয়ার পথে যাচ্ছেন জীর্ণ কাপড় পরে, শীর্ণকায় একটি গাধায় চড়ে পালাক্রমে তিনি এবং তার ক্রীতদাস। একবার তিনি চড়েন, তো তাঁর গোলাম টানে। আরেকবার গোলামকে চড়িয়ে নিজেই লাগাম টানতে লেগে যান। তাঁরা বায়তুল মাকদিস অভিমুখে যাচ্ছেন। সেখানে পাদ্রীরা খলীফার নিজ হাতে চাবি অর্পণ করবে। বিজিত হবে মুসলমানদের প্রথম কেবলা। আর ওইতো বায়তুল মাকদিসের কাছাকাছি তারা এসে পড়েছে।

ওইতো  বায়তুল মাকদিসের কাছাকাছি তারা এসে পড়েছেন! আর গোলাম গাধার পিঠে চড়ার পালা পড়েছে। ওইতো গোলাম কাকুতি মিনতি করছে। নিজের পালা খলীফাকে দয়া করে গ্রহণ করতে বলছে। আর খলীফা সরাসরি অস্বীকৃতি জানিয়ে দিচ্ছেন। সেই ভূমিই তো সাক্ষী যে, মুসলিম সেনাপতি আমর ইবনুল আস এলেন। আর একটি তাজী ঘোড়া ও একজোড়া উন্নত কাপড় নিয়ে এলেন। আর খলীফা তাঁর ঐতিহাসিক সেই বাণী উচ্চারণ করলেন, যা স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখবার মতো “নাহনু কাউমুন আয়াযযানাল্লাহু বিল ইসলাম”। আমরা তো সেই জাতি, যাদেরকে আল্লাহ তাআলা ইসলামের মাধ্যমে সম্মানিত করেছেন।

আমরা হলাম মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহর গোলাম। ওই তো তিনি এক কিবতির নালিশে ডাকিয়ে আনছেন মিশরের গভর্ণর ও  তার শাহজাদাকে, কিবতির হাতে চাবুক তুলে দিচ্ছেন প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে। আর গভর্ণরকে বলছেন “আর কতদিন তোমরা তাদেরকে দাস মনে করবে। তাদের মায়েরা তো তাদেরকে স্বাধীন হিসেবে জন্ম দিয়েছে।” তিনি ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন যে, মুসলমানেরা কখনো মারার জন্যে যুদ্ধ করেনি, বাচাঁনোর জন্যেই কেবল করেছে। তাই আজো ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখা আছে যে, ইসলামের জয় তলোয়ারে নয়, চরিত্রের উদারতাই ইসলামের বিজয়ের চাবিকাঠি।