8.3 C
New York
Friday, October 24, 2025

Buy now

spot_img
Home Blog Page 17

রাসূল করীম (সা.)-এর জন্মতারিখঃ বিচার-বিশ্লেষণ-সংশয়-সন্দেহের অপনোদন

 মুফতী রেজাউল হকঃ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শুভ জন্ম কোন বছরে, কোন মাসে, কোন দিনে, কখন ও কোন জায়গায় হয় এ নিয়ে কার কী মত? বিশুদ্ধ মতামত কোনটি? বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধে সে বিষয়ে আলোচন-পর্যালোচনা করা হয়েছে।

মুহাক্কিক ও গবেষকদের মতে, ৯ ই রবিউল আউয়াল মোতাবেক ২০ শে এপ্রিল ৫৭১ খ্রিস্টাব্দ, রোজ সোমবার আনুমানিক ভোর ৪টা ৪০ মিনিটে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর শুভাগমনে পৃথিবী চির ধন্য হয়।

জন্মের বছর : রাসূল করীম (সা.)-এর শুভাগমন হয় ‘আমুল ফিল’-এ তথা অভিশপ্ত আবরাহা তার বিশাল হাতি বাহিনী নিয়ে কা’বা শরীফের ওপর যে বছর আক্রমণ করে, সেই বছরে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) শুভ জন্মলাভ করেন।

এই বিষয়ে সকল ঐতিহাসিক ও সীরাত প্রণেতাগণ ঐক্যমত্য পোষণ করেছেন। (আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ২/৩২১, ছিফাতুস সাফওয়াহ-১/৫১, আর-রাওযুল আনফ ১/২৭৬)

হাতি বাহিনীর অভিযানের কয় দিন পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অবির্ভাব ঘটে তা নিয়ে অবশ্য বিভিন্ন মতামত পাওয়া যায়, তবে যে মতটি সর্বাধিক প্রচলিত ও অধিক প্রসিদ্ধ তা হলো, পঞ্চাশ দিন পরে রাসূল (সা.) জন্মলাভ করেন।

হাফেয ইবনে কাসীর (রহ.) বলেন,
ولد عام الفيل…. فقيل بعده بشهر… وقيل بخمسين يوما، وهو أشهر

“জন্ম লাভ করেন ‘আমুল ফিল’-এ। কেউ কেউ বলেন, ঘটনার এক মাস পরে; আর কেউ কেউ বলেন, পঞ্চাশ দিন পরে, আর এই মতটিই অধিক প্রসিদ্ধ।” (আল-বিদায় : ২/৩২১)

জন্ম মাস : কোন মাসে জন্ম লাভ করেন? এ বিষয়ে বহু মতপার্থক্য রয়েছে।

আল্লামা কাসতলানী (রহ.) (মৃ. ৯২৩ হি.) ছয়টি মত উল্লেখ করেছেন। যথা-

১. মুহাররম,
২. ছফর,
৩. রবিউল আউয়াল,
৪. রবিউল আখের,
৫. রজব,
৬. রমাজান।

তবে জমহুর (সংখ্যাগুরু ঐতিহাসিকগণ) এ বিষয়ে ঐকমত্য পোষণ করেছেন যে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর জন্মগ্রহণ রবিউল আউয়াল মাসে হয়েছে।

হাফেজ ইবনে কাছীর (রহ.) বলেন,
ثم الجمهور على أنه كان فى شهر ربيع الأول

“অতঃপর জমহুর একমত হয়েছেন রবিউল আউয়াল মাসের ওপর।” (আল-বিদায়া ২/৩২০)

বিশ্বনন্দিত প্রসিদ্ধ আলেমে দ্বীন আল্লাম মুহাম্মদ যাহেদ কাউসারী (রহ.) বলেন, রবিউল আউয়াল ব্যতীত অন্য মাসে জন্ম লাভ করার মতামতটি বিজ্ঞ ওলামায়ে কেরামের নিকট গ্রহণযোগ্য নয়, তা ভুলক্রমে কারো কলমে চলে এসেছে হয়তো। (মাকালাতে কাউছারী, পৃ. ৪০৫)

জন্মদিন : কোন দিনটিতে জন্ম লাভ করেন? এ কথাই সকল ঐতিহাসিক একমত যে রাসূল (সা.)-এর জন্ম সোমবার হয়েছে।

فى الحديث: وسئل رسول الله صلى الله عليه وسلم عن يوم الإثنين، فقال ذلك يوم ولدت فيه ويوم يبعث

‘‘হাদীসে বর্ণিত আছে যে রাসূল (সা.)-কে সোমবার-বিষয়ক প্রশ্ন করা হলো। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) উত্তরে বললেন, সেটি এমন দিন, যাতে আমার জন্ম হয়েছে এবং প্রেরিত হয়েছি। (মুসলিম শরীফ, হা. ১১৬২; আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ২/৩১৯)

জন্মতারিখ : রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মাহে রবিউল আউয়ালের সোমবারে জন্ম লাভ করেছেন এ কথা স্পষ্ট ও চিহ্নিত, তবে কোন তারিখে হয়েছে, তা নির্দিষ্ট ও চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি।

পক্ষান্তরে অধিকাংশ ওলামায়ে কেরাম বলেন, নির্দিষ্ট তারিখ রয়েছে। কিন্তু নির্দিষ্ট কোন তারিখে জন্মগ্রহণ করেছেন, তা নিয়ে ইখতিলাফ রয়েছে ও বিভিন্ন রেওয়ায়ত রয়েছে।

আল্লামা কসতলানী (রহ.) মোট সাতটি রেওয়ায়াত উল্লেখ করেছেন। যথা-

(এক) ২ রবিউল আউয়াল।
(দুই)  ৮ রবিউল আউয়াল।
(তিন) ১০ রবিউল আউয়াল।
(চার)  ১২ রবিউল আউয়াল।
(পাঁচ) ১৭ রবিউল আউয়াল।
(ছয়)  ১৮ রবিউল আউয়াল।
(সাত) ২২ রবিউল আউয়াল। (আল- মাওয়াহিবুল লাদুননিয়্যাহ ১/১৪০-১৪২)

আল্লামা যাহেদ কাউছারী (রহ.) বলেন, ৮, ৯ ও ১০ এই তিন মতামত ব্যতীত অন্যান্য মতামত গ্রহণযোগ্য নয়।

সুতরাং আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হলো এই তিনটি রেওয়ায়াত। এখন প্রশ্ন হল, এ তিনটির কোনটি প্রাধান্য পাওয়ার যোগ্য এবং কেন?

১০ তারিখের রেওয়ায়াত :
এ রেওয়ায়াতকে ইবেন সা’আদ (রহ.) (মৃ. ২৩০ হি.) মুহাম্মদ বাকের (রহ.) (মৃ. ১১৪)-এর দিকে নিসবত করেন। কিন্তু এ সনদে তিন বর্ণনাকারী এমন রয়েছেন যাঁরা বিতর্কিত, যাঁদের বিষয়ে কালাম রয়েছে।
সুতরাং ১০ তারিখের রেওয়ায়াতটি প্রাধান্য পাওয়ার যোগ্য নয়।

আর এ রেওয়ায়াতটির দিকে আল্লামা কাউছারী ( রহ.) ইঙ্গিত করেছেন। এ রেওয়ায়াত নকল করা হয় তবকাতে কুবরা থেকে। রেওয়ায়াতটি হলো,

قال ابن سعد: أخبرنا محمد بن عمر بن واقد الأسلمى قال: حدثنى أبو بكر ابن عبد الله بن ابى سبرة عن إسحاق بن عبد الله بن أبى فروة عن أبى جعفر محمد بن على (يعرف بمحمد الباقر) قال: ولد رسول الله صلى الله عليه وسلم يوم الإثنين لعشر ليال خلون من شهر ربيع الأول، …. فبين الفيل وبين مولد رسول الله صلى الله عليه وسلم خمس وخمسين ليلة

অনুবাদ : আবু জাফর মুহাম্মদ ইবনে আলী যিনি মুহাম্মদ আল বাকের নামে প্রসিদ্ধ। তিনি বলেন, রাসূলে কারীম (সা.)-এর জন্ম হয়েছে ১০ রবিউল আউয়াল। …হাতি বাহিনীর অভিযান ও রাসূল (সা.)-এর পবিত্র জন্মের মধ্যকার সময়ের ব্যবধান ৫৫ দিন। (আত-তাবকাতুল কুবরা, ১/১০০)

১২ রবিউল আউয়াল’-এর রেওয়ায়াত :

এ রেওয়ায়াতের বর্ণনাকারী হলেন মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক (মৃ. ১৫১ হি.) কিন্তু তিনি কোনো সনদ বর্ণনা করেননি।

এ বর্ণনাটি যদিওবা অধিক প্রসিদ্ধ ও সর্বাধিক প্রচলিত এবং মক্কাবাসী সেই অনেক আগে থেকেই এ দিনেই সিরাত সেমিনার করে থাকেন সাথে সাথে পৃথিবীব্যাপী সভা-সেমিনার এই দিনেই হয়ে আসছে এতদ্বসত্ত্বেও এ রেওয়ায়াতটি প্রমাণসিদ্ধ নয় এবং এই দিনেই যে রাসূল (সা.)-এর জন্ম হয়েছে, তার কোনো দলিল-প্রমাণ পাওয়া যায় না।

একটি রেওয়ায়াত পাওয়া গেলেও সেটি মুত্তাসিল না হওয়াতে অগ্রহণযোগ্য বরং তা সনদহীন রেওয়ায়াতের ন্যায়। রেওয়ায়াতটি নিম্নে প্রদত্ত হলো

حَدَّثَنَا أَبُو الْحَسَنِ مُحَمَّدُ بْنُ أَحْمَدَ بْنِ شَبُّوَيْهِ الرَّئِيسُ بِمَرْوَ، ثنا جَعْفَرُ بْنُ مُحَمَّدٍ النَّيْسَابُورِيُّ، ثنا عَلِيُّ بْنُ مِهْرَانَ، ثنا سَلَمَةُ بْنُ الْفَضْلِ، عَنْ مُحَمَّدِ بْنِ إِسْحَاقَ، قَالَ: «وُلِدَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لِاثْنَتَيْ عَشْرَةَ لَيْلَةً مَضَتْ مِنْ شَهْرِ رَبِيعٍ الْأَوَّلِ

মুহাম্মদ ইবেন ইসহাক থেকে বর্ণিত “রাসূল (সা.) জন্মগ্রহণ করেন রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখে।” (মুসতাদরাকে হাকেম, হা. ৪১৮৩)

৯ তারিখে জন্মগ্রহণ নিয়ে বিশ্লেষণ :

সূত্র ও যুক্তির বিচারে যে মতটি প্রাধান পাওয়ার যোগ্য তা হলো, রাসূল (সা.)-এর জন্ম রবিউল আউয়াল মাসের আট দিন পর নবম তারিখে।

বর্ণনাসমূহ :
১.

আল্লামা ইবনে আব্দিল বার (রহ.) (মৃ. ৪৬৩ হি.)

এ বিষয়ে মতানৈক্য বর্ণনা করতে গিয়ে উপরোক্ত মতটি সর্বাগ্রে উল্লেখ করেছেন। [আল ইস্তি’আব ইবনে আব্দিল বার (রহ.), ১/৩০]

قال أبو عمر: وقد قيل لثمان وخلون منه وقيل..، قيل… وقيل..

২.

হাফেয ইবনে কাসীর (রহ.) বলেন,

وَقِيلَ لِثَمَانٍ خَلَوْنَ مِنْهُ حَكَاهُ الْحُمَيْدِيُّ عَنِ ابْنِ حَزْمٍ.

وَرَوَاهُ مَالِكٌ وَعُقَيْلٌ وَيُونُسُ بْنُ يَزِيدَ وَغَيْرُهُمْ عَنِ الزُّهْرِيِّ عَنْ مُحَمَّدِ بْنِ جُبَيْرِ بْنِ مُطْعِمٍ وَنَقَلَ ابْنُ عَبْدِ الْبَرِّ عَنْ أَصْحَابِ التَّارِيخِ أَنَّهُمْ صَحَّحُوهُ وَقَطَعَ بِهِ الْحَافِظُ الْكَبِيرُ مُحَمَّدُ بْنُ مُوسَى الْخُوَارِزْمِيُّ وَرَجَّحَهُ الحافظ أبو الخطاب بن دِحْيَةَ فِي كِتَابِهِ التَّنْوِيرِ فِي مَوْلِدِ الْبَشِيرِ النَّذِيرِ

“কেউ কেউ বলেন, রাসূল (সা.)-এর জন্ম মাসের আট দিন অতিবাহিত হওয়ার পর নবম দিনে হয়েছে।

হুমায়দি (রহ.) ইবনে হাযম থেকে বর্ণনা করেন, মালেক, উকাইল, ইউনুস বিন ইয়াযিদ প্রমুখ ইমাম যোহরী (রহ.) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি মুহাম্মদ ইবনে জুবাইর ইবনে মুতঈম (রহ.) থেকে বর্ণনা করেন।

ইবনে আব্দিল বার (রহ.) বলেন, ইতিহাসবিদরা উপরোক্ত মতের সত্যায়ন করেছেন।

হাফেযে কবীর মুহাম্মদ ইবনে মুসা আল-খারযেমী (রহ.) তাঁকে আরো সুনিশ্চিত ও মাযবুত করেছেন এবং হাফেয আবুল খাত্তাব ইবনে দিহয়া নিজ গ্রন্থে এ রেওয়ায়াতকে প্রাধান্য দিয়েছেন।” (আল-বিদায়া আন-নিহায়া ২/৩২০)

৩.

হযরত মাওলানা হিফজুর রহমান (রহ.) (মৃ. ১৩৮২ হি.) লিখেছেন,

সাধারণ জনগণের মধ্যে ১২ রবিউল আউয়ালের মতটি অধিক প্রচার-প্রসার হয়, যার ভিত্তি দুর্বল রেওয়ায়াতের ওপর। আর কিছুসংখ্যক উলামায়ে কেরামের মত হলো, ৮ রবিউল আউয়াল, তবে বিশুদ্ধ ও প্রমাণসিদ্ধ মতটি হচ্ছে ৯ রবিউল আউয়াল।

বিশ্ব্যবিখ্যাত জীবনীকার, ইতিহাস রচয়িতা ও আইম্মায়ে হাদীসসহ অনেকেই এ তারিখকে সহীহ ও মজবুত বলেছেন।

তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন হুমাইদী (রহ.), উকাইল (রহ.), ইউনুস ইবনে ইয়াযিদ (রহ.), ইবনে হাযম (রহ.), মুহাম্মদ ইবনে মুসা খারযেমী (রহ.), আবুল খাত্তাব ইবনে দিহয়া (রহ.), ইবনে তাইমিয়া (রহ.), ইবনুল কাইয়ূম (রহ.), ইবনে কাসীর (রহ.), ইবনে হাজর আসকালানী (রহ.) ও শায়খ বদরুদ্দীন আইনী (রহ.)। (কাসাসুল কোরআন ৪/২৫৩)

৪.

আল্লামা সুলাইমান নদভী (রহ.) ও ৯ রবিউল আউয়ালকে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর জন্মতারিখ হওয়ার মতকে প্রাধান্য দিয়েছেন। (রাহমাতুল লিল আলামীন, ১/৩৮-৩৯)

যুক্তির বিচারে ৯ রবিউল আউয়াল

১.

মুহাম্মদ ইবনে মুসা খারযেমী (রহ.) (মৃ. ২৩৫ হি.) ছিলেন সৌরবিজ্ঞানী। তাঁর মতের কথা আগেই বলা হয়েছে।

২.

সৌরবিজ্ঞানী মাহমুদ পাশা মিশরী (১৩০২ হি.) ফ্রান্সিস ভাষায় تقويم العرب قبل الإسلام (ইসলামপূর্ব আরবরে ক্যালেন্ডার) এ বিষয়ে অসাধারণ এক গ্রন্থ রচনা করেন। আরবীতে অনুবাদ করেন, আল্লামা আহমদ যকী পাশা (মৃ. ১৩৫৩ হি.) যার নাম হলো,

نتائج الإفهام فى تقويم القرب قبل الإسلام وفى تحقيق مولد النبى وعمره عليه الصلاة والسلام

এই কিতাবটিতে বহু বৈজ্ঞানিকের উদ্ধৃতিকে সামনে রেখে করা গবেষণা ও বিশ্লেষণে ৯ রবিউল আউয়াল তারিখটি স্পষ্ট হয়ে উঠে। ( নাতায়িজুল আফহাম…, পৃ. ৩৫-৩৮)

উপরোক্ত কিতাবে উল্লেখ করা বিশ্লেষণসমূহ থেকে একটি বিশ্লেষণ নিম্নে প্রদত্ত হলোঃ

রাসূল (সা.)-এর পবিত্র যুগে দশম হিজরীর মাহে শাওয়ালের শেষ তারিখে সূর্যগ্রহণ হয়েছিল।

একই দিনেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাহেবজাদা হযরত ইবরাহীম (রা.) মৃত্যুবরণ করেন,

يَوْم مَاتَ إِبْرَاهِيم يَعْنِي بن النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَقَدْ ذَكَرَ جُمْهُورُ أَهْلِ السِّيَرِ أَنَّهُ مَاتَ فِي السَّنَةِ الْعَاشِرَةِ مِنَ الْهِجْرَةِ …… وَالْأَكْثَرُ عَلَى أَنَّهَا وَقَعَتْ فِي عَاشِرِ الشَّهْرِ

হাফেয ইবনে হাজর আসকালানী (রহ.) (মৃ. ৮৫২ হি.) বলেন, যেদিন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর প্রিয় ছেলে ইবরাহীম (রা.) মৃত্যুবরণ করেন (সেদিনই সূর্যগ্রহণের ঘটনা ঘটে)।

অধিকাংশ সীরাত প্রণেতাগণ বলেন, তিনি মারা যান দশম হিজরিতে। কোন মাসে এ ঘটনা সংঘটিত হয় সে বিষয়ে মতানৈক্য থাকলেও সংখ্যাগুরু উলামায়ে কেরামের মতামত হচ্ছে দশম মাস তথা শাওয়াল মাসে সূর্যগ্রহণের ঘটনাটি ঘটেছিল। (ফাতহুল বারী, ৩/৪৮৯)

উপরোক্ত হিসাব অনুযায়ী গণনা করা হলে রাসূল (সা.)-এর জন্মগ্রহণ রবিউল আউয়ালের ৯ তারিখে হওয়াটাই প্রমাণিত হয়।

কেননা, জন্মের দিনটি যে সোমবার এ বিষয়ে তো সাবাই একমত আর সেদিনটি হস্তি বাহিনী ধ্বংসের বছরের রবিউল আউয়ালের ৯ তারিখেই হয়। এ ছাড়া অন্য তারিখে হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই নেই।


এটা পড়ুন  মহানবীর ﷺ বিছানা – যেমন বিছানায় ঘুমাতেন রাসুল সাঃ ।


আল্লামা মাহমুদ পাশা বলেন, “সমস্ত উলামায়ে কেরাম ঐকমত্য পোষণ করেন যে রাসূল (সা.)-এর শুভ জন্মের শুভ দিনটি ছিল সোমবার। (আবরাহার হাতি বাহিনীর অভিযানের বছরের) রবিউল আউয়াল মাসের ৮ কিংবা ১২তম তারিখে সোমবার পাওয়া যায় না। সে মাসের নবম দিনে সোমবার ছিল।

সুতরাং নবম দিন ভিন্ন অন্য কোনো তারিখে রাসূল (সা.)-এর জন্ম হয়েছেÑএ কথা অগ্রহণযোগ্য বলেই সাব্যস্ত হবে।”

হযরত মাওলানা হিফজুর রহমান (রহ.) বলেন, মাহমুদ পাশা (কুসতুনতুনিয়ার প্রসিদ্ধ জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও সৌরবিজ্ঞানী ছিলেন) তিনি জ্যোতির্বিদ্যার আলোকে যে নক্ষত্রসূচি/বর্ষপুঞ্জি প্রণয়ন করেছেন, যার উদ্দেশ্য ছিল রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর যুগ থেকে এ যুগ পর্যন্ত সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণের যত ঘটনা ঘটে গিয়েছে তার একটা সঠিক হিসাব বের করা।

তিনি তাতে পূর্ণ তাহকীকের সাথে প্রমাণ করেছেন যে রাসূল (সা.)-এর মোবারক জন্মের বছরে কোনোভাবেই সোমবার ১২ রবিউল আউয়ালে পড়ে না বরং তা একমাত্র ৯ রবিউল আউয়ালেই পড়ে।

শক্তিশালী দলিল-প্রমাণের ভিত্তিতে, বিশুদ্ধ সূত্র ও বর্ণনার নিরিখে, জ্যোতির্বিদ্যা ও সৌরবিজ্ঞানের আলোকে রাসূল  (সা.)-এর জন্মগ্রহণের গ্রহণযোগ্য প্রামাণ্য তারিখ হলো ৯ রবিউল আউয়াল। (কাসাসুল কোরআন ৪/২৫৩)

৩.

উপরোক্ত নাতায়েজু আফহাম… নামক গ্রন্থের এক অ্যাডিশনে ভূমিকা লিখেছেন সে যুগের প্রসিদ্ধ ইসলামিক চিন্তাবিদ, ইতিহাসবিদ ও বিখ্যাত সাহিত্যিক শায়খ আলি তানতাবী (রহ.) (মৃ. ১৪২০ হি.)।

তিনি নিজের লিখিত ভূমিকায় গ্রন্থ প্রণেতা কর্তৃক গৃহীত প্রাধান্য পাওয়া ৯ তারিখের মতের পক্ষে জোরদার সমর্থন জুগিয়েছেন। (মুকাদ্দামাতুত তানতাবী, ৮৩)

৪.

স্বনামধন্য মুহাদ্দিস ও গবেষক শায়খ আহমদ শাকের (রহ.) (আহমদ বিন মুহাম্মদ আব্দুল কাদের, মৃ. ১৩৭৭ হি.) তিনিও শায়খ বৈজ্ঞানিক মাহমুদ পাশার গবেষণা মেনে নিয়েছন এবং সে গবেষণা থেকে সূর্যগ্রহণ-বিষয়ক সহযোগিতা নিয়েছেন। (হাশিয়াতুশ শায়খ আহমদ শাকের ‘আলাল মুহাল্লা বিল আছার, ৫/১১৪-১১৫)

৫.

আরবের গবেষক সৌরবিজ্ঞানী আব্দুল্লাহ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে ইবরাহীম (মৃ. ১৪১৬ হি.) লিখেছেন, “বিশুদ্ধ রেওয়ায়াত দ্বারা প্রমাণিত হয় যে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) শুভাগমন হয় ২০ এপ্রিল ৫৭১ ইংরেজিতে আমুল ফিল’-এ…সুতরাং তাঁর জন্ম-মৃত্যুর দিন খুব সূক্ষ্মভাবে বের করা সম্ভব…এর ভিত্তিতে বর্ণনার বিচারে ও যুক্তির আলোকে রাসূল (সা.)-এর জন্মতারিখ হলো ৯ রবিউল আউয়াল হিজরীপূর্ব ৫৩ সনে মোতাবেক ২০ এপ্রিল, ৫৭১ খ্রিস্টাব্দ। (তাকভীমুল আযমান, পৃ. ১৪৩)

আরো দ্রষ্টব্য

গবেষণা প্রবন্ধ যার শিরোনাম হলো

تحديد ميلاده الشريف

যা সন্নিবেশিত রয়েছে

ما شاع ولم يثبت فى السيرة النبوية নামক গ্রন্থে, লেখক হলেন মুহাম্মদ ইবেন আবদুল্লাহ। সে প্রবন্ধে প্রবন্ধকার বৈজ্ঞানিক আবদুল্লাহ ইবনে ইবরাহীমের উপরোক্ত উদ্ধৃতি উল্লেখপূর্বক অন্যান্য উলামায়ে কেরামের মতামতের আলোকে ৯ তারিখের মতকে প্রাধান্য দিয়েছেন।

অনুরূপ আল্লামা যাহেদ কাউসারী (রহ.) নিজের রচিত প্রবন্ধ

المولد الشريف النبوى

-এ মাহমুদ পাশার উচ্চ প্রশংসা করেছেন এবং প্রবন্ধ রচনায় তাঁর রচিত কিতাব থেকে যথেষ্ট সহযোগিতা নিয়েছেন এবং তাঁর সাথে সহমতপোষণ করেছেন। (মাকালাতে কাউসারী, পৃ. ৪০৫-৪০৮)

আরো দ্রষ্টব্য হযরত মাওলানা মুফতী ্ওমর ফারুক সাহেব (শায়খুল হাদীস দারুল উলূম লন্ডন) কর্তৃক রচিত প্রবন্ধ, যা তাঁ র প্রণীত কিতাব ফেকহী জাওয়াহের-এ সন্নিবেশিত, ১/৬৮-৭১ ৮ ও ৯ তারিখের বর্ণনাদ্বয়ের মধ্যে সমন্বয় সাধন মনে রাখতে হবে, কিছু কিছু উলামা হযরাত ৮ তারিখের মতটি গ্রহণ করেছেন এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে ৮ ও ৯ উভয়ের মধ্যে একটিকে অপরটির ওপর প্রাধান্য দেওয়ারও চেষ্টা করা হয়েছে।

মাওলানা হিফজুর রহমান সাহেব (রহ.) মতদ্বয়ের মধ্যে সমন্বয় সাধন করেছেন। তিনি বলেন, ৮ ও ৯ এর মধ্যে বাস্তবিকার্থে কোনো এখতিলাফ নেই।

কেননা তা মাসের ২৯ ও ৩০ এর হিসাবের ওপর নির্ভরশীল। হিসাব করে দেখা যায়, সঠিক তারিখটি ছিল মূলত ২১ এপ্রিল। এ হিসেবে ৮ তারিখের সকল বর্ণনা ৯ তারিখের জন্য সহায়ক হয়ে যায়। (কাসাসুল কোরআন, ৪/২৫৪)

জন্মের সময়কাল :

সোমবারের কোন সময়ে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) জন্মগ্রহণ করেন? সীরাতের কিতাবসমূহে স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে যে নবী কারীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর জন্ম সুবহে সাদিকের সময় হয়েছে আর পবিত্র মক্কা নগরীতে ২০ এপ্রিল সুবহে সাদিক হয় ৪টা ৩৯ মিনিটে।

সুতরাং বলা যায় রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ৯ রবিউল আউয়াল, হিজরীপূর্ব ৫৩ সনে; ২০ এপ্রিল, ৫৭১ খ্রিস্টাব্দ, রোজ সোমবার আনুমানিক ভোর ৪টা ৪০ মিনিটে এ ধরাতে তাশরীফ এনেছেন।

উপরোক্ত আলোচনা-পর্যালোচনা থেকে এ কথা স্পষ্ট হয়ে যায় যে আকল ও নকলের আলোকে, যুক্তি ও সূত্রের বিচারে রাসূল (সা.)-এর মোবারক জন্মের গ্রহণযোগ্য তারিখ হলো, ৯ রবিউল আউয়াল।

জন্মস্থান :

জমহুর উলামায়ে কেরাম বলেন, রাসূল (সা.) পবিত্র জন্মস্থান হলো পবিত্র মক্কা নগরী। তবে নির্দিষ্ট কোন জায়গায় জন্মলাভ করেন তা নিয়ে মতভেদ থাকলেও প্রসিদ্ধ মত হচ্ছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর জন্ম শা’বে বনি হাশেম নামক প্রসিদ্ধ জায়গায় হয়েছে। কয়েক বছর পূর্বেও মানুষ সে জায়গার জিয়ারতের উদ্দেশ্যে যেতেন। বর্তমানে সে জায়গা বন্ধ করে দিয়ে তাতে মাকতাবা নির্মাণ করা হয়েছে।


মূল লেখক- মুফতী রেজাউল হক : শায়খুল হাদীস : দারুল উলূম যাকারিয়া দ.আফ্রিকা
অনুবাদ : মুফতী আতীকুল্লাহ

আল বিরুনি বিশ্বখ্যাত মুসলিম শিক্ষাবিদ ও গবেষক

ইসলামের ইতিহাস পড়তে গেলে অতীতের মুসলিমদের বৈজ্ঞানিক, বুদ্ধিবৃত্তিক, সৃষ্টিশীল কাজ ও অর্জনগুলো আমাদের বরাবরই বিস্মিত করে। ইসলামের স্বর্ণযুগে, গণিত থেকে শুরু করে চিকিৎসাবিজ্ঞান, দর্শন, শিল্পকলা, পদার্থবিজ্ঞান ইত্যাদি সকল বিষয়েই মুসলিমদের নতুন নতুন আবিষ্কার, ইত্যাদি সবকিছুতেই মুসলিমরা সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে এসেছে। বিখ্যাত মুসলিম বিজ্ঞানীদের কথা চিন্তা করতে গেলে ইবনে সিনা, ইবন আল-হাইথাম, ইবন খালদুন, আল-ফারাবী ইত্যাদি নামগুলো নিজের অজান্তেই কল্পনায় চলে আসে।

সর্বকালের সেরা স্কলারদের এই তালিকার আরেকটি নাম হচ্ছে পারস্যের মুসলিম স্কলার আবু রায়হান আল-বিরুনী। তাঁর জন্ম ৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে, মৃত্যু ১০৪৮ খ্রিস্টাব্দে, এবং তিনি জীবনের বেশীরভাগ সময়ই কাটিয়েছেন মধ্য এশিয়া ও হিন্দুস্তানে। তাঁর সুপ্রসিদ্ধ কর্মজীবনের বর্ণময় যাত্রায় তিনি ইতিহাস, পদার্থবিজ্ঞান, গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, ভাষাতত্ত্ব, তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব, ভূবিদ্যাসহ অনেক বিষয়ে পাণ্ডিত্যের স্বাক্ষর রেখেছেন। তাঁর সময়ে গোটা মুসলিম বিশ্বজুড়ে বিশৃঙ্খল রাজনৈতিক অস্থিরতা সত্ত্বেও তিনি সকল ঝামেলার উর্ধ্বে থেকে তাঁর কাজ চালিয়ে যান এবং ইতিহাসের সর্বকালের সেরা একজন স্কলার হিসেবে গড়ে উঠেন।

আল-বিরুনীর জন্ম ৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে উত্তর-পূর্ব পারস্যের খোরাসান প্রদেশে। তিনি আরবী ও ফারসি ভাষা, ইসলামের প্রাথমিক বিষয়সমূহ, এবং বিজ্ঞানের উপর জ্ঞানলাভ করেন। শুরু থেকেই তিনি গণিত এবং জ্যোতির্বিদ্যায় বিশেষ আগ্রহ দেখান এবং পরবর্তীতে তৎকালীন শ্রেষ্ঠ জ্যোতির্বিদদের অধীনে পড়ালেখা করে জ্যোতির্বিদ্যায় পাণ্ডিত্য অর্জন করেন।

২০ বছর বয়সে তিনি জ্ঞানার্জনের উদ্দেশ্যে ভ্রমণ শুরু করেন। ৩ বছর ধরে তিনি গোটা পারস্য চষে বেড়ান এবং বিভিন্ন স্কলারের অধীনে পড়ালেখা করে বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞানার্জন করেন। ৯৯৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি জুরজান (বর্তমানে ‘গুরগান’, উত্তর ইরানের একটি শহর) এ স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন এবং স্থানীয় শাসক শামস আল-মা’আলি কাবুস এর অধীনে চাকুরী নেন। জীবনের পরবর্তী ১০ বছর তিনি উত্তর ইরানের এই ছোট্ট শহরেই বসবাস করেন, নিজের গবেষণা চালিয়ে যান, বই লিখেন, এবং জ্ঞানার্জনে রত থাকেন।

এ সময়েই তিনি তাঁর কিংবদন্তী গ্রন্থ রচনা করেন যেখানে তিনি প্রাচীন সভ্যতাসমূহের উত্থান এবং পতনের বিস্তারিত বিশ্লেষণ করেন। এ রচনার মাধ্যমেই ভবিষ্যতে অনেক বিষয়ে তিনি যে পাণ্ডিত্য অর্জন করবেন তার পূর্বাভাস পাওয়া যায়। গ্রন্থটি শুধুই একটি ইতিহাস গ্রন্থ ছিলনা, বরং ইতিহাসের পাশাপাশি বিজ্ঞান, জ্যোতির্বিদ্যা, এবং সংস্কৃতির বিভিন্ন উপাদানের বিস্তারিত ব্যাখ্যার মাধ্যমে তিনি অতীতের বিভিন্ন ঘটনা তুলে ধরেন। জুরজান শহরে তাঁর করা কাজগুলোর মাধ্যমেই তিনি তৎকালীন বিশ্বের অগ্রগামী মস্তিষ্কের একজন হিসেবে বহিঃপ্রকাশ করেন।

জুরজান এ ১০ বছর থাকার পর আল-বিরুনী গজনীতে চলে যান এবং তাঁর কিছু কিংবদন্তী কাজ এই শহরেই করেন। বাস্তবে, গজনীতে না গেলে তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ কিছু কাজ হয়তো করা সম্ভব হতোনা। এখানে তিনি গজনীর সুলতান মাহমুদ এর পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন। আর গজনী ছিল তখনকার এক নামকরা সুবৃহৎ নগরী, যা বর্তমান আফগানিস্তানে অবস্থিত। সুলতান মাহমুদের সাম্রাজ্যের সীমানা আফগানিস্তান ছাড়িয়ে বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল, মূলত বর্তমান ইরান, পাকিস্তান এবং ইন্ডিয়াতেও। মূলত এই শক্তিশালী সাম্রাজ্যের কারণেই আল-বিরুনী তাঁর কাজের জন্য প্রয়োজনীয় সকল উপকরণ পান এবং তাঁর যোগ্যতা প্রমাণ করে দেখান।

সুলতান মাহমুদের সাথে থাকার কারণে যে নির্দিষ্ট যে সুবিধাটি তিনি পেয়েছিলেন তা হলো, হিন্দুস্তানে নিজের শাসনকার্য বজায় রাখার জন্য সুলতান মাহমুদ নিয়মিত সামরিক অভিযান চালাতেন এবং সকল অভিযানেই আল-বিরুনীকে সাথে করে নিয়ে যেতেন। এটি ছিল সুলতান মাহমুদ এর একটি অভ্যাস। যার ফলে আল-বিরুনীর সুযোগ হয় হিন্দুস্তানের বিভিন্ন ভাষা, সংস্কৃতি এবং ধর্মের সাথে পরিচয় লাভ করার এবং বিস্তারিত জানার।

তিনি প্রাচীন হিন্দুস্তানের ইতিহাসের উপর একটি বিশ্বকোষ সংকলন করেন যা “কিতাব তারিখ আল-হিন্দ” (হিন্দুস্তানের ইতিহাসের গ্রন্থ) হিসেবে পরিচিত। প্রকৃতপক্ষে, প্রাচীন হিন্দুস্তানের ইতিহাস নিয়ে আমরা আজ যা কিছু জানি তার বেশীরভাগই আল-বিরুনীর এই গ্রন্থ থেকেই সংগৃহীত। সত্যি বলতে তারিখ আল-হিন্দ বাস্তবে শুধুই প্রাচীন হিন্দুস্তান সংক্রান্ত গ্রন্থ নয়। বরং, ঐতিহাসিক ঘটনাগুলোর প্রেক্ষাপট বোধগম্য হওয়ার জন্য আল-বিরুনী জ্ঞানের অনেক শাখাকে একত্র করে ব্যাখ্যা করার যে যোগ্যতা রাখতেন, এই গ্রন্থটি ছিল তারই সাক্ষ্য। বইটি হচ্ছে হিন্দুস্তানী দর্শন, ভূগোল, এবং সংস্কৃতি জানার একটি উন্মুক্ত দরজা। একারণে তারিখ আল-হিন্দ কে বিশ্বের সর্বপ্রথম নৃবিদ্যা (Anthropology – মানব সমাজ এবং এর ক্রমবিকাশ সংক্রান্ত বিদ্যা) উপর লিখিত গ্রন্থ হিসেবে ধরে নেয়া যায়।


এটা পড়ুন – ভারতবর্ষে যুগশ্রেষ্ট কয়েকজন নির্যাতিত আকাবিরের ইতিহাস


হিন্দুস্তানের ইতিহাস এবং সংস্কৃতির এক বিশেষজ্ঞ হওয়ার পাশাপাশি আল-বিরুনী বৈজ্ঞানিক গবেষণায় উল্লেখযোগ্য অবদান রাখার জন্যও সময় বের করতে পেরেছিলেন। যেহেতু তিনি অনেক ভ্রমণ করতেন, তাই বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন ধরনের ভৌগলিক বৈশিষ্ট্য সরাসরি দেখার এবং নিজ হাতে পরখ করার সুযোগ পেয়েছিলেন। এর মাধ্যমে তিনি অনেক নতুন তত্ত্ব প্রদান করেন এবং তত্ত্বগুলো কিভাবে একে অপরের সাথে সম্পর্কিত তা দেখিয়েছিলেন। তিনি গঙ্গা নদীর উৎস থেকে শুরু করে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত নদীতে বিভিন্ন ধরনের মাটির উপাদান নিয়ে গবেষণা করেন। এর মাধ্যমে কিভাবে মাটির ক্ষয় হয়, কিভাবে নতুন করে চর জেগে উঠে ও আকৃতি পায় তা নিয়ে তত্ত্ব প্রদান করেন, এবং এসব ক্ষেত্রে পানি কি ভূমিকা পালন করে তার উপর বিশেষভাবে আলোকপাত করেন।

একই ধরনের আরেক গবেষণায় তিনি হিমালয় পর্বতমালায় প্রাচীন সামুদ্রিক প্রাণীর জীবাশ্ম আবিষ্কার করেন, যে পর্বতমালার মাধ্যমে হিন্দুস্তান গোটা বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন। সমুদ্রের নিম্নস্তরের প্রাণী শামুক এবং এ জাতীয় অন্যান্য প্রাণী সমুদ্র থেকে স্থলভাগের দিকে হাজার হাজার মাইল ভ্রমণ করে হিমালয় পর্বতমালার পাশে চলে আসবে, ব্যাপারটি বিশ্বাসযোগ্য নয়। এর মাধ্যমে আল-বিরুনী এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে হিমালয় পর্বতমালা অবশ্যই পূর্বে কোন এক সময় সমুদ্রের নীচে ছিল, এবং ধীরে ধীরে লক্ষাধিক বছর পর বর্তমান অবস্থানে সরে এসেছে। পৃথিবীর গঠনের ব্যাপারে আধুনিক বিজ্ঞানের ধারণা অনুযায়ী পৃথিবীর উপরিতল কিছু পাতলা, অনমনীয় পাতের সমন্বয়ে তৈরি, যারা একে অপরের দিকে চলাচল করতে সক্ষম। এই পাতগুলো টেকটনিক পাত হিসেবে পরিচিত। আল-বিরুনীর গবেষণাটি আধুনিক বিজ্ঞানের এই ধারণাকেই নিশ্চিত করেছিল – কিভাবে সময়ের সাথে মহাদেশগুলোর স্থান পরিবর্তন হয়।

আল-বিরুনী ভূবিদ্যা (Geology)-র একজন পথিকৃৎ। তিনি শতাধিক বিভিন্ন ধরনের ধাতু এবং রত্নপাথর সংগ্রহ করে সেগুলো পরীক্ষা করেন। এগুলোর বৈশিষ্ট্য, এগুলো কিভাবে সৃষ্টি হয়, এবং কোথায় পাওয়া যায় তার বিস্তারিত বর্ণনা দেন। রত্নপাথর নিয়ে লেখা তার বইগুলো স্ট্যান্ডার্ড বই হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে।

একাদশ শতাব্দীতে আল-বিরুনী তাঁর বর্ণময় কর্ম এবং গবেষণা জীবন চালিয়ে যান, এবং বিভিন্ন বিষয়ের গবেষণায় নতুন নতুন ও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি প্রদান করেনঃ

আল বিরুনি
চাঁদের দশার উপর তার কাজ ।


কিভাবে পৃথিবীর এর কক্ষপথে ঘূর্ণায়মান।
কিভাবে কুয়া এবং ঝর্ণা থেকে পানি ভূ-পৃষ্ঠে প্রবাহিত হয়।
স্থিতিবিদ্যা (Statics) এবং গতিবিদ্যা (Dynamics) কে একীভূত করে বলবিদ্যা (Mechanics) নামক গবেষণার নতুন ক্ষেত্রের প্রবর্তন। (Mechanics এর উপর ভিত্তি করেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আধুনিক Mechanical Engineering, Civil Engineering, Structural Engineering, Aerospace Engineering, Automotive Engineering, Naval Architecture, Astronomy, Geophysical Science, Biophysics সহ গবেষণা ও কাজের হরেক রকমের ক্ষেত্র)।
সহস্রাধিক শহরের অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশ নির্ণয়, এবং এর সাহায্যে তিনি প্রত্যেক শহর থেকে মক্কার দিক নির্ণয় করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
‘ছায়া’-র অপটিক্যাল (আলোকবিদ্যা বিষয়ক) গবেষণা, এবং এর মাধ্যমে নামাজের সময় নির্ধারণ করেন।
মানুষের মাঝে জোতির্বিদ্যা (Astronomy)-র ‘কুসংস্কারাচ্ছন্ন’ ধ্যান-ধারণা দূর করে এর বৈজ্ঞানিক রূপ দেন।

ফলিত বিজ্ঞানী এবং জ্যোতির্বিজ্ঞান । আল-বিরুনি যে কত বড় ফলিত বিজ্ঞানী এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানে তিনি যে কত উচ্চস্তরে স্থান লাভ করেছিলেন, এ সম্বন্ধে একটি ঘটনা উল্লেখই যথেষ্ট। একদিন সুলতান মাহমুদ গজনিতে তার হাজার বৃহ্মের বাগানে গ্রীষ্মবাসের ছাদে বসে আল বিরুনিকে বললন, এ বাড়ির চার দরজার কোন দরজাটি দিয়ে আমি বের হবো, আপনি তা গুনে ঠিক করে একটি কাগজ়ে লিখে আমার কম্বলের নিচে রেখে দিন।

আল-বিরুনি তার আস্তারলব যন্ত্রের সাহায্যে অঙ্ক কষে তার অভিমত একটি কাগজ়ে লিখে সুলতান মাহমুদের কম্বলের নিচে রেখে দিলেন। তখন সুলতান রাজমিস্ত্রির সাহায্যে একটি নতুন দরজা সৃষ্টি করে বেরিয়ে গিয়ে আবার ফিরে এসে দেখেন আল-বিরুনির কাগজে অনুরূপ কথাই লেখাঃ “আপনি পূর্ব দিকের দেয়াল কেটে একটি নতুন দরজা করে বেরিয়ে যাবেন”। কাগজের লেখা পাঠ করে সুলতান রেগে গিয়ে ছাদ থেকে আল-বিরুনিকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দেয়ার জন্য আদেশ দিলেন। নিচে মশামাছি প্রতিরোধের জন্য জাল পাতা ছিল। সুলতানের আদেশ কার্যকর হওয়ার পর আল-বিরুনি সেই জালে আটকে গিয়ে মাটিতে আস্তে পড়ার ফলে বেশি আঘাত পেলেন না।

সুলতান আল-বিরুনিকে আবার ডেকে আনলেন এবং তার চাকরের কাছ থেকে আল বিরুনির দৈনিক ভাগ্য গণনার ডায়েরিটা নিয়ে সুলতান দেখলেন, তাতে লিখা আছে “আমি আজ উঁচু জায়গা থেকে নিচে পড়ে গেলেও বিশেষ আঘাত পাব না”। এ দেখে সুলতান আরো রেগে গিয়ে আল-বিরুনিকে জেলে পাঠালেন। এর পর আল-বিরুনিকে কারগার থেকে মুক্তির সুপারিশ করতে কেউ সাহস পেলেন না। ছয় মাস পর সুলতানের মনমর্জি বুঝে প্রধানমন্ত্রী আহমদ হাসান একদিন আল-বিরুনির প্রতি সুলতানের নেক নজর আকর্ষণ করলেন। সুলতান মাহমুদের এ কথা স্বরণই ছিল না। তিনি তৎহ্মণাৎ তাকে মুক্তি দিলেন।

৭৫ বছরের বর্ণময় জীবনে আল-বিরুনী প্রচলিত অসংখ্য বিষয়ে আমূল পরিবর্তন এনেছিলেন। ১০৪৮ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি একশ’রও বেশী বই লিখেন যার বেশীরভাগই পরবর্তীতে হারিয়ে গিয়েছে। তাঁর ধীশক্তি, বিভিন্ন বিষয়ে পাণ্ডিত্য এবং জ্ঞানের বিভিন্ন শাখাকে একসূত্রে গেঁথে দেয়ার দক্ষতা তাঁকে স্থান করে দিয়েছে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ মুসলিম স্কলারদের তালিকায়। তাঁর জীবন প্রমাণ করে জ্ঞানের জগতের প্রচলিত সীমানাকে নবদূরত্বে নিয়ে গিয়ে নতুন নতুন সব শাখা সৃষ্টি করায় অতীতের মুসলিম স্কলারদের যোগ্যতা কতটুকু ছিল। তাঁর অর্জনগুলো দেখিয়ে দেয় কিভাবে সেরা স্কলারগণ রাজনৈতিক সমস্যা, যুদ্ধ-বিগ্রহ, এবং জীবনের অন্যান্য সাধারণ সব সমস্যার উর্ধ্বে থেকেও ধরণীকে পরিবর্তন করে দেয়ার মতো গবেষণা করতে পারেন এবং অসাধারণ সব আবিষ্কার করে যান মানব সভ্যতার কল্যাণ সাধনের জন্য।

আরও জানুন – আবু রায়হান আল বিরুনি

ভারতবর্ষে যুগশ্রেষ্ট কয়েকজন নির্যাতিত আকাবিরের ইতিহাস

সৈয়দ আনোয়ার আবদুল্লাহঃ যুগে যুগে আহলে হক আলেমরা নানান বাতিল পন্থিদের দ্বারা নির্যাতিত ও সমালোচিত হয়েছেন, এসব ঘটনা আমরা প্রায়ই শুনে থাকি। তবে এই ইতিহাসগুলো খুব কমই শুনা যায়, স্বগোত্রের আহলে হক আলেমদের দ্বারা বা তাদের ভুল ফতোয়া কিংবা এখতেলাফি/ মতানৈক্যের কারনে, আকাবির হযরাতদের অনেক সেরেতাজ আলেমরা কতোটা নির্মম নির্যাতিত হয়েছিলেন সময়ে সময়ে। নির্যাতন এমনভাবে হয়েছে যে, আমীরে হিন্দ শাহ ওয়ালী উল্লাহ মোহাদ্দিসে দেহলভীর হাতের আঙ্গুল পর্যন্ত কাটা হয়েছিল ফতোয়া দিয়ে। তিনিই আজ আমাদের আকাবির। আমাদের এলেম ও তাসাউফের প্রধান বাতিঘর। সব আকাবিরদের সুতিকাগার থাকে ঘিরেই। এজামানায় এমন নির্যাতন কারো উপর কল্পনাও করা যায় না।

ইতিহাস এমন একটি ক্ষেত্র যেখানে সবার স্থান হয় না। যুগ-জমানা পাল্টে দেয়া ব্যক্তিরাই সেখানে স্থান পায়। এজন্য তাদের উপর দিয়ে বারোধীতার স্লাইকোন চলে। ধর্য্যের সাথে যারা এসব মোকাবিলা কনে যান, তারাই একদা ইতিহাস হন। ভারত বর্ষের বিগত তিনশ বছরের প্রসিদ্ধ কয়েকজন আলেম স্বগ্রোত্রীয় আলরমদের দ্বারা নির্যাতিত হওয়ার কিছু যৎসামান্য ঘটনা আজ আমি আপনাদের সামনে তুলে ধরব। শুনাব তারা আবেগী, হুজুগী উগ্রবাদী ও স্বার্থপর ফেতনাবাজ শ্রেনীর আলেমদের দ্বারা কিভাবে জুলুমে স্বীকার হয়েছেন। এই জুলমবাজ নামমদ্বারী দুনিয়াদ্বার আলেমশ্রেনী ও তাদের ফেৎনা সর্বকালেই ছিল। এবং কেয়ামত পর্যন্ত থাকবে। তাদের দিয়েই আল্লাহ তার প্রিয় বান্ধাদের সবর আর ইস্কেকামাতের কটিন পরিক্ষা নিয়ে থাকেন।

আমরা ইতিহাসের পাতায় সে সব ইতিহাসে কেবল পড়েছি, কিন্তু আমরা এমন দু’একজনকে এজামানায়ও এমন জুলুমে স্বীকার হতে দেখেছি। এর রাজসাক্ষি হচ্ছে আমাদের প্রজন্ম। তাঁদের জীবনী এভাবে পাঠ করবে আমাদের পরবর্তি প্রজন্ম। শুনাতে পারব পরবর্তি প্রজন্মকে এযুগের এমন দু’কজন মজলুম মনীষার কথা।

জামানার মহা-নায়করা এমনি হন। স্রোতের উল্টো, আবেগ-হুজুগী আর চিন্তার সংকীর্ণতার অনেক উর্ধ্বে উঠে তারা কাজ করেন। তাদের দূরদর্শি চিন্তা চেতনা স্পর্শ করার মতো যোগ্যতা থাকে না সমকালীন অনেকেরই। ফলে তাদের বিরোধীতা করাকেই অকাজের কাজিরা কাজ মনে করেন। তাদের আঘাত করাকে অনেক বুঝমান ব্যক্তিও এবাদত মনে করেন। বিরোধীতাকে সওয়াব ভাবেন। তাদের অনুসারীদের গলাচেপে ধরতে, কিংবা গাড় ধাক্কা দিয়ে মসজিদ থেকে তাড়িয়ে দেয়াকে পূন্যের মনে করেন।

আর তারা কোন প্রকার সমালোচনার পরোয়া না করে কাজের কাজ করে যান আপন গতিতে। গীবত, শেকায়ত, থেকে তারা মুক্ত থাকেন। এই মরুঝড় আর তুফানের ভেতর দিয়েও একদল মুখলেস আল্লাহর বন্দা এসব মজলুম আকাবিরদের সাথে থেকে তাদের অনুসরণ করে থাকে এবং ইতিহাসে স্থান করে নেন। ঠিকমত ইতিহাসটি পরবর্তি প্রজন্মের জন্য লিখে রাখেন কেউ কেউ। যুগে যুগে এমনিই হয়েছে, আর এমনিই হবে….

___________________________________
শাহ ওলী উল্লাহ মোহাদ্দেসে দেহলভী রহ:

উপমহাদেশে সর্ব প্রথম ফার্সি ভাষায় কুরআনের তাফসীর ও অনুবাদ করেন। কোরআনকে ফার্সি করে ফেলা! কত বড় অপরাধ! এটা মেনে নিতে পারলেন না সমকালীন কিছু আবেগি মানুষ। হক্কানি আলেমদের বড় একটি অংশ। তৎকালীন উলামায়ে কেরাম এর জমহুর জামাত এই বিষয়ে একমত হয়ে গেলেন, যে শাহ সাহেব মুহার্রিফে কুরাআন। যুগের সবচেয়ে বড় নকীব ও বিদগ্ধ এই মুজাদদ্দেদ আলেমের উপর বার বার সশস্ত্র আক্রমন করা হল। অবশেষে তার বৃদ্ধাঙ্গুলি কেট ফেলা হল। তাকে যারা হক মনে করে আকড়ে ছিলেন তাদেরকেও গোমরা মনে করে আঘাত করা হত। এমনকি আল্লাহর ঘর মসজিদের ভিতর তাঁর অনুসারীদের নামাজ পড়তে দেয়া হত না।

তার কোন অনুসারীকেই তখন কোন দ্বীনী কাজ করতে দেয়া হত না। কিন্ত দেহলভী রহ. যুক্তি ছিলো ভবিষ্যত প্রজন্মকে কুরআন শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ করন। পরবর্তীতে তার চিন্তা চেতনা ও দর্শনই সহি বলে বিবেচিত হল। তিনি পরবর্তিতে ভারতবর্ষের সবচেয়ে অবিসংবাদিত মুসলিম নেতা।পরে তার তাফসিরকে গোটা উপমহাদেশে কোরআন চর্চার মাইল ফলক বলে ফলো করা হল।

আজ শত বছর পরে এসে ইতিহাস বলে তিনি হকের উপর প্রতিষ্টিত কালজয়ী এক মহা মনীষা হিসাবেই অমর হয়ে আছেন। আর বিরোধীরা আজ কোথায়? ইতিহাসে কি তাদের কোন অস্তিত্ব আছে?

উপমহাদেশের সকল উলামায়ে কেরামের যাবতীয় দ্বীনী, ফিকহি সিলসিলা, হাদীসের সনদ, তাযকিয়ার শাযরাহ গিয়ে একত্রিত হয়েছে শাহ ওয়ালী উল্লাহ মোহাদ্দেসে দেহলভীর সাথে। তাকে বাদ দিয়ে উপমহাদেশে ইমলামের ইতিহাস রচনা করা সম্ভব নয়। আর ইতিহাস পাঠে এখন এসে অবাক হতে হয়, এই মহান যুগ সংস্কারক আলেমেদ্বীনের উপরেও তৎকালিন উলামায়ে কেরামদের একটি বড় অংশ ৩০বছরের অধিক সময় কুফরি ফতোয়া দিয়ে রেখেছিলেন দীর্ঘদিন। এমনকি তিনি কাফের হিসাবে তাকে হত্যা করার জন্য বারবার সবোর্চ্চ চেষ্টা করেছেন এই ফতোয়াবাজ আলেম শ্রনী। (বিস্তারিত দেখুন, হায়াতে ওয়ালী পৃষ্টা নং ৩২১)

শাহ ওয়ালী উল্লাহ দেহলভী ছিলেন, ঐব্যাক্তি -যিনি দীর্ঘ এগার বছর কাল সাধনার পরে কুরআন শরিফের প্রথম পুনাঙ্গ অনুবাদ করেছিলেন উপমহাদেশে। তখন সর্বত্র ফার্সি ভাষার প্রচলন ছিল। ফারসি ভাষায় তিনি কুরআনের তরজমা “ফতহুর রাহমান” প্রকাশের পর তৎকালিন উলামায়ে কেরাম না বুঝেই আরবী কুরআনকে ফার্সি করার অপরাধে তার উপর ভয়ংকর ‘কুফরি’ ফতোয়া আরোপ করেন। তার বিরোদ্ধে মিটিং মিছিল আর অবরোধ ও হামলা সহ এমন কোন নেক্কারজনক ঘটনা নেই যা, স্বগোত্রের আলেমদের দ্বারা তার উপর হয়নি। আমিরুর_রওয়াত গ্রন্থে আছে, এমনকি এই ফতোয়ার কারনে তাকে তাঁর এলাকা থেকে অবাঞ্ছিত ঘোশনা করে বের করে দেয়া হয়েছিল। (বিস্তারিত দেখুন, শাহ ওয়ালী উল্লাহ আউর উনকি সিয়াসি তাহরিক, মাওলানা উবায়দুল্লাহ
_______________________________
হুজ্জাতুল ইসলাম ক্বাসিম নানুতবী.

দেওবন্দের প্রতিষ্ঠাতা হুজ্জাতুল ইসলাম হযরত ক্বাসিম নানুতবী রহ.। একবার লাখনৌর ‘পুরকাজী’ নামক অঞ্চলে ছিলেন।তখন সেখানে শিয়াদের মহররমের আনুষ্ঠানিকতা চলছে। শিয়ারা কি এবং তাদের হারাম কাণ্ডকারখানা সম্পর্কে সবাই অবগত আছেন। তো তাদের একটি প্রতিনিধি দল নানুতবী রহ. এর কাছে এসে দাওয়াত দিলো তাদের তাযিয়া মিছিল ও মাতম অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। তিনি দাওয়াত কবুল করলেন। সেখানে গিয়ে বক্তব্যও রাখলেন। তাঁর সেই বক্তব্য পরবর্তীতে অনেকের হেদায়াতের পথ খুলে দিলেও, তখন কিন্তু পুরো ভারতবর্ষে জুড়ে তার সমালোচনা ও নিন্দার তুলকালাম ঘটে গেল।মানাযির আহসান গিলানী রহ. এর ভাষায় খালবালি মাচ গায়ি। তিনি শিয়া হয়ে গেছেন বলে মিছিল মিটিং পর্যন্ত হয়ে গেল। তাকে সমালোচনায় ক্ষত-বিক্ষত করা হল। তবে নানুতবী রহ. তা থোড়াই পাত্তা দিয়েছেন, কিন্তু শেষে নিজের মানুষদের প্রশান্তির জন্য সেই দৃঢ় উত্তর শুনিয়ে দেন “শক্তিসম্পন্ন সাধক বিষ খেয়েও হজম করতে পারে বিষের কোন প্রতিক্রিয়া তাঁর দেহে প্রকাশ পায় না। যার পাকস্থলী দুর্বল সে তো সামান্য তৈল ব্যঞ্জনেও অসুস্থ হয়ে পড়ে। (শিয়াদের তাযিয়া মঞ্চে)যদি হালুয়া গ্রহণ করে থাকি তাদের মঞ্চে সত্যকথাও তো পৌঁছে দিয়েছি”।
মানাযির আহসান গিলানী রহ. এর ভাষায় খালবালি মাচ গায়ি [সাওয়ানেহে কাসেমী ২/৬৮, মাকতাবায়ে দারুল উলূম]

শেষ হয়নি, ফতোয়া, সমালোচনায় ক্ষত-বিক্ষত। তবে নানুতবী রহ. তা থোড়াই পাত্তা দিয়েছেন, কিন্তু শেষে নিজের মানুষদের প্রশান্তির জন্য সেই দৃঢ় উত্তর শুনিয়ে দেন “শক্তিসম্পন্ন সাধক বিষ খেয়েও হজম করতে পারে বিষের কোন প্রতিক্রিয়া তাঁর দেহে প্রকাশ পায় না। যার পাকস্থলী দুর্বল সে তো সামান্য তৈল ব্যঞ্জনেও অসুস্থ হয়ে পড়ে। (শিয়াদের তাযিয়া মঞ্চে)যদি হালুয়া গ্রহণ করে থাকি তাদের মঞ্চে সত্যকথাও তো পৌঁছে দিয়েছি”। [সাওয়ানেহে কাসেমী ২/৬৮, টীকায় কারী তৈয়্যব রহ. লিখেন, গ্রহণ করেছেন জানা যায় কিন্তু খেয়েছেন বলে কোন তথ্য নেই। বিস্তারিত দেখুন মুফতী ফয়যুল্লাহ আমান কাসেমী কৃত হৃদয়ের আঙিনায় নববী দাওয়াত, মাসিক পাথেয় জুলাই ও অগাস্ট ‘১৫]

আজ সমালোচক বিরোধীরা কোথায়? আর নানুথবী রহ ইতিহাসে কোথায় সবারই জানা।

____________________________________
শায়খুল হিন্দ মাহমুদ হাসান দেওবন্দী রহ.

শাযখুলহিন্দের নেতৃত্বে ইংরেজ বিরোধী আন্দোলন শুরু হল ভারতবর্ষে। সুদূর আফ্রিকা থেকে ডেকে আনলেন হিন্দু নেতা করমচাঁদ গান্ধিকে। মুসলমানদের চাঁদার টাকা খরচ করে সারা ভারতে করমচাদ গান্ধিকে হাইলাইট করলেন হিন্দুদের অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে। শায়খুল হিন্দ তাকে মহাত্মা গান্ধি” উপাধি দিলেন। শুধু কি তাই! শায়খুল হিন্দ সরাসরি হিন্দুদের নেতৃত্বাধীন কংগেসে যোগ দান করলেন। শায়খুল হিন্দ তখন ১৯১৫সালের ২৯ অক্টোবর ভারতের অস্থায়ী ছায়া সরকার গঠন করলেন, সে সরকারে অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট বানালেন রাজা মহেন্দ্র প্রতাপকে।

তখন মুসলমাদের অতি আবেগী একটা দল শায়খুল হিন্দকে হিন্দুদের দালাল এবং মুসলমানদের অর্থ তসরুফ কারী ঘোষণা করেছিলো। পরবর্তীতে এটাই প্রমানিত হয়েছে শায়খুল হিন্দের চেতনার ফসলই ভারতবর্ষের স্বাধীনতা। খোদ দেওবন্দ থেকে শায়খুল হিন্দের বিপ্লবী কর্মকান্ডের উপর যখন আপত্তি তোলে একের পর এক বিরোধীতা করা হল তখন, হযরত শায়খুল হিন্দ রহ এক বিবৃতিতে বলেন, আমার জিহাদী ও সিয়াসি কর্মকান্ড যারা মাদরাসার ভিতর বসে বুঝতে সক্ষম হচ্ছেন না, তাদের উচিত দরস তাদরিস তথা তালিমে মশগুল থাকা। তারা রাজনীতি নিয়ে কথা বলা সমুচিত নয়, বরং অন্যায়। যেহেতো তারা সিয়াসি ময়দানে নেই এবং সে সম্পর্কে কোন অভিজ্ঞতাও নেই। তারা সিয়াসি বিষয়ে কথা বললে, বিশিংখলা বাড়বে বৈ কমবে না।
(বিস্তারিত দেখুন, শায়খুল হিন্দ আওর উনকা সিয়াসি তাহরিক)

_____________________________
মাওলানা উবায়দুল্লাহ সান্ধি রহ.

মাওলানা উবায়দুল্লাহ সিন্ধি ছিলেন, যুগ সংস্কারক। তার অধিকাংশ চিন্তার সাথে খোদ দেওবন্দী আলেমদের একাংশ একমত্র হতে পারেন নি কখন। কুফরি ফতোয়াতে শিকার হয়েছিলেন শায়খুল হিন্দ মাহমুদ হাসান রহসহ তাঁর অসংখ্য ছাত্র ও শিষ্য। তাদেরই একজন মাওলানা উবায়দুল্লাহ সিন্ধি। বৃট্রিশ বিরোধি বিখ্যাত রেশমি রুমাল আন্দোলনের অন্যতম মহানায়ক তিনি। উবায়দুল্লাহ সিন্ধির উপর তৎকালিন দেওবন্দি একদল আলেম তার কিছু সমকালিন চিন্তাধারা নিয়ে ব্যাপকভাবে “কুফরি ফতোয়া” প্রদান করেন। এবিষয়ে ইতিহাস গবেষক নুর উদ দীন আহমদ সিন্ধির জীবনীতে লিখেছেন, “মাওলানা উবায়দুল্লাহ সিন্ধি দেওবন্দে শিক্ষালাভ করেছিলেন বটে,কিন্তু তিনি দেওবন্দের বাহ্যিক রূপ, রং এবং আকৃতি-প্রকৃতির প্রতি অনুরক্ত ছিলেন না। শাহ ওয়ালী উল্লাহ যে চিন্তাধারা দ্বারা দেওবন্দের বিশিষ্ট নেতাগন অনুপাণিত ছিলেন, তিনি সে আর্দশ ও দর্শনের মর্মমূলে পৌছে ছিলেন। শায়খুল হিন্দও তাঁর এরূপ যোগ্য শিষ্যের কাছে দেওবন্দ প্রতুষ্ঠানের অন্তর্নিহিত বৈপ্লবিক লক্ষের বিষয়ে খুলে বলেছিলেন। মাওলানা উবায়দুল্লাহ সিন্ধি ইসলামকে যে বিশ্ব মেজাজ ও দৃষ্টিতে দেখেছিলেন, খোদ দেওবন্দের উলামাদের একাংশের তা মনঃপূত ছিল না। এজন্য তাঁরা মাওলানা সিন্ধির উপর কাফেরি ফতোয়া একের পর এক আরোপ করতে থাকেন। (বিস্তারিত দেখুন, শাহ ওয়ালী উল্লাহ ও তাঁর রাজনৈতিক চিন্তাধারা, ভূমিকা, মাওলানা উবায়দুল্লাহ সিন্ধী)

___________________________
মাওলানা আবুল কালাম আযাদ.

ভারতবর্ষে জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ ও পরবর্তিতে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম নামে আলেমদের ইসলামি হুকুমত প্রতিষ্টার রাজনৈতিক দল তখন কাজ করছে। কিন্তু মাওলানা আবুল কালাম আযাদ তখন হিন্দুদের একমাত্র রাজনৈতিক দল “ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের ” একটানা ২২ বছরের কেন্দ্রীয় সভাপতি। দুরদর্শি চিন্তা চেতনা ভাবনা সমকালীন অনেক মুসলিম নেতাই মেনে নিতে পারেন নি। কিন্তু ৪৭সালে গান্ধিকে নিয়ে মুসলিম গনহত্যা বন্ধে তার ঐতিহাসিক অবদান কে অস্বীকার করতে পারে? যা সমকালিন মানুষ হুজুগে বুঝতে পারে নাই। তাকে হিন্দু মদপ্যি সহ নানান অপবাদে জর্জরিত করা হয়েছিল। ফলে তিনি বহু আক্রমনে স্বীকার হয়েছেন। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষি যাকে হিন্দু বলে ফতোয়া দেয়া হয়েছিল, ভারতীয় জাতিয় কংগ্রেসের সভাপতি মাওলানা আবুল কালাম আযাদ ঠিকই আজ মুসলমানদের কাছেই ইতিহাসের মহানায়ক। স্বর্ণালী অক্ষরে তার নাম ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে আছে। যাদেরকেই একসময় দালাল,দালাল বলে চিৎকার করা হয়েছিল তারাই আজ ইতিহাসে জাতির মহান কাণ্ডারি
হিসাবে অমর হয়ে আছেন।
________________________
শায়খুল ইসলাম সৈয়দ হুসাইন আহমদ মাদানী

কুতবে আলম সৈয়দ হুসাইন আহমদ মাদানী রহ ছিলেন অখন্ড ভারতের পক্ষে। জিন্নাহের ধোকাবাজি ইসলামি রাষ্টের ঘোর বিরোধী। বলেছিলেন সবাই পাকিস্তানে চলে গেলেও আমি এই ভারতেই থাকব। ৭৩ লাখ মুসলিম তখন পাকিস্তানে গিয়েছিলেন। মদনী রহ সে ঘোষনা না দিলে ভারত হত একক হিন্দু রাষ্ট। মদনী রহ কে তখন আক্রমন করা হয়েছিল কংগ্রেসের দালাল বলে। মাদানী রহ এর কট্টর বিরোধীদাকারিদের একজন, মাওলানা শিব্বির আহমদ উসমিনী। তিনি মৃত্যুর আগে প্রায়ই বলতেন, মুজক জিন্নাহ ধোকা দিয়া, সিয়াসী সমজা ওহ মাদানীনে সমজনা”।

৪৭সালে হিন্দুস্তান জুড়ে হযরত মাদানী রহ.কে কাফের ফতওয়া প্রদানের হিড়িক পড়ে যায়। ফতোয়াগুলো কোন ইংরেজ দালাল দেয় নি। যারা দিয়েছিলেন। তারাও ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলরন। পাকিস্তান আন্দোলনের স্রষ্টারা মনে করতেন, হযরত মাদানী ইসলামি রাষ্ট তথা খেলাফতের বিরোধী। ব্যাস তিনি কুফরের মাঝে আছেন। স্রোতের সাথে ভেসে তার আজীবনের ভক্ত এক আল্লামাও কাফের ফতওয়া প্রদান করে রীতিমত হযরত মাদানী রহ এর বিরোদ্ধে একটি দালিলিক কিতাব লিখে ফেলেন। অগত্যা হযরত শায়খুল ইসলাম মাদানী (রহ) নিজের অবস্তান পরিষ্কার করে ”মুত্তাহিদায়ে কাওমিয়্যাত আওর ইসলাম ”’ নামে একটি কিতাব রচনা।

_____________________________________
হযরতজী মাওলানা মোহাম্মদ ইলিয়াস

দিল্লী শাহী মসজিদে এমন অবস্থা হয়েছিল, এক ওয়াক্তে একক মসলকের একেক ইমাম নামাজ পড়াতেন। একাধিক জামাত হত হর ওয়াক্তে। এক আলেমের অনুসারী আরেক ইমামের পেছনে নামাজ পড়তেন না। একেক আহলে হক ইমামের অনুসারীরা একেক ধরনের টুপি, পান্জাবী, পাগরী পড়তেন। উম্মতের পোশাক পর্যন্ত ভাগ হয়ে গিয়েছিল। আলেম আর আওয়ামের মাঝে জুযন জুযন দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। এমন এক কঠিন পরিস্তিতে হযরতজী মাওলানা ইলিয়াস রহ মেওয়াতের মূর্খ আওয়ামদের নিয়ে যখন দাওয়াত ও তাবলীগের মোবারক মেহনত আরম্ব হল। তখন বড়বড় আরেমদের এই কাজ বুঝে আসে নি। চারদিক থেকে শুরু হল বিরোধীতার তুফান। হযরতজীর বিরোদ্ধে লিফলেট, পেষ্টার এমন কিছু নেই যা করা হয় নি।


এটা পড়ুন  ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহঃ দিল্লিবাসী সাধারণ জনগণের পরিণতি


হযরতজী মাওলানা মোহাম্মদ ইলিয়াস রহ যখন দাওয়াত ও তাবলীগের এই মোবারক মেহনত শুরু করেন তখন এই কাজের উপর নানান অভিযোগ আর এশকালাত এসেছিল শুরু থেকেই বড়বড় শায়খুল মাশায়েখদের পক্ষ থেকে। আহলে হক উলামায়ে কেরাম ও কাছের মানুষদের কাছ থেকেই তিনি সবচেয়ে বেশি বাধা গ্রস্থ হয়েছিলেন। তার এক আত্মীয় মাওলানাতো এই কাজের বিরোধীতা করতে গিয়ে তাকে ঘর থেকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন,ঘোমরাহ মৌলবী বলে। বড় বড় এলমি মারকাজ থেকে আওয়ামদের নিয়ে এই দাওয়াতের মেহনত শুরু করার বিরোধীতা করে শহরে বড়বড় পোষ্টার লাগিয়ে ফতোয়া প্রকাশ করা হচ্ছিল।

হযরতজীর উপর যখন ফতোয়ার তুফান চলছিল ভারতজুরে, তখন বড় হযরতজী চুপ ছিলেন, কিন্তু হাকীমুল ইসলাম ক্বারি তাইয়্যেব রহ তখন এসবের জবাব দিয়ে লিখলেন, তাবলীগী মেহনত কিয়া জরুরী হ্যায়, শায়খুল হাদীস জাকারিয়া রহ. “জামাতে তাবলীগরপার এতরাজকে জওয়াবাত, আল্লামা মঞ্জুর নোমানী রহ “তাবলীগ পর এশকালাত কি জওবাত” মালুফুজাতে হযরতজী। মুফতি হাবিবুর রহমান রহ তাবলীগ জামাত আওর উসকা নাকিদিন”। মুফতি মাহমুদ হাসান গাঙ্গুহী রহ “ফতোয়ায়ে মাহমুদীয়া” আফ্রিকা আওর খেদমতে তাবলীগ” খুতুবাত ও হাকীকতে তাবলীগ। নুর মোহাম্মদ কাদের তিউনুসবীর “তাবলীগ জামাত আওর মাশায়েখে আরব”। এহতেশামুল হাসান এর সাওয়ানাহে হযরতজী দেহলভীসহ অসংখ্য পুস্তিকা আমাদের অনেক আকাবিরগন লিখে জবাব দিয়েছিলেন। কিন্তু হযরতজী ঠিকই নিরব ছিলেন। ফলে আশ্চর্য এক আমল সব ফেৎনার তুফানকে উড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিল কয়েক বছরের ভিতরেই।

(বিস্তারিত দেখুন, আপবিতী, শায়খুল হাদীস জাকারিয়া রহ., তাবলীগ জামাত আওর মুফতি মাজমুদ রহ গ্রন্থে)
________________________________________
আল্লামা ইকবাল

আমাদের আকাবিরদের মাঝে যিনি স্বগোত্রের আলেমদের বিশ্বাস, চেতনা ও আক্বিদা লালন করার পরেও সবচেয়ে বেশি নির্যাতন আর ফতোয়ার রোশানলে বারবার পড়েছেন তিনি আল্লামা ইকবাল। আল্লামা ইকবাল ছিলেন। দুরদর্শী চিন্তা ও উম্মাহর কল্যান এবং জাগরনের এক ধারক বাহক। তার কবিতা, লেখনি, প্রবন্ধ, নিবন্ধ, ও বক্তৃতা ছিল উম্মাহর জাগরনের হাতিহায়ার। আর উম্মাহকে বিনিষ্টকারি স্বার্থপর শ্রেণীর বিরোদ্ধে সোচ্চার। ফলে তার ললাটের স্থায়ী লিখন ছিল উলামাদের বিরোধীতা। তার উপর নানান কারনেই এতোবেশি ফতোয়া হয়েছে, তার জীবনী গ্রন্থাকার লিখেছেন, এসব দিয়ে হাজার পৃষ্টার গ্রন্থ রচনা করা সম্ভব হত। বিশেষ করে আল্লামা ইকবালের, শিকওয়া কাব্য গ্রন্থ প্রকাশের পর ভারতবর্শজুড়ে তার উপর কুফরি ফতোয়া ও কাফের বলার হিরিক পড়ে যায়। তখন তিনি বলেছিলেন, আমি যদি কাফের হই তোমরা কেউ আর মুসলিম নও। তারপর দীর্ঘ অপেক্ষার পর, :জওয়াবে শিকওয়া” লিখে তিনি তার উপর আরোপিত অভিযোগের জবাব দিয়েছিলরন।

_______________________________
মাওলানা জামাল উদ্দীন আফগানী

জামাল উদ্দীন আফগানী ছিলেন যুগ সংস্কারক এক মহান আলেমেদ্বীন। ভারত উপমহাদেশ পেরিয়ে এই আফগান আলরমেদ্বীন আরব বিশ্বে ব্যাপক জনপ্রিয় ছিলেন। স্প্যান ইসলাম, নামে তিনি একটি যুগান্তকারী আন্দোলনের প্রবর্ক্তা। জীবনের বড় অংশ কাটিয়েছেন ভারতবর্ষ ও মিসরে। লিখেছেন ,অনেক গ্রন্থ। তারমধ্যে মাকালাতে জামাল উদ্দিন ও আসারে জামালুদ্দিন বিখ্যাত।তিনি তার এক বয়ানে বয়ানে বলেছিলেন, খোদ নবীরাও যখন চেষ্টা -সাধনা ক্ষেত্রে শৈথিল্য প্রদর্শন করেন, তখন তাদেরও পিছিয়ে পড়তে হয়েছে। এর পরেই অন্ত্যন্ত নৈপুণ্যের সাথে উক্ত বক্তৃতাকে বক্তৃতাকে বিভিন্নভাবে বিকৃতি করে তার ভিত্তিতে আফগানীকে কাফির বলে ফতোয়া দেওয়া হয়।

যখন, ঐ ফতোয়া সম্পর্কে আফগানী অবহিত করা হয় তখন তিনি বলেন, তাঁরা আমাকে কাফির বলে ফতোয়া দিচ্ছে এবং আমিও তাদের উপর সেই ফতোয়াই চড়াচ্ছি। ইবনে সীনা রহ এর উপর যখন কুফরি ফতোয়া দেয়া হয়েছিল তখন, তিনি কবিতা আবৃত্তি করে বলতেন, বর্তমান যুগে শুধু আমি আর আমার অনুসারীরাই মুসলমান, তা ছাড়া আর কোন মুসলমানের অস্তিত্ব নেই। আফগানী বলতেন আমারও এই জবাব। (বিস্তারিত দেকুন সাইয়্যিদ জামাল উদ্দিন আফগানীর রচনাবলী, মুহাম্মডআব্দুল কুদ্দুস কাসেম, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ)
__________________________________
ফেদায়ে মিল্লাত সৈয়দ আসআদ মাদানী

ফিদায়ে মিল্লাত আসআদ মাদানী রহ. কাহিনী। যুদ্ধ চলছে কারগিলে। ভারত সৈন্যদের সাথে মুসলমানদের। ফিদায়ে মিল্লাত -রসদ পাঠালেন হিন্দু সৈন্যদের জন্য। সফরে চলে গেলেন এক-মাসের জন্য। সমালোচনা ঝড় উঠলো উলামায়ে কেরামের মাঝে। একি করলেন তিনি ? সবাই রাগে ফুঁসতে লাগলেন। তার বিরোদ্ধে কেউ কেউ ফতোয়া দিয়ে দিলেন। এদিকে মুসলিম সৈন্যদের হাতে প্রচন্ড মার খেলো হিন্দু সৈনারা। পার্লামেন্টে প্রস্তাব উঠলো গনহারে মুসলিম নিধনের। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বাঁধ সাধলেন। বললেন, মুসলিম নেতা আসআদ মাদানী আমাদের সৈন্যরদেরর জন্য রসদ পাঠালেন। এর পরও কোন যুক্তিতে আমরা মুসলিম নিধন করবো? এক মাস পর ফিরে এলেন ফিদায়ে মিল্লাত। সাঈদ আহমদ পালনপুরী দা.বা. বললেন “হযরত ! সিয়াসাত আপ হি কে লিয়ে হেঁ“। এরকম অসংখ্য নির্যাতন আর জুলুমে বারবার স্বীকার হতে হয়েছিল হযরত ফেদায়ে মিল্লাত রহ কে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে যখন আল্লামা আসাদ মাদানী সরাসরি অবস্থান নেন, তখন পাকিস্তানের আলেমদের এক জামাত মুসলিম রাষ্ট ভাঙ্গার অভিযোগ ও হিন্দুদের দালাল বলে সরাসরি কাফের ফতোয়া দেয়া হয়। দৈনিক সংগ্রামে তাদের বিবৃতি ছাপা হয়।
_____________________
ইতিহাস অামাদের যে চমকপ্রদ তথ্যটি দিচ্ছে তা হলো, মানুষ এসব ফতোয়াবাজদের মনে রাখেনি। কিন্তু ফতোয়ার শিকার ব্যক্তিগণের নাম ইতিহাসের পাতায় জ্বল জ্বল করছে। শাহ ওয়ালী উল্লাহ দেহলভী রহ. মাওলানা কাসেম নানুতাবি রহ. মাওলানা স্যায়িদ হুসাইন আহমদ মাদানী রহ. মাওলানা উবায়দুল্লাহ সিন্ধি রহ. অাল্লামা ইকবাল রহ. মাওলানা আবুল কালাম আযাদ, মাওলানা জামাল উদ্দিন আফহানী রহসহ অসংখ্য যুগের নকীবদের উপর উপমহাদেশে সময়ে সময়ে ভয়ংকর কুফরি ফতোয়া আরোপিত হয়েছে। তাদের উপর কে বা কোন কোন প্রতিক্রিয়াশীল ওলামা ফতোয়া দিয়েছে সেটি অাজ অার কেউ মনে রাখেনি।

আরেক ভাবে বললে, যাদের নামই ইতিহাসে পরবর্তীতে সোনালী কালিতে লেখা হয়েছে, তাদের প্রত্যেকেই এই পরিবেশ মোকাবেলা করেছিলেন। হুজুগী ফতোয়া আর নানান সমালোচনার কটিন পাহাড় অতিক্রম করে তারা অমর হয়েছেন। ইমাম বুখারী রহ. তো শেষ পর্যন্ত আল্লাহ্ তাআলার কাছে যাওয়ার আর্জী পেশ করেছেন। মিশকাতের শরাহ মিরকাতুল মাফাতিহের মাকতাবায়ে রশীদিয়া সংস্করনে ইমাম বুখারীর জীবনী দেয়া আছে। সংক্ষেপে এতো সুন্দর আলোচনা আর দেখিনি। পড়ে দেখুন, চোখ দিয়ে অঝোর ধারার কান্না বের হবে।

এভাবেই। যুগে যুগে এসবই ঘটেছে। এবং ঘটবে। ফতোয়াবাজরা হারিয়ে যাবেন যুগের অন্তলোকে। আর চিন্তাশীল যুগ শেষ্ট মনীষা গন যাদের বারোধীধীতা করা হয়েছিল, নানান বাহানা আর গায়েল করার ফতোয়া নামক হাতিয়ার ব্যবহার করে, তারাই ইতিহাসে অমর হয়ে রবেন যুগ যুগান্তরে। আকাবিরদের ইজ্জত হননের নষ্ট খেলায় মেতে উঠেছিল স্বগোত্রের লোকজন তারাই একদিন ঘৃনীত হয়ছে ইতিহাসের কাটগড়ায়। আর যারা স্রোতের সাইক্লোন মোকাবিলায় পাহারসম ধর্য্য নিয়ে তাদের আনুগত্য করে গেছেন শত আক্রমনের মোকাবিলায় তাদেরকেই আজ শ্রদ্ধা করা হয়, শ্রদ্ধা করবে আগামি পৃথিবী।

কুতবে আলম শায়খুল ইসলাম মাওলানা সাইয়্যিদ হুসাইন আহমদ মাদানী রহ এর উপর দীর্ঘ সময় আলেমদের একটি বড় জামাতের পক্ষ থেকে এমন কটিন নির্যাতন ও সমালোচনা গেছে যে, যা পাঠ করলে গা শিউরে উঠে। হযরত মাদানী রহ.কে পুড়িয়ে মারার জন্য মুসলীম লীগের কর্মিরা ট্রেনে তার কামরায় আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। আল্লাহর কুদরতে তিনি বেঁচে গিয়েছিলেন। রাস্তায় একদল পাকিস্তানপন্থি আলেম শাইখুল ইসলাম মাদানী রহ. এর পাগড়ী টেনে খুলে সেই সময়েই যখন তাঁর গায়ে হাত তোলা
হচ্ছিল তখন তাঁর খাদেম আঘাতগুলো নিজের গায়ে নিচ্ছিলেন। তাঁকে রক্ষা করতে নিজের প্রাণ উৎসর্গ করছিলেন।

ঘটনাটি প্রায় প্রতিটি জীবনীতেই আলোচনায় এসেছে। এখন আপনার সিদ্ধান্ত আপনার হাতে, নিজেকে ইতিহাসের পাতায় কোন দলে দেখতে চান? যখন একজন না- সীহুন আমীন কে আঘাত করা হচ্ছিল, পাগড়ী টেনে নেয়াদের দলে , না তাঁর রক্ষাকারীদের দলে?

এখন আপনার সিদ্ধান্ত আপনার হাতে, নিজেকে ইতিহাসের পাতায় কোনদলে দেখতে চান? যুগে যুগে ফতোয়া প্রদানকারে আকাবিরদের গায়েল কারার হীন চেষ্টাকারীদের দলে? যখন কুরআন হাদিসের অসংখ্য দলীল আর কিতাব লিখে একজন না- সীহুন আমীন কে আঘাত করা হচ্ছিল, পাগড়ী টেনে নেয়াদের দলে , না তাঁর রক্ষাকারীদের দলে?
সিদ্ধান্ত আপনার…

সিদ্ধান্ত আপনার হাতে…

রোজার আধুনিক মাসায়েল

১. ইনজেকশন (Injection): ইনজেকশন নিলে রোযা ভাঙবে না। (জাওয়াহিরুল ফতওয়া) [তবে অনেক ডাক্তারের মতে এটা এড়িয়ে চলা ভালো।]

২.ইনহেলার (Inhaler): শ্বাসকষ্ট দূর করার লক্ষ্যে তরল জাতীয় একটি ওষুধ স্প্রে করে মুখের ভিতর দিয়ে গলায় প্রবেশ করান হয়, এভাবে মুখের ভিতর ইনহেলার স্প্রে করার দ্বারা রোজা ভেঙ্গে যাবে।(ইমদাদুল ফতওয়া)

৩.এনজিও গ্রাম (Angio Gram) হার্ট ব্লক হয়ে গেলে উরুর গোড়া দিয়ে কেটে বিশেষ রগের ভিতর দিয়ে হার্ট পর্যন্ত যে ক্যাথেটার ঢুকিয়ে পরীক্ষা করা হয় তার নাম এনজিও গ্রাম।এযন্ত্রটিতে যদি কোন ধরনের ঔষধ লাগানো থাকে তারপরেও রোজা ভাঙ্গবে না। (ইসলাম ও আধুনিক চিকিৎসা)

৪.এন্ডোস কপি (Endos Copy): চিকন একটি পাইপ যার মাথায় বাল্ব জাতীয় একটি বস্তু থাকে।পাইপটি পাকস্থলিতে ঢুকানো হয় এবং বাইরে থাকা মনিটরের মাধ্যমে রোগীর পেটের অবস্থা নির্নয় করা হয়। এ নলে যদি কোন ঔষধ ব্যবহার করা হয় বা পাইপের ভিতর দিয়ে পানি/ঔষধ ছিটানো হয়ে থাকে তাহলে রোজা ভেঙ্গে যাবে, আর যদি কোন ঔষধ লাগানো না থাকে তাহলে রোযা ভাঙ্গবে না। (জাদীদ ফিকহী মাসায়েল)

৫. নাইট্রোগ্লিসারিন (Nitro Glycerin): এরোসল জাতীয় ঔষধ, যা হার্টের জন্য দুই-তিন ফোটা জিহ্বার নীচে দিয়ে মুখ বন্ধ করে রাখে।ঔষধটি শিরার মাধ্যমে রক্তের সাথে মিশে যায় এবং ঔষধের কিছু অংশ গলায় প্রবেশ করার প্রবল সম্ভবনা রয়েছে। অতএব- এতে রোজা ভেঙ্গে যাবে। (জাদীদ ফিকহী মাসায়েল)

৬. লেপারোস কপি (Laparoscopy): শিক্ জাতীয় একটি যন্ত্র দ্বারা পেট ছিদ্র করে পেটের ভিতরের কোন অংশ বা গোশত ইত্যাদি পরীক্ষা করার উদ্দেশ্যে বের করে নিয়ে আসার জন্য ব্যবহৃত যন্ত্র। এতে যদি ঔষধ লাগানো থাকে তাহলে রোজা ভেঙ্গে যাবে অন্যস্থায় রোযা ভাঙ্গেব না। (আল মাকালাতুল ফিকহীয়া)


এটা পড়ুন আমরা রোজা রাখি কেন?


৭.অক্সিজেন (Oxygen): রোজা অবস্থায় ঔষধ ব্যবহৃত অক্সিজেন ব্যবহার করলে রোজা ভেঙ্গে যাবে।তবে শুধু বাতাসের অক্সিজেন নিলে রোযা ভাঙ্গবে না। (জাদীদ ফিকহী মাসায়েল)

৮. মস্তিস্ক অপারেশন (Brain   Operation): রোজা অবস্থায় মস্তিস্ক   অপারেশন করে ঔষধ ব্যবহার করা হোক বা না হোক   রোজা ভাঙ্গবে না। (আল মাকালাতুল ফিকহীয়া)

৯. রক্ত নেয়া বা দেয়া :    রোযা অবস্থায় রক্ত দিলে রোযা ভাঙ্গে না। তাই টেস্ট বা পরীক্ষার জন্য রক্ত দেওয়া যাবে। তবে এ পরিমাণ রক্ত দেওয়া মাকরুহ যার কারণে শরীর অধিক দুর্বল হয়ে পড়ে এবং রোযা রাখা কষ্টকর হয়ে যাবে। তাই দুর্বল লোকদের জন্য রোযা অবস্থায় অন্য রোগীকে রক্ত দেওয়া ঠিক নয়। আর এমন সবল ব্যক্তি যে রোযা অবস্থায় অন্যকে রক্ত দিলে রোযা রাখা তার জন্য কষ্টকর হবে না সে রক্ত দিতে পারবে। এতে কোন অসুবিধা নেই। [সহীহ বুখারী, হাদীস ১৯৩৬, ১৯৪০, আলবাহরুর রায়েক ২/২৭৩   কিতাবুল আসল ২/১৬৮ মাজমাউল আনহুর ১/৩৬০]

১০. সিস্টোসকপি (cystoscopy):    প্রসাবের রাস্তা দিয়ে ক্যাথেটার প্রবেশ করিয়ে যে পরীক্ষা করা হয়   এর দ্বারা রোজা ভাঙ্গবে না। (হেদায়া)

১১.প্রক্টোসকপি (proctoscopy): পাইলস, পিসার, অর্শ, হারিশ, বুটি ও ফিস্টুলা ইত্যাদি রোগের   পরীক্ষাকে প্রক্টোসকপ বলে।মলদ্বার দিয়ে নল প্রবেশ করিয়ে পরীক্ষাটি করা হয়। রোগী যাতে ব্যথা না পায় সে জন্য  নলের মধ্যে গ্লিসারিন জাতীয় কোন পিচ্ছল বস্তু ব্যবহার করা হয়। নলটি পুরোপুরী ভিতরে প্রবেশ করে না। চিকিৎসকদের মতানুসারে ঐ   পিচ্ছিল বস্তুটি নলের সাথে মিশে থাকে এবং নলের সাথেই বেরিয়ে আসে, ভেতরে থাকে না। আর থাকলেও তা পরবর্তীতে বেরিয়ে আসে। যদিও শরীর তা চোষে না কিন্তু ঐ   বস্তুটি ভিজা হওয়ার কারণে রোজা ভেঙ্গে যাবে।   (ফতওয়া শামী)

১২. কপার-টি (Coper-T):    কপার-টি বলা হয় যোনিদ্বারে প্লাস্টিক   লাগানোকে, যেন সহবাসের সময় বীর্যপাত হলে বীর্য   জরায়ুতে পৌছাতে না পারে। এ কপার-টি লাগিয়েও সহবাস করলে রোযা ভেঙ্গে যাবে।  কাযা কাফফারা উভয়টাই ওয়াজিব হবে।

১৩.সিরোদকার অপারেশন(Shirodkar   Operation): সিরোদকার অপারেশন হল  অকাল গর্ভপাত হওয়ার আশংখা থাকলে জরায়ুর মুখের   চতুষ্পার্শ্বে সেলাই করে মুখকে খিচিয়ে রাখা।এতে অকাল   গর্ভপাত রোধ হয়।যেহেতু এতে কোন ঔষধ বা বস্তু রোযা ভঙ্গ হওয়ার   গ্রহণযোগ্য খালি স্থানে পৌছে না তাই এর দ্বারা রোযা ভাঙ্গবে না।

১৪. ডি এন্ড সি (Dilatation and   Curettage): ডি এন্ড সি হল আট থেকে দশ সপ্তাহের মধ্য Dilator এর   মাধ্যমে জীবত কিংবা মৃত বাচ্চাকে মায়ের গর্ভ থেকে বের করে নিয়ে আসা।   এতে রোযা ভেঙ্গে যাবে। অযথা এমন করলে কাযা কাফফারা উভয়টি দিতে হবে এবং তওবা করতে হবে।   (হেদায়া)

১৫. এম.আর(M.R):    এম আর হল গর্ভ ধারণের পাঁচ থেকে আঁট সপ্তাহের   মধ্যে যোনিদ্বার দিয়ে জরায়ুতে এম,আর সিরন্জ প্রবেশ   করিয়ে জীবত কিংবা মৃত ভ্রণ নিয়ে আসা। যারপর ঋতুস্রাব পুনরায়   হয়। অতএব মাসিক শুরু হওয়ার কারণে রোযা ভেঙ্গে যাবে এবং কাযা করতে হবে।   কিন্তু যদি রাতের বেলা করা হয় তাহলে দিনের রোজা কাযা করতে হবে না। (ফতহুল   কাদীর)

১৬.আলট্রাসনোগ্রাম(Ultrasongram):    আলট্রাসনোগ্রাম পরীক্ষায় যে ঔষধ বা যন্ত্র ব্যবহার করা হয় সবই   চামড়ার উপরে থাকে, তাই আলট্রাসনোগ্রাম করলে রোযা ভাঙ্গবে না। (হেদায়া)

১৭. স্যালাইন (Saline):    স্যালাইন নেয়া হয় রগে, আর রগ যেহেতু   রোজা ভঙ্গ হওয়ার গ্রহণযোগ্য রাস্তা নয়, তাই স্যালাইন   নিলে রোজা ভাঙ্গবে না, তবে রোজার কষ্ট লাঘবের জন্য স্যালাইন   নেয়া মাকরূহ। (ফতওয়ায়ে দারাল উলূম)

১৮. টিকা নেয়া (Vaccine) :    টিকা নিলে রোজা ভাঙ্গবে না। কারণ, টিকা রোজা ভঙ্গ হওয়ার   গ্রহণযোগ্য রাস্তায় ব্যবহার করা হয় না। (আপকে মাসায়াল)

১৯. ঢুস লাগানো (Douche):    ঢুস মলদ্বারের মাধ্যমে দেহের   ভিতরে প্রবেশ করে, তাই ঢুস নিলে রোজা ভেঙ্গে যাবে। ঢুস   যে জায়গা বা রাস্তা দিয়ে প্রবেশ করে এ জায়গা বা রাস্তা রোজা ভঙ্গ   হওয়ার গ্রহণযোগ্য স্থান । (ফতওয়া শামী)

২০.ইনসুলিন গ্রহণ করা (Insulin):    ইনসুলিন নিলে রোজা ভাঙ্গবে না। কারণ, ইনসুলিন রোযা ভঙ্গ হওয়ার  গ্রহণযোগ্য রাস্তা দিয়ে প্রবেশ করে না এবং গ্রহণযোগ্য খালী জায়গায় প্রবেশ করে না।   (জাদীদ ফিকহী মাসায়েল)

২১.দাঁত তোলা: রোজা অবস্থায় একান্ত   প্রয়োজন হলে দাঁত তোলা জায়েয   আছে। তবে অতি প্রয়োজন না হলে এমনটা করা মাকরূহ। ঔষধ   যদি গলায় চলে যায় অথবা থুথু থেকে বেশী অথবা সমপরিমান রক্ত   যদি গলায় যায় তাহলে রোজা ভেঙ্গে যাবে। (আহসানুল ফতওয়া)

২২. পেস্ট, টুথ পাউডার ব্যবহার করা : রোজা অবস্থায় দিনের বেলায় টুথ পাউডার, পেস্ট, মাজন   ইত্যাদি ব্যবহার করা মাকরূহ। কিন্তু গলায় পৌঁছালে রোজা ভেঙ্গে যাবে।   (জাদীদ ফিকহী মাসায়েল)

২৩.মিসওয়াক করা : শুকনা বা কাঁচা মিসওয়াক দিয়ে দাঁত   মাজার দ্বারা রোজার কোন ক্ষতি হয় না। চাই যখনই করা হোক না কেন।   (ফতওয়া শামী)

২৪. মুখে ঔষধ ব্যবহার করা : মুখে ঔষধ ব্যবহার করে তা গিলে ফেললে বা ঔষধ অংশ বিশেষ গলায় প্রবেশ করলে রোজা ভেঙ্গে যাবে। গলায় প্রবেশ না করলে রোজা ভাঙ্গবে না। (ফতওয়া শামী)

২৫. রক্ত পরীক্ষার জন্য রক্ত দেয়া: রক্ত পরীক্ষার জন্য রক্ত দিলে রোযার কোন ক্ষতি হবে না। তবে খুব বেশী পরিমাণে রক্ত দেয়া যার দ্বারা শরীরে দুর্বলতা আসে, তা মাকরূহ।

২৬. ডায়াবেটিসের ‍সুগার মাপা: ডায়াবেটিসের ‍সুগার মাপার জন্য সুচ ঢুকিয়ে যে একফোটা রক্ত নেয়া হয়, এতে রোযার কোন ক্ষতি হবে না।

২৭. নাকে ঔষধ দেয়া : নাকে পানি বা ঔষধ দিলে যদি তা খাদ্য নালীতে চলে যায়, তাহলে রোজা ভেঙ্গে যাবে এবং কাযা করতে হবে। (ফতওয়া রাহমানিয়া)

২৮. চোখে ঔষধ বা সুরমা ব্যবহার করা : চোখে ঔষধ বা সুরমা ব্যবহার করার দ্বারা রোজা ভাঙ্গবে না। যদিও এগুলোর স্বাদ গলায় অনুভব হয়। (হেদায়া)

২৯. কানে ঔষধ প্রদান করা : কানে ঔষধ, তেল ইত্যাদি ঢুকালে রোযা ভেঙ্গে যাবে।তবে গোসল করার সময় অনিচ্ছায় যে পানি কানে ঢুকে তাতে রোযা ভঙ্গ হবে না। অবশ্য এক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে, যেন পানি গলায়
না চলে যায়। (মাকালাতুল ফিকহীয়া)

৩০. নকল দাঁত মুখে রাখা: রোজা রেখে নকল দাঁত মুখে স্থাপন করে রাখলে রোজার কোন ক্ষতি হয়
না। (ইমদাদুল ফতওয়া)

যাকাত বিষয়ক ভুল-ত্রুটি, মুফতি আব্দুল্লাহ আল-মাসুম

যাকাত একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। তাই তা সঠিকভাবে আদায় করা জরুরী। নামায যেমন সঠিকভাবে আদায় করতে হয়। তেমনি যাকাতও সঠিকভাবে আদায় করতে হবে। আদায়ে ভুল বা ত্রুটি যেন না হয়। এখানে যাকাত আদায়ে বহুল প্রচলিত কিছু ভুল-ত্রুটি নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করা হল। যেন আমরা এসব ভুল থেকে সহজে বেঁচে থাকতে পারি। এর সাথে যাকাত বিষয়ে চিন্তাগত কিছু ভুলও উল্লেখ করা হয়েছে।

১. যাকাতবর্ষ কবে পূর্ণ হয় তা যথাযথভাবে হিসাব না রাখা। শুধু প্রতি রমযানে যাকাত আদায় করা। এটি ঠিক নয়। কারণ, বাস্তবে যদি রমযানের আগেই আপনার যাকাতবর্ষ পূর্ণ হয়ে থাকে তাহলে রমযানের আগের দিনগুলোর যাকাত অনাদায়ী থেকে যাবে। তাই করণীয় হল, চিন্তা-ভাবনা করে হিসাব করে চন্দ্র বর্ষ অনুাযয়ী যাকাতবর্ষ ঠিক করা।

২. যথাযথ হিসাব না করে অনুমান করে যাকাত আদায় করা। এটিও ঠিক নয়। নামায যেমন অনুমান করে পড়া যায় না। তেমনি যাকাতও অনুমান করে আদায় করা যায় না। এতে যাকাত অনাদায়ী থেকে যেতে পারে। তাই যথাযথ হিসাব করে যাকাত আদায় করা জরুরী।

৩. অনেকের ধারণা, নগদ ক্যাশের যাকাত আদায়ে স্বর্ণের নেসাব ধর্তব্য হবে। সুতরাং সাড়ে সাত ভরি স্বর্ণের মূল্যে নগদ ক্যাশ না পৌঁছলে যাকাত দিতে হবে না। এটি সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। নগদ ক্যাশে রূপার নেসাব ধর্তব্য হয়। এমনকি সাড়ে সাত ভরির কম স্বর্ণের সাথে যদি নগদ ক্যাশ থাকে তাহলে সেক্ষেত্রেও স্বর্ণের নেসাব ধর্তব্য নয়; বরং রূপার নেসাব ধর্তব্য হবে। হাঁ, কারো কাছে যদি কেবল স্বর্ণ থাকে, এর সাথে যাকাতযোগ্য অন্য কোনো সম্পদ না থাকে তাহলে কেবল সেক্ষেত্রে স্বর্ণের নেসাব ধর্তব্য হবে।

৪. অনেকের ধারণা, প্রতি টাকায় এক বছর অতিক্রান্ত হতে হবে। এটি অত্যন্ত ব্যাপক একটি ভুল ধারণা। যাকাত আদায় আবশ্যক হওয়ার জন্য প্রতি টাকায় স্বতন্ত্র এক বছর অতিক্রান্ত হওয়া জরুরী নয়। যেদিন যাকাতবর্ষ পূর্ণ হবে সেদিন হাতে নগদ টাকা যা থাকবে সবগুলোর আড়াই পার্সেন্ট যাকাত হিসেবে আদায় করতে হবে। এমনকি একদিন আগে যে টাকা হাতে এসেছে এরও যাকাত দিতে হবে।

৫. যাকাত হিসাবে বাজরে প্রচলিত যাকাতের শাড়ী ও লুঙ্গী আদায় করা। এটি মোটেও ঠিক নয়। প্রথমত, যাকাত হিসেবে নগদ ক্যাশ আদায় করা নিয়ম। কারণ এর মাধ্যমে যাকাত গ্রহীতা তার সব ধরনের প্রয়োজন পূরণ করতে পারে। দ্বিতীয়ত, এসব শাড়ী হয়ে থাকে খুবই নি¤œমানের। খুব দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়। অতএব এ থেকে বিরত থাকা উচিত।

৬. অনেকের ধারণা যাকাত আদায় করলে সম্পদ হ্রাস পায়। এটি সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। সুদ সম্পদ বৃদ্ধি করে এ ধারণা যেমন সঠিক নয়, তেমনি যাকাত সম্পদ হ্রাস করে এটিও ঠিক নয়। সম্পদের মালিক আল্লাহ সুবহানাহু। তিনিই আমাদেরকে সম্পদ দান করেন। তিনি স্বয়ং ঘোষণা দিয়েছেন-যাকাতে সম্পদ হ্রাস হয় না;বরং বৃদ্ধি হয়।

৭. বিভিন্ন টিভি চ্যানেলকে যাকাত প্রদান। এটি ঠিক নয়। এতে যাকাতের উপযুক্ত কাউকে মালিকানা প্রদান করে যাকাত আদায় করা হয় না। অতএব এভাবে যাকাত দিলে তা আদায় হবে না।

৮. মসজিদের দান বাক্সে বা নির্মাণ কাজে যাকাত প্রদান। এটিও ঠিক নয়। এভাবে যাকাত আদায় হবে না।

৯. মাদ্রাসার নির্মাণ কাজ, মাদ্রাসার উস্তাযদের বেতন-ভাতা এসব খাতেও যাকাত প্রদান করা যাবে না।

১০. রমযানের হাফেযদেরকে হাদীয়ার নামে যাকাতের অর্থ প্রদান। এটিও ঠিক নয়। কারণ, হাফেয সাহেব যাকাত গ্রহণের উপযুক্ত নাও হতে পারেন। উপয্ক্তু হলেও এতে পারিশ্রমিকের গন্ধ আছে। তাই তারাবীহের নামায পড়ানোর উপলক্ষ্যে তাকে যাকাত দেয়া যাবে না। অবশ্য যাকাত গ্রহণের উপযুক্ত হলে রমযানের আগে পরে দেয়া যাবে।

১১. অনেক নারী তাদের ব্যবহৃত স্বর্ণ/রূপার অলংকারের যাকাত আদায় করে না। এটি মোটেও ঠিক নয়। এ ব্যাপারে পূর্বে হাদীস উল্লেখ হয়েছে যে, যেসব নারী স্বর্ণ/রূপার অলংকারের যাকাত প্রদান করে না তাদেরকে কেয়ামতের দিন আগুনের অলংকার পরিধান করানো হবে। অতএব এ ব্যাপারে নারীদের পাশাপাশি পিতা ও স্বামীদের সচেতন হওয়া আবশ্যক।

১২. কাজের বুয়াকে যাকাত প্রদান। এটিও ভুল। অনেকে ঈদের সময় যাকাতের টাকা থেকে তাদের বেতন বাড়িয়ে দেয়। তারা যাকাত গ্রহণের উপযুক্ত হলেও তা বৈধ নয়। কারণ পারিশ্রমিক বাবদ যাকাত আদায় করা যায় না। তাদেরকে যাকাত দিতে হলে বেতন-বোনাস বাদ দিয়ে স্বতন্ত্রভাবে দিতে হবে। (যদি তারা যাকাত গ্রহণের উপযুক্ত হয়)

১৩. ঋণ হিসাবে সুদের অংশও বিয়োগ করা। এটি ভুল। ঋণ বা দেনা হিসাবে সুদ থাকলে সেটা বিয়োগ দেয়া যাবে না। যেমন, কেউ কারো থেকে এক লক্ষ টাকা সুদে করজ নিয়েছে। তাকে এক লক্ষ বিশ হাজার টাকা শোধ করতে হবে। তাহলে সে যাকাতযোগ্য সম্পদ থেকে কেবল এক লক্ষ টাকা বিয়োগ দিতে পারবে। বিশ হাজার নয়।

১৪. সুদী উপার্জন বা উপার্জনের পুরোটাই সুদী। যেমন, সুদী ব্যাংকে চাকরী করা। যদিও সুদের অর্থে যাকাত নেই। এর পুরোটাই সওয়াবের নিয়ত ছাড়া দানযোগ্য। তদুপরি পুরোটা দান সম্ভব না হলে যাকাত আদায় করে যাওয়া উচিত। এতে কিছু হলেও দান হবে।

১৫. যাকাত আদায়ে নিজ আত্মীয়দের মাঝে যারা উপযুক্ত তাদেরকে খুঁজে খুঁজে বের করে যাকাত দেয়া উচিত। অনেকেই এ ব্যাপারে অবহেলা করেন।

১৬. অনেকে লোক দেখানোর জন্য গরীবদেরকে লাইনে দাঁড় করিয়ে যাকাতের শাড়ি-লুঙ্গি প্রদান করে। এটি মোটেও ঠিক নয়। যাকাত একটি ইবাদত। সব ইবাদতই একমাত্র আল্লাহর জন্য করতে হয়। অন্য কারো জন্য নয়।

১৭. যেকোনভাবে খরচ করা যাকাত আদায়ের জন্য যথেষ্ট নয়। কোন কোন বিত্তশালী ভাই মনে করেন, আমরা তো বিভিন্ন উপলক্ষ্যে খরচ করে থাকি। অসহায় লোকদেরকে মোটা অংকের আর্থিক সুবিধা দিয়ে থাকি। অফিসের কোন কর্মচারী অসুস্থ হলে চিকিৎসা খরচ বহন করি। এভাবে পুরো বছর বহু আর্থিক সুবিধা প্রদান করা হয়ে থাকে। সুতরাং আমাদের জন্য আলাদাকরে যাকাত দেয়ার প্রয়োজন নেই ।

এটি সম্পূর্ণ ভুল ধারণা ও খামখেয়ালি। মনে রাখতে হবে, যাকাত একটি ইবাদত। এটি আদায়ের জন্য খোদ রাব্বুল আলামীন এর নিয়ম-নীতি নির্ধারণ করে দিয়েছেন। কী ধরনের সম্পদ থেকে কী পরিমাণ যাকাত দিতে হবে এবং কোথায় কাদেরকে দিতে হবে সবই নির্ধারিত। এসব নিয়ম-কানুন ও বিধি-বিধান অনুসরণ করে যাকাতের নিয়তে সম্পদ খরচ করাকে যাকাত বলে। নিজের খুশিমত জন-কল্যাণমূলক কোন কাজে খরচ করা বা ব্যক্তিগতভাবে কাউকে আর্থিক সহায়তা দেয়া এটি ইখলাসের সাথে হলে নিঃসন্দেহে তা বড় সওয়াবের কাজ। কিন্তু যাকাত আদায়ের জন্য যাকাতের মাসায়েল অনুসারে পাই-পয়সার হিসাব করে যাকাত আদায় করতে হবে।

১৮. অনেকে যাকাত আদায়ের দিন কেবল মোটা অংকের নগদ ক্যাশে হিসাব করে। জামার পকেটে বা মানি ব্যাগে যে ভাংতি কিছু টাকা থেকে যায় তা হিসাবে নিয়ে আসা হয় না। ফলে দেখা যায়, এই খুচরা টাকাগুলোর যাকাত অনাদায়ী থেকে যায়। অথচ যাকাত আদায়ের ক্ষেত্রে নিয়ম হল, পাই পাই হিসাব করে যাকাত আদায় করা।

১৯. যাকাতকে ট্যাক্স মনে করা। যাকাতকে ট্যাক্স মনে করা সম্পূর্ণ মূর্খতা বৈ কিছুই নয়। যাকাতের সাথে ট্যাক্সের বিন্দুমাত্রও সম্পর্ক নেই। এ দুটির মাঝে মৌলিক পার্থক্যগুলো নিম্নরূপ-
– যাকাত একটি খালেস ইবাদত।
-যাকাত আদায়ের খাত সুনির্ধারিত। যা ট্যাক্সে নেই।
-যাকাতের খাত ফকীর-মিসকীন। অথচ ট্যাক্সের সুবিধা ভোগ করে সম্পদশালী ব্যক্তিবর্গ।
-ট্যাক্স আসে ইনকামের উপর (ইনকাম ট্যাক্স)। অথচ যাকাত আসে যাকাতযোগ্য সম্পদের মূলে।
-যাকাতের মাধ্যমে আখলাকের পরিশুদ্ধি ও সম্পদের পবিত্রতা অর্জন করা উদ্দেশ্য হয়। এর সাথে ট্যাক্সের কোন মিল নেই।
মোটকথা, যাকাত ও প্রচলিত ট্যাক্স মোটেও এক নয়। এ দুটির মাঝে বিস্তর পার্থক্য রয়েছে।

এছাড়া যাকাত আদায়ে আরো অনেক ভুল-ত্রুটি হয়ে থাকে। আমাদের উচিত প্রথম কয়েক বছর বিজ্ঞ কোনো আলেমের সাথে বিস্তারিত পরামর্শ করে যাকাত আদায় করা। তাহলে অনেক ভুল-ত্রুটি থেকে বেঁচে থাকা যাবে ইনশাআল্লাহ।

যাকাত নিয়ে যত কথা । মাসায়েল-ফাযায়েল ও অনাদায়ের ভয়াবহতা ।

“যারা স্বর্ণ ও রৌপ্য জমা করে রাখে, আল্লাহর পথে ব্যয় (যাকাত) করে না, তাদেরকে আপনি যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সুসংবাদ দিন।” [সূরা তাওবা: ৩৪]

মুফতি আবদুল্লাহ আল মাসুমঃ কোন বিষয় করার পূর্বে সে বিষয় প্রথমে তা ভালভাবে শিখি। যেমন ব্যবসা/চাকুরী করার পূর্বে তা শিখি । অথচ দ্বীনের ব্যাপারে আমরা একদম উলটো । এখানে যাকাতের মাসায়েল-ফাযায়েল ও অন্যান্য বিষয় বিষয় আলোচনা করা হবে । যা জানব আমরা …
(০১)যাকাত পরিচিতি (০২) কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে যাকাতের বিধান (০৩)যাকাত প্রদানের উপকারিতা (০৪)যাকাত প্রদান না করার ভয়াবহতা (০৫) যাকাতযোগ্য সম্পদ (০৬) যাকাতযোগ্য সম্পদের যাকাত আদায়ের শর্তাবলী (০৭) নেসাব (০৮) যাকাত ও ঋণ (০৯) যাকাত হিসাবের পদ্ধতি (১০) যাকাত আদায়ে কতিপয় ভুল-ত্রুটি (১১) যাকাত আদায় পদ্ধতি

যাকাত পরিচিতি

যাকাত একটি অত্যাবশ্যকীয় “ফরয” ইবাদাত। যাকাত ইসলামের তৃতীয় স্তম্ভ। আর যাকাতের বিধান অস্বীকারকারী বেঈমান। যাকাত শব্দের শাব্দিক অর্থঃ

  • যাকাত (الزكاة) শব্দটি আরবী। আরবী প্রাচীন ও নির্ভরযোগ্য অভিধানগুলোতে এর অর্থ লেখা হয়েছে – বৃদ্ধি, পবিত্রতা, প্রশংসা করা, বরকত হওয়া। বিশিষ্ট আরবী অভিধানবিদ আল্লামা ইবনে মানযুর রহ. (মৃত ৭১১হি.) লিখেছেন – “আভিধানিক দৃষ্টিকোণ থেকে যাকাতের মূল অর্থ হল, পবিত্রতা, বৃদ্ধি, বরকত ও প্রশংসা। এসবকটি অর্থে ‘যাকাত’ শব্দটি কুরআন ও হাদীসে ব্যবহৃত হয়েছে।”
  • তবে শাব্দিকভাবে মূল সম্পদ থেকে যাকাত হিসেবে যে সম্পদটুকু বের করা হয়, তাকে ‘যাকাত’ বলা হয়। তবে আল্লামা যামাখশারী রহ. লিখেছেন – যাকাত আদায়ের কাজটিকেও ‘যাকাত’ বলা হয়।

যাকাত – এর পারিভাষিক অর্থঃ

“মুসলিম, প্রাপ্ত বয়স্ক ও সুস্থ সস্তিস্কসম্পন্ন ব্যক্তি নেসাব পরিমাণ বিশেষ সম্পদের মালিক হলে, উক্ত সম্পদের উপর পূর্ণ একটি চন্দ্র বর্ষ অতিবাহিত হওয়ার পর উক্ত সম্পদের একটি নির্ধারিত পরিমাণ শরীয়ক্ত কর্তৃক নির্ধারিত লোকদেরকে মালিক বানিয়ে দেয়াকে শরীয়তের পরিভাষায় যাকাত বলা হয়।”
উল্লেখ্য মৌলিকভাবে যাকাতের বিধান মক্কায় অবতীর্ণ হয়, তবে তাফসীলীভাবে মদীনায় অবতীর্ণ হয়।

কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে যাকাতের বিধান

কুরআনুল কারীমে অন্তত ২৭ স্থানে নামাযের সাথেই যাকাতের আদেশ করা হয়েছে। যেমন, সূরা হাজ্জ-এ এসেছে ।

فأقيموا الصلاة و آتوا الزكاة واعتصموا بالله

“তোমরা সালাত কায়েম কর, যাকাত প্রদান কর এবং আল্লাহর দ্বীনকে আঁকড়ে ধর” – ৭৮

কুরআনুল কারীমের পাশাপাশি হাদীসেও যাকাতের বিধান স্পষ্টভাবে এসেছে। হাদীসে মাশহুরে এসেছে –بني الإسلام على خمس: شهادة أن لا إله إلا الله، وأن محمد رسول الله، وإقام الصلاة، وإيتاء الزكاة، وصوم رمضان، وحج البيت لمن استطاع إليه سبيلاً.
“পাঁচটি স্তম্ভের উপর ইসলাম দাঁড়িয়ে আছে। যথা – ১. এ কথার সাক্ষ্য দেয়া যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন মাবুদ নেই এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়অসাল্লাম আল্লাহর বান্দা ও রাসূল। ২. নামায কায়েম করা। ৩. যাকাত আদায় করা। ৪. রোযা রাখা। ৫. যে সামর্থ্য রাখে সে হজ্ব করা। – সহীহ বুখারী ১/৬, সহীহ মুসলিম ১/৩২

যাকাত – এর তাৎপর্য

যাকাতের তাৎপর্য অত্যন্ত গভীর ও মর্মস্পর্শী। সংক্ষেপে তা হল নিম্নরূপঃ

যাকাত সম্পদ সিকিউর করে। এক হাদীসে এসেছি –
حصنوا أموالكم بالزكاة
“তোমরা তোমাদের সম্পদকে যাকাত আদায়ের মাধ্যমে সুরক্ষিত করো” – মারাসীল, আবু দাউদ, ২০৫

যাকাত সম্পদ বৃদ্ধি করে, সম্পদ হ্রাস করে না।
যাকাত প্রদান সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করে।

যাকাত প্রদানের উপকারিতা

যাকাত আদায়ের উপকারীতা ও কল্যাণের বহু দিক কুরআন ও হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে। নিম্নে এর কিছু উল্লেখ করা হল-
যাকাত আদায়ে বহুগুণ সওয়াব অর্জন হয়। আল্লাহ তাআলা বলেন –
وما آتيتم من زكواة تريدون وجه الله فأولائك هم المضعفون
“তোমাদের মধ্য থেকে যারা আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে যাকাত যাকাত প্রদান করে তারাই আল্লাহর নিকট দিগুণ সওয়াব প্রাপ্ত হয়” – সূরা রূম: ৩৯

যাকাত-সাদাকা আল্লাহ তাআলার ক্ষোভের আগুন নিভিয়ে দেয় ও অপমৃত্যু রোধ করে। হযরত আনাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন –
إن الصدقة لتطفئ غضب الرب وتدفع ميتة السوء
“নিঃসন্দেহে দান-সাদাকা (যাকাত) আল্লাহ তাআলার ক্ষোভের আগুন নিভিয়ে দেয় এবং অপমৃত্যু থেকে রক্ষা করে।” – জামে তিরমিযী ৬৬৪

যাকাত আদায়ের মাধ্যমে সম্পদের অনিষ্টতা দূর হয়। হযরত জাবির রা. থেকে বর্ণিত, জনৈক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করল, কেউ তার সম্পদেও যাকাত আদায় করলে এর ফায়দা কী? নবীজী জবাবে বললেন –
من ادى زكاة ماله فقد ذهب عنه شره
“যে ব্যক্তি তার সম্পদের যাকাত আদায় করবে, এর মাধ্যমে তার থেকে তার সম্পদের যাবতীয় অনিষ্টতা দূর হয়ে যাবে”। – সহীহ ইবনে খুযাইমা – ৪/১৩

যাকাত প্রদানের উপকারিতা (পার্থিব দিক)

ইসলামের একটি বড় বৈশিষ্ট্য হল, এর প্রতিটি বিধান মানব কল্যাণকে নিশ্চিত করে। মানবের জন্য অকল্যাণকর এমন কোনও বিধান তাতে নেই। যাকাতও এর ব্যতিক্রম নয়। যাকাতের সবচেয়ে কল্যাণকর দিকটি হল-অর্থ-সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত হয় যা দারিদ্র বিমোচনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে।

আজকে আমাদের দেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে যদি যাকাতের বিধান থাকত এবং প্রত্যেক সম্পদশালী মুসলমান স্বতস্ফূর্তভাবে যাকাত দিত ও সেটা যথাযথ খাতে ব্যয় হত তবে বাজেটের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ এখান থেকেই সরবরাহ হয়ে যেত।

যেমন, গত বছর (২০১৭) শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে সম্পূর্ণ বাজেটের ১৫.০৬% বরাদ্দ ছিল। যার মধ্যে দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য বরাদ্দ ছিল। তাই এ অংশটুকু সহজেই যাকাতের মাধ্যমে সমাধা করা যেত।

প্রতিবন্ধী, বয়স্ক ও বিধবাদের জন্য গত বাজেটে বরাদ্দ ছিল ৫.০৮% যা যাকাতের মাধ্যমে সরবরাহ করা যেত।

চিকিৎসার জন্য যাকাতের অর্থ ব্যয় করে প্রতিটি হাসপাতালে দরিদ্র রোগীদের জন্য অর্থ বরাদ্দ রাখা যেত।

সমাজের অনেক পরিবার পুঁজির অভাবে কিছু করতে পারে না, তাদেরকে যাকাতের অর্থ প্রদানের মাধ্যমে স্বাবলম্বী হতে সাহায্য করা যেত।

যাকাত প্রদান না করার ভয়াবহতা

যাকাত আদায় না করার ক্ষতি ও ভয়াবহতা অনেক। কুরআন ও হাদীসে যাকাত আদায় না করার বহু ক্ষতি ও ভয়বহতা তুলে ধরা হয়েছে। নিম্নে এর কিয়দাংশ উল্লেখ করা হল-

পরকালীন আযাব। আগুনের উত্তপ্ত দাগ। কুরআনুল কারীমে ইরশাদ হয়েছে –
وَاَلَّذِينَ يَكْنِزُونَ الذَّهَبَ وَالْفِضَّةَ وَلَا يُنْفِقُونَهَا فِي سَبِيلِ اللَّهِ فَبَشِّرْهُمْ بِعَذَابٍ أَلِيمٍ يَوْمَ يُحْمَى عَلَيْهَا فِي نَارِ جَهَنَّمَ فَتُكْوَى بِهَا جِبَاهُهُمْ وَجَنُوبُهُمْ وَظُهُورُهُمْ هَذَا مَا كَنَزْتُمْ لِأَنْفُسِكُمْ فَذُوقُوا مَا كُنْتُمْ تَكْنِزُونَ.

“যারা স্বর্ণ ও রৌপ্য জমা করে রাখে, আল্লাহর পথে ব্যয় (যাকাত) করে না, তাদেরকে আপনি যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সুসংবাদ দিন। যেদিন সেগুলো উত্তপ্ত কওে তা দ্বারা তাদেও মুখমন্ডল, পার্শ্ব ও পিঠে দাগ দেয়া হবে। এবং বলা হবে, এগুলো তোমাদের সেই সম্পদ যা তোমরা নিজেদের জন্য কৃক্ষিগত কওে রেখেছিলে। এখন নিজেদের অর্জিত সম্পদেও স্বাদ আস্বাদন কর” – সূরা তাওবা: ৩৪-৩৫

বিষধর সাপের দংশন। হাদীসে এসেছে –
من آتاه الله مالا فلم يؤد زكاته مثل له يوم القيامة شجاعا أقرع له زبيبتان يطوقه يوم القيامة ثم يأخذ بلهزمتيه يعني بشدقيه ويقول: أنا مالك أنا كنزك.

“আল্লাহ তাআলা যাকে সম্পদ দান করেছেন, অথচ সে তার যাকাত আদায় করেনি, তাহলে তার সেই সঞ্চিত সম্পদকে কেয়ামতের দিন মাথায় টাক পড়া বিষধর সাপে রূপ দেয়া হবে। যার চোখের উপর দুটি কালো দাগ থাকবে। সেই সাপ কেয়ামতের দিন তার গলায় পেঁচিয়ে দেয়া হবে। সেটা তার মুখে দংশন করতে থাকবে আর বলবে, আমি তোমার সম্পদ। আমি তোমার সঞ্চয়।” – সহীহ বুখারী ১/১৮৮

যাকাত না দেয়া জাহান্নামের কারণ। হাদীসে ইরশাদ হয়েছে –
مانع الزكاة يوم القيامة  في النار
“যে যাকাত আদায় করবে না কেয়ামতের দিন সেই ব্যক্তি জাহান্নামের আগুনে জ্বলবে”। – তাবরানী, সগীর, ১/৫৮

যাকাত প্রদান না করার ভয়াবহতা (পার্থিব দিক)

যাকাত আদায় না করলে দুর্ভিক্ষ আসে: হাদীসে এসেছে –
ما منع قوم الزكاة إلا ابتلاهم الله بالسنين
“যে সম্প্রদায় যাকাত দিবে না। আল্লাহ তাআলা তাদেরকে ক্ষুধা ও দুর্ভিক্ষে নিমজ্জিত করবেন” – ইবনে মাজাহ, ৪০৯১

যাকাত আদায় না কররা সম্পদ ধ্বংসের কারণ। হাদীসে ইরশাদ হয়েছে –
ما تلف مال في بر ولا بحر إلا بحبس الزكاة.

“স্থলভাগে ও সমুদ্রে যত সম্পদ ধ্বংস হয় তা যাকাত আদায় না করার কারণেই হয়ে থাকে”। – আত্-তারগীব ওয়াত্ তাহরীব, হাদীস: ১১৩০

সুতরাং ব্যবসায়ীদের ভাবা উচিত। স্থলে বা জলে পণ্য পরিবহনের সময় এর সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে শুধু ইন্সুরেন্স করা যথেষ্ট নয়। বরং আল্লাহর ইন্সুরেন্স আগে সম্পন্ন করতে হবে। যথা সময়ে যাকাত আদায় করতে হবে। তবেই সম্পদের নিরাপত্তা লাভ হবে। হাঁ, এরপরও কারো সম্পদ ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে। সেটা তার ঈমানের পরীক্ষা নেয়া হতে পারে।

যাকাতযোগ্য সম্পদ

আমাদের সমাজের বহুল ব্যবহৃত যাকাতযোগ্য ৩টি সম্পদ হলঃ

স্বর্ণ-রূপা
নগদ ক্যাশ
ব্যবসায়িক পণ্য

এছাড়া আর ৩ প্রকার সম্পদেও যাকাত দিতে হয়। সেগুলো হলঃ

ফসল
পশু
ভূ-গর্ভস্থিত সম্পদ

যাকাতযোগ্য সম্পদ নির্ধারণের মানদণ্ডঃ

বর্ধনশীল সম্পদ
বর্ধনহীন সম্পদ

যাকাতযোগ্য সম্পদ – ০১: “স্বর্ণ” ও “রূপা”

সোনা-রূপার যাকাতযোগ্য হওয়া বলতে কী বুঝায়?
নিজস্ব মালিকানায় থাকতে হবে ।
যে কোন আকৃতিতে থাকলেই চলবে ।
যে কোন অবস্থায় থাকতে পারে ।
মালিকানা বহাল থেকে যে কারো দখলে থাকতে পারে ।
ব্যবহারে থাকতে পারে বা অব্যবহৃত অবস্থায় থাকতে পারে ।

স্বর্ণ-রৌপ্যের অলংকারের যাকাত

কেউ কেউ মনে করেন, সোনা-রূপার অলংকার যাকাতযোগ্য নয়। এ ধারণা অগ্রগণ্য নয়।

■একবার এক মহিলা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আসল। সাথে তার এক মেয়ে ছিল। মেয়ের হাতে স্বর্ণের ভারি দুটি চুড়ি ছিল। নবীজী মহিলাকে বললেন, তুমি কি এর যাকাত আদায় করো? মহিলাটি জবাবে বলল, না। নবীজী বললেন –

أيسرك أن يسورك الله بهما يوم القيامة سوارين من نار؟

“ তোমরা কি এটা পসন্দ করবে যে, আল্লাহ তাআলা এর পরিবর্তে তোমাদেরকে আগুনের চুড়ি পড়িয়ে দিবেন? – সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং ১৫৬৩

■আরেক হাদীসে এসেছে, আম্মাজান আয়েশা সিদ্দীকা রা. এর হাতে রূপার অংলকার ছিল। নবীজী বললেন, তুমি কি এর যাকাত আদায় করো? জবাবে তিনি বললেন, না। নবীজী তখন বললেন–
هو حسبك من النار
“এটিই তোমার জাহান্নামী হওয়ার জন্য যথেষ্ট”। – সুনানে আবু দাউদ, ১৫৬৫

■সৌদী আরবের সর্বোচ্চ ফতোয়া বোর্ড ‘লাজনাতু দাইমা লিল-বুহুসিল ইলমিয়্যা ওয়াল ইফতা’ (Permanent Committee for Scholarly Research and Ifta) তাঁদের ১৭৯৭ নং ফতোয়ায় এ বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে বিশদ আলোচনার পর স্পষ্ট লিখেছেন –

والأرجح من القولين قول من قال بوجوب الزكاة فيها إذابلغت النصاب أن كان لدي مالكيها من الذهب والفضة أو عروض التجارة ما يكمل النصاب.

“এক্ষেত্রে অগ্রগণ্য বক্তব্য হল, অলংকারে যাকাত আসা। যখন তা নেসাব পরিমাণ হবে অথবা স্বর্ণ ও রূপা বা ব্যবসায়িক পণ্য মিলে তা নেসাব পরিমাণ হবে।”

যাকাতযোগ্য সম্পদ – ০২: “নগদ-ক্যাশ”

■নগদ-ক্যাশও যাকাতযোগ্য সম্পদ। কুরআন ও হাদীসে স্বর্ণ ও রূপার যাকাতের বিধান পাওয়া যায়। স্বর্ণ ও রৌপ্য সে সময়ে Medium of Exchange হিসেবে ব্যবহৃত হত।

যুগের ফকীহগণ স্বর্ণ ও রৌপ্যের ন্যায় কাগুজে মুদ্রায় নিম্নোক্ত চারটি গুণ থাকায় কাগুজে মুদ্রার মাঝেও স্বর্ণ-রূপার যাকাতের বিধান আরোপ করেছেন।

Medium of Exchange
Wide Acceptability
Standard / Measure of Value
Store of Value

■এ ব্যাপারে স্বীকৃতি প্রদানকারী উল্লেখযোগ্য ফিকহ ফোরামগুলো হলঃ

ইসলামী ফিকাহ্ একাডেমী জিদ্দা, রেজুলেশন নং: (৯)/৩/০৮/৮৬, সন: ১৯৮৬ইং।
হাইয়াতু কিবারিল উলামার সিদ্ধান্ত, সন ১৩৯৩ হি.।
ইসলামী ফিকাহ একাডেমী, মাক্কাতুল মুর্কারামা, সন: ১৪০২ হি.।
ইসলামী ফিকাহ একাডেমী, হিন্দ, সন: ১৯৮৯ ইং।
এ্যাওফি এর ৩৫ নং শরীয়াহ্ স্ট্যান্ডার্ড, ধারা: ৩/১/২।

নগদ-ক্যাশের বিস্তৃতি

নগদ অর্থের যাকাতযোগ্য কতিপয় অবস্থা

  • হাতে নগদ
  • ব্যাংক বা কোন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমাকৃত মূল অর্থ
  • ব্যবসায়ে বিনিয়োগকৃত নগদ মূলধন ও প্রাপ্ত মুনাফা
  • বন্ড, ডিবেঞ্চার, ট্রেজারী ইত্যাদির জন্য বিনিয়োগকৃত মূল অর্থ
  • জীবন বীমায় প্রদত্ত মূল অর্থ
  • শেয়ার বাজারে বিনিয়োগকৃত অর্থ
  • বৈদেশিক মুদ্রা
  • ব্যাংক গ্যারান্টি হিসেবে প্রদত্ত অর্থ
  • বায়না হিসেবে প্রাপ্ত অর্থ
  • জামানত হিসেবে প্রদত্ত অর্থ
  • সিকিউরিটি মানি হিসেবে প্রদত্ত অর্থ
  • উসুলযোগ্য ঋণ
  • ক্রেতার নিকট বিক্রেতার পাওনা
  • অগ্রিম মূল্য হিসেবে প্রাপ্ত অর্থ
  • প্রভিডেন্ট ফান্ডে প্রদত্ত ঐচ্ছিক অর্থ
  • সঞ্চয়পত্রের মূল অর্থ

যাকাতযোগ্য সম্পদ – ০৩: “ব্যবসায়িক পণ্য”

■কুরআন ও সুন্নাহ অনুসারে তৃতীয় যাকাতযোগ্য সম্পদ হল ব্যবসায়িক পণ্য অনুসারে “ব্যবসায়িক পণ্য”ও যাকাতযোগ্য সম্পদ। এটি বহুল প্রচলিত তৃতীয় প্রকার যাকাতযোগ্য সম্পদ।

■কুরআনুল কারীমে ইরশাদ হয়েছে –
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَنفِقُوا مِن طَيِّبَاتِ مَا كَسَبْتُمْ

‘হে মুমিনগণ, তোমরা যা উপার্জন করো এর উৎকৃষ্ট থেকে ব্যয় করো’ [সূরা বাকারা, ২৬৭]

■হাদীসে এসেছে-হযরত সামূরা রা. বলেন,

كان النبي صلى الله عليه وسلم يأمرنا أن نخرج الصدقة من الذي نعد للبيع.

“নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে আদেশ করতেন, আমরা ব্যবসার জন্য যেসব পণ্য প্রস্তুত করি এর যাকাত আদায় করতে” [সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং ১৫৬২]

 

যাকাতযোগ্য সম্পদ – ০৩: “ব্যবসায়িক পণ্য” (Cont.)

ব্যবসায়িক পণ্য যাকাতযোগ্য হওয়ার জন্য ২টি গুণ থাকা আবশ্যক।

‘আল-আমল’ বা কাজ। এর অর্থ হল, ক্রয় বা অন্য কোনও বিনিময়ের সূত্রে পণ্যের মালিকানা অর্জন করা।

‘নিয়ত’ বা ইচ্ছা। এর অর্থ হল, পণ্য ক্রয় বা বিনিময়ের মাধ্যমে মালিকানা অর্জনের সময়ই তা বিক্রি করে লাভ করা উদ্দেশ্য থাকা।

■এই দুইটি থাকলেই তা যাকাতযোগ্য হবে নতুবা নয়। কোন বস্তুর ব্যবসায়িক পণ্য ব্যাপারে তাই আমরা কয়েকটি কেইস-এর আলোচনা লক্ষ্য করতে পারি।

■কেইস # ০১:

একটি কোম্পানী একটি গাড়ি ক্রয় করেছে। ক্রয়ের সময় নিয়ত ছিল, কোম্পানীর ব্যক্তিগত কাজে তা ব্যবহার করা হবে। এটি ছিল মূল নিয়ত। সাথে এ নিয়তও ছিল, দাম ভাল পেলে বিক্রি করে দিবে।

■কেইস # ০২:

কোম্পানী ব্যবসা তথা বিক্রি করে দেয়ার উদ্দেশ্যে অনেকগুলো গাড়ি ক্রয় করেছে। এরপর এর থেকে একটি গাড়ি ব্যক্তিগত কাজেও প্রয়োজনে ব্যবহার করা হয়। তবে ব্যবসার নিয়ত থেকে বের করা হয়নি।

■কেইস # ০৩:

একটি বস্তু ব্যবসার উদ্দেশ্যে ক্রয় করা হয়েছে। পরবর্তীতে বিক্রির পূর্বে নিয়ত বা উদ্দেশ্য পরিবর্তন করা হয়েছে। সিদ্ধান্ত হয়েছে, সেটি আর বিক্রি করবে না। ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করবে।

■কেইস # ০৪:

একটি বস্তু ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে ক্রয় করা হয়েছে। পরবর্তীতে নিয়ত বা উদ্দেশ্য পরিবর্তন করা হয়েছে। সিদ্ধান্ত হয়েছে, সেটি বিক্রি করে দিবে।

■কেইস # ০৫:

হিবা, গিফট, দান সূত্রে, ওসিয়ত সূত্রে অথবা বিবাহের মোহরানা হিসেবে কিংবা খুলা তালাকের বিনিময়ে কোন বস্তুর মালিকানা অর্জন হলে মালিকানা অর্জনের সময় ব্যবসার নিয়ত করা হলে সেটা ব্যবসায়িক পণ্য হবে কি না।

যাকাতযোগ্য সম্পদ – ০৩: “ব্যবসায়িক পণ্য” – এর বিস্তৃতি

■ব্যবসায়িক পণ্য বলতে বুঝানো হয়, যা বিক্রি করে মুনাফা অর্জন করা উদ্দেশ্য। মূল পণ্যের সাথে সংযোজন হয়ে দাম বৃদ্ধিতে যা যা ভূমিকা রাখবে সবাই পণ্য বলে বিবেচিত হবে। যেমনঃ

১.ব্যবসার মূল পণ্য।
২.কাঁচা মাল (Raw Material)।
৩.এখনও প্রসেসে আছে (Goods in process)।
৪.যে পণ্য রাস্তায় আছে। শিপমেন্ট হয়ে গেছে।
৫.যে পণ্য কাউকে কমিশনের বিনিময়ে বিক্রি করে দিতে বলা হয়েছে।
৬.উক্ত পণ্য স্পর্শযোগ্য হতে পারে,অথবা অদৃশ্য হক (Abstract Rights / Intangible Rights) ও হতে পারে। যেমন, কপি রাইট, ট্রেডমার্ক ইত্যাদি।

■তবে নিম্নের জিনিসগুলো ব্যবসায়ের উপাদান হিসেবে বিবেচিত হবে না।

পণ্য পরিষ্কার করার জন্য ক্রয়কৃত কাঁচা মাল (Raw Material)।
পণ্য প্যাকেটিং করার জন্য ক্রয়কৃত কাঁচা মাল (Raw Material)।

■বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়, পণ্য প্যাকেটিং করার জন্য ক্রয়কৃত কাঁচা মালে স্বতন্ত্রভাবে ব্যবসার নিয়ত করা হলে তা ব্যবসায়িক পণ্য হিসেবে বিবেচিত হবে। তদ্রুপ প্যাকেটিং যদি বিশেষায়িত হয়, যা মূল পণ্যের দাম বৃদ্ধি করে তবে তা ব্যবসায়ের পণ্য হিসেবে বিবেচিত হবে। নতুবা পণ্য হিসেবে বিবেচিত হবে না।


এটাও পড়ুন ইসলামী ব্যাংকিং ও অর্থনীতি


যাকাতযোগ্য সম্পদের যাকাত আদায়ের শর্তাবলী

■পূর্বোক্ত বহুল প্রচলিত যাকাতযোগ্য সম্পদসমূহে যাকাত আদায়ের শর্তাবলী দু’ ধরনের।

সম্পদকেন্দ্রিক শর্ত
ব্যক্তিকেন্দ্রিক শর্ত

■সম্পদকেন্দ্রিক শর্তাবলীঃ

যাকাতযোগ্য সম্পদে পূর্ণ মালিকানা (Full Ownership) থাকা
নেসাব
পূর্ণ এক বৎসর (হাওল) অতিবাহিত হওয়া

■ব্যক্তিকেন্দ্রিক শর্তাবলীঃ

মুসলিম হওয়া
সাবালক হওয়া
বিবেকবুদ্ধি সম্পন্ন হওয়া

প্রথম শর্ত “যাকাতযোগ্য সম্পদে পূর্ণ মালিকানা থাকা”

■যাকাতযোগ্য সম্পদে পূর্ণ মালিকানা (Full Ownership) বলতে মূলত বুঝায়ঃ

সম্পদে অন্য কারো হক প্রতিষ্ঠিত না থাকা।
তসররুফে (Dispose) পূর্ণ স্বাধীনতা থাকা।
এর মুনাফা (Income) মালিকের জন্য অর্জন হওয়া।

■সুতরাং যে সম্পদ ব্যক্তি থেকে হারিয়ে গেছে তাতে যাকাত নেই।
■তদ্রুপ সম্পদ কোথায় আছে জানা আছে, তবে উসূল সম্ভব নয় তাতেও যাকাত নেই।
■তদ্রুপ যে মোহর বিলম্বে আদায় করা হয়। তাতে নারীর যাকাত দিতে হবে না। কারণ, তাতে নারীর তসররুফের অধিকার নেই।
■তদ্রুপ মধ্যম ও দূর্বল প্রকৃতির প্রাপ্য ঋণের যাকাত নেই। যেমন, বকেয়া বেতন।

দ্বিতীয় শর্ত “নেসাব”: পরিচিতি

■যাকাতযোগ্য সম্পদ থাকলেই যাকাত দিতে হয় না; বরং একটি নূন্যতম পরিমাণে তা থাকতে হয়। যাকাতযোগ্য সম্পদের সেই নূন্যতম পরিমাণ (Lot) কেই পরিভাষায় ‘নেসাব’ বলা হয়। শব্দটি আরবী-نصاب। আরবী ভাষায় প্রত্যেক জিনিসের মূলকে ‘নেসাব’ বলা হয়।

■সুতরাং, নেসাব পরিমাণ সম্পদ হল যাকাত ফরয হওয়ার উৎস।
■সালাফ থেকে ইমাম লাইছ ইবনে সা’দ রহ. (মৃ.১৭৫হি./৭৯১ইং) যাকাতের নূন্যতম লটকে ‘নেসাব’ নাম দিয়েছেন।
■নেসাব ৩ ধরণের সম্পদের উপর ধরা হয়।

–স্বর্ণ-রৌপ্যের নেসাবঃ যদি কারও কাছে স্বর্ণ ব্যতীত অন্য কোন সম্পদ না থাকে তাহলে স্বর্ণের স্বতন্ত্র নেসাব যাকাতের জন্য বিবেচ্য। না হলে, রূপার নেসাব বিবেচ্য হবে।
–নগদ-ক্যাশের নেসাবঃ স্বর্ণ বা রৌপ্য যে নেসাবে ধরলে যাকাত আসবে সেই নেসাবই ধরতে হবে।
–ব্যবসায়িক পণ্যের নেসাবঃ এর বিধানও নগদ-ক্যাশের অনুরূপ।

দ্বিতীয় শর্ত “নেসাব”: স্বর্ণ ও রৌপ্যের নেসাব

■যদি কারও কাছে স্বর্ণ ব্যতীত অন্য কোন সম্পদ না থাকে তাহলে স্বর্ণের স্বতন্ত্র নেসাব যাকাতের জন্য বিবেচ্য। না হলে, রূপার নেসাব বিবেচ্য হবে।

■রূপার নেসাবঃ

হাদীসের ভাষায় রূপার নেসাব হল “৫ উকিয়া”।
১ উকিয়া খাঁটি রূপায় ৪০ দিরহাম হয়। তাই রূপার নেসাব (৫ ´ ৪০) বা ২০০ দিরহাম।
উপমহাদেশীয় হিসাব অনুযায়ী রূপার নেসাব ধরা হয় সাড়ে বায়ান্ন (৫২ ১/২)তোলা বা ভরি।
গ্রামের হিসাবে আসে ৬১২.৬০ গ্রাম। তবে আমাদের দেশে গ্রামের হিসাবে ৬১২.৩৬ গ্রাম রূপার নেসাব হিসেবে প্রচলিত।

■স্বর্ণের নেসাবঃ

সালাফের ভাষায় স্বর্ণের নেসাব হল “২০ দিনার”।
আমাদের উপমহাদেশে স্বর্ণের নেসাব হিসেবে সাড়ে সাত (৭ ১/২)ভরি স্বর্ণকে ধরা হয়।
গ্রামের হিসাবে আসে ৮৭.৫২ গ্রাম। তবে আমাদের দেশে গ্রামের হিসাবে ৮৭.৪৮ গ্রাম স্বর্ণের হিসাবে প্রচলিত।

■নববী যুগের নেসাবঃ

নববী যুগে রৌপ্যমুদ্রা ও ব্যবসায়িক পণ্যে যাকাতের নিসাব সাধারণত রূপার নেসাবে ধরা হত। স্বর্ণের যাকাতের প্রচলন তেমন ছিল না। এ সংক্রান্ত হাদীসগুলোও রূপার নেসবা সংক্রান্ত। সুতরাং যারা বর্তমান সময়ে যারা স্বর্ণের নেসাবকে মূল ধরার কথা বলেন, তাদের কথা সঠিক নয়।

স্বর্ণ ও রৌপ্যের যাকাতে অংশের দিক থেকে মিলানো

স্বর্ণের পরিমাণ (ভরি) রূপার পরিমাণ (ভরি) যাকাতের পরিমাণ
স্বর্ণ থেকে রূপা থেকে
সাড়ে ৬ ভরি ৭ ভরি ০.১৬২৫ ০.১৭৫
সাড়ে ৫ ভরি ১৪ ভরি ০.১৩৭৫ ০.৩৫
৫ ভরি সাড়ে ১৭ ০.১২৫ ০.৩৬২৫
সাড়ে ৩ ভরি ২৮ ভরি ০.০৮৭৫ ০.৭
আড়াই ভরি ৩৫ ভরি ০.০৬২৫ ০.৮৭৫

নগদ-ক্যাশ ও ব্যবসায়িক পণ্যের নেসাব

 

■কাগুজে মুদ্রার নেসাবঃ

কাগুজে মুদ্রার ব্যাপারে সকলেই একমত যে, স্বর্ণ/রূপা যেটার নেসাবে ধরলে যাকাত আসবে সেটাই ধরা হবে

■কাগুজে মুদ্রার নেসাবের ক্ষেত্রে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ঃ

স্বর্ণ/রূপার কোন মূল্য ধরা হবে?
ক্রয় মূল্য কোনটা ধরা হবে?
রূপার কোন ক্যারেট ধরতব্য হবে?
পাইকারী না খুচরা মূল্য ধর্তব্য?
কোয়ালিটির ভিন্নতার কারণে একাধিক দর প্রচলিত থাকলে?

■ব্যবসায়িক পণ্যের নেসাবঃ

ব্যবসায়িক পণ্যের নেসাবের ক্ষেত্রে ব্যবসায়িক পণ্যের মূল্য হিসাব করা হবেমূল্য যে নেসাবে পৌঁছবে সেই নেসাব অনুযায়ী যাকাত আবশ্যক হবেসাধারণত তা রূপার নেসাবে পৌঁছে যায়, তাই রূপার নেসাবে যাকাত আদায় করবেএজন্য বলা হয়, শুধু স্বর্ণ থাকলে কেবল সেক্ষেত্রেই স্বর্ণের নেসাব ধরা হয়এছাড়া সকল ক্ষেত্রেই রূপার নেসাব ধরা হয়

তৃতীয় শর্ত “পূর্ণ এক চন্দ্র বর্ষ (হাওল) অতিবাহিত হওয়া”

■আরবী “হাওল” শব্দের অর্থ বাংলা অর্থ “যাকাত বর্ষ”। হাওল দ্বারা মূলত আমরা বুঝতে পারি, যেদিন প্রথমবার পূর্ব বর্ণিত যাকাতযোগ্য সম্পদ থেকে নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হবেন, সেদিন থেকে গড়ে ঐ নেসাবের উপর পূর্ণ এক বছর অতিক্রান্ত হওয়া আবশ্যক। যেদিন এক বছর শেষ হবে সেদিন যাকাত আদায় করা আবশ্যক হবে। এর আগে নয়।

■হযরত আলী রা. থেকে বর্ণিত এক হাদীস এসেছে,
إذا كانت لك مئتا درهم وحال عليها الحول ففيها خمسة دراهم
‘যখন তোমার ২০০ দিরহাম হবে ও এর উপর এক বছর অতিক্রান্ত হবে তখন তুমি এর থেকে যাকাত হিসাবে ৫ দিরহাম আদায় করবে’ – সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১৫৭৩

■আন্তর্জাতিকভাবে দুই ধরণের বর্ষ প্রচলিত। এক, চন্দ্র বর্ষ। দুই, সৌর বর্ষ।
■ইসলামের অন্যান্য বিধানের ন্যায় যাকাতের বিষয়েও চন্দ্র বর্ষ-ই ধরতব্য।
■একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নঃ যাকাতের জন্য কি সৌর বর্ষ ধরা যাবে? যদি কেউ সৌর বর্ষ ধরে যাকাত আদায় করে তবে তার জন্য কি বিধান হবে?

যাকাত ও ঋণ

■আমাদের দৈনন্দিন জীবনে “ঋণ” একটি অতি পরিচিত বিষয়। “যাকাত” আদায়ে এই “ঋণ” – এর কিছু হিসাব-নিকাশ আছে।

■এই ঋণ মৌলিকভাবে ২টি ভাবে ঘটনার জন্ম দেয়ঃ

ঋণ প্রদান
ঋণ গ্রহণ

■ঋণ প্রদান করলে ঋণ গ্রহিতার কাছে থেকে অর্থ পাওয়া যায়, তাই এতে ঋণ প্রদানকারী “পাওনাদার” – এ পরিণত হয়।
■অপরদিকে, ঋণ গ্রহণ করলে ঋণদাতাকে অর্থ প্রদান করতে হয়, এবং তাতে ঋণ গ্রহীতা “দেনাদার” – এ পরিণত হয়।

■অন্যের নিকট প্রাপ্য ঋণ আবার ২ প্রকারঃ

উসূহওয়ার আশা আছে
উসূল হওয়ার আশা নেই

পাওয়ার আশা আছে এমন ঋণের যাকাত কখন আদায় করবে?

যে পাওনা উসূলের আশা নেই, তার কি যাকাত আদায় করতে হবে?

যাকাত ও ঋণ (পাওনা ঋণ)

হানাফী মাযহাবে “প্রাপ্য ঋণ” বা “পাওনা ঋণ” – এর ৩টি প্রকার দেখা যায়ঃ

মযবুত পাওনা (الدين القوي): এমন ঋণ যা ব্যবসায়িক পণ্য বাকিতে বিক্রয় করে পাওনা সৃষ্টি হয়েছে অথবা টাকা করজ দিয়ে হয়েছে অথবা স্বর্ণ-রূপা কাউকে দেয়ার কারণে পাওনা সৃষ্টি হয়েছে। মোটকথা, এমন সম্পদের বিপরীতে সৃষ্ট দায়, যে সম্পদ নিজের কাছে থাকলেও এর যাকাত দিতে হত।

মধ্যম পাওনা: (الدين المتوسط): এমন পাওনা, যা কোনও সম্পদ বাকিতে বিক্রির পরিবর্তে অন্যের উপর দায় সৃষ্টি হয়েছে। তবে সেই সম্পদ ব্যবসার সম্পদ নয়। স্বাভাবিক ব্যবহারের জিনিস। যা তার নিকট সারা বছর পড়ে থাকলেও এর উপর যাকাত আসত না।

দূর্বল পাওনা (الدين الضعيف): এমন পাওনা যা কোন সম্পদের বিনিময়ে সৃষ্টি হয়নি। না ব্যবসায়িক সম্পদ, না ব্যবহারের সম্পদ। না এটি কোন করজের বিপরীতে হয়েছে। বরং কোন সম্পদের বিনিময় ছাড়াই সৃষ্টি হয়েছে। যেমন, বিবাহের অনাদায়ী মোহরানা, অনাদায়ী মীরাসের সম্পদ, অনাদায়ী ওসিয়তের সম্পদ, ইত্যাদি।

যাকাত আদায়ের ক্ষেত্রে উক্ত ৩টি ঋণ বা পাওনার বিধান কি?

যাকাত ও ঋণ (পাওনা ঋণ)

■মানুষ সাধারণত ২ ভাবে ঋণী হতে পারেঃ

শরীয়াতের পক্ষ থেকে ঋণী হওয়াযেমন, মানত, কাফফারা আদায় না করা। (যাকাতএর জন্য প্রতিবন্ধক নয়)
মানুষের পক্ষ থেকে ঋণী হওয়া। (প্রতিবন্ধক হওয়া বা না হওয়ার ব্যাপারে সালাফগণের মতামত-ই এখনকার আলোচ্য বিষয়)

■যে আলেমগণ ঋণকে প্রতিবন্ধন, তাঁদের দৃষ্টিতে এর ক্ষেত্র বা সীমাঃ

হানাফী মাযহাবে ঋণ শুধু স্বর্ণ-রূপা, নগদ-ক্যাশ, ও ব্যবসায়িক পণ্যের জন্য প্রতিবন্ধকফসলের যাকাত, খারাজ এবং অন্যান্য শরীয়তী ঋণের ক্ষেত্রে তা প্রতিবন্ধক নয়
হাম্বলী মাযহাবে ফল-ফসলের যাকাতের ক্ষেত্রেও তা প্রতিবন্ধক
মালেকী মায়হাবেও ফসলের ক্ষেত্রে ঋণ প্রতিবন্ধক নয়তাঁদের মতে ঋণ নগদ ক্যাশে প্রতিবন্ধক এবং ব্যবসায়িক পণ্য দ্বারা যদি ঋণ পরিশোধ সম্ভব না হয়, তাহলে সেক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক হবে

কতিপয় প্রায়োগিক ঋণ এবং যাকাত বিষয়ে এর শরঈ বিধান

■সাধারণ ঋণ যা বিশেষ প্রয়োজনে নেয়া হয়।

■দীর্ঘ মেয়াদী ঋণ যা বছরে বছরে শোধ করা হয়।

■কিস্তিতে পরিশোধযোগ্য মূল্য।

■ব্যবসায়িক পণ্যের জন্য গৃহীত ঋণ।

■ব্যবসায়িক প্রয়োজনে ঋণ গ্রহণ, যা পণ্যের জন্য নয়।

■ব্যক্তিগত প্রয়োজনে ঋণ গ্রহণ।

■শিল্প ঋণ।

■প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ ক্রয়ের জন্য ঋণ গ্রহণ।

■অবৈধ পন্থায় ঋণী হওয়া, যেমন সুদী চুক্তিতে ঋণ গ্রহণ।

■বছরের বিভিন্ন সময়ে কাঁচামাল ও ব্যবসায়িক পণ্য ক্রয়ে ঋণ গ্রহণ কিন্তু যাকাত দেয়ার সময়ে সঠিক ঋণের হিসাব মনে করা যাচ্ছে না।

■সালাম চুক্তি।

■ইস্তিসনা চুক্তি।

■অগ্রিম ডাউন পেমেন্ট গ্রহণ।

■সাধারণ ক্রয়-বিক্রয় চুক্তির মাধ্যমে অগ্রিম গ্রহণ। (সালাম চুক্তি নয়)

■ট্যাক্স।

■মুদির দোকানদারের ক্রেতার কাছে থেকে অগ্রিম গ্রহণের বিপরীতে প্রতিদিন মূল্য পরিশোধের হিসাবে পণ্য দেয়া।

■কর্মচারীর বেতন, বাড়ি ভাড়া, সার্ভিসের পেমেন্ট বকেয়া থাকা।

স্বর্ণ ও রৌপ্যের যাকাত আদায়

স্বর্ণ-রূপার যাকাত ৩ ভাবে হতে পারেঃ

শুধু স্বর্ণ আছেঃ এক্ষেত্রে শুধু স্বর্ণের যাকাত আদায় করবে
শুধু রূপা আছেঃ এক্ষেত্রে শুধু রূপার যাকাত আদায় করবে
দুটিই আছেঃ এক্ষেত্রে মিলিয়ে আদায় করবে

■স্বর্ণ ও রৌপ্যের যাকাতের পরিমাণ ৪০ ভাগের ১ ভাগ।
■কারও কাছে ২টিই যদি থাকে এবং উভয়টিই পৃথকভাবে যাকাতযোগ্য তবে প্রত্যেকটির যাকাত আলাদাভাবে আদায় করতে হবে।
■কিন্তু ২টিই আছে কিন্তু পৃথকভাবে কোনটির নেসাব পূর্ণ হয় না, দুইটি মিলিয়ে হয়, তাহলেও যাকাত আদায় করতে হবে।

■একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নঃ

কোনও নারী দীর্ঘদিন তার স্বর্ণালংকারের যাকাত দেয়নি। এখন যখন যে যাকাত দেয়ার ইচ্ছা করেছে, তখন স্বর্ণের আগের মূল্য ও বর্তমান মূল্যে অনেক তফাৎ। যেমন, একজন নারীর কাছে ৮ ভরি স্বর্ণ আছে। ৫ বছর যাবত যাকাত দেয়নি। ৫ বছর আগে ভরি প্রতি মূল্য ছিল ৩৫ হাজার টাকা।  এখন ৫ বছর পর যখন যাকাত দেয়ার ইচ্ছা করেছে, এখন ভরি প্রতি ৪৫ হাজার টাকা। যাকাত সে টাকায় আদায় করবে। স্বর্ণ দিয়ে নয়।  এখন প্রশ্ন হল, বর্তমানে স্বর্ণের কোন মূল্য ধরে সে যাকাত দিবে?

নগদ-ক্যাশ টাকার যাকাত আদায়

■এখনে ২টি সূরত লক্ষ্য করা যায়ঃ

শুধু নগদ ক্যাশ আছে
নগদ ক্যাশ আছে।  সাথে স্বর্ণ/রূপার অলংকারও রয়েছে।  তবে শুধু নগদ ক্যাশে নেসাব হয় না। স্বর্ণ/রূপাকে মিলিয়ে হিসাব করলে নেসাব হয়

■নগদ-ক্যাশের সাথে স্বর্ণ-রৌপ্য মিলিয়ে নেসাব হলে, নিচের অতিগুরুত্বপূর্ণ বিষয় ২টিতে আমাদের দৃষ্টিপাত করতে হবেঃ

মিলিয়ে নেসাব ধরবো কিনা? যদি মেলানো হয় তবে কোন নেসাবকে গ্রহণ করবো?
মিলানোর ক্ষেত্রে স্বর্ণ বা রূপার কোনটির মূল্য ধরতে হবে?

নগদ-ক্যাশের কতিপয় প্রায়োগিক উদাহরণ ও এর শরঈ বিধান

■ভবিষ্যতে কোনো কাজ সম্পাদনের উদ্দেশ্যে জমাকৃত অর্থ। যেমন, বাড়ি নির্মাণ, হজ্ব করা ইত্যাদি।
■ব্যবসায় প্রদেয় টাকা।
■ব্যাংক গ্যারন্টি মানি।
■কোম্পানির শেয়ারের যাকাত।
■শেয়ার বাজারে আমরা ২ ধরণের শেয়ারহোল্ডার দেখতে পাই –

  • যারা কোম্পানির শেয়ার ক্রয়ের মাধ্যমে কোম্পানির লভ্যাংশ লাভের আশা করে
  • যারা শেয়ার বাজারের দাম উঠা-নামার উপর শেয়ার কেনা-বেচার মাধ্যমে ক্যাপিটাল গেইন করতে চায়তারা বিক্রয়ের নিয়তে শেয়ার কিনে লভ্যাংশের সাথে তাদের কেনার কোন সম্পর্ক নাই

কোম্পানির শেয়ারের যাকাতের বিধান

বিধানঃ

দ্বিতীয় প্রকার শেয়ারহোল্ডারদের কাছে শেয়ার একটি ব্যবসায়িক পণ্যতাই যাকাত বর্ষ পূর্ণ হওয়ার দিন তারা শেয়ারের মার্কেট ভ্যালু অনুযায়ী যাকাত আদায় করবেক্রয়কৃত শেয়ারের বিপরীতে যাকাতযোগ্য সম্পদ আছে কি না তা বিবেচ্য নয়

প্রথম প্রকার শেয়ারহোল্ডারদেরকে তাদের শেয়ারের বিপরীত থাকা যাকাতযোগ্য সম্পদের জন্য যাকাত আদায় করতে হবেএজন্য তারা ব্যালেন্সশীটে থাকা ফিক্সড এ্যাসেট বা স্থায়ী সম্পদ বাদ দিয়ে কাঁচা-মাল, ব্যবসায়িক পণ্য, নগদ-ক্যাশের উপর যাকাত দিবে

মিশ্রিত শেয়ারহোল্ডারঃ
কিছু শেয়ারহোল্ডার আছে যাদের নির্দিষ্ট কোন নিয়ত থাকে না। যখন মনে হয় বিক্রি করলে মুনাফা হবে তখন বিক্রি করে, যখন মনে করে ডিভিডেন্ড নিলে বেশি মুনাফা হয় তখন তা বিক্রি করে না

তাদের বিধানঃ
যাকাত বর্ষের পূর্ণতার দিন সে তার নিয়ত দেখবে। সেদিন যেসব শেয়ারের ব্যাপারে বিক্রির নিয়ত থাকবে সেগুলোর বাজার মূল্য ধরে যাকাত হিসাব করবে। আর যেসব শেয়ারের ডিভিডেন্ডে অংশগ্রহণের নিয়ত থাকবে সেগুলোর পূর্বোক্ত পন্থায় শুধু ননফিক্সড এ্যসেটের যাকাত দিবে।

ব্যবসায়িক পণ্যের যাকাত আদায়

■ব্যবসায়িক পণ্য রূপার নেসাবে উপনীত হলে অথবা নগদ ক্যাশ ও ব্যবসায়িক পণ্য মিলে রূপার নেসাবে পৌঁছুলে অথবা স্বর্ণ, রূপা, নগদ ক্যাশ ও ব্যবসায়িক পণ্য মিলে রূপার নেসাবে উপনীত হলে যাকাত বর্ষ শেষে এর যাকাত দিতে হবে।
■উল্লেখ্য, ব্যবসায়িক পণ্যে স্বর্ণের নেসাব বিবেচ্য হওয়ার বিষয়টি অগ্রগণ্য নয়।  এভাবে বিবেচনা করলে বহু ব্যবসায়ীর যাকাত আসবে না।

■ব্যবসায়িক পণ্যের যাকাত দেয়ার জন্য আমরা পণ্যের ৩ ধরণের মূল্য দেখতে পাইঃ

পাইকারি মূল্য
খুচরা মূল্য
যাকাত বর্ষ পূর্ণ হওয়ার দিনে সমুদয় পণ্য বিক্রয় করলে যে মূল্য পাওয়া যায়

■মূল্য ধরার ব্যাপারে ২টি মত বহুল প্রচলিতঃ

শাইখুল ইসলাম তাকী উসমানী হাফিযাহুল্লাহ এর মতে, পাইকারি মূল্য হিসাব করা উত্তমঅধিক সতর্কতা

আমাদের উস্তাযে মুহতারাম মুফতি আবুল হাসান মো. আব্দুল্লাহ হাফিযাহুল্লাহ (প্রধান মুফতি ও পরিচালক মারকাযুদ্দাওয়া আল ইসলামিয়া, ঢাকা) লিখেছেন – তৃতীয়টি ধরে যাকাত আদায় করবে।

ব্যবসায়িক পণ্যের কতিপয় প্রায়োগিক উদাহরণ ও এর শরঈ বিধান

■উৎপাদিত পণ্য

■এমন পণ্য যা বিক্রয় হয়েছে তবে ক্রেতা এখনও নিয়ে যায় নি।

■দোষযুক্ত পণ্য।

■এমন পণ্য যার বেচা-বিক্রি কম হয়।

■উৎপাদন প্রক্রিয়াধীন পণ্য।

■এমন পণ্য যা ক্রয় করে হয়েছে কিন্তু এখনও রাস্তায় আছে।

■দৃশ্যমান নয় এমন সম্পদ। যেমন, কপি রাইট, ট্রেড মার্ক, কম্পিউটার সফট্‌ওয়্যার।

■এমন পণ্য যা তৈরির জন্য অর্ডার করা হয়েছে এবং টাকা এডভান্সও করা হয়েছে।

■বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে ক্রয়কৃত পশু।

■বাচ্চা দেয়ার উদ্দেশ্যে ক্রয়কৃত পশু।

■পশু থেকে প্রাপ্ত দুধ, গোবরে ব্যবসার নিয়ত করা হলে।

যাকাত হিসাবের পদ্ধতি

ধাপ: ০১ যেদিন আপনার যাকাতবর্ষ পূর্ণ হবে সেদিন পূর্বোক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে প্রথমে আপনি আপনার যাকাতযোগ্য সম্পদের একটি তালিকা করবেন।

ধাপ: ০২ উপরোক্ত সম্পত্তির পরিমাণ বের করবেন।

ধাপ: ০৩ এবার আপনি আপনার ঋণ বা দেনা যদি থাকে তা বের করবেন।

ধাপ: ০৪ এবার মোট কী পরিমাণ ঋণ আছে, সেটা যোগ করবে। এরপর তা মোট যাকাতযোগ্য সম্পদ থেকে বিয়োগ দিবেন।

ধাপ: ০৫ সর্বশেষ বিয়োগ দেয়ার পর যাকাতযোগ্য সম্পদ যা দাঁড়ায় এর ২.৫% যাকাত হিসাবে আদায় করবেন।

যাকাত আদায়ের খাত

■সূলা তাওবা, আয়াত নং: ৬০

إِنَّمَا الصَّدَقَاتُ لِلْفُقَرَاءِ وَالْمَسَاكِينِ وَالْعَامِلِينَ عَلَيْهَا وَالْمُؤَلَّفَةِ قُلُوبُهُمْ وَفِي الرِّقَابِ وَالْغَارِمِينَ وَفِي سَبِيلِ اللَّهِ وَابْنِ السَّبِيلِ ۖ فَرِيضَةً مِّنَ اللَّهِ ۗ وَاللَّهُ عَلِيمٌ حَكِيمٌ

“প্রকৃতপক্ষে যাকাত

১. ফকীর –
২. মিসকীনদের হক,
৩. সেই সকল কর্মচারীদের, যারা যাকাত উসূলের কাজে নিয়োজিত,
৪. যাদের মনোরঞ্জন করা উদ্দেশ্য তাদের। বর্তমানে এ খাতটি বিদ্যমান নাই ।
৫. তাছাড়া দাসমুক্তিতে,
৬. ঋণগ্রস্থের ঋণ পরিশোধে এবং
৭. আল্লাহর পথের মুজাহিদ ও
৮. মুসাফিরের সাহায্যেও ব্যয় করা হবে। এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রদত্ত বিধান। আল্লাহ জ্ঞানেরও মালিক, হিকমতেরও মালিক।”

যাকাত আদায়ে কতিপয় ভুল-ত্রুটি

■যাকাতবর্ষ কবে পূর্ণ হয় তা যথাযথভাবে হিসাব না রাখা।
■যথাযথ হিসাব না করে অনুমান করে যাকাত আদায় করা।
■যাকাত হিসাবে বাজরে প্রচলিত যাকাতের শাড়ী ও লুঙ্গী আদায় করা।
■বিভিন্ন টিভি চ্যানেলকে যাকাত প্রদান।
■মসজিদের দান বাক্সে বা নির্মাণ কাজে যাকাত প্রদান।
■মাদ্রাসার নির্মাণ কাজ, মাদ্রাসার উস্তাযদের বেতন-ভাতা এসব খাতেও যাকাত প্রদান করা যাবে না।
■রমযানের হাফেযরদেরকে হাদীয়ার নামে যাকাতের অর্থ প্রদান।
■অনেক নারী কর্তৃক তাদের ব্যবহৃত স্বর্ণ/রূপার অলংকারের যাকাত আদায় করে না।
■কাজের বুয়াকে বেতন-বোনাস হিসেবে যাকাত প্রদান।
■ঋণ হিসাবে সুদের অংশও বিয়োগ করা।
■যাকাত আদায়ে নিজ আত্মীয়দের মাঝে উপযুক্ত খুঁজে খুঁজে বের করে যাকাত না দেয়া।

যাকাত আদায়ে আরও ভুল-ত্রুটি বিস্তারিত জানুন এখানে

যাকাত আদায় পদ্ধতি

যাকাত আদায়ের ৫টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলঃ

০১) যাকাত আদায়ে মালিকানা প্রদান

সঠিকভাবে যাকাত আদায়ের একটি মৌলিক শর্ত হল, যাকাত গ্রহণের উপযুক্ত ব্যক্তিকে এর মালিকানা সত্ত্ব প্রদান করা। শুধু উপকার ভোগের অধিকার দিলে হবে না।

০২) অগ্রীম যাকাত আদায়

কেউ যদি কয়েক বছরের অগ্রিম যাকাত আদায় করতে চায়, তাহলে এরও সুযোগ আছে।  তবে কোন বছর যদি সম্পদ বেড়ে যায়, তাহলে বর্ধিত সম্পদের যাকাত আলাদা ভাবে দিতে হবে।

অগ্রিম যাকাত আদায় যাকাত হিসেবে যথেষ্ট হওয়ার জন্য মোট শর্ত তিনটি।  যথা –

  • যখন অগ্রিম যাকাত দিবে তখন মৌলিকভাবে নেসাবের মালিক থাকা।
  • যাকাতবর্ষ শেষে নেসাব বাকি থাকতে হবে। অর্থাৎ যে কয় বছরের অগ্রিম দিবে সেই বছরগুলোতে নেসাব বাকি থাকতে হবে।

যাকাতবর্ষের মাঝে নেসাব পরিপূর্ণরূপে নিঃশেষ না হওয়া।

০৩) সময়মত যাকাত আদায়

যাকাত আবশ্যক হওয়ার পর তৎক্ষণাৎ তা আদায় করাই নিয়ম । বিনা প্রয়োজনে বিলম্ব করা ঠিক নয়। মনে রাখতে হবে এটি সম্পদের নিরাপত্তা।

০৪) নিয়ত

সঠিকভাবে যাকাত আদায়ের একটি মৌলিক শর্ত হল, নিয়ত করা। যাকাতের নিয়তে যাকাত প্রদান করা। মুখে বলা জরুরী নয়। সুতরাং হাদিয়া বলেও যাকাত প্রদান করা যাবে। শর্ত হল, মনে মনে যাকাতের নিয়ত থাকা।

০৫) ওকীল বা প্রতিনিধির মাধ্যমে যাকাত আদায়

এক্ষেত্রে ওকীল বা প্রতিনিধিকে

  • বিশ্বস্ত হতে হবে।
  • যাকাতের খাতে যাকাত আদায় করতে হবে।
  • (ওকীল বা প্রতিনিধি) যাকাত আদায়ের পূর্ব পর্যন্ত ব্যক্তির যাকাত আদায় হবে না।

লেখক
মুফতি আব্দুল্লাহ মাসুম
প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক,আই এফ একাডেমী এন্ড কনসালটেন্সি,
সহকারী মুফতি,ফতোয়া বিভাগ,জামিয়া শারইয়্যাহ মালিবাগ ঢাকা।

 

যদি এটা ইসলাম হয়, তবে আমি মুসলিম হতে চাই

লরেন বুথ পেশায় একজন উপস্থাপক, সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী। তাই মধ্যপ্রাচ্যের খবর পরিবেশনের জন্য তিনি অনেক বার এ অঞ্চল সফরের সুযোগ পেয়েছেন। এর অংশ হিসেবে তিনি বেশ কয়েকবার অধিকৃত ফিলিস্তিন সফর করেছেন। সেখানে ধর্ম ও নানা শ্রেণি বা সম্প্রদায় নির্বিশেষে ফিলিস্তিনিদের কষ্ট ও দুর্দশা নিজ চোখে দেখেছেন।

পবিত্র রমজান মাসে ফিলিস্তিনের এমনি এক দরিদ্র পরিবার নিয়ে সম্প্রতি একটি সাক্ষাৎকার তার অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছেন।

পাঠকদের জন্য তার সাক্ষাৎকারটি:

আমি দরজায় নক করতেই এক মা তার দরজা খুলে দিলেন এবং আমাকে সালাম দিয়ে স্বাগত জানালেন।

তাকে অত্যন্ত আলোকিত দেখাচ্ছিল, তার চোখ ও ত্বক জ্বলজ্বল করছিল। সে দরজা খুলে দেয়া মাত্রই মনে হলো যেন আমি তাজমহলে প্রবেশ করছি। যেন তিনি বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর স্থানে বসবাস করছেন।

এবং যখন আমি তার বাড়িতে যাই, তখন তার বাড়িতে কি ছিল? শুধুমাত্র একটি ছোট্ট খালি রুম, ফ্লোর, সিলিং ছাড়া সেখানে আর কোনো কিছুই ছিল না এবং একটি কার্পেটের ওপর দশজনের ইফতারের জন্য খাবার রাখা আছে।

আর ইফতারের জন্য তাদের খাবার কি ছিল? রুটি, প্লাস্টিকের একটি বাটিতে কিছু ছোলা আর কিছু সালাদ।

তাই আমি যখন বসলাম, তখন আমি তা না খাওয়ার চেষ্টা করলাম কিন্তু তিনি আমাকে খাবার খেতে দিলেন এবং বললেন, ‘তুমি তো আমাদের অতিথি।’

এবং আমার না সত্ত্বেও তিনি আমাকে বেশিরভাগ খাবার দিয়ে দিলেন। এতে আমি রাগ করলাম। আমি ইসলাম নিয়ে রাগ করলাম! আমি একটি গ্রন্থের ওপর রাগ করলাম; যেটি টানা ত্রিশ দিন উপবাসের জন্য নির্দেশ দিয়েছে।


এটা পড়ুন – মুসলিম রোগী দেখে মার্কিন ডাক্তার অরিভিয়ার ইসলাম গ্রহণ


এই দরিদ্র নারীর ঘরে থাকা পানি যখন সবসময়ই নোংরা থাকে, তখন পানি না খাওয়ার জন্য নির্দেশ দেয়ায় কুরআনের প্রতি আমি রাগান্বিত ছিলাম।

তাই আমি ওই মাকে বলেছি, ‘কেন রমজান মাসে তোমরা রোজা রাখো?’

কেন? কি উদ্দেশ্য তোমরা রোজা রাখো?

তিনি আমাকে বললেন, ‘গরীবদের স্মরণ করতে আমি রমজানের রোজা রাখি!’

এই মায়ের দুনিয়াতে কিছুই নাই, কিছুই না! তার জীবনে কোনো কিছু পাবার আশাও নেই। তবু তিনি তার চেয়ে দরিদ্র লোকদের জন্য তার হৃদয়কে উজার করেছেন। এটা কেন?

এই মহিলা জানত কেবল দুর্দশাই তার পেটকে খালি করছে। তবো খালি পেটের জন্য তিনি ঈশ্বর ধন্যবাদ দিচ্ছেন। এটা কেন?

এবং ওই মুহূর্তে আমি চিন্তা করলাম, ‘যদি এটা ইসলাম হয়, তবে আমি মুসলিম হতে চাই!’

ইকনা

সাইয়্যিদুল ইস্তিগফার বা তওবার শ্রেষ্ঠ দোয়া

যে ব্যক্তি সুদৃঢ় বিশ্বাসের সঙ্গে সন্ধ্যায় সায়্যিদুল ইস্তিগফার পড়ে সে যদি সকাল হওয়ার আগে মারা যায়, তবে জান্নাতে প্রবেশ করবে। -সহিহ বোখারি: ৬৩০৬

নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি সুদৃঢ় বিশ্বাসের সঙ্গে সকালে সায়্যিদুল ইস্তিগফার পাঠ করবে, সে যদি সন্ধ্যা হওয়ার আগে মারা যায় তবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।

নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি সুদৃঢ় বিশ্বাসের সঙ্গে সকালে সায়্যিদুল ইস্তিগফার পাঠ করবে, সে যদি সন্ধ্যা হওয়ার আগে মারা যায় তবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আর যে ব্যক্তি সুদৃঢ় বিশ্বাসের সঙ্গে সন্ধ্যায় সায়্যিদুল ইস্তিগফার পড়ে সে যদি সকাল হওয়ার আগে মারা যায়, তবে জান্নাতে প্রবেশ করবে। -সহিহ বোখারি: ৬৩০৬

اللَّهُمَّ أَنْتَ رَبِّي لَا إِلَهَ إِلَّا أَنْتَ خَلَقْتَنِي وَأَنَا عَبْدُكَ وَأَنَا عَلَى عَهْدِكَ وَوَعْدِكَ مَا اسْتَطَعْتُ أَعُوذُ بِكَ مِنْ شَرِّ مَا صَنَعْتُ أَبُوءُ لَكَ بِنِعْمَتِكَ عَلَيَّ وَأَبُوءُ لَكَ بِذَنْبِي فَاغْفِرْ لِي فَإِنَّهُ لَا يَغْفِرُ الذُّنُوبَ إِلَّا أَنْتَ

উচ্চারণ : আল্লাহুম্মা আনতা রাব্বি। লা ইলাহা ইল্লা আনতা। খালাকতানি ওয়া আনা আবদুকা। ওয়া আনা আলা আহদিকা। ওয়া ওয়া’দিকা মাসতাতা’তু। আউজু বিকা মিন শাররি মা-সানা’তু। আবুয়ু লাকা বিনি’মাতিকা আলাইয়্যা। ওয়া আবুয়ু লাকা বি জাম্বি। ফাগফিরলী। ফা ইন্নাহু লা ইয়াগফিরুজ জুনবা ইল্লা আনতা।


এটা পড়ুন – একাকী সফর ও নি:সঙ্গ রাত্রি যাপন সুন্নাতের খেলাফ।


অর্থ : হে আল্লাহ! একমাত্র আপনিই আমাদের প্রতিপালক। আপনি ব্যতীত আর কোনো উপাস্য নেই। আপনিই আমার স্রষ্টা এবং আমি আপনার দাস। আমি আপনার সঙ্গে কৃত ওয়াদা ও অঙ্গীকারের ওপর সাধ্যানুযায়ী অটল ও অবিচল আছি। আমি আমার কৃতকর্মের সব অনিষ্ট হতে আপানার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি। আমার উওর আপনার দানকৃত সব নেয়ামত স্বীকার করছি। আমি আমার সব গুনাহ স্বীকার করছি। অতএব, আপনি আমাকে ক্ষমা করুন। কেননা, আপনি ছাড়া আর কেউ গুনাহ ক্ষমা করতে পারবে না।

১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহঃ দিল্লিবাসী সাধারণ জনগণের পরিণতি

একটা দেশের ক্ষমতা গুষ্টিবাদের হাতে কুক্ষিগত হয়ে থাকলে দীর্ঘমেয়াদী কি হতে পারে ইতিহাসে এর নজির রয়েছে ভূরি ভূরি। জনগণকে রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে সংযুক্ত করতে না পারলে রাষ্ট্রের যেমন বিপদ, বিপদ জনগণেরও। জনগণের মধ্যে ‘আমাকে জানানো হয়নি’ বা ‘রাজনীতি বুঝিনা’ বা ‘আই হেইট পলিটিকস’ বলা লোকেরা বিপদে পরে সবচেয়ে বেশি।১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লবের প্রতিক্রিয়ায় সংঘটিত দিল্লি জেনোসাইডে এটাই ঘটেছিল।

দিল্লিতে যখন ব্রিটিশ সৈন্যরা কামানের গোলা নিক্ষেপ করছিল দিল্লির অধিবাসীরা মশকরা করে মজা লুটতেছিল। তাঁরা মনে করেছে এটা এক ধরনের আতশবাজি।সূফী ও উর্দু কবি খাজা হাসান নিজামি তাঁর Delhi Ki Jan Kuni (The Agony of Delhi) বইয়ে লিখেন (১);

”The residents of Delhi have always been known at times of joy and in times of hardship never to lose their sense of joy and leisure. When the British started shelling Delhi, the residents instead of feeling terrified or afraid looked at the spectacle as a show of fireworks. When the firing started they would climb on their roofs to see the shells coming they would then shout and point them out to each other and then wait to see where the shells were falling.” (P:27)

তাঁদের মজা এতেই সীমাবদ্ধ ছিলনা।যখন দিল্লিতে নির্বিচারে মানুষদের মারা হচ্ছিল তখনো তাঁদের কোন হুঁশ ছিলনা। প্রভাবশালী ও অভিজাত লোকদের গ্রেফতার করা হচ্ছিল, গুলি করে মেরে ফেলা হচ্ছিল।অথচ ফাঁসিতে ঝুলানোর আগের দিন রাতেও তারা দাবা ও অন্যান্য খেলায় ব্যস্ত ছিল। খাজা হাসান নিজামি লিখেন;

”The feeling of fun and leisure amongst the residents of Delhi was not limited to this spectacle, even after the capture of Delhi when people were being killed and murdered everywhere; the residents of Delhi were not cowered. Famous nobles from Delhi were captured, were tried and condemned to death but the night before they were to be hanged, they would pass their time playing chess, and other games such as Kunjafa, and Chaucer”. (P:28)

সিপাহী বিপ্লব সিপাহী বিদ্রোহ প্রজা
ইংরেজদের নির্যাতনের খণ্ডচিত্র

মুসলিমদেরকে দুনির্দিষ্টভাবে টার্গেট করে মেরে ফেলা হচ্ছিল। তাঁদেরকে ফাঁসিতে ঝুলানোর দৃশ্যটা ছিল মর্মান্তিক।তাঁদেরকে লাইন ধরে দাঁড় করানো হত।এক গ্রুপের সামনে অন্য গ্রুপকে মারা হত এবং এই দৃশ্য দেখতে বাধ্য করত। হাত বেঁধে কামানের সামনে দাঁড় করিয়ে রাখা হত ভিক্টিমদের।
এবং যখন কামান দাগানো হত সেই মানুষের শরীরটা উড়ে গিয়ে পরত শহরের বাহিরে।আর এই দৃশ্য দেখে মজা নিতে আসত সাধারণ ব্রিটিশরা,এসব দেখে তাঁরা আনন্দ পেত। খাজা হাসান নিজামি লিখেন;

”Opposite the Chandni Chowk Police Station there used to be a pond, this has now gone. On three sides of it the British had erected gallows for hanging people. At the time of the hangings, the arrangements were quite dreadful. The people who were to be hanged were made to stand in a line. Half of them were hanged and the other half were made to watch the fate that awaited them. Civilised nations do not act in this manner and consider this type of behaviour obnoxious.


এটা পড়ুন – মাদরাসা – ইতিহাসে ফিরে দেখা


The victims would be taken out of the Fort in a cart with their hands tied behind their backs. The British spectators would come around the Police Station to view the hanging. When the hanging took place the spectators would laugh with joy, and the body of the victim was thrown on the cart head down for burial outside the city” (P:34)

মা-বোন ও নারীদের অবস্থা ছিল সবচেয়ে করুণ। তাঁদের অনেকেই এমন ছিলেন যে ঘরের বাহিরে যায়নি, পর্দার মধ্যে ছিল।ঘরে ঘরে যখন ব্রিটিশ সৈন্যরা যেতে লাগল তাঁরা ধর্ষণ থেকে বাঁচতে, সম্মান, ইজ্জত বাঁচাতে পানির কুপগুলোতে লাফিয়ে পরতে লাগল। মরতে মরতে পুরো কূপগুলো এতটাই ভরে গিয়েছিল যে শেষের দিকে যারা লাফিয়ে পরত, পরত অন্য দেহের ওপর। মানব শীরের লাশে কূপ ভর্তি হয়ে গভীরতা কমে আসায় শেষের দিকে আত্মহত্যা করতে যাওয়া কেউ কেউ মরতনা। পরে তাদের অনেককেই আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়।

এর ওপর ছিল গণলুটপাট। পাঞ্জাবী শিখ, মুসলিম ও বেলুচিস্তান থেকে আগত সৈন্যদের লেলিয়ে দেয়া হয়েছিল।খাজা হাসান নিজামি’র বইয়ে একটা অংশ আছে যার শিরোনাম ‘How did the Hindus in Delhi become rich’। তিনি দেখিয়েছেন কিভাবে একটা সম্ভ্রান্ত জনগোষ্ঠী রাতারাতি ফকির, ভিক্ষুতে পরিনত হয়েছে। সিপাহী বিদ্রোহের পর দিল্লি’র মুসলিমেরা এমন একটি উদাহরণ। অথচ ৯০% এর বেশি জনগন এই বিদ্রোহের সাথেও ছিলনা, পাছেও ছিলনা।

৬ মাস পর স্যার লরেন্স যখন দিল্লির দায়িত্ব নিয়ে আসেন তিনি মুসলিমদের দিল্লিতে ফিরতে অনুমতি দেন। হাসান নিজামীর বর্ণনায় জানা যায় মাত্র কয়েক মাসে দিল্লির মুসলিম জনগোষ্ঠীর মাত্র ২৫% তাদের আবাসে ফিরে আসতে পেরেছিল। In short, the Mutiny which came as an angel of destruction for the Muslims became a Goddess of Wealth for its Hindu residents. (P:40)

এই ঘটনার ১০০ বছর আগে যখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী বাঙলা দখলের মাধ্যমে উপনিবেশের শুরু করে তখনো জনগণ ছিল নির্বিকার।পলাশীর জয়ের পর ১৭৫৭ সালে যখন ক্লাইভের বাহিনী মাত্র কয়েকশ সৈন্য নিয়ে মুর্শিদাবাদে ঢুকছিল, তখন রাস্তার দুই ধারে দাঁড়িয়ে মানুষজন তামাশা দেখছিল। ক্লাইভ বলেছিল জনগন যদি একটা করে পাথরের কণা নিক্ষেপ করত তাহলে আমরা মাটির সাথে মিশে যেতাম। রাজনৈতিকভাবে বিভাজিত, অসংযুক্ত, নিরাশক্ত বা অসচেতন জনগোষ্ঠী হলে যা হয়। কিন্তু এই জনগোষ্ঠী আরামে থাকেনি। মাত্র ১৩ বছরের মাথায়, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর দেওয়ানী লাভের কয়েক বছরের মধ্যে, খাজনার নামে সীমাহীন লুটপাটের (২) কারণে দেশে দুর্ভিক্ষ নেমে আসে।তাতে বাঙলার ৩ ভাগের ১ ভাগ লোক উধাও হয়ে যায়।(৩)

অতীতের উদাহরণ কেন, মাত্র কয়েক বছর আগের সোমালিয়ার দিকে চেয়ে দেখুন।(৪) কিভাবে রাজনৈতিক পরিসর সংকুচিত হয়ে যাবার কারণে ধীরে ধীরে একটি সমৃদ্ধ রাষ্ট্র গৃহযুদ্ধের দিকে চলে গেল, যা থেকে দেশটি আজও বের হতে পারেনি।সেখানেও এখন দুর্ভিক্ষ।যার ভিক্টিম সাধারণ মানুষ। আমাদের নিজেদের উদাহরণও আছে।

আমি রাজনীতি করিনা? আই হেইট পলিটিকস? সময় যখন আসবে তখন এই মানসিকতার লোকেরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়। যার কেক যত বড়, রাষ্ট্রে তাঁর তত বেশি স্টেইক। Remember!

নোটঃ

(১) Syed Khwaja Hasan Nizami, Delhi Ki Jan Kuni, Published by Ibn Arbi, 1922, Translated by A Sattar Kapadia as ‘The Agony of Delhi’ 2003,https://www.scribd.com/…/44684266/Agony-of-Delhi-Khwaja-Has…

(২) লুটপাট নিয়ে ক্লাইভের বক্তব্য দেখুন; https://www.facebook.com/…/a.10343474266…/1267382843325036/…

(৩) ১৭৬৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী বাংলার দিওয়ানী লাভের মাত্র ৫ বছরের মাথায় দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়, এর মধ্যেই চলতে থাকে ইংরেজদের লুটপাট, দেখুন;https://www.facebook.com/muldharabd/posts/1265585713504749

আরো দেখুন; The Bengal Famine: British engineered the worst genocide in human history for profit, http://www.muldharabd.com/?p=223

সৌজন্য – মূলধারা বাংলাদেশ

একাধিক মাযহাব হল কেন ? মুফতী মনসূরুল হক দা.বা.

মাযহাব একটি হলেই তো হয়, মাযহাব একাধিক হল কেন? সব মুসলমান একই মাযহাবের অনুসারী হত এবং মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য ও একতা ঠিক থাকতো।

এর জবাব হলো, স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের ইচ্ছাই হয়তো এমন ছিল যে, মাযহাব একাধিক সৃষ্টি হোক। তাই তিনি কুরআনের শব্দগুলি এমনভাবে অবতীর্ণ করেছেন যে, সেখান থেকে একাধিক অর্থ বুঝার সুযোগ রেখে দিয়েছেন। এমনিভাবে নবীজী ﷺ এর ইচ্ছাও এমন ছিল যে, একাধিক মাযহাব সৃষ্টি হোক।

তাই অনেক হাদীসের শব্দ এমনভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, সেখান থেকে একাধিক অর্থ নেওয়া যায়। উদাহরণ দিলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে।
কুরআনের উদাহরণঃ
কুরআন শরীফে আল্লাহ তা‘আলা তালাকপ্রাপ্তা মহিলাদের ইদ্দতের আলোচনায় বলেনঃ
وَالْمُطَلَّقَاتُ يَتَرَبَّصْنَ بِأَنْفُسِهِنَّ ثَلَاثَةَ قُرُوء
‘তালাকপ্রাপ্তা মহিলারা তিন “কুরু” ইদ্দত পালন করবে’। (সূরা: বাকারা:২২৮) قُرُوء (কুরু) শব্দের অর্থ আরবী অভিধানে হায়েয ও পবিত্রতা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থাৎ কুরু শব্দের অর্থ যেমনিভাবে হায়েয হয় তেমনিভাবে পবিত্রতাও হয়। আর এই দুই অর্থের সমর্থনে হাদীসও পাওয়া যায়।

যেমন হযরত আয়েশা, ইবনে আব্বাস, যায়েদ বিন সাবেতসহ আরো অনেক সাহাবি রাযি. থেকে কুরু শব্দের অর্থ পবিত্রতা বর্ণিত আছে। আবার হযরত আবূ বকর সিদ্দীক, উমর ফারূক, আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ সহ আরো অনেক সাহাবা রাযি. ও তাবেঈন থেকে কুরু এর অর্থ হায়েয বর্ণিত আছে। একই শব্দের বিপরীতমুখী অর্থের কারণে এখানে এই মাসআলায় দুই মাযহাব সৃষ্টি হয়েছে। ইমাম মালেক ও শাফেয়ী কুরু এর অর্থ পবিত্রতা গ্রহণ করে বলেন, এমন তালাকপ্রাপ্তা মহিলা যে ঋতুবর্তী (গর্ভবতী নয়) সে তিন পবিত্রতা ইদ্দত পালন করবে।


এটা পড়ুন একটি সরল মূল্যায়ন: কুরআন-সুন্নাহ থাকতে মাযহাব কেন ?


আর ইমাম আবূ হানীফা ও আহমাদ বিন হাম্বল রহ., কুরু এর অর্থ হায়েয গ্রহণ করে বলেছেন, ঋতুবতী তালাকপ্রাপ্তা মহিলা তিন হায়েয ইদ্দত পালন করবে। (বিস্তারিত জানতে তাফসীরে ইবনে কাসীর, সূরা বাকারা:২২৮)

এখানে লক্ষণীয় বিষয় হলো, আল্লাহ তা‘আলা যেহেতু অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের সর্বময় জ্ঞানের অধিকারী, তাই তিনি অবশ্যই জানতেন যে, কুরআনের এই কুরু শব্দ নিয়ে একাধিক মত বা মাযহাব সৃষ্টি হবে। আল্লাহ তা‘আলা যদি ইসলামী শরী‘আতের মধ্যে একাধিক মাযহাবের সৃষ্টি না চাইতেন, তাহলে এখানে কুরু শব্দ ব্যবহার না করে তুহুর-হায়েয বা এ জাতীয় অন্য কোনো শব্দ ব্যবহার করে একাধিক অর্থ গ্রহণের সম্ভাবনা বন্ধ করে দিতে পারতেন। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা সব কিছু জানা সত্ত্বেও তা করেননি। এর দ্বারা একথাই স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, একাধিক মাযহাব সৃষ্টি হওয়ার মধ্যে স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের ইচ্ছারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।

হাদীসের একটি উদাহরণঃ
খন্দক যুদ্ধ চলাকালীন ইয়াহুদী গোত্র বনী কুরাইযা মুসলমানদের সাথে কৃত অঙ্গীকার ভঙ্গ করে গাদ্দারী করে। তাই খন্দক যুদ্ধ শেষে আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে বনী কুরাইযার সাথে জিহাদ করার হুকুম আসে। হুকুম আসামাত্র নবীজী ﷺ সাহাবা রাযি. কে খুব দ্রুত বনীকুরাইযার এলাকায় পৌঁছার হুকুম দেন। সেই হুকুমের শব্দটি ছিল এরূপঃ
لا يصلين أحد العصر إلا في بني قريظة
‘তোমাদের কেউ যেন বনী কুরাইযায় পৌঁছার আগে আসরের নামায না পড়ে’। (বুখারী হা.নং ৩৮৩৯) এই নির্দেশ পেয়ে সাহাবায়ে কেরাম রাযি. বনী কুরাইযা অভিমুখে নিজেদের সাধ্যমত দ্রুত ছুটলেন। কিন্তু চেষ্টা সত্ত্বেও আছরের ওয়াক্তের মধ্যে বনী কুরাইযায় পৌঁছতে পারলেন না। এদিকে পথিমধ্যেই আসরের ওয়াক্ত শেষ হওয়ার অবস্থা। তখন সাহাবা কেরাম রাযি. দুই দলে বিভক্ত হয়ে গেলেন। একদল নবীজী ﷺ এর কথার বাহ্যিক অর্থ ধরে বললেন, যেহেতু নবীজী ﷺ বনী কুরাইযায় না পৌঁছে আসর পড়তে নিষেধ করেছেন, তাই আমরা বনী কুরাইযায় পৌঁছেই মাগরিবের ওয়াক্তে আসর পড়ব।

আরেক দল যারা নবীজী ﷺ কথার মর্ম বুঝেছিলেন তাঁরা বললেন, নবীজী ﷺ এর ঐ কথার উদ্দেশ্য ছিল দ্রুত বনী কুরাইযায় পৌঁছা। আমরা যেহেতু সাধ্যানুযায়ী চেষ্টা করেও আসরের ওয়াক্তে বনী কুরাইযায় পৌঁছতে পারিনি, তাই আমরা আসর কাযা না করে এখনই আসর পড়ে তারপর বনী কুরাইযায় পৌঁছবো। উভয় দল নিজেদের মতানুযায়ী আমল করলেন। হযরত আব্দুল্লাহ বিন উমর রাযি. বলেন, বনী কুরাইযার যুদ্ধ শেষে যখন এই ঘটনা নবীজী ﷺ কে বলা হলো, তখন তিনি কোনো দলের কাজকেই ঠিক বা ভুল বলেননি। (সহীহ বুখারী হা.নং ৩৮৩৯)

এখানে লক্ষণীয় বিষয় হলো, নবীজী ﷺ এর বাণী ‘তোমাদের কেউ যেন বনী কুরাইযায় পৌঁছার আগে আসরের নামায না পড়ে’ এই বাণীর দুই রকম অর্থ সাহাবায়ে কেরাম বুঝলেন এবং দুই ভাবে আমলও করলেন। আর নবীজী ﷺ ও কোনো দলের সিদ্ধান্তকে ঠিক আর কোনো দলের সিদ্ধান্তকে ভুল বললেন না। এর দ্বারা একথাই প্রমাণিত হয় যে, নবীজী ﷺ এর ইচ্ছাও এমন ছিল যে, শরী‘আত মানার ক্ষেত্রে একাধিক মত ও পথ তৈরি হোক।

কেননা যদি নবীজী ﷺ এর ইচ্ছা এমনটি নাই হতো, তাহলে তিনি অবশ্যই সাহাবায়ে কেরামের দুই দলের এক দলকে বলতেন ‘তোমাদের কাজ ঠিক হয়নি, তোমরা আমার কথা বুঝতে পারনি’। কিন্তু তিনি এমনটি বলেননি। আর তিনি হুকুমটাও এমনভাবে করেছেন যে, তা থেকে দুই রকম অর্থ বোঝার সুযোগও ছিল। অথচ তিনি কথাটা ওভাবে না বলে এভাবেও বলতে পারতেন যাতে দুই রকম অর্থ বুঝার সম্ভাবনা সৃষ্টি হত না । যেমন তিনি এভাবে বলতে পারতেনঃ ‘আসর কাযা করতে হলেও তোমরা বনী কুরাইযায় গিয়েই আসর পড়বে।’ এভাবে বললে সাহাবা কেরাম দুই রকম অর্থ বুঝতেন না। আর দুই মতেরও সৃষ্টি হত না।

যাই হোক কুরআন-সুন্নাহ দ্বারা এ কথাই প্রমাণিত হলো যে, শরী‘আত মানার ক্ষেত্রে একাধিক মাযহাব সৃষ্টি হওয়া স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলা ও নবীজী ﷺ এর ইচ্ছা ছিল। তাই এই প্রশ্ন একেবারেই অবান্তর যে, ইসলামে এত দল, এত মত কেন? সাথে সাথে মুসলিম উম্মাহকে যে কোনো এক মত বা মাযহাবের উপর ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করাও আল্লাহ তা‘আলার মর্জির খেলাফ।

সালফে সালেহীন মাযহাবের এই ইখতিলাফকে রহমত বলে অভিহিত করেছেন। এবং তারা মুসলিম উম্মাহকে একই মাযহাবের উপর আমল করতে উদ্বুদ্ধ করার প্রচেষ্টারও বিরোধিতা করেছেন। নিম্নে এ ব্যাপারে সালফে সালেহীনের কয়েকটি উক্তি উল্লেখ করা হচ্ছেঃ

১. কাসেম বিন মুহাম্মাদ বিন আবূ বকর সিদ্দীক রহ. বলেনঃ ‘আমলের মধ্যে সাহাবায়ে কেরামের ইখতিলাফের মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা এই উম্মতের কল্যাণ করেছেন। এখন যে কেউ কোনো আমল করতে চাইলে সে এ ব্যাপারে প্রশস্ত পথ পেয়ে যায়। সে দেখে যে, তার থেকে উত্তম ব্যক্তি এই আমল করে গেছেন।’ (জামেউ বায়ানিল ইলমি ওয়া ফাযলিহি:২/৮০)

২. হযরত উমর ইবনে আব্দুল আজীজ রহ. বলেছেন: ‘সাহাবায়ে কেরাম রাযি. এর মধ্যে ইখতিলাফ না হওয়াটা আমার নিকট পছন্দনীয় নয়। কারণ, যদি ইখতিলাফ না হত, শরী‘আত মানার পথ একটিই হত, তাহলে এর দ্বারা এক ধরণের সংকীর্ণতা সৃষ্টি হত। অথচ সাহাবায়ে কেরাম যেহেতু প্রত্যেকেই অনুসরণীয় তাই (তাদের মধ্যে ইখতিলাফ হওয়ার ফলে এখন) যে কারো যে কোনো সাহাবীর মতানুযায়ী আমল করার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।’

৩. একদা হযরত ইমাম মালেক রহ. কে তখনকার মুসলিম জাহানের খলীফা আবূ জা‘ফর মানসূর বললেন, আমি চাচ্ছি আপনার সংকলিত এই ইলম (মুআত্তা মালেক) কে একমাত্র অনুসরণীয় করবো এবং সেনাবাহিনী ও বিচারক সবাইকে এই অনুযায়ী আমল করতে বলব। অতঃপর কেউ এটার বিরোধিতা করলে তার গর্দান উড়িয়ে দিব। ইমাম মালেক রহ. বললেন, হে আমীরুল মুমিনীন! একটু ভেবে দেখুন। নবীজী ﷺ এমন অবস্থায় উম্মতের মধ্য থেকে বিদায় নিলেন যখন মাত্র কয়েকটি এলাকা ইসলামের অধিনে এসেছে।

এরপর হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. এর সময়ও ইসলাম তেমন ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ পায়নি। হযরত উমর ফারূক রাযি. এর সময় ইসলাম পৃথিবীর বুকে ছড়িয়ে পড়লো। অনেক দেশ মুসলমানদের করতলগত হল। তখন তিনি বিজিত এলাকার মুসলমানদের ইসলামী শিক্ষা-দীক্ষার জন্য বিভিন্ন সাহাবায়ে কেরামকে বিভিন্ন এলাকায় প্রেরণ করতে বাধ্য হলেন। তখন থেকে আজ পর্যন্ত সেসব এলাকায় ঐসব সাহাবায়ে কেরামের ইলম চর্চা হতে লাগল যাদেরকে ঐ এলাকার মুআল্লিম হিসাবে প্রেরণ করা হয়েছিল। এখন আপনি যদি সেসব লোককে এমন কোনো বিষয় মানতে বাধ্য করেন যা তাদের নিকট সংরক্ষিত ইলমের পরিপন্থী, তাহলে তারা এটাকে কুফরী মনে করবে। অতএব, আপনি দয়া করে প্রত্যেক শরহবাসীকে তাদের নিকট যে ইলম সংরক্ষিত আছে, সে ইলম অনুযায়ী আমল করতে বলুন। আর আপনার পছন্দ হলে এই কিতাব আপনি নিজের জন্য নিতে পারেন। একথা শুনে খলীফা বললেন, আপনি ঠিকই বলেছেন। এই কিতাব আপনি আমার ছেলে মুহাম্মাদের জন্য লিখে দিন।’ (আদাবুল ইখতিলাফ পৃ.৩৬)

৪. ইমাম মালেক রহ. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, ‘ফুকাহা কেরামের ইখতিলাফ এই উম্মতের জন্য আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে রহমত স্বরূপ।’ (আদাবুল ইখতিলাফ পৃ.৩৯)
উপরিউক্ত আলোচনা দ্বারা এ কথা প্রমাণিত হলো যে, শরী‘আত মানার ক্ষেত্রে একাধিক পথ সৃষ্টি হওয়া কোনো দোষণীয় বিষয় নয়। বরং এটা এই উম্মতের জন্য রহমত এবং এটা উম্মতে মুহাম্মাদীর বিশেষ বৈশিষ্ট্য।

অতএব, একাধিক মাযহাব নিয়ে কোনো প্রশ্ন করা এবং যে এলাকায় যে মাযহাব প্রচলিত আছে সেই এলাকার লোকদেরকে তাদের মাযহাব পরিপন্থী কোনো কিছু মানার আহ্বান করা কুরআন-সুন্নাহ ও সালফে সালেহীনের আমলের পরিপন্থী। তাই যারা এ কাজ করছে, তাদের উচিত আরো একটু গভীরভাবে ভেবে দেখা। তারা কি আসলেই মুসলিম উম্মাহর খায়েরখাহী করছে নাকি মুসলিম উম্মাহকে ফেতনা-ফাসাদ ও সংঘর্ষের পথে নিয়ে যাচ্ছে।

ইমাম মালেক রহ. নিজের মাযহাব সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়ার মোক্ষম সুযোগ পেয়েও তিনি সেই সুযোগ গ্রহণ করলেন না, বরং খলীফার কাছে আবেদন করলেন প্রত্যেক এলাকাবাসীকে নিজেরদের অবস্থার উপর ছেড়ে দেওয়ার জন্য। বর্তমানে যারা হানাফী মাযহাব মাননেওয়ালা মুসলিমদেরকে মাযহাব বিমুখ করার প্রচেষ্টায় লিপ্ত তারা কি নিজেদেরকে ইমাম মালেক থেকেও বেশি সমঝদার মনে করেন যে, তারা হানাফী মুসলিমদেরকে নিজেদের মনগড়া মাযহাবের প্রতি আহ্বান করে সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে চলছেন? আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে সঠিক বুঝ দান করুন।

প্রধান মুফতী ও শাইখুল হাদীস,
জামিয়া রহমানিয়া,মুহাম্মাদপুর,ঢাকা।