পৃথিবীতে আগমনের পূর্বেই বিভিন্ন আসমানি কিতাবে নবী জির আগমনের সুসংবাদ ও আলামত লিপিবদ্ধ ছিল। সর্বপ্রথম যেই রমজানে নবীজির ওপর ওহি অবতীর্ণ হয়, জিবরাইলের প্রচ- চাপায় নবীজি জ্বরে আক্রান্ত হন। শরীরে কম্পন আরম্ভ হয়। কোনো মতে বাড়িতে এসে হযরত খাদিজাকে বললেন, আমাকে কম্বল দিয়ে জড়িয়ে দাও। হযরত খাদিজা নবীজিকে কম্বলে জড়িয়ে দিলেন। কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ার পরে নবীজি খাদিজার নিকট ওহি অবতীর্ণ হওয়ার ঘটনা খুলে বললেন। আতঙ্কিত কণ্ঠে নবীজি বললেন, আমি জীবনের আশঙ্কা করছি।
হযরত খাদিজা ছিলেন এক মহীয়সী ও বিদুষী নারী। একজন আদর্শ স্ত্রী। নবীজির মানসিক বিপর্যয়ের এই মুহূর্তে তিনি নবীজিকে পরম সান্ত¡নার বাণী শোনালেন। তিনি বললেন: আল্লাহর কসম, তিনি কখনো আপনাকে লাঞ্ছিত করবেন না। আপনি আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করেন। সর্বদা সত্য কথা বলেন। অসহায় মানুষের বোঝা বহন করেন। আপনি বিশ্বস্ত। আপনি আমানতদার। মেহমানদের আপ্যায়ন করেন। মানুষকে সাহায্য করেন। যার মধ্যে এমন সুন্দর চরিত্রমাধুরি বিদ্যমান সে কখনো লাঞ্ছিত হবে না।
হযরত খাদিজার কথায় নবীজি সান্ত¡না লাভ করলেন। এরপরে হযরত খাদিজা তার চাচাত ভাই ওয়ারাকা ইবনে নওফেলের কাছে গেলেন। ওয়ারাকা ছিল একজন খ্রিস্টান ধর্মযাজক। ইঞ্জিল ও তাওরাতের প-িত। মূর্তিপূজা পছন্দ করত না। বয়সের ভারে ন্যূব্জ ও অন্ধ ওয়ারাকা ঘটনার বিবরণ শুনে বলল, তুমি যদি সত্য বলে থাক তাহলে তাঁর কাছে সেই ফেরেশতা এসেছেন যিনি হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের কাছে আগমন করতেন।
পরে নবীজির থেকে ঘটনার বিবরণ শুনে ওয়ারাকা বলল, হায়, আমি যদি তোমার নবুয়তির সময়ে শক্তিমান ও সক্ষম থাকতাম, যখন তোমার সম্প্রদায় তোমাকে দেশান্তরিত করবে অন্তত তখন যদি আমি জীবিত থাকতাম! নবীজি আশ্চর্য হয়ে জানতে চাইলেন, আমাকে দেশ থেকে বের করে দেওয়া হবে!
মক্কার মানুষ ছিল মূর্তিপূজক। তাদের কাছে আসমানি কিতাবের জ্ঞান ছিল না। নবীজি ইসলাম প্রচার শুরু করলে বিষয়টি যাচাইয়ের জন্য তারা নযর ইবনে হারিস ও উকবা ইবনে আবি মুয়িত নামে দুই ব্যক্তিকে মদীনায় ইহুদি ধর্মের প-িতদের কাছে প্রেরণ করল। যেন তারা আসমানি কিতাবের আলোকে নবীজির নবুয়তির সত্যতা বা অসারতা প্রমাণ করে। মদীনার ইহুদি আলেমরা তাদের বলল: মুহাম্মাদকে এই তিনটি প্রশ্ন করবে :
১. কারা গুহায় আত্মগোপন করেছিল?
২. কোন মহান ব্যক্তি পৃথিবীর পূর্ব থেকে পশ্চিম প্রান্ত পুরা দুনিয়া চষে বেড়িয়েছেন?
৩.রূহ কী?
যদি প্রথম দুটি প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দেয় এবং তৃতীয় প্রশ্নের উত্তর না দেয় তাহলে তিনি আল্লাহর প্রেরিত নবী, অন্যথায় মিথ্যাবাদী।
নযর ও উকবা মক্কায় এসে নবীজির নিকট প্রশ্ন তিনটি পেশ করল। আল্লাহ তাআলা ওহির মাধ্যমে নবীজিকে প্রথম দুটি প্রশ্নের উত্তর জানিয়ে দিলেন। যার প্রেক্ষিতে সুরায়ে কাহাফ অবতীর্ণ হয়েছে। যার মধ্যে গুহাবাসী তথা আসহাবে কাহাফ ও হযরত যুলকারনাইনের ঘটনার বিবরণ পেশ করা হয়েছে। আর রূহ সম্পর্কে কোনো উত্তর না দিয়ে শুধু বলা হলো, রূহ আল্লাহর একটি নির্দেশ। এর দ্বারা প্রমাণিত হলো নবীজির নবুয়ত সত্য।
শৈশবে নবীজি চাচা আবু তালেবের সাথে বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে সিরিয়া গমন করেন। সফরের অসহনীয় দুর্ভোগ ও যন্ত্রণার কথা চিন্তা করে আবু তালেব প্রথমে কিশোর মুহাম্মাদকে সঙ্গে নিতে চাননি। কিন্তু যাত্রার সময় তাঁর চেহারায় বিষণœতার ছাপ দেখে তাকেও সাথে নিয়ে নেন। বসরার কাছাকাছি এক খ্রিস্টান ধর্মযাজক বাস করতেন। তার নাম জারজিস। বোহায়রা রাহেব নামে প্রসিদ্ধ ছিল। মক্কার ব্যবসায়িক কাফেলা বোহায়রা রাহেবের গির্জার পাশে অবতরণ করল। কিশোর মুহাম্মাদের চেহারা দেখেই সে বোহায়রা নিশ্চিত হয়ে গেল, এই কিশোরই হবে শেষ নবী, পূর্ববর্তী কিতাবসমূহে যার নিদর্শন বর্ণিত হয়েছে। বোহায়রা গির্জা থেকে বের হয়ে এসে কিশোর মুহাম্মাদের হাত ধরে বলল:
“এ হলো দোজাহানের সর্দার। বিশ্বপ্রতিপালকের প্রেরিত রাসূল। আল্লাহ তাকে পৃথিবীর জন্য রহমতস্বরূপ প্রেরণ করেছেন।”
কোরায়শের নেতৃবৃন্দ বলল: আপনি কিভাবে বললেন? বোহায়রা বলল, তোমরা তাঁবু থেকে বের হওয়ার পর এমন কোনো গাছ ও পাথর ছিল না, যে তাঁকে সিজদা করেনি। তাছাড়া তাঁর পিঠ ও গর্দানের মধ্যে অঙ্কিত মোহরে নবুয়ত দেখে তাকে চিনেছি। ( আসমানি কিতাবে নবী — )
পরে বোহায়রা তাদের বলল: তোমরা তাঁকে রোম দেশে নিও না। তারা নিদর্শন দেখে তাঁকে চিনে ফেলবে এবং হত্যা করে ফেলবে। এর মধ্যেই হঠাৎ বোহায়রা দেখলেন কিছু রোমীয় লোক কাকে যেন সন্ধান করছে। বোহায়রা তাদের ডেকে জিজ্ঞেস করল, তোমরা কি খোঁজছ? তারা বলল: আমরা সেই নবীর সন্ধান করছি। তাওরাত ও ইঞ্জিলে বর্ণিত আছে এই মাসে সে সফরে বের হবে। আমরা সবদিকে লোক নিযুক্ত করেছি। বোহায়রা বলল: আচ্ছা, মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ যাকে প্রেরণের ইচ্ছা করেছেন তোমরা তাকে প্রতিহত করতে পারবে? তারা বলল: না। তারপর তারা নবীকে অনুসন্ধান না করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে চলে গেল।
আবদে আশহাল গোত্রের এক ইহুদি পতি। একদিন লোকদের জড়ো করে কেয়ামত আখেরাত হিসাব নিকাশ ও জান্নাত জাহান্নাম সম্পর্কে আলোকপাত করল। পরকালের আলোচনা শুনে এক মুশরিক পৌত্তলিক মূর্তি পূজারী বলে উঠল: তোমার জন্য আফসোস, তুমি কি আবোল তাবোল বকছ? এসব কি সত্যি হবে বলে তুমি মনে কর? মৃত্যুর পর মানুষ পুনর্জীবিত হবে? সবাই একত্রিত হবে? সেখানে জান্নাত জাহান্নাম থাকবে? প্রত্যেককে নিজ নিজ কাজের বিনিময় দেওয়া হবে?
ইহুদি বলল: হ্যাঁ এমনি হবে। যারা এটা মানে না তাদের জন্য সেখানে একটা বিশাল চুলা থাকবে। সেখানে তারা দগ্ধ হবে। মূর্তি পূজারী লোকটি বলল: বল কি? তাহলে তার কিছু লক্ষণ বল?
ইহুদি প-িত বলল: এই অঞ্চল থেকে অচিরেই একজন নবী হতে যাচ্ছেন। লোকেরা বলল, কত দিনে মধ্যে তিনি আবির্ভূত হবেন?
বর্ণনাকারী বদরি সাহাবি হযরত সালামা রাযি. বলেন, ইহুদি প-িত আমার দিকে ইশারা করে উত্তর দিলেন, এই বালক যদি পূর্ণ আয়ু পায় তাহলে সে নবীকে দেখতে পারবে।
হযরত সালামা বলেন, এর কিছুদিন পরেই নবীজির আবির্ভাব হয়। আমরা নবীজির প্রতি ঈমান আনি। কিন্তু সেই ইহুদি হিংসা বশত নবীজির প্রতি ঈমান আনল না।
সিরিয়ার অধিবাসী ইবনে হাইয়্যাবান সিরিয়া ছেড়ে মদীনায় এসে বসবাস করতে আরম্ভ করেন। আমল নামাজ ও অত্যধিক ইবাদত বন্দেগির কারণে তার প্রতি ইহুদিদের ভক্তি ছিল অনেক বেশি। তাকে দিয়ে বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়ানো হত। মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে এলে তিনি ইহুদিদের ডেকে বললেন: কি কারণে সিরিয়ার মতো প্রাচুর্যের দেশ ছেড়ে আমি এই ক্ষুধার দেশে এসেছি তা জান? তারা বলল, না। বৃদ্ধ বললেন, আমি একজন নবীর আগমনের অপেক্ষায় রয়েছি। তার আগমনের সময় আসন্ন। এ শহরে তিনি হিজরত করবেন। আমার আশা ছিল, আমার জীবদ্দশায় তিনি আসবেন এবং আমি তাঁর অনুসারী হব। যদি আমি বেঁচে থাকতে তিনি না আসেন তাহলে তিনি আসার পর তোমরা তাঁর উপর ঈমান আনতে বিলম্ব কর না। কেননা তাঁর হাতে তাঁর বিরোধীদের অনেক রক্তপাত হবে। শিশু ও নারীরা বন্দি হবে। দেখ, তোমাদের আগে যেন অন্যরা তাঁর ওপর ঈমান আনতে না পারে।
হযরত খাদিজা ছিলেন মক্কার সম্ভ্রান্ত ধনাঢ্য মহিলা। বেতনভুক্ত কর্মচারী রেখে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে তিনি ব্যবসা পরিচালনা করতেন। এর জন্য প্রয়োজন ছিল বিশ্বস্ততা ও নিষ্ঠার। বালক মুহাম্মাদের সততা নিষ্ঠা বিশ্বস্ততা ও চারিত্রিক মহত্ত্বের কথা অন্যদের ন্যায় খাদিজার কানেও পৌঁছল। একদিন খাদিজা বালক মুহাম্মাদকে ব্যবসায়িক পণ্যসম্ভার নিয়ে সিরিয়া যাওয়ার প্রস্তাব করলেন। জানালেন, সম্মানি বাবত অন্যদের তুলনায় তাঁকে বেশি দিবেন। সাথে খাদিজার চাকর মাইসারাকে সঙ্গে দিতে চাইলেন।
বালক মুহাম্মাদ খাদিজার পণ্য সামগ্রী নিয়ে সিরিয়ায় গেলেন। সিরিয়ার কাছাকাছি এক গির্জার পাশে তাবু গাড়লেন। সবাই বিশ্রামে গেল। বালক মুহাম্মাদও একটি গাছের নিচে বিশ্রাম গ্রহণ করলেন। অদূরবর্তী গির্জা থেকে এক পাদ্রি এই দৃশ্য দেখছিল। সে বিস্ময়াভিভূত! পাদ্রি মাইসারাকে ডেকে গোপনে জিজ্ঞেস করল: গাছের নিচে বিশ্রামরত ভদ্রলোকটি কে? মাইসারা উত্তর দিল, কাবা শরিফের কাছাকাছি বসবাসকারী এক কোরায়শী যুবক। তার নাম মুহাম্মাদ। ধর্মযাজক বলল : এই গাছের নিচে নবী ছাড়া কেউ কখনো বিশ্রাম নেয়নি।
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, মাসিক কিশোর পথ, প্রাবন্ধিক, শিক্ষক, গ্রন্থকার।
আযানের অর্থ । ইসলামের প্রতিটা হুকুমের পেছনেই কোন না কোন সৌন্দর্য লুকিয়ে থাকে। এই যেমন আযানের কথাই ধরা যাক। আমরা ছোটবেলা থেকে হাজার হাজারবার আযান শুনে এসেছি, কিন্তু কখনো ভেবে দেখেছি কি আযানে যে কথাগুলো বলা হয় সেগুলো কেন বলা হয়? অথচ আযানের কথাগুলোর মর্ম অনুধাবন করতে পারলে আযান কানে আসামাত্রই আমরা নামাজ পড়ার জন্য একটা অন্যরকম তাগাদা অনুভব করতাম! এই লেখায় আমি সংক্ষেপে আযানের কথাগুলোর মর্মার্থ আলোচনা করব। আযানের অর্থ
১) আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার
অর্থ: আল্লাহ সবচেয়ে মহান, আল্লাহ সবচেয়ে মহান
“আল্লাহু আকবার” কথাটির মধ্যে চমৎকার একটা ভাষার খেলা আছে। আরবী “কাবির” শব্দের ইংরেজী হলো “গ্রেট”, “আকবার” এর ইংরেজী “গ্রেটার”, আর “আল-আকবার” এর ইংরেজী “গ্রেটেষ্ট”। আল্লাহ তো সবার চাইতে মহান বা গ্রেটেষ্ট, লক্ষ্য করুন তারপরেও এখানে “আল-আকবার” (গ্রেটেষ্ট) ব্যবহার না করে “আকবার” (গ্রেটার) ব্যবহার করা হয়েছে। কেন? কারণ, “গ্রেটেষ্ট” তখন ব্যবহার করা জরুরী হয়ে পড়ে যখন কমপক্ষে তিনজনের মধ্যে তুলনা করা হয় । দুইজনের মধ্যে কে বেশী মহান তা বুঝানোর জন্য “গ্রেটার” শব্দটাই যথেষ্ট। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা অন্য সব কিছুর তুলনায় এত বেশী মহান যে তাঁর সামনে সবকিছুই নগণ্য, সব কিছুই তুচ্ছ। ঠিক যেমন অসীম কোন কিছুর সাথে যদি ক্ষুদ্র সব কিছুর তুলনা করার জন্য “গ্রেটার” শব্দটাই যথেষ্ট, তেমনিভাবে মহান আল্লাহর মহানতা বর্ণনার জন্য “আকবর” ব্যবহার করলেও সেটা “গ্রেটেষ্ট” কেই বুঝায়।
আমি এখন যে কাজই করছি না কেন – পড়াশুনা করছি, চাকরি করছি বা সোফায় গা এলিয়ে টিভি দেখছি, “আল্লাহু আকবার” বলার মাধ্যমে মুয়াজ্জিন আমাকে মনে করিয়ে দিলেন – যে আল্লাহর হাতে আমার প্রাণ, তিনি আমাকে ডাকছেন। আযানের অর্থ –
২) আশহাদু আল্লাহ ইলাহা ইল্লালাহ
অর্থ: আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আল্লাহ ছাড়া ইবাদতের যোগ্য আর কোন উপাস্য নাই
ইবাদত শব্দের অর্থ হলো উপাসনা ও দাসত্ব করা। এখানে আমাকে মনি করিয়ে দেয়া হলো আমি আল্লাহর দাস। কাজেই, আমার ইচ্ছা হলো তাই নামাজ পড়লাম, আর ইচ্ছা হলো না তাই নামাজ পড়লাম না – এরকম করা যাবে না। দাসের কাজ হলো প্রভু যা বলে তা পালন করা। আযানের অর্থ –
৩) আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ
অর্থ: আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে মুহাম্মাদ(সা) আল্লাহর প্রেরিত বার্তাবাহক
কিভাবে আল্লাহর ইবাদত করতে হবে তা আল্লাহ জানিয়ে দিয়েছেন তাঁর বার্তাবাহক মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর মাধ্যমে। আল্লাহর হুকুম মানতে চাইলে অনুসরণ করতে হবে মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে। কাজেই জানতে হবে, আযান শুনলে মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কি করতে হবে শিখিয়ে গেছেন? মুহাম্মাদ(সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলে গেছেন – ইসলাম আর কুফরীর মধ্যে পার্থক্য হলো নামাজ। তিনি আরো বলে গেছেন – তাঁর সাথে তাঁর উম্মতের কন্ট্রাক্ট হলো নামাজ, যে ইচ্ছা করে নামাজ ছেড়ে দিল, সে কন্ট্রাক্ট ভঙ্গ করলো। আমি আমার অফিসের কন্ট্রাক্ট এর বিরুদ্ধে কোন কাজ করলে যেমন আমার চাকরী থাকবে না, তেমনি মুহাম্মাদ(সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যে কন্ট্রাক্ট দিয়েছেন সেটা ভঙ্গ করে নিজেকে তাঁর উম্মত দাবি করা কতটা যুক্তিযুক্ত ? আযানের অর্থ –
৪) হাইয়া ‘আলাস সলাহ
অর্থঃ নামাজের দিকে আসো
এই বাক্যে আহবান করা হলো সরাসরি নামাজের দিকে। তুলনা করে দেখুন, অফিসে আমাদের বস যখন আমাদের ডাকে তখন আমরা কেমন পড়িমড়ি করে তার কাছে ছুটে যাই।
৫) হাইয়া ‘আলাল ফালাহ
অর্থ: সফলতার দিকে আসো
আল্লাহ জানেন যখন আমাদের নামাজের দিকে ডাকা হয় তখন আমরা কি ভাবি, তাই একেবারে মোক্ষম পয়েন্টে আঘাত করা হলো! আমরা বেশীরভাগ মানুষই নামাজ পড়ি না এই বলে যে – “আরে নামাজ পড়লে আমার অফিসের কাজগুলি করবে কে?”, “আগামী কাল পরীক্ষা আছে এখন নামাজ পড়ার টাইম নাই”, “ফজরের নামাজ পড়তে উঠলে তো ঘুমের বারটা বাজবে” – এই সবগুলি অজুহাতেরই মূল কথা হলো নামাজ পড়তে গেলে আমার পার্থিব সফলতার ব্যাঘাত ঘটবে। “হাইয়া ‘আলাল ফালাহ” এর মাধ্যমে আমাদের মনে করিয়ে দেয়া হলো, সফলতায় ব্যাঘাত নয় বরং সফলতা অর্জনের জন্যই আল্লাহ নামাজের হুকুম দিয়েছেন! সত্যি কথা বলতে কি সারা দিনের একেক ওয়াক্তের ফরজ নামাজ আদায় করতে কিন্তু ৫-১০ মিনিটের বেশী সময় লাগে না, এর চেয়ে ঢের বেশী সময় আমরা ইউনিভার্সিটিতে/অফিসে ব্যয় করি কফি খেয়ে, আড্ডা মেরে, পত্রিকা পড়ে, ফেইসবুকিং করে। অথচ চাইলেই সময় মতো কমপক্ষে শুধু ফরজ নামাজটুকু পড়ে নিয়ে আমরা কিন্তু অনায়াসে পুরো উদ্যমে পড়ালেখা/অফিসের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারি।
৬ ও ৭) আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার; লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ
অর্থ: আল্লাহ সবচেয়ে মহান, আল্লাহ সবচেয়ে মহান; আল্লাহ ছাড়া ইবাদতের যোগ্য আর কোন উপাস্য নাই
শেষের এই অংশটা এক মহাসতর্ক বাণী। আল্লাহ আমাদের জানিয়ে দিচ্ছেন – হে বান্দাহ। তুমি নামাজ পড়তে আসো আর নাই আসো, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার তাতে কিছুই যায় আসে না। তুমি নামাজ পড়লেও তিনি সবচেয়ে মহান, তুমি নামাজ না পড়লেও তিনি সবচেয়ে মহান; তুমি তাঁর ইবাদত করলেও তিনি তোমার মা’বুদ, তুমি তাঁর ইবাদত না করলেও তিনি তোমার তোমার মা’বুদ। যত লাফালাফি করার ইচ্ছা তুমি করে নাও, তোমাকে যে এসাইনমেন্ট দিয়ে পাঠানো হয়েছে তার ডেডলাইন ঠিক করা আছে, সময় ফুরোলেই কড়ায় গন্ডায় হিসেব নেয়া হবে।
আযানের জবাব:
আযানের জবাবে আযানে যা যা বলা হয় তার সবই বলা হয় শুধু ৪ আর ৫ নং বাক্য দুইটা আলাদা। এই দুই বাক্য শুনলে বলতে হয় – “লা হাওলা ওয়া লা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ”, অর্থ: “আল্লাহ ছাড়া কোন কিছুরই কোন পরিবর্তন বা কোন শক্তি নেই”। কেন এরকম বলা হয়? কারণ, “হাইয়া ‘আলাস সালাহ” শুনে আমরা নামাজ পড়ার জন্য অজু করে প্রস্তুতি নেয়া শুরু করব, আর তাই আল্লাহর কাছে দু’আ করা হচ্ছে ও শুকরিয়া আদায় করা হচ্ছে – হে আল্লাহ তুমি আমাকে শক্তি দিয়েছ বলেই আজ আমি নামাজের উদ্দেশ্যে উঠে দাড়াতে পারছি। কত মানুষ অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে আছে তারা শত চেষ্টা করেও নামাজ পড়তে পারছে না! আবার, কত মানুষ তাদের কর্মের মাধ্যমে তোমার রাগ অর্জন করেছে, ফলে তাদের হৃদয় তুমি সীলগালা করে দিয়েছ, তাই আযানের এই সুন্দর আহবান তাদের অন্তরে বিন্দুমাত্র পরিবর্তনের সৃষ্টি করে না।
আল্লাহ আমাদের তৌফিক দিন যেন প্রতিটি ইবাদতের পেছনের সৌন্দর্যগুলি আমরা বুঝতে পারি এবং সেই অনুযায়ী তাঁর ইবাদত করতে পারি।
মুফতী মনসুরুল হক – ভূমিকাঃ অন্তরের ১০টি রোগের চিকিৎসা করে অন্তরের ১০টি গুণ হাসিল করার নাম তাযকিয়া বা আত্মশুদ্ধি। যা শরী‘আতের দৃষ্টিতে ফরযে আইন এবং এর জন্যে কোন ইজাযত প্রাপ্ত শাইখের সাথে ইসলাহী সম্পর্ক করাও ফরযে আইন। বাইআত হওয়া ফরয বা ওয়াজিব নয় বরং এটা মুস্তাহাব, এর উপর আত্মশুদ্ধি নির্ভর করে না। আত্মশুদ্ধি অর্জন হলে সমস্ত জাহেরী গুনাহ বর্জন করা এবং জাহেরী ইবাদত-বন্দেগী করা সহজ হয়ে যায় এবং সেই বন্দেগীকে তাকওয়ার যিন্দেগী বা সুন্নতী যিন্দেগী বলে এবং সে ব্যক্তি তথন আল্লাহর ওলী হয় এবং তার হায়াতে তাইয়িবা তথা পবিত্র জীবন নসীব হয়। আল্লাহ তা‘আলা সকলকে এ দৌলত নসীব করেন, আমীন।
অন্তরের ১০টি রোগের বর্ণনা
১. বেশী খাওয়া এবং ভাল খানার প্রতি লোভী হওয়া
বেশি খাওয়া এবং উদর পূর্তি করে খাওয়া অসংখ্য গুনাহের মূল। এজন্য হাদীসে পাকে ক্ষুধার্ত থাকার অনেক ফযীলত বর্ণিত হয়েছে। রাসূল আকরাম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেনঃ “মানুষের জন্য পূর্ণ করার ক্ষেত্রে পেটের থেকে খারাপ কোন পাত্র নেই।” (বুখারী হা: নং ৪৩৪৩)
খানা কম খাওয়ার উপকারসমূহ
১. অন্তরে স্বচ্ছতা সৃষ্টি হয়। ২. দিল নরম হয় এবং মুনাজাতে স্বাদ অনুভূত হয়। ৩. অবাধ্য নফস অপদস্থ ও পরাজিত হয়। ৪. নফসকে শাস্তি দেওয়া হয়। ৫. কুপ্রবৃত্তি দুর্বল হয়ে যায়। ৬. বেশী নিদ্রা আসে না এবং ইবাদত কষ্টকর হয় না। ৭. দুনিয়াবী চিন্তাভাবনা কমে আসে এবং জীবিকা নির্বাহের বোঝা হাল্কা হয়ে যায়।
উল্লেখ্য বর্তমান যামানার লোকেরা পূর্বের তুলনায় অনেক কমজোর হওয়ায় তাদের খানার মুজাহাদার ব্যাপারে হাকীমুল উম্মত হযরত থানভী রহ. লিখেছেনঃ এ যমানায় খানার মুজাহাদার অর্থ হলো পেট পূর্ণ হতে ২/৪ লুকমা বাকী থাকা অবস্থায় খানা শেষ করা এবং নফস বা শরীর দিয়ে খুব কাজ নেয়া।
২. অধিক কথা বলা
যবান হল অন্তরের দূত, অন্তরের যাবতীয় নকশা ও কল্পনাকে যবানই প্রকাশ করে। এজন্য যবানের ক্রিয়া বড় মারাত্মক হয়।
হাদীসে পাকে ইরশাদ হয়েছেঃ যে ব্যক্তি নিজের লজ্জাস্থান এবং জিহবাহর ব্যাপারে আমাকে নিশ্চয়তা দিতে পারবে আমি তার জন্য জান্নাতের নিশ্চয়তা দিব। (বুখারী হা: নং ৬৪৭৪)
এটা অত্যন্ত খারাপ একটি আত্মিক ব্যাধি। রাগ দোযখের আগুনের একটি টুকরা এজন্য রাগান্বিত ব্যক্তির চেহারা লাল হয়ে যায়। এর কারণে মারামারি ঝগড়াঝাটি, গালাগালী, এমনকি খুনাখুনী পর্যন্ত সংঘটিত হয়।
এমনকি অনেকে বৃদ্ধি বয়সে এসে তুচ্ছ ঘটনায় বিবিকে তিন তালাক দিয়ে পস্তাতে থাকে। মহানবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন: ঐ ব্যক্তি বাহাদুর নয় যে যুদ্ধের ময়দানে দুশমনকে নীচে ফেলে দেয় বরং ঐ ব্যক্তি বাহাদুর যে রাগের মুহূর্তে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম। (বুখারী হাদীস নং ৬১১৪)
গোস্বার চিকিৎসা
দুইভাবে গোস্বার চিকিৎসা করা হয়। ১. ইলমী বা জ্ঞানগত পদ্ধতিতে ২. আমলী বা কার্যগত পদ্ধতিতে।
ইলমী চিকিৎসা হলঃ গোস্বার সময় চিন্তা করতে হবে গোস্বা কেন আসে? গোস্বা আসার কারণ তো এটাই যে, যে কাজটি আল্লাহর ইচ্ছায় হয়েছে সে কাজটি আমার মনের মোতাবেক কেন হয়নি? কেন এটা আল্লাহর ইচ্ছা অনুযায়ী হল? তার মানে আমি আল্লাহর ইচ্ছাকে আমার ইচ্ছার অনুগত বানাতে চাই? নাউযুবিল্লাহ! এভাবে চিন্তা করলে গোস্বার বদ অভ্যাস দূর হয়ে যাবে।
আর আমলী চিকিৎসা হলঃ
গোস্বা আসলে ১ (أعُوْذ ُبِاللهِ مِنَ الشيْطَانِ الرَّجِيْمِ) পড়বে, ২. নিজ অবস্থা পরিবর্তন করবে। অর্থাৎ, দাঁড়ানো থাকলে বসে পড়বে, বসে থাকলে শুয়ে পড়বে। ৩. যার প্রতি গোস্বার উদ্রেক হয় তার সামনে থেকে সরে পড়বে। ৪. তারপরও গোস্বা ঠান্ডা না হলে উযু করবে, নিজ গালকে মাটিতে লাগিয়ে দিবে। এভাবে আমল করলে গোস্বা দূর হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।
৪. হিংসা করা
হিংসার সংজ্ঞাঃ কোন ব্যক্তিকে আরাম আয়েশ বা প্রাচুর্যপূর্ণ অবস্থায় দেখে তার সে নেয়ামত দূরীভূত হয়ে নিজের জন্য হাসিল হওয়ার আকাংখা করা। হিংসা অত্যন্ত জঘন্য একটি ব্যাধি।
আল্লাহ তা‘আলা হাদীসে কুদসীতে বলেনঃ আমার বান্দার উপর নেয়ামত দেখে হিংসাকারী কেমন যেন আমার ঐ বন্টনের ব্যাপারে অসন্তুষ্ট যা আমি আমার বান্দাদের মধ্যে করেছি। নাউযুবিল্লাহ। (এহয়াউ উলুমুদ্দীন-৩/২৯২)
রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেনঃ “হিংসা নেকী সমূহকে এমনভাবে জ্বালিয়ে দেয় যেমন আগুন শুকনো লাকড়ীসমূহকে জ্বালিয়ে দেয়”। অবশ্য অন্যের কোন নেয়ামত দেখে সেটা তার মধ্যে বহাল থেকে নিজের জন্য হাসিল হওয়ার আকাংখা করা যাকে “গিবতা” বা “ঈর্ষা” বলে সেটা জায়েয। (আবূ দাউদ হাদীস নং-৪৯০৩)
৫. কৃপণতা ও সম্পদের মোহ
সম্পদের মোহই মূলতঃ কৃপণতার মূল আর সম্পদের মুহব্বাত মানুষকে দুনিয়ার দিকে আকৃষ্ট করে। যে কারণে আল্লাহ তা‘আলার প্রতি মুহব্বাত দুর্বল হয়ে যায়।
এ কারণেই কুরআনে কারীমে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেনঃ যার ভাবার্থ হল: আল্লাহর দেয়া সম্পদে কৃপণতাকারীদের জন্য পরকালে ভয়াবহ পরিস্থিতি হবে। (সূরা আলে ইমরান আয়াত ১৮০)
হাদীসে পাকে ইরশাদ হয়েছেঃ তোমরা লোভকে নিয়ন্ত্রণ কর কারণ এটা তোমাদের পূববর্তী লোকদেরকে ধ্বংস করেছে। (সহীহ মুসলিম হাদীস নং-২৫৭৮)
বাস্তবিক পক্ষে সম্পদের মোহ মানুষকে আল্লাহ পাক থেকে উদাসীন করে দেয়। এই সম্পদ মুসলমানদের জন্য ভয়াবহ এক ফেতনা।
অবশ্য শুধু সম্পদ কোন নিন্দনীয় ব্যাপার নয়। বিশেষতঃ যদি সে সম্পদ দীনী কাজে ব্যয় করা হয়। নতুবা জরুরত পরিমাণ সম্পদ থাকলে কোন অসুবিধা নেই, যাতে কারো নিকট ভিক্ষার হাত বাড়াতে না হয়। এবং আত্মসম্মান নিয়ে বেঁচে থাকা যায়।
৬. খ্যাতি ও পদের মোহ
খ্যাতি ও পদের মোহ অত্যন্ত নিকৃষ্ট একটি আত্মিক ব্যাধি। এর দ্বারা অন্তরে নিফাক সৃষ্টি হয়। এজন্য নিজেকে সব সময় লুকিয়ে রাখা চাই, খ্যাতির পিছনে পড়া অনুচিত। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ এই পরকাল আমি তাদের জন্যে নির্ধারিত করি, যারা দুনিয়ার বুকে ঔদ্ধত্য প্রকাশ করতে ও অনর্থ সৃষ্টি করতে চায় না। (সূরা কিসাস-৮৩)
হাদীসে পাকে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেনঃ “যদি কোন বকরীর পালের মধ্যে দুটি নেকড়ে প্রবেশ করে তাহলেও সেটা এত ক্ষতি করে না যতটা সম্পদ ও পদের মুহাব্বত দীনদার মুসলমানদের দীনের ক্ষতি করে।” (তিরমিযী হা: নং ২৩৮১, মুঃ আহমাদ হাঃ ১৫৭৯০)
অবশ্য যদি কামনা-বাসনা ছাড়াই আল্লাহ তা‘আলা কাউকে সুখ্যাতি দান করেন হবে সেটা দোষণীয় নয়। যেমন নবীগণ আ. সাহাবীগণ রাযি. তাবেয়ী ও তাবে তাবেয়ীগণ রহ. তাঁদের প্রত্যেকেরই দুনিয়াতে খ্যাতি ছিল কিন্তু তাঁরা কেউ দুনিয়াতে খ্যাতি কামনা করেননি।
৭. দুনিয়াপ্রীতি
দুনিয়াপ্রীতি শুধু সম্পদ ও পদের মুহব্বাতকেই বলেনা বরং ইহজীবনে যে কোন অবৈধ কামনাকে পূর্ণ করার প্রচেষ্টা ও খাহেশকেই দুনিয়াপ্রীতি বলে। অবশ্য দীনী ইলম, মারিফাতে ইলাহী এবং সৎকর্ম যেগুলোর ফলাফল মৃত্যুর পর পাওয়া যাবে, সেগুলো যদিও দুনিয়াতেই সংঘটিত হয় কিন্তু বাস্তবিকপক্ষে এসবের মুহব্বাতকে দুনিয়ার মুহব্বাত বলে না বরং এগুলো হলো আথেরাতের মুহব্বাত।
দুনিয়ার জীবনের নিন্দাবাদ করে মহান আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেছেন “দুনিয়ার জীবনের সবকিছুই ধোঁকার সামান।” (সূরা আল ইমরান, আয়াত- ১৮৫)
অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে যে, “দুনিয়ার সামানপত্র, রং তামাশা ও খেলাধুলা ছাড়া আর কিছুই নয়।” (সূরায়ে হাদীদ, আয়াত-২০)
রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেনঃ দুনিয়া হল একটি মরা জন্তু যারা এটাকে লক্ষবস্তু বানিয়েছে তারা হল কুকুরের দল। দুনিয়ার ভোগ বিলাসকে উদ্দেশ্য না করে দুনিয়াকে আখেরাতের প্রস্তুতির হিসেবে ব্যবহার করতে হবে। তাহলে কামিয়াব হওয়া যাবে।
৮. অহংকার করা
তাকাব্বুর বা অহংকার এর অর্থ হলঃ প্রশংসনীয় গুণাবলীর মধ্যে নিজেকে অন্যের তুলনায় শ্রেষ্ঠ মনে করা এবং অন্যকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা, হক ও সত্যকে অস্বীকার করা। বলা বাহুল্য যে, যখন মানুষ নিজের ব্যাপারে এরূপ ধারণা পোষণ করে এবং আল্লাহর দেয়া গুণসমূহকে নিজের কৃতিত্ব মনে করে তখন তার নফস ফুলে উঠে, অতঃপর কাজকর্মে এর প্রতিক্রিয়া প্রকাশ পেতে থাকে, উদাহরণস্বরূপ: রাস্তায় চলার সময় সাথীদের আগে আগে চলা, মজলিসে সদরের মাকামে বা সম্মানিত স্থানে বসা। অন্যদেরকে তাচ্ছিল্যের সাথে দেখা বা আচরণ করা অথবা কেউ আগে সালাম না দিলে তার উপর গোস্বা হওয়া, কেউ সম্মান না করলে তার উপর অসন্তুষ্ট হওয়া, কেউ সঠিক উপদেশ দিলেও নিজের মর্জির খেলাফ হওয়ায় সেটাকে অবজ্ঞা করা। হক কথা জানা সত্ত্বেও সেটাকে না মানা। সাধারণ মানুষকে এমন দৃষ্টিতে দেখা যেমন গাধাকে দেখা হয় ইত্যাদি।
পবিত্র কুরআন ও হাদীসের অনেক আয়াতে ‘অহংকার’ এর নিন্দাবাদ করা হয়েছে, অহংকারের কারণেই ইবলীস বেহেশত থেকে বিতাড়িত হয়েছে। অহংকারের কারণেই আবূ জাহাল মহানবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে সত্য জেনেও অস্বীকার করেছে।
৯. আত্মতুষ্টি
আত্মতুষ্টি বা নিজেকে নিজে সঠিক মনে করা মূলত: এটা অহংকারেরই ভূমিকা বা প্রাথমিক রূপ। পার্থক্য শুধু এতটুকু যে, অহংকারের ক্ষেত্রে অন্যদের তুলনায় নিজের নফসকে বড় মনে করা হয় আর আত্মতুষ্টির মধ্যে অন্যদের সাথে তুলনা করা ছাড়াই স্বীয় নফসকে নিজ খেয়ালে কামেল মনে করা হয়। এবং আল্লাহ প্রদত্ত নেয়ামতসমূহকে নিজের হক মনে করা হয়, অর্থাৎ, এটাকে আল্লাহর দান ও অনুগ্রহ মনে করা হয় না এবং সেটা যে কোন মুহূর্তে ছিনিয়ে নেয়া হতে পারে সে ব্যাপারে শংকাহীন হয়ে পড়া। এটাকেই তাসাওউফের পরিভাষায় “উজুব” বা “খোদপছন্দী” বলে। এটার চিকিৎসা করা না হলে এটাই কিছু দিন পরে অহংকারে পরিণত হয়ে বান্দাকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যায়।
১০. লোক দেখানো (রিয়া বা প্রদর্শনী)
রিয়া বলা হয় নিজ ইবাদত ও ভাল আমলের মাধ্যমে মানুষের অন্তরে বড়ত্ব ও মর্যাদার আকাংখা করা।
এটা ইবাদতের মূল উদ্দেশ্যের সম্পূর্ণ বিপরীত ব্যাপার। কেননা ইবাদতের দ্বারা মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা। এখন যেহেতু এই আমলের উদ্দেশ্যের মধ্যে অন্য শরীকও চলে এসেছে, বিধায় একে “শিরিকে আসগার” বা ছোট শিরক বলা হয়।
কুরআনে কারীমে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেনঃ মানুষকে শুধুমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যে ইবাদত করার হুকুম করা হয়েছে। (সূরায়ে বায়্যিনাহ আয়াত-৫)
হাদীসে পাকে ইরশাদ হয়েছেঃ “কিয়ামতের দিন সবপ্রথম যে তিন শ্রেণীর ব্যক্তিকে অধোমুখে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে তারা সবাই হবে রিয়াকার।” তারা সারা জীবন দীনের পথে থেকেও অন্তরের একটি রোগের কারণে সকলের পূর্বে জাহান্নামে যাবে। রিয়াকে “শিরকে খফী” বা গোপন শিরকও বলা হয়।
রিয়ার সূরতসমূহঃ
মোট ছয় ভাবে রিয়া হতে পারে। ১। শরীরের দ্বারা ২। অঙ্গভঙ্গির দ্বারা ৩। আকৃতি অবলম্বনের দ্বারা ৪। কথাবার্তার দ্বারা ৫। আমলের দ্বারা ৬। নিজ মুরীদ ও ভক্তের আধিক্য ও নিজের ইবাদত বন্দেগীর বর্ণনার দ্বারা।
মূল মাওলানা মুহাম্মাদ ওমর পালনপুরী রাহ. ভাষান্তর : আশিক বিল্লাহ তানভীর দ্বীন-ইসলামের হেফাযত ও মুসলিম মিল্লাতের সুরক্ষার জন্য কুরবানী ও আত্মত্যাগের বিকল্প নেই। যুগে যুগে বহু গুণীজন এ কুরবানীর নাযরানা পেশ করে গেছেন।
যারা কুরবানী করেছেন তাঁরা সফল হয়েছেন। এমনই একজনের ঘটনাঃ
আমেরিকার কোনো এক মহকুমার সেক্রেটারী ছিলেন এক নারী। ধর্মে খ্রিস্টান। হঠাৎ কী মনে করে তিনি বিভিন্ন ধর্মের বই-পুস্তক নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি শুরু করলেন।
একপর্যায়ে ইসলামকেই তার কাছে সত্য মনে হল। সত্য যখন উদ্ভাসিত হয়েছে- ব্যস, কালিমা পড়ে মুসলমান হয়ে গেলেন।
ইসলাম সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য ছুটে গেলেন মুসলমানদের কাছে। মুসলমানগণ যদ্দুর বলার বললেন। সাথে সাথে এ-ও বলে দিলেন যে, ইসলাম নারীকে পর্দার কথা বলে। সে রাতেই তিনি বোরকার ব্যবস্থা করলেন।
পরদিন সকালে অফিসে গেলেন পর্দা করে- বোরকা-আবৃত হয়ে। অফিসে প্রবেশ করতেই সবাই হকচকিয়ে গেল। কালো কাপড়ে ঢাকা এ আবার কে?
জিজ্ঞাসা করল, কে তুমি?
আমি অমুক; মুসলমান হয়েছি।
মুসলিম নারীগণ কালো কাপড়ে ঢাকা থাকে নাকি?! :
হ্যাঁ, বোরকা পরেই থাকা উচিত।
আমেরিকায় তো অনেক মুসলিম নারী রয়েছে। কই তারা তো খ্রিস্টান নারীদের মতই পর্দা ছাড়া থাকে! ইসলামে পর্দার বিধান থাকলে তারাও তো পর্দা করত।
কেউ যদি মুসলমান হয়েও তার নবীর কথা না মানে, তাহলে আমার কী করার আছে? আমি তো ব্যস, যে নবীকে মেনে নিয়েছি তাঁর কথা মতই চলব।
এ অবস্থায় তো আমরা তোমাকে অফিস করতে দিতে পারি না।
কুছ পরোয়া নেহি। রুজির ব্যবস্থা তোমরা কর না; আল্লাহই করেন। মানুষ যখন সঠিক পথে চলতে চায়, তখন আল্লাহ তাআলা তার সামনে রাস্তা খুলে দেন।
শরীয়ত মোতাবেক হালালের গণ্ডিতে থেকে কেউ যদি পথ চলতে শুরু করে, তাহলে আল্লাহ পাকের দরবারে আশা, অন্য সকল পথের যাত্রী অপেক্ষা সে শ্রেষ্ঠ বিবেচিত হবে।
আল্লাহ তাআলার ওয়াদা- هُوَ الّذِیْۤ اَرْسَلَ رَسُوْلَهٗ بِالْهُدٰی وَ دِیْنِ الْحَقِّ لِیُظْهِرَهٗ عَلَی الدِّیْنِ كُلِّهٖ وَ لَوْ كَرِهَ الْمُشْرِكُوْنَ. তিনি সেই সত্তা, যিনি স্বীয় রাসূলকে প্রেরণ করেছেন হেদায়েত ও সত্য ধর্ম দিয়ে, যাতে একে তিনি সকল ধর্মের উপর বিজয়ী করেন। যদিও মুশরিক সম্প্রদায় তা অপছন্দ করে। -সূরা ছফ (৬১) : ৯
তাই সহীহ তরিকা অবলম্বনকারী ব্যক্তি ভুল পথের অনুসারী অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ হয়েই থাকে।
যাইহোক, আমেরিকাপ্রবাসী জার্মান নাগরিক এ নারী উচ্চ সম্মানের পদ ও পদবী ছেড়ে ভিন্ন কর্ম গ্রহণ করলেন।
পেটের দায়ে এখন তিনি মানুষের ঘর-বাড়িতে আয়া-বুয়ার কাজ করতে লাগলেন। এতে যা জোটে তাতেই দিনগুজরান করতে থাকলেন।
আল্লাহর কী হুকুম! একদিন তিনি বাইতুল্লাহ যিয়ারতের উদ্দেশ্যে হজ্বের সফরে রওনা হয়ে গেলেন। সেখানে আমাদের পরিচিত ইংরেজী শিক্ষিত এক ভাই তার মেযবান হলেন।
তারা যথাসাধ্য তার একরাম করলেন। আদর-যত্নের সাথে মেহমানদারি করলেন। আল্লাহর ঘরের সামনে বসে তিনি খুব দুআ করতেন। জারজার হয়ে কাঁদতেন- হে আল্লাহ! আমি তোমার মেহমান! আমার কী যোগ্যতা অছে- তোমার ঘরের মেহমান হব? আর সামর্থ্য বলতে তো আমার কিছুই নেই। কেবল তুমিই দয়া ও অনুগ্রহ করে তোমার দরবারে এনেছো। ফলে খ্রিস্টানের ঘরে জন্ম নিয়েও আমি আজ বাইতুল্লাহর ছায়ায়। এ সবই তোমার করুণা হে আল্লাহ!
মদীনা মুনাওয়ারায় রওজায়ে আতহারে দাঁড়িয়ে দুরূদ ও সালাম পেশ করে কেঁদে কেঁদে বললেন- ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি আপনার এক নগণ্য উম্মত। উম্মতের জন্য আপনার দিলে যে দরদ ও ব্যথা ছিল আল্লাহ যেন আমাকেও তা দান করেন।
তারপর তিনি আমাদের এ ভারত উপমহাদেশে আগমন করেন। এখানকার মুসলিম সমাজের সাথে মেশেন ও ইসলামী কৃষ্টি-কালচার শেখেন।
এখান থেকেই কুরআন শেখা শুরু করেন। পরে পাকিস্তান গিয়ে নামায-তিলাওয়াত পুরোপুরি শিখে নেন। সেখানকার মুসলিমগণ তাকে বলেন- বোন, তুমি আমাদের এখানেই থেকে যাও। এখানে তোমার একটা বিবাহের বন্দোবস্ত করে দেই।
তিনি বললেন, এখানে তো কুরআন শেখানোর মত, দ্বীন শেখানোর মত অনেক বোনই রয়েছেন। কিন্তু আমেরিকায় আল্লাহর দ্বীনের যে কী এতিমী হালত! সেখানে কুরআন শেখানোর মত কাউকে পাওয়া বেজায় ভার। আর নারীদের মাঝে কুরআনের খেদমত! তা তো বহু দূরের কথা! এজন্য আমাকে আমেরিকায়ই যেতে হবে। সেখানে কুরআনের খেদমত করতে হবে। আমি চাই, সারাজীবন দ্বীনের খাদেম হয়ে থাকতে।
আল্লাহর কী শান! এদিকে আমেরিকান এক কৃষ্ণাঙ্গ যুবক ভারত পাকিস্তান সফর করলেন। সে আমাদের এখানে এতেকাফও করেছিল। দাওয়াতের কাজে প্রভাবিত হয়ে সে নিয়ত করে নিয়েছে যে, গোটা জীবন এ কাজ নিয়েই থাকবে।
দেশে গিয়ে সে সিদ্ধান্ত নিল, একমাত্র দ্বীনদার নারীকেই সে জীবনসঙ্গিনী হিসেবে গ্রহণ করবে। ওদিকে ঐ নারী পাক্কা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন, কোনো দ্বীনদার সঙ্গী পেলে তবেই সংসার পাতব।
বহুজন বহুভাবে তাকে বুঝাল- দেখ, আমেরিকার পরিবেশে দ্বীনদার পাত্র পাওয়া খুবই মুশকিল। সে সাফ সাফ জানিয়ে দিল, মুশকিল হোক বা আসান; দ্বীনদার পাত্র পেলে তবেই বিবাহ বসব। শুনে রাখ, আমার আল্লাহর খাজানায় কোনো কমতি নেই। মুসলমানদের থেকে আমি নামায পড়ে আল্লাহর কাছে চাইতে শিখেছি। তাই আল্লাহর কাছেই চেয়ে যাচ্ছি।
উভয়েই আপন আপন জায়গা থেকে দুআ জারি রাখল। আপনজন পরিচিতজনদের জানিয়ে দিল, আগে দ্বীনদারি দেখতে হবে, তারপর স্ট্যাটাস। দ্বীনদারি ব্যতীত শুধু দুনিয়াদারির কোনো মূল্য নেই।
উভয়ের বসবাস নিউইয়র্কে। মেয়ে জার্মানী বংশোদ্ভূত শ্বেতাঙ্গ পরিবারের সন্তান। আর ছেলে কৃষ্ণাঙ্গ পরিবারের।
উভয়কে যখন উভয়ের সংবাদ ও সন্ধান দেওয়া হল, ছেলের জন্য তো এটা ছিল আকাশের চাঁদ পাওয়া। কিন্তু মেয়ের জন্য এরকম একটা ছেলেকে মেনে নেওয়া বাহ্যত খুবই মুশকিল ছিল।
তবে বাস্তব কথা হল- মেয়ের প্রশ্ন ছিল একটিই। বল, ছেলে দ্বীনদার কি না?
যখন তিনি জানতে পারলেন, ছেলে দ্বীনদার। তাবলীগেও সময় লাগিয়েছে। রাজি হয়ে গেলেন। আশপাশ থেকে আওয়াজ উঠল, কীভাবে তুমি এমন একটি ছেলের কাছে নিজেকে সঁপে দিতে যাচ্ছো?
তার জবাব ছাফ- কালো হয়েছে তাতে কী? সে যদি দ্বীনের উপর চলে আল্লাহ তাআলা তো কিয়ামতের দিন উজ্জ্বল নূরানী চেহারা দান করবেন। দুনিয়ার এ কয়েকদিন তার চামড়া কালো থাকলে কী যায় আসে? কিয়ামতের দিন যখন আজীবনের জন্য তার চেহারা চকমক করবে, তখন! یَّوْمَ تَبْیَضُّ وُجُوْهٌ وَّ تَسْوَدُّ وُجُوْهٌ. যেদিন কিছু মুখ হবে আলো-ঝলমলে আর কিছু মুখ হবে মলিন-কালিমাযুক্ত। -সূরা আলে ইমরান (৩) : ১০৬
যাহোক, তাদের ‘আকদে মাসনূন’ সম্পন্ন হল। মহিলা তার মিশন নিয়ে রইল। স্থানীয় মেয়েদেরকে সে কুরআনুল কারীম শেখাতে থাকল।
একবার এ দম্পতি আমাদের এখানে আসে। আমরা তাদের জামাতকে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠাই। সেখানকার অবস্থা তো আর আপনাদের অজানা নয়- ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষক-শিক্ষিকা কী পরিমাণ আল্ট্রা মডার্ন-আপটু-ডেট।
তারা যখন জানতে পারল, আমেরিকা থেকে এক নারী এসেছে। তাও কি শ্বেতাঙ্গ ঘরানার! সে আলোচনা করবে। ব্যস, তারা ইউরোপিয়ান স্টাইলে সেজেগুজে সেখানকার একটি হলে জমা হল।
রঙে ভারতীয় হলেও ঢঙে যেন তার সাথে তাল মেলাতে পারে। যেমনটি অনেকেরই আগ্রহের বিষয় হয়ে থাকে যে, তারা ইংরেজ বনে থাকবে। কথা বলার ঢং থেকে শুরু করে সেকেল-সূরত সব কিছুকে তারা ইংরেজী আদলে করার ফিকিরে থাকে।
তো তারা এভাবে একটি হলে একত্র হল। আমাদের মুবাল্লিগীন বোনেরাও তার মেহমান ছিল। সবাই যখন এসে হাযির। পাশের কামরা থেকে বোরকা পরা এক নারী হলে প্রবেশ করলেন।
ঢুকেই গেট বন্ধ করে দিলেন- যাতে কোনো পুরুষ আসতে না পারে।
উপস্থিত সবার সামনে মুখ খুললেন। হ্যাঁ, আমেরিকার সেই খোলামেলা খ্রিস্টান নারীটিই এখন তাদের সামনে মুসলিম হয়ে পর্দা করে এসেছেন। আর মুসলিম ঘরের মেয়েরা তার সামনে ইউরোপিয়ান সেজে বসে আছে!
তারপর তিনি আলোচনা শুরু করলেন। দিলের দরদে পূর্ণ ছিল তার কথাগুলো। ঈমান-একীনের কথা বললেন। আল্লাহ তাআলার কুদরতের কথা বললেন। আরো বললেন, একদিন কিয়ামত হবে। তখন সবাই আবার জীবিত হবে। হিসাব-নিকাশ হবে। জান্নাতের সুসংবাদ ও জাহান্নামের শাস্তির কথাও শোনালেন।
সুন্দর করে ছয় নম্বরের বয়ান করলেন। এরপর যে কথাগুলো তিনি বললেন, তা কেবল তার মুখেই শোভা পায়। বড় হেকমতের সাথে তিনি তাদেরকে বোঝানো শুরু করলেন। গলার স্বর নরম থেকে ধীরে ধীরে গরম হতে লাগল। বললেন, তোমরা নিজেদেরকে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লামের উম্মত বলে দাবি কর। অথচ তোমাদের জীবনযাত্রা এরকম!
চিন্তা করে দেখ, নবীর উম্মত হয়ে তোমরা কোন পথে হাঁটছো!
তার কণ্ঠ আরো ঝাঁঝিয়ে ওঠল- জেনে রাখো, তোমরা যে জীবন গ্রহণ করেছ বা করতে আগ্রহী আমাদের জীবন আগে এটাই ছিল। সে জীবনকে আমরা ঘৃণাভরে ছুড়ে ফেলেছি। তোমাদের আজকের এ জীবন তো ঐ জীবন, যা আমরা ফেলে দিয়ে পবিত্র জীবনে ফিরে এসেছি।
হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শ গ্রহণ করে নতুন জীবন লাভ করেছি।
তার কলজেছেঁচা এ কথাগুলো এভাবেই তাদের কলিজায় গিয়ে বিঁধল। গলায় ঝোলানো দোপাট্টাগুলো ধীরে ধীরে মাথা ঢেকে নিতে লাগল।
এখন সবাই তওবার জন্য প্রস্তুত। সবাই তার নিকট ওয়াদা করল, এখন সবখানে নামাযের পরিবেশ কায়েম করবে। যিকির ও তিলাওয়াতের পরিবেশ সৃষ্টি করবে। আলোচনা শেষে তিনি ফিরে গেলেন নিজ দেশে। কিন্তু তাঁর দরদমাখা নসীহত হল আলীগড়ের নারী শিক্ষার্থীদের নিত্যসঙ্গী- জীবনের পাথেয়।
এখন আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের কারগুজারী শুনুন। সেখানে হলগুলোর রুম থেকে এখন তিলাওয়াতের সুমধুর গুঞ্জন ভেসে আসছে। যিকিরের পরিবেশ দেখা যাচ্ছে। তো আমি যা বলতে চাচ্ছি, আমাদের মা-বোনদের দ্বীনের জন্য কুরবানী করার জযবা থাকতে হবে। দ্বীনের উপর চলার যেহনিয়ত পয়দা করতে হবে। যেহেন তৈয়ার হয় তাদেরকে সুন্দরভাবে বোঝানোর মাধ্যমে।
এজন্য ঘরে ঘরে তালীমের হালকা করুন। পুরুষগণ যারা পড়তে পারেন ঘরের সবাইকে নিয়ে তালীম করবেন। ঘরে নারী-শিশুরা মনোযোগ দিয়ে শুনবে। কখনও পুরুষগণ অধিক ব্যস্ততার দরুণ তালীম করতে না পারলে ঘরের বয়োজ্যেষ্ঠ নারী সবাইকে নিয়ে তালীম করবেন। নামাযের আমলী মশক করবেন।
আদনান ফয়সাল এই লেখায় আমি নামাজে মনোযোগ বৃদ্ধির কিছু টিপস শেয়ার করব যেগুলোর মাধ্যমে আমি আমার নামাজে মনোযোগ বাড়াতে সক্ষম হয়েছি । এই টিপসগুলো আমাকে একজন বেনামাজী থেকে কিছুটা হলেও মনোযোগী নামাজী হতে সাহায্য করেছে।
১। নামাজের গুরুত্ব জানুন: মহান আল্লাহ আল–কোরআনে একটিমাত্র ইবাদতকে ঈমান এর সমার্থকরূপে ব্যবহার করেছেন, আর তা হলো নামাজ। ঘটনাটি ছিল এরকম – প্রিয়নবী মুহাম্মদ(সা) এর নবুয়তীর প্রথম দিকে সাহাবারা বায়তুল মুকাদ্দাসের দিকে ফিরে নামাজ পড়তেন। হিজরতের পরে আল্লাহ কিবলা পরিবর্তন করে যখনকা’বা শরীফের দিকে করে দিলেন তখন অনেক সাহাবা প্রশ্ন করতে লাগলেন যে তাদের আগের নামাজগুলির কি হবে? সেগুলির জন্য কি সওয়াব পাওয়া যাবে না? উত্তরে আল্লাহ নিচের আয়াত নাজিল করেন:
“আর আল্লাহ এরূপ নন যে তিনি তোমাদের ঈমানকে ব্যর্থ করবেন”। (সূরা বাকারাহ:১৪৩ এর অংশবিশেষ)
উপরের আয়াতে আল্লাহ নামাজকে ঈমানের সমার্থক হিসাবে ব্যবহার করেছেন। এই আয়াত দ্বারা এটা প্রমাণিত হয় যে, নামাজ না পড়লে ঈমান থাকে না। এছাড়া রাসূলুল্লাহ(সা) তিরমিযী, আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ এর একাধিক হাদিসে বলেছেন, যে নামাজ না পড়ল সে কুফরী করল। ইমাম আহমাদ ইবনে হানবাল,শাইখ মুহাম্মাদ আল উসাইমিন সহ বহু আলেম মনে করেন, যে ব্যক্তি নিয়মিত ৫ ওয়াক্ত আদায় না করে সে কাফের এবং পরকালে চিরস্থায়ী জাহান্নামী হবে।
” ‘কিসে তোমাদের জাহান্নামে নিক্ষেপ করেছে‘? তারা বলবে, ‘আমরা নামাজীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলাম না‘ ” (সূরা মুদ্দাসসির:৪২–৪৩)
২। কোয়ান্টিটি নয়, কোয়ালিটিতে মনোযোগী হোন: তাড়াহুড়া করে পড়া নামাজ আল্লাহ কবুল করেন না। কাজেই, ফরজ–সুন্নাত–নফল সব নামাজকে টার্গেট না করে আগে শুধু ফরজ নামাজটাকে ধীরে ধীরে খুশু‘ (বিনয় ও নম্রতা) এর সাথে আদায় করুন।
“কাজেই দুর্ভোগ সেই নামাজীদের যারা তাদের নামাজের ব্যাপারে অমনোযোগী”। (সূরা মা‘উন:৪–৫)
সারাদিন মাত্র ১৭ রাকআত নামাজ আদায় করা ফরজ, এই নামাজগুলো আগে ধীরতার সাথে পড়া আয়ত্ব করুন। সুন্নাত সহ ১০ রাকআত যোহর নামাজ যে সময়ে পড়েন সেই সময়ে ধীরে ধীরে ৪ রাকআত ফরজ নামাজটুকু পড়ুন। যখন ফরজ নামাজে ধীরতা আয়ত্ব করে ফেলবেন তারপর সুন্নাত নামাজগুলো যদি আবার চালু করেন তাহলে অবচেতনভাবে সেগুলোও আপনি ধীর ভাবেই পড়বেন।
“পৃথিবীর উপরে যা কিছু আছে তার সবকিছু আমি এর জন্য শোভা করেছি মানুষকে পরীক্ষার জন্য যে তাদের মধ্যে কে কর্মে উত্তম”। (সূরা কাহফ:৭)
লক্ষ্য করুন, এখানে আল্লাহ বলেননি তিনি পরীক্ষা করবেন কে সবচেয়ে বেশী আমল করে, বরং তিনি বলেছেন কে সবচেয়ে উত্তম আমল করে। কাজেই, আমাদের উচিত হবে নামাজসহ সকল ইবাদতের কোয়ান্টিটি নয়, কোয়ালিটির দিকে গুরুত্ব দেয়া।
“অবশ্যই বিশ্বাসীগণ সফল হয়েছে, যারা নিজেদের নামাজে বিনয়–নম্র” (সূরা মু‘মিনুন:১–২)
৩। সিজদায় নিজের ভাষায় দু‘আ করুন:আমরা অনেকেই জানি না, রুকুতে সিজদায় আরবীর ট্র্যাডিশনাল দু‘আ গুলোর বাইরে নিজের ভাষায় দু‘আ করা যায়। আমার এখনো মনে আছি, এই বিধানটা যেদিন জেনেছিলাম সেদিন থেকেই আমার নামাজ কেমন বদলে গিয়েছিল। আগে নামাজ পড়তাম এই ভেবে যে কখন নামাজ শেষ হবে আর মুনাজাতে যেয়ে আল্লাহর কাছে কিছু চাইব, আর এখন জানতে পারলাম নামাজের মধ্যেই আল্লাহর কাছে চাওয়া যায় – দারুন ব্যাপার তো! সিজদায় নিজের ভাষায় দু‘আ করলে অনুভব করতে পারি আল্লাহর সাথে যেন কথা সরাসরি বলছি – নামাজের অনুভূতিটা ঠিক যেরকম হওয়া উচিত।
রাসূলুল্লাহ(সা) বলেছেন: তোমরা তোমাদের রবের সবচেয়ে কাছে আসো যখন সিজদায় থাকো। কাজেই তোমরা সিজদারত অবস্থায় বেশী করে দু‘আ কর। [মুসলিম ও আহমাদ]
৪। কোরআনীয় আরবী শিখুন: পয়েন্টটা পড়ে মনে হতে পারে, ওরে বাবা! আরবী শিখব? এত অনেক কঠিন কাজ। আসলে ব্যাপারটা মোটেই তা নয়, কেন? কারণ, এটা আল্লাহর ওয়াদা।
অবশ্যই আমি কোরআনকে বুঝার ও মুখস্থ করার জন্য সহজ করে দিয়েছি। (সূরা ক্বমর:১৭ আয়াতাংশ)
আল্লাহর এই ওয়াদা কতটুকু সত্য – আসুন তলিয়ে দেখা যাক । কোরআনীয় আরবী আর স্পোকেন আরবী এক জিনিস নয়। কোরআনে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা একই শব্দ বহুবার রিপিট করেছেন, ফলে খুব অল্প কিছু শব্দ আর বেসিক গ্রামার শিখে নিলেই আমরা নামাজে নিয়মিতভাবে সে সূরা ও দু‘আ গুলো পড়ি সেগুলোর অর্থ বোঝা সম্ভব হবে। আরো স্পেসিফিকভাবে বলতে গেলে, মাত্র ১২৫টি হাই–ফ্রিকোয়েন্সী আরবী শব্দ যদি আপনি শিখে নেন তাহলে ৬০০ পৃষ্ঠার এই বইয়ের ৫০% শব্দই আপনি বুঝতে পারবেন!পৃথিবীর ইতিহাসে শেখার জন্য এর চেয়ে সহজ বই বোধ করি আর দুইটা নাই।
নামাজে ব্যবহৃত সূরা ও দু‘আগুলির অর্থ যখন আপনি জানবেন এবং বুঝে বুঝে নামাজ পড়বেন, তখন আপনার নামাজ সম্পূর্ণরূপে বদলে যেতে বাধ্য। স্কলারেরা বলেন, নামাজ হলো আল্লাহর সাথে বান্দার কথোপকথন। নামাজে যখন আমরা কোরআন তেলাওয়াত করি তখন আল্লাহ আমাদের সাথে কথা বলেন,আর যখন আমরা দু‘আ করি তখন আমরা আল্লাহর সাথে কথা বলি। আপনি যখন নামাজের সূরাগুলি, দু‘আ গুলি অর্থ বুঝে পড়বেন, তখনই কেবল অনুধাবন করতে পারবেন দিনে ৫ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা একটি কন্টিনিউয়াল লাইফ ইম্প্রুভমেন্ট প্রোগ্রাম।
৫। নতুন সূরা ও দু‘আ মুখস্থ করুন: আমরা যখন আমাদের গৎবাঁধা একই সূরা আর দু‘আ দিয়ে নামাজ পড়তে থাকি তখন নামাজ একটা রোবাটিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়, চিন্তা করার আগেই আমাদের ঠোঁটের আগায় একেকটা আয়াত চলে আসে, ফলে আমাদের মনোযোগ নামাজ থেকে অন্যত্র চলে যায়। প্রতি মাসে ১/২টা নতূন সূরা, কিছু নতুন আয়াত বা দু‘আ শিখুন, তারপর সেগুলো নামাজে ব্যবহার করুন। নতুন আয়াতগুলো যেহেতু আপনাকে সচেতনভাবে মনে করে করে পড়তে হবে, কাজেই আপনি বাধ্য হবেন নামাজে মনোযোগী হতে।
উদাহরণস্বরুপ বলা যায় – রুকু‘ থেকে উঠার পর আমরা সবাই জানি যে বলতে হয় “রাব্বানা লাকাল হামদ”। কিন্তু এর সাথে অতিরিক্ত আরেকটি দু‘আ আছে যেটি হলো – “হামদান কাসিরান তাইয়িবান মুবারাকান ফি”। ছোটবেলায় আমরা যখন নামাজ শিখেছি তখন আমাদের হুজুর এটা শিখাননি, কারণ তিনি বেশীরভাগ ক্ষেত্রে যেটুকু না পড়লেই নয় সেটুকু শিখিয়েছিলেন। আমরা আমাদের জ্ঞানের এই সীমাবদ্ধতাকে পজিটিভ দৃষ্টিতে দেখে নতুন নতুন সূরা ও দু‘আ মুখস্থ করে যদি নামাজে ব্যবহার করি তাহলে আল্লাহ চাইলে নামাজে আমাদের মনোযোগ বাড়বে।
৬। তাজউইদ শিখুন: দুই বন্ধুর মধ্যে কথা হচ্ছে। দুজনেই কোরআন আরবীতে পড়তে পারে, কিন্তু একজন তাজউইদ (উচ্চারণের বিধি–বিধান) ভালমত জানে, আরেকজন জানে না।
১ম বন্ধু: এই তুই কোরআন পড়তে পারিস?
২য় বন্ধু: হ্যাঁ, পারি।
১ম বন্ধু: আচ্ছা এটা পড়ে দেখাতো, ঠিক করে উচ্চারণ করবি। বাংলা শব্দের মত করে পড়বি না, আরবীর মত করে উচ্চারণ করবি।
২য় বন্ধু: কোন্ শব্দটা পড়তে হবে – এইটা? ফাজলামী করিস আমার সাথে? আমাদের প্রভুর নাম আরবীতে পড়তে পারে না এরকম কোন মুসলিম আছে নাকি? এটা হলো “আল্ লা হু”।
১ম বন্ধু: হয়নি। আরবীতে لَএর উচ্চারণ সবখানে হাল্কা “লা” হয়, শুধু এই শব্দটাতেই এটা ভারী ও লম্বা “লঅ” হয়, ইংরেজী Law শব্দটার মত। কাজেই, এর সঠিক উচ্চারণ হবে “আল্ লঅ হু”।
২য় বন্ধু: তাই নাকি! জানতাম না তো!
১ম বন্ধু: আচ্ছা এই বাক্যটা এবার পড়ে শুনা।
২য় বন্ধু: দোস্ত এটা তো সবাই পারে, কোরআনের সূরা তাওবা বাদে প্রত্যেকটা সূরাই এই বাক্য দিয়ে শুরু হয়। এর উচ্চারণ হলো, দাঁড়া একটু চিন্তা করে নেই। ও আচ্ছা, لَ কে ভারী করে পড়তে হবে – এই তো?কাজেই এটাকে পড়তে হবে “বিসমিল্ লআ হির রাহমাআ নির্ রাহিইম”
১ম বন্ধু: এটাও হয়নি রে। এখানে لَ হাল্কা হবে অর্থাৎ “লঅ” না হয়ে “লা” হবে। আর رَএর উচ্চারণ সবসময়ই “র” হয় (ইংরেজী Raw এর মত), এর উচ্চারণ কখনো “রা” হয় না। এছাড়া حَকেও ভারী করে পড়তে হবে। কাজেই বাক্যটার উচ্চারণ হলো “বিসমিল্ লাআ হি‘র্ রহ‘ মাআনির্ রহি‘ইম”
…
উপরের ঘটনার পর তাজউইদ শেখার গুরুত্ব নিয়ে নিশ্চয় আর কিছু বলার দরকার নেই। আপনি যখন সঠিক উচ্চারণ চিন্তা করে করে নামাজে কোরআন তেলাওয়াত করবেন তখন এমনিতেই আপনার মনোযোগ নামাজে চলে আসবে। তাজউইদ শেখার জন্য Understand Quran Academy এর পেইড কোর্স Read Quranকরতে পারেন, আর ফ্রি কোর্স চাইলে শেইখ ইয়াসির কাদির “The Noble Emissaries” (ইউটিউবে পাবেন) কোর্সটি করতে পারেন।
৭। শাইখ হুসসারি এর তেলাওয়াত শুনুন: লক্ষ্য করুন আমি বলিনি যে কোন ক্বারীর কোরআন তেলাওয়াত শুনতে, আমি নির্দিষ্ট একজনের নাম বলেছি। কেন? কারণ, শাইখ খলিল আল–হুসসারি (Khalil Al-Hussary) এর তেলাওয়াত একটা খুব বিশেষ কিছু। তিনি প্রতিটা হরফ, প্রতিটা হরকত অত্যন্ত ধীরে ধীরে, স্পষ্টভাবে তাঁর দরাজ কন্ঠে তেলাওয়াত করে যান। তাঁর তেলাওয়াত শুনলে মনে হয় কোরআনের প্রত্যেকটা অক্ষরের প্রতি তাঁর সে কি মায়া, প্রত্যেকের উপরে তিনি কন্ঠ দিয়ে যেন পরশ বুলিয়ে যাচ্ছেন,প্রত্যেক অক্ষরকে তিনি প্রাপ্য এটেনশন দিবেন, এতটুকু কৃপণতা বা বাহুল্য করবেন না।
নামাজে যে সূরাগুলি আপনি পড়েন সেগুলি শাইখ হুসসারি এর কন্ঠে ডাউনলোড নিন (গুগল করলেই mp3পাবেন), মোবাইলে বা গাড়ির সিডিতে কপি করে নিয়ে বার বার শুনুন। এর ফলে আপনি যখন নামাজে ঐ সূরা পড়তে যাবেন তখন নিজের অজান্তেই শাইখ হুসসারি এর ধীর–গতির আবৃত্তি আপনার কানে বাজতে থাকবে। ফলে, আপনার মনে তাড়াহুড়া করে নামাজ পড়ার কু–ইচ্ছা থাকলেও শাইখ হুসসারি এর দরাজ কন্ঠ আপনাকে তা করতে দেবে না। আমরা অনেকেই বেঁচে থেকেও মরে আছি, আর শাইখ হুসসারি কবরে শুয়ে শুয়েও আমাদের শিখিয়ে যাচ্ছেন কিভাবে কোরআনকে মর্যাদা দিতে হয়!
খ্রিস্টিয় সপ্তম শতাব্দীর শুরুর দিকে আরবে একটি ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক শক্তির উত্থান ঘটেছিলো। নবী মুহাম্মাদ ﷺ এর মাধ্যমে প্রেরিত জীবনধারা (ইসলাম) খুব অল্প সময়ের মধ্যে সমগ্র আরবের জীবনযাপনের একমাত্র পথনির্দেশনায় পরিণত হয়েছিল। এতই দ্রুত এটি ঘটেছিল এবং এতই মনোমুগ্ধকর ইসলামের শিক্ষা যে, বিশ্বাসীদের জীবনের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রে, প্রতিটি ব্যাপারে এটি সুপ্রতিষ্ঠিত হতে সময় লেগেছিলো মাত্র কয়েক বছর। কী খাওয়া উচিত আর কী খাওয়া উচিত নয়, রাতে কিভাবে ঘুমানো উচিত, বাথরুমে যাওয়া-আসার নিয়ম থেকে শুরু করে রাজনৈতিক এবং সরকারী নিয়মাবলীর সবকিছু এতগুলো মানুষের মধ্যে এত অল্প সময়ে এভাবে আমূলে পরিবর্তিত হয়ে যাওয়া এর আগে কোনো গণজাগরণের ইতিহাসে নেই।
কীভাবে সেটি তখন সম্ভব হয়েছিল তা এখনো পর্যন্ত ইতিহাসবিদদের কাছে একটি রহস্য! অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি যে, ইসলামের প্রথম চার খলিফার শাসনামলের পূর্ণতা পেতে পেতে ইসলামিক রাষ্ট্রের পরিধি আরব থেকে পশ্চিমের লিবিয়া, আর সেখান থেকে চলে গিয়েছিলো পূর্ব প্রান্তের পারস্যে। আর এর মাত্র একশ’ বছরের মধ্যেই ইসলামিক সাম্রাজ্য স্পেন এবং ভারত পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে গিয়েছিল!
আগেই বলেছি, বিশ্ব ইতিহাসে কখনো অন্য কোনো জাগরণ ইসলামের প্রথম একশ’ বছরের মতো এতটা দ্রুত প্রসারিত হয়নি। আর এটা কেবলই মুসলিমদের দাবী নয়, বরং সর্বজনস্বীকৃত সত্য। আমরা মুসলিম হিসাবে অবশ্যই বিশ্বাস করি যে, আল্লাহর হুকুমেই ইসলাম এরকম অকল্পনীয় সাফল্য অর্জন করতে পেরেছিল।
কিন্তু, সেক্যুলার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে: কী এমন বিশেষত্ব ছিল ইসলামের যার ফলে এই অভূতপূর্ব অর্জন সম্ভব হয়েছিল? কোন্ সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিস্থিতি এই সাফল্যকে ত্বরান্বিত করেছিল? কোনো কোনো ইতিহাসবিদ এক বাক্যে এর কারণ ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা করেন, আর অবশ্যই সেটি ইসলামের প্রতি তাদের লালিত আক্রোশকে চরিতার্থ করার জন্যই। তারা বলতে চান যে, ইসলাম-পূর্ব আরবে যুদ্ধ-বিগ্রহ এবং জাতীয়তার অহংকার খুব প্রবল ছিল, আর সেটিকে পুঁজি করেই ইসলামের নাম দিয়ে যুদ্ধ এবং বল প্রয়োগের মাধ্যমে আরব দেশগুলোকে দখল করে নিয়েছিল মুসলিমেরা।
বলাই বাহুল্য, এহেন দাবী কোনো বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাসবিদের মুখে মানায় না, কারণ জটিল এবং দীর্ঘ একটি ইতিহাসের সবকিছু অগ্রাহ্য করে একটি এক বাক্যের স্লোগান কখনোই ইতিহাসভিত্তিক সত্য বলে গৃহীত হতে পারে না। সত্যি কথা বলতে কি, ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়: তৎকালীন আরব ভূখন্ড ও তাদের আশেপাশের এলাকাগুলোকে যেন নিঁখুতভাবে প্রস্তুত করা হয়েছিল এক-স্রষ্টায় বিশ্বাসী কোনো ঐক্যবদ্ধকারী মতাদর্শকে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য। সপ্তম শতাব্দীর শুরুর দিকে মধ্যপ্রাচ্যের সংস্কৃতি, ভাষা, জলবায়ু এবং রাজনীতি সবই যেন ইসলামের আগমনের অপেক্ষা করছিল! ( ইসলাম পূর্ব আরবের অবস্থা )
ইসলাম-পূর্ব আরবের রাজনৈতিক পরিস্থিতি:
আবহাওয়া এবং জলবায়ু বিচারে আরবের ভৌগোলিক পরিবেশ এবং বাসভূমি সেখানে বসবাসকারীদের জন্য ভয়ংকর প্রতিকূল হয়ে উঠতে পারে। তার কারণ এখানে কোনো স্থিতিশীল নদী, জলপ্রবাহ কিংবা হ্রদ নেই। জীবনধারণের প্রধান উত্সই ছিলো অপ্রতুলভাবে আরবের এখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ছোট ছোট সবুজ এলাকা যাতে একটি বা দুটি পানির উত্স (ফোয়ারা কিংবা কুয়া) থাকে। মরুভূমির মধ্যে দিয়ে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ভ্রমণ করা বেশ কঠিন একটি কাজ। এমনকি, আজকের দিনেও আরবের মরুভূমির কিছু কিছু বিস্তৃত জায়গা সম্পূর্ণ জনমানবহীন, কারণ এসব জায়গায় পানির কোনো উত্সই নেই। আর পানির নিয়মিত যোগান ছাড়া কোনো স্থানে জনবসতি গড়ে ওঠা প্রায় অসম্ভব।
আরব মরুভূমির এই জনমানবহীন বিশাল এলাকাগুলো আরবদের এবং আরবের বাইরে বসবাসকারীদের মধ্যে একই সাথে একটি বাধা এবং একটি সংযোগকারী হিসেবে কাজ করতো। বস্তুতই, এই এলাকাগুলোকে একসাথে বলা হতো ‘জাজিরাত আল-আরব’ কিংবা ‘আরবদের দ্বীপ’। এই নামটি দিয়েছিলো ইসলাম-পূর্ব আরবের অধিবাসীরা। দ্বীপ বলে এদের আখ্যায়িত করার কারণ অন্যান্য সব এলাকা থেকে এই এলাকাগুলো কার্যত সম্পূর্ণই বিচ্ছিন্ন ছিলো।
এই এলাকা এতই বেশী বসবাসের অনুপযোগী এবং বন্য ছিলো যে, শুধুমাত্র বিশেষভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও অত্যন্ত সহনশীল আরবদের পক্ষেই এই এলাকায় বেঁচে থাকা সম্ভব ছিলো। আর আরবে প্রবেশের আগেই এহেন দুর্যোগপূর্ণ বিশাল এলাকার পরিবেষ্টন আরবকে বহির্বিশ্বের আক্রমনের হাত থেকে বেশ নিরাপদ রেখেছিলো। যদিও ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পারি যে, দু’দুটি বড় সম্রাজ্য আরব আক্রমনের চেষ্টা করেছিলো।
ইসলামের আগমনের পূর্বে বিশ্বের কোনো শক্তিশালী সাম্রাজ্যই আরবের উপর কতৃত্ব করতে পারেনি। তত্কালীন সময়ে রোমানরাই তখনো পর্যন্ত প্রাচীন বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী সম্রাজ্য ছিলো। রোমানদের কর্তৃত্ব ভূমধ্যসাগর (Mediterranean Sea) পর্যন্ত বিস্তৃত ছিলো। আর তাই কেউ যদি আরব জয় করতে পারতো, সেটা হতো রোমানরাই। এমনকি তারা আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে সেই চেষ্টা করেছিলোও – খৃষ্টপূর্ব ২৪ সালে ওদের আরব আক্রমণ সেটাই আমাদের দেখায়।
তাদের সাম্রাজ্য বিস্তারের এই চেষ্টা শেষ পর্যন্ত একটি প্রকাণ্ড ব্যর্থতা হিসেবে থেকে গিয়েছিলো তাদের সামরিক এবং রাষ্ট্রীয় ইতিহাসে। বিশ্বখ্যাত রোমান সৈন্যবাহিনী খুব ভালোভাবেই কাজ করেছিলো Mediterranean জলবায়ুতে। কিন্তু, আরবের বিরূপ আবহাওয়ার ধকল সামলে যুদ্ধে জেতার মতো ক্ষমতা কিংবা যুদ্ধশৈলী তাদের ছিলো না মোটেই। আর তাই আরবের উত্তর মরুভূমির উত্তর প্রান্তের সীমানা পেরিয়ে রোমানরা কখনোই তাদের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি।
ইসলাম পূর্ব আরবের গোত্র
ইসলাম-পূর্ব বিশ্বের অন্য পরাশক্তিটি ছিল পারস্য সাম্রাজ্য। আরবের উত্তর এবং পূর্ব পাশে অবস্থিত এই সাম্রাজ্যটিও চেষ্টা করেছিলো এই অঞ্চলের উপর তাদের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে, যার ফলশ্রুতিতে তারা রোমানদের সঙ্গে একটি নিরবিচ্ছিন্ন সংঘাতেও জড়িয়ে পড়েছিলো। রোমান এবং পারস্য বাহিনীর মধ্যকার এই নাছোড়বান্দা রেষারেষি আর একে অন্যকে আক্রমনের চেষ্টার মধ্যে পড়ে দুই বাহিনীর রণক্ষেত্রের ঢাল হতে বাধ্য হয়েছিল ইরাক ও সিরিয়ার ভূখণ্ড। যেহেতু এই দুই বাহিনী একে অন্যের আক্রমণ প্রতিহত করতেই ব্যস্ত ছিলো, এদের কেউই শেষ পর্যন্ত আরবের ভূখণ্ডের দখল নিতে পারেনি।
আরবের উত্তর পাশের এই দুই প্রতিবেশী প্রায় সারাক্ষণই যুদ্ধে লিপ্ত থাকতো, আর সেই সুযোগে আরব ছিলো সম্পূর্ণ স্বাধীন। আর এভাবে বিচ্ছিন্নভাবে থাকার কারণে আরববাসীদের কখনোই বহির্বিশ্বের রাজনৈতিক ব্যাপারস্যাপারগুলো নিয়ে মাথা ঘামাতে হয়নি। তারা কোনো ধরনের প্রভুত্বের দাস না হয়েই তাদের জীবনযাপন করতে পারতো, আর ফলশ্রুতিতে নিজেদের মধ্যেই রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান তৈরী করে নিয়েছিল।
এভাবে যে রাজনীতির প্রবাহ তাদের সমাজে এবং গোত্রগুলোর মধ্যে তৈরী হয়েছিল সেটি বলতে গেলে ছিলো সম্পূর্ণ বিকেন্দ্রীত। তার মানে, আরবের রাজনীতিতে কারো একচ্ছত্র প্রভাব বা কর্তৃত্ব ছিলো না। সেখানে মানুষ ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক স্বাধীনতা খুব ভালোভাবে উপভোগ করতো। গোত্রীয় সংঘবদ্ধতা ছিলো সে অঞ্চলের সবচেয়ে শক্তিশালী রাজনৈতিক বল। আরবের সেসকল গোত্রের মানুষজন খুব সহজ একটি জীবনধারা তৈরী করে নিয়েছিল, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো মরুভূমিতে যাযাবরদের মতন ঘুরে বেড়ানো, বিভিন্ন স্থানে কেনাবেচার হাট আয়োজন করা, দ্রব্য বিনিময় কিংবা ক্রয় বিক্রয় করা, আর হালকা চাষাবাদ ইত্যাদি।
ইসলাম-পূর্ব আরবের ভাষা, ধর্ম ও সংস্কৃতি:
তৎকালীন আরব সংস্কৃতি তাদের ভৌগোলিক অবস্থার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল। রুক্ষ মরু পরিবেশ আরবদের বুঝিয়ে দিয়েছিলো যে, এই ভূমি একাকী জীবনযাপনের জন্য নিতান্ত অনুপযোগী। আত্মীয়দের উপর নির্ভরশীলতাই ছিল তাদের জীবনের প্রতি হুমকিস্বরূপ বিরূপ প্রকৃতি আর চরম উত্তাপের বিরুদ্ধে প্রাথমিক রক্ষাকবচ। আর সেকারণে পরিবার ও গোত্রই হয়ে উঠেছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান। তদুপরি, মরুভূমির এই রুক্ষতার প্রতিক্রিয়াস্বরূপ আরববাসীদের মধ্যে অতিথিপরায়নতা বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি ভূমিকা রাখতো।
এটা রীতিমতো তাদের নীতিবোধের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছিল। যেকোনো ভ্রমণকারী অতিথিরাই আরবের যেকোনো গোত্রের কাছে আশ্রয় এবং নিরাপত্তা চাইলে কোনো রকম প্রশ্ন ছাড়াই তা দেয়া হতো। শত্রুর হাত থেকে পালিয়ে বেড়ানো অতিথিদের জন্যও সেটি সমানভাবে প্রযোজ্য ছিল। নিজ পরিবারের সর্বোচ্চ সুরক্ষা নিশ্চিত করা এবং নিরাপত্তা প্রদান করার ব্যাপারটি সপ্তম শতাব্দীর শুরুর দিকের আরবদের মধ্যে হয়ে উঠেছিল একটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নিয়ম। এব্যাপারে তাদের মধ্যে কখনো দ্বিমত ছিল না এবং তারা কখনোই এর কোনো ধরনের ব্যতিক্রম ঘটাতে রাজি ছিল না।
ধর্ম পালনের ক্ষেত্রে আরবদের মধ্যে বহু দেবতার (একের অধিক প্রভুর) উপাসনা কিংবা পুজো করা ভয়াবহভাবে সংক্রমিত হয়ে গিয়েছিলো। নবী ইব্রাহীম এবং তাঁর পুত্র ইসমাইল (তাঁদের উপর শান্তি বর্ষিত হোক) প্রায় ১৮০০ খ্রিস্টপূর্ব সালে কাবা নির্মাণ করেছিলেন এবং তত্কালীন সময়ের আরবদেরকে এক প্রভুর উপাসনার ধর্মের সাথে তাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু আরবরা প্রভুর একত্ববাদের সেই শিক্ষা বিকৃত করে ফেলেছিল এবং সৃষ্টিকর্তার সাথে সাথে আরও অনেক ছোট ছোট দেবতা কিংবা প্রভুর পুজো করা শুরু করেছিলো।
এইসব দেবতাদের মূর্তি তৈরী করে তারা পুজো করত, যার ফলশ্রুতিতে খোদ কাবার ভেতরেই ৩৬০টির বেশী মূর্তি তারা সবসময় সাজিয়ে রাখতো। যেই কাবা নবী ইব্রাহীম (তাঁর উপর শান্তি বর্ষিত হোক) এক প্রভুর উপাসনা করার জন্য তৈরী করেছিলেন, সেটাই দুর্ভাগ্যজনকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছিল এক প্রভুর সাথে অন্যসব মানব-নির্মিত এবং কল্পনাপ্রসূত দেবতাদের উপাসনা করার মতো ঘৃণিত কাজে।
কাবা নিয়ে তাদের ব্যবসা এবং ধর্মীয় অনুভূতি যাই হোক না কেন, আরবদের প্রধান সাংস্কৃতিক রত্ন ছিল তাদের ভাষা। মরুভূমিতে শৈল্পিক নৈপুন্যের ক্ষেত্র খুব একটা ছিল না, থাকার কথাও নয়। রোমান এবং গ্রীকদের মতো মূর্তি নির্মানের কিংবা চিত্রাংকনের শিল্প মরুভূমিতে বসবাসকারী আরবদের জন্য মোটেই বাস্তবসম্মত ছিল না। আর তাই সেটি সীমাবদ্ধ ছিল কেবলমাত্র পুজোর মূর্তি তৈরীর কাজে।
এধরনের শিল্পের অনুপস্থিতিতে কাব্যশিল্প তার সমস্ত ডালপালা মেলে বিকশিত হয়েছিল আরবদের মধ্যে। আরবী ভাষার গঠন খুবই তাল ও ছন্দময়, যে কারণে এটি কাব্য রচনার জন্য ছিল অতীব চমত্কার একটি ভাষা। আরবে প্রতিবছর সবচেয়ে ভালো সব কবিদের একটি মিলনমেলা হতো, যেখানে এসে ভালো কাব্য উপহার দিতে পারলে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই সে পুরো আরবের মধ্যে রীতিমতো তারকাখ্যাতি পেয়ে যেত এবং তাদের কাব্যিক শিল্পগুনের জন্য সবাই তাদেরকে চিনতো।
ইসলামের জাগরণের সাথে এটি কীভাবে সম্পর্কিত?
যখন কুরাইশ গোত্রের অন্তর্ভুক্ত একজন সম্মানিত এবং ‘বিশ্বাসী’-খ্যাতিপ্রাপ্ত ব্যক্তি মক্কায় ৬১০ সালে এক-প্রভুর উপাসনার ধর্ম প্রচার শুরু করলেন তখন কেউই ধারনা পর্যন্ত করতে পারেননি কীভাবে এই ধর্মের কথা সবখানে ছড়িয়ে দেবার ক্ষেত্রে তত্কালীন আরবের ভৌগোলিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতি সহায়ক ভূমিকা রাখবে। যদিও এই ধর্মের বাণীর অতুলনীয় বৈশিষ্ট্য এবং যে পরিস্থিতিতে এটি মানুষের মাঝে প্রেরণ করা হয়েছিল সেটি পর্যালোচনা করে আজ প্রতিটি বিশ্বাসীই (মুসলিম) এ ব্যাপারে নিশ্চিত যে, পুরো ব্যাপারটিই স্বয়ং প্রভুর পরিকল্পিত ছিলো, যেটি তার পরবর্তী ১০০ বছরের মধ্যেই ইসলামকে বিশ্বের প্রধান ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত করেছিলো।
রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে ইসলাম বাইরের বিশ্বের কাছে পৌছানোর আগেই নিজেদের মধ্যে বেড়ে ওঠার এবং একটি শক্ত ভিত তৈরী করার যথেষ্ট সময় পেয়েছিল। এর মূল কারণ ছিলো তত্কালীন বহির্বিশ্বের দুই মূল শক্তি পারস্য এবং রোম সৈন্যবাহিনী বারবার একে অন্যের আক্রমণ প্রতিহত করে দিচ্ছিল, আর সেইসাথে আরবের মরুভূমির দুর্যোগ অতিক্রম করে আসাও তাদের জন্য বিশাল ক্ষতির কারণ হয়ে থাকতো সবসময়। মক্কা যদি নবী মুহাম্মাদ ﷺ এর জীবদ্দশায়ই রোমান কিংবা পারস্যের দখলে চলে আসতো, তাহলে তাঁর ﷺ পক্ষে ইসলামের বাণী প্রচার করা আরো অনেক বেশীগুনে কঠিন হয়ে যেত। সপ্তম শতাব্দীতে রোমানরা ছিলো গোঁড়া খ্রিস্টান এবং তারা অন্য কোনো ধর্মীয় বিশ্বাসের ব্যাপারে একেবারেই সহনশীল ছিলো না।
অন্যদিকে, আরবের নিজেদের মধ্যে গোত্রীয় রাজনীতি মুহাম্মাদকে ﷺ একটি কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক শক্তির মোকাবিলা করার হাত থেকে রক্ষা করেছিলো। আরবের রাজনীতিতে কোনো কেন্দ্রীয় শক্তি ছিলো না, বরং সব গোত্রই ছিলো স্বাধীন। যদিও কুরাইশরা শুরুর বছরগুলোতে ইসলামের প্রচার বন্ধ করতে চেয়েছিল, তারা ছিলো অনেক গোত্রের মধ্যে একটি মাত্র। আর তাই নবী মুহাম্মাদকে ﷺ শুধুমাত্র মদীনায় চলে আসতে হয়েছিল যেখানে আরবে প্রচলিত অতিথিপরায়নতার নীতি তাঁকে ﷺ এবং তাঁর অনুসারীদেরকে রক্ষা করেছিলো, আর একইসাথে কুরাইশ গোত্রের রাজনৈতিক প্রভাব থেকে অনেক দূরে থাকতে সাহায্য করেছিলো।
তদুপরি, আউস ও খাযরাজ গোত্রদ্বয় যুগের পর যুগ ধরে যে যুদ্ধ করে আসছিল তা মদীনার তরুন প্রজন্মকে অতিষ্ঠ করে তুলেছিল, তারা এর থেকে মুক্তি চাচ্ছিল। তদুপরি, ইহুদীদের সাথে সহাবস্থানের কারণে তারা জানত অচিরেই মুহাম্মাদ ﷺ এর মতো একজন মানুষ নবী হিসাবে আবির্ভূত হবেন। কাজেই, মুহাম্মদ ﷺ কে নেতা হিসাবে বরণ করে নেয়া তাদের সকল সমস্যার একটা চমৎকার সমাধান ছিল। অতএব, একথা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, তত্কালীন আরবের গোত্রসমূহের ভৌগোলিক ও রাজনৈতিকভাবে পৃথক এবং স্বাধীন থাকার ক্ষমতা এবং পরিস্থিতি নবীর ﷺ প্রতি প্রেরিত যুগান্তকারী বাণীর নির্বিঘ্ন প্রচারে পুরোপুরিভাবে সহায়ক ছিলো।
তদুপরি, নবীর ﷺ মৃত্যুর পর যখন মুসলিমরা উত্তরদিকে তাদের রাজ্যসীমানা বাড়িয়ে চলেছিল, তখন রোমান এবং পারস্য – এই দুটি পরাক্রমশালী রাজ্যই বছরের পর বছর নিজেদের মধ্যে এবং অন্যান্য শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধবিগ্রহে জড়িত থাকার কারণে অনেকটাই নড়বড়ে হয়ে পড়েছিল। তাদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক দুর্বলতা মুসলিম বাহিনীর বিজয়কে সম্ভব করে তুলেছিল এবং তাদের স্থাপিত সাম্রাজ্যের দখল নেবার মাধ্যমে মুসলিম বিশ্ব দ্রুত মধ্যপ্রাচ্য ছাড়িয়ে আরো বিস্তৃত হয়েছিলো।
তত্কালীন আরব সমাজ সাংস্কৃতিকভাবেও ইসলামের প্রচার ও প্রসারের জন্য মোক্ষম ছিল। সপ্তম শতাব্দীর শুরুতে মক্কার সবচেয়ে শক্তিশালী বন্ধন ছিলো পারিবারিক বন্ধন। আর তাই মুহাম্মাদ ﷺ যখন ইসলাম প্রচারের মাধ্যমে মক্কার বহুদেবতার পূজারীদের বিরাগভজন হয়ে পড়েছিলেন, তখন তিনি ﷺ তাঁর পরিবারের উপরই নির্ভর করেছিলেন তাঁর ﷺ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে। আর এই কাজে সবচেয়ে বেশী সাহায্য তিনি ﷺ পেয়েছিলেন তাঁর ﷺ চাচা আবু তালিবের কাছ থেকে। ইসলামের বাণী কখনোই বিশ্বাস না করেও আবু তালিব শুধুমাত্র তাঁর পারিবারিক ভালোবাসা এবং কর্তব্য থেকে তাঁর ভাতিজা মুহাম্মাদকে ﷺ নিরাপত্তা দিতে বদ্ধপরিকর ছিলেন। যদি পরিবারের সকল সদস্যের সুরক্ষা প্রদানের এই সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক রীতি আরবে না থাকতো, তাহলে হয়তো মুহাম্মাদকে ﷺ কুরাইশ গোত্রের রাজনৈতিক নেতারা অনেক আগেই তাঁর ﷺ নবী জীবনের শুরুতেই নিস্তব্ধ করে দিতে পারতো।
আগেই আমরা আলোচনা করেছি যে, ইসলামের আগমনের পূর্বে আরবরা সবাই বহুদেবতার পূজারী ছিলো, তারপরেও তারা নবী ইব্রাহীমের (তাঁর উপর শান্তি বর্ষিত হোক) প্রভুর একত্ববাদের বাণী কিছুটা হলেও বুঝতে পারতো। ফলশ্রুতিতে, যখন আরবরা নবী মুহাম্মাদের ﷺ ইসলাম প্রচার এবং কুরআনের বাণী শুনতে শুরু করলো, তাদের জন্য এটি ছিলো ইব্রাহিমের ﷺ কাছ থেকে শিখে আসা বাণীরই একটি পুনরাবৃত্তি। কিন্তু মুসলিম হবার যে পূর্বশর্ত ছিলো এক আল্লাহ’র সার্বভৌমত্বে বিশ্বাস করা এবং মুহাম্মাদকে ﷺ তাঁর প্রেরিত সর্বশেষ নবী ও বার্তাবাহক হিসেবে স্বীকার করা, সেটি আরবদের জন্য বহুদেবতার উপাসনা পুরোপুরিভাবে বন্ধ করা বাধ্যতামূলক করে দিয়েছিলো। বাস্তবতার দিকে তাকালে আমরা দেখি, তাদের বেশীরভাগের জন্যই এটা খুব একটা কঠিন কাজ ছিলো না, বরং এটি তাদের বিশ্বাসকে পরিশুদ্ধ করে তাদের মনে প্রকৃত শান্তি এনে দিয়েছিলো।
সেইসাথে, আরবের এই বহুদেবতার পুজো করার রীতি (Paganism) মুহাম্মাদের ﷺ কাছে প্রেরিত বাণীর একটি অলৌকিক বৈশিষ্ট প্রকাশ করে। আব্রাহামিক ধর্মগুলো থেকে অনেক অনেক দূরে, পুরোপুরিই পৃথক একটি মরুভূমিতে জন্ম নেয়া মুহাম্মাদের ﷺ কাছে প্রেরিত কুরআনে যেভাবে পূর্বের নবীদের কাহিনী নির্ভুলভাবে বর্ণিত হয়েছে সেটি স্বয়ং প্রভুর কাছ থেকে না আসলে মুহাম্মাদের ﷺ নিজের পক্ষে কখনোই এরকম একটি ধর্মগ্রন্থ রচনা করা সম্ভব ছিলো না। কারণ, মুহাম্মাদের ﷺ জন্য আদম, মুসা, ইউসুফ আর ঈসা-র জীবনের সব কাহিনী জানা তো দূরে থাক, তাদের নাম জানাই অনেক কঠিন ছিলো। অথচ, এই মূর্তিপূজারী আরবদের মাঝেই এমন একজন নবী আসলেন যার কাছে আগের সব নবীদের ব্যাপারে নির্ভুল জ্ঞান ছিলো, আর তিনি ছিলেন প্রভুর প্রেরিত সর্বশেষ নবী। তাই অনেকের জন্যই, বিশেষ করে হেজাজ-এর ইহুদীদের জন্য কুরআনের এই বাণীগুলো অলৌকিক ছিলো কারণ তারা জানত কোনোভাবেই মুহাম্মাদের ﷺ পক্ষে তাদের তাওরাত পড়া সম্ভব ছিলো না কারণ তিনি পড়তে জানতেন না, আর তারাও নিজেদের গোত্রের বাইরে কারো সাথে তাওরাতের বাণী নিয়ে কথা বলতে অনিচ্ছুক ছিলো।
সবশেষে, কুরআনের বাণীর কাব্যিক ছন্দময় রচনাশৈলী তত্কালীন আরবের কাব্যিক সমাজ এবং সংস্কৃতির জন্য ছিলো পুরোপুরি উপযুক্ত। যে সমাজে কবিদের সম্মান অন্য যেকোনো কিছুর চাইতে বেশী ছিলো, যে সমাজে কবিরা সবসময়ে নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগীতা করতেন কে কার চেয়ে ভাল কবিতা রচনা করতে পারবেন, ঠিক সেখানেই কুরআনের বাণীর রচনাশৈলী এই কবিদের যেকোনো সময়ের রচিত যেকোনো কবিতার রচনাশৈলী থেকে অনেক বেশী উচ্চমানের ছিলো। কুরআন যদি এধরনের একটি কাব্যমুখরিত সমাজ ব্যবস্থার কাছে প্রেরিত না হতো, তাহলে কুরআনের বাণীকে মানুষ প্রভুর বাণী বলে বিশ্বাস করার মতো অলৌকিক কিছু হিসেবে গ্রহণ করতো না। আর তাই আরবদের জন্য তাদের মনে কুরআনের ব্যাপারে কোনো ধরনের সন্দেহ ছিলো না, যার ফলশ্রুতিতে তারা তাদের সবটুকু দিয়ে এই বাণী চারদিকে ছড়িয়ে দিয়েছিলো আর মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেছিল এই বাণী তাদের সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকেই এসেছে।
উপসংহার:
ইসলামের আগমন এবং বিকাশের জন্য ভৌগোলিকভাবে তত্কালীন বিশ্বের বড় দুই পরাশক্তির কাছ থেকে পৃথক থাকা, নবী মুহাম্মাদের ﷺ বৈচিত্রপূর্ণ জীবনের জন্য সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে তৈরী থাকা এবং কাব্যিক রচনাশৈলীতে প্রেরিত কুরআনের জন্য ভাষাগত দিক থেকে প্রস্তুত থাকা — সেই আরবের চেয়ে উপযুক্ত আর কোনো স্থান পৃথিবীর ইতিহাসে অন্য কোথাও কখনোই ছিলো না। মুসলিমদের জন্য এটা বুঝতে একটুও কষ্ট করতে হয় না যে, এত চমত্কার এবং উপযুক্ত একটি সময় এবং স্থানে ইসলামের আগমন কোনোভাবেই সাধারণ একটি ঘটনা হতে পারে না, বরং এটি স্বয়ং স্রষ্টার নিখুত পরিকল্পনারই একটি অংশ ছিলো। যদিও অমুসলিম ইতিহাসবিদরা সেটা মানতে নারাজ, কিন্তু তাদের প্রথাগত ইতিহাস বিশ্লেষণের উপাদান ব্যবহার করে ইসলামের এত অল্প সময়ের মধ্যে পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে পড়াটি তাদের জন্য একটি রহস্যই হয়ে আছে।
গ্রন্থপঞ্জী:
১. Hodgson, M. G. S. The Venture of Islam, Conscience and History in a World Civilization. 1. Chicago, IL: University of Chicago Press, 1974.
২. Hourani, Albert Habib. A History Of The Arab Peoples. New York: Mjf Books, 1997. Print.
৩. Kennedy, Hugh. The Great Arab Conquests: How the Spread of Islam Changed the World We Live In. Philadelphia: Da Capo Press, 2007. Print.
৪. Saunders, JJ. A History of Medieval Islam. London: Rout ledge, 1965. Print.
কুরআনের ১০০টি উপদেশ বাণী….. পড়ার পরে অবশ্যই শেয়ার করবেন…….!
১। তোমরা সত্যকে মিথ্যার সাথে মিশিয়ে দিও না। [সূরা বাকারা ২:৪২]
২। সৎকার্য নিজে সম্পাদন করার পর অন্যদের করতে বলো। [সূরা বাকারা ২:৪৪]
৩। পৃথিবীতে বিবাদ-বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করো না। [সূরা বাকারা ২:৬০]
৪। কারো মসজিদ যাওয়ার পথে বাধা সৃষ্টি করো না। [সূরা বাকারা ২:১১৪]
৫। কারো অন্ধানুসরণ করো না। [সূরা বাকারা ২:১৭০]
৬। প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করো না। [সূরা বাকারা ২:১৭৭]
৭। ঘুসে লিপ্ত হয়ো না। [সূরা বাকারা ২:১৮৮]
৮। যারা তোমাদের সঙ্গে লড়াই করবে, শুধু তাদের সঙ্গে তোমরা লড়াই করো। [সূরা বাকারা ২:১৯০]
৯। লড়াইয়ের বিধি মেনে চলো। [সূরা বাকারা ২:১৯১]
১০। অনার্থদের রক্ষণাবেক্ষণ করো। [সূরা বাকারা ২:২২০]
১১। স্রাব কালে সঙ্গম করো না। [সূরা বাকারা ২:২২২]
১২। শিশুকে পূর্ণ দুই বছর দুগ্ধপান করাও। [সূরা বাকারা ২:২৩৩]
১৩। সৎগুণ দেখে শাসক নির্বাচন করো। [সূরা বাকারা ২:২৪৭]
১৪। দ্বিনের ব্যাপারে কোনো জবরদস্তি নেই। [সূরা বাকারা ২:২৫৬]
১৫। প্রতিদান কামনা করে দাতব্য বিনষ্ট করো না। [সূরা বাকারা ২:২৬৪]
১৬। প্রয়োজনে তাদের সহযোগিতা করো। [সূরা বাকারা ২:২৭৩]
১৭। সুদ ভক্ষণ করো না। [সূরা বাকারা ২:২৭৫]
১৮। যদি ঋণীঅভাবগ্রস্তহয তবে তাকে স্বচ্ছলতা আসা পর্যন্ত সময় দাও। [সূরা বাকারা ২:২৮০]
১৯। ঋণের বিষয় লিখে রাখো। [সূরা বাকারা ২:২৮২]
২০। আমানত রক্ষা করো। [সূরা বাকারা ২:২৮৩]
২১। গোপন তত্ত্ব অনুসন্ধান করো না এবং পরনিন্দা করো না। [সূরা বাকারা ২:২৮৩]
২২। সকল নবীর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করো। [সূরা বাকারা ২:২৮৫]
২৩। সাধ্যের বাইরে কারো উপর বোঝা চাপিয়ে দিও না। [সূরা বাকারা ২:২৮৬]
২৪। তোমরা পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ো না। [সূরা আল-ইমরান ৩:১০৩]
২৫। ক্রোধ সংবরণ করো। [সূরা আল-ইমরান ৩:১৩৪]
২৬। রূঢ় ভাষা ব্যবহার করো না। [সূরা আল-ইমরান ৩:১৫৯]
২৭। এই বিশ্বের বিস্ময় ও সৃষ্টি নিয়ে গভীর চিন্তাভাবনা করো। [সূরা আল-ইমরান ৩:১৯১]
২৮। পুরুষ ও নারী উভয়ই তাদের কৃতকর্মের সমান প্রতিদান পাবে। [সূরা আল-ইমরান ৩:১৯৫]
২৯। মৃতের সম্পদ তার পরিবারের সদস্যসের মাঝে বন্টন করতে হবে। [সূরা নিসা ৪:৭]
৩০। উত্তরাধিকারের অধিকার নারীদেরও আছে। [সূরা নিসা ৪:৭]
৩১। অনার্থদের সম্পদ আত্মসাৎ করো না। [সূরা নিসা ৪১০]
৩২। যাদের সাথে রক্তের সম্পর্ক তাদের বিবাহ করো না। [সূরা নিসা ৪:২৩]
৩৩। অন্যায়ভাবে কারো সম্পদ ভক্ষণ করো না। [সূরা নিসা ৪:২৯]
৩৪। পরিবারের উপর কর্তৃত্ব চালাবে পুরুষ। [সূরা নিসা ৪:৩৪]
৩৫। অন্যদের সাথে সদাচারী হও। [সূরা নিসা ৪:৩৬]
৩৬। কার্পণ্য করো না। [সূরা নিসা ৪:৩৭]
৩৭। বিদ্বেষী হয়ো না। [সূরা নিসা ৪:৫৪]
৩৮। মানুষের সাথে ন্যায়বিচার করো। [সূরা নিসা ৪:৫৮]
৩৯। একে অপরকে হত্যা করো না। [সূরা নিসা ৪:৯২]
৪০। বিশ্বাসঘাতকদের পক্ষ নিয়ে বিতর্ক করো না। [সূরা নিসা ৪:১০৫]
৪১। ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত থেকো। [সূরা নিসা ৪:১৩৫]
৪২। সৎকার্যে পরস্পরকে সহযোগিতা করো। [সূরা মায়িদা ৫:২]
৪৩। সীমালঙ্ঘনের ব্যাপারে একে অন্যের সহায়তা করো না। [সূরা মায়িদা ৫:২]
৪৪। মৃত পশু, রক্ত ও শূয়োরের মাংসা নিষিদ্ধ। [সূরা মায়িদা ৫:৩]
৪৫। সৎপরায়ণ হও। [সূরা মায়িদা ৫:৮]
৪৬। অপরাধীকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাও। [সূরা মায়িদা ৫:৩৮]
৪৭। পাপ ও অবৈধ জিনিসের বিরুদ্ধে শ্রম ব্যয় করো। [সূরা মায়িদা ৫:৬৩]
৪৮। মাদক দ্রব্য ও আলকোহল বর্জন করো। [সূরা মায়িদা ৫:৯০]
৪৯। জুয়া খেলো না। [সূরা মায়িদা ৫:৯০]
৫০। ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের উপাস্যদের গালমন্দ করো না। [সূরা মায়িদা ৫:১০৮]
৫১। আধিক্য সত্যের মানদণ্ড নয়। [সূরা আন’আম ৬:১১৬]
৫২। মানুষকে প্রতারণা করেরে ওজনে কম দিও না। [সূরা আন’আম ৬:১৫২]
৫৩। অহংকার করো না। [সূরা আ’রাফ ৭:১৩]
৫৪। পানাহার করো, কিন্তু অপচয় করো না। [সূরা আ’রাফ ৭:৩১]
৫৫। সালাতে উত্তম পোশাক পরিধান করো। [সূরা আ’রাফ ৭:৩১]
৫৬। অন্যদের ত্রুটিবিচ্যুতি ক্ষমা করো। [সূরা আ’রাফ ৭:১৯৯]
৫৭। যুদ্ধে পশ্চাদ্মুখী হয়ো না। [সূরা আনফাল ৮:১৫]
৫৮। যারা নিরাপত্তা কামনা করছে তাদের সহযোগিতা করো ও নিরাপত্তা দাও। [সূরা তওবা ৯:৬]
৫৯। পবিত্র থেকো। [সূরা তওবা ৯:১০৮]
৬০। আল্লাহ্ তাআলার অনুগ্রহ হতে নিরাশ হয়ো না। [সূরা ইউসুফ ১২:৮৭]
৬১। যারা অজ্ঞতাবশত ভুলত্রুটি করে আল্লাহ্ তাআলা তাদেরকে ক্ষমা করবেন। [সূরা নাহ্ল ১৬:১১৯]
৬২। প্রজ্ঞা ও উত্তম নির্দেশনা দ্বারা আল্লাহ্ তাআলার প্রতি আহ্বাব করা উচিত। [সূরা নাহ্ল ১৬:১১৯]
৬৩। কেউ কারো পাপের বোঝা বহন করবে না। [সূরা ইসরা ১৭:১৫]
৬৪। পিতামাতার সাথে সদ্ব্যবহার করো। [সূরা ইসরা ১৭:২৩]
৬৫। পিতামাতাকে অশ্রদ্ধা করে কোনো কথা বলো না। [সূরা ইসরা ১৭:২৩]
৬৬। অর্থ অপচয় করো না। [সূরা ইসরা ১৭:২৯]
৬৭। দারিদ্রের আশঙ্কায় সন্তানসন্ততিকে হত্যা করো না। [সূরা ইসরা ১৭:৩১]
৬৮। অবৈধ যৌনাচারে লিপ্ত হয়ো না। [সূরা ইসরা ১৭:৩২]
৬৯। যে বিষয়ে জ্ঞান নেই তার অনুবর্তী হয়ো না। [সূরা ইসরা ১৭:৩৬]
৭০। শান্তভাবে কথা বলো। [সূরা ত্বা-হা ২০:৪৪]
সম্প্রতি বেশ কিছু ভাই মেসেজে জানালেন কুরবানীর জন্য কাকে নেওয়া হয়েছিল—ইসমাঈল(আ) নাকি ইসহাক(আ) এটা নিয়ে নাকি কনফিউশনের সৃষ্টি করা হচ্ছে।এ নিয়ে নাকি নাস্তিক-মুক্তমনারা জল ঘোলা করছে।তারা নাকি বাইবেল ও কুরআন উভয় গ্রন্থ থেকে প্রমাণ করেছে ইসহাক(আ) ছিলেন কুরবানীর জন্য নির্বাচিত সন্তান! খ্রিষ্টান মিশনারীরা তাদের ধর্ম প্রচার করার জন্য অনেক আগে থেকেই এ নিয়ে প্রচার চালিয়ে আসছিল।এখন তাদের দলে নাস্তিকরাও যোগ দিয়েছে। এ যেন চোরে চোরে মাসতুতো ভাই! যা হোক, এ বিষয়টা নিয়ে এই লেখা।
ইসলামী আকিদা হচ্ছে—নবী ইব্রাহিম(আ) এর বড় ছেলে ইসমাঈল(আ)কে কুরবানীর জন্য নির্বাচিত করা হয়েছিল অর্থাৎ ইসমাঈল(আ) হচ্ছেন ‘জবিহুল্লাহ’।কুরআন দ্বারা এটি প্রমাণিত এবং এ ব্যাপারে মুসলিম উম্মাহর ইজমা রয়েছে।অপরদিকে বাইবেল বলে যে, ইব্রাহিম(আ) এর অন্য ছেলে ইসহাক(আ)কে কুরবানীর জন্য নির্বাচিত করা হয়েছিল।
বাইবেলের Old Testament(পুরাতন নিয়ম) অংশটি ইহুদি ও খ্রিষ্টান উভয় ধর্মালম্বীদের ধর্মগ্রন্থ।কাজেই এ নিয়ে মুসলিমদের বিশ্বাস এক এবং ইহুদি-খ্রিষ্টানদের বিশ্বাস আরেক।নাস্তিকরা মূলত ইসলামের বিরোধিতা করে এবং অনেক সময়েই অটোমেটিক চয়েস হিসাবে ইহুদি-খ্রিষ্টানদের অবস্থানকে ডিফেন্ড করে। আমরা এখন কুরআন-হাদিস এবং বাইবেল সকল প্রকারের উৎস থেকেই ইব্রাহিম(আ) এর কুরবানীর ঘটনাটি নিরপেক্ষভাবে আলোচনা করব এবং দেখব আসলে কে কুরবানির জন্য নির্বাচিত হয়েছিলেন—ইসমাঈল(আ) নাকি ইসহাক(আ)।
কুরআনে সুস্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে যে ইব্রাহিম(আ) এর বড় ছেলে অর্থাৎ ইসমাঈল(আ)কে কুরবানী দেবার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।দেখুনঃ সুরা আস সফফাত ৩৭:৯৯-১১২ {এখান থেকে আয়াতগুলো দেখুনঃ এখানে}। এখানে পুরো কুরবানীর ঘটনা বর্ণণা করার পরে ১১২নং আয়াতে ইসহাক(আ) এর জন্মের কথা বলা হয়েছে।অর্থাৎ ঐ ঘটনার সময়ে ইসহাক(আ) এর জন্মই হয়নি।আরো দেখুন, সুরা হুদ ১১:৬৯-৭১ {{এখান থেকে আয়াতগুলো দেখুনঃ এখানে }।
এখানে স্পষ্টত বলা হচ্ছে ফেরেশতারা একই সাথে ইব্রাহিম(আ)কে ইসহাক(আ) ও ইয়া’কুব(আ) এর সুসংবাদ দেন।ইসহাক(আ) যদি জবিহুল্লাহ হয়ে থাকেন,তাহলে ইয়া’কুব(আ) এর সংবাদ কিভাবে দেওয়া হবে? তিনি তো কুরবানীই হয়ে যাবেন! তাহলে তো ইব্রাহিম(আ)কে কোন পরীক্ষা করা হল না।পরীক্ষার ফল আগে থেকেই জানা,ইসহাক(আ) বেঁচে যাবেন ও তাঁর ছেলে ইয়া’কুব(আ) নবী হবেন! কুরআন থেকে এভাবে মুসলিম উম্মাহ নিঃসন্দেহে বিশ্বাস করে ইসমাঈল(আ) হচ্ছেন জবিহুল্লাহ।
খ্রিষ্টান-মিশনারী কিংবা নাস্তিকরা এই বলে জল ঘোলা করে যেঃ কুরআনে কেন সরাসরি নাম বলা হয়নি? আমরা ইতিমধ্যেই দেখেছি যে সরাসরি নাম না বললেও কুরআনে এটা স্পষ্ট যে ইসমাঈল(আ)ই জবিহুল্লাহ।কুরআনে কুরবানীর পুরো ঘটনা উল্লেখ করে(সুরা আস সফফাত ৩৭:৯৯-১১২) জবিহুল্লাহর নাম উহ্য রাখা হয়েছে।ঘটনা বর্ণণা শেষ করার পরে ইসহাক(আ) এর বৃত্তান্ত শুরু করা হয়েছে।
এরপর মুসা(আ) ও হারুন(আ) এর বৃত্তান্ত।এ দ্বারা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে কুরবানীর উদ্যেশ্যে ইসহাক(আ)কে নেওয়া হয়নি বরং বড় ছেলে অর্থাৎ ইসমাঈল(আ)কে নেওয়া হয়েছিল।মুসলিম,ইহুদি ও খ্রিষ্টানরা একমত যে ইসমাঈল(আ) বড় ছেলে।কুরআন অনেক সময়েই মহিমান্বিত ব্যক্তির নাম উহ্য রেখে বিশেষণ দিয়ে ঐ ব্যক্তিকে প্রকাশ করা হয়েছে।এটা কুরআনের একটি বর্ণণাভঙ্গি।ইসমাঈল(আ) ছাড়াও ইউনুস(আ) এর নাম উহ্য রেখে এক স্থানে তাঁকে ‘যান নুন'(মাছওয়ালা) বলে উল্লেখ করা হয়েছে[দেখুনঃ সুরা আম্বিয়া ২১:৮৭;]।
এবার আমরা ইহুদি-খ্রিষ্টানদের গ্রন্থ থেকে ঘটনাটি বিশ্লেষণ করব।
ইহুদি-খ্রিষ্টানদের গ্রন্থ [ইহুদিদের তানাখ, খ্রিষ্টানদের বাইবেলের পুরাতন নিয়ম(Old Testament) অংশের ‘আদিপুস্তক’(Genesis)] ইব্রাহিম(আ) কর্তৃক তাঁর বড় ছেলে ইসমাঈল(আ)কে পারানের(আরবদেশ) মরুভূমিতে রেখে আসার ঘটনাটি বর্ণণা করেছে।
সহীহ বুখারীতেও [৩১২৫ নং হাদিস] ঘটনাটি আছে {হাদিসটি দেখুন এখান থেকেঃ https://goo.gl/xrvAeV }।
হাদিস এবং আদিপুস্তক(Genesis) এ ব্যাপারে একমত যে—ইসমাঈল(আ)কে যখন পারানের(আরব দেশ) মরুভূমিতে রেখে আসা হয়, তখন তিনি ছিলেন ছোট শিশু।
ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের ধর্মগ্রন্থে ঘটনাটি যেভাবে আছে—-
[ঈশ্বর বললেন] “আমি দাসীর ছেলেটিকেও এক মহা জাতিতে পরিণত করব কারণ সে তোমার বংশধর।” পরদিন সকালে আব্রাহাম[ইব্রাহিম(আ)] কিছু খাবার এবং চামড়ার থলেতে পানি নিলেন এবং হাগারকে(বিবি হাজিরা) দিলেন।তিনি সেগুলোকে তার কোলে তুলে দিলেন এবং ছেলেটির সাথে তাকে পাঠিয়ে দিলেন।তিনি[হাগার/বিবি হাজিরা] চলে গেলেন এবং বেরশেবার মরুভূমিতে ঘুরতে লাগলেন।চামড়ার থলের পানি যখন শেষ হয়ে গেল, তিনি বাচ্চাটিকে ঝোঁপের নিচে রাখলেন।তিনি উঠে গেলেন এবং কাছেই তীর ছোড়ার দূরত্বে গিয়ে বসে পড়লেন।
কারণ তিনি ভাবছিলেন, “আমি বাচ্চাটার মরণ দেখতে পারব না।” তিনি কাছে বসে ছিলেন এবং বাচ্চাটি কাঁদতে শুরু করল।
ঈশ্বর বাচ্চাটির কান্না শুনলেন।ঈশ্বরের স্বর্গদূত স্বর্গ থেকে হাগারকে আহ্বান করলেন, “কী হয়েছে হাগার? ভয় পেয়ো না।ঈশ্বর বাচ্চাটির কান্না শুনতে পেয়েছেন কারণ ও এই স্থানে শুয়ে আছে।
বাচ্চাটিকে তোল এবং কোলে নাও, কারণ আমি তাকে এক মহান জাতিতে পরিনত করব।”
অতঃপর ঈশ্বর তাঁর চোখ খুলে দিলেন এবং তিনি পানির এক কূপ [জমজম কূপ] দেখতে পেলেন। তিনি সেদিকে গেলেন, চামড়ার থলে পানি দিয়ে ভর্তি করলেন এবং বাচ্চাটিকে পানি খাওয়ালেন।ঈশ্বর সেই ছেলেটির সাথে ছিলেন, এবং সে আস্তে আস্তে বড় হল। সে মরুভূমিতে বাস করতে লাগলো এবং একজন তীরন্দাজ হল।সে পারানের মরুভূমিতে থাকতো এবং তার মা মিশরের একটি মেয়ের সাথে তার বিয়ে দিলেন।”
(বাইবেল, আদিপুস্তক(Genesis) ২১:১৩-২১)
কিন্তু ইহুদি-খ্রিষ্টানদের আদিপুস্তক(Genesis) এর বর্ণণায় এখানে একটা বড়সড় সমস্যা আছে। ২১নং অধ্যায়ে পরিষ্কার বলা হচ্ছে যে ইসমাঈল(আ)কে মরুভূমিতে রেখে আসার সময়ে তিনি এক ছোট শিশু ছিলেন। ঠিক যেভাবে রাসুল(স) এর হাদিসে বলা হয়েছে।
কিন্ত,একটু আগেই,ঐ একই অধ্যায়ে[আদিপুস্তক ২১:৫-১১] বলা হচ্ছে—ইসমাঈল(আ)কে মরুভূমিতে রেখে আসার কারণ ছিল তিনি ইসহাক(আ)কে ভেঙিয়েছিলেন! এ কী করে সম্ভব, যে ছেলে একটা কাউকে ভেঙানোর মত বড়, এক অধ্যায় পরেই সেই ছেলেটি একটি দুধের শিশুতে পরিনত হয় যে পানির জন্য কাঁদে??
“ইসহাকের যখন জন্ম হয়, তখন আব্রাহামের[ইব্রাহিম(আ)] বয়স ১০০বছর। সারা বললেন, “ঈশ্বর আমার মুখে হাসি ফিরিয়ে দিলেন। আর যে এ খবর শুনবে, সেও হাসবে।”
তিনি আরো বললেন, “আব্রাহামকে কেই বা বলতে পেরেছিল যে সারা একসময় বাচ্চা লালনপালন করবে? তারপরেও আমি বৃদ্ধা বয়সে তাঁকে একটা সন্তান এনে দিলাম।”
বাচ্চাটি বড় হল এবং দুধ খাওয়া ছাড়ল। আর যেদিন ইসহাক দুধ খাওয়া ছাড়ল, সেদিন আব্রাহাম এক বিশাল ভোজের আয়োজন করলেন।
কিন্তু সারা লক্ষ্য করলেন যে, আব্রাহামের মিশরীয় দাসীর ছেলেটি[ইসমাঈল(আ)] ভেঙচি কাটছিলো।
সারা আব্রাহামকে বললেন, “ঐ দাসী আর তার ছেলেটাকে বের করে দাও।কারণ দাসীর ছেলে আমার ছেলে ইসহাকের উত্তরাধিকারের অংশীদার হতে পারে না।”
(আদিপুস্তক(Genesis) ২১:৫-১২)
বাইবেলের বর্ণণামতে ইসমাঈল(আ) ছিলেন ছোট ভাই ইসহাক(আ) এর চেয়ে ১৪ বছরের বড় [দেখুন আদিপুস্তক ১৬:১৬ ও ২১:৫]। ইসহাক(আ)এর দুধ ছাড়াতে ২ বছর লাগার কথা। সেই হিসাবে ইসহাক(আ) এর দুধ ছাড়ানোর ভোজসভার সময়ে ইসমাঈল(আ) এর বয়স ছিল ১৪+২=১৬ বছর। বাইবেলের বর্ণণামতে, ১৬ বছরের ছেলেটিকে ভেংচি কাটার জন্য তার মা-সহ ইব্রাহিম(আ) বের করে দিয়েছিলেন। অথচ বের করে দেবার পরেই আদিপুস্তক(Genesis) ২১:১৩-২১ এর বর্ণণায় ইসমাঈল(আ) দুধের শিশু হয়ে গেলেন!!!
এর অর্থ হচ্ছে—ইসমাঈল(আ) কর্তৃক ভেংচি কাটার ঘটনাটি একটি বানোয়াট ঘটনা। এই ঘটনার কারণেই বাইবেলে এত বড় স্ববিরোধিতা দেখা দিচ্ছে।
মুহাম্মাদ(স) এর হাদিস এবং আদিপুস্তক(Genesis) ২১:১৩-২১ উভয়ের বর্ণণা অনুযায়ী বের করে দেবার সময়ে ইসমাঈল(আ) ছিলেন শিশু। কুরআনের বর্ণণা অনুযায়ী—ইসহাক(আ) এর জন্মের সুসংবাদ দেওয়ারও আগে ইসমাঈল(আ)কে কুরবানী দিতে নিয়ে যাবার ঘটনা ঘটেছিল [দেখুন সুরা আস সফফাত ৩৭:৯৯-১১২]।এর মানে ইসমাঈল(আ)কে মরুভূমিতে রেখে আসার ঘটনাটাও ঘটেছিল ইসহাক(আ) এর জন্মেরও বহু আগে। কাজেই ইসমাঈল(আ) কর্তৃক ইসহাক(আ) এর ভোজসভায় ভেংচি কাটার ঘটনা ঘটবার প্রশ্নই আসে না।
বাইবেলের বর্ণণায়ও দেখা যায় যে ইব্রাহিম(আ)কে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল তাঁর একমাত্র পুত্রকে কুরবানী দিতে নিয়ে যাবার জন্য [দেখুন আদিপুস্তক ২২:২], অথচ নামের জায়গায় ইসহাক(আ) এর নাম। ইসহাক(আ) কখনোই ইব্রাহিম(আ) এর একমাত্র পুত্র ছিলেন না কারণ তিনি ছিলেন তাঁর ২য় ছেলে। কেবলমাত্র বড় ছেলে ইসমাঈল(আ) এরই ইব্রাহিম(আ) এর “একমাত্র পুত্র” হওয়া সম্ভব। ইসহাক(আ) এর জন্মের আগ পর্যন্ত ১৪ বছর ধরে তিনিই ছিলেন ইব্রাহিম(আ) এর “একমাত্র পুত্র”।
প্রকৃতপক্ষে ঝামেলাটা আছে ইহুদি-খ্রিষ্টানদের গ্রন্থে। ইহুদিরা এই ঘটনায় ইসমাঈল(আ) ও ইসহাক(আ) এর নাম অদলবদল করতে গিয়ে ফ্যাকরাটা বাঁধিয়েছে। ইহুদিরা চেয়েছিল কুরবানীর ঘটনায় ইসমাঈল(আ) এর নাম বদলে ইসহাক(আ) এর নাম বসানোর কারণ ইসহাক(আ) তাদের পূর্বপুরুষ। এই কুকাজটা করতে গিয়ে তাদের কিতাবে এই হাস্যকর বৈপরিত্য বা স্ববিরোধিতা দেখা দিয়েছে।
কাজেই আমরা দেখতে পাচ্ছি যে—কুরআন ও হাদিসের বর্ণণায় কোন বৈপরিত্য বা ঝামেলা নেই।বরং ইহুদি-খ্রিষ্টানদের ধর্মগ্রন্থ তানাখ ও বাইবেলে ইসমাঈল(আ) ও ইসহাক(আ) এর নাম অদল-বদল করে ইসমাঈল(আ)কে কুরবানীর ঘটনা থেকে সরানো এবং ইসমাঈল(আ) এর নামে একটি বানোয়াট ঘটনা অন্তর্ভুক্ত করবার কারণেই তাদের গ্রন্থে এই সমস্যা দেখা দিয়েছে।
কুরআন ও হাদিসের বর্ণণা মেনে নিলে আর এই সমস্যা থাকে না বরং ব্যাপারগুলো খাপে খাপে বসে যায়। অথচ নাস্তিক-মুক্তমনারা অন্ধভাবে ইহুদি-খ্রিষ্টানদের গ্রন্থের বিবরণের উপরেই নির্ভর করে, শুধুমাত্র ইসলামকে ভুল প্রমাণ করার জন্য। অথচ এ দ্বারা তাদের নিজেদের ভুল অবস্থান তো প্রমাণ হলই, ইহুদি-খ্রিষ্টানদের ধর্মগ্রন্থের বিকৃতিও প্রমাণ হল।আমরা মুসলিমগণ আল্লাহর প্রেরিত পুরুষদের মধ্যে পার্থক্য করি না[সেখুন সুরা বাকারাহ ২:২৮৫], আমরা সকল নবী-রাসুলকেই বিশ্বাস করি ও ভালোবাসি।কুরআন-হাদিসে যদি বলা হত ইসহাক(আ) জবিহুল্লাহ, তাহলে আমরা নির্দ্বিধায় তা মেনে নিতাম।ইসমাঈল(আ) ও ইসহাক(আ) উভয়কেই আমরা ভালোবাসি।কিন্তু ব্যাপার হচ্ছে কুরআন-সুন্নাহ এবং বাইবেল সকল সূত্র থেকেই এটা প্রমাণিত যে ইসমাঈল(আ)ই জবিহুল্লাহ। আল্লাহ মুসলিম উম্মাহকে ষড়যন্ত্রমূলক অপপ্রচার থেকে রক্ষা করুন।
এই বিষয়টি নিয়ে গত বছর ঈদুল আযহার দিন ইস্রায়েলী ইহুদি পণ্ডিত বেন আব্রাহামসনের সঙ্গে আমার অনলাইনে ডিবেট হয়েছিল। সেই ডিবেটে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছিল।ডিবেটের আলোচনা দেখতে পারেন এই নোটেঃgoo.gl/aqb2jk
এ ছাড়া এই টপিকে খন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর(র) এর একটি অসাধারণ বই আছেঃ— “তাওরাত, যাবুর, ইঞ্জিল ও কুরআনের আলোকে কুরবানী ও জাবীহুল্লাহ”। বইটির ডাউনলোড লিঙ্কঃ https://goo.gl/PV414o
মাওলানা মুহাম্মাদ যাকারিয়া আব্দুল্লাহ কোনো প্রাণীর-মূর্তি নির্মাণ করা ইসলামী শরীয়তে কঠিন কবীরা গুনাহ ও হারাম । মূর্তি সংগ্রহ, মূর্তি সংরক্ষণ এবং মূর্তির বেচাকেনা ইত্যাদি সকল বিষয় কঠিনভাবে নিষিদ্ধ। মূর্তিপূজার কথা তো বলাই বাহুল্য, মূর্তি নির্মাণেরও কিছু কিছু পর্যায় এমন রয়েছে যা কুফরী।
কেউ কেউ মূর্তি ও ভাস্কর্যের মধ্যে বিধানগত পার্থক্য দেখাতে চান। এটা চরম ভুল। ইসলামের দৃষ্টিতে মূর্তি ও ভাস্কর্য দুটোই পরিত্যাজ্য। কুরআন মজীদ ও হাদীস শরীফে এ প্রসঙ্গে যে শব্দগুলো ব্যবহৃত হয়েছে সেগুলো মূর্তি ও ভাস্কর্য দুটোকেই নির্দেশ করে। এ প্রসঙ্গে কুরআন মজীদের স্পষ্ট নির্দেশ-
‘তোমরা পরিহার কর অপবিত্র বস্ত্ত অর্থাৎ মূর্তিসমূহ এবং পরিহার কর মিথ্যাকথন।’ -সূরা হজ্জ : ৩০
এই আয়াতে পরিস্কারভাবে সবধরনের মূর্তি পরিত্যাগ করার এবং মূর্তিকেন্দ্রিক সকল কর্মকান্ড বর্জন করার আদেশ দেওয়া হয়েছে।
আরো লক্ষণীয় বিষয় এই যে. উপরের আয়াতে সকল ধরনের মূর্তিকে ‘রিজস’ শব্দে উল্লেখ করা হয়েছে। ‘রিজ্স’ অর্থ নোংরা ও অপবিত্র বস্ত্ত। বোঝা যাচ্ছে যে, মূর্তির সংশ্রব পরিহার করা পরিচ্ছন্ন ও পরিশীলিত রুচিবোধের পরিচায়ক।
দ্বিতীয় আয়াত
অন্য আয়াতে কাফের সম্প্রদায়ের অবস্থা তুলে ধরা হয়েছে এভাবে-
‘এবং তারা বলেছিল, তোমরা কখনো পরিত্যাগ করো না তোমাদের উপাস্যদেরকে এবং কখনো পরিত্যাগ করো না ওয়াদ্দ, সুওয়া, ইয়াগূছ, ইয়াঊক ও নাসরকে।’ -সূরা নূহ : ২৩
এখানে কাফের সম্প্রদায়ের দুটো বৈশিষ্ট্য উল্লেখিত হয়েছে : ১. মিথ্যা উপাস্যদের পরিত্যাগ না করা। ২. মূর্তি ও ভাস্কর্য পরিহার না করা। তাহলে মিথ্যা উপাস্যের উপাসনার মতো ভাস্কর্যপ্রীতিও কুরআন মজীদে কাফেরদের বৈশিষ্ট্য হিসেবে চিহ্নিত। অতএব এটা যে ইসলামে গর্হিত ও পরিত্যাজ্য তা তো বলাই বাহুল্য।
উপরের আয়াতে উল্লেখিত মূর্তিগুলো সম্পর্কে আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা. বলেন, এগুলো হচ্ছে নূহ আ.-এর সম্প্রদায়ের কিছু পুণ্যবান লোকের নাম। তারা যখন মৃত্যুবরণ করেছে তখন শয়তান তাদের সম্প্রদায়কে এই কুমন্ত্রনা দিয়েছে যে, তাদের স্মৃতি বিজড়িত স্থানগুলোতে মূর্তি স্থাপন করা হোক এবং তাদের নামে সেগুলোকে নামকরণ করা হোক। লোকেরা এমনই করল। ওই প্রজন্ম যদিও এই সব মূর্তির পূজা করেনি কিন্তু ধীরে ধীরে প্রকৃত বিষয় অস্পষ্ট হয়ে গেল এবং পরবর্তী প্রজন্ম তাদের পূজায় লিপ্ত হল। -সহীহ বুখারী হাদীস : ৪৯২০
‘আর তারা বলেছিল, তোমরা পরিত্যাগ করো না তোমাদের উপাস্যদের এবং পরিত্যাগ করো না ওয়াদ্দ সুওয়াকে, ইয়াগূছ, ইয়াঊক ও নাসরকে। অথচ এগুলো অনেককে পথভ্রষ্ট করেছে।’ -সূরা নূহ : ২৩-২৪
কুরআন মজীদে একটি বস্ত্তকে ভ্রষ্টতার কারণ হিসেবে চিহ্ণিত করা হবে এরপর ইসলামী শরীয়তে তা বৈধ ও গ্রহণযোগ্য থাকবে-এর চেয়ে হাস্যকর কথা আর কী হতে পারে।
চতুর্থ আয়াত
কুরআনের ভাষায় মূর্তি ও ভাস্কর্য হল বহুবিধ মিথ্যার উৎস। ইরশাদ হয়েছে-
তোমরা তো আল্লাহর পরিবর্তে উপাসনা কর (অসার) মূর্তির এবং তোমরা নির্মাণ কর ‘মিথ্যা’। -সূরা আনকাবুত : ১৭
মূর্তি ও ভাস্কর্য যেহেতু অসংখ্য মিথ্যার উদ্ভব ও বিকাশের উৎস তাই উপরের আয়াতে একে ‘মিথ্যা’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
এই আয়াতগুলো থেকে পরিষ্কার জানা যাচ্ছে যে, মূর্তি ও ভাস্কর্য দুটোই সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাজ্য।
হাদীস শরীফেও নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মূর্তি ও ভাস্কর্য সম্পর্কে পরিষ্কার বিধান দান করেছেন।
১.
হযরত আমর ইবনে আবাসা রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন ‘আল্লাহ তাআলা আমাকে প্রেরণ করেছেন আত্মীয়তার সর্ম্পক বজায় রাখার, মূর্তিসমূহ ভেঙ্গে ফেলার, এবং এক আল্লাহর ইবাদত করার ও তাঁর সঙ্গে অন্য কোনো কিছুকে শরীক না করার বিধান দিয়ে। -সহীহ মুসলিম হা. ৮৩২
২.
আবুল হাইয়াজ আসাদী বলেন, আলী ইবনে আবী তালেব রা. আমাকে বললেন, ‘আমি কি তোমাকে ওই কাজের দায়িত্ব দিয়ে প্রেরণ করব না, যে কাজের জন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে প্রেরণ করেছিলেন? তা এই যে, তুমি সকল প্রাণীর মূর্তি বিলুপ্ত করবে এবং সকল সমাধি-সৌধ ভূমিসাৎ করে দিবে।’ অন্য বর্ণনায় এসেছে,… এবং সকল চিত্র মুছে ফেলবে।’ -সহীহ মুসলিম হা. ৯৬৯
৩.
আলী ইবনে আবী তালেব রা. বলেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি জানাযায় উপস্থিত ছিলেন। তখন তিনি বললেন, ‘তোমাদের মধ্যে কে আছে, যে মদীনায় যাবে এবং যেখানেই কোনো প্রাণীর মূর্তি পাবে তা ভেঙ্গে ফেলবে, যেখানেই কোনো সমাধি-সৌধ পাবে তা ভূমিসাৎ করে দিবে এবং যেখানেই কোনো চিত্র পাবে তা মুছে দিবে?’ আলী রা. এই দায়িত্ব পালনের জন্য প্রস্ত্তত হলেন। এরপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে কেউ পুনরায় উপরোক্ত কোনো কিছু তৈরী করতে প্রবৃত্ত হবে সে মুহাম্মাদের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রতি নাযিলকৃত দ্বীনকে অস্বীকারকারী।’ -মুসনাদে আহমাদ হা. ৬৫৭
এই হাদীসগুলো থেকে স্পষ্ট জানা যাচ্ছে যে, যে কোনো প্রাণী মূর্তিই ইসলামে পরিত্যাজ্য এবং তা বিলুপ্ত করাই হল ইসলামের বিধান। আর এগুলো নির্মাণ করা ইসলামকে অস্বীকারকারী সম্প্রদায়ের বৈশিষ্ট্য।
প্রতিকৃতি তৈরিকারী (ভাস্কর, চিত্রকর) শ্রেণী হল ওইসব লোকদের অন্তর্ভুক্ত যাদেরকে কিয়ামত-দিবসে সবচেয়ে কঠিন শাস্তি প্রদান করা হবে।’ -সহীহ বুখারী হা. ৫৯৫০
৫.
আবু হুরায়রা রা. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন, আল্লাহ তাআলা বলেন-
ওই লোকের চেয়ে বড় জালেম আর কে যে আমার সৃষ্টির মতো সৃষ্টি করার ইচ্ছা করে। তাদের যদি সামর্থ্য থাকে তবে তারা সৃজন করুক একটি কণা এবং একটি শষ্য কিংবা একটি যব! -সহীহ বুখারী হা. ৫৯৫৩
এই হাদীসটি বর্তমান সময়ের জন্য অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক, যখন ভাস্কর-চিত্রকর, এমনকি গল্পকার ও ঔপন্যাসিকদেরকে পর্যন্ত ‘স্রষ্টা’ বলতে এবং তাদের কর্মকান্ডকে ‘সৃষ্টি’ বলতে সামান্যতমও দ্বিধাবোধ করা হয় না। কোনো কোনো আলোচকের আলোচনা থেকে এতটা ঔদ্ধত্যও প্রকাশিত হয় যে, যেন তারা সত্যি সত্যিই স্রষ্টার আসনে আসীন হয়ে গিয়েছেন!
সহীহ বুখারীর বিখ্যাত ভাষ্যকার হাফেয ইবনে হাজার আসকানী রাহ. লেখেন- এই ভাস্কর ও চিত্রকর সর্বাবস্থাতেই হারাম কাজের মধ্যে লিপ্ত। আর যে এমন কিছু নির্মাণ করে যার পূজা করা হয় তার পরিণাম অত্যন্ত ভয়াবহ। আর যে স্রষ্টার সামঞ্জস্য গ্রহণের মানসিকতা পোষণ করে সে কাফের ।’ -ফতহুল বারী ১০/৩৯৭
৬.
উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা. ও আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-
এই প্রতিকৃতি নির্মাতাদের (ভাস্কর, চিত্রকরদের) কিয়ামত-দিবসে আযাবে নিক্ষেপ করা হবে এবং তাদেরকে সম্বোধন করে বলা হবে, যা তোমরা ‘সৃষ্টি’ করেছিলে তাতে প্রাণসঞ্চার কর!’
-সহীহ বুখারী হা. ৭৫৫৭, ৭৫৫৮;
৭.
আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস রা. বলেন, আমি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, ‘যে কেউ দুনিয়াতে কোনো প্রতিকৃতি তৈরি করে কিয়ামত-দিবসে তাকে আদেশ করা হবে সে যেন তাতে প্রাণসঞ্চার করে অথচ সে তা করতে সক্ষম হবে না।’ -সহীহ বুখারী হা. ৫৯৬৩
৮.
আউন ইবনে আবু জুহাইফা তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সুদ ভক্ষণকারী ও সুদ প্রদানকারী, উল্কি অঙ্কণকারী ও উল্কি গ্রহণকারী এবং প্রতিকৃতি প্রস্ত্ততকারীদের (ভাস্কর, চিত্রকরদের) উপর লানত করেছেন। -সহীহ বুখারী হা. ৫৯৬২
এই হাদীসগুলো থেকে প্রমাণিত হয় যে,ভাস্কর্য নির্মাণ অত্যন্ত কঠিন কবীরা গুনাহ। আর কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা কুফরীরও পর্যায়ে পৌঁছে যায়।
মূর্তি ও ভাস্কর্যের বেচাকেনাও হাদীস শরীফে সম্পূর্ণ হারাম সাব্যস্ত করা হয়েছে।
৯.
হযরত জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ রা. বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা বিজয়ের সময় মক্কায় থাকা অবস্থায় এই ঘোষণা দিয়েছেন যে, আল্লাহ ও তার রাসূল মদ ও মূর্তি এবং শুকর ও মৃত প্রাণী বিক্রি করা হারাম করেছেন।’ -সহীহ বুখারী হা. ২২৩৬
১০.
উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা. বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অসুস্থতার সময় তাঁর জনৈকা স্ত্রী একটি গির্জার কথা উল্লেখ করলেন। গির্জাটির নাম ছিল মারিয়া। উম্মে সালামা ও উম্মে হাবীবা ইতোপূর্বে হাবাশায় গিয়েছিলেন। তারা গির্জাটির কারুকাজ ও তাতে বিদ্যমান প্রতিকৃতিসমূহের কথা আলোচনা করলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শয্যা থেকে মাথা তুলে বললেন, ওই জাতির কোনো পুণ্যবান লোক যখন মারা যেত তখন তারা তার কবরের উপর ইবাদতখানা নির্মাণ করত এবং তাতে প্রতিকৃতি স্থাপন করত। এরা হচ্ছে আল্লাহর নিকৃষ্টতম সৃষ্টি।’-সহীহ বুখারী হা. ১৩৪১ সহীহ মুসলিম হা. ৫২৮ নাসায়ী হা. ৭০৪
১১.
আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস রা. বলেন, ‘(ফতহে মক্কার সময়) নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন বায়তুল্লাহয় বিভিন্ন প্রতিকৃতি দেখলেন তখন তা মুছে ফেলার আদেশ দিলেন। প্রতিকৃতিগুলো মুছে ফেলার আগ পর্যন্ত তিনি তাতে প্রবেশ করেননি।’ -সহীহ বুখারী হা. ৩৩৫২
দৃষ্টান্তস্বরূপ এগারোটি হাদীস পেশ করা হল। আলোচিত প্রসঙ্গে ইসলামী বিধান বোঝার জন্য এটুকুই যথেষ্ট। কুরআন মজীদে যে কোনো ধরনের মূর্তির সংশ্রব ও সংশ্লিষ্টতা পরিহারের যে আদেশ মুমিনদেরকে করা হয়েছে সে সম্পর্কে একটা বিস্তারিত ধারণাও উপরোক্ত হাদীসগুলো থেকে জানা গেল।
কুরআন ও সুন্নাহর এই সুস্পষ্ট বিধানের কারণে মূর্তি বা ভাস্কর্য নির্মাণ, সংগ্রহ, সংরক্ষণ ইত্যাদি সকল বিষয়ের অবৈধতার উপর গোটা মুসলিম উম্মাহর ইজমা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
আদনান ফয়সাল: এক লোক রাসূলুল্লাহ(সা) এর কাছে এসে বলল, “আমাকে তিলাওয়াত করা শিখান (অর্থাৎ সূরা শিখান), হে আল্লাহর রাসূল”। রাসূলুল্লাহ(সা) বললেন, “তুমি সেই তিনটা সূরা তিলাওয়াত করো যেগুলো আলিফ-লাম-রা দিয়ে শুরু”।
লোকটা বলল, “আমার বয়স হয়েছে। আমার হৃদয় কঠিন হয়ে গেছে আর জিহবা ভারী হয়ে গেছে।”
উনি(সা) বললেন, “তাহলে ঐ তিনটা পড়ো যা হা-মীম দিয়ে শুরু।”
লোকটা একইভাবে বলল – এটাও কঠিন।
উনি(সা) বললেন, “তবে সেই তিনটা পড়ো যেগুলো আল্লাহর পবিত্রতা বর্ণনা করে শুরু হয়।”
লোকটা একইভাবে বলল – এটাও কঠিন। সে যোগ করল, “হে রাসূলুল্লাহ(সা), আমাকে এমন একটি সূরা শিখিয়ে দিন যেটা সবকিছু কাভার করে (comprehensive), আমি ওটা পড়ব।”
নবী (সা) তিলাওয়াত করলেন – “ইযা- যুলযিলাতিল আরদু যিলযা-লাহা ”। এভাবে তিনি সূরা যিলযাল এর শেষ পর্যন্ত পড়লেন।
লোকটা বলল, “সেই সত্তার কসম যিনি আপনাকে সত্যসহ পাঠিয়েছেন, আমি এর সাথে সারাজীবনে আর কিছুই যোগ করব না (অর্থাৎ এই সূরায় যা আছে আমি শুধু তার উপরই আমল করব)” – এই বলে সে চলে গেল।
আল্লাহর রাসূল (সা) দুইবার বললেন, “ছোট মানুষটি সফল হয়েছে”।
– (আবু দাউদ ১৩৯৯, সাহিহ (আহমেদ শাকির), আব্দুল্লাহ ইবনে আমর(রা) হতে বর্ণিত)
হাদিসের শিক্ষা:
১) রাসূলুল্লাহ(সা) কতটা নন-জাজমেন্টাল ছিলেন তা লক্ষ্য করলে অবাক হতে হয়। লোকটা যতবারই রাসূলুল্লাহ(সা) কে বলেছে – এটা আমার জন্য কঠিন হয়ে যাচ্ছে, তিনি ততবারই তার জন্য তার কাজকে সহজ করে দিয়েছেন। একবারের জন্যও তিনি বলেন নাই – “এমনি এমনি বেহেস্তে যেতে চাও? এইটুকু করতে পারবা না?”, অথবা – “এটুক তো তোমার করতে পারা উচিত” – না, তিনি এরকম বলেন নাই। তিনি লোকটিকে বিশ্বাস করেছেন। যখন সে বলছে সে পারবে না, সে কেন পারবে না, তার পারা উচিত কিনা, এটা করতে পারলে সে অনেক সাওয়াব হাসিল করতে পারতো – এসব কোন কথার মধ্যেই তিনি যাননি। আমরা মানুষের প্রতি যত নন-জাজমেনটাল হব – মানুষ তত আমাদের কাছে আসবে। অন্য মানুষকে আমরা যেন বিশ্বাস করি – ধর্মীয় কাজে এবং দৈনন্দিন কাজেও। চাপাচাপি, জোরাজুরি না করি, “তোমার এটা করা উচিত, ওটা করা উচিত” – যত কম বলা যায় তত ভাল।
২) কেউ যদি কঠিন নিয়ম পালন না করে সহজ নিয়ম পালন করে, তাকে নিয়ে উপহাস না করি। সূরা বাকারা পড়েও অনেকে মুনাফিক থেকে গেছে, আর শুধু সূরা যিলযাল পড়েও এই ব্যক্তি সফল হয়েছে।
৩) মনে করুন, আপনার বস এসে আপনাকে বলল – তোমাকে অমুক কাজটা করতে হবে। আপনি বললেন, স্যার আমি এটা করতে পারব না, অন্য একটা কাজ দেন। বস বললেন, আচ্ছা তাহলে ঐটা করো। আপনি কি এইবারও বলতে পারবেন – না স্যার, ঐটাও পারবো না। খুব সম্ভবত পারবেন না। ‘না’ বলতে আপনার মনে ভয় কাজ করবে। কারণ, আমরা আমাদের বসদের, নেতাদের ভয় পাই। কিন্তু, আল্লাহর রাসূলের (সা) ব্যাপারটা দেখুন। তিনি তাঁর অনুসারীদের মনে এমন একটা মানসিক অবস্থার সৃষ্টি করেছিলেন – যে সবাই তাকে গভীরভাবে ভালবাসত, সম্মান করত, কিন্তু ভয়ে কম্পমান থাকত না। তারা নিঃসংকোচে রাসূলুল্লাহ(সা) এর কাছে সব বলতে পারত। তারা জানত – রাসূলুল্লাহ(সা) অন্যকে এই ব্যাপারে বলে বেড়াবেন না, তিনি জাজ করবেন না, ভুল কিছু বললে ক্ষমা করে দিবেন, এই কথার উপর ভিত্তি করে পরে প্রতিশোধ নিবেন না। এরকম গুনময় যে নেতা – তার অনুসরণ করতে কে না চায়?
৪) স্কলারেরা আলোচনা করেছেন – এত সূরা থাকতে রাসূলুল্লাহ(সা) লোকটাকে সূরা যিলযাল পড়তে বললেন কেন? কি এমন আছে এই সূরাতে যা ইসলামের আদ্যোপান্তকে কাভার করে? বেশীরভাগ স্কলার বলেছেন – এই সূরার মাহাত্ম্য এর শেষের দুই আয়াতে, যেখানে বিচার দিবস সম্পর্কে বলা হয়েছে –
“সুতরাং কেউ অণু পরিমাণ ভালো কাজ করলে সে তা দেখতে পাবে। এবং কেউ অনু পরিমাণ খারাপ কাজ করলেও তা দেখতে পাবে।” (সূরা যিলযাল ৭-৮)
বিচার দিবসের দিনে যেটাকে ভালো কাজ হিসাবে ধরা হবে সেটাই ভালো কাজ, আর সেদিন যেটাকে মন্দ কাজ হিসাবে ধরা হবে সেটাই মন্দ কাজ।
এই দুই আয়াতে অণু পরিমাণ হলেও ভালো কাজ করার কথা বলা হয়েছে আর অণু পরিমান মন্দ কাজেও না জড়ানোর কথা বলা হয়েছে – আর এটাই ইসলাম। আমরা বিশাল বিশাল কাজের কথা চিন্তা করে ঘাবড়ে যাই, হতাশ হয়ে পড়ি, হাল ছেড়ে দেই, শেষে আর কিছুই করি না। তাই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছেন ছোট কাজগুলোর কথা। রামাদানে অমুক ভাই দিনে এক পারা কুরআন পড়ে – আয় হায় আমি কি করলাম? ঠিক আছে, এক পারা না পারি – এক রুকু পড়ি, এক রুকু না পারি – একটা আয়াত তো পড়তে পারি। অমুকে তো ৫০ হাজার টাকা দান করে দিল, আচ্ছা আমি ৫০ হাজার না পারি ৫০০ টাকা করি, ৫০০ না পারলে ৫ টাকা তো পারি, তা-ও না পারলে মনে মনে আফসোস করি – ইশশ আমার অন্তরটা যদি ওর মতো সুন্দর হতো, আমিও যদি প্রাণ খুলে দান করতে পারতাম!
ছোট ভাল কাজ গুলোর গুরুত্ব মোটেও কম নয়। ছোট খারাপ কাজগুলোর ব্যাড-ইফেক্টও কম নয়। প্রতি মুহুর্তে মাথায় এটা রাখি, তাহলেই সফলতা আসবে।